অপ্রিয় তুমি পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0
66

#অপ্রিয়_তুমি
#অন্তিম_পর্ব (প্রথম অংশ)
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

নিস্তব্ধ, গুমোট, স্তম্ভিত পরিবেশ। দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরে ঘেউ ঘেউ ডাক। যা আত্মচিৎকারে রূপান্তরিত হয়েছে। উৎসা তব্দা খেয়ে বসে রইলো কিছুক্ষন। মিনিটের ব্যাবধানে কি হলো ওর মাথায় কিছুই ঢুকলো না। সব যেন ওর চিন্তা ভাবনা চেতনার ওপর দিয়ে গেল। আচমকা একটা বিকট শব্দ, অতঃপর শুনশান নীরবতা। ওপাশ থেকে অপ্রিয় মানুষটার হাসির শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। শান্ত, নীরব সব কিছু যেন ঝড় হয়ে যাওয়ার পরের শান্ত পরিবেশ।

মিনিট দুই বাদে উৎসার ধ্যান ফিরলো। বোধ গম্য হলো ঘটনা। কি করবে সেটা বুঝতেও সময় খানিকটা লেগে গেল। স্তম্ভিত ফিরে পেতেই উৎসা তড়িৎ গতিতে মেহরাবকে ডাকা শুরু করলো।
“এইযে শুনছেন? কি হয়েছে? কিসের শব্দ হলো? আপনি কথা বলেছেন না কেন? আপনি ঠিক আছেন তো! শুনছেন?”

ওপাশ থেকে কথার বিপরীতে কোনো শব্দ ভেসে এলো না। উৎসা মেহরাবের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ব্যাকুল হলো। মনের মাঝে অস্থিরতা শুরু হলো। আকুলতা নিয়ে মেহরাব কে ডাকা শুরু করলো,
“এইযে শুনছেন? মিস্টার লুচু! কথা বলছেন না কেন? এই কথা বলুন না! আমার কথা আপনি শুনতে পাচ্ছেন না! আপনি ইচ্ছে করে এমন করছেন তাই না? আমায় জ্বালিয়ে আপনি কি মজা পান বলুন তো? আর কতো জ্বালাবেন আমায়! এতো জ্বালিয়ে ও শান্তি হচ্ছে না আপনার? এই! কথা বলুন না! একটু আগে কি সুন্দর হাসছিলেন, একটু হাসুন না। শুনতে পাচ্ছেন আপনি আমার কথা?”

উঁহু ওপাশ থেকে কোনো শব্দ আসছে না। ওপাশের মানুষটার কান অবধি পৌছালো না উৎসার আকুলতা মিশানো ডাক। থমকে আছে ওপাশের পরিবেশ। উঁহু, কোনো শব্দই আসছে না। এতক্ষন মেহরাবের ড্রাইভ করার শব্দ ভেসে আসছিলো এখন সুম্পূর্ণ নিস্তব্ধ সব। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না উৎসা। গলায় কান্নারা এসে জমেছে। বুকের মাঝে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে। কু গাইছে মন।
“মেহরাব! এই মেহরাব! শুনতে পাচ্ছেন আপনি আমার কথা? এইযে দেখুন আমি আপনার নাম ধরে ডাকছি। শুনতে পাচ্ছেন আপনি? আপনি না আমার মুখে আপনার নাম শুনতে চেয়েছেন? এই দেখুন আমি ডাকছি আপনাকে। সারা দিন না? এমন কেন করছেন? কথা বলুন না। দেখুন আমার কষ্ট হচ্ছে। কান্না পাচ্ছে। আমি কান্না করে দিবো বলে দিলাম”

কথা গুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো উৎসা। এক পর্যায়ে শব্দ করে কান্না করে দিলো মেয়েটা। ওর কান্নার শব্দ ওপাশের মানুষটা সহ্য করতে পারে না। তার নাকি বুকে বিঁধে উৎসার কান্না। কিন্তু এখন কি সুন্দর চুপ করে আছে। উৎসা কান্না করছে, তার প্রেয়সী কান্না করছে তাও মানুষটার মাঝে হেলদোল নেই। উৎসা এবার উঠে দাঁড়ালো। কান্না করতে করতে ছুটলো রিনির রুমের দিকে। রাত এখন দুইটা বেজে তিন মিনিট। উৎসা আশেপাশে কিছু দেখলো না। নক করতে লাগলো রিনিদের রুমের দরজায়। মিনিট যেতেই রুমের দরজা খুলল মাহিন। ঘুম ঘুম চোখে কিছু বলবে তার আগেই উৎসার কান্নার শব্দে ওর ঘুম ছুটে গেল। নিজেকে সামলে তরিঘরি জিজ্ঞেস করলো,
“উৎসা কান্না করছো কেন বোন? কি হয়েছে?”

উৎসার কান্নার দাপটে হেঁচকি উঠে গেছে। কান্নার ফলে কথা বলতে পারছে না। উৎসার কান্নার শব্দে রিনি উঠে এলো। ওর ঘুম ও ছুটে গেছে। তড়িৎ গতিতে উৎসাকে নিয়ে রুমে বসালো। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? কান্না করছিস কেন? এই উৎসা কথা বল”

উৎসা কান্না থামিয়ে কোনো মতে বলল,
“তোমার দেবর কথা বলছে না, এই দেখো আমি তাকে ডাকছি উনি কথা বলছেন না”

“আবার ঝগড়া করেছিস দুজন?”

উৎসা দুদিকে মাথা নাড়ালো। এর অর্থ না। রিনি জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে কি হয়েছে?”

উৎসা কান্না থামার নাম্ নিচ্ছে না। মাহিন ওকে পানি এনে দিলো। উৎসা পানির গ্লাস হাতে নিতেই মাহিন বলল,
“হয়তো নেটওয়ার্ক সমস্যা”

উৎসা পানি খেয়ে নিজেকে কিছুটা শান্ত করলো। অতঃপর বলল,
“না, নেটওয়ার্ক সমস্যা না। ওপাশ থেকে বিকট একটা শব্দ হয়েছে। তার পর থেকেই উনি চুপ করে গেছেন। আমি এতো ডাকছি তবুও আমার ডাকে সারা দিচ্ছে না”

মাহিনের কপালে ভাঁজ পড়লো। চট জলদি বিছানায় পাশ থেকে ফোন তুলল। উৎসা তখনো সমান তালে কেঁদেই চলেছে। রিনি ওকে বোঝাচ্ছে। কিন্তু উৎসা বুঝলে তো! ও রিনিকে নিজের অবস্থা বোঝাতে পারছে না। মেহরাব কি অবস্থায় আছে? কি হয়েছে? ওর মনের মাঝে কেমন অস্বাভাবিক, অস্থিরতা শুরু হয়েছে। ওর মনের অবস্থা টা কেউ বুঝতে পারছি না। মাহিন মেহরাবের নাম্বার ডায়াল করতে করতে বলল,
“ও তো হোটেলের ভিতরে আছে। সেখানে বিকট শব্দ হবে কি করে. তুমি হয়তো ভুল শুনেছ উৎসা। আর আমি ওকে জিজ্ঞেস করছি ও কেন তোমার সাথে কথা বলছে না। ভাইয়া ওকে বকে দিবো”

উৎসা কান্নার মাঝে বলল,
“উনি তো হোটেলে নেই”

মাহিনের কপালে ভাঁজ পড়লো। ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলো,
“মেহরাব হোটেলে নেই তো কোথায়? ওর তো মিটিং শেষ করে হোটেলে ফিরে আসার কথা। মিটিং শেষ করে আসার পথে আমার সাথে কথা হয়েছে তো! ও বলল, হোটেলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। তাহলে ও কোথায় গেল?”

