অপ্রিয় সেই তুমি পর্ব-০৮

0
9

#অপ্রিয়_সেই_তুমি
#প্রিয়া_আফরোজ
#পর্ব৮

মায়া এবং তূর্য এই মুহূর্তে যেই রুমটাতে আছে সেই রুমটার একপাশের দেয়াল কাচের তৈরি। তূর্য সেই দেয়ালের সাদা রংয়ের পর্দাটা এক টানে সরিয়ে ফেলে বলল:-
-কারণ তুমি এখন বাংলাদেশে না, লন্ডনে আছো। (তুর্য)

-বললেই হলো?
আপনার কি মাথায় সমস্যা আছে নাকি?
উল্টোপাল্টা কথা বলছেন কেন? (মায়া)

-১১ ঘন্টা আগেই তুমি লন্ডনের মাটিতে পা রেখেছো, ও সরি আমি তো তোমাকে কোলে করে নিয়ে এসেছি। বিশ্বাস না হলে বাইরে তাকিয়ে দেখো। (তুর্য)

তূর্য মায়াকে কোলে করে এখানে নিয়ে এসেছে এটা শোনার পরে প্রথমে মায়া রেগে গেলেও,
পরে তুর্য কথা শুনে মায়া বাইরে তাকিয়ে দেখল সত্যি এটা তার চিরচেনা সেই শহর নয়। তখন মায়া বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো যে তূর্য সত্যি কথা বলছে।
তাই মায়া তূর্যর কাছে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল:-

-কেন করলেন এসব?
কি চান আপনি? (মায়া)

-তোমার মুখে একটু খানি হাসি দেখার জন্য। (তুর্য)

-মানে?(মায়া)

-তোমার ছোট্ট একটা স্বপ্ন পূরণ করার জন্য তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি।(তুর্য)

মায়া কিছুটা অবাক হয়ে বলে :-
-আমার স্বপ্ন? (মায়া)

-Yes,”University college of London”
তোমার স্বপ্ন।
সেইটাই পূরণ করার দায়িত্ব নিয়েছি আমি। (তুর্য)

মায়ার সবকিছু ভুলে উৎসাহিত হয়ে বলে উঠলো :-
আপনি সত্যি আমাকে University college of London-এ পড়াশোনা করার ব্যবস্থা করে দিবেন? (মায়া)

মায়া প্রশ্নটি করার সাথে সাথে তূর্য ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে মায়ার দিকে এগিয়ে দিলো।

-কাল থেকে তোমার ভার্সিটির ক্লাস শুরু হবে। (তুর্য)

-কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন এটা আমার স্বপ্ন? (মায়া)

-তন্নীর মুখে শুনেছিলাম। তোমার নাকি অনেক বড় স্বপ্ন এটা। তাই আমার লোকেদের দিয়ে তোমার ভর্তির কাজ সম্পূর্ণ করে রেখেছিলাম।(তুর্য)

মায়া ও অশ্রু সিক্ত চোখের তূর্যর দিকে তাকিয়ে বলল

-আমার জন্য এত কিছু করলেন, তাহলে আমাকে জানান নি কেন? আমাকে এত কষ্ট দিলেন কেন? জানেন ইমন ভাইয়া যখন বলল আপনার বুকে গুলি লেগেছে, আর আপনার অবস্থা খুব খারাপ, তখন আমার কেমন লাগছিল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার, নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। নিজেকে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে করছিল।
এত নাটক না করলেও পারতেন।
কেন আমাকে সত্যিটা বলেননি? (মায়া)

সত্যিটা বললে তুমি আমার সাথে আসতে বুঝি? (তুর্য)

তূর্যর প্রশ্ন শুনে মায়া কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। কারণ মায়া নিজেও জানে, তূর্য মায়াকে বললেও মায়া তূর্য সঙ্গে আসতো না।

মায়ার এসব ভাবনার মাঝে হঠাৎ তূর্য মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে :-

জানো আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি,
কারন :-
সেই পুরুষ আসলেই অনেক ভাগ্যবান,
যাকে হারানোর ভয়ে তার শখের নারী
পাগলের মতো কান্না করে (তুর্য)

মায়া তুর্যর কথার কোন প্রতি উত্তর করল না। বরং ভার্সিটির বিষয়ে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করে এই কথাটি ঘুরিয়ে ফেলার চেষ্টা করল।

