#অপ্রিয়_সেই_তুমি
#প্রিয়া_আফরোজ
#পর্ব৩
শক্ত কাঠের দরজার সাথে বারি লাগার ফলে তার কপাল খানিকটা কেটে যায়, সাথে অনেকটা ফুলেও যায়।
তূর্য ভাবতেও পারিনি মায়া এরকম কিছু করবে,
সে তো এসেছিল মায়ার সাথে কিছু কথা বলতে।
কিন্তু তা আর হলো কই? তার আগেই তো মায়া তূর্যকে আঘাত করে বসলো।
অপরদিকে,
মায়া এই সময় হঠাৎ তূর্যকে তার রুমে আসতে দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মায়া ভেবেছে তুর্য হয়তো এত বছরের সব রাগ মায়ার উপর ঝাড়তে এসেছে। মায়া ভাবছে তূর্য হয়তো ছোটবেলার মতো তাকে আবার আঘাত করবে, না হলে তাকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলবে। মায়ার যে যাওয়ার কোন জায়গা নেই এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে কোথায় যাবে? কার কাছে আশ্রয় নেবে?
এসব ভাবতে ভাবতে মায়া আবার দরজাটা একটু ফাকা করলো, তূর্য চলে গেছে কিনা তা দেখার জন্য।
তূর্য তখনও দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, মায়াকে ধীরে ধীরে দরজা খুলতে দেখে সে নিজের মধ্যে গম্ভীর্য ধরে রেখে বলে উঠলো :
-এই মেয়ে, কি হয়েছে? কি সমস্যা তোমার?
মায়া তূর্যর বিপরিতে কিছু বলতেই যাবে তখনই মায়ার চোখ গেল তূর্যর কপালের দিকে। প্রথম যখন তূর্য মায়ার রুমের সামনে এসেছিল, তখন কপালের এই কাঁটা দাগটা ছিল না।
মায়া বুঝতে পারে সে নিজের অজান্তেই কি করে বসে আছে। নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য মায়া লজ্জিত হয়ে বলে:
– I’m sorry. আমি দেখতে পাইনি, আমি ইচ্ছে করে আঘাত করিনি আপনাকে।
তখনই সেখানে উপস্থিত হয় তন্নি, সে এসেই মায়াকে বকা দিতে শুরু করে।
-কিরে মায়া তোকে না আমি বলেছিলাম আজ আমরা শপিং করতে যাবো, তিনদিন পর বিয়ে, আমার অর্ধেক কেনাকাটা এখনো বাদ রয়েছে। আর নিজের জন্য তো এখনো কিছুই কিনিস নাই। আমার একটা মাত্র ছোট বোন তুই, আমার বিয়েতে তোর এভাবে থাকাটা মানায়? চল তাড়াতাড়ি রেডি হয়েনে। (তন্নি)
-আচ্ছা ঠিক আছে আপু তুমি নিচে যাও আমি রেডি হয়ে আসছি। (মায়া)
– চল আমি সাথে করে নিয়ে যাবো তোদের। (তূর্য)
তুর্যর কথা শুনে তন্নী খুব খুশি হলেও খুশি হতে পারলো না মায়া।
______________
কিছুক্ষণ পর তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলো মায়া,
পরনে তার নীল রঙের ১টা সুন্দর থ্রি পিস, দেখতে অপূর্ব সুন্দর লাগছে। তূর্য যেন চোখই ফেরাতে পারছে না মায়ার দিক থেকে।
তখনই আতিয়া বেগম খেয়াল করলেন তুর্যর কপালের কাটা দাগটা, তিনি ছেলের কাছে এগিয়ে সে উতলা হয়ে বললেন:
– কিরে বাবা? কি হয়েছে তোর কপালে? সকালেও তো ভালো ছিলি, এইটুকু সময়ের মধ্যে কার সাথে মারপিট করলি? কই আমি তো তোকে বাইরে যেতেও দেখলাম না।
– আরে আম্মু, বাড়িতে গুন্ডা থাকতে মার খাওয়ার জন্য বাইরে যাওয়ার কি দরকার?
তূর্যর কথা শুনে মায়া লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল
– বাড়িতে আবার গুন্ডা কোথায় পেলি তুই? কি বলছিস এসব? আমি তোর কথার আগা-গোড়া কিছুই বুঝতে পারছি না।
-তোমাকে অত কিছু বুঝতে হবে না তুমি তোমার রুমে গিয়ে একটু রেস্ট নাও।
এর মধ্যে তন্নি এসে তূর্যর কপালের কাটা জায়গাটায় একটু মেডিসিন লাগিয়ে দিল।
তারপর তিনজন মিলে চলে গেল গাড়ির কাছে,
গাড়ির কাছে গিয়ে তূর্য গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল,তন্নি ও মায়া উঠে বসলো পিছনের সিটগুলোতে।
তখন তূর্য রাগী গলায় বলে উঠলো:-
-আমাকে দেখে কি তোদের ড্রাইভার মনে হয়? আমি গাড়ি ড্রাইভ করবো আর তোরা পিছনে বসে থাকবি? চাকর পেয়েছি আমাকে?
