অপ্রিয় সেই তুমি পর্ব-০৬

0
2

#অপ্রিয়_সেই_তুমি
#প্রিয়া_আফরোজ
#পর্ব৬

মায়া রেগে গিয়ে তুর্যর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বিছানায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলতে থাকে :-
-আমি এটা পরবো না, পরবো না, পরবো না। আর আপনি, খবরদার বেশি বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা করবেন ন…উম….উ….

কথা শেষ করার আগেই তূর্য মায়ার ঠোঁট দুটো নিজের দখলে নিয়ে নিলো। মায়ার পুরো শরীর কিছু মুহূর্তের জন্য অবশ হয়ে গেল, মায়া প্রথমে বুঝে উঠতে পারল না তার সাথে এটা কি হচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মায়ার মস্তিষ্ক সচল হয়ে গেল। তখন মায়া অনেক চেষ্টা করলো তুর্যর থেকে নিজেকে ছারানোর জন্য। মায়ার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।
কিন্তু তুর্যর মতো বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী একজন পুরুষের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানো মায়া পক্ষে সম্ভব হলো না।

পুরো দু মিনিট পরে তুর্য মায়াকে ছেড়ে দিলো।
তুর্যর থেকে ছারা পেয়ে মায়া জোরে-জোরে নিশ্বাস নিতে শুরু করে।
তখন তুর্য মায়ার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলতে থাকে :-
-এইটুকুতেই এই অবস্থা? তাহলে যেদিন পুরো আমি টাকেই তোমার নামে লিখে দেবো সেদিন কি হবে তোমার? (তুর্য)

তুর্যর কথা কানে আসতেই মায়া রাগি চোখে তুর্যর দিকে তাকায়। তারপর বোলতে থাকে:-
-আপনার সাহস কি করে হলো আমাকে স্পর্শ করার?
কোন অধিকারে আপনি আমাকে স্পর্শ করলেন? (মায়া)

-সেদিন তোমাকে জুয়েলারি সপ থেকে ডায়মন্ডের যেই নেকলেস ২টা কিনে দিয়েছি, ওই নেকলেস ২টার দাম ছিলো 70 লক্ষ টাকা, আর আমাদের বিয়ের সময় মোহরানা নির্ধারিত করা হয়েছিল 50 লক্ষ টাকা।
সেই হিসেবে আমি তোমার মোহরানা পরিশোধ করে দিয়েছি দুই দিন আগেই। এখন আমি যদি স্বামীর অধিকার নিয়ে তোমার কাছে আসতে চাই, তাহলে তুমি আমার কাছে নিজেকে উজাড় করে দিতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু আমি তা কখনোই চাইবো না। আমি সেদিনই তোমাকে আপন করে নেবো, যেদিন তুমি নিজের থেকে আমার কাছে এসে ধরা দিবে। (তুর্য)

-মোহরানার নাম ভাঙ্গিয়া টাকার বিনিময়ে আমার দেহটা কিনে নিতে চাইছেন? (মায়া)

মায়া কথাটা বলার সাথে সাথে তূর্য মায়ার গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়।

তূর্যর শক্ত হাতে চড় খেয়ে মায়া তাল সামলাতে না পেরে বিছানার উপর গিয়ে পড়ে। তারপর বিছানায় বসা অবস্থায় কান্না করতে করতে বলল :-
-আমি আপনার বাড়ির আশ্রিতা বলেই আমার সাথে এরকম করতে পারছেন, আজ যদি আমার বাবা-মা বেঁচে থাকতো তাহলে আপনি কখনো আমার সাথে এই ব্যবহার করতে পারতেন না। (মায়া)

-৮ বছর আগে তোমাকে যতবার আঘাত করেছি তা নিয়ে আমার আফসোস হয়। কিন্তু আজ তোমাকে যে চরটা দিলাম এটা নিয়ে আমার মনে কোনো আফসোস থাকবে না। বরং তুমি যে কথাটা বলেছ তার জন্য তোমার জিভ টেনে ছেড়ে দিতে পারলে আমার মনটা শান্ত হতো। (তুর্য)

-আমি তো ভুল কিছু বলিনি, প্রতিটি পুরুষ মানুষই নারীর দেহের লোভে আটকায়। (মায়া)

-সব পুরুষ এক না, না হলে আমি সবার মত না। (তুর্য)

-আপনি সবার থেকে আলাদাও না। (মায়া)

-এটা তোমার ভুল ধারণা। (তুর্য)