কথা গুলো বলতে বলতে মাহিন বার দুয়েক মেহরাব কে কল দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ওপাশ থেকে কল রিসিভ হচ্ছে না। মাহিন ফের কল লাগালো মেহরাবের নাম্বারে। নাহ! এবার ও ওপাশ থেকে কেউ কল রিসিভ করলো না। মাহিন এবার চিন্তিত গলায় বলল,
“মেহরাব তো কল রিসিভ করছে না, দাড়াও আমি হোটেলের ম্যানেজারের কল করছি”

মাহিন ব্যাস্ত হাতে কল লাগালো হোটেলের ম্যানেজারের নাম্বারে। কাজের ক্ষেত্রে গাজীপুর এলে বেশির ভাগ সময়ই ওদের এই হোটেলেই ওঠা হয়। সেই জন্যই ম্যানেজারের সাথে ওদের বেশ ভালোই পরিচিতি আছে। রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো। মাহিন একবার উৎসার দিকে তাকালো। মেয়েটা অনবরত কেঁদেই চলেছে। উৎসার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাহিন ম্যানেজার কে জিজ্ঞেস করলো,
“মেহরাব কি ওর রুমে আছে? ছেলেটা ফোন ধরছে না। আপনি একটু ওর খোঁজ নিন তো। তারপর আমায় জানান ও কোথায়?”

ম্যানেজার অত্যন্ত শ্রদ্ধা স্বরূপ বলল,
“আপনি দুটো মিনিট লাইনে থাকুন স্যার, আমি আপনাকে এক্ষুনি জানাচ্ছি”

ম্যানেজার সাহেব মাহিন কে লাইনে থাকতে বলে সাথে সাথে একজন স্টাফ কে পাঠালো মেহরাবের খোঁজ নিতে। মিনিটের মাথায় স্টাফ নেমে এসে জানালো। ম্যানেজার সাহেব বলল,
“স্যার! মেহরাব স্যার রুমে নেই। উনি প্রায় আধা ঘন্টা আগে চেক আউট করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে”

“ও আচ্ছা”

মাহিন পড়ে গেছে চিন্তায়। ছেলেটা এই রাতের বেলায় বের হলো কেন? ওর তো কাল সকালে রওনা দেওয়ার কথা ছিলো। তাহলে হুট করে কি এমন হলো যে এই রাতের বেলায় বের হলো? কাউকে কিছু জানায় ও নি। মাহিনা এগিয়ে গিয়ে বলল,
“মেহরাব নাকি হোটেল থেকে চেক আউট করে বেরিয়ে পড়েছে। উৎসা তুমি জানো কি কিছু জানো? মেহরাব তোমায় কিছু বলেছে? যে ও বেরিয়ে পড়েছে বা কিছু?”

উৎসা কান্না থামিয়ে ভাবলো। হ্যাঁ! মেহরাবের সাথে তো ওর কথা হয়েছে। দুজনের বেশ ভালোই সময় কাটছিলো। কিন্তু কি থেকে যে কি হলো!
“হ্যাঁ”

উৎসা একে একে শুরু থেকে সব খুলে বলল। মাহিনের কপালে ভাঁজ পড়লো। কি এমন হলো যে বিকট শব্দ হবে? মেহরাবের ড্রাইভ করার হাত বেশ ভালো। এদিকে সেদিক হওয়ার চান্স তেমন নেই। তবুও বলা যায় না। মাহিন উৎসার থেকে ঘটনা শুনে তরি ঘড়ি কল লাগালো ওর পরিচিত একজন কে। সে কল তুলতেই তাড়াহুড়ো করে বলল,
“মেহরাব হোটেল থেকে বেরিয়েছে। দেখা তো ও কোথায় আছে? ওর খবর নিয়ে আমায় জানা তো!”

কথা শেষ করে ড্রেসিং টেবিলের কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে পিছন থেকে ডেকে উঠলো রিনি,
“এতো রাতে কোথায় যাচ্ছ?”

“গাজীপুর যাবো”

“এখন?”

“হ্যাঁ। শুনতে পেলে তো মেহরাবের কোনো খবর নেই। কি হয়েছে? কোথায় আছে ভাই আমার কিছুই জানি না”

“ঠিক আছে যাও”

মাহিন যেতে নিলে উৎসা উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“আমিও আপনার সাথে যাবো ভাইয়া”

“তুমি এখানেই থাকো। আমি যেয়ে ওর খবর তোমায় জানাবো। আর ইচ্ছে মত ওকে বকে দিবো”

“আমি এখানে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারবো না। আমার মন মানবে না। প্লিজ ভাইয়া আমি যাবো। আপনি না করবেন না”

মাহিন আর কিছু বলার মতো পেল না। মেয়েটার অবস্থা ও কিছুটা হলেও বুঝলো। মেয়েটা মেহরাব কে প্রচন্ড ভালোবাসে কিন্তু স্বীকার করতে চায় না। মাহিন মুখে বলল,
“আসো”

মাহিন উৎসা বেরিয়ে পড়লো। মাহিন ড্রাইভ করছে। পাশে বসে আছে উৎসা। ওর দৃষ্টি বাহিরে। তবে মনের মাঝে বইছে উথাল পাথাল ঢেউ। দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো হাতে থাকা ফোনের দিকে। উৎসা কিছু মনে পড়তেই আবার ডায়াল করলো মেহরাবের নাম্বারে। রিং হচ্ছে। একবার, দুবার, তিনবার। বাজতে বাজতে কল কেটে গেল কিন্তু রিসিভ হলো না। উৎসা আবার ডায়াল করলো। ঘটনা একই ঘটলো। রিসিভ হলো না। উৎসার ইচ্ছে করলো হাতে থাকা ফোনটা আছাড় দিতে। কিন্তু দিলো না। মনের মাঝে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে উৎসার প্ৰিয় জিনিসটা ক্রমেই ওর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। উৎসা বার বার চাচ্ছে জিনিসটা আঁকড়ে ধরে রাখতে কিন্তু সেটা ওর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে কালো আঁধারের মাঝে। এর মাঝে মাহিনের কাছে কল এলো। মাহিন ফোনটা উৎসাকে রিসিভ করতে বলল। উৎসা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বলল,
“ভাই মেহরাবের কোনো খবরই পাচ্ছি না, আশেপাশে খুঁজেছি। কিন্তু ওকে বা ওর গাড়ি কিছুই পাইনি”

