#অপ্রিয়_তুমি
#পর্ব১৯
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
রাতের আকাশে এক জটলা কালো মেঘ দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কালো মেঘেদের আনাগোনায় চন্দ্র ততক্ষণে নিজেকে আড়াল করে ফেলেছে। কালো আঁধার সাথে কৃষ্ণ বর্ণ মেঘেদের ভিড়ে চন্দ্র হারিয়েছে নিজের উজ্জ্বলতা, নিজের স্থায়ীত্ত। চন্দ্রের কিরণও আজ সকল আঁধার কে কাটিয়ে উঠতে পারছে না। সকল শত্রু যখন এক জোট হয়ে বাসা বাধে তখন প্রতি পক্ষের কিছুই করার থাকে না। নিরুপয়ের মতো চেয়ে দেখা ছাড়া। সত্যিই কি কিছু করার থাকে না? নাকি চাইলেই সকল বাধা বিপত্তি পেরিয়ে আসা যায়? উৎসা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। মনের ভিতরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। মনের কোণে জমেছে এক রাশ ঘৃ*ণা। মেহরাব এতটা খারাপ? উৎসা জানতো ছেলেটা মা*রা*মা*রি করে, গু*ন্ডামি করে বেড়ায় তাই বলে খু*নি? মেহরাব ওর সাথে কেন করলো এমনটা? উৎসা তো ওর কোনো ক্ষতি করে নি! তাহলে কেন করলো এমনটা? এতগুলো মানুষের সামনে ওর বাবার মান সন্মান কেন ধুলায় মেশালো? কেনোই বা এতো বড় নাটক সাজালো। এর পিছনের কারণ কি? উৎসার জানা মতে এমন কোনো কারণ নেই যার জন্য মেহরাব এমন ঘটনা ঘটাতে পারে। নিজেই রিয়াদকে কিডন্যাপ করে নিজেই হিরো সেজে উৎসাকে বিয়ে করছে। উৎসার প্রতি এতো দয়া তাকে কে দেখাতে বলছে? উৎসার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ইমন নামের ছেলেটার কথা। মেহরাব কিভাবে পারলো একটা মানুষকে প্রাণে মে*রে ফেলতে? ওর কি একটাবারের জন্য বুক কাপেনি? কোনো মায়ের বুক খালি করতে বিবেকে বাঁধেনি? কতোটা নৃ*শং*স, ভ*য়ংক*র মানুষটা ভেবেই উৎসার গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। কই কখনো তো উৎসার ওকে দেখে এমনটা মনে হয়নি। শেষ মেষ কিনা একটা খু*নি জুটলো উৎসার কপালে? এতো খারাপ কি ওর সাথেই হওয়ার ছিলো? কই উৎসা তো কখনো কারো ক্ষতি করেনি তাহলে ওর সাথে কেন এমন হলো। বেচারির মাথায় জেঁকে বসেছে এক রাশ প্রশ্নের ঝুলি। উৎসার ভাবনার মাঝে ঘরে প্রবেশ করলো কেউ। উৎসা সেদিকে পাত্তাও দিলো না। ও ভালো করেই জানে মেহরাব এসেছে। এ ছাড়া অন্য কেউ এতো রাতে রুমে আসবে না। উৎসা গম্ভীর হলো। কাঠিন্য মুড়িয়ে নিলো নিজেকে। আজকে মেহরাবকে ওর সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। কেন ও এমনটা করলো? কি ক্ষতি করেছে উৎসা ওর? কেন ওর জীবনটা নিয়ে এমন ছিনি মিনি খেলল? কোনোই বা তার হিরোগিরি দেখানো? মেহরাব ক্লান্ত পায়ে রুমে ঢুকেই আশেপাশে উৎসাকে খুজলো। রুমে না পেয়ে ওয়াশরুমে খুজলো তাও না পেয়ে ডাকা শুরু করলো,
“বউ, ও বউ কোথায় তুমি? এদিকে এসো”
উৎসা শুনেও জবাব দিলো না। মেহরাব ডেকেও উৎসার জবাব না পেয়ে হাতে থাকা কোট বিছানায় ছুড়ে ফেলে দিলো। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে এগিয়ে গেল ব্যালকনিতে। উৎসাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন ছুড়লো,
“তুমি এখানে? আমি ডাকছি সারা দিচ্ছ না কেন?”
উৎসা উত্তর দিলো না। মেহরাব কাছে এগিয়ে আসলো। উৎসার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুলো ঠিক দেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে বলতে লাগলো,
“বাহ্ আজকে আমার বউটা দেখি ভালো হয়ে গেছে। কোনো কথা ছাড়াই একা একা চলে এসেছে। তুমি আমাকে আগে বলবে না তুমি চলে আসবে তাহলে আমি সোজা তোমার কাছে চলে আসতাম। আমায় এতটা ঘুরতে হতো না”
উৎসা এবারও জবাব করলো না। চুপচাপ সরে গেল। মেহরাব ওকে চুপ থাকতে দেখে নিজেই বলল,
“কাহিনী কি বউ? আজ এতো ভালো হয়ে গেলে যে? জামাইয়ের প্রতি ভালোবাসা জেগে উঠলো নাকি? আজ আমার বলার আগেই চলে এলে? প্রতিদিন তো ব্ল্যাক মেইল করে আনতে হয়। তাহলে আজকে একা একাই চলে এলে যে? আর আমি না তোমাকে বলেছি একা একা বের হবে না আমি এসে নিয়ে যাবো!”