-তাই?
আমার এই সৌন্দর্য না থাকলে আপনি কি আমাকে বউ হিসেবে মেনে নিতেন? আমার এই রূপ না থাকলে কি আপনার এই দামী দামী গিফট গুলো আমার পাওনা হত? আমি দেখতে কুৎসিত হলে কি আপনি আসার পরও খান বাড়িতে আমার জায়গা হতো? প্রতিটি মানুষই সৌন্দর্যের পূজারী, আর আপনিও তার ব্যতিক্রম নন। (মায়া)

-নিজের সৌন্দর্য নিয়ে অহংকার করছিস? (তুর্য)

-যদি বলি হ্যাঁ। যেই সৌন্দর্যের জোরে আমি এখন পর্যন্ত এখানে টিকে আছি, সেই সৌন্দর্য নিয়ে এইটুকু অহংকার তো করতেই হয়। (মায়া)

তখনই তূর্য মায়ার চোয়াল টিপে ধরে, ঠোঁট উঁচিয়ে, বলতে থাকে :-
-আব্রাহাম খান তূর্যকে তুই এখনো চিনিস নাই, তোকে আমার চাই মানে চাই। আমি এতটাও সুপুরুষ নই যে নিজের ভালোবাসা ভাগ্যের উপরে ছেড়ে দেবো, আমারটা আমি আদায় করে নিতে জানি। আর তুই যেই সৌন্দর্যের অহংকার করছিস, প্রয়োজনের তোর সেই সৌন্দর্য আমি এসিড দিয়ে পুড়িয়ে তোকে সারা জীবন নিজের কাছে বন্দি করে রাখবো। (তুর্য)

কথাগুলো বলে তূর্য ছেড়ে দেয় মায়াকে,
তারপর বেরিয়ে যেতে নেয় রুম থেকে। দরজার কাছে যেতেই তূর্য আবার ঘুরে তাকায় মায়ার দিকে,
মায়ার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে :-
-আজ চলে যাচ্ছি তোর কাছ থেকে, খুব তাড়াতাড়ি তুই নিজে আসবি আমার কাছে। তখন কিন্তু আমার হাত থেকে কেউ তোকে বাঁচাতে পারবে না। (তুর্য)

কথাগুলো বলে তূর্য চলে যায় সেখান থেকে।

তূর্য চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মায়া গিয়ে দাঁড়ালো আয়নার সামনে, নিজেকে ভালো করে দেখতে থাকলো। চড় মারার ফলে তূর্যর হাতের পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ মায়ার গালে বসে গেছে। নিজের এই অবস্থা দেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মায়া অনেকক্ষণ কান্না করে।

কিছুক্ষণ পরে নিচে শোরগোল শুরু হয়, সবার মুখে শোনা যায় বরযাত্রী চলে এসেছে।
তাই মায়া আর দেরি না করে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে একটু পানি দিয়ে নেয়।
তারপর আলমারি থেকে গোল্ডেন কালারের একটি গ্রাউন বের করে তা পড়ে নেয়। গ্রাউনটি পরে আয়নার সামনে এসে ফাউন্ডেশন এবং ব্রাশের সাহায্যে থাপ্পরের দাগটি ঢাকার চেষ্টা করে।
নিচে অনেক লোকজন আছে, এতগুলো মানুষের মাঝে কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে চায় না।

_________________

সুন্দর মতো তৈরি হয়ে মায়া নিচে চলে গেল। তখনই একটা বাচ্চা এসে জানালো, তন্নি নাকি অনেকক্ষণ যাবৎ মায়া কে খুঁজছে। তাই মায়া আর দেরি না করে তন্নিকে যেই রুমে সাজানো হচ্ছে সেই রুমে চলে গেল।

মায়া গিয়ে দেখল তন্নিকে সাজানো শেষ হয়েছে,
বউ সাজে তন্নিকে অপূর্ব লাগছে।

তন্নি মায়াকে আসতে দেখেই বলতে শুরু করলো:-
-কিরে কোথায় গিয়ে মরেছিলি? সে কখন বললি রেডি হয়ে আসছি, তারপর তো তোর আর কোন খবরই নেই।
(তন্নি)

বলতে বলতে তন্নি মায়ার মুখের দিকে তাকালো, তন্বী মায়ার চোখ দেখে অবাক হয়ে গেল, মায়ার চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়েছিল, দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এখানে আসার আগে মায়া অনেকক্ষণ যাবৎ কান্না করছিল।
মায়ের সাথে কথা বলার জন্য তন্বী সবাইকে বলল
-আমার একটা পার্সোনাল কাজ আছে, সবাই একটু কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যাবে প্লিজ। (তন্নি)