মাহিন ড্রাইভ করতে করতে বলল,
“ভালো করে খুঁজেছিস? আধা ঘন্টায় কতো দূর যাবে, বেশি দূর যেতে পারেনি। আশেপাশেই আছে। আমি প্রায় এসে পড়েছি। তুইও খোঁজ আমিও আসছি”

কল কেটে দিলো। মাহিন বেশ জোরে সোরে গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়ির স্প্রিড ৯০-১০০ এর মাঝে। রাত হওয়ায় ফাঁকা রাস্তা। মেহরাবের স্বভাব বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালানো। রাগ হলে বা ওর কথার এদিক ওদিক হলেই রাগে গজ গজ করতে করতে বেরিয়ে যেত। সেদিক থেকে মাহিন শান্ত শিষ্ট ছেলে। কিন্তু আজ মাহিনের ও ভাইয়ের টেনশনে মাথা ঠিক নেই। সব সময় মেহরাব কে,
“আস্তে গাড়ি চালাবি, স্প্রিড যেন ৫০-৬০ এর মাঝে থাকে”

বলা ছেলেটাও আজ স্প্রিডে গাড়ি চালাচ্ছে। মাহিনের মনের মাঝে তুফান বইছে। উৎসার কথা শুনেই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে তাও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে। ও ভেঙ্গে পড়লে উৎসার অবস্থা আরো বেগতিক হবে। তাই নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। ওরা প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। আর আধা ঘন্টা দূরত্বই হোটেল। কিছুটা এগিয়ে যেতেই নজর পড়লো হাইওয়ে রাস্তার মাঝে দুই তিনটা গাড়ি ভীড় করে রাখা। অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে সেখানে। মাহিনের ভ্রু কুঁচকে এলো। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় কি ভেবে যেন গাড়ি থামালো। একজকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো,
“এখানে কি হয়েছে?”

“প্রাইভেট কার আর ট্রাকের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে”

মাহিনের বুকের মাঝে চিপ মেরে উঠলো। খেয়াল করে দেখলো হোটেল থেকে এখানে আস্তে আধা ঘন্টার মতো সময় লাগে, সাথে এখানে একটা একসিডেন্ট হয়েছে। মনের মাঝে বাজে চিন্তা এলো। মাহিন নিজেই নিজেকে বোঝালো,
“ওর ভাইয়ের কিছু হতে পারে না। পারে না কিছু হতে!”

পাশ থেকে এক বয়স্ক মানুষ বলে উঠলো,
“ইসস! ছেলেটার কি অবস্থা হয়েছে। বাঁচবে বলে মনে হচ্ছে না। আহারে! কোন মায়ের সন্তান কে জানে। এইটুকু বয়সে ছেলের হারা হয়ে মা টা কিভাবে নিজেকে সামলাবে আল্লাহ মালুম। এমন শোনার টুকরো ছেলেটা!”

লোকটার কণ্ঠে আফসোস। মাহিন গাড়ি থেকে নেমে এলো। এর মাঝেই সেখানে ওর পরিচিত লোকটা এলো। দুজন নেমে এগিয়ে গেল। ওদের পিছু পিছু উৎসাও নামলো। ওর বুক কাঁপছে। অস্বাভাবিক হচ্ছে হৃদ স্পন্দন। সবাইকে পেরিয়ে একদম সামনে যেতেই উৎসা থমকে গেল। এটা মেহরাবের গাড়ি। হ্যাঁ ! এটা মেহারাবেই গাড়ি। উৎসার চিনতে ভুল হয়নি। এই গাড়িতে কতো শত দুস্টুমিষ্টি স্মৃতি দুজনের। সেই গাড়ি উৎসা কি করে চিনবে না। গাড়ির সামনেটার অবস্থা খুবই খারাপ। গাড়ি যেয়ে লেগেছে গাছের সাথে। গাড়ির গ্লাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। মাহিন এতক্ষন নিজেকে সামলালেও এখন আর সামলাতে পারলো না। উৎসা মেয়েটাকে কি বলবে? পাশে চোখ পড়তে নজর পড়লো উৎসার দিকে। মেয়েটা নিশ্চল চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো অনুভূতি নেই ওর মাঝে। যেন অনুভূতিহীন পাথরে পরিণত হয়েছে। পাশে থাকা ছেলেটা মাহিন কে আগলে নিলো। জিজ্ঞেস করলো,
“একসিডেন্ট করা লোকদের কোথায় নেওয়া হয়েছে? কেউ বলতে পারবেন?”

সবার মাঝ থেকে একজন বলল,
“সিটি হসপিটালে”

সিটি হসপিটাল কাছেই। এখান থেকে যেতে মিনিট পাচেক লাগবে। ছেলেটা তড়িঘড়ি মাহিনকে বলল,
“ভাই চলো আমরা তাড়াতাড়ি হহসপিটালে যাই। দেখি কি অবস্থা”

মাহিন সম্মতি জানালো। ছেলেটা নিজের গাড়ি রেখে মাহিনের গাড়িতে এসে বসলো। মাহিন এগিয়ে আসতে নিয়েও পিছন ফিরে তাকালো। উৎসা এখনো আগের ন্যায় পাথর মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মাহিন উৎসার কাছে যেয়ে বলল,
“উৎসা চলো”

উৎসার কানে কথা ঢুকলো কিনা বোঝা গেল না। তবে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। কোনো বাক্য ব্যায় না করে গাড়িতে উঠে বসলো। মিনিট কয়েকের ব্যাবধানে গাড়ি এসে থামলো হসপিটালের সামনে। কেউ নামার আগেই উৎসা নেমে পড়লো। উদভ্রান্তের ন্যায় এগিয়ে গেল হসপিটালের ভিতরে। ওর পা কাঁপছে। শরীর ভেঙ্গে আসছে। তবু উৎসা হেটে চলেছে। ওকে যে যেতেই হবে। পৌঁছাতে হবে কাঙ্খিত মানুষটার কাছে। রিসিপশনে যেয়ে জিজ্ঞেস করার মতো কিছু খুঁজে পেল না। ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ও, সব তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কান্না গলায় আটকে গেছে। এর মাঝেই মাহিন আর ছেলেটা চলে এলো। ছেলেটা রিসিপশনে জিজ্ঞেস করলো,
“মেহরাব মির্জা নামে কেউ এখানে ভর্তি হয়েছে?”

রিসেপশনে থাকা মেয়েটা একটা ফাইলে নাম খুজল কিন্তু পেল না। বলল,
“সরি স্যার এই নামে কেউ এডমিট হয়নি”

ছেলেটা বুদ্ধি করে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছুক্ষন আগে হাইওয়ে একসিডেন্ট হয়েছে, একসিডেন্ট হওয়া পেশেন্ট কোন রুমে আছে বলতে পারবেন?”

“তাঁদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। তাকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে। অপারেশন চলছে। ওটি সোজা যেয়ে বাম দিকে। তার পাশের….”

