অপ্রিয় রঙ্গনা পর্ব-২০+২১

0
448

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২০

রাতটুকু কেটে গেলো ছন্দময় প্রণয়ে।
অক্টোবরের আঁধারে ডুবে থাকা ভোর! শেষরাতের বৃষ্টি। হাসনাহেনার ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে আছে চারিপাশটা। ভিজে যাওয়া মাটির সাথে কামিনীসহ অন্যান্য ফুলের কড়া ঘ্রাণ ‘নিরিবিলি’ বাড়ির তিনতলায়ও ঘুরপাক খাচ্ছে। বাইরে তখনো গাঢ় অন্ধকার। শীতল বাতাস জানালা দিয়ে ফরফর
করে ঘরে ঢুকছে। বৃষ্টিভেজা ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে
দিতেই সদ্য কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেলো তাখলিফের। চাদর টেনে জড়াতেই ওপাশে টান অনুভব করলো। গুমোট হয়ে থাকা মস্তিষ্কটা তখনই সচল হলো। দু’সেকেন্ড ব্যয় করে বা-দিকে ফিরতেই ঝুমুরকে গুটিশুটি মেরে ওর বুকের কাছে শোয়া দেখতে পেলো। সেখান থেকে নাক টানার মৃদু শব্দ আসছে। তাখলিফ ভ্রু কুঁচকে ফেললো। আশ্চর্য বনে গেলো! স্ব-ইচ্ছায় নিজেকে সমর্পণ করে এখন কাঁদছে কেন মহারাণী? রাতে যে এত করে বুঝালো, শুধু হাতে-পাতে ধরা বাকি ছিলো তখন ভুলটা মনে হয়নি? পরক্ষণেই তাখলিফ নিজের প্রতি বিরক্তিতে ভাষাহীন হলো। ঝুমুরকে দোষ দিয়ে লাভ কি? ও নিজেও সেই দোষে দোষী। তাখলিফ আলগোছে ঝুমুরের মাথায় হাত বুলিয়ে নিচু স্বরে বলল, “সরি ঝুমুর। ভুল করে ফেলেছি, আমার নিজেরই বোঝা উচিৎ ছিলো। বাট আমি হেল্পলেস ছিলাম। তুই এভাবে কাঁদলে আমি কি করবো বল তো? কি করলে মাফ করবি সোনা?”

ঝুমুর নিজের কান্না বন্ধ করলো। মানুষটার কি দোষ? ও-ই তো চেয়েছে! তবে মৃদু কেঁপে ওঠা থামলো না। তাখলিফ আর না পেরে ওঠে বসলো। এরপর ঝুমুরকেও ওঠে বসালো। চাদরটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিজেকে মুড়িয়ে রেখেছে একদম। সারা মুখে ছেয়ে আছে লজ্জা আর ভয়। গলায়, পেটে-পিঠে আদরের চিহ্ন! তাখলিফ দ্রুত ওর জামাকাপড় খুঁজে এনে নিজহাতে পরিয়ে দিলো। এলামেলো চুলগুলো আনাড়ি হাতে অনেক কষ্টে হাতখোঁপা করে কাটা দিয়ে আটকে দিলো। এরপর ওর চোখের পাতায় চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কষ্ট হচ্ছে?”

ঝুমুর নাক টেনে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানালো। তাখলিফ ওকে বিশ্রাম নিতে বলে নিজে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। পূর্ব আকাশে তখনো সূর্যের দেখা নেই। মেঘের আড়ালে ডুবে আছে সেটা। বৃষ্টির তেজ ক্রমেই বাড়ছে। ইলশেগুঁড়ি থেকে মুষলধারে বর্ষণ শুরু হয়েছে। ঝুমুর কাচের জানালা দিয়ে একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকলো। তাখলিফ ফ্রেশ হয়ে এসে চুলের পানি ঝেড়ে ঝুমুরকে আদুরে স্বরে বলল, “একটু উঠ সোনা। ফ্রেশ হয়ে আয়।”

ঝুমুর খানিকটা মিইয়ে গিয়ে বলল, “না।”

“না মানে?”

“আমার ঠান্ডা লাগছে। পরে প্লিজ।”

“হবে না, একদম না। দ্রুত যা। পানি গরম আছে।”

“পরে প্লিজ।”

তাখলিফ অধৈর্য্য হয়ে বিরক্তির নিঃশ্বাসটুকু ফেলে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। মুখে রাগ স্পষ্ট। এরপর আচমকা জোর করেই একদম বিছানাসহ ঝুমুরকে তুলে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। ঝুমুর ছটফট করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই তাখলিফ চোখ রাঙিয়ে ওর গালে নিজের গাল ঘষে দিলো। ট্রিম করা দাড়ির খোঁচা লাগতেই ঝুমুর ‘উফ’ করে ওঠলো। কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল, “এটা কি করলেন? গালে ব্যথা লাগলো তো!”

তাখলিফ ব্রিদ্রুপাত্মক কন্ঠে বলল,
“এটুকুতে কিছু হবে না। ইউ নো, তোদের মেয়েদের সহ্যক্ষমতা অনেক বেশি, রাতে তো দেখলামই।”

বলে ওকে ওয়াশরুমে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে দিলো। এদিকে ওসব কথা শুনে কানটান গরম হয়ে গেলো ঝুমুরের। বিড়বিড় করে নিজের রাগ, লজ্জা ঝেড়ে এরপর ফ্রেশ হয়ে নিলো। দরজায় টোকা দিতেই তাখলিফ এসে খুলে দিলো। ঝুমুর দুর্বল পায়ে হেঁটে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। তাখলিফ সেটা দেখে ওকে কিছু না বলে ওর চুলে প্যাঁচানো তোয়ালেটা খুলে নিজেই আস্তেধীরে চুল থেকে পানি মুছতে লাগলো। ঝুমুর ওর উরুতে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বলল, “ঠান্ডা লাগে তো।”

“তোর শাস্তি। রাতে আমার কথা না শোনার!”

“বেশ করেছি!”

“লজ্জাহীন।”

বলে তাখলিফ ওর চুলগুলো ভালো করে মুছিয়ে দিয়ে বেডসাইডের ওপর রাখা একটা গ্লাস হাতে নিয়ে এসে বলল, “দেখি দু’মিনিটের জন্য একটু উঠে বস।”

ঝুমুর ওর কথা শুনে গাইগুই করে চোখ খুলতেই দেখলো দুধের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তাখলিফকে।
মুহূর্তেই মনটা বিষিয়ে গেলো ওর। এই ভোরবেলা দুধ খেতে হবে ভাবতেই গা গুলিয়ে এলো ওর। তাখলিফ দেখেও না দেখার ভান করে জোর করে ওর মুখ চেপে ধরে পুরোটা খাইয়ে শেষ করে মিটিমিটি হেসে চলে গেলো। এরপর ফিরে এসে জানালার পর্দা ভালো করে টেনে ঘর অন্ধকার করে ঝুমুরকে নিয়ে আবারও শুয়ে পড়লো। ঝুমুর ওর বুকে নিজের থুতনি রেখে ওর দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো, কিছুই বললো না। তাখলিফ ওর ভেজা চুলে আঙুল ডুবিয়ে সন্দেহ নিয়ে বলল, “এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আবার কোন কু-বুদ্ধি ঘুরছে মাথায়?”

