অপ্রিয় মাস্টার পর্ব-০২

0
274

#অপ্রিয়_মাস্টার
পার্ট [০২]
#লেখিকা_ফারহানা_নিঝুম

এই হাড় কাঁপানো শীতে কলেজ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কন্ঠ এবং রিয়া, অপেক্ষা করছে দু’জনে। এখনও কলেজের গেইট পর্যন্ত খোলা হয়নি, কন্ঠ বোকা বোকা মুখ নিয়ে জিজ্ঞাস করে।

” দেখলি তো রিয়া আজকে কলেজ অফ আর আমাদের কেউ বলেইনি।”

রিয়া কন্ঠের মাথায় হালকা ধা’ক্কা দিয়ে বলে।

” আরে বোকা মেয়ে কলেজ অফ নয়, আমরাই সবার আগে চলে এসেছি।”

ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে কন্ঠ। কিছুক্ষণ পরেই দাড়োয়ান এসে কলেজ গেইট খুলে দেয়,ওরা ভেতরে যায় কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকতেই দেখতে পায় হিয়া বড় বড় বিল্ডিং। কন্ঠ বড় বড় চোখে আশেপাশে তাকিয়ে রিয়া কে চেঁচিয়ে বলে উঠে।

” রিয়া রে হিয়া বড় বড় বিল্ডিং আচ্ছা কয় তালা হতে পারে বল তো?”

রিয়া দাঁতে দাঁত চে’পে ধরে।

‘ হইইইইইইই আচ্ছা তোর কী চোখ নেই?কয় তালা তা গুনতে পারিস না?”

কন্ঠ বোকা বোকা চাউনি দিয়ে রিয়া কে বলে।

” রাগ করিস কেন?”

নতুন ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় নবীনদের, কিন্তু এসবের মধ্যে বেশ ক্লান্ত লাগছে কন্ঠ এবং রিয়া কে।সেই সকালে ওরা এসেছে সব কিছু আয়োজন করতে করতে এগারোটা বেজেছে আর অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে তিনটে।এর মধ্যে এখনও দুজনের পেটে কিছুই পড়েনি।

বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই চোখ দুটো সামনের দিকে স্থির হয়ে গেল কন্ঠের, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুঠামদেহী পুরুষ কে দেখে বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো তার। গায়ের রং ততটা ফর্সা না হলেও বেশ সুন্দর, মুখশ্রী জুড়ে গভীরতা।পরনে হারকা ধূসর রঙের শার্ট,হাতা গুলো কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রেখেছে।
চোখে চোখ পড়তেই পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কন্ঠ,ভুলেই গেছে সে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি তাকেই দেখছে।
তূর্য খান স’রু দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে কন্ঠ কে,ব্যাপারটি বুঝতে পেরে চোখ সরিয়ে নেয় কন্ঠ।

” কন্ঠ ওই দেখ কলেজের সবথেকে গম্ভীর প্রফেসর তূর্য খান।”

রিয়ার কথা শুনে কন্ঠ বুঝতে পারলো এই সেই স্যার যার কথা আসার পর থেকেই শুনে যাচ্ছে।


” নতুন করে সংসার করার স্বপ্ন আমার নেই, তাই তুমি যদি বিয়ের কথাটা না বলো তাহলেই আমি খুশী হবো মা।”

তুফায়েল অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছে মাত্র,এসেই সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তার, ইদানিং অফিসে বেশ চাপ নিতে হচ্ছে তাকে।যত কাজ সব তার উপর,আর কত আহাদ আহমেদ এবং সাহাদ আহমেদ কে পেশার দেওয়া যায়?ছেলে হিসেবে এখন তো সবটা তাকেই দেখতে হবে।মাথাটা বেশ ধরেছে আজ, তাই হাতের ওয়াশ খুলতে খুলতে আনিকা আহমেদ কে বলে।

” মা এক কাপ কফি দাও তো, খুব মাথা ব্যথা করছে।”

তনয়া আহমেদ কফি বানিয়ে তুলে দেয় আনিকার হাতে, উনি নিয়ে গিয়ে কফি কাপ দিলেন তুফায়েল কে।এরই মধ্যে বলে বসলেন বিয়ের কথা। ওনার পছন্দের এক মেয়ের ছবি তার সামনে ধরতেই চোখ মুখ শক্ত করে নেয় তুফায়েল, অতঃপর উপরোক্ত কথা বলে উঠে।
আনিকা আহমেদ তুফায়েল কে বোঝানোর উদ্দেশ্য করে বলে।

“‌ দেখ বাবা জীবন তো আর থেমে থাকে না কারো জন্য?তোরও নেই হয়তো ওর-ও নেই, তাহলে তুই কেন মুভ অন করতে চাইছিস না?”

তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় তুফায়েল,কে বলছে এসব কথা?তার-ই মা, আচ্ছা মায়ের জন্যেই তো আজ তার জীবন থমকে গেছে।

তুফায়েল ম্লান হেসে বলে।

” তুমি এই কথা গুলো বলছো মা?জানো আজকে আমার এই অবস্থার জন্য ক্ষনিকটা নয় পুরোপুরি দায়ী তুমি। আচ্ছা বলতে পারবে কী দোষ ছিল আমার?”