অনেকক্ষণ যাবত কথা বলার ফলে মায়ার জন্য নায়ে আসা খাবারটা ঠান্ডা হয়ে গেছে, তাই তুর্য একজন মেডকে ডেকে খাবারটা চেঞ্জ করে দিতে বলল।

মায়া তখন তূর্যকে জিজ্ঞেস করল :-
-আচ্ছা এটা কি কোন হোটেল রুম? (মায়া)

-না, এটা আমাদের ফ্ল্যাট (তুর্য)

-আমাদের মানে? (মায়া)

তূর্য তখন মায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল:-

-আমাদের মানে আমার আর তোমার, আজ থেকে তুমি এই রুমেই থাকবে। আর পাশের রুমটা আমার কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে ডেকো। (তুর্য)

-এখানে আমাকে কতদিন থাকতে হবে?(মায়া)

-তোমার পড়াশোনা শেষ হতে মিনিমাম পাঁচ বছর লাগবে, এর মধ্যে আমি আমার বিজনেস বাংলাদেশে শিফট করে ফেলব। তারপর তোমার পড়াশোনা শেষ হলে আমি তোমাকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে যাবো। (তুর্য)

তূর্যর কথার প্রতিউত্তর হিসেবে মায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

তূর্য মায়া রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলেই মায়া তূর্যকে ডেকে বলে উঠলো :-

-আপনার ফোনটা একটু দেওয়া যাবে? মামনি আর বাবাই কে কল করে সবটা জানাতাম। (মায়া)

-আব্বু আম্মুকে তোমার কিছুই জানাতে হবে না, ওনারা সবটাই জানে। তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নাও তার পরে কথা বলো ওনাদের সঙ্গে। (তুর্য)

মায়া যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না শেষ পর্যন্ত কিনা তার বাবাই আর মামনীও এসবের সাথে জড়িত হয়েছে।

তূর্য চলে যেতে নিলে মায়া আবারও তুর্যকে ডেকে উঠল

-এই যে শুনছেন? (মায়া)

-হুম, আবার কি হলো? (তুর্য)

-আমি ফ্রেশ হবো, আমার ড্রেস লাগবে। (মায়া)

-ও হ্যাঁ তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, খাটের পিছনের লাগেজে দেখো তোমার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আছে। সাথে দুটো ড্রেসও হয়তো আছে। আসার সময় আম্মু দিয়ে দিয়েছিল। এখন ওখান থেকে যেকোনো একটা নিয়ে পড়ে নাও, বিকেলে আমি তোমাকে নিয়ে শপিংয়ে বেরোবো। (তুর্য)

কথাগুলো বলে তূর্য তার রুমে চলে গেলো।

তূর্য চলে যাওয়ার পরে মায়া লাগেজটা খুলে সেখান থেকে একটা ড্রেস বের করে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।

অনেকটা সময় নিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নিলো মায়া।
তারপর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো তার জন্য রুমে খাবার দেওয়া হয়েছে। মায়ার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল তাই সে খাবার খাওয়ার জন্য বসে গেল।

খাওয়া শুরু করতেই যাবে তখনই মায়ার মনে হলো তূর্যর কথা,
তূর্য খেয়েছে তো?

তাই মায়া খাবার গুলো ঢেকে রেখে চলে গেল তূর্যর খোঁজ করতে।

তূর্যকে খুঁজতে রুম থেকে বেরিয়ে মায়া যা দেখল তা দেখার জন্য মায়া মোটেই প্রস্তুত ছিল না।

মায়া এতক্ষন রুমের ভিতরটা দেখে ভেবেছিল এটা হয়তো দুই অথবা তিন রুমের সুন্দর একটা ফ্ল্যাট। কিন্তু রুম থেকে বেরোতেই এই ফ্ল্যাটের আকৃতি টা দেখে মায়ার সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।

ফ্ল্যাট টা দেখে মায়া যেন তুর্যর কথা একদম ভুলেই বসলো, মায়া নিজের মতো করে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলো পুরো ফ্ল্যাটটা। এই ফ্ল্যাটে মোট ছয়টা রুম আছে। তার মধ্যে তিনটা বেডরুম এবং বাকি তিনটা লাইব্রেরি, অফিস রুম ও স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