মেয়েটা কথা শেষ করতে না করতে বাকিটা সোনাটা প্রয়োজনে বোধ করলো না উৎস। সোজা মেয়েটার বলা মতো সেদিকে হাঁটা দিলো। উদভ্রান্তের ন্যায় চলেছে মেয়েটা। হুস জ্ঞান কিছুই নেই। পা জড়িয়ে আসছে। উৎসার কানে কেবল মেহরাবের কথা গুলোই বাজছে।
“এখন এভাবে দূরে ঠেলে দিচ্ছ তো! যখন থাকবো না তখন খুঁজেও পাবে না”

“হতেও তো পারে একটা সময় তুমি মরিয়া হয়ে আমায় খুঁজবে তাও আমায় পাবে না”

মেহরাবের বলা কথা গুলো উৎসার কানে তীব্র ভাবে বাজছে। এই মুহূর্তে উৎসা কথা গুলোর মানে বুঝতে পারছে। হন্ন হয়ে খুঁজছে ও মানুষটাকে কিন্তু সেই কোথায়? সে কেন এসে দেখা দিচ্ছে না? কেন এমন করছে লোকটা ওর সাথে? সে কি জানে না উৎসার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, পা ভেঙ্গে আসছে, বুকের মাঝে দম আটকে আসছে? তাহলে কেন এসে দেখা দিচ্ছে না? এসে বলছে না,
“এইযে বউ আমি এখানে”

কেন করছে না লোকটা এমন? লোকটা তো ওকে আশা দিয়েছে যে ও সকালে চোখ খুলে তাকে দেখবে কিন্তু সে কই? ভাবমার মাঝেই উৎসা ওটির সামনে এসে দাঁড়ালো। এমন সময় ওটির লাইট নিভে গেল। ওটির সামনে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। ডক্টর গম্ভীর মুখে বেরিয়ে এলো। নির্দয়ের মতো আওড়ালো,
“সরি, রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। আনতে দেরি করে ফেলেছেন আপনারা”

নিষ্ঠুরের ন্যায় বাক্য আওরে চলে গেল। মাহিনরাও এসে দাঁড়ালো। শুনলো ডক্টরের পাষণ্ড বাক্য। মিনিটের ব্যাবধানে একটা স্ট্রেচার বাহিরে এনে রাখা হলো। সাদা কাপড় জড়িয়ে রাখা মানুষটার ওপর। উৎসা নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না। ধপ করে বসে পড়লো ফ্লোরে। ওর পা গুলো ভেঙ্গে আসছে, দম বন্ধ হয়ে আশার জোগাড়। উৎসার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো,
“আপনি পাষান মিস্টার মেহরাব। আপনি কথা দিয়ে কথা রাখেন নি। আপনি বলেছেন খুব শীঘ্রই আমার কাছ ফিরে আসবেন, তবে সাদা কাফনে কেন এসেছেন? আমায় এতো জ্বালিয়েও আপনার শান্তি হয়নি? এখন আবার নতুন রূপে জ্বালাতে এসেছেন?”

#চলবে?

#অপ্রিয়_তুমি
#অন্তিম_পর্ব (শেষ অংশ)
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ পরিবেশ। কারো মুখে কোনো রা নেই। নাকে ভেসে আসছে ফিনাইলের তীব্র বাজে গন্ধ। হসপিটালের করিডরে পড়ে রয়েছে সাদা কাপড়ে ঢাকা দেহ বিশিষ্ট স্ট্রেচার। কেউ সাহস করে এগিয়ে যাচ্ছে না। সবাই যেন থমকে গেছে। থমকে আছে পরিবেশ। সবার নিশ্চুপ, থমকে যাওয়ার মাঝে সাহস করে উঠে দাঁড়ালো উৎসা। কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা নিজের মাঝে নেই। ঘোরের মাঝে আছে। একপা এক পা করে এগিয়ে যেয়ে স্ট্রাচারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কম্পন রত হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছুঁতে চাইলো সাদা কাপড়ে মোড়ানো মানুষটাকে, তবে ওর অনিয়ন্ত্রিত হৃদ স্পন্দন অস্বাভাবিক শ্বাস প্রস্বাস ওকে সেটা করতে দিলো না। কেঁপে উঠলো উৎসার ছোটো অন্তরাত্মা। উৎসা কম্পনরত কণ্ঠে বলল,
“মেহরাব! এই মেহরাব! আপনি শুনছেন আমার কথা? এই কথা বলুন না! আপনি এভাবে শুয়ে আছেন কেন? আপনার কি হয়েছে? আপনার কিছুই হয়নি। আপনি উঠে বসুন, কথা বলুন আমার সাথে। এই দেখুন আমি আপনার নাম ধরে ডাকছি, আপনার কথা শুনতে চাইছি। আপনি আমায় ফিরিয়ে দিবেন? কথা বলবেন না আমার সাথে? এমন করছেন কেন আপনি আমার সাথে?”

উৎসা একটু থামলো। অতঃপর আবার বলা শুরু করলো,
“আপনি আমায় ইচ্ছে করে জ্বালাচ্ছেন তাই না? আমি আপনাকে এতদিন জ্বালিয়েছি বলে আপনিও আমায় জ্বালাচ্ছেন তাই না? যেই বুঝছেন আমি আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে গেছি সেই আমায় জ্বালানো শুরু করেছেন তাই না? আপনি আমাকে যতো ইচ্ছে জালান, তবুও উঠুন, কথা বলুন আমার সাথে। এই মেহরাব, শুনছেন? উঠুন না”

উৎসা এবার মাহিনের কাছে গেল। মাহিন পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। উৎসা মাহিনের কাছে যেয়ে অভিযোগের সুরে বলল,
“ভাইয়া তোমার ভাইকে উঠতে বলো। ওনাকে আমার সাথে কথা বলতে বলো। তুমি না বলেছো তোমার ভাইকে বোকে দিবে? উনি কেন আমার সাথে কথা বলছেন না সেটা জিজ্ঞেস করো। ভাইয়া বলো না ওনাকে উঠতে, আমার সাথে কথা বলতে”

মাহিন কিছু বলতে পারলো না। তবুও অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে কোনো মতে বলল,
“উৎসা বোন আমার, পা*গলামো করে না। একটু শান্ত হও। শুনলে তো ডক্টর কি বলল”

উৎসা চিৎকার করে বলে উঠলো,
“ডক্টরের কি বলেছে? ওনার কথা আমি মানি না। মিস্টার মেহরাবের কিছু হতে পারে না। তোমার ভাই ইচ্ছে করে আমায় জ্বালাচ্ছে। একটু পর দেখবে উনি উঠবেন, আমার সাথে কথা বলবেন। ওনার কিছু হয়নি। উনি কলে আমায় বলেছে উনি সকাল সকাল আমার কাছে চলে আসবে। উনি ওনার কথা রাখবে। তোমার ভাইয়ের কিছু হতে পারে না, কিছু হতে না ওনার”

