অপ্রিয় মাস্টার পর্ব-০৮

0
228

#অপ্রিয়_মাস্টার
পার্ট [০৮]
#লেখিকা_ফারহানা_নিঝুম

সকাল সকাল এভাবে অপ’মা’নিত হতে হবে কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি কন্ঠ, সবার অগোচরে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু কণা মূছে নেয় সে।

ক্যান্টিনে বসে আছে কন্ঠ, নিজেকে খানিকটা গু’টিয়ে নিয়েছে সে।যেই তার পাশ দিয়ে যাচ্ছে তারই যেন মুখ চেপে হাসি থামানোর চেষ্টা করছে। কলেজের কিছু ম্যাম তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টি নি’ক্ষে’প করছে তার দিকে।

দূরে দাঁড়িয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করছে সান,সোহা,তারিফ,তাহিয়া এবং রিয়া। নিজের বোকা বোনের জন্য বেশ মন খারাপ লাগছে তার, নিজেদের অপ’রা’ধী মনে হচ্ছে সবার।

সেদিন আর ক্লাস করলো না কন্ঠ,বাড়ির পথে রওনা দিল।ওর পিছু পিছু রিয়াও ছুটে যায়,সান বলেছে ওরা কী পড়া দেয় জানি দেবে।আর সাথে এটাও বলেছে কন্ঠের খেয়াল রাখতে।
_____________

বাড়ি খালি খালি লাগছে অহনা খানের,এই তিন চার দিনে নীলা কেমন সবার মনে জায়গা করে নিয়েছে। হঠাৎ এভাবে চলে যাবে ভাবেনি কেউ,অহনা খানের হঠাৎ কন্ঠের কথা মনে পড়ল। মেয়েটাকে বেশ মনে ধরেছে ওনার,কত মিষ্টি মেয়ে। সেদিন বাসায় আসার পর ছট করে মিশে গেছে সবার সাথে। কিছু মানুষ অমায়িক হয় বলার মত না।
বাড়িতে প্রবেশ করল তূর্য, সোফায় গিয়ে বসলো।ওর পাশে এসে বসলো শাহিনা খান, তূর্যের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল।

” দাদু ভাই আমার তোর লগে কথা আছে?”

তূর্য শাহিনা খানের হাত মুঠো করে নিয়ে বলল।

” হ্যা বলো দাদী?”

শাহিনা খান স্বভাব সুলভ হেসে বললেন।

“‌দেখ দাদু ভাই বয়স তো কারো জন্য থেমে থাকে না?দিনে দিনে তো তোমার বয়স বাড়তেছে। এবার বিয়েটা কইরা নেও দাদু ভাই?”

ফুস করে শ্বাস টেনে নিল তূর্য,অহনা খান সবটা শুনছেন, এবারে উনি শাশুড়ির সাথে একমত।ছেলের তো বয়স বাড়ছে, কিন্তু তার দিকে খেয়াল নেই।

” কী রে দাদু ভাই,বল কিছু?”

তূর্য স্ফীত হেসে বলে।
” আচ্ছা করব বিয়ে,মেয়ে দেখো।”

তূর্য বিয়ে করবে কথাটা কর্ণ স্পর্শ করতেই আনন্দে চোখ দুটো চিক চিক করে উঠলো অহনা খানের,শাহিনা খান উৎফুল্ল হয়ে বললেন।

” সত্যি দাদু ভাই?”

তূর্য মাথা এপাশ ওপাশ নাড়িয়ে ছোট্ট করে “হুম” শব্দ করে বসা থেকে উঠে দুতলায় চলে যায়।
শাহিনা খান অহনা খান এবং শাহা খান কে ডেকে বলল।

” বড় বউ,ছোট বউ তোমরা কই? আমার বড় নাতির লাইগা পাত্র দেখো।”
________

” আচ্ছা আমাকে কী তূর্য ভালোবাসে না? আমি তো ওকে অনেক ভালোবাসি।”

কথাটা ভাবতেই এক রাশ বিষন্নতা চে’পে ধরে সহিতা কে।সেই কলেজ লাইফ থেকে দু’জনে ফ্রেন্ড,সহিতা কতবার নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছে তূর্যের সামনে কিন্তু তূর্য বরাবরই না করেছে।যেহেতু বেস্ট ফ্রেন্ড তাই আর তেমন একটা জো’র করেনি সহিতা। তবুও ওদের মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল কিন্তু ইদানিং তূর্য অনেক বদলে গেছে।

মনে মনে ভেবে নেয় যদি তূর্য কখনো ওকে নিজের কাছে টেনে না নেয় তাহলেই সিদ্ধান্ত নেবে।

জানালার কাছে চুল ছেড়ে একা কী দাঁড়িয়ে আছে কন্ঠ? জানালার কপাট খুলে দেওয়ায় হিম হাওয়া ভেতরে প্রবেশ করছে। আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে তেমনি মনের এক আকাশ সম অভিমান জমেছে কন্ঠের তার বড় মামার প্রতি।
কিছুক্ষণ আগেই বাড়িতে আসা মাত্র আহাদ আহমেদ কাছে ডাকেন কন্ঠ কে।

” শুনো তনয়া কন্ঠ কে বলো একটু আসতে।”

তনয়া আহমেদ থ হয়ে দাঁড়িয়েছে, হঠাৎ কন্ঠ কে ডাকছে আহাদ আহমেদ বিশ্বাস করতে পারছে না তিনি।আহাদ আহমেদ আবার বললেন।

” কী হলো? দাঁড়িয়ে আছো যে? কন্ঠ কী কলেজ থেকে আসেনি?”

