#অপ্রিয়_সেই_তুমি
#প্রিয়া_আফরোজ
#পর্ব১৪
রাত আটটার দিকে কলিং বেল বেজে উঠতেই মায়া গিয়ে দরজা খুলে দিল।
মায়া দরজা খুলতেই তূর্যর পাশে দেখতে পেলো চেনা এক মুখ, তাকে দেখে হাসি মুখে মায়া বলে উঠলো :-
-আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন ভাইয়া? (মায়া)
অপর পাশ থেকে ইমন বললো :-
-ওয়ালাইকুম আসসালাম
আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি,
আপনি কেমন আছেন ভাবী? (ইমন)
-আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি। ভেতরে আসেন ভাইয়া। (মায়া)
তুর্য এবং ইমন মায়ার পিছু পিছু ফ্লাটে প্রবেশ করলো।
মায়া দেখল ইমনের হাতে বড় একটি লাগেজ রয়েছে, মায়া ভাবল ইমন হয়তো তাদের সাথে এই ফ্ল্যাটে কিছুদিন থাকবে তাই সাথে করে লাগেজ নিয়ে এসেছে।
লাগেজটি নিয়ে ইমন এবং তূর্য চলে গেল তূর্যর রুমে।
মায়া বুঝতে পারল না তূর্য কেন ইমনকে নিজের রুমে নিয়ে গেল, তখনই তূর্য তার রুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল :-
-baby প্লিজ কিছু মনে করো না, কোম্পানির কিছু সিক্রেট ফাইল বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে, ওই ফাইলগুলো এখন আমরা দুজনে মিলে চেক করব।
ফাইলগুলো চেক করতে অনেকটা সময় লাগতে পারে,
তুমি ততক্ষণ পাশের রুমে থাকতে পারো।
আমাদের কাজ হয়ে গেলে সবাই একসাথে ডিনার করবো, OK? (তুর্য)
-OK (মায়া)
তুর্যর কথা মতো মায়া পাশের রুমে চলে যায়, সেখানে গিয়ে মায়া অনেকটা সময় ফোনে তন্বী এবং আতিয়া বেগমের সাথে গ্রুপে ভিডিও কল দিয়ে কথা বলে।
রাত প্রায় এগারোটার দিকে তূর্য আর ইমনের কাজ শেষ হয়।
তারপর তারা ফ্রেশ হয়ে এসে একসাথে ডিনার করছিলো, ডিনার করতে করতে মায়া ইমনকে জিজ্ঞেস করল :-
-আচ্ছা ভাইয়া আপনি কোথায় থাকেন?
আমি তো প্রথমে শুনেছিলাম আপনি নাকি ওনার সাথে লন্ডনেই থাকেন। কিন্তু কই লন্ডনে আসার পরে গত নয় মাসে তো আপনাকে একটা বারের জন্য দেখলাম না।(মায়া)
-আসলে হয়েছে কি ভাবি…(ইমন)
-এটা কি হচ্ছে ভাইয়া? আমাকে প্লিজ এভাবে আপনি আপনি করবেন না, আমাকে আপনার ছোট বোন ভাবতে পারেন। আমাকে আমার নাম ধরে ডাকলেই আমি খুশি হব। (মায়া)
-Ok, আজ থেকে তুমি আমার ছোট বোন, (ইমন)
-হুম (মায়া)
-তো যেটা বলছিলাম,
তুমি লন্ডনে আসার আগে তোমার হাজব্যান্ড তার সকল ব্যবসা নিজেই দেখাশোনা করত। কয়েকটা দেশে তার কোম্পানি থাকায় মাসের ২০-২৫ দিন তাকে সে সকল দেশে গিয়ে নিজের কোম্পানির দেখাশোনা করা লাগতো। কিন্তু তুমি লন্ডনে আসার পর থেকে সে লন্ডনেই ঘাটি গেরেছে। তাই তার পরিবর্তে বিভিন্ন দেশে গিয়ে তার কোম্পানির সকল তথ্য তার কাছে পাঠাতে হয়। তার জন্যই গত নয় মাসে আমার একবারের জন্যেও লন্ডনে আসা হয়নি। (ইমন)
