#অপ্রিয়_সেই_তুমি
#প্রিয়া_আফরোজ
#পর্ব১১
ইরা জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার কথা শুনে মায়ার চোখের কোনে পানি চলে আসলো।
তখনই মায়া হঠাৎ বলে উঠলো :-
-আপু তুমি তুর্যকে খুব ভালোবাসো তাই না? (মায়া)
মায়ার মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে ইরা ভয় পেয়ে গেল,
তারপর নিজেকে একটু সামলে বলল :-
-হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ইমন আর তূর্যকে অনেক ভালোবাসি। (ইরা)
মায়া তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল :-
-আপু আমার প্রশ্নটা কিন্তু এরকম ছিল না। (মায়া)
ইরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল :-
-তাহলে কি রকম ছিল? (ইরা)
-আমার প্রশ্নটা কি রকম ছিল সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো। (মায়া)
-না আমি জানিনা, আমি বুঝতে পারছি না তুমি এসব কি বলছো। (ইরা)
-আপু আমিও একটা মেয়ে, আমি দেখেছি তোমার কষ্ট, আবেগ, চোখের কোনে জমে থাকা অশ্রু।
এগুলো অন্তত বন্ধুত্বের চিহ্ন না।
তুমি আমার কাছে যতই লুকানোর চেষ্টা করো আমি কিন্তু জানি তুমি তুর্যকে ভালোবাসো। (মায়া)
ইরা অশ্রুসিক্ত নয়নে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল :-
মায়া তুমি আজকে আমাকে যা বললে, এই কথাগুলো কখনো তূর্যকে বলবেনা। আমি চাইনা আমাদের বন্ধুত্বতে কোন প্রকার আচ আসুক। (ইরা)
-হুম, আমি ওনাকে কখনো বলবো না এইসব কথা, তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।
আচ্ছা আপু তুমি কি কখনো তূর্যকে তোমার মনের কথা জানিয়ে ছিলে? (মায়া)
মায়ার প্রশ্নের জবাবে দুচোখ ভর্তি পানি নিয়ে ইরা বলল :-
-বলেছিলাম একবার,
কিন্তু তূর্য খুব বাজেভাবে রিঅ্যাক্ট করেছিল।
তূর্য জানতো আমার ফিলিংসের ব্যাপারে।
৬বছর আগে কি হয়েছিল জানো? (ইরা)
★★★অতীত★★★
সেবার আমরা স্টাডি ট্যুরের জন্য একটা মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম, প্রথমে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সবাই একসাথেই ছিলো।
তারপর সবাই আলাদাভাবে নিজেদের মতো করে মিউজিয়াম টা ঘুরে দেখতে থাকে।
আমি, তূর্য আর ইমন, আমরা তিনজন একসাথেই ঘুরে দেখছিলাম মিউজিয়ামটা।
তার কিছুক্ষণ পরে ইমন একটা দরকারে অন্যদিকে যেতেই তুর্যকে বললাম :-
-জানিস তুর্য আমি অনেকদিন যাবত একটা কথা ভাবছিলাম। (ইরা)
-কি কথা? (তুর্য)
-দেখ বিয়ে আমাদের সবার জীবনেরই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়।
আজ হোক, কাল হোক, বিয়ে আমাদের করতেই হবে।
তোর বিয়ের জন্য ভালো মেয়ে খুঁজতে হবে,
অন্যদিকে আবার আমার বিয়ের জন্য একটা ভালো ছেলে খুঁজতে হবে।
তার চেয়ে ভালো আমরা দুজনে বিয়ে করে নেই।
এমনিতেই আমার বাবা-মায়ের বিষয়টা দেখার পরে আমি সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না।
আমরা দুজনতো দুজনকে খুব ভালোভাবে চিনি আমরা এক হয়ে গেলে কেমন হয় বল। (ইরা)
ইরার কথা শুনে তূর্য খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বলল :-
-খুবই বাজে হবে বিষয়টা।
বিয়ের প্রতি আমার একটা তিক্ততা আছে।
আমি চাইনা কখনো কারো সাথে আমার জীবনকে জরাতে।
আর তোর যদি বিশ্বস্ত কাউকে প্রয়োজন হয়, তাহলে তুই আমার কথা না ভেবে ইমনের কথাটা ভেবে দেখ।(তুর্য)
-সেটা হয়না। (ইরা)
-কেন হয় না?