ঝুমুর একগাল হেসে ওর গালের একটা কাটা দাগ ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি খুব সুন্দর, ড্যাশিং, হ্যান্ডসাম। আচ্ছা আপনার গালে এটা কিসের দাগ?”

তাখলিফ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমি যে কখনো বিপথে গিয়েছিলাম ওটা তার চিহ্ন।”

ঝুমুর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রসঙ্গ পাল্টালো,
“আচ্ছা, আপনার কখনো মেয়েবন্ধু ছিলো না?”

“মানে?”

“গার্লফ্রেন্ড, ছিলো না?”

তাখলিফ চোখমুখ কেমন করে ফেললো মুহূর্তেই,
“তোকে বলবো না।”

“কেন?”

“কারণ তুই আমার বউ।”

ঝুমুরের ভ্রু কুঁচকে গেলো,
“তার মানে ছিলো?”

“বললাম তো, তোকে বলা যাবে না। বউদের এসব বলতে নেই।”

ঝুমুর স্তব্ধ হয়ে গেলো,
“আপনি এত খারাপ?”

“হু, তোর ভাবনার চেয়েও বেশি খারাপ।”

ঝুমুরের বিভ্রান্ত চোখে চাইলো। অনিশ্চিত কন্ঠে বলল, “তার মানে আপনি এর আগেও কোনো মেয়েকে এভাবে…”

“কী?”

ঝুমুর কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল, “আমার সাথে যা করেছেন, সেসবও করেছেন?”

ঝুমুরের কথা শুনে বিস্ফোরণ ঘটে গেলো তাখলিফের মস্তিষ্কে। ওর চোখ দুটো থেকে কোটর বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। এদিকে ঝুমুরের রাগের পারদ বাড়তেই থাকলো। এক রাতেই যেন এই মেয়ে তাখলিফকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। কথাবার্তা, আচরণ সব পালটে গেছে। তাখলিফ কেশে ওঠলো ওর এমন পরিবর্তন দেখে। হাসার প্রচেষ্টা করে তড়িঘড়ি করে বলল, “এসব করিনি, কস্মিনকালেও না।”

ঝুমুরের চোখদুটো শান্ত হয়ে এলো। তাখলিফের ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল, “এগুলো আমার ছাড়া আর কারোর না হোক।”

তাখলিফ ওর বাচ্চামো দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো। ঝুমুর কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আপনি অন্য কারো হওয়ার আগে যেন অন্য কেউটা ধ্বংস হয়ে যায়। বলুন আমিন।”

তাখলিফ থতমত খেয়ে ওর সাথে সাথে বলল, “আমিন।”

পরক্ষণেই ও ভাবুক গলায় বলল, “কিন্তু তুই যদি
অন্য কারো হয়ে যাস?”

ঝুমুর মিটিমিটি হাসলো। ব্যাপারটা বুঝলো না তাখলিফ। তাই চোখমুখ গম্ভীর হয়ে গেলো ওর। রাগান্বিত হয়ে রহস্য খেলা করা ঝুমুরকে সরিয়ে দিতে যাবে তখনি ঝুমুর বলল, “অন্য কারো হয়ে যাওয়ার আগে আমার অস্তিত্ব যেন এ পৃথিবী থেকে মুছে যায়। আমিন। আপনিও বলুন, আমিন…”

তাখলিফের মেজাজ মুহূর্তেই গরম হলো। ঝুমুরকে নিজের নিচে ফেলে ওকে বিছানার সাথে চেপে ধরে বলল, “সবগুলো দাঁত একটা একটা করে খুলে ফেললে কি হবে রে তোর? জিভ ছাড়া কিছু বলতে পারবি? আমি কিন্তু ভুলেও ফিরে দেখবো না তোকে৷ তাই উল্টাপাল্টা কথা বলে লিমিট ক্রস করবি না। লাস্টবার ওয়ার্নিং দিলাম।”

ঝুমুর মুখ কালো করে বলল,
“আমি মজা করছিলাম।”

তাখলিফ ওর গাল চেপে ধরে বলল, “তুই একমাত্র! যার কারণে আমি জীবনটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি, মা-বাবার পর তুই এখন আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় কেউ। তাই এমন কিছু বলিস না বা করিস না যাতে করে আমি শেষবারের মতো সবদিক থেকে ভেঙে গুড়িয়ে যাই।”

ঝুমুর মিনমিন করে বলল,
“সরি। এইযে, আর কখনো এমন কিছু বলবো না।”

“করবিও না। ঘুমাই এবার? রাতে বড্ড জ্বালিয়েছিস।”

“একটুই তো।”

ঝুমুরের করুণ কন্ঠস্বর শুনে তাখলিফ বলল,
“আচ্ছা যা, মাফ করে দিলাম।”

ঝুমুর স্মিত হেসে বলল,
“আপনি ওপরে ওপরে কঠিন হওয়ার চেষ্টা করলেও ভেতরে শিমুল তুলার মতোন নরম। আমি আপনাকে আগে কি ভাবতাম জানেন?”

তাখলিফ কিছু বললো না। কৌতূহলী চোখে তাকালো।
ঝুমুর ওর সম্মতির অপেক্ষা না করেই চোখমুখ কুঁচকে বলা শুরু করলো, “নির্দয়, অহংকারী, দাম্ভিক, পাষাণ। মুখটা কেমন শুকনো করে রাখতেন, একটুও হাসতেন না। আমি আপনাকে খুব ভয় পেতাম। কেউ একটু ভুলচুক করলেই এমনভাবে চোখ রাঙাতেন আর ধমক দিতেন যে ভয়ে আমার আত্মা বেরিয়ে যেতো। মাঝেমাঝে আবার ভাবতাম আপনি খুব দুঃখী লোক। তাই কথায় একফোঁটা রসকষও নেই। একবার দুপুরে ছাদে গাছে পানি দিতে গেলে সামান্য কারণে আপনি আমাকে কি ধমকটাই না দিয়েছিলেন, সব মনে আছে আমার। সেদিন আমার ভয়ে জ্বর এসে গেছিলো। তখন আমি এগারো বছরের একটা মেয়ে ছিলাম। আপনার একটু মায়া হয়নি। হুহ!”