উৎসা তাও জবাব দিলো না। মেহরাবের এবার খটকা লাগলো। উৎসার আরো কাছে এসে জড়িয়ে ধরতে নিয়ে বলল,
“কি বেপার বউ? এমন রেগে বম হয়ে আছো কেন? সকাল থেকে এই পর্যন্ত চুমু না পেয়ে এভাবে কেউ রাগ দেখায়? সোজাসুজি বললেই তো হয়। কাছে এসো ঝটপট চারটে চুমু দিচ্ছি তাও রাগ করে থাকে না বউ”
মেহরাব জড়িয়ে ধরতে নিলে উৎসা ওকে আটকে দেয়। হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“ব্যাস! কাছে আসবেন না আমার। আপনি ঐ অপবিত্র হাত দিয়ে ছোবেন না আমায়। আপনি একটা খু*নি মিস্টার মেহরাব। হিংস্র জা*নো*য়ারের চেয়েও বেশি হিং*স্র আপনি। আপনি একটা খু*নি, খু*নি আপনি। আমার থেকে দূরে থাকুন আপনি, প্লিজ”
মেহরাব থমকে গেল উৎসার কথা শুনে। ও রীতিমতো অবাক হয়েছে। টাস্কি খেয়ে বেচারা ধপ করে বসে পড়লো পাশে রাখা চেয়ারে। উৎসা এসব কি বলছে? ও আবার কাকে খু*ন করলো?
“কি বললে? আমি খু*নি? কাকে খু*ন করেছি আমি?”
উৎসা হা হা করে হেসে ফেলল। হাত তালি দিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
“বাহ মিস্টার মেহরাব মির্জা আপনি তো ভালোই এক্টিং করতে পারেন! প্রফেশনাল এক্টর নাকি?”
“হেয়ালি করো না উৎসা। আগে বলো আমি কাকে খু*ন করেছি?”
উৎসা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
“কেন ভুলে গেলেন ইমন নামের ছেলেটার কথা?”
মেহরাব উৎসার কথার মানে বুঝতে না পেরে বলল,
“কোন ইমন? কার কথা বলছো তুমি?”
“এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন? সেই ইমন যে স্কুলের সামনে, আমাদের গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করতো। একদিন আমাকে আর তানজিলা কেও বাজে কথা শুনিয়েছিলো”
মুহূর্তেই মেহরাবের চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। হাত মুষ্ঠি বদ্ধ করে নিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ওর শাস্তির দরকার ছিলো। ও যেটা করেছে সেটার বিপরীতে ওর মৃত্যুই অনিবার্য ছিলো। ওর মতো কীটদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। শুকরিয়া আদায় করো যে আমি ওকে কে*টে টুকরো টুকরো করে কু*কুর কে খাওয়াইনি এটাই অনেক”
উৎসার গাঁ শিউরে উঠলো। কি সাংঘাতিক কথা বার্তা। উৎসার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। উৎসা বলল,
“আপনি একটা সাইকো। খু*নি আপনি”
মেহরাব আয়েস করে বসলো। আয়েসি ভঙ্গিতে বলল,
“এগুলো শুনতে শুনতে অভ্যস্ত আমি। নতুন কিছু বলো”
“আপনি চিটার, বাটপার। মুখোশধারী অভিনেতা আপনি। কি নিদারুন অভিনয় ক্ষমতা আপনার”
মেহরাব হাই তুলতে তুলতে বলল,
“কারণ বলো। অযথা মাথা খাটিয়ে ভাবতে পারবো না আমি”
উৎসা তেতে উঠলো। এতো কিছু করেও তার কি সুন্দর আয়েসি ভঙ্গি। খাপ ছাড়া ভাব। উৎসার গাঁ পিত্তি জ্বলে উঠলো। মেহরাবের কাছে এসে এক টানে দাঁড় করিয়ে শার্টের কলার ধরে ঝাকিয়ে বলা শুরু করলো,
“কেন আপনি আমার সাথে এমনটা করলেন? বিয়ের দিন রিয়াদকে কিডন্যাপ করে আমার বাবার মান সম্মান ধুলোয় মিশালেন। অতঃপর নিজেই হিরো সেজে এসে আমায় বিয়ে করলেন। এসব করে নিজেকে হিরো প্রমান করতে চাইছেন আপনি? এসব করে কি লাভ আপনার? কেন আপনি আমার সাজানো গোছানো জীবনটাকে এভাবে এলোমেলো করে দিলেন কেন? দয়া দেখাতে চেয়েছিলেন আমার ওপর? কেন এগুলো করেছেন আপনি?”
মেহরাব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“স্বামীর কলারে হাত দিতে হয়না জানো না? এতটা অভদ্র হলে থেকে? আর রইলো ঐ রিয়াদের কথা। এগুলো কি ও নিজের মুখে তোমায় বলেছে?”
“হ্যাঁ”
মেহরাব দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলল,
“শা*লার যে পাখা গজিয়েছে সেটা আগেই খেয়াল রাখা উচিত ছিলো। তাহলে এতো দূর আসতো না বিষয়টা। শা*লাকে টাইট দিতে হবে”
মুখে বলল,
“তুমি ওর কথা বিশ্বাস করে নিলে? যেই ছেলেটা বিয়ের দিন না এসে তোমায় অপমান করলো তুমি তার কথা বিশ্বাস করে নিজের হাসবেন্ডের কাছে জবাব চাইছো?”
