#অপ্রিয়_সেই_তুমি
#প্রিয়া_আফরোজ
#পর্ব২
★★বর্তমান★★★
তুর্য খান বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে কলিং বেল চাপতেই ১টা মেয়ে এসে সদর দরজা খুলে দিলো, তারপর আবার রান্নাঘরে দিকে চলে গেলো।
তুর্য ভাবছে, কে এই মেয়ে? এটাই কি মায়া?
তার এই ভাবনার মাঝেই আতিয়া বেগম একপ্রকার দৌড়ে বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে, এসেই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কান্না জুরে দিলেন, কতো বছর পরে ছেলেকে কাছে পেয়েছে।
তুর্য মায়ের কান্না থামিয়ে, মায়ের সঙ্গে অল্প কিছু বাক্য বিনিময় করে চলে গেল দোতালায় তার ঘরের দিকে।
আতিয়া বেগম চেয়ে থাকে ছেলের চলে যাওয়ার দিকে,
গত ৮টি বছরে তার ছেলেটার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ৮ বছর আগের সেই হ্যাংলা-পাতলা গড়নের যুবক এখন বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী হয়ে গেছে। দেখতে আরো সুদর্শন হয়েছে।
_______________
সন্ধ্যা ৭টা
পুরো ৪ ঘন্টা পরে নিচে নামলো তুর্য,
রুমে গিয়ে গোসল করে একটু ঘুমিয়েছিল সে।
তুর্য নিচে আসতেই পরিবারের সবাই মিলে একসাথে খেতে বসে যায়।
নীরব চলে গেছে অনেক আগেই, হসপিটালে তার একটা অপারেশন ছিল তাই।
খাবার টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে আরাফ খান, তূর্য এবং তন্নি আর আতিয়া বেগম তাদেরকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। তূর্য অনেকবার আতিয়া বেগমকে তার সাথে বসে খাবার খেতে বললেও, আতিয়া বেগম তূর্যর কথা শুনল না।
ছেলের পাশে দারিয়ে একটু পর-পরই সে ছেলের পাতে এটা ওটা তুলে দিচ্ছে। খাবার টেবিলে রাখা আছে সরষে ইলিশ, গরু মাংস, খাসির মাংস, মুরগির রোস্ট, আলুভাজি, পোলাও, পায়েস ও রসমালাই, এগুলো সবই তুর্যর ভীষণ পছন্দের খাবার।
একটু পর পর রান্নাঘর থেকে এটা ওটা নিয়ে আসছিল দুপুরে দেখা সেই মেয়েটি।
তূর্য একবার তাকালো মেয়েটির দিকে, মেয়েটাকে ভালো করে দেখার পর তূর্য খানিকটা অবাক হলো
ছোটবেলা থেকে মায়া ছিল নজরকারা সৌন্দর্যের অধিকারী, কিন্তু এখন তার এ কি হাল হয়েছে?
চুলগুলো এলো-মেলো, চোখের নিচে কালো দাগ, পরনে নরমাল একটা সুতি থ্রি-পিস, সে কখনো এই মেয়েটার সাথে সংসার করবে না, এসব ভাবতে ভাবতে তুর্য আবার খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলো
খাবার খাওয়া শেষে রুমে গিয়ে তুর্য নিজের ল্যাপটপে কাজ করতে শুরু করলো। লন্ডনের তার নিজস্ব ২টা কোম্পানি আছে। তু্র্যর অবর্তমানে কোম্পানির সকল কাজের দেখাশোনা করার দায়িত্ব এসে পড়েছে তার এসিস্ট্যান্ট+বন্ধু ইমনের কাধে। ইমন কোম্পানির বিভিন্ন ফাইল ইমেইলের মাধ্যমে তুর্যর কাছে পাঠাচ্ছে, এদিকে তূর্য ল্যাপটপের সামনে বসে সেগুলো চেক করছে।
৫বছর আগে তূর্য তার বাবার থেকে ৭০০ কোটি টাকা নিয়ে একটি কোম্পানি খুলেছিল, তুর্যর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে কোম্পানির লাভের পরিমাণ বিপুল হারে বাড়তে থাকে, তারপর তূর্য ধীরে ধীরে নিজের ব্যবসা বিস্তার ঘটায় আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দুবাই ও কানাডায়। তুর্যর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ বর্তমানে সে ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকার মালিক।
_________________
রাত ১১টা…..