তাখলিফের ঠোঁটের কোণের চাপা হাসির রেখাটা চোখে পড়লো না ঝুমুরের। ও বলতেই থাকলো নিজের মতো। তাখলিফ গলার স্বর গম্ভীর করে স্বগোতক্তি করলো, “এগারো বছরের সেই ছোট্ট, অবুঝ ঝুমুর এখন নির্দয় লোকটার বুকের নিচে শুয়ে জোর করে চুমু খায়, শাড়ি পরে সিডিউস করে ফেলে পাষাণ লোকটাকে। একটুও ভয় পায় না দাম্ভিক লোকটাকে। কত উন্নতি হয়েছে তোর। আই কান্ট বিলিভ।”

ঝুমুর ওর ঠাট্টা ধরতে পারলো না। অনুযোগের স্বরে বলল, “হ্যাঁ, আগে খারাপ ছিলো। এখন ভালো। চুমু খেতে দোষের কী? আমার বর হয়, যা খুশি করবো।”

“দম আটকে মে’রে ফেল।”

ঝুমুর বিগলিত চিত্তে বললো, “বললেই হলো? সবাইকে রেখে আমাকে এত ভালোবাসে, মরে গেলেও এত কষ্ট দিতে পারবো না।”

তাখলিফ অবাক হওয়ার ভান করে জিজ্ঞেস করলো,
“কে বললো ভালোবাসে? মুখে বলেছে তোর বর?”

“মনে মনে বলে, আমি শুনতে পাই।”

“ওটা তোর ভুল ধারণা।”

ঝুমুর হার মানলো না। উল্টো নির্লিপ্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে বলল, “আমি তাকে এত ভালোবাসবো যে তাকে ‘ভালোবাসি’ বলার সুযোগই দেবো না। অবশ্য সে যে প্রতি সেকেন্ডে মনে মনে আমাকে ‘ভালোবাসি’ বলে সেটা আমিসহ পুরো পৃথিবী জানে। কারণ তার কাছে আমি স্পেশাল। তাই শত খোঁচা দিয়েও লাভ নেই মিস্টার তাখলিফ হাসান তূর্য।”

ঝুমুর নামটা এমনভাবে উচ্চারণ করলো যে তাখলিফের বুকের ভেতর সমুদ্র তরঙ্গ আছড়ে পড়তে লাগলো। শীতল হয়ে ওঠলো দেহ, মন। বৃষ্টির শব্দগুলো ছন্দ হয়ে মাথায় ঘুরতে লাগলো একমনে। ভালোবাসা আর অনুভূতির জোয়ার এতো মধুর হয় তা আগে জানা ছিলো না ওর। একটা মেয়ে, শুধু ওর বউ বলেই এত কি করে বুঝে ওকে ভেবে পায় না তাখলিফ। ও বহু কষ্টে নিজের আড়ষ্টতা সামলে ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “ট্রিমেন্ডার্স গার্ল।”

“ডেফিনেটলি সাহেব। আপনি আগে ভীষণ কিউট ছিলেন।”

তাখলিফ ভ্রু কুঁচকালো, “তখন? এখন না?”

“এখন তার চেয়েও বেশি। তবে কিউটনেস কমে হ্যান্ডসামনেস বেশি।”

“তাই?”

“একটুও মিছে না। আসলে…”

তাখলিফ ওর বকবক থামাতে এবার ওর নাক টেনে ধরে ক্লান্ত গলায় বললো, “বকবক করতেই থাকবি? রাত থেকে বলছি, আমি ভীষণ ক্লান্ত। তুই একটু ঘুমালে আমিও ঘুমাবো।”

মুহুর্তেই মেজাজ পালটে গেলো ঝুমুরের। লোকটার এত প্রশংসা করলো আর সে বলে কি-না ঘুমা? ওর তো একটুও প্রশংসা করলো না! অভিমানে স্তব্ধ হলো মনটা। ঝুমুর ধারালো গলায় বলল, “ডিস্টার্ব করার জন্য সরি। আপনি ঘুমান, আমি চুপ আছি। ছাড়ুন আমায়…”

ঝুমুরের অভিমানী গলা। এর অর্থ বুঝতে সময় লাগলো না তাখলিফের। ছলছল, সুন্দর, গভীর দৃষ্টি জোড়ায় ডুবে গেলো কিয়ৎক্ষণের জন্য। নিচু অথচ গভীর গলায় সে শুধালো, “তুই আমার মৃ’ত মস্তিষ্কে প্রাণের সঞ্চার করা সেই চিরসুন্দর মন, যে আমার অন্তঃকরণে প্রস্ফুটিত করেছিস এক পৃথিবী ফুল।
সেই শোধবোধ থেকে বলছি, তুই হলি আমার সেই বন্য গোলাপ— যে মাখো মাখো প্রেমের মতো নির্মল, স্বচ্ছ! আরও কিছু শুনতে চাস? তাহলে শোন, তুই আমার পুরো জীবনের আস্ত একটা ভালোবাসার ন্যায় সুন্দর ঝুমুর।”

ত্বরিত কেঁপে ওঠলো ঝুমুর। বাক্যগুলো শিহরণ জাগালো ওর ভোঁতা মস্তিষ্কে। ছলছল, উদাস করা নেত্রপল্লবে এবার ওঠলো সমুদ্রের তরঙ্গোচ্ছ্বাস। মলিন মুখটাতে ফুটে ওঠলো প্রথম সূর্যের ন্যায় দীপ্তিমান উজ্জ্বলতা, শুষ্ক ওষ্ঠজোড়ায় চওড়া হলো হাসি। আচ্ছা, বর্ষা—শরৎের মাঝামাঝি বৃষ্টি কি মেঘের ভাঁজে করে প্রেম নিয়ে আসে নতুন করে? নাহলে স্বামীর মুখ থেকে শোনা দু-তিনটে বাক্য কেন ওর মন উলটপালট করে দিলো? অদৃশ্য জাদুবলে স্বামী নামক পুরুষটাকে প্রেমিক পুরুষে রুপান্তর করে তার কাব্য গাথা শুনতে ইচ্ছে হলো কেন? একটু ভাবুক হলো ঝুমুর, তাখলিফ নামক পুরুষটা কি আদৌ কাব্য গেঁথেছে ঝুমুরের জন্য? কে জানে!