তনয়া আহমেদ থতমত খেয়ে বললেন।
” হ্যা হ্যা এসেছো, তুমি বসো এখুনি ডাকছি।”

তনয়া আহমেদ নিজে গিয়ে কন্ঠ কে ডেকে নিয়ে এসেছে ড্রয়িং রুমে। কন্ঠ গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়েছে,এটার কারণও আছে।যখনই আহাদ আহমেদ কন্ঠের সাথে কথা বলে তখন হয়তো বকা আর নয়তো চোখ রাঙিয়ে দেয়।সেই ভয়েই আজ কন্ঠ চোখ ফেলে রেখেছে মেজেতে। আহাদ আহমেদ কন্ঠ কে সোফায় বসতে বলল, চুপচাপ বাধ্য মেয়ে মত সোফায় বসে পড়ল। শুধু সে একা নয় ওর পাশের সোফায় বসেছে সাহাদ আহমেদ,মুখ জুড়ে তার আনন্দের মাখামাখি।
আহাদ আহমেদ শান্ত কন্ঠে বলল।

” তোমাকে তো কখনও কিছু দেইনি, বা তোমার ব্যাপারে তেমন একটা মাথা ঘামায় না।”

মাথা নিচু করেই সবটা শুনছে কন্ঠ,আহাদ আহমেদ ফের বলল।

“‌এবার আমি তোমাকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন কথা হচ্ছে তাতে কী তুমি রাজী হবে?”

চোখ তুলে তাকায় কন্ঠ,বড় মামা তাকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর সেটা কন্ঠ শুনবে না এটা কী হতে পারে? কখনো না,বড় মামা যদি বলে তাকে ফাঁ’সি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তবুও রাজী আছে। কন্ঠ তড়িৎ গতিতে বলে উঠল।

” তুমি যা বলবে সব শুনব বড় মামা।”

কন্ঠের সম্মতি জানা মাত্র বিয়ের কথা বলে বসলো আহাদ আহমেদ,যেটা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না কন্ঠ।তনয়া আহমেদ আনিকা আহমেদ বেশ অবাক হয়েছে। ওরা তো এসব সম্পর্কে কিছুই জানে না।

ঠাস করে জানালার কপাট একটি আরেকটি সঙ্গে সংঘ’র্ষ’ণ হয়, তাতেই বাস্তবে ফিরে আসে কন্ঠ, চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। হয়তোবা সাথে চোখ থেকে ঝড়ে পড়ে দু ফোঁটা অশ্রু কণা।
_________

খান বাড়িতে অনেক দিন পর পা রেখেছে ঐশী রহমান, উনি এ বাড়ির-ই মেয়ে এত দিন রংপুর ছিলেন নিজের শশুর বাড়ীতে,বেশ অনেক দিন পর ঢাকা এসেছেন। ওনাকে মোটেও কেউ আশা করেনি,অহনা খান এবং শাহা খান ওনাকে দেখে শুকনো ঢুক গিলে নেয়।শাহিনা খানের থেকেও বেশ কড়া ঐশী রহমান,শাহিনা আহমেদ মেয়ে কে দেখে জড়িয়ে নেয়।ঐশী মন খুলে মা কে আলিঙ্গন করে।

অহনা খান,শাহা খান কুশল বিনিময় করে ঐশী রহমানের সাথে।কালো রঙের জ্যাকেট পড়েছে তূর্য,বেশ ঠান্ডা লাগছে আজ তাই আর কী এই আজ নতুন রূপে বেরিয়েছে। তূর্য কে দেখা মাত্র মুখে এক গাদা গম্ভীর ভাব নিয়ে নেয় ঐশী রহমান।ফুপি কে দেখে স্ফীত হাসে তূর্য।

” আসসালামুয়ালাইকুম ফুপি, কেমন আছো?”

ঐশী রহমান সালামের উত্তর দিয়ে বলেন।

” আল্লাহ যেমন রাখছে,তবে তোর থেকে এটা আশা করিনি তূর্য?”

তূর্য বুঝতে পারলো না ঐশী রহমানের কথা,কী আশা করেনি?”