মায়া সবকয়টা রুম ঘুরে দেখলেও এখনো ঘুরে দেখেনি তূর্যর রুম। তাই কৌতুহলবশত তূর্য রুমে ঢুকে গেল, তূর্যর রুম দেখে মায়া আরো অবাক হয়ে গেল, আর ভাবতে থাকল একটা মানুষের ঘর কিভাবে এত সুন্দর হয়? মায়ার রুমের পাশে ব্যালকনি থাকলেও তূর্য রুমে ব্যালকনির পরিবর্তে মিনি ছাদ করা।

রুম থেকে গ্লাসের দরজা পেরিয়ে মিনি ছাদে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল ছাদের একপাশে রয়েছে বিভিন্ন রকমের দেশি ও বিদেশি ফুলের গাছ এবং অন্যপাশে রয়েছে ছোট একটা সুইমিং পুল।

সুইমিং পুলটা দেখে মায়া আনন্দে নেচে উঠলো। তারপর দৌড়ে গিয়ে সালোয়ার টা একটু উপরে উঠিয়ে সুইমিং পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে পরলো।

একটু পরে তূর্য ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে সুইমিং পুলের দিকে তাকাতেই দেখল মায়া মনের আনন্দে সুইমিং পুলের পানি নিয়ে খেলা করছে। তখনই তূর্য ফোনটা হাতে নিয়ে মায়ার কিছু ছবি উঠালো।

তারপর তূর্য নিজেই কফি মেকারের কাছে গিয়ে দুই কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে রওনা হলো মায়ার দিকে।

মায়া নিজের মতো করে পানিতে পা ডুবিয়ে, পানি নিয়ে খেলা করছিল। তখনই তূর্য দুটো কফির কাপ নিয়ে গিয়ে বসল মায়ার পাশে। তারপর একটি কাপ এগিয়ে দিল মায়ার দিকে, মায়া তূর্যর হাত থেকে কফির কাপটি নিয়ে বলল :-

-sorry (মায়া)

-কেউ কোন কিছু দিলে তাকে thank you বলতে হয় সেটা জানতাম, কিন্তু sorry বলতে হয় সেটা তো জানতাম না (তুর্য)

-sorry টা অনুমতি না নিয়ে আপনার রুমে ঢুকেছি বলে। (মায়া)

-সমস্যা নাই তুমি যেকোন সময়ে এই রুমে আসতে পারো। (তুর্য)

-জানেন এখানে না আসলে আমি জানতেই পারতাম না যে, একটা ফ্ল্যাটও এত সুন্দর হতে পারে। (মায়া)

-thank you, আসলে এই ফ্ল্যাটের ডিজাইনটা আমি নিজের মনের মতো করে করেছি। আর ফ্ল্যাটটা একদম আমার নিজের হাতে গোছানো। (তুর্য)

-তাই? (মায়া)

-হুম। (তুর্য)

কফি খেতে খেতে তূর্য মায়ার দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। মায়া সেটা খেয়াল করতেই তূর্যকে জিজ্ঞেস করল:-

-কি হলো? এভাবে কি দেখছেন? (মায়া)

-তোমাকে। (তুর্য)

-আমাকে এভাবে দেখার কি আছে? (মায়া)

-আছে অনেক কিছু আছে।(তুর্য)

-যেমন? (মায়া)

-যেমন :- আজকের তুমি টা একদম অন্যরকম।
আজ তুমি আমার সঙ্গে মন খুলে কথা বলছো, যা গত কয়দিনে কখনো হয়নি। (তুর্য)

-এতদিন কথা বলার জন্য আমার পাশে তন্নি আপু, মামনি, বাবাই সবাই ছিল।
কিন্তু এখন এই শহরে আমার বন্ধু এবং শত্রু বলতে শুধু আপনি আছেন যার সাথে আমি কথা বলতে পারি।তাই, যদি বলি বাধ্য হয়ে কথা বলছি আপনার সাথে? (মায়া)

-তাহলে বলবো বাকিটা জীবন বাধ্য হয়েই থেকে যাও আমার পাশে। কথা দিচ্ছি অভিযোগ করার কোন সুযোগ দেবো না তোমাকে। (তুর্য)

মায়া কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল :-
-পাশে থাকবো কিনা জানি না, কিন্তু এটুকু কথা দিতে পারছি যে, কখনো ছেড়ে যাব না। (মায়া)

-দুটোর মধ্যে তফাৎ? (তুর্য)

-সময় হলে বুঝবেন। (মায়া)

চলবে।