__________

বর্ষা পেরিয়ে শরৎ এলো এইতো কিছুদিন। শিউলি এসেছে অথচ এখনো আকাশ থেকে কালো মেঘ সরে গিয়ে পেঁজা তুলোর সৌন্দর্য উপভোগ করা বিরল ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কালেভদ্রে দেখা দেওয়া সেই অমায়িক সৌন্দর্য নিয়ে কেউ ভাবে না। অবশ্য ভাবার অবকাশও নেয়। মানবজীবনের জটিলতার কাছে পৃথিবীর সৌন্দর্য তুচ্ছ! নিশ্চল, মন খারাপ করা আবহাওয়া নিয়ে দু, দু’টো সপ্তাহ চোখের পলকেই কেটে গেলো। সবকিছু শান্ত, সুন্দর, স্বাভাবিকভাবে চলছে। কিন্তু মায়ের মন? যেখানে তীব্র বিষাদ রুপ নিয়েছে তীব্র ঘৃণায় তা কি কালো মেঘের মতো কখনো মন থেকে সরে যায়? না যায় না। চির অপছন্দের ছেলেটির সাথে তার সর্বশেষ নাড়িছেঁড়া ধন একসাথে থাকছে, খাচ্ছে, শুচ্ছে, হেসেখেলে বেড়াচ্ছে তা পাখি বেগম কিছুতেই মানতে পারছেন না। মেয়ের সুখের চিন্তা তো তার মাথায়ই আসেনি, এসেছে তাখলিফ নামক চির অপছন্দের ছেলেটির সুখের কথা। এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকে যে ছেলেটাকে বাচ্চা বয়স থেকে তিনি ঘৃণা করে আসছেন সে-ই ঘৃণা কি দু’দিনে মেটে? না, কখনো না। মেয়ের জীবন, স্বামীর বেজার মুখখানা আর শ্বাশুড়ির তাখলিফকে নিয়ে প্রশংসামূলক আচরণ তার গায়ে কাঁটা হয়ে বিঁধছে! যা তার সত্তা এই আঠাশ বছরের জীবনেও নিতে পারেনি, এই দু’সপ্তাহে কি করে মেনে নিবেন? তাখলিফের প্রতি এই বিষাদ, ঘৃণা, অপছন্দ, নিজের আত্মঅহমিকা, রক্ষণশীল মনোভাব সবকিছু মিলিয়ে তাকে ভেতরে ভেতরে করে তুলেছে হিংস্র।

অজপাড়া গায়ের রক্ষণশীল ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবার থেকে ওঠে আসা পাখি বেগম। পড়াশোনা প্রাইমারির গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ। মধ্যবিত্ত পরিবারে দারুণ সৌন্দর্য নিয়ে জন্মেছিলেন বলে বিয়ের বয়স না হতেই পরিবার থেকে বিত্তশালী ব্যবসায়ী ও ভালো বংশের পাত্রের খোঁজ পেয়ে তাকে শামসুল হকের সঙ্গে জীবনভর বেঁধে দেওয়া হয় বিয়ে নামক সম্পর্কে। এরপর! অল্প পানির মাছ বেশি পানিতে পড়লে যা হয়, পাখি বেগমেরও সেটাই হলো। কুটিল মনোভাবসম্পন্ন তিনি পারিবারিক রাজনীতিটা নিজের পরিববার থেকেই আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। তাই এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর সবদিক বিবেচনা করে তিনি চিরকালই চেয়েছেন এ বংশে নিজের ছাড়া অন্য কারো পুত্রসন্তান না আসুক। তাখলিফের ব্যাপারটা যা তা, কিন্তু যখন শুনলো ছোট জা প্রমিলার দুই জমজ মেয়ের পর এবার তার ছেলেসন্তান আসতে চলেছে তখনই পাখি বেগম হিংসায় ফেটে পড়েন ভেতরে ভেতরে। নিজের ছেলের আরো একজন প্রতিদ্বন্দ্বী আসছে ভেবে গ্রামের সেই মূর্খ মহিলাটি নিকৃষ্ট একটা অন্যায় করে বসে এরপর। তাখলিফের সামান্য রাগকে কেন্দ্র করে কৌশলে সেদিন এমনভাবে সবকিছু করেন যাতে করে পরবর্তীতে সবাই বোঝে প্রমিলার অনাগত পুত্রসন্তানকে মেরে ফেলা এবং চিরজীবনের জন্য মাতৃত্ব হারানোর একমাত্র দায়ভার বড়বৌ তমালিকার একমাত্র আদরের সন্তান তাখলিফেরই। কাজটাতে সফলও হন তিনি। প্রমিলার এ দুর্ঘটনার পর এ বিশাল প্রতিপত্তির ভাগিদার ও বংশপ্রদীপ রইলো দু’জন। তাখলিফ আর ইয়াসিফ। পাখি বেগম জানতেন তাখলিফ খুবই জেদী, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ছেলে। তাকে যদি একবার ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে তার পুত্র ইয়াসিফ ছাড়া আর কেউ এ বিশাল প্রতিপত্তির ভাগিদার হতে পারবে না। নিজের ছেলর চেয়ে তমালিকার পুত্রকেই সবাই মাথায় করে রাখতো বলে তাখলিফের প্রতি তার আজন্ম ক্রোধ।

বলা বাহুল্য, শহরের চাকচিক্যময় জীবন, শ্বশুরবাড়ির প্রতিপত্তি, সংসারে নিজের ক্ষমতা জাহির করাটাই ছিলো তার কাছে মুখ্য বিষয়। তবে বড় বৌ তমালিকার জন্য চাইলেও সেরকম জায়গা তৈরি করতে পারেন নি। তবুও মুখবুজে সব মেনে নিচ্ছিলেন। কারণ তমালিকা ছিলো শিক্ষিত, আদর্শ নারী। যার পরামর্শের ভিত্তিতেই এ বাড়ির সব ক’টা মানুষ চলাফেরা করতো৷ তার জন্যই পাখি বেগম এ বাড়ির বউ হতে পেরেছেন। সেজন্য মনে চাপা রাগ থাকলেও তা কখনো প্রকাশ করেন নি। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করেছেন এ বাড়ির সবাইকে হাতের মুঠোয় নিতে। তাখলিফ যখন মাদকাসক্ত জীবন কাটাচ্ছিলো তখন তমালিকা খুবই ভেঙে পড়েছিলো। আর এই সুযোগে তমালিকার দুশ্চিন্তায় ‘ঘি’ ঢেলে তাখলিফের নামে বানোয়াট অনেক কথাই পাখি বেগম তার কানে তুলেন। সেসব আজ পর্যন্ত কেউ জানে নি, কেউ অবশ্য জানবেও না। সবাই তাকে সহজ-সরল মহিলা হিসেবে জানে এখনো পর্যন্ত। সেরকমটাই বুঝিয়ে এসেছেন স্বামীসহ পুরো পরিবারের মানুষগুলোর কাছে। এরপর ম্যাজিকের ন্যায় অভাবনীয় ভাবে পেয়ে যাওয়া তমালিকার মৃত্যুটা ছিলো তার কাছে হাতে পাওয়া আকাশের চাঁদের মতোন। তার কুৎসিত, নোংরা মনটা তখন অবশ্য প্রফুল্লচিত্তে ডালপালা মেলে ভেতরে ভেতরে। নিজের সবকিছু দিয়ে সংসারটা আগলে রাখার চেষ্টা করলেও কেন যেন সবাইকে নিজের বাগে আনতে পারে নি। তবে কৌশলে করা এ অন্যায় চাওয়াগুলোর জন্য অবশ্য আজ পর্যন্ত তার মনে কোনো আফসোস, অনুতাপ নেই। কিন্তু ইদানীং তার কাছে সবকিছু দুর্বোধ্য ঠেকছে। তার সুষ্ঠু, সহজ পরিকল্পনা সব একটা ঝড়েই কেমন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। নিজের দু’টো সন্তানই তাখলিফ বলতে অজ্ঞান। বোকা, কদর্য ও নিকৃষ্ট চিন্তাধারার মহিলাটি দিশেহারা হয়ে এবার ঠিক করলেন বড় মেয়ে ঝিনুককে দিয়েই ঝুমুরের ব্রেন ওয়াশ করাবেন। কারণ তার ছোট মেয়ে ঝুমুর বড় বোনকে খুব মানে। ঝিনুকের কথা ফেলার আগে নিশ্চয়ই দশবার ভাববে ঝুমুর। এতেই যদি মেয়েটার সুবুদ্ধি উদয় হয় তাহলে তারচেয়ে বেশি শান্তি কেউ পাবে না। জা’য়ের ছেলে এমনভাবে ঝুমুরের মাথা খেয়েছে; যে মেয়েটা আগে তাকে চোখে হারাতো সে এই দুই সপ্তাহ মায়ের কাছেই আসেনি, বলতে গেলে তিনতলা থেকে দোতলার পথও মাড়ায়নি। তবে একবার আসলে মেয়েকে আর যেতে দিতেন না, এটা নিশ্চিত! সন্তানের ভালো থাকা মা-বাবার চেয়ে আর কে বুঝে এই পৃথিবীতে? এখন মেয়ে নাচানাচি করছে সবটাই আবেগ! ক’দিন পর যখন সব আবেগ, ভালোবাসা শেষ হয়ে যাবে তখন ঠিকই বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসবে এই বদ্ধমূল ধারণা বিষাদিনী পাখি বেগমের!