উৎসা পা*গলামো করছে। পা*গলের ন্যায় আচরণ ওর। কোনো উন্মাদ সত্ত্বা যেন ভর করছে ওর ওপর। উৎসা যেন ওর মাঝে নেই। পা*গলের ন্যায় প্রলাপ বকছে,
“ওনাকে আমার কাছে ফিরতেই হবে। ওনার কিছু হতে পারে না, পারে না ওনার কিছু হতে”

বলতে বলতে উৎসার কণ্ঠে ক্ষীণ হয়ে আসে। শরীর আর সায় দিচ্ছে না। চোখ গুলো কান্না করতে করতে বুজে এসেছে, শরীর সকল ভার ছেরে দিতে চাইছে। ক্লান্তি এসে ভর করছে শরীরে। উৎসা নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলো। তবে ব্যার্থ হলো। ধীরে ধীরে ঢোলে পড়ে যেতে নিলো। উৎসা পড়ে যেতে নিলে কেউ একজন দূর থেকে দৌড়ে এলো। পড়ে যাওয়ার আগেই নিজের প্রেয়সীকে বুকে আগলে নিলো।
————
শুভ্র রঙা হসপিটালের বেডে অবচেতন হয়ে পড়ে আছে উৎসা। মেয়েটার জ্ঞান ফিরার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। স্যালাইন চলছে। কেটে গেছে দুটো ঘন্টা। তবুও উৎসার জ্ঞান ফিরার কোনো লক্ষণই নেই। একই ভঙ্গিতে পড়ে রয়েছে হসপিটালের বেডে।

একটু দূরে সোফায় বসে আছে এক মানব। মুখে তার চিন্তার রেশ। কপালে পড়েছে বেশ কয়েকটা ভাঁজ। দুই হাতের ওপর ভর করে থুতনি রেখে সেই কখন থেকে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। নাহ! মেয়েটার জ্ঞান ফিরার কোনো নামই নেই। মানব আর ধৈর্য ধরতে পারলো না। হন্ত দন্ত হয়ে চিৎকার করে ডাকলো নার্স কে। সেকেন্ডের ব্যাবধানে একজন নার্স এসে তার সামনে দাঁড়ালো। মানব গম্ভীর কণ্ঠ অধৈর্য নিয়ে একবার হাতে থাকা ঘড়ির দিকে দৃষ্টি দিয়ে সুধালো,
“ওর এখনো জ্ঞান ফিরছে না কেন? দুই ঘন্টা হয়ে গেছে, এখনো কেন জ্ঞান ফিরছে না?”

শেষের কথাটা যেন একটু ধমক দিযেই জিজ্ঞেস করলো। নার্স কেঁপে উঠলো। তোতলানো স্বরে বলল,
“আপনি চিন্তা করবেন না স্যার, খুব শীঘ্রই ম্যামের জ্ঞান ফিরবে। আপনি একটু অপেক্ষা করুণ”

“খুব শীঘ্রই, খুব শীঘ্রই করতে করতে দুই ঘন্টা কেটে গেল। আর কতো অপেক্ষা করবো?”

মানবের চিৎকারে বাহির হতে মাহিন ছুটে এলো। বলল,
“শান্ত হ, উৎসার জ্ঞান ফিরবে। এখানে তো ওনাদের কোনো দোষ নেই। শুধু শুধু ওনাদের ওপর রাগ ঝাড়ছিস কেন?”

“রাগ ঝাড়বো না তো কি করবো? তুমি বুঝতে পারছো আমার বউ দুই ঘন্টা যাবত অজ্ঞান হয় আছে আমার অনুভূতি কেমন? পা*গল,পা*গল লাগছে আমার। বুকের ভেতর যন্ত্রনা হচ্ছে। মেয়েটা না জানি কি অবস্থায় ছিলো সে সময়!”

দুটোই পা*গল! একজনের থেকে আরেকজন কম না। মাহিন ইশারায় নার্স কে চলে যেতে বলল। নার্স চলে যেতেই শান্ত কণ্ঠে বলল,
“শান্ত হ, খুব শীঘ্রই উৎসার জ্ঞান ফিরবে। মিলিয়ে নিস আমার কথা”

মাহিন যেভাবে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই চলে গেল। মানব একপা একপা করে এগিয়ে গিয়ে বেডের পাশে বসলো। অতঃপর হাতের মুঠোয় পুড়ে নিলো প্রেয়সীর হাত। চুমু খেল হাতের উল্টো পিঠে। অতঃপর হাত খানা স্পর্শ করালো বুকে। এতক্ষনে বুকে কিছু টা শান্তি লাগছে।

————

চোখের পাতা কাঁপছে। উৎসার জ্ঞান ফিরে এসেছে। পিট পিট করে চোখ খোলার চেষ্টা করলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো পুরুষালি বুক। আশেপাশে তাকিয়ে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলো। নিজেকে পুরুষালি আলিঙ্গনে আবিষ্কার করতেই চমকে উঠলো। কে এই পুরুষ? ওকে এভাবে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরেছে কেন ? ধড়ফড় করে উঠে বসতে চাইলো উৎসা। তবে পারলো না। ব্যার্থ হয়ে পড়ে গেল পুরুষটির বুকে। উৎসা ছুটোছুটি শুরু করলো। পুরুষটির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো যেন। নিশ্চিন্তে একটু চোখ বুজে ছিলো। ঘুমের রেশ না কাটিয়েই বলল,
“ব্যাঙের মতো লাফালাফি না করে একটু ঘুমাতে দেও তো”

উৎসা থমকে গেল। ও কানে ঠিক শুনলো তো! নাকি ভ্রম? মনে করার চেষ্টা করলো জ্ঞান হারানোর আগের স্মৃতি। একটু চেষ্টা করতেই স্মরণ হতো বী*ভৎস ঘটনা। উৎসার ভিতরটা নড়ে উঠলো। এটা কি সত্যি? নাকি ওর স্বপ্ন বা কল্পনা? ও ঠিক শুনলো তো? নাহ কল্পনা হওয়ার সুযোগ নেই। মানুষটা এখনো ওকে শক্ত আলিঙ্গনে জড়িয়ে রেখেছে। উৎসার বিশ্বাস হলো না। মানুষটাকে ঠেলতে ঠেলতে বলল,
“কে আপনি? পর নারীকে এভাবে জড়িয়ে ধরতে লজ্জা লাগছে না! ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি। অ*সভ্য লোক!”