“বিশ্বাস করেছি কি করিনি সেটা পরের বিষয়। আমি আপনার কাছে সত্যি টা জানতে চাই। একটা মানুষ এমনি এমনি তো কোনো কারণ ছাড়া এগুলো বলবে না। তাই না? আর যদি তিনি মিথ্যা বলে তাহলে আমি তাকে জেলের ভাত খাওয়াবো আপনি শিওর থাকেন। এখন সত্যি টা বলুন”
মেহরাব ঘাবড়ে গেল। উৎসা যে বিষয়টা এতো সিরিয়াসলি নিবে কে জানতো? রিয়াদকে জেলের ভাত খাওয়াতে পারলে ওকে যে কি করবে সেটাই ভাবছে মেহরাব। একবার আড়চোখে বউয়ের দিকে তাকালো। বউ রণমূর্তি রূপ ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। এদিক থেকে ওদিক হলেই সোজা গর্দান যাবে।
“কি হলো উত্তর দিচ্ছেন না কেন?”
উৎসা এবার ধমকে উঠলো। মেয়েটার সাহস তো কম না! ওকে ধমকাচ্ছে। মেহরাব খাপ ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
“বিয়ের দিন যেটা দেখেছো সেটাই সত্যি”
উৎসা গর্জে উঠলো,
“মিথ্যা! মিথ্যা কথা বলছেন আপনি”
“আমি যে মিথ্যা কথা বলছেন তার প্রমাণ কি? আর আমার কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই নাকি? আমি রিয়াদ না কি যেন নাম ছেলেটার? আমি কেন ওকে কিডন্যাপ করতে যাবো?”
উৎসা ফুসে উঠলো। ব্যাস্ত হাতে পাশে থাকা ফোনটা তুলে নিলো। কিছু একটা খুঁজছে মেয়েটা। অবশেষে পেয়ে যেতোই মেহরাবের চোখের সামনে ধরলো। মেহারাব উৎসা চোখের সামনে ফোন ধরলে ভালো করে দেখলো। এগুলো তারই পাঠানো হু*মকি বার্তা।
“এরপরও বলবেন আপনি কিছু করেননি? আপনি সাধু পুরুষ?”
মেহরাব হাই তুলল। এমন ভাব করলো যেন ও কিছু দেখেই নি। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“এই সামান্য ম্যাসেজ কি প্রমাণ করে? আমি রিয়াদকে কিডন্যাপ করেছি? কি হলো বলো”
উৎসা ফের মেহরাবের কলার চেপে ধরে বলল,
“নাটক করবেন না মিস্টার মেহরাব। এগুলো যে আপনিই করেছেন সেটা আমি জানি। এখন ভং ধরে কোনো লাভ নেই। সত্যি টা বলুন”
মেহরাব উৎসার হাত থেকে নিজের কলার ছুটাতে ছুটাতে বলল,
“দেখো উৎসা তুমি যেগুলো করছো এগুলো কে অভদ্রতা বলে। কলার ছাড়ো আমার। হাজবেন্ড এর কলার ধরা এগুলো কোন ধরণের অভদ্রতা?”
উৎসা এতক্ষনের সামলে রাখা রাগ আর কন্ট্রোল করতে পারলো না। এতক্ষন ভিতরে থাকা সকল রাগ বেরিয়ে আসতে চাইলো। উৎসা নিজেকে সামলাতে ব্যার্থ হলো। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“ফাইজলামো শুরু করেছেন আপনি আমার সাথে? আমার জীবনটা আপনার কাছে জোকস? মজা পেয়েছেন? আমি আপনার কোনো ক্ষতি করেছি? করিনি তো তাই না? তাহলে কেন এমন করলেন আমার সাথে? আমি তো আপনাকে আমার জীবনে চাই নি। কেন জোর করে আমার জীবনে এলেন? কোনোই বা তছনছ করে দিলেন সব কিছু? কি সমস্যা আপনার?”
মেহরাব এতক্ষন শান্ত থাকতে চাইলেও এই মুহূর্তে সেটা আর সম্ভব হলো না। মেয়েটা সকল বাঁধ অতিক্রম করে ফেলেছে। ও বার বার নিজেকে সামলাতে চেয়েছে ভেবেছে উৎসা যেন ভয় না পায় এমন আচরণ করবে না। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো না। মেহরাব উৎসার বাহুর শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা তুমি। শুধু তুমি!”
উৎসা আওড়ালো,
“আমি?”