মায়া বুঝতে পারল, কাজের অতিরিক্ত চাপ থাকার কারণে ইমন লন্ডনে আসতে পারিনি। তাই মায়া ছোট্ট করে উত্তর দিল :-
-ও বুঝতে পেরেছি। (মায়া)
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মায়া আবার বলতে শুরু করলো :-
-আমি ভেবেছিলাম বাইরের কেউ আসবে। আপনার বন্ধু যদি আমাকে আগে বলতো যে আপনি আসবেন, তাহলে আমি ইরা আপুকে আসতে বলতাম। তারপর সবাই মিলে আজ সারারাত আড্ডা দিতাম। (মায়া)
মায়ার কথা শেষ হতেই তূর্য বলল :-
-ইরাকে আমরাই সাথে করে নিয়ে আসতাম,
কিন্তু ও আজ দুপুরের ফ্লাইটে বাংলাদেশের ব্যাক করেছে বলে সেটা সম্ভব হলো না। (তুর্য)
তূর্যর কথা শুনে মায়া অবাক হয়ে গেল,
গত তিন মাসে ইরা এবং মায়ার মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মায়া যেমন নিজের সবকিছু নির্দ্বিধায় ইরার সাথে শেয়ার করে, ইরাও ঠিক তেমন ভাবে নিজের ছোট ছোট বিষয়গুলোও মায়ার সাথে শেয়ার করে।
সেই ইরা হঠাৎ এভাবে মায়াকে না জানিয়ে বাংলাদেশে চলে গেল।
কাল রাতেও ইরার সঙ্গে মায়ার ফোনে কথা হয়েছে। কই তখন তো ইরা মায়াকে কিছুই জানালো না এ বিষয়ে। মায়া তাই তুর্যকে প্রশ্ন করল :-
-আপনি কিভাবে জানলেন?
কাল রাতেও তো ইরা আপুর সাথে আমার অনেকক্ষণ ফোনে কথা হয়েছে, কই ইরা আপু আমাকে তো কিছু বলল না। (মায়া)
-কাল রাতে বলবে কিভাবে?
ইরার বড় মামা হঠাৎ করেই আজ সকালে ব্রেন-স্ট্রোক করেছে। ১১টার দিকে ইরা আমাকে কল করে কান্না করতে করতে বলল, ও নাকি বাংলাদেশে যাবে কিন্তু ইমার্জেন্সি ভাবে কোন টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না।
তাই আমি দুপুরে আমার প্রাইভেট জেট-এ করে ওকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি (তুর্য)
-এখন ইরা আপুর মামার কি অবস্থা?(মায়া)
-ইরার সাথে আমার আর কথা হয় নাই। (তুর্য)
-ও (মায়া)
তারপর ডিনার শেষ হতেই তূর্য এবং মায়ার থেকে বিদায় নিয়ে ইমন চলে যায় তার নিজের ফ্ল্যাটে।
মায়া অনেকবার বলেছিল তাদের ফ্ল্যাটে আজকের রাতটা থেকে যেতে, কিন্তু ইমন বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে চলে গেল।
ইমন চলে যেতেই তূর্য পিছন থেকে এসে মায়ার কোমর জড়িয়ে ধরল।
মায়া তূর্য হাত ছাড়ানোর জন্য ছোটাছুটি করতে শুরু করলে, তুর্যর হাতের বাধন আরো শক্ত হলো।
তূর্য অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই মায়া কেন যেন তুর্যকে এরিয়ে চলার চেষ্টা করছে।
তূর্য তাই মায়াকে জিজ্ঞেস করল :-
-তুমি কি কোনো কারনে আমার ওপরে রেগে আছো? (তুর্য)
-না, রেগে থাকবো কেনো?