তন্নির কথা শুনে সবাই একে একে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো। সবার সাথে মায়া ও বেরিয়ে যেতে নিলে তন্নি মায়ার হাত ধরে মায়াকে বিছানার একপাশে বসিয়ে দিল। তারপর নিজে গিয়ে দরজাটা আটকে এসে মায়ার পাশে বসে মায়া কে জিজ্ঞেস করল :-
-কি হয়েছে বনু? (তন্নি)

– ক কই কিছু নাতো। (মায়া)

– তাহলে এভাবে তোতলাচ্ছিস কেন? আমাকে মিথ্যে বলছিস? । (তন্নি)

– না আপু মিথ্যা কেন বলব সত্যি কিছু হয়নি। (মায়া)

– আচ্ছা থাক কিছু বলতে হবেনা। আমি হয়তো কখনো তোর নিজের বোন হতে পারিনি, তাই আমার কাছেও আজ তোর এত গোপনীয়তা। (তন্নি)

তন্নির মুখে এমন কথা শুনে, মায়া তন্নিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করে। তারপর ধীরে ধীরে সবকিছু তন্নিকে বলতে থাকে।

তন্নি মায়াকে জড়িয়ে ধরে মায়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ভাবতে থাকে:-
বাচ্চা মানুষ না হয় ভুল করে একটা কথা বলে ফেলেছে, তার ভাই তাকে এমন করে মারবে? মায়া আর সে কি সমান নাকি? তার তো একটু ধৈর্য ধরা উচিত ছিল।

একটু পরে সবাই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তন্নিকে ডাকতে থাকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

মায়া তখন উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে আসে।

একটু পরে সুন্দর ভাবে তন্নির বিয়ে সম্পুর্ন্ন হয়ে যায়।

মেয়ের বিয়ের সময় আরাফ খানের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। বিয়ে পড়ানো শেষে আরাফ খান নিরবের হাতে তন্নীকে তুলে দিয়ে ভাঙ্গা গলায় বলল :-
-বাবা আমার কলিজার টুকরাটাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম, ওকে একটু দেখে রেখো।

নিরব এই বলে শ্বশুরকে আশ্বস্ত করলো যে:-
-আঙ্কেল আমি আপনাকে কথা দিলাম, আমার জীবন দিয়ে হলেও আমি তন্নীকে আগলে রাখবো।

বিদায়ের সময় আতিয়া বেগম, মায়া এবং তন্নীর ফুপিরা কান্নায় ভেঙে পড়ে।

কান্নার এক পর্যায়ে তন্নি নিজেও জ্ঞান হারায়।
তাই নিরব নিজে তন্নিকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

_________________

তন্নীর বিয়ের পরে কেটে গেছে সাতটা দিন
গতকাল রাতের ফ্লাইটে তন্নী ও নিরব পারি জমিয়েছে অস্ট্রেলিয়াতে।
নিরব অস্ট্রেলিয়ার অনেক বড় একজন হার্ট সার্জন।

এই সাত দিনের মধ্যে তূর্যকে আর মায়ার আশেপাশে দেখা যায়নি।
খাবার টেবিলেও দুজন সামনাসামনি হয়নি।
তুর্য যখন খাবার খেতো তখন মায়া নিচে আসতো না।

একটু আগেই মায়া আতিয়া বেগমের থেকে জানতে পারলো তুর্য আজ লন্ডনে ফিরে যাবে।
কথাটা শোনা মাত্রই মায়ার বুকের ভিতরে কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো।

দুপুরের দিকে লাগেজ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো তূর্য এবং ইমন।

ড্রয়িং রুমের একটি সোফায় বসে ছিল আতিয়া বেগম এবং আরাফ খান। তূর্যকে নিচে আসতে দেখেই আতিয়া বেগম উঠে গিয়ে তুর্যকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলেন। তারপর তুর্যকে ছেড়ে কান্না করতে করতে ইমনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

মায়া কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিল। কিন্তু তূর্য সেদিকে একটাবার ফিরেও না তাকিয়ে বাবা মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

তূর্য চলে যাওয়ার পরে আতিয়া বেগম মায়াকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্না করলো, ঘন্টাখানে পরে যে যার নিজের রুমের দিকে চলে গেল।

মায়া নিজের ঘরে গিয়ে হাটুতে মুখ গুজে বসে কান্না শুরু করে দিলো।

কিছুক্ষণ পরে মায়ার ফোনে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে বারবার কল আসতে থাকে। মায়া প্রথমে কয়েকবার ফোনটি না উঠালেও শেষে ভাবলো এতোবার কল করছে তাহলে প্রয়োজনিয় কল হতে পারে, কলটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইমন বলে উঠলো :-
-এয়ারপোর্টে তুর্যর উপর হামলা হয়েছিল,
“তুর্যর বুকে গুলি লেগেছে”
চলবে।