“হ্যাঁ তুমি। তুমিই আস্ত সমস্যা। কে বলেছিলো আমায় নিজের মায়ায় ফেলতে? আমাকে উন্মাদনা বানাতে? আমি তো ভালোই নিজের জীবনে নিজের মতো ছিলাম। এক মুঠো বসন্ত নিয়ে কেন এসেছিলে আমার জীবনে? আমি তো তোমার কাছে যেচে যাইনি। ঝড়ের মতো আমার জীবনে প্রবেশ করে এলোমেলো করে দিয়েছিলে আমায়। আমার নিজের থেকে আমার আমিটাকে কেড়ে নিয়েছিলে তুমি। তোমার যন্ত্রনায় ঠিক মতো ঘুমাতে পারতাম না, খেতে পারতাম না, পড়ায় মন বসাতে পারতাম না। আমার সকল শান্তি এক নিমিষে কেড়ে নিয়েছিলে। কেন আমার কিশোর বয়সে আমায় ঘায়েল করেছিল। একটু আগে বললে আমি তোমার ক্ষতি করেছি। আদতে তো তুমি আমার ক্ষতি করেছো। আমার সব কিছু কেড়ে নিয়েছো। একটু একটু করে ধ্বংস করেছো আমায়। কই আমি তো একবারও তোমার নামে অভিযোগ তুলিনি? আমার শান্তিতে বেঁচে থাকাটাই তুমি কেড়ে নিয়েছিলে। ভালোবাসার অনলে পুড়েছি বহুবার তবুও তোমায় বলতে পারিনি। এই কষ্টের মানে বোঝো? তুমি কাউকে ভালোবাসো কিন্তু তাকে কিছু বলতে পারছো না উল্টো অপর পাশের ব্যক্তি তোমায় ঘৃ*ণা করে। কখনো ভেবে দেখছো অনুভূতি টা কেমন হয়? দম বন্ধ হয়ে আসে। তুমি বুঝবে না!”
মেহরাব থামলো। উৎসা থমকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহরাবের দিকে। মেহরাব পুনরায় বলা শুরু করলো,
“হ্যাঁ আমিই রিয়াদকে হু*মকি দিয়েছি, বিয়ের দিন ওকে কিডন্যাপ করেছি বেশ করেছি। এতো বছর ভালোবাসেছি কি এমনি এমনি? নিজের ভালোবাসা কে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার মতো ছেলে আমি না। নিজের ভালোবাসাকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে দেবদাসের মতো পথে পথে ঘুরতে পারবো না আমি। আমি নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত যেতে পারি, এমনকি ছিনিয়ে ও নিতে পারি। এবং আমি সেটাই করেছি। এখন তুমি আমার, শুধুই আমার। আমার থেকে এক চুল পরিমান দূরে যেতে দিবো না তোমায়। এতে যা কিছু হয়ে যাক। বুঝেছো তুমি?”
উৎসা ‘থ’ হয়ে তাকিয়ে রইলো মেহরাবের দিকে। ওর পিছনে এতো কিছু হয়ে গেল আর ও জানতেই পারলো না! মেহরাব ওকে ভালোবাসে? আর যাই হোক মেহরাব ওকে ভালোবাসতে পারে না। নিজের জেদের জন্য নিশ্চই লোকটা মিথ্যা বলছে। উৎসা মেহরাবের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,
“আপনার সাথে থাকা যায় না। আপনি একটা খু*নি, সাইকো। আমি কালই বাড়ি চলে যাবো”
মেহরাব আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“বাড়ির বাহিরে এক পা দিলে ঢ্যাং ভেঙ্গে ফেলবো বলে দিলাম। এর পরও যদি তুমি বের হও তাহলে সম্পূর্ণ দায়ী তুমি থাকবে। আমার অবশ্য খোঁড়া বউ কোলে নিয়ে ঘুরতে সমস্যা নেই”
উৎসা ব্যাথা পাচ্ছে। মেহরাবের আঙ্গুল যেন ওর বাহুতে ডেবে গেছে।
“ছাড়ুন, লাগছে আমার”
“তোমার তো শরীরে লাগছে। আমার যে মনে লেগেছে সেই বেলায়? শরীরের ব্যথা তো একটা সময় চলে যাবে কিন্তু মনের ব্যাথা? তার কি হবে?”
উৎসা মেহরাবের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন ছুড়লো,
“এই আপনার ভালোবাসার নমুনা?”
মেহরাব সাথে সাথে উৎসাকে ছেড়ে দিলো। গভীর চোখে তাকালো উৎসার চোখে। অন্যরকম কণ্ঠে বলল,
“মেহরাব মির্জার ভালোবাসা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই মেয়ে। তুমি তো ব্যাস্ত তার ত্রুটি খুঁজতে। তার ভালোবাসা তুমি বুঝবে কি করে?”
#চলবে?