আমার রেগে থাকা মানায় না।(মায়া)
তুর্য মায়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে, মায়ার মুখটা উঁচু করে, মায়ার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো:-
-তাহলে এভাবে কথা বলছো কেন? (তুর্য)
মায়া ছোট ছোট চোখ করে তূর্যর দিকে তাকিয়ে বলল :-
-কিভাবে কথা বলছি? (মায়া)
-একটু অন্যরকম ভাবে (তুর্য)
-এটা আপনার মনের ভুল (মায়া)
-তাই? (তুর্য)
-হুম। (মায়া)
হঠাৎই তূর্য পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে মায়ার চোখ বেঁধে ফেলল, তারপর মায়াকে কোলে নিয়ে কোথাও একটা যেতে শুরু করলো।
কয়েক পা হাঁটার পরেই তূর্য মায়াকে কোল থেকে নামিয়ে দিল, তারপর ধীরে ধীরে মায়ার চোখ থেকে রুমালটা খুলে ফেলল।
তূর্য মায়ার চোখ থেকে রুমালটা সরাতেই মায়া চমকে উঠল নিজেদের রুম দেখে, পুরোটা রুম ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে, বিভিন্ন রকমের ফুল দিয়ে সাজানো রয়েছে বিছানার চারিপাশ।
ঘরের পুরো মেঝেতে গোলাপের পাপড়ি বিছানো রয়েছে।
ঘরটা দেখে মায়ার মনে হচ্ছে এ যেন তার স্বপ্নের বাসর ঘর।
তখনই তূর্য মায়ার সামনে এসে তার পকেট থেকে কালো রঙের একটি বক্স বের করে মায়ার সামনে ধরল।
বক্সটি দেখে মায়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল:-
-কি আছে এটাতে? (মায়া)
-নিজেই খুলে দেখো (তুর্য)
তুর্যর কথা মতো মায়া বক্সটি খুলে দেখলো, বক্সের ভিতরে নীলরঙা পাথরের সুন্দর একটি আংটি রয়েছে।
আংটিটা দেখতে অসম্ভব রকমের সুন্দর, দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব দামি হবে।
মায়া তূর্যর দিকে তাকিয়ে বলল :
-হঠাৎ এভাবে বাসর ঘর সাজানোর আর এতো দামি উপহার দেওয়া কারণ জানতে পারি? (মায়া)
-হঠাৎ এভাবে বাসর ঘর সাজানোর আর এতো দামি উপহার দেওয়া কারণ হলো,
আজ থেকে ঠিক ৯ বছর আগে আজকের এই দিনটাতেই তুমি আমার জীবনে এসেছিলে।
তোমার আমার দুজনেরই বয়সটা তখন কম ছিল, হয়তো জ্ঞানের অভাবে তখন তোমাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি।
তাই এখন তোমাকে সেই মর্যাদা দিয়ে, অতীতের সেই ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করছি। (তুর্য)
তূর্যর কথা শুনে মায়া আনন্দে তূর্যকে জরিয়ে ধরলো, তারপর তূর্যর গালে চুমু দিয়ে বললো :-
-আপনার মনে আছে আজকের দিনটার কথা?
জানেন আজকে সারাটা দিন আমার মনটা অনেক খারাপ ছিল, আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো এসব মনেই রাখেননি। (মায়া)
-কি করে মনে না রাখি বল, দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বিয়ে করেছি।
সেই Marriage anniversary টা ভুলে গেলে হয়? (তুর্য)
মায়া খুশি হয়ে যায় তূর্যর কথা শুনে।
তূর্য তখন মায়াকে বলে :-
-বাসর ঘরে সব স্বামী রাই স্ত্রীদেরকে কিছু না কিছু উপহার দেয়, ভেবে নিও তোমার বাসর ঘরের উপহারটা আমার কাছে তোলা ছিল সেটাই আজ দিয়ে দিলাম। (তুর্য)
মায়া খুশিমনে আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে।