নিশ্চুপ ভঙি’মায় মাথা নিচু করে নেয় আনিকা আহমেদ, তপ্ত শ্বাস ফেলে সুট হাতে তুলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
রুমে গিয়ে গা এলিয়ে দিল বিছানায়, চোখের কোণে থেকে গড়িয়ে পড়ল। চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় তুফায়েল,হাতে লাল রঙের বাহারি কাঁচের চুড়ি ,ছম ছম আওয়াজ হচ্ছে।ফট করে বিছানায় উঠে বসে তুফায়েল,কপালে জমা হয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
___________

স্টাডি রুমে বসে অফিসের কিছু কাজ নিয়ে আলোচনা করছে আহাদ আহমেদ এবং সাহাদ আহমেদ, দু’জনেই ভাবছে নেক্সট উইক তুফায়েল কে কিছু প্রজেক্টের কাজে মালয়শিয়া যেতে হবে হয়ত।
চায়ের ট্রে নিয়ে হাজির হয় নীলা,দরজায় টোকা দিতেই আহাদ আহমেদ নীলা কে আসতে বলে।
ভেতরে প্রবেশ করে নীলা।

অধরে হাসি টেনে বলে

” তোমাদের জন্য চা এসে গেছে,এই যে এটা চাচার জন্য।”

নীলা আহাদ আহমেদের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে এরপর নিজের বাবা সাহাদ আহমেদের হাতে চায়ের কাপ দেয়।

আহাদ আহমেদ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন।

” থ্যাংক ইউ মা, সত্যি এখন এটার খুব প্রয়োজন ছিল।”

নীলা শব্দ করে হেসে বলে।

” জানতাম তো তোমাদের এখন এটা খুব প্রয়োজন, আচ্ছা তোমরা কাজ করো ডিস্টার্ভ করব না।”

নীলা ট্রে নিয়ে বেরিয়ে গেল,সাহাদ আহমেদ আহাদ আহমেদ কে উদ্দেশ্য করে বলে।

” মেয়েটা কবে যে বড় হয়ে গেলো বুঝতেই পারিনি।”

আহাদ আহমেদ বলেন।

” মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠে, এখন তো দেখছি আমাদের নীলা মায়ের জন্য পাত্র দেখতে হচ্ছে।”

সাহাদ আহমেদ চায়ের কাপ সেন্টার টেবিলের উপর রেখে বলেন।

” হ্যা ভাইয়া সেটা তো ঠিক আছে কিন্তু আমার ছেলেটা?”

আহাদ আহমেদ তপ্ত শ্বাস ফেলে বলেন।

” চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।”

রান্না ঘরে ট্রে রেখে যেই মাত্র বের হতে যাবে তখুনি আনিকা আহমেদ নীলা কে থামিয়ে বলে।

” নীলা তুই এখন কোথায় যাচ্ছিস?”

নীলা ম্লান হেসে বলে।

” মা আমাকে স্কুলে যেতে হবে তুমি বোধহয় ভুলে গেছো?”

আনিকা আহমেদ ভ্রুকুটি করে বলেন।

” আমাদের কী কিছু কম আছে যে তোকে অন্যের চাকরি করতে হয়?বয়স তো কম হয়নি,দু দিন পর বিয়ে দিতে হবে।আর তুই এখন বাইরে বাইরে টই টই করে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করবি না?”

নিচের দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে নীলা, মায়ের কথা শুনলে হয়তো তার জীবনও বড় ভাই তুফায়েলের মত হবে, কিন্তু সে এমন কিছুই ঘটতে দেবে না। অতঃপর শান্ত কন্ঠে আনিকা আহমেদ কে উদ্দেশ্য করে বলে নীলা।

” মা আমাদের একটু একা ছাড়বে? আমরা জানি তুমি মা হও তোমার চিন্তা থাকে,তুমিও ছেলেমেয়েদের ভালো চাও। কিন্তু এসব করতে গিয়ে যে সবটা আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছো সেটা কী বুঝতে পারছো?”

কুঁচকে যাওয়া ভ্রু আরো কুঁ’চকে বলেন আনিকা।

” এখন কী তুইও তোর ভাইয়ের মত আমাকে জ্ঞান দিবি?”

হঠাৎ মিষ্টি মুখে ঢুকিয়ে দেয় তনয়া আহমেদ,পাশে তাকিয়ে তনয়া কে দেখে হকচকিয়ে গেল আনিকা আহমেদ।নীলার মুখেও একটা মিষ্টি পু’রে দিয়ে যেতে বলে তনয়া।

” গেলাম চাচী,বাই।”

আনিকা আহমেদ আরো কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু মুখে মিষ্টি থাকার কারণে কিছু বলতে পারল না। নৈঃশব্দ্যে হাসলেন তনয়া, এখন এটা না করলে কথায় কথা বাড়তো।

ক্লাসের এক পাশে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে কন্ঠ এবং রিয়া, কলেজের কাউকেই তো তেমন একটা চেনে না তাই একটু বিব্রত বোধ করছে দুজনেই। হঠাৎ তড়িৎ গতিতে দু তিনটে মেয়ে এবং দুটি ছেলে এসে ওদের বেঞ্চে বসে পড়ল। ওদের মধ্যে একটি মেয়ে উঠে বলল।

” একটু সর আমাদের একটু জায়গা দে?”