#অপ্রিয়_তুমি
#পর্ব২০
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
গোধূলি বিকেলে আকাশে ক্লান্ত মেঘেদের খেলা চলছে। পেঁজো মেঘেদের দল পুরো আকাশ জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু পর পর দলে দলে পাখি উড়ে যাচ্ছে তাঁদের নীড়ে। আপন মানুষের অপেক্ষার অবসান ঘটাতে ফিরে যাচ্ছে আপন বাসায়। তবে মেহরাবের মাঝে সেই তারা নেই। ও এক মনে বিশাল আকাশের নিচে বসে রয়েছে। আস্তে করে গাঁ এলিয়ে দিলো মাঠের সবুজ ঘাসের ওপর। দুহাতের ওপর মাথা এলিয়ে বিশাল বিস্তৃত আকাশ পানে দৃষ্টি ঠেকালো। যেন ক্লান্ত পথিক এক মুঠো স্বস্তির আশায় পথ চেয়ে বসে আছে। ছেলেটার মাঝে না আছে তাড়া আর না আছে ভাবাবেগ। কেমন অনুভূতি শুন্য তার আঁখিদয়। কথায় আছে প্ৰিয় মানুষটার থেকে অবহেলা পেতে পেতে মানুষ পাথর হয়ে যায়। তার মাঝে অনুভূতি নামক কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। মেহরাবে হয়েছে সেই অবস্থা। ক্লান্তিতে শরীর ছেড়ে দিয়েছে। এখন আর কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না। প্রেয়সীর বারবার তাকে ভুল বোঝা, ছেড়ে যাওয়া আর মেনে নিতে পারছে না ছেলেটা। মেয়েটা কেন বোঝে না মেহরাব তাকে এতটা ভালোবাসে? মেহরাব কি করেনি ওর জন্য? এইযে এতো পা*গলামো, উন্মাদনা, বেয়ারা জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে লাইফ নিয়ে সরিয়াস হয়েছে তাও মেয়েটা রীতিমতো তাকে অবজ্ঞা করেই যাচ্ছে। মেহরাব চেয়েছে তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে। কিন্তু মেয়েটা একবারের জন্য ও ওকে বোঝনি আর না চেয়েছে বুঝতে। বারবার দূরে ঠেলে দিয়েছে অবহেলায়।
মেহরাব এবার পণ করেছে কোনো মতেই উৎসার কাছে ফিরবে না। মেয়েটা বুঝুক তার শুন্যতা। ওর শুন্যতাও যদি উৎসাকে না ভাবায় তাহলে হয়তো দুজনের পথ আলাদা হয়ে যাবে। জোর করে আটকে রাখা যায়, তবে ভালোবাসা পাওয়া যায় না। কবি বলেছেন,
“ভালোবাসলে তাকে মুক্ত পাখির ন্যায় উড়তে দেও। যদি সে ফিরে আসে তাহলে তোমার, আর না আসলে…..”
মেহরাবের বুকে মোচর দিয়ে উঠলো। দম আটকে আসা অনুভূতি। কিন্তু ওর কিছুই করার নেই। উপরোক্ত বাক্যটির অর্থ মেহরাব হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। ও এতদিন জোর করে উৎসাকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছে, আঁকড়ে থাকতে চেয়েছে। তবে এখন আর না! মেয়েটা নিজে থেকে না আসলে মেহরাব কখনোই তার কাছে ফিরবে না। আর না প্রেয়সীর প্রতি দুর্বল হবে। ভালোবেসেছে, ভালোবাসে এবং ভালোবেসে যাবে চিরকাল। তবে জোর করে নয়।
মেহরাবের বুকে চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। উৎসা ওকে ভালোবাসেনি আর না ওকে বুঝেছে। যদি মেয়েটা ওকে ভালোই বাসতো তবে ভুল বুঝতো না। ওর ভালোবাসার গভীরতা বোঝার চেষ্টা করতো। মেহরাবরের ভালোবাসার গভীরতা মেপে এই বুকেই লুটোপুটি খেত। কিন্তু পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। গত দুদিন যাবত মেহরাব বাড়ি যায় না। বাড়ির কোনো খবরই তার কাছে নেই বললেই চলে। সেই যে বেরিয়েছে কারো সাথে যোগাযোগও করেনি। ফোন বন্ধ করে রেখেছে। আপাতত কাছের এক বন্ধুর বাসায় আছে। বন্ধুকেও বলে দিয়েছে তার খবর কাউকে না জানাতে। তবে সে এটা জানে উৎসা বাড়িতে নেই। ও বেরিয়ে আসার কতক্ষন পরেই বেরিয়েছে। বলে গেছে বাবার বাড়ি যাচ্ছে। সালেহা বেগম ও মানা করেনি। মেহরাব বিস্তৃত আকাশ পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি আমায় কখনোই ভালোবাসোনি বউ, আর না বুঝেছো। অবহেলায় রেখেছো দূরে দূরে। কখনো দূরে সরে গেলে কেঁদেও কুল পাবে না। তখন মনে হবে এই পৃথিবীতে মেহরাব মির্জা নামক এক উন্মাদ ছিলো যে তোমাকে একবুক ভালোবেসে ছিলো। আমার মতো ভালো তোমায় আর কেউ বাসতে পারবে না, কেউ না। দেখে নিও”
বিগত দুদিনে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়াও করেনি মেহরাব। জীবনটা হুট্ করে কেমন বদলে গেল। আধো আধো খুনসুটি ময় জীবনটা বিষাদে রূপান্তরিত হলো এক নিমিষেই। মেহরাব তো উৎসাকে কখনোই জোর করে নি। চেয়েছিল মেয়েটা নিজে থেকে এগিয়ে আসুক তাকে একটু হলেও ভালোবাসুক। কিন্তু সেটা হলো না! সেই অপ্রিয়ই রয়ে গেল। চির জীবন কি তবে তাকে “অপ্রিয়”হয়েই কাটাতে হবে? পাবে না প্রেয়সীর একটু খানি ভালোবাসা? প্ৰিয় হবার সুযোগ? মেহরাবের কাছে একটা প্রশ্নের উত্তরও নেই। বুকে চিঁড়ে কবেও হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বিগত দুদিন ঘুমও হয়নি। হবে কি করে? শুন্য বুকে প্রেয়সীর হাহাকার তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সারারাত এপাশ ওপাশ করেও ঘুমাতে পারেনি। ক্লান্তিতে চোখ বুঝে আসছে। মেহরাব ক্লান্তিতে চোখ বুজে ফেলল। তলিয়ে গেল ঘুমের দেশে।
————
বিগত দুইটো দিন উৎসার মনে হলো কেমন ঘোরের মাঝে কেটে গেল। কিছুই বুঝতে পারলো না। মনে মনে কিছুটা খুশিও হলো। এখন সে মুক্ত। মুক্ত পাখির ন্যায় জীবনটাকে উপভোগ করবে। মেহরাব নামক সাইকোটা আর তাকে আটকে রাখতে পারবে না। উৎসা ভেবে নিয়েছে ও আর কখনোই ওবাড়িতে ফিরে যাবে না। বিগত দুদিন ভালোই গেছে তার। সকাল বেলায় কলেজে গিয়েছে। কলেজ থেকে এসে ঘুমিয়েছে। বিকেলে ভাইয়ের সাথে খুনসুটি, তানজিলার সাথে কলে আড্ডা, রাতে একটু পড়তে বসেছে ব্যাস এভাবেই কেটে গেছে দুটি দিন। বাবা, মা, ভাইয়ের আদরে সে দিব্যি আছে। যেদিন এসেছিলো সেইদিন অবশ্য তনয়া বেগম জিজ্ঞেস করেছিলো,
“কিরে জামাই বাবা কোথায়?”