___________

চলবে…

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২১

ঝুমুর বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
কান্নার কারণ তাখলিফের মানা থাকা স্বত্তেও ওর অনুপস্থিতির সুযোগে বৃষ্টিতে ভিজে কঠিন জ্বর বাঁধিয়েছে সে। অফিস থেকে ফিরে বাবার কাছ থেকে এসব শুনে তাখলিফ ভীষণ ঝেড়েছে ওকে। ঝুমুর ওর বকাঝকা আর কঠিন কথায় দুঃখ পেয়ে কাঁদছে। আর তাখলিফ রেগে বোম হয়ে বিছানা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে এখনো অফিসের পোশাক। ক্লান্তশ্রান্ত মুখ খানি কঠোর। চোখদুটো রক্তিম। ওর ইচ্ছে করছে ঝুমুরকে ঠাটিয়ে দুটো চড় দিতে। কিন্তু তা সম্ভব না। বউয়ের গায়ে হাত ওঠাতে গেলে ওর নিজেরই কলিজা মোচড় দিয়ে ওঠে। ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রয়ার থেকে ঔষধ বের করে নিয়ে এলো। কিন্তু ঝুমুরকে টলানো গেলো না, কিছুতেই নড়চড় করলো না। তাখলিফ আরো রেগে গিয়ে জোর করে চেপে ধরে ওর মুখে ট্যাবলেট দিয়ে দিলো। কিন্তু ঝুমুরেরও রাগ হচ্ছে, ও মুখে ট্যাবলেট নিয়ে বসে রইলো। ঢোক গিললো না। তাখলিফ চোখ রাঙানি দিয়ে গমগম স্বরে বলল, “চুপচাপ গিলে নে। রাগাবি না।”

ধমক! সেবা করে আবার ধমক দিচ্ছে? কে হাতেপায়ে ধরেছে ওর? কে চেয়েছে সেবা? ঝুমুর রাগে-দুঃখে শক্ত হয়ে বসে রইলো। জ্বরের কারণে নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। তাখলিফ এই দৃশ্য দেখে নিজের রাগ সামলাতে চোখ বন্ধ করে জমে থাকা শ্বাসটুকু নির্গমন করলো। এরপর ঝুমুরের কপালে হাত রেখে টেম্পারেচার চেক করতেই ঝুমুর মুখ থেকে ট্যাবলেটটা ফেলে দিয়ে গায়ে কম্বল টেনে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো। তাখলিফ হতভম্ব, বাক্যহারা হয়ে গেলো ওর আচরণ দেখে। পরক্ষণেই ফুলদানিটা আছাড় মেরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সানওয়ার হক বসার ঘরে টিভি দেখতে দেখতে চা খাচ্ছিলেন। শব্দ শুনে চমকে ওঠলেন। তাখলিফ ডাইনিংয়ে এসে জগ থেকে গ্লাসে পানি নিয়ে খেতে উদ্যত হতেই সানওয়ার হক হাতের কাপটা নামিয়ে রেখে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি একটা ভাঙলো?”

“জানি না।”

“ঝুমু’র জ্বর নেমেছে?”

তাখলিফ চটে গিয়ে বলল, “তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস করো।”

“এভাবে কথা বলছিস কেন?”

“ভালো কথা মুখ দিয়ে আসছে না।”

“হয়েছেটা কী?”

তাখলিফ গলা চড়িয়ে বলল,
“তোমার ভাইয়ের মেয়েকে আর রাখবো না। তার বাড়িতে দিয়ে এসো।”

সানওয়ার হক কপালে ভাঁজ ফেললেন, “আমার ভাইয়ের মেয়ে বলছিস কেন? ও আমার পুত্রবধূ, বড় কথা তোর বউ।”

“কিসের বউ? বউ লাগবে না। এমন বেয়াদব মেয়ে আমার বউ হতে পারে না।”

সানওয়ার হক শান্ত স্বরে বললেন,
“রাগারাগি করেছিস? আহা! মেয়েটা অসুস্থ। একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে কথা বল।”

“এখনি দিয়ে এসো, নয়তো ওকে আমি কি করবো নিজেও জানি না।”

তাখলিফ নাছোড়বান্দা। সানওয়ার হক পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “আমায় বলছিস কেন তাহলে? নিজেই যা। অসুস্থ বউকে ডাক্তার না দেখিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দে। লোকে তোকে মহাপুরুষ বলবে।”

তাখলিফ তেঁতে ওঠলো, “তোমার কি ধারণা, আমি কাপুরুষ?”

“আমি তো একবারও বলিনি। কেন তোর কি নিজেকে নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে?”