কাজ করতে করতে তূর্যর কফির প্রয়োজন হয়, এত রাতে কাউকে বিরক্ত করতে চাইলো না তূর্য। তাই তূর্য নিজেই রওনা হলো কিচেনের দিকে, উদ্দেশ্য এক কাপ কফি। ড্রয়িংরুমে পৌঁছাতেই তূর্য দেখতে পেলো এক কেশবতি কন্যা ফ্রিজের সামনে বাচ্চাদের মত মেঝেতে বসে রসমালাই খাচ্ছে। উল্টোদিকে ঘুরে বসার কারণে মেয়েটির মুখ এখনো দেখতে পায়নি তূর্য, মেয়েটি এখনো তূর্যর উপস্থিতি টের পাইনি, সে আপন মনে একহাতে ফোন টিপছে আর অন্য হাত দিয়ে চামচের সাহায্যে রসমালাই নিজের মুখে পুরে নিচ্ছে।
পরনে তার হাঁটু পর্যন্ত লম্বা গেঞ্জি আর প্লাজো,
মেয়েটা বসে থাকার সুবাদে তার লম্বা বিনুনিটা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
তখনই হঠাৎ তুর্য গম্ভীরতা ধরে রেখে জিজ্ঞেস করলো:-
-কে ওখানে?
তূর্যর কণ্ঠ শুনে মেয়েটি আস্তে আস্তে ঘুরে তাকালো তার দিকে, তূর্যর হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য মেয়েটার মায়াবী চোখের একটা চাহনিই যেন যথেষ্ট ছিল। মেয়েটিকে দেখার পর তূর্য যেন কয়েক মুহূর্ত নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গেল।
এদিকে মেয়েটি দুর্যোগে তার দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে রসমালাই এর বাটিটা ফ্রিজে তুলে রেখে দৌড়ে সিঁড়ির কাছে চলে গেল, তারপর এক নজর পিছনে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি দোতারার একটা ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল, তূর্যর কেন যেন মনে হল মেয়েটা তাকে দেখে ভয় পাচ্ছিল।
তূর্য এতক্ষন যেন মেয়েটার রূপে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছিল।
তূর্য এবার কিচেন এগিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আসলো, তারপর যেতে শুরু করলো নিজের রুমের দিকে। তূর্য কফি নিয়ে যাওয়ার সময় কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল মেয়েটা রুমের দরজার দিকে, তারপর আবার চলে গেল নিজ গন্তব্যে।
রুমে গিয়ে তূর্য ল্যাপটপে কাজ করতে নিলো, কিন্তু কোনভাবেই সে নিজের কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না, বারবার শুধু ওই মেয়েটার মুখ তার চোখে সামনে ভেসে উঠছে, মাথার মধ্যে ওই মেয়েটার কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে।
তূর্য ল্যাপটপটা বন্ধ করে পাশে রেখে দেয়,
তারপর নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে কপাল চুলকায় আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে:-
“কে এই মেয়ে? যার রূপ আব্রাহাম খান তুর্যর মনে ঝড় তুলতে সক্ষম।
একটু পরে তূর্য আবার ভাবলো হয়তো তন্নির বিয়ে উপলক্ষে ওর কোন বান্ধবী কিছুদিন আগেই চলে এসেছে।
_________________
সকালে নাস্তা করার জন্য টেবিলে বসে আছে সবাই। নেই শুধু তূর্য, কিছুক্ষণের মধ্যেই তূর্যকে দেখা গেল ফোন হাতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে। তূর্য ফোনে কিছু একটা করছিল, ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল নাস্তা করতে।
ফোন থেকে মুখ তুলতেই দেখতে পেল টেবিলের অপর পাশে তার সামনেই বসে আছে রাতের দেখা সেই মেয়েটি।
তূর্য মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে,
তারপর খাওয়া শুরু করে। মেয়েটার পরনে ক্রিম কালার একটা ড্রেস, মাথায় ওড়না দেওয়া আছে। জামার রংটা যেন গায়ের রং এর সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
মেয়েটার এই সৌন্দর্য তূর্যর হৃদয়ে যেনো তীরের মত বিধছে।
তূর্য মনে মনে ঠিক করে রেখেছে মায়াকে ডিভোর্স দেওয়ার পরে তার মাকে বলবে, “ছেলেকে কাছে রাখতে চাইলে ছেলের বউ হিসেবে এই মেয়েটাকে এনে দাও”
খাবার টেবিলে পুরোটা সময় মেয়েটা মাথা নিচু করে রাখল, তারপর খাওয়া শেষ হতেই উঠে চলে গেল।
মেয়েটা চলে যেতেই তূর্য আতিয়া বেগমকে প্রশ্ন করে,
-আম্মু এই মেয়েটা কে?