উৎসা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিল,
“আমি এসেছি এতে খুশি হওনি?”
“না, না। খুশি তো হয়েছি কিন্তু মেহরাব আসেনি?”
উৎসা জিভে দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। না চাইতেও তাকে মিথ্যা কথা বলতেই হবে। তনয়া বেগম কে সত্যি টা জানতে দেওয়া যাবে না। তারা যে দেখে শুনে মেয়েকে একটা সাইকো, খু*নির হাতে দিয়েছে সেটা জানলে তারা কষ্ট পাবে।
“না। উনি কাজে ব্যাস্ত। তাই আমি একাই এসেছি”
এরপর আর কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি। উৎসা পড়ছিলো। এমন সময় রুমে প্রবেশ করে তিয়াস। উৎসার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
“কিরে পে*ত্নী কি করছিস?”
উৎসা মাথা ডলতে ডলতে এক প্রকার ঝাড়ি দিয়েই বলল,
“দেখছো না পড়ছি? কানা হয়ে গেলে নাকি?”
“তু্ই নিজে থেকে পড়ছিস? তাও আমায় মানতে হবে?”
“না মানলে নাই। কি বলতে এসেছো সেটা বলে বিদায় হও”
“তোর ঘরে আমি থাকতে আসিনি। জরুরি কাজেই এসেছি। মেহরাবের সাথে তোর কথা হয়েছে?”
উৎসা ঘাবড়ে গেল। ভাইকে এখন কি জবাব দিবে? বিগত দুই দিনে মেহরাব ওকে এক বারও কল দেয়নি। আর না ও দিয়েছে। লোকটা কল দিলেও ধরবে না বলে পণ করে বসে ছিলো। এখন তিয়াসকে সেটা বলবে কি করে?
“আসলে কালকে রাতের পর ওনার সাথে আমার কথা হয়নি। উনি নাকি আজকে ব্যাস্ত থাকবে তাই আমিও আর কল দেই নি”
“বিকেল থেকে ওকে কল দিয়ে যাচ্ছি বেটার ফোন ধরার নামই নেই। ওর সাথে আমার জরুরি কথা ছিলো। তোকে ফোন দিলে বলিস আমার সাথে যোগাযোগ করতে”
উৎসা মাথা নেড়ে সায় জানালো। তিয়াস রুম থেকে বেরিয়ে গেল। উৎসা ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে দম ছেড়ে বলল,
“বজ্জাত বেডা এখনোও আমায় শান্তি দিবে না”
————
কেটে গেল আরো তিনটে দিন। উৎসার কাছে মেহরাবের কোনো খবর নেই। আর না ইচ্ছে আছে খবর নেওয়ার। কিন্তু ও অবাক হয়েছে এতদিনেও মেহরাবের কাছ থেকে কোনো কল না পেয়ে। লোকটা তো ওকে এতদিন বাবার বাড়ি থাকতে দেওয়ার মতো মানুষ না! ওকে হু*মকি ধামকি দিয়ে নিয়ে যেত। তাহলে কি কিছু হলো মানুষটার?
উৎসাহ বাজে চিন্তা মাথা থেকে বের করে দিলো। এমন সময় পাশে থাকা ফোন বিকট শব্দে বেজে উঠলো। আচমকা এমনটা হওয়ায় উৎসা ভয় পেয়ে গেল। নিজেকে সামলে ফোন ধরতেই দেখলো রিনির কল। এই সময়ে রিনির কল দেওয়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। উৎসা ফোন রিসিভ করে কানে নিলো। কুশল বিনিময় করে প্রথমেই রিনির প্রশ্ন,
“মেহরাব কোথায় জানিস বনু? ওর সাথে তোর কথা হয়েছে?”
উৎসা ‘থ’ হয়ে গেল। রিনি ওকে এই কথা জিজ্ঞেস করবে ভাবেনি। কি উত্তর দিবে এখন? তোতলানো কণ্ঠে বলল,
“কেন? উনি বাড়ি যান নি?”