“বাবা প্লিজ! ডোন্ট আন্ডারএস্টিমেট।”

“আমি কিছু বলছি না তো। তোর বউ, ঘর-সংসার তুই সামলা। আমাকে অহেতুক জড়াস না। তুই মহাপুরুষ না কাপুরুষ তা নিয়ে ভাবার সময় আছে নাকি আমার? এমনিতেই ব্যবসায়ী হয়ে মস্ত ফ্যাসাদে থাকি।”

বলতে বলতে নিজের ঘরে চলে গেলেন সানওয়ার সাহেব। তিনি কখনোসখনো এটা-ওটা উপদেশ দেন, বোঝান। কিন্তু ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টা করেন না। স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে ঢোকাটা তার কাছে নিচু মানসিকতার ব্যাপার বলে গণ্য হয়। ছেলের চেহারা দেখেই তিনি বেশ বুঝেছেন, মনোমালিন্য হয়েছে দু-জনের। ছেলে ঝুমুরের ওপর রেগে আছে। কিন্তু এত সরল, ভদ্র একটা মেয়ের ওপর কিভাবে কেউ রেগে থাকতে পারে তাই বুঝে আসছে না তার। ছোট থেকে ঝুমুরকে দেখছেন তিনি, কত অমায়িক, সুলভ ব্যবহার! একদম নিশি-তিথি বা ঝিনুকের মতো নয়। সানওয়ার হক অবশ্য প্রথমে ওদের সম্পর্কটা নিয়ে প্রচুর চিন্তাগ্রস্ত থাকলেও দু’জনের মিলমিশ দেখে তার দুশ্চিন্তা কমেছিলো। কিন্তু ছেলেটা এখন আবার অসুস্থ মেয়েটার সঙ্গে রাগারাগি করছে যার কোনো কারণ নেই। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলে-মেয়ে দুটো ভালো থাকলে তারও সুখ। সবটা ঠিকঠাক থাকলেই তার স্বস্তি।

.

বাবা-ছেলের কথা ভেতর ঘর থেকে শুনছিলো ঝুমুর। ওকে দোতলায় পাঠিয়ে দেবে শুনেই ওর অন্তরাত্মা কাঁপাকাপি জুড়ে দিয়েছে। শত রাগারাগি, ঝগড়া হলেও তাখলিফকে ছাড়া সে থাকতে পারবে না। কিছুতেই না। এই ক’দিনে ওর অভ্যাসে, আত্মার সাথে মিশে গেছে লোকটা। সেজন্য পারতপক্ষে সে দোতলাও মাড়ায় না। মা-বাবার ভয়ে সে বাইরে বের হওয়া ছাড়া দোতলাটা খুবই এড়িয়ে চলে। সেখানে এই লোকটা এত অবলীলায় কিভাবে পাঠিয়ে দেবে বলছে? তাও জ্বরাগ্রস্ত ঝুমুরকে? তাখলিফের ওপর চাপা রাগ আর অভিমানটা ভয়ে পরিণত হলো ওর। তাই চুপচাপ চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছিলো সে।

এদিকে বাবার কথা দারুণ ইগোতে লাগলো তাখলিফের। ঝুমুরের ওপর হওয়া রাগটা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে লাগলো। তৎক্ষনাৎ ঘরে গিয়ে ঝুমুরকে বলল, “চল।”

ঝুমুরের কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো, “কোথায়?”

“হসপিটালে।”

“কেন?”

“তোকে হসপিটালে নিয়ে যাবো। দরকার পড়লে এডমিট করাবো।”

“না, আমি কোথাও যাবো না।”

তাখলিফ কড়া গলায় বলল,
“যেতে হবে। তোকে সুস্থ করিয়েই তোর বাড়ি পাঠিয়ে দেব। আমার কাছে থাকলে তো তোর মন ঠিকঠাক থাকে না। যা খুশি তাই করতে পারিস। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধাতে পারিস,অথচ আমি সামলাতে পারি না তোকে। বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে তোর বাবা-মা মিলে তোকে সামলাবে। ওদের কথা তুই নিশ্চয়ই শুনিস। আমি কে যে আমার কথা শুনবি? বাবা আমাকে তোর জন্য কাপুরুষ ভাবলো! কিছুতেই তো আমি সেটা মানবো না।

“দেখুন আমি সরি।”

“সরি? কিসের সরি?”

ঝুমুর দু’হাতে মুখে ঢেকে ভয় ভয় গলায় বলল,
“আমি আর কখনো আপনার কথা অমান্য করবো না।
কখনো বৃষ্টিতে ভিজবো না। আপনার কথার বাইরে এক পাও চলবো না। আপনি যেমন বলবেন তেমনই চলবো। আপনার মুখে মুখে কথা বলবো না। রাগ-জেদ করবো না। বেয়াদবি করবো না। অসুখ হলে আপনি যে ঔষধ দেবেন সাথে সাথে খেয়ে নেবো। তবুও দয়া করুন, আপনি আমাকে কোথাও যেতে বলবেন না…”

ঝুমুর যেন নিজের মাঝে নেই। কোনো ঘোরে চলে গেছে সে। হাত-পা কাঁপছে। চোখ জলে টলমল। নাকের ডগা আরো লাল হয়েছে। তাখলিফ ভ্রু কুঁচকে সূক্ষ্ম চোখে ওর কার্যকলাপ দেখছিলো। ঝুমুর মাথা নুইয়ে এমনভাবে একনাগাড়ে কথাগুলো বলছিলো যে তাখলিফ কখন ওর পাশে বসেছে তা টেরই পেলো না! ঝুমুরকে আস্তে করে আগলে নিলো সে, কান্নায় হাবুডুবু খাওয়া ঝুমুর ওর পানে তাকালো না। তাখলিফ ওর হৃদপিন্ড বরাবর হাত দিয়ে ছুঁতেই টের পেলো সেটা অস্বাভাবিক গতিতে ছুটছে। গায়ের তাপমাত্রা আগের চেয়ে একটু বেশি গরম। তাখলিফের কপালে ভাঁজ পড়লো। রাগ-জেদ উবে গেলো সাথে সাথেই। অসুস্থ বউয়ের জন্য ওর খুব মায়া লাগলো, নিজেকে অসহায় লাগলো। ঝুমুরের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে গরম কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, “এত জ্বর কেন হলো তোর? আমি এখন কি করবো তোকে নিয়ে? নিজের ভালো একটুও বুঝিস না।”

ঝুমুর সেঁটে গেলো ওর সাথে। তাখলিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই ভয়ার্ত গলায় বলল, “আমি কিন্তু মায়ের কাছে যাবো না। আপনি এমন কথা আর বলবেন না তো?”

“আমার সব কথা শুনলে বলবো না।”

“শুনবো।”

“তাহলে এক্ষুনি ঔষধ নিবি, তারপর হসপিটাল যাবো।”

“এখন? লাগবে না। ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবো।”

তাখলিফ চোখ রাঙালো,
“আবার বেয়াদবি?”