ইমন তো সব দিক দিয়েই পারফেক্ট, তোকে বিয়ে করার সব রকম যোগ্যতা ওর আছে।
তুই ওকে নিয়ে একবার ভেবে দেখ। (তুর্য)
-সে তো তোকে বিয়ে করারও সব রকম যোগ্যতা আমার আছে, তাহলে তুই কেন আমার বিষয়টা একবার ভেবে দেখছিস না? (ইরা)
-তুই বুঝতে পারছিস না, আমি চাইনা কেউ আমার জীবনে আসুক। (তুর্য)
-এটা কেমন কথা?
দেখ আমি তোকে বলছি না যে আমাকে এখন বিয়ে কর। আমাদের জীবনটা তো সবে শুরু, আমাদের ক্যারিয়ার গড়তে অনেকটা সময়ের প্রয়োজন সেটা আমিও জানি, কিন্ত আমি তোর জন্য অপেক্ষা করতে রাজি আছি। (ইরা)
তূর্য তখন রেগে গিয়ে বলল :-
-তোর কি মাথায় সমস্যা হইছে?
এতক্ষণ যাবৎ আমি কি বলছি বুঝতে পারছিস না তুই?
আমি চাইনা আমার জীবনে কখনো কেউ আসুক, লাগবে না আমার কাউকে। কোন লাইফ পার্টনারের দরকার নেই আমার। বিয়ে জিনিসটাকে আমি ঘৃণা করি। (তুর্য)
ইরার সাথে দুর্ব্যবহার করে তূর্য চলে যায় মিউজিয়াম থেকে।
তুর্য চলে যেতেই ইরা অঝোরে কাঁদতে থাকে।
তখন ইমন এসে সামলায় ইরাকে।
★★★বর্তমান ★★★
মায়া এতক্ষন মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ইরার কথাগুলো।
ইরা আবার বলতে শুরু করে :-
-জানো যেদিন তূর্য বলেছিল যে “বিয়ে জিনিসটাকে ও ঘৃণা করে”, সেদিনের পর থেকে আর কখনো আমি ভালোবাসার দাবি নিয়ে ওর সামনে যাইনি।
আমি ভেবে রেখেছিলাম যেদিন ওর বিয়ের প্রতি এই তিক্ততার অবসান ঘটবে, সেদিন আমি আবার তূর্যর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো আমার একপক্ষিক ভালবাসার দাবিতে।
কিন্তু তার হলো না।
ছয় মাস আগে হঠাৎ তূর্য তোমাকে সামনে দাঁড় করিয়ে বলল meet my wife Maya.
একবার ভাবো তো, তখন আমার মনের অবস্থাটা ঠিক কেমন হয়েছিল?
জানো আমি কাঁদতে পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলাম।
আমার ওই কষ্টের জন্য কাকে দোষ দিতাম? তূর্যকে?
সে তো আমাকে কখনো ভালোই বাসেনি।
কিন্তু আমি তো তাকে ভালোবেসে ছিলাম,
দীর্ঘ আটটা বছর পাগলের মত ভালবেসেছিলাম তাকে।
one sided love -এর সমস্যাই এটা,
ভালোও একজনই বাসে,
কষ্টও একজনই পায়। (ইরা)
ইরা স্ট্রং পার্সোনালিটির একটা মেয়ে,
সে সহজে কারো কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে না। কিন্তু আজ কেন যেন মায়ার কাছে নিজের সব কষ্ট
নির্দ্বিধায় উজাড় করে দিল।
-আপু তুমি কি এখনো তূর্যকে ভালবাসো? (মায়া)
-ভালোবাসার কোন পাস্ট ফর্ম হয় না।
কাউকে ভালো লাগলে সময়ের ব্যবধানে তাকে ভুলে যাওয়া যায়, কিন্তু কাউকে ভালবাসলে যুগের পর যুগ পেরিয়ে যায় তবুও তাকে না পাওয়ার আক্ষেপ ফুরায় না। ভালোবাসা একটা সুন্দর অনুভূতির নাম,
এই অনুভূতি একবার যদি কেউ কারো প্রতি অনুভব করে, তবে তাকে পাক বা না পাক ভালোবাসা আজীবন তার প্রতি থেকে যাবে। (ইরা)
ইরার মুখে এমন কথা শুনে মায়া ইরাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে।
ইরা তখন নিজের চোখের পানি মুছে, মায়ার মাথায় হাতবুলিয়ে বলল :-
-এই পাগলি তুমি কাঁদছো কেন? (ইরা)
-আপু, তোমার এই কষ্টের কারণ তো আমি। তাই না? (মায়া)
মায়ার কথা শুনে হঠাৎ ইরা হেসে ফেলল তারপর বলল :-
-তোমাকে কে বলেছে যে আমার কষ্টের কারণ তুমি?
