অপ্রিয় মাস্টার পর্ব-০৭

0
265

#অপ্রিয়_মাস্টার
পার্ট [০৭]
#লেখিকা_ফারহানা_নিঝুম

এইবারেও স্যার ই’জ্জ’ত খাইয়া দিলো,এইটা কোনো কথা? সবাই কি সুন্দর বেঞ্চে বসে ক্লাস করছে আর সেখানে কিনা ওকে বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কিছু লিখতে হচ্ছে, উফ্।সব কিছু হয়েছে সানের জন্য, একবার বাইরে যাই তার পর দেখাচ্ছি মজা।
এই স্যারও এমন কেনো? আমি ওনার সম্পর্কে বেয়াইন হই, মিনিমাম সম্মান দিল না ছে।
ক্লাস শেষে তূর্য বের হওয়ার সময় কন্ঠ কে উদ্দেশ্য করে বলে।

” হেই ইউ, তুমি এবং তোমার সো কল্ড ফ্রেন্ড গুলো কে নিয়ে আমার কেবিনে এসো।”

হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল তূর্য,চোখ মুখ শক্ত করে নেয় কন্ঠ,ওর বন্ধুদের সো কল্ড বলল? ইচ্ছে করছে ওর মাথা ফা’টিয়ে দেই,আসলেই সান ঠিকই বলে ব’জ্জা’ত স্যার একটা।
___________
ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখতে ব্যস্ত নীলা,আজ একটু অন্যরকম লাগছে। কাল রাতের কথা মনে পড়তেই ল’জ্জা এসে জড়িয়ে ধরছে নীলা কে। বারংবার কেঁপে উঠছে নীলা, সাফিনের প্রতিটি স্পর্শ তাকে ভালোবাসার এক নতুন অনূভুতি সৃ’ষ্টি করেছে।
বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে সাফিন, হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যেতেই উঠে গিয়ে নীলা কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।

” আই লাভ ইউ।”

নীলা স্ফীত হেসে বলে।
” আই লাভ ইউ টু।”

লাল শাড়ি পড়নে এলোমেলো চুলে দৌড়ে যাচ্ছে একটি মেয়ে,ওর পিছু পিছু ছুটছে এক সুদর্শন পুরুষ। পায়ের নূপুরের ছন্দ হাতে কাঁচের চুড়ি শব্দ দুটো মিলে তৈরি হচ্ছে ভালোবাসার ছন্দ। পুরুষ বারংবার বলছে।

” দাঁড়াও না,আর কত জ্ব’ল’ব এই ভালোবাসায়?”

মেয়েটি পিছন ফিরে তাকিয়ে খিল খিল করে হেসে বলে উঠল।

” যত দিন না আমি কাছে আসবো তত দিন এভাবেই জ্ব’লতে হবে।”

কথাটা বলে আবারও ছুট লাগালো মেয়েটি এক সময় সীমা রেখার বাইরে চলে যায় সে।

” না।”

ঘুম থেকে লা’ফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে তুফায়েল, কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিল, অতঃপর দু হাত দিয়ে মাথা চে’পে ধরল। কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে ওয়াড্রফ থেকে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।

বাড়ি ফিরতেই তনয়া আহমেদ তাড়া দিল কন্ঠ রিয়া দুজনকে।

” তোদের পই পই করে বারন করেছি আজকে কলেজে যেতে হবে না, তবুও কথা শুনিস না।”

কথা গুলো বলতে বলতে হাতের কলেজ ব্যাগ নিয়ে অন্য প্যাকেট ওদের হাতে ধরিয়ে দেয় তনয়া আহমেদ, কন্ঠ ভীষণ উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞাস করে।

” এটাতে কী আছে মামী?”

আনিকা আহমেদ কথার পিঠে বলে উঠেন।

” ওদের বাড়িতে যাচ্ছিস তাই এইটা দিছে আপা,তার মানে এটা নয় এখন এটা নিয়ে ঢং করতে হবে।”

মূহুর্তের মধ্যে সব খুশী কর্পূরের ন্যায় উবে গেল,মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে।
রিয়া নিজের মায়ের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে।

” এহহহহহহহহহহহ মায়ের এই কথা গুলো পাত্তা দিস না,মা তো হুদাই সারাদিন বক বক করে।”

মূহুর্তের মধ্যে নাকের পাটাতন ফুলে উঠে আনিকা আহমেদের,মেয়ে কী না তার কথা পা’ত্তাই দিল না?

” কী বললি আমি সারা দিন হুদাই বক বক করি?”