ঝুমুর মিইয়ে গেলো ধমক শুনে। প্রতিবাদ করার সাহসটুকুও রইলো না। চুপচাপ ঔষধ খেয়ে নিলো কিন্তু ওঠে দাঁড়ানোর শক্তি পেলো না। তাখলিফ মহাবিরক্ত ও শঙ্কিত হলো। সানওয়ার সাহেব বললেন এত রাতে অসুস্থ শরীরে হসপিটালে নেওয়াটা ঝুমুরের পক্ষে সম্ভব হলেও কষ্টকর! তাই পরিচিত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে। তাখলিফ ভেবেচিন্তে সেইমতো পরিচিত ডাক্তারকে কল করলো। ডাক্তার সব শুনে বললেন হাসপাতালে আসার দরকার নেই। যে ঔষধ নিয়েছে তাতেই হবে, তেমন বাড়াবাড়ি কিছু হলে গা-মাথায় পানি দিয়ে জ্বর নামানোর চেষ্টা করলে কাজে দেবে। তাখলিফ তা-ই করলো। একটুখানি স্যুপ খাইয়ে, মাথায় পানি দিয়ে, গা-টা মুছিয়ে কম্বলে মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো ঝুমুরকে নিয়ে। তাখলিফের বুকে ঝুপ করে শান্ত হয়ে যাওয়া বাচ্চার মতো পড়ে রইলো ঝুমুর। তবে সুযোগ পেলেই ওর সামনে বকবক করে আজগুবি কথা বলা ঝুমুরকে এত শান্তও নিতে পারছিলো না তাখলিফ। তাই কিছুক্ষণ উসখুস করে প্রশ্ন করলো, “ঘুমিয়েছিস?”

“উহু।”

“তাহলে? কিছু বলছিস না যে? খুব খারাপ লাগছে?”

ঝুমুর মিয়ম্রাণ কন্ঠে বলল, “আপনি তো অনুমতি দেন নি কথা বলার।”

তাখলিফ অবাক হয়ে গেলো, “কথা বলার জন্য অনুমতি নেওয়ার কি আছে?”

ঝুমুর উৎকন্ঠিত গলায় বলল,
“আপনি যদি বিরক্ত হয়ে আমাকে পাঠিয়ে দেন? মা-বাবা আর আসতে দেবে না। আপনাকে ছাড়া
আমি একটুও থাকতে পারবো না, একটুও না।
মরে যাবো। আচ্ছা, আপনি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন?”

তাখলিফ ভীষণ অবাক হলো। বুকের ভেতর কেমন চিনচিনে একটা ব্যথা হচ্ছে। কেন হচ্ছে জানে না। ঝুমুরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ওর ঠোঁটে আঙুল রেখে ফিসফিস করে বলল, “হুঁশশ, ঘুমা।”
.

ঝুমুরকে নিয়ে ভয়ে থাকায় রাতটা নির্ঘুম কাটলো তাখলিফের। ঝুমুরের জ্বর ভোরের দিকে নেমে গেলো। তখনি একটু স্বস্তিতে চোখদুটো বুজতে পারলো সে। ছুটির দিন থাকায় সকালে ওঠার তাড়া ছিলো না।
নয়টার দিকে ঝুমুরের ঘুম ভেঙে গেলো। নিজেকে আবিষ্কার করলো তাখলিফের বাহুডোরে। ঘুমন্ত তাখলিফের মুখ খানির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে অনেকটা সময় কাটিয়ে ওঠে বসলো সে। জ্বর নামায় ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে গা। দুর্বল শরীরটা নিয়ে বিছানা থেকে নামলো। ফ্যানের স্পিডটা বাড়িয়ে দিয়ে পর্দাগুলো টেনে দিলো যাতে বাইরের রোদ এসে তাখলিফের ঘুমটা না নষ্ট করতে পারে। এরপর গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। বারান্দায় কাপড় মেলতে দেওয়ার সময় দেখলো বাড়ির গেটের সামনে এসে থেমেছে একটি সাদা রঙের গাড়ি। একটু ভাবুক হলেও তেমন একটা পাত্তা দিলো না সে। আওয়াজ না করে ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে আসতেই দেখলো সানওয়ার হক বসে আছেন। ঝুমুর মাথায় ওড়না টেনে তার কাছে যেতেই সানওয়ার হক ওকে দেখে ব্যস্ত গলায় বললেন, “একি! ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? এসে বসো!”

ঝুমুর হাসলো। এরপর বসলো। সানওয়ার হক উৎকন্ঠিত গলায় বললেন,”জ্বরটা নেমেছে রে মা?”

“এখন জ্বর নেই চাচ্চু।”

“তবুও! একটু বিশ্রাম নাও, ভালো লাগবে।”

“অনেকক্ষণ রেস্ট করেছি। এখন তো বোরিং লাগছে।”

সানওয়ার হক হেসে বললেন,
“তাও বটে!”

ঝুমুর জিজ্ঞেস করলো, “নিশ্চয়ই এখনো খান নি। আপনি কি নাস্তা করবেন বলুন চাচ্চু।”

সানওয়ার সাহেব নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন, “আমি খেয়ে নিয়েছি মা। টেবিলে দেখো তোমাদের জন্য খাবার রাখা আছে। তাখলিফ কোথায়? এখনো ঘুমাচ্ছে নাকি?”

“জি।”

“তাহলে তুমি খেয়ে নাও, ও পরে ওঠলে খেয়ে নেবে। অসুস্থ শরীরে বেশিক্ষণ খালিপেটে থেকো না।”

“আচ্ছা। কিন্তু আপনি আজ বাসায়ই তো?”

“হ্যাঁ। কেন?”

“তাহলে আজ দুপুরে আমি রান্না করবো।”

সানওয়ার হক আঁৎকে ওঠার ভঙ্গিতে বললেন,
“না, একদম না। আমি তো দেবোই না, তাখলিফ দেখলে ভীষণ রাগ করবে।”

ঝুমুর অনুরোধের স্বরে আবদার করলো,
“না করবেন না চাচ্চু। আপনি তো বাসায়ই থাকেন না সচরাচর, একদিন একটু আমার রান্না খান। ওনি রাগ করবে না।”

“দেখো তুমি সুস্থ থাকলে চাচ্চু না করতাম না। কিন্তু.. ”

ঝুমুর ব্যহত গলায় বলল,
“কোনো কিন্তু না বড়চাচ্চু। আমি এখন ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। তাছাড়া আমি তো আপনার মেয়েই। আমি আজ একটু রাঁধি প্লিজ…”