আমার কষ্টের কারণ তো আমার ভাগ্য, তূর্য আমার ভাগ্যেই ছিল না। তুর্য যদি আমার ভাগ্যে থাকতো তাহলে অনেক আগেই আমার ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতো।
তুর্য যদি আমার ভাগ্যেই থাকতো তাহলে বোনের বিয়েতে গিয়ে নিজে বিয়ে করে ফিরতো না।
যাই হোক তুমি অনেক ভাগ্যবতী, তাই তুমি তূর্য ভালোবাসা পেয়েছ। (ইরা)
-যদি বলি সে ভাগ্য আমারও হয়নি। (মায়া)
-মানে? (ইরা)
-মানে হলো, তূর্য আমাকেও কখনো ভালোবাসেনি। (মায়া)
-এসব তুমি কি বলছো? (ইরা)
-যা বলছি ঠিকই বলছি। (মায়া)
-তোমার ধারনা ভুল। কারণ তুর্য যদি তোমাকে ভালোই না বাসতো তাহলে বোনের বিয়েতে বাংলাদেশে গিয়ে তোমায় বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে আসতো না। (ইরা)
-তূর্য ওর বোনের বিয়ের জন্য বাংলাদেশে গিয়ে আমাকে বিয়ে করেনি, তার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল প্রায় নয় বছর আগে। (মায়া)
মায়ার মুখে এমন কথা শুনে ইরার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।
ইরা যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
ইরা রেগে গিয়ে মায়াকে বলল
-কি বলছো এসব তুমি?
তোমার বয়স কতো?
আট নয় বছর আগে তোমার বয়সই বা কত ছিল?
একটুখানি পুঁচকে মেয়ে হয়ে এত মিথ্যে কথা কিভাবে বলো? (ইরা)
এরা যখন মায়াকে মিথ্যাবাদী ভাবতে শুরু করল,মায়া তখন ইরাকে নিজের সম্পর্কে সবকিছু বলতে লাগলো।
-বিশ্বাস করো আপু আমি সত্যি বলছি, তূর্য ভাইয়া আমার কাজিন ছিলো।
আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে আমার মায়ের মৃত্যু হয়, বাবার কাছে খুব আদরেই বেড়ে উঠছিলাম। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা আর দ্বিতীয়বারের মতো সংসার বাধার কথা ভাবলেন না।
আমার যখন ৯ বছর বয়স তখন হঠাৎ একটা অ্যাক্সিডেন্টে বাবাও মারা গেলেন। তারপর আমার একমাত্র আশ্রয় হয় আমার ফুপি অর্থাৎ তূর্যর মায়ের কাছে। আমি ছোট থেকে আমার ফুপি-ফুপাকে মামনি এবং বাবাই বলে সম্মোধন করতাম।
মামুন এবং বাবাই আমাকে খুবই ভালোবাসতো, কিন্তু বিপত্তি ঘটতো তখন যখন বাবাই-এর বোনেরা বাড়িতে আসতো। উনারা আমাকে একদমই সহ্য করতে পারত না, সবাই মিলে যখন আমাকে অনাথ আশ্রমে পাঠানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল, তখন সবার বিরুদ্ধে গিয়ে আমাকে নিজের কাছে রাখার জন্য তূর্য ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেয় মামনি।
জোর করে তূর্য ভাইয়াকে বিয়ের জন্য বাধ্য করা হয়, তাই সে পরিবারের উপর রাগ করে পাড়ি জমায় লন্ডনে।
দীর্ঘ ৮ বছর লন্ডনে থাকার পরে, ছয় মাস আগে উনি দেশে যায় ওনার বোনের বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে আর আমাকে ডিভোর্স দিতে।
কিন্তু আমাকে দেখার পরে ওনার মন ঘুরে যায়,
তাই উনি আমার সাথেই সংসার করার সিদ্ধান্ত নেয়।
উনি কখনো আমাকে ভালোবাসেননি। (মায়া)
কথাগুলো বলে মায়া কান্না করতে শুরু করল।
ওদিকে ইরাও মায়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবছে, এইটুকু একটা মেয়ের উপর দিয়ে কত ঝড় গিয়েছে।
এরা মায়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল :-
-এটা তোমার ভুল ধারণা,
তূর্য সত্যি তোমাকে ভালোবাসে। (ইরা)
-উনি খুব ভালো একজন মানুষ, কিন্তু উনি আমাকে ভালোবাসেন না। শুধুমাত্র সৌন্দর্যর কারণে উনি আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছেন। (মায়া)
ইরা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে :-
শুধুমাত্র সৌন্দর্য দিয়েই যদি তূর্যকে আটকানো যেতো, তাহলে আমি হয়তো তূর্যর ফার্স্ট চয়েজ হতাম। (ইরা)
চলবে।