রিয়া দাঁত দেখিয়ে বলল।

” হ্যা।”

এটা বলেই ছুটে দুতলায় চলে গেল।
রান্নাবান্না প্রায় শেষ, বাড়িতে অতিথিদের আপ্যায়ন করতে হবে,আজ অনেক কাজ আছে। অনেকেই নতুন বউ দেখতে আসবে,সেই সুবাদে কাজ চলছে।অহনা খান অনেক বার নীলা কে জিজ্ঞেস করেছে কন্ঠ কখন আসছে? কন্ঠ কে নিয়ে অহনা খানের এত আগ্রহ দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে নীলা।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে ব্যস্ত তূর্য, অজান্তেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেশ দেখা যাচ্ছে।হাতে ব্র্যান্ডেড ঘড়িটা পড়ে বাইরে গেল।
বাইরে যেতেই চোখ দুটো আটকে গেল আকাশী রঙের সিল্কি জামা পরিহিত মেয়েটি কে দেখে।
ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক,হাতে গুটি কয়েক নীল রঙের চুড়ি, অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিচ্ছে সে।
চোয়াল শক্ত করে নিল তূর্য, চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নেয় কন্ঠ কিন্তু বার কয়েক আড় চোখে পর্যবেক্ষণ করেছে স্যার কে। শুধু সুদর্শন বললে ভুল হবে, সুদর্শন সুপুরুষ। ধূসর রঙের শার্ট পড়েছে,কেউ কী করে এতটা সুন্দর হয়? হয়তো স্যার কে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।
নানা কথা ভাবছে কন্ঠ তার মধ্যে অহনা খান এসে কন্ঠের হাত ধরে বললেন।

” তুমি এসেছো?”

কন্ঠ কে দেখে কুশল বিনিময় করল অহনা খান,শাহা খান দূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছেন।

অনুষ্ঠান শেষ পর্যায়ে,বাড়ি যাওয়ার জন্য বায়না করছিল কন্ঠরা, কিন্তু তার মধ্যে অহনা খান সাফ সাফ না করে দিলেন আজ ওদের যেতে হবে না। অবশেষে জোরপূর্বক ভাবে থাকতে হলো কন্ঠ ও রিয়া কে।

কিছু দিন পরেই নীলা সাফিনের সাথে লন্ডনে চলে যাবে,এই কয়েক দিন ওদের বোনের সাথে সময় কা’টাতে পারবে।বেশ রাত পর্যন্ত তিন বোন গল্প করেছে,কথার পিঠে বার বার ভুলবশত কন্ঠ নীলার কাছে তূর্যের কথা জিজ্ঞেস করেছে।নীলা হেসে বলেছে তূর্য হয়তো গম্ভীর, কিন্তু এই দুই দিনে বুঝেছে তূর্যের মন অনেক ভালো।
তূর্যের সম্পর্কে এত সুন্দর কথা শুনে অজান্তেই ভেতরটা শান্তি লাগছে কন্ঠের।
প্রতি রাতেই ছাদে যায় কন্ঠ, আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ছাদে যেতেই অন্য আরেকজনের উপস্থিতি টের পেলো, তূর্য কালো রঙের ট্রাউজার এবং একটা কালো ট্রি-শার্ট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। কন্ঠ কী যেন একটা ভেবে দৌড়ে আবার নিচে নিজের ঘরে গিয়ে তূর্যের দেওয়া ব্যাগ গুলো নিয়ে আসে।

” স্যার।”

চিরচেনা কন্ঠ শুনে নৈঃশব্দ্যে হাসে তূর্য,হয়তো সে জানত কন্ঠ এখন আসবে। মুখে খানিকটা গম্ভীর্য টেনে নিয়ে পিছন ফিরে তাকালো। শুকনো ঢুক গিলে নেয় কন্ঠ, অতঃপর কাঁপা গলায় বলল।

” স্যার এই প্যাকেট গুলো, সেদিন বাড়িতে ভুলে রেখে গিয়েছেন।”

হাত বাড়িয়ে দেয় তূর্য,প্যাকেট গুলো দেয় কন্ঠ,চোখ দুটো তার হাতের দিকে আর ঐদিকে আরো এক জোড়া চোখ কন্ঠের চোখের দিকে সীমাবদ্ধ।

রুমে চলে গেল কন্ঠ,প্যাকেট গুলোর দিকে তাকিয়ে আবারো নৈঃশব্দ্যে হাসলো তূর্য।
_________
দু দিন হলো সাফিন আর নীলা লন্ডনে চলে গেছে,যাবার আগে অনেক কেঁদেছে নীলা,কবে আসবে ঠিক নেই সবাই কে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেনি সে। কিন্তু মানুষ যা কল্পনা করে না ঠিকই তাই বাস্তবে রূপ নিয়ে আসে।

প্রায় এক সপ্তাহ পর কলেজের গ’ন্ডিতে পা রাখে কন্ঠ,মাঝের দিকে কিছুটা অসুস্থ হওয়ার দরুন আসতে অক্ষম ছিল। অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট মুখশ্রীতে ফোঁটে উঠেছে।রুক্ষ চুল গুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে হাওয়ায়, শরীরে একদমই জোর পাচ্ছে না সে।চোখের নিচে জমেছে কালো দাগ ছোপ।

কন্ঠ কে দেখে দেহে প্রান ফিরে আসার মত আনন্দ অনুভব করছে বন্ধু মহল,সোহা গিয়ে দৌড়ে জড়িয়ে ধরল কন্ঠ কে। সবার মুখে তৃপ্তির হাসি।

” ছে ছে কন্ঠ তোর এই অবস্থা ক্যা?কার কাছ থেকে ছ্যা’কা খাইয়া ব্যা’কা হইয়া গেলি?”