রিনি তড়িৎ গতিতে জবাব দিলো,
“না। তু্ই যাওয়ার পর একদিনও বাড়ি আসেনি। আর না ফোন রিসিভ করছে। আমি, তোর ভাইয়া, মা, বাবা সবাই চিন্তিত। এতবার করে কল দিচ্ছি বারবার ফোন বন্ধ বলছে। ছেলেটা তো এমন করার মানুষ না”
উৎসা কি জবাব দিবে বুঝতে পারছে না। রিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
“মেহরাবের সাথে তোর কথা হয়েছে? তোদের বাড়ি গেছে? এতদিন হয়ে গেল তু্ই ও আসছিস না!”
উৎসা থতমত খেয়ে গেল। জবাবের কোঠা শুন্য ওর। কিছুই বলার মতো নেই।
“কি হলো বল!”
“আসলে এ বাড়ি আসার পর থেকে আমারও ওনার সাথে কথা হয়নি। উনিও কল দেয়নি আর আমিও না”
“তোদের বাড়িও যায় নি?”
উৎসা মিন মিনে কণ্ঠে জবাব দিলো,
“না!”
“কি বলছিস? মাথা ঠিক আছে তোর? মেহরাব তো একটা দিনও তোকে ছেড়ে থাকতে পারে না। সেখানে পাঁচ দিনে ও তোকে কলও দেয়নি আর না তোদের বাড়ি গিয়েছে কিভাবে সম্ভব এটা?”
উৎসা জবাব দিলো না। উৎসা কে চুপ থাকতে দেখে রিনি শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“তোদের মাঝে আবার কিছু হয়েছে?”
উৎসা তাও জবাব দিলো না। রিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
“ঝগড়া করেছিস দুজন?”
উৎসা তাও চুপ। এবার আর শান্ত থাকতে পারলো না রিনি। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
“প্লিজ উৎসা কি হয়েছে আমাকে খুলে বল! মেহরাব কখনো এতগুলো দিন কাউকে কিছু না বলে বাড়ির বাহিরে থাকার ছেলে না। এ বাড়িতে আসার পর আমি ওকে কখনো এমন করতে দেখনি। প্লিজ পুরো ঘটনা বল আমায়”
উৎসা দম নিলো। একে একে খুলে বলল সকল ঘটনা। রিনি তাজ্জব বনে গেছে। এতো কিছু ঘটে গেছে আর ও কিছুই জানে না। উৎসা কান্না করতে করতে বলল,
“উনি একটা খু*নি আপু। সাইকো উনি। ওনার সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। ওনার জন্য আমি কোথাও যেয়েও পারিনা, ঠিক মতো বাবার বাড়িও থাকতে পারিনা। ওনার ট*র্চারে অসহ্য হয়ে ওঠেছি আমি”
“এটা অ*ত্যা*চার না উৎসা। এটা ভালোবাসা”
“উনি আমায় একটুও ভালোবাসে না। ভালোবাসলে এভাবে বন্দি করে রাখতো না। একটা জলজ্যান্ত ছেলেকে মে*রে ফেলেছে তোমার দেবর। উনি একটা খু*নি”
“উৎসা বোঝার চেষ্টা কর, সবার ভালোবাসার ধরণ এক না। কেউ ছেড়ে গিয়ে ভালোবাসে, কেউ আঁকড়ে ধরে। মেহরাব তোকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছে। বেচারা প্রতিনিয়ত তোর ছেড়ে যাওয়ার ভয়ে তোকে ছাড়েনি। আর তু্ই কিনা ওকে ভুল বুঝলি”
“তুমিও তোমার দেবরের সাইড নিচ্ছ? তোমরা কেউ আমায় বুঝলে না। উনি আমায় কখনো ভালোই বাসেনি”
“শোন, মেহরাব যদি তোকে ভালোই না বাসতো তাহলে তোকে খারাপ কথা শুনানোর জন্য একটা ছেলেকে মে*রে ফেলতো না। তোকে কেউ কিছু বললেই তাকে আঘাত করতো না। তোকে সব সময় আগলে রাখতো না। আর না তোর বিয়ের দিন ঐ কাণ্ড ঘটাতো না। তোকে আমি আগেই বলেছিলাম মেহরাব তোকে ভালোবাসে, ছেলেটা তোকে পা*গলের মতো ভালোবাসে। সেই জন্যই তোকে হারানোর ভয়ে এতো কাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু তু্ই বুঝলি না। আজ আমিও মেহরাবের মতো বলতে বাধ্য হলাম, তু্ই কখনো মেহরাবের ভালোবাসা বুঝিসই নি। আর না ওকে বুঝতে চেষ্টা করেছিস”
রিনি কল কেটে দিয়েছে। উৎসা ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। শেষ মেষ রিনি ওকে এগুলো বলতে পারলো? ও কি সত্যি মেহরাব কে বোঝেনি? ওর ভালোবাসা বোঝেনি? এর মাঝেই রুমে প্রবেশ করলো তিয়াস। রুমে ঢুকেই সর্বপ্রথম কথা,
“মেহরাব কোথায় জানিস? ওর সাথে কথা হয়েছে তোর?”