উৎসার যন্ত্রনায় মানুষটা উঠে বসলো। ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলল,
“নিজের তিন কবুল পড়া বউকে জড়িয়ে ধরেছি, কোনো পর নারীকে না”

মানুষটা উঠে একদম উৎসার বরাবর বসলো। এতক্ষন মানুষটার মুখ দেখা যায়নি। এখন পুরা পুরি ভাবে স্পষ্ট। উৎসা থমকে গেল। ওর মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না। কাঙ্খিত মানুষটাকে এতো প্রতীক্ষার পর নিজের দুচোখের সামনে দেখে ওর কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। হারিয়ে ফেলেছে কথা বলার ভাষা। সকল কথা যেন গলায় আটকে গেছে। নিশ্চল চোখে নিস্পলক ভাবে চেয়ে রইলো সামনে বসা পুরুষটির দিকে। উৎসার এক বারের জন্য মনে হচ্ছে মানুষটা সত্যি সত্যি ওর সামনে বসে আছে পরক্ষনেই সেই সময়ের বি*ষাক্ত ঘটনা মনে পড়তেই মনে হচ্ছে এটা ওর কল্পনা। ও মনে হয়তো স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে আগের সব ঘটনা পুনরাবৃত্তি হবে। মনের মাঝে এক রাশ আশঙ্কা নিয়ে দুরু দুরু কাঁপতে থাকা বুকে সাহস জুগিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো মেহরাবের পানে। উৎসার হাত কাঁপছে। যেমন তেমন ভাবে না অসম্ভব রকম কাঁপছে মেয়েটার হাত। উৎসা কাঁপা কাঁপা হাত নিয়ে রাখলো মেহরাবের গালে। মেহরাব বুঝতে পারলো উৎসার মাঝে বয়ে চলা ঝড়ের অস্তিত্ব। উৎসা কম্পনরত কণ্ঠে বলল,
“আপনি?”

“হ্যাঁ, আমি। আমি ছাড়া অন্য কারো থাকার কথা ছিলো নাকি?”

উৎসার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে মেহরাব ওর সামনে বসে আছে। লোকটার বিখ্যাত সেই ত্যাড়া কথা বলার ধরণ। সোজা কথা যেন তার মুখ দিয়েই বের হয়না। উৎসা ফের বলল,
“আপনি কি সত্যিই আমার সামনে বসে আছেন? নাকি এটা আমার স্বপ্ন বা কল্পনা? আপনি আবার উধাও হয়ে যাবেন না তো! ঘুম ভেঙ্গে দেখবো আপনি নেই। আশেপাশটা ফাঁকা মরুভুমির ন্যায় ধু ধু করছে। এটা কি সত্যিই আপনি মিস্টার মেহরাব? নাকি আমার ভ্রম?”

মেহরাব মেয়েটার আকুলতা বুঝলো। মাহিন একে একে উৎসার পা*গলামো কাণ্ড সব ওকে বলেছে। মেহরাব চুপচাপ কেবল শুনেই গেছে সেই কাহিনী, এখন যেন নিজের চোখেই প্রেয়সীর উন্মাদনা দেখছে, তার সাক্ষী হচ্ছে। আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠলো মেহরাবের হৃদয়। তবে উৎসার কথা ভাবতেই আনন্দ মাটি চাপা পড়ে গেল। মেয়েটা এখনো একটা ঘোরের মাঝে আছে। আগে ওকে ঘোর থেকে বের করে আনতে হবে, জানাতে হবে মেহরাবের অস্তিত্ব। মেয়েটাকে আগে স্বাভাবিক করা জরুরি। মেহরাব প্রতি উত্তরে বলল,
“তুমি কোনো ভুল দেখছো না। এইযে আমি, স্বশরীরে তোমার সামনে বসে আছি। তোমার মিস্টার মেহরাব তোমার সামনে বসে আছে মিসেস মেহরাব”

উৎসার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। আরেকবার অবিশ্বস্য কণ্ঠে সুধালো,
“এটা সত্যিই আপনি তো!”

মেহরাব ধৈর্য সহ কারে উত্তর করলো,
“হ্যাঁ, আমিই। এতে একটুও ভুল নেই আর না তুমি স্বপ্ন দেখছো। বলেছিলাম না সকাল হতেই তুমি নিজেকে আমার বুকে আবিষ্কার করবে? আমার কথা মিললো তো?”

উৎসা ঝাঁপিয়ে পড়লো মেহরাবের প্রশস্ত বুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মেহরাব কে। হঠাৎ এমন আক্রমণে মেহরাব একটু পিছিয়ে গেল। ও ভাবেনি হুট করে উৎসা এমন আক্রমণ করে বসবে। নিজেকে সামলে নিয়ে ও নিজেও উৎসাকে জড়িয়ে ধরলো। উৎসা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে মেহরাব কে, যেন ছেড়ে দিলেই মেহরাব আগের ন্যায় হারিয়ে যাবে। সেই ভয় মেয়েটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। জড়িয়ে ধরা অবস্থায় উৎসা বলা শুরু করলো,
“আপনি সেই সময় কথা বলছিলেন না কেন? এমন চুপ করে গিয়েছিলেন কেন? জানেন কতবার ডেকেছিল আপনাকে? আপনি একটা পাষান! এতবার ডাকার পরও একবারও সারা দেন নি। উল্টো আমায় কিভাবে আরো জ্বালানো যায় সেই ফন্দি এটে বসেছেন। আপনি জানেন সেই সময় আমার কেমন অনুভূতি হছিলো? ডাক্তার যখন বলল পেশেন্ট কে বাঁচানো যায়নি শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। হাত বা অবশ হয়ে যাচ্ছিলো। মস্তিষ্ক কাজ করছিল না। কেমন অনুভূতি হয়েছে বলে বোঝানোর মতো না। আপনি পাষান মানুষ, আপনি বুঝবেন না। ইচ্ছে করে জ্বালিয়েছেন আমায়। আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই। ছাড়ুন, ছাড়ুন আমায়”

উৎসা ছাড়ানোর জন্য মোচড়া মুচরি করলো। কিন্তু মেহরাব ছাড়লো না। আর না একচুল নড়তে দিলো। একই ভাবে মিশিয়ে রেখে বলল,
“কার এতো সাহস বলো যে তোমায় জ্বালাবে? মেহবারের মিসেসকে কে জ্বালায়েছি শুনি?”

উৎসা গাল ফুলিয়ে বলল,
“কে আবার? আপনি”

অবাক হওয়ার ভান করে মেহরাব বলল,
“আমি? আমি আবার কি করলাম?”

উৎসা চোখ পাকিয়ে বলল,
“এতো কাণ্ড ঘটানোর পর বলছেন আপনি কি করলেন? আমি ভাবলাম কি না কি হলো? টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছিলো এখানে এসে দেখি সাহেব দিব্যি আছে, আমায় দুশ্চিতায় রাখার পয়তারা সব”

মেহরাব উৎসাকে নিজের থেকে সরালো। ইশারায় কপাল ইঙ্গিত করে বলল,
“তোমার কি মনে হয় আমি ইচ্ছে করে এতো কিছু করেছি? তোমায় টেনশনে রেখেছি?”

উৎসা মেহরাবরের ইশারায় তাকালো না, মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ভেংচি কেটে বলল,
“তা নয় তো কি?”

মেহরাব উৎসার থুতনিতে হাত রেখে ওকে নিজের দিকে ফিরালো। অতঃপর বলল,
“এরপর ও বলবে আমি তোমায় ইচ্ছে করে কষ্ট দিয়েছি?”