ওর পাশের ছেলেটা উঠে বলে।

” তাড়াতাড়ি বস তাহিয়া,স্যার চলে আসবে।”

মেয়েটি উঠে বলল।

” ওয়েট ওয়েট সান।”

প্রথম দুটো মেয়ে এবং একটি ছেলে কন্ঠদের বেঞ্চে বসে,আরেকটা ছেলে এবং আরেকটা মেয়ে ওদের পিছনের বেঞ্চে বসলো। কন্ঠ ও রিয়া একটু সরে বসতেই ওদের পাশে বসে থাকা ছেলেটা বলে উঠলো।

” আরে চিল উই আর ফ্রেন্ড,দেখ ভাই আপনাআপনি আমার দ্বারা হবে না তাই তুই করে বলছি। আমি সান,ও রিফাত,এটা তাহিয়া, আর এটা হলো আমাদের সিনিয়র আপাই সোহা।”

পিছনে থাকা সোহা সানের মাথায় চা’টি মে’রে বলল।

” এই সান একদম আমাকে সিনিয়র বলবি না বলে দিলাম?”

উপস্থিত সবাই হুঁ হুঁ করে হেসে উঠলো, কন্ঠ এতক্ষণে বুঝতে পারলো ওরা কতটা মিশুক প্রকৃতির।তাহিয়া কন্ঠ কে উদ্দেশ্য করে বলে।

” তা তোর নাম কী?”

কন্ঠ মিহি কন্ঠে বলে।

” আমি কন্ঠ আর ও আমার মামাতো বোন রিয়া।”

রিয়া সৌজন্য মূলক হাসি দেয়, অতঃপর সবাই একে অন্যের সাথে পরিচিত হয়ে উঠে।কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে যে আজকেই ওদের প্রথম দেখা।হুট করে ক্লাসে প্রবেশ করে তূর্য খান, সবাই যে যার মত আছে।এমন মনে হচ্ছে যেন তূর্য কারো নজরেই পড়েনি। শান্ত কন্ঠে তূর্য বলে উঠে।

” সাইলেন্ট।”

তাতে কারো কোনো ভাবান্তর নেই, এবার হুংকার দিয়ে বলে উঠল তূর্য।

” আই সে সাইলেন্ট,ওয়াট ইস দিস? এটা কী আদেও ক্লাস রুম?”

সবাই একে বারে নিশ্চুপ হয়ে যায়,টু শব্দটি পর্যন্ত নেই।বুকে হাত গুজে টান টান হয়ে দাঁড়ায় তূর্য। অতঃপর আগের ন্যায় হুংকার দিয়ে বলে।

” কলেজে উঠেছে তার মানে এটা নয় সা’পের পাঁচ পা দেখেছো?স্কুলে যা শিখেছে তা এখন কাজে লাগানোর সময় অ্যান্ডেসটেন্ট?”

সবাই এমন ভাবে চুপ করে আছে মনে হচ্ছে শ্বাস পর্যন্ত নিচ্ছে না কেউ,বুকের ভেতর টিপ টিপ শব্দ হচ্ছে কন্ঠের।ভয়ে হাত-পা রিতিমত কাঁপছে তার।

” এরপর যখন ক্লাসে আসবো তখন নিজেদের আচরণ ঠিক রাখবে, অন্তত আমার ক্লাসে যেন এসব অস’ভ্যতামো না দেখি?”

ক্লাস রুমে প্রবেশ করে প্রিন্সিপাল স্যার নাহিদ হাসান।

” গুড মর্নিং তূর্য।”

তূর্য শান্ত কন্ঠে বলে।

” গুড মর্নিং স্যার।”

নাহিদ হাসান বেশ ফুরফুরে মেজাজে বলেন।

” তোমাদের সবার কে আমাদের কলেজে স্বাগতম, আশা করি আমাদের কলেজে তোমরা নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।অবশ্য যদি তোমাদের প্রফেসর তূর্য খান থাকে। তূর্য আই হোপ তুমি আবারও নিজের বেস্টটা দেবে?”

ম্লান হাসে তূর্য।

” আই উইল ট্রাই টো মাই বেস্ট স্যার।”

নাহিদ হাসান আবারও আগের ন্যায় হেসে বলেন।

” অল দ্যা বেস্ট ডিয়ার স্টুডেন্ট।”

নাহিদ হাসান ক্লাস থেকে বের হওয়া মাত্র, তূর্য সবার দিকে তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টি নি’ক্ষে’প করে।

চলবে……………✨।