তূর্যর প্রশ্ন শুনে আতিয়া বেগমতো অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন,
-তুই চিনতে পারিস নি ওকে?
-না
-ও তোর বৌ মায়া
মায়ের মুখে এই কথা শুনে তূর্য ভয়ংকর রকমের বিষম খেলো।
আরাফ খান তাড়াতাড়ি ছেলের দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো, আতিয়া বেগম এগিয়ে এসে ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো।
কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরে তূর্য আবার তার মাকে জিজ্ঞেস করল :-
-এটা মায়া হলে কালকে যাকে দেখলাম ওটাকে (তুর্য)
-আরে ওইটা তো তোর রহিমা খালার মেয়ে রাবেয়া, তোর রহিমা খালা তিন দিন যাবৎ অসুস্থতার কারণে আসতে পারছে না, মায়া এবার HSC-তে গোল্ডেন A+ পেয়েছে, এখন তো ওদের ভর্তি পরীক্ষা চলছে, কাল মায়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। তন্নি তোকে আনতে গিয়েছিল, আমি এতগুলো কাজ একা হাতে কিভাবে করি?
তাই ফোন করে রহিমা আপাকে বলেছিলাম ওকে পাঠিয়ে দিতে।(আতিয়া বেগম)
তূর্য আর কোন কথা না বলে চুপচাপ ঘরে চলে আসলো, এখন তার নিজের উপরে খুব রাগ হচ্ছে।
কেন এত দিনে একবারও তার বউটার কোন ছবি দেখতে চায়নি সে?
তূর্য বিড়বিড় করে বলতে থাকে :-
-ঘরে আগুন সুন্দরী বউ রেখে, এত বছর বিদেশে পড়েছিলাম, ছি শালার জীবন। দেশে থাকলে এতদিনে দুই এক বাচ্চার বাপ হয়ে যেতাম।
বিড়বিড় করতে করতেই তুর্য পা বাড়ায় মায়ার রুমের দিকে, তূর্যর রুমের পাশের রুমটাই মায়ার। মায়া রুমের দরজায় দুইবার টোকা দেওয়ার পরেই মায়া এসে দরজা খুলে দেয়।
তুর্য মায়ার দিকে তাকাতেই থমকে যায়, মায়া চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে এতক্ষণ কান্না করেছে।
মায়া ও এই সময় তূর্যকে এখানে আশা করিনি, মায়া ভেবেছিল তার তন্নি আপু অথবা মামনি এসেছে।
তূর্যকে এখানে দেখে মায়া একটু ভোরকে যায়,
মায়ার এখন কি করা উচিত তা বুঝতে না পেরে মায়া হুট করে দরজাটা বন্ধ করে ফেলে।
মায়াকে দরজা খোলা দেখে তূর্য খানিকটা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। যার ফলস্বরূপ মায়া যখন দরজাটা লাগিয়ে দিল তখন তুর্যর কপালে দরজার বাড়ি লাগে শক্ত কাঠের দরজার সাথে বারি লাগার ফলে তার কপালা খানিকটা কেটে যায়, সাথে অনেকটা ফুলেও যায়।
তূর্য ভাবতেও পারিনি মায়া এরকম কিছু করবে,
সে তো এসেছিল মায়ার সাথে কিছু কথা বলতে।
[চলবে]