উৎসা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মেহরাবের দিকে। চোখ গিয়ে আটকালো মাথার ব্যান্ডেজের দিকে। উৎসা এতক্ষন খেয়ালই করেনি। ও তো ব্যাস্ত ছিলো মানুষটার অস্তিত্ব প্রমান করতে। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো মেহরাবের ব্যান্ডেজ। পুরো কপালে ছেয়ে আছে শুভ্র রঙা ব্যান্ডেজে।
“ব্যথা করছে?”

“এতক্ষন করছিলো। প্রেয়সীর ছোঁয়া পেয়ে ব্যাথা প্রশমিত হয়ে গেছে”

“অ*সভ্য লোক”

উৎসার কথায় হো হো করে শব্দ করে হেসে উঠলো মেহরাব। উৎসা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেহরাবের প্রাণ খোলা হাসির দিকে। মানুষটাকে এভাবে খুব কম হাসতে দেখেছে উৎসা। মেহরাব শব্দ করে কমই হাসে। ওর হাসি হলো মুচকি হাসি। ঠোঁট এলিয়ে হাসবে সব সময়। উৎসা মুগ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আপনি সব সময় এভাবেই হাসবেন মেহরাব। আপনাকে হাসলে ভীষণ সুন্দর লাগে”

মেহরাব ঝুঁকলো উৎসার দিকে। বলল,
“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ”

“বউ যেহেতু বলেছে তাহলে তো হাসতেই হবে। তার সকল আবদার সার আখো পার”

একটু থেমে কিছু মনে পড়তেই তড়িৎ গতিতে বলে উঠলো,
“এক মিনিট! এক মিনিট! তুমি আমায় নাম ধরে ডাকলে? আমি কি ঠিক শুনলাম?”

উৎসা ভরকে গেল। কি ভুল করেছে বুঝতেই জিভে কামড় দিলো। কথা ঘুরাতে বলল,
“কই? আমি তো আপনাকে নাম ধরে ডাকিনি। আপনি বোধ হয় ভুল শুনেছেন”

মেহরাব দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“উঁহু, আমি ভুল শুনিনি। আমি ঠিক শুনেছি। এখন তুমি স্বীকার করো”

“বললে বলেছি, এখন সে কথা বাদ দিয়ে কি হয়েছে সেটা বলুন। কথা বলছিলেন না কেন আপনি? এরপর কতবার কল দিয়েছি জানেন?”

মেহরাব বলা শুরু করলো,
“কাল তোমার সাথে যখন কথা বলছিলাম এমন সময় সামনে তাকিয়ে দেখি একটু দূরেই একটা বড় সর ট্র্যাক ধেয়ে আসছে আমার দিকে। সম্ভবত ট্রাকের ড্রাইভার ড্রাঙ্ক ছিলো। আকিয়ে বাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলো। ঔ মুহূর্তে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ট্র্যাক টা যখন আমার গাড়ি থেকে গুনে গুনে ১০ হাত দূরে সেই সময় স্তম্ভিত ফিরে আসে আমার। সাথে সাথে স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি রাস্তার একপাশে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। সামনে ছিলো গাছ। ট্রাকের দিকে খেয়াল রাখতে গিয়ে সেটা খেয়াল করিনি। ফল স্বরূপ গাছের সাথে জোরে সরে ধাক্কা লাগে। স্টেয়ারিংয়ের সাথে মাথা যেয়ে আঘাত লাগে। সাথে সাথে আমি জ্ঞান হারাই। এরপর কি হয়েছে কিছুই জানি না আমি”

মেহরাব একটু থামলো। অতঃপর বলল,
“জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে আবিষ্কার করি হসপিটালের বেডে। মাথাটা চিনচিন করছিলো। মনে পড়লো সেই সময়ের কথা। নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলাম। আশেপাশে কেউ নেই। কয় ঘন্টা পরে জ্ঞান ফিরেছে সেটাও জানি না। কেবিন থেকে বেরিয়ে হসপিটলের করিডর ধরে এগিয়ে আসতে নিলে শুনতে পাই অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর। তুমি আহাজারী করছো। তোমার কণ্ঠ শুনে একবার নিজের মনের ভ্রম ভেবে উড়িয়ে দেই। তারপর কি যেন মনে করে আবার এদিকে আসি। চোখ পরে ধীরে ধীরে ঢোলে পরে যাওয়া তোমার দিকে। সাথে সাথে দৌড়ে আসি। তুমি ততক্ষনে জ্ঞান হারিয়েছো। তোমায় কেবিনে এনে স্যালাইন দেওয়া হয়। তারপরের ঘটনা তো তুমি জানো। এখন আমি তোমার সামনে”

উৎসা হা করে তাকিয়ে মেহরাবের কথা শুনছিলো। এতো ঘটনা ঘটে গেছে বিগত কয়েক ঘন্টায়। উৎসা কিছু মনে পড়তেই জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার ফোনে কোথায়?”

মেহরাব পকেটে খুজলো ফোন। কিন্তু পেল না। অতঃপর মনে পড়লো ড্রাইভিং করায় ফোন গাড়ির সামনে রেখে কথা বলছিলো। বলল,
“হয়তো গাড়ির মধ্যে কোথাও পরে গেছে”

উৎসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ফোন যেদিকে যায় যাক। আপনি সহি সালামতে আছেন এই অনেক”

এর মাঝে দরজায় নক করলো কেউ। উৎসা ছিটকে দূরে সরে গেল মেহরাবের থেকে। মাহিন এসেছে। দাঁত কেলিয়ে বলল,
“মিস্টার এন্ড মিসেস মেহরাব! আপনাদের কথা শেষ হলে আমরা বাসায় যেতে পারি? অনেক ক্ষণ হলো তো! বাসায় সবাই নিশ্চই টেনশন করছে”

উৎসা মেহরাব একসাথে মাথা নেড়ে সায় জানালো। তিনজন বেরিয়েছে পড়লো। কিছুটা এগিয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে যেতেই নজরে এলো কন্দরত কিছু অপরিচিত মুখ। মাহিন জানালো এরা ট্র্যাক ড্রাইভারের বাড়ির লোক। ট্র্যাক যেয়ে ধাক্কা খায় খাম্বার সাথে। ছেলেটার অবস্থা খারাপ ছিলো। রাত হওয়ার সেই রাস্তা দিয়ে তেমন গাড়ি চলাচল করছিলো না। তাই ছেলেটাকে হসপিটালে আনতে দেরি হয়ে গেছে। ছেলেটার বাড়ির লোকের কান্নার শব্দে উৎসার কলিজা খামচে ধরলো। মনে পড়ে গেল কয়েক ঘন্টা আগে করা নিজের আহাজারির কথা। কিছুক্ষন আগেও হুবহু এই একই পরিস্থিতিতে ছিল উৎসা। ও হারে বুঝতে পারছে প্ৰিয় মানুষ হারিয়ে যাওয়ার বেদনা। উৎসা মেহরাবের সাথে সেটে গেল। শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরলো মেহরাবের হাত। মেহরাব বুঝল মেয়েটার ভীতি,নিজেও উৎসাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। পা বাড়ালো সামনের দিকে।
————