তারিফের কথা শুনে হুঁ হুঁ করে হেসে উঠলো সবাই, কন্ঠ তারিফের কথার পিঠে বলে উঠে।

” তোর কী মাথার তাড় গেছে ?কী বলিস এসব?”

” গাইস গাইস এসব বাদ চল ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলি?”

তাহিয়ার আইডিয়া বেশ ভালো লাগে কন্ঠের, অতঃপর সবাই গেম শুরু করে।

রিয়া প্রথমেই সান কে বলে।

” আগে তুই বল,ট্রুথ না ডেয়ার?”

সান বেশ পুরুষত্ব দেখিয়ে বলে।

” অলওয়েজ ডেয়ার কো কী কবি কো?”

রিয়া কন্ঠ সোহা তাহিয়া নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে হেসে কুটি কুটি অবস্থা। অতঃপর রিয়া বলে উঠে।

” ওই দেখ ডাসবিন,ওইটা নিয়ে এখন মাঠের সব ময়লা তুলে ফেল ”

মূহুর্তে মুখ চুপসে গেল সানের, অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় সবার দিকে, অবশ্য কেউ তেমন একটা পাত্তা দেয় না।
কিছু না পেয়ে একে একে সব ময়লা ডাসবিনে তুলে নেয় সান,ঘেমে একাকার অবস্থা ওর, সবাই ওকে দেখে হাসছে।

” এবার কন্ঠের পালা।”

সোহা কন্ঠ কে ডেয়ার দেয়।

” তুই বরং একটা চিঠি লেখ।”

হঠাৎ চিঠির কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে নেয় কন্ঠ,এত সহজ কাজ দিল কন্ঠ কে?ভেবে সবাই সোহার দিকে তাকিয়ে আছে।সোহা সবাই কে কাছে ডেকে কী যেন কানে কানে বলল?শুনার বৃথা চেষ্টা করল কন্ঠ। সবাই ওকে চে’পে ধরল চিঠি লিখার জন্য, অবশেষে নতুন করে একটা চিঠি লিখে কন্ঠ,লেখা শেষ হতেই তাহিয়া ছু মে’রে নিয়ে নিল।
কিছু সময় পর সবাই ক্লাসে চলে গেল, বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরতেই আবার সেই অজানা নাম্বার থেকে কল আসলো,ভ্রু কুঁ’চকে নেল কন্ঠ।কে এটা? হঠাৎ হঠাৎ কল করছে কিন্তু কিছু বলছে না?তার মানে কী? আচ্ছা ফ্রেন্ডরা মজা করছে না তো?

ভাবনার মাঝে ফোন কে’টে গেল, ফোন বিছানায় রাখতে যাবে তার আগেই আবার টুং টুং শব্দ করে বেজে উঠলো।ফুস করে শ্বাস টেনে নিল কন্ঠ, শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল।

” হ্যলো কে?”

সেদিনের মত অপর পাশ থেকে কোনো জবাব এলো না, বিরক্ত হলো কন্ঠ।আবারো শুধায়,তবে রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে।

” কে বলছেন?কথা বলছেন না কেন?হ্যলো?”

ফোন কে’টে গেল, নাম্বার থেকে মে’সে’জ আসলো,” মিষ্টি কন্ঠের, মিষ্টি কন্ঠস্বর শুনতে ইচ্ছে করছিল।মন শান্ত হয়ে গেছে,টাটা সাথে এত্ত গুলো ভালোবাসা।”

আর কিছু ছিল না,চোখ কপালে উঠে গেল কন্ঠের।এটা কে ছিল?কী লিখেছে এসব? মাথায় আকাশ ভে’ঙ্গে পড়লো মনে হচ্ছে কন্ঠের, ভাবতে ব্যর্থ সে, প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। অবশেষে ফোন রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিল কন্ঠ।
_______
সকালের নাস্তা রেডি করে রাখে কন্ঠ, খাবার টেবিলে আসেন আহাদ আহমেদ,সাহাদ আহমেদ।তুফায়েল সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে,কী একটা কাজ আছে সেটা বলে।
খাবার বেড়ে দিচ্ছে কন্ঠ,আজ বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছে সবাই। অনেক দিন পর কন্ঠের হাতের রান্না খাচ্ছে। মুখে হয়ত আহাদ আহমেদ কিছু বলছে না কিন্তু মনে মনে বেশ প্রশংসা করছে কন্ঠের রান্নার।
ব্যাগ নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে কন্ঠ রিয়া, কন্ঠের হাতে রসায়ন বই আছে। কলেজের গেটে পা রাখতেই বুকের ভেতর ধ’ড়’ফ’ড় করে উঠল সামনের লোকটি কে দেখে। লম্বা ফর্সা লোকটাকে দেখেই হৃদয় যন্ত্রটা লাফাতে শুরু করেছে। ব্ল্যাক সুট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।আজ প্রথম ক্লাস ওনারই।

চলবে………… ✨।