তূর্য তখনই মায়াকে প্রশ্ন করে :-
-আংটিটা পছন্দ হয়েছে? (তুর্য)
-হ্যাঁ হ্যাঁ খুব পছন্দ হয়েছে, জানেন আমি এর আগে কখনো এই ধরনের কোন আংটি দেখিনি। এই আংটিটার ডিজাইন, কাটিং-সেফ সবকিছুর মধ্যেই অদ্ভুত রকমের সৌন্দর্য রয়েছে। আংটিটা নিশ্চয়ই অনেক দামী তাই না? (মায়া)
-হুম, অনেক দামি।(তুর্য)
-কাল আমি এটা ভার্সিটিতে পড়ে গিয়ে জাইফাকে দেখাবো। (মায়া)
-Ok (তুর্য)
মায়া কৌতূহল বসতো তুর্যকে জিজ্ঞেস করলো:-
-আচ্ছা এই আংটিটার দাম কত? (মায়া)
-কোন গিফটেরই দাম জানতে চাওয়া ঠিক না। (তুর্য)
কথাটা বলেই তূর্য পানি খেতে নেয়
তখনই মায়া বলে ওঠে :-
-আংটিটা দেখে যথেষ্ট দামি মনে হচ্ছে, কম করে হলেও এটা ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকাতো হবেই। (মায়া)
মায়ার কথা শেষ হতেই তূর্যর মুখ থেকে সব টুকু পানি বেরিয়ে গেল, হঠাৎই তূর্য বিষম খেলো।
তূর্যকে বিষম খেতে দেখে মায়া এগিয়ে গিয়ে তূর্যর পিঠে হাত বোলাতে থাকলো।
তূর্য কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলল :-
-আমি এত শখ করে তোমার জন্য আংটিটা আনলাম আর এটাকে তোমার ১০-১৫ লক্ষ টাকার আংটি মনে হল?
আংটিটার ওপরে যে পাথর টা দেখছো ওটা
“ব্লু রয়্যাল”-এর। (তুর্য)
তূর্যর মুখে “ব্লু রয়্যাল” নামটা শোনার সাথে সাথে মায়ার হাত থেকে আংটিটা পড়ে যেতে নিল।
মায়া কোনভাবে আংটিটা ধরে, অবাক হয়ে তূর্যর দিকে তাকিয়ে রইল।
কারণ মায়া জানে যে:
“নীল রঙের হীরাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো “ব্লু রয়্যাল” হীরক। এটি “গোলকোন্ডা ব্লু” নামেও পরিচিত। এই হীরার বাংলাদেশি মূল্য নির্ভর করে এর আকার, স্বচ্ছতা, এবং রঙের ওপর, তবে এই ধরনের হীরের দাম সাধারণত বাংলাদেশী টাকার কয়েকশ কোটি টাকা হয়ে থাকে। ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বা বাংলাদেশী টাকার (প্রায় ৪৪০ কোটি টাকা) বিক্রি হয় একটি নীল হীরা “ব্লু রয়্যাল”।”
মায়া এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে তূর্য তার জন্য ব্লু রয়্যাল এর আংটি এনেছে।
মায়া ভাবছে এটা কি সত্যি না স্বপ্ন?
তখনই মায়ার হাত থেকে আংটিটা নিয়ে তূর্য নিজে মায়ার আঙ্গুলে সেই আংটি পরিয়ে দিল।
তারপর আলমারির থেকে একটা প্যাকেট এনে মায়ার হাতে দিয়ে বলল :-
-যাও এটা পড়ে আসো।
আমার খুব জোরে বাসর পাচ্ছে। (তুর্য)
-এটা আবার কেমন কথা? (মায়া)
-এখন আর কোন কথা বাড়িও না,
প্লিজ এটা পড়ে আসো। (তুর্য)
মায়া তূর্যর দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল :-
-যেটাই পড়ে আসি ৫ মিনিট পর সেই তো খুলেই ফেলবেন, তাহলে আর এখন এগুলো পড়ার কি দরকার?(মায়া)
-এই প্যাকেটে এমন কিছু ড্রেস আছে, যা খুলতে আমার আরো বেশি মজা লাগবে। (তুর্য)
মায়া এই ঠোঁটকাটা লোকের সাথে কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়,
ওয়াশরুমে গিয়ে প্যাকেটটা খুলেই মায়া চিৎকার করে বলে :
-কুত্তা কি আনছিস এগুলা?