দেখতে দেখতে কেটে গেছে অনেক গুলো দিন। মেহরাব এখন পুরোপুরি সুস্থ। মাথার ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে পনেরো দিনের মাথায়। মেহরাবের সুস্থতার পিছনে উৎসার অবদান অনেক বেশি। মেয়েটা সব ভুলে এক মনে মেহরাবের সেবা যত্ন করেছে। সালেহা বেগম বলে বেড়ান উৎসার সেবা যত্নেই নাকি তার ছেলে এতো তাড়াতাড়ি সেরে উঠেছে। উৎসার হাত দুটো নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলেছেন,
“এভাবেই আমার ছেলেটাকে ভালোবেসে আগলে রাখিস মা। আমার পরে আমার ঘাড়ত্যাড়া ছেলেটাকে শুধু মাত্র তুই আগলে রাখতে পারবি। তুই ছিলিস বলেই ও এতো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেছে। স্বয়ং আমিও হয়তো ওর এতটা খেয়াল রাখতে পারতাম না যতোটা তুই রেখেছিস। তুই ওকে ছেড়ে কোথাও যাস না। তোকে ও অনেক ভালোবাসে”

মায়ের মুখের ছেলের ভালোবাসর কথা শুনে লজ্জা পেল উৎসা। উৎসাকে লজ্জা পেতে দেখে সালেহা বেগম হাসলেন। মাথায় হাত রেখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“এভাবেই দুজন সব সময় একে অপরকে ভালোবেসে আগলে রাখিস”

উৎসা সেদিন লজ্জায় সালেহা বেগমের সামনে থেকে উঠে আসে। ও উতঠে আসতেই সালেহা বেগম শব্দ করে হেসেই ফেলেন। হাসতে হাসতে বলেন,
“পা*গলী মেয়ে একটা”

ঘড়ির কাঁটা বারোর ঘর পেরিয়ে গেলেই মেহরাবের জন্মদিন। উৎসা অনেক কিছু প্ল্যান করেছে। প্ল্যান মাফিক সব আয়োজন করেছে। এখন শুধু কাঙ্খিত ব্যাক্তির অপেক্ষা। মেহরাব এলো আট টা নাগাদ। উৎসা ওকে কিছুই বুঝতে দিলো না। রাত বারোটা নাগাদ টেনে টুনে ছাদে নিয়ে এলো। সবাই একসাথে উইশ করলো মেহরাবকে। সবাই মিলে কেক কেটে খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষে রুমে ফিরলো উৎসা। মেহরাব মাহিনের সাথে কি নিয়ে যেন কথা বলছে।

উৎসা এসে দাঁড়ালো ব্যালকনিতে। আকাশে থালার ন্যায় পূর্ণিমার চাঁদ জ্বল জ্বল করছে। একটু পর পর হিমেল হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে উৎসার শরীর। আবেশে চোখ বুজে নিলো উৎসা। খানিক বাদে ব্যালকনিতে পা রাখলো মেহরাব। মেহরাবের উপস্থিতি টের পেতেই চোখ খুলে তাকালো উৎসা। মেহরাব এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো উৎসাকে। মুখ নামিয়ে উৎসার কানের লতিতে আলতো করে চুমু দিলো। উৎসা কেঁপে উঠলো মেহরাবের ছোঁয়ায়। মেহরাব ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমার গিফ্ট কোথায় মিসেস মেহরাব?”

“গিফ্ট? আমি তো কোনো গিফ্ট আনিই নি”

“সেটা বললে তো হবে না। আমার গিফ্ট চাই, চাই মানে চাই”

“না দিলে হবে না?”

মেহরাব ঠোঁট উল্টে বলল,
“উঁহু”

“চোখ বন্ধ করুণ”

মেহরাব বিনা বাক্য ব্যায় করে চোখ বুজলো। উৎসা পা উঁচু করে মুখটা মেহরাবের কান বরাবর নিলো। অতঃপর ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
“ভালোবাসি মিস্টার মেহরাব। কখন, কিভাবে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি নিজেও জানি না। তবে এইটুকু জানি আপনাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছি। “অপ্রিয়” বলতে বলতে কখন যে আপনি আমার জীবনের সব চেয়ে “প্ৰিয়” মানুষটার স্থান দখল করে বসেছেন আমি নিজেও জানি না। তবে আপনাকে ভালোবাসি কখন অনুভব করলাম জানেন?”

মেহরাব প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো উৎসার পানে। উৎসা থেমে বলল,
“যখন আপনি কথা বলছিলেন না, আপনার সারা পাচ্ছিলাম না তখন নিজেকে উন্মাদ উন্মাদ লাগছিলো। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হচ্ছিলো আপনি ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমার বেঁচে থাকার জন্য হলেও আপনাকে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে আমার চাই। চাই মানে চাই। সেই মুহূর্তে যেয়ে অনুভব করলাম আপনি নামক মানুষটাকে আমি কতোটা ভালোবেসে ফেলেছি। আপনি ছাড়া আর কোনো চিন্তায় আমার মাথায় আসছিলো না। শুধু মাত্র আপনি ছিলেন আমার সকল চিন্তার কারণ”

উৎসা একটু থেমে বুকে ভরে শ্বাস নিলো। ফের বলল,
“ভালোবাসি”

মেহরাব এতক্ষন এক মনে শুনছিলো উৎসার অনুভূতি। উৎসা থামতেই ধ্যান ভাঙলো। অতঃপর বুকে হাত দিয়ে বলল,
“আপনার মুখে ভালোবাসি শব্দ টা শুনতে পেরে আমি ধন্য মিসেস। এটা আমার জন্মদিনের সেরা গিফ্ট”

উৎসা কপাল কুঁচকে নিলো। কোমরে হাত গুঁজে বলল,
“ধন্য হলে হবে না, আমার রিপ্লাই কোথায়?”

“রিপ্লাই! কিসের রিপ্লাই?”

“একটু আগে যেটা বললাম তার”

মেহরাব মাথায় খাটালো। মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
“ও আচ্ছা দাড়াও বলছি”

উৎসা অধির আগ্রহে মেহরাবরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরাব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“আমিও”

উৎসা কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলো,
“আমিও কি?”

“আমিও ভালোবাসি”

উৎসা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ঠোঁট উল্টে বলল,
“এভাবে বললে হবে না”

মেহরাব উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো। থুতনি নিয়ে রাখলো উৎসার ঘাড়ে। অতঃপর কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলল,
“আমিও আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসি মিসেস মেহরাব”

থেমে জিজ্ঞেস করল,
“এবার ঠিক আছে?”

উৎসা মাথা নেড়ে সায় জানালো। অতঃপর ফিক করে হেসে দিলো। উৎসার সাথে সাথে মেহরাব ও হেসে দিলো। উৎসার হাসির শব্দ ঝংকার তুলেছে মেহরাবের বুকে। দূরের ওই আকাশের আর চন্দ্র ও যেন হেসে উঠলো ওদের সাথে। সাক্ষী হলো কপোত কপোতীর স্নিদ্ধ ভালোবাসার।

~সমাপ্ত ~