ঐশী রহমান মুখ বাঁকিয়ে বললেন।
” বড় ভাইয়ের আগে কী না ছোট ভাই বিয়ে করে বসে আছে? ছিঃ ছিঃ জীবনে না শুনছি আর না দেখছি।”

তূর্য আর অপেক্ষা করল না,কথায় কথা বাড়ে।আর এই কথাই বাড়াতে চায় না তূর্য।আজ কলেজ নেই তাই হাঁটতে বেরিয়ে গেছে সে, শনিবার কলেজ অফ।এটা বেশ ভালো হয়েছে, সরকার থেকে এখন একদিন নয় দু দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এই দু দিন কাউকে বেশ মিস করবে সে।

ঐশীর মোটেও এই বিষয়টি পছন্দ হলো না তূর্যের , এভাবে তাকে এড়িয়ে চলে গেল? অতঃপর কিছু করতে না পেরে অহনা খান কে উদ্দেশ্য করে বলল।

” বড় ভাবী ছেলে কিন্তু আস্তে আস্তে হাতের বাইরে চলে যাইতেছে, এখন সময় আছে বিয়েটা করাই ফেলো।”

অহনা খান রান্না ঘরে যেতে যেতে বলল।
” সময় হয়ে গেছে,আসছো যখন একে বারে ছেলের বিয়ে খেয়ে যেও।”


মৃদু বাতাসে এলোমেলো চুল গুলো উঠছে এদিকে সেদিক, তবুও কাঁধে ব্যাগ ছাপিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কন্ঠ, গন্তব্য অজানা দু চোখ যত দূর যায় সেটাই গন্তব্য। হঠাৎ বিয়ে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সেটা কন্ঠ, এবং কী সেই দুঃখে পাত্রের ছবিটা পর্যন্ত দেখেনি সে।
রাতে রিয়া বরের ছবি নিয়ে এসেছিল কন্ঠের কাছে কিন্তু কন্ঠ ঘুমের ভান করে শুয়ে ছিল,মূলত ওর উদ্দেশ্যই পাত্রের মুখ দেখবে না।বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে চলে এসেছে কন্ঠ, সামনে পদ্মববিল। ওখানে দু তিনটে বেঞ্চ রাখা আছে,গুটি কয়েক লোকজন দেখা যাচ্ছে সেখানে গিয়ে বসে পড়ল কন্ঠ।

যত দূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি, মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে পদ্ম ফুল। খুব সুন্দর দৃশ্য, মূহুর্তের মধ্যে সব মন খারাপ উবে গেল। নিজের পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই নড়ে চড়ে উঠলাম,জ্যাকেট পরিহিত একজন কে দেখতে পেলাম। মেজাজ গরম করে দিচ্ছে, আচ্ছা আর কোনো জায়গায় বসতে পড়ল না?বেশ কড়া ভাবে কিছু কথা শুনিয়ে দিলাম।

” এই যে অন্য কোথাও বসতে পারলেন না? এইখানেই বসতে হলো? আপনাদের মত লোকজনের জন্য একটু কোথাও বসেও শান্তি নেই।”

নাক মুখ কুঁ’চকে নিলাম কথা গুলো বলে, কিন্তু পর মূহুর্তে ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ ফাঁকা হয়ে গেল লোকটির মুখশ্রী দেখে।

” স্যার আপনি?”

কপালে ভাঁজ দেখা যায় তূর্যের,জহুরীর ন্যায় পরখ করছে কন্ঠ কে,শুকনো ঢুক গিলে নেয় কন্ঠ। এখানে ওনাকে মোটেও আশা করেনি সে। আচ্ছা তার সাথে এসব কী হচ্ছে?ঘুরে ফিরে স্যারের সামনেই খারাপ হতে হলো? ইশ্ কী বি’শ্রী ব্যাপার।
তূর্য বিনা বাক্যে উঠে হাঁটতে লাগল, ওনাকে চলে যেতে দেখে কন্ঠও উঠে দাঁড়াল, দৌড়ে গিয়ে ওনার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে।ভ্রু নাচিয়ে কী জিজ্ঞেস করে তূর্য?
জ্বিভা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে চাপা স্বরে বলে কন্ঠ।

” আমি স্যরি স্যার, আসলে আমি বুঝতে পারিনি আপনি ছিলেন।”

পকেটে হাত গুজে ফুস করে শ্বাস নিয়ে বলল তূর্য।

” আচরন ঠিক করো।”

হাঁটতে লাগল, পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে কন্ঠ।কী খারাপ আচরণ করল সে? সবসময় তার সাথে এত রুড বিহেভ করার কারণ খুঁজে পায় না সে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উল্টো পথে হাঁটতে লাগলো কন্ঠ।

কিছু মানুষ ভীষণ রকম ভাবে অদ্ভুত হয়,যাদের বোঝা মুশকিল। নিজেদের মত থাকতে দেওয়াই ভালো, এবং আমাদের উচিত তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা। হ্যাঁ আজ থেকে এই তূর্য খান নামে লোকটির থেকে দূরে থাকব, প্রয়োজনে ক্লাস করব না তাতে যদি মার্ক কম আসে তাতে সমস্যা নেই। এমনিতেই আর পড়াশোনা হবে কী না জানি না?বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের পড়াশোনা করতে দেয় না তেমন একটা।

চলবে………..✨।