উৎসা তেতে উঠলো। ঝাড়ি মেরে বলল,
“তোমার বন্ধুর সব খবর নিয়ে কি আমি বসে থাকি? আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন?”
তিয়াস বোনের দিকে তাকালো। উৎসার হঠাৎ এভাবে রিয়েক্ট করার কারণ ও খুঁজে পাচ্ছে না। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে তোদের মাঝে? তু্ই বাড়ি এসে বস আছিস, ওদিকে মেহরাবের খবর নেই। দুজন ঝগড়া করেছিস?”
উৎসা তেজি কণ্ঠে বলে উঠলো,
“ঝগড়া? তোমার খু*নি বন্ধুর সাথে একসাথে থাকা যায়? খু*নি, সাইকো একটা। তুমি ইচ্ছে ওরে বোনের সাথে নিজের বন্ধুর বিয়ে দিয়েছো তাই না? এক বারও বিবেকে বাধে নি? নিজের বোনের এতো বড় ক্ষতি করতে?”
তিয়াস ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো উৎসার গালে। উৎসা ‘থ’ হয়ে তাকিয়ে রইলো নিজের ভাইয়ের দিকে। তিয়াস বলল,
“তু্ই কাকে খু*নি বলছিস? মেহরাব কে? ওর মতো ছেলে আরেকটা খুঁজে দেখাতে পারবি? ঠিক আছে মেনে নিলাম ও খু*নি। বল কাকে খু*ন করেছে ও?”
উৎসা চুপ। তিয়াস ধমক দিলো,
“বল”
উৎসা মিন মিনে গলায় বলল,
“ইমনকে”
“তু্ই জানিস ইমন সম্পর্কে? কতো টুকু জানিস? জানিস কতো টা জ*ঘন্য ছেলে ছিলো ও? মেহরাব ওকে মে*রেছে তোকে এটা কে বলল?”
“রিয়াদ”
তিয়াস হাত মুষ্ঠি বদ্ধ করে ফেলল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ঐ হা*রা*জা*দার কথা বিশ্বাস করেছিস তু্ই? আরে ও নিজেই তো এক নাম্বারের খারাপ ছেলে। ইমন সেদিন তোদের বাজে কথা বলায় আমি, মেহরাব আমাদের গ্রূপের ছেলেরা মিলে ইমনকে মা*রছিলাম। মেহরাব রাগের মাথায় বলেছিলো ওকে খু*ন করে ফেলবে। যদিও ইমনের অবস্থা তখন বেশি ভালো ছিলো না। ইমন আমাদের হাত থেকে পালাতে বড় রাস্তার দিকে দৌড় দেয়। সেখানেই একটা বাসের সাথে ওর ধাক্কা লাগে। পরে হসপিটালে ভর্তি করলে দুই দিন থেকে মা*রা যায়। মেহরাব ওকে মা*রেনি”
উৎসা বিস্মিত, স্তম্ভিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ের রইলো ভাইয়ের দিকে। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ও। তাও নিজেকে সামলে কোনো মতে বলল,
“বিয়ের দিন উনি রিয়াদ কে কিডন্যাপ…”
উৎসা পুরোটা বলার আগেই তিয়াস আটকে দিলো। বলল,
“আমি জানি সেটা ঘটনা। রিয়াদ ভালো ছেলে না। সেই জন্য মেহরাব ওকে হু*মকি দিয়েছিলো তোকে বিয়ে করতে রাজি না হতে। যদিও প্রথমে আমরা কিছুই জানতাম না। বিয়ের আগের দিন রিয়াদের আসল রূপ সম্পর্কে অবগত হই আমরা। তখনই আমরা প্ল্যান করি ওকে কিডন্যাপ করার। মেহরাবের সকল প্লানই আমি জানি। বেস্ট ফ্রেন্ড আমি ওর। এক রিয়াদ খারাপ, দুই বাবা আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। ভোর হলেই আত্মীয়রা চলে আসবে। আমাদের হাতে শক্ত কোনো প্রমাণ ও ছিলো না। যেটা আমরা বাবাকে দেখাবো। তাই এটা ছাড়া আমাদের কাছে অন্য কোনো উপায় ছিলো না।
আমি জানি মেহরাব তোকে ভীষণ ভালোবাসে সেই জন্য ওর সাথে বিয়ের কথাটা আমিই তুলেছি। মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ায় বাবাও ভেঙ্গে পড়েছিল, এমনি হলে মেহরাব কে বাবা কিছুতেই মেনে নিতো না। সব মিলিয়ে ভাই হিসেবে আমার মেহরাবকেই তোর জন্য বেস্ট মনে হয়েছে তাই ওর সাথেই তোর বিয়ে দিয়েছি”
উৎসা থমকে গেছে। ওর পিছনে এতো কিছু হয়েছে আর ও সব কিছু সম্পর্কে জানেই না। তিয়াস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মেহরাব ছেলেটা সত্যি তোকে অনেক ভালোবাসে। অনেক বেশিই ভালোবাসে। ভাই হিসেবে আমি তোকে বলছি মেহরাবের চেয়ে ভালো কেউ তোর জন্য হতে পারে না। আর না হবে”
তিয়াস বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। যাওয়ার আগে বিড়বিড় করে বলল,
“ছেলেটা কোথায় আছে কে জানে! যেখানেই আছে সুস্থ আছে তো!”
#চলবে?