অতঃপর ঝুমুরের বায়না আর জেদের কাছে সানওয়ার হককে হার মানতেই হলো। কোনোমতে সকালের নাস্তাটা শেষ করে দুপুরের রান্নার আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো সে। যেগুলো তৈরিতে ঝুমুর বেশ পটু, সেগুলোই বেছে নিলো। পোলাও, রোস্ট, গরুর মাংস, ডাব চিংড়ি, ডিম ভুনা আর সব্জি। সবকিছু জোগাড়যন্তর করে রান্না বসিয়ে দিলো। সানওয়ার হকও ওকে সাহায্য করলেন। মাংস, সবজি কেটে ধুয়েটুয়ে দিলেন। এরপর রান্নাঘরের স্পেসে বসে ওর রান্না করা দেখার সাথে সাথে সঙ্গও দিলেন। বেশ হাসিঠাট্টাও হলো। সাড়ে বারোটার দিকে মাংসের সুগন্ধে তাখলিফের ঘুম ভাঙলো। ঘুম হালকা হতেই বিছানার বা-পাশটা হাতড়ে ঝুমুরকে না পেয়ে চোখদুটো খুললো সে। পাশ ফিরে সত্যিই ওকে না পেয়ে আপনাআপনি ভ্রু কুঁচকে গেলো ওর। জ্বর নিয়ে কোথায় গেলো ভাবতে ভাবতে ওঠে পড়লো। এরপর খুঁজে খুঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কাহিনী দেখতেই পায়ের তালু থেকে মাথার তালু পর্যন্ত গরম হয়ে গেলো ওর। সারারাত জ্বরে ভুগে উল্টাপাল্টা বকে এখন হেসে-খেলে রান্না করা হচ্ছে? আচমকা সানওয়ার হকের চোখ ওর দিকে পড়তেই সে বাবার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। ছেলেকে ওমন রাগতে দেখে তিনি কেশে ওঠলেন। ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি আনার প্রচেষ্টা করে বললেন, “ঝুমুর আমার জন্য আজ নিজহাতে রান্না করেছে। সুঘ্রাণেই বুঝা যাচ্ছে খেতে দারুণ হবে।”

বলে তিনি সেখান থেকে কেটে পড়লেন। এতক্ষণ ঝুমুরের মনোযোগ ছিলো রান্নায়। চাচার কথা শুনে পেছনে ফিরে তাখলিফকে রাগান্বিত চেহারা দেখতেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেলো। ওপাশ থেকে ফিরে ভয়ে কি করবে বুঝে ওঠতে না পেরে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে লাগলো। সব্জিতে খুন্তি নাড়তে লাগলো। এরপর অনেকক্ষণ পেছন থেকে তাখলিফের অস্তিত্ব না পেয়ে ভাবলো সে বুঝি চলে গেছে। তাই একবার পেছনে ফিরলো স্বস্তিতে। কিন্তু এরপরই অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। কারণ তাখলিফ ঠিক ওর পেছনে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ভ্রু কুঁচকানো, শক্ত মুখ। ঝুমুর ভয়ে ঢোক গিলে বলল, “এই শেষ, আর কোনোদিন আপনার কথা অমান্য করবো না।”

তাখলিফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আছাড় দিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।”

ঝুমুর কেঁপে ওঠে সাথে সাথে মুখ ফসকে বলল,
“ভেবেছি আপনি, বড়চাচ্চু আজ বাসায়। তিনজনে একসাথে খাবো, তাই…”

তাখলিফ ওর তোতলানো দেখে আর কথা বাড়ালো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর কপালে হাত রেখে এরপর জিজ্ঞেস করল, “এখন কেমন লাগছে?”

“ভালো।”

“রান্না শেষ?”

এ পর্যায়ে ঝুমুর খুশি গলায় বলল, “জি। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

তাখলিফ গেলো না৷ একটা চামচ নিয়ে প্রেশার কুকার থেকে মাংসের কারিটা চেখে দেখলো। এরপর বলল,
“রঙটা তো জোস এসেছে…”

প্রশংসা শুনে ঝুমুর আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো। তাখলিফ রোস্ট আর ডাব চিংড়িটাও চেখে দেখলো। সবগুলো রান্নাই ভালো হয়েছে, তবে এগুলো আর মুখফুটে বললো না। ঝুমুর অবশ্য ওর মুখ দেখেই যা বোঝার তা বুঝে গেলো। এরপর তাখলিফ চলে গেলো ফ্রেশ হতে, ঝুমুর বাকি রান্নাটুকু শেষ করলো আস্তেধীরে। এরপর শসা, টমেটো, গাজর, লেটুস নিয়ে বসলো সালাদ বানাতে।

.

তাখলিফ গালে শেভিং ক্রিম মেখে শেভ শুরু করেছিলো মাত্র। আচমকা ঝুমুরের মৃদু চিৎকার শুনে এমনই ভড়কে গেলো যে অসাবধানতা বশত ওর গাল কে’টে গেলো। কিন্তু সেটার খেয়াল বা তোয়াক্কা না করেই ও তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এসে দেখলো শসা কাটতে গিয়ে হাত কে-টে গেছে ঝুমুরের। মেয়েটা কাঁদছিলো, ওকে দেখে ধমক খাবে ভেবে সঙ্গে সঙ্গে কান্না বন্ধ করে শক্ত হয়ে বসে রইলো ঝুমুর। হাতটা লুকিয়ে নিলো ওড়নার আড়ালে। তাখলিফ বকাঝকা না করে জ্বলন্ত চোখে ওর দিকে এগিয়ে গেলো।
এরপর জোর করে হাতটা ওড়নার আড়াল থেকে বের করে নিচু স্বরে ধমক দিলো, “একটু দেখেশুনে কাজ করবি না? কি করছিলি?”

“সালাদ বানাচ্ছিলাম।”

“আর বানাতে হবে না।”

বলে ঘরে নিয়ে গেলো। ওকে বিছানায় বসিয়ে নিজেই তুলো দিয়ে র-ক্ত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। ঝুমুর তখনি ওর কাটা গাল দেখে কিছু বলতে যাবে ধমক দিয়ে ওর মুখ বন্ধ করে ওয়াশরুমে চলে গেলো তাখলিফ। গালে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে না কেন জানি, তবুও ইনফেকশন এড়াতে নিজেই রক্ত পরা বন্ধ করার জন্য মলম লাগিয়ে নিলো গালে। এরপর সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। দুপুরে তিনজনে মিলে বেশ ভালোই খাওয়াদাওয়া করলো। হাসিঠাট্টা, আনন্দে সময়টুকু কাটলো। সানওয়ার সাহেব সব ক’টা পদের ভীষণ প্রশংসা করলেন। ঝুমুর তাতে খুব খুশি হলো। বিকেলে চা-নাস্তার আয়োজন করলেন সানওয়ার হক। গল্পে গল্পে সময়টা বাবা, ঝুমুরের সময়টা কেটে যেতে লাগলেও তাখলিফ চুপচাপ খেলো, বসে বসে চাচা-ভাতিজির গল্প শুনলো। দুজনের আনন্দিত, হাসিখুশি চেহারাটা ওর মনে গেঁথে রইলো। সুখ সুখ অনুভূতি হলো৷ কিন্তু ওর নিজের মনের ভেতরে অস্বস্তি হলো, কিছু ভালো লাগলো না, ঠিক মনে হলো না। অথচ কেন এমন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না।

____________

চলবে…