-আপু গিয়ে সামনে বসো।(মায়া)
-আরে! তুই কি পাগল হয়েছিস? তোর নীরব ভাইয়া একটু পরপর কল করছে, আমি কি আমার ভাইয়ের পাশে বসে ফোনে আমার হবু বরের সাথে প্রেম আলাপ করব নাকি? তার চেয়ে বরং যা বোন তুই গিয়ে সামনে বসে পর।(তন্নি)
-Impossible. আমি পারবো না তোমার ভাইয়ের পাশে বসতে।(মায়া)
-তোমার ভাই, তোমার ভাই করছিস কেন? আমার ভাই কি তোর কিছুই হয় না?
তন্নির কথা শুনে মায়া চুপ করে রইলো, কারণ বুঝতে শেখার পরে আশেপাশের লোকেরা যখন তুর্জর দেশে না ফেরা নিয়ে মায়াকে কটু কথা শুনিয়েছে, তখন সেই কষ্টে রাতের পর রাত কান্না করতে করতে নির্ঘুম কাটিয়েছে মায়া, আর সেই রাতগুলোর সাক্ষী হয়ে মায়ার পাশে ছিল তন্বী।
এখন বেশি কথা বাড়ালে হয়তো সেই সবকিছুই তূর্যর সামনে বলে দেবে তন্নি।
তন্নী মেয়েটা এমনই ওর পেটে কোন কথা থাকে না।
মায়া চাইছে না তূর্যর প্রতি মায়ার দুর্বলতা সম্পর্কে তুর্য কিছু জানতে পারুক। তাই সে চুপচাপ গিয়ে বসে পড়লো তুর্যর পাশের সিটে।
তারপর সবাই রওনা হলো শপিং মলের উদ্দেশ্যে।
_________________
গাড়ি এসে থামল বিশাল এক শপিং মলের সামনে, তূর্য মায়া এবং তন্নিকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি পার্কিং এরিয়ায় নিয়ে গেল।
তন্নি মায়া কে সাথে করে এগিয়ে গেল বড় একটি শাড়ির দোকানের দিকে।
অল্প সময়ের মধ্যেই তন্নির অনেকগুলো শাড়ি পছন্দ হয়ে গেলো। তার মধ্যে ৩টা শাড়ি আতিয়া বেগমের জন্য, ৫টা শাড়ি নিজের জন্য, ২ টা তার হবু শাশুড়ির জন্য এবং ১টা শাড়ি মায়ার জন্য নিলো, তন্নি মায়ার জন্য আরো কিছু শাড়ি পছন্দ করেছিল কিন্তু মায়া সেগুলো নিতে দেয়নি, কারন মায়া কখনো শাড়ি পড়েনি, শাড়ির প্রতি মায়ার আগ্রহ খুব কম। তন্নি খুব বেশি জোর করছিল বলে মায়া গায়ে হলুদের দিন পড়ার জন্য একটা শাড়ি নিলো, তখনই নিরব তন্নিকে ফোন দেওয়ায় তন্বী উঠে একটু দূরে চলে গেল, যাওয়ার সময় মায়াকে বলে গেলো নিজের জন্য কিছু ড্রেস দেখতে। তবুও চুপচাপ বসে থাকতে দেখা গেলো মায়াকে, মায়া বুঝে উঠতে পারছে না যে বিয়েতে সে কি পরবে। তখনই মায়ার চোখ গেল আকাশী রং-এর সুন্দর একটা শাড়ির দিকে।
মায়া মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এগিয়ে গেলো শাড়িটির দিকে।
এতক্ষনে তুর্যও চলে এসেছে ওদের কাছে, তুর্য মায়ার থেকে খানিকটা দুরে দারিয়ে আছে। মায়া আলতো হাতে ছুয়ে দেখলো শাড়িটা।
তখন-ই দোকানের একজন মহিলা কর্মচারী মায়াকে বলে:-
-আপু আপনি একটু ওইদিকে শাড়িগুলো ট্রাই করুন,
এই শাড়িটা আপনার জন্য না। ওই পাশের সবকটা শাড়ি ৮ থেকে ১০ হাজারের মধ্যেই আছে। আপনার হাতের এটা আমাদের টপ কালেকশনের মধ্যে একটা, ১০% ডিসকাউন্ট এর পরেও এটার দাম ৮৫ হাজার টাকা।
মায়া অপমান বোধ করল, কান্নায় মায়ার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। মা ওই মহিলাটিকে কিছু করা কথা বলতেই যাবে তখনই তূর্য হুংকার ছেরে বলে ওঠে :-
-এই সপের ম্যানেজার কোথায়? তাড়াতাড়ি ম্যানেজার কে ডাকুন, আমি কথা বলতে চাই তার সাথে।
হঠাৎ ভাইয়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে তন্নিও দৌড়ে চলে এলো তাদের কাছে
তখনই পাশের অফিস রুম থেকে একটা লোক বেরিয়ে এলো তুর্যর কাছে। লোকটা এসেই তাড়াহুড়ো করে বলতে শুরু করে:-
-স্যার, আমি এই সপের ম্যানেজার,
কি সমস্যা হয়েছে স্যার?
আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
তখন তুর্য বলে ওঠে:-
-আমি যদি ভুল না হয়ে থাকি তাহলে এই সপের ওনার শফিকুল শেখ
-Yes স্যার
-এক্ষুনি ওনাকে ফোন করুন, ফোন করে ওনাকে এখানে আসতে বলুন, সাথে এটাও বলুন আব্রাহাম খান তূর্য তার জন্য অপেক্ষা করছে।
শফিকুল শেখকে আব্রাম খান তূর্যর নাম বলায় ২০ মিনিটের মধ্যে চলে এলেন সে। এর মাঝে তন্নী ও মায়া
অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে তূর্যকে কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি।
শফিকুল শেখ তুর্য কে দেখে ভয় পাচ্ছিল, তূর্যর ক্ষমতা সম্পর্কে শফিকুল শেখ আগে থেকেই অবগত।
শফিকুল শেখের আসার পরপরই তূর্য তাকে সঙ্গে করে অফিস রুমে চলে গেল।
মায়া এবং তন্নিও অফিস রুমের ভেতরে ঢুকে পড়ল। তূর্য এবং শফিকুল শেখের কথাবার্তায় বোঝা গেল মায়ার অপমানের বদলা নিতে তূর্য দিগুন টাকা দিয়ে পুরো সপটা কিনে নিচ্ছে।
শফিকুল শেখ ও দ্বিমত পোষণ করলো না কারণ সে এই সপের পিছনে যত টাকা ইনভেস্ট করেছে,
তার দ্বিগুন টাকা দিয়ে তুর্য এই সপটা কিনবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে এসে উপস্থিত হলো উকিল,
এক ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত কাগজ কাগজপত্র এনে রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো।
মায়া এবং তন্নি পুরোটা সময়ই নিরব থাকলো,
কারণ তারা জানে যে তূর্যর ইগোতে আঘাত লাগলে
তূর্য তার শেষ দেখে ছাড়ে।
অন্যদিকে মায়াকে অপমান করা সেই মহিলা কর্মচারী এইসব দেখে রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে।
তখনই তূর্য মহিলাটির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে:-
-আপনি ঠিকই বলেছেন আমার বউ এই সামান্য একটা শাড়িটা ডিজার্ভ করে না, সে তো পুরো শাড়ির দোকানটা ডিজার্ভ করে।
– sorry sir আমার ভুল হয়ে গেছে আমি বুঝতে পারিনি।
– No, No. আপনি ভুল করেননি আপনি যেটা করেছেন সেটাকে বলা হয় অপরাধ, ভুলের ক্ষমা হয় কিন্তু অপরাধের কোন ক্ষমা হয় না। কাল থেকে যেনো এখানে আপনার ছায়াও আমি না দেখতে পাই।
মহিলাটিকে কথাগুলো বলে মায়ার পছন্দ করা শাড়িটি তূর্য একটি ব্যাগে ভরে নিল, তারপর মায়ার হাত ধরে রওনা হল জুয়েলারি শপের দিকে।তাদের পিছু পিছু তন্নিও যেতে থাকে সেদিকে।
মায়ার কানে এখনো বাজছে তূর্যর বলা “আমার বউ” কথাটি।
জুয়েলারি শপে গিয়ে তন্নী নিজের মত করে কিছু ডায়মন্ডের জুয়েলারি পছন্দ করে।
এবং মায়ার জন্য তূর্য নিজে দুটো ডায়মন্ডের নেকলেস পছন্দ করে কিনে নিয়ে জুয়েলারি ব্যাগটা মায়ার হাতে দিয়ে দেয়।
তারপর আরো কিছু কেনাকাটা করে তিনজন মিলে একটা রেস্টুরেন্টে যায়। খাওয়া-দাওয়া শেষে আবার বাড়ির পথে রওনা হয়। খান বাড়ির গেট পেরিয়ে এসে গাড়ি থামতেই, মায়াকে রেখেই তন্নি গাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়ে চলে যায় বাড়ির দিকে। এদিকে মায়া যখন গাড়ি থেকে নামতে যাবে, ঠিক তখনই তুর্য গাড়ির ডোর লক করে ফেলল।
তূর্যর এরকম কাজ দেখে মায়া তূর্যর দিকে তাকিয়ে বলল
-সমস্যা কি আপনার?
-কই? আমার কোন সমস্যা নেই তো, বিশ্বাস না হলে তুমি চেক করে দেখতে পারো।(তুর্য)
তূর্যর কথা শুনে মায়া…..
চলবে।