আমি এগুলো পড়তে পারবো না। (মায়া)
-baby তুমি ওগুলো পরতে না পারলে,
আমি নিজের হাতে তোমাকে পরিয়ে দেবো ওগুলো। (তুর্য)
মায়া উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়েই সেই ছোট ছোট ড্রেসগুলো পরে নিল।
তারপর কোনরকমে ওয়াশরুম থেকে বাইরে এলো।
মায়াকে দেখে তূর্যর নেশা যেন আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেল, সে এগিয়ে গিয়ে মায়ার ঠোট দুটো নিজের দখলে নিয়ে নিল। তারপর ধীরে ধীরে মায়া কে নিয়ে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে।
তাদের ভালবাসার সাক্ষী হলো আরেকটি রাত, সেইসাথে দুমড়ে-মুচরে যেতে থাকলো বিছানার উপরে থাকা গোলাপের পাপড়ি গুলো।
চলবে….
#অপ্রিয়_সেই_তুমি
#প্রিয়া_আফরোজ
#পর্ব১৫
সকালে মায়া তূর্যর আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়ল, তারপর তূর্যর হাতের বাধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, ওয়াশরুমে চলে গেল গোসল করতে।
ওয়াশরুম থেকে ফিরে মায়া জাইফাকে কল করার জন্য ফোনটা হাতে নিল।
ফোন হাতে নিতেই মায়া দেখল দেড় ঘন্টা আগে ইরা বেশ কয়েকবার কল করেছে মায়াকে, কিন্তু মায়ার ফোন সাইলেন্ট থাকার কারণে মায়া বুঝতে পারেনি।
মায়া কখনোই নিজের ফোন সাইলেন্ট করে রাখে না।
তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের যেন কোন ব্যাঘাত না ঘটে তাই
গতরাতে তূর্য নিজের এবং মায়ার ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিল।
মায়া আর দেরি না করে তখনই ইরাকে কল করলো।
দুইবার রিং হতেই ওপাশ থেকে ইরা ফোন রিসিভ করল।
ইরা ফোন রিসিভ করতেই মায়া বলে উঠলো :-
-আপু তুমি কেমন আছো? (মায়া)
-এইতো আছি কোনরকম। (ইরা)
-আপু তুমি বাংলাদেশে পৌঁছেছো কখন?
তোমার মামার এখন কি অবস্থা? (মায়া)
ইরা কান্না মাখা কন্ঠে উত্তর দিলো।
-আমি বাংলাদেশে পৌঁছেই তোমাদের জানিয়ে দেওয়ার জন্য তুর্যকে এবং তোমাকে কল করে ছিলাম।
আমি বাংলাদেশে পৌঁছেছি প্রায় ৫ ঘন্টা আগে, এখন আমি হসপিটালেই আছি।
মামার অবস্থা ভালো না, ওনার এখনো ফেরেনি।
ড. বলেছেন ২৪ ঘন্টা পার না হলে তারা কিছু বলতে পারবে না। (ইরা)
-নিজেকে সামলাও আপু, একটু ধৈর্য ধরো।
আসা করি সব ঠিক হয়ে যাবে। (মায়া)
ইরা তখন কান্না করতে করতে বললো:-
-কিভাবে ধৈর্য ধরি বলো, আমার বাবা-মা যখন নিজেদের সুখ খুজতে ব্যস্ত ছিলো এই মানুষটাই তখন বটবৃক্ষের মতো আমাকে ছায়া দিয়েছিল।
আমি যখন রাতের পর রাত বাবা-মায়ের শুন্যতা অনুভব করে কান্না করতাম, এই মানুষটা তখন আমার মাথায় হাত রেখে বলতেন :-
‘কাঁদছিস কেনো আমি তো আছি’।
আজ সেই মানুষটিই মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে,
এই অবস্থায় আমি কিভাবে ধৈর্য ধরি বলো। (ইরা)
মায়ার কাছে ইরাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা নেই।
তবু মায়া ইরার সথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে, ইরাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।
তারপর কথা বলা শেষ হতেই মায়া ফোন রেখে কিচেনে চলে যায় ব্রেকফাস্ট রেডি করতে।
ব্রেকফাস্ট রেডি করে মায়া রুমে চলে আসে তূর্যকে ডাকতে, প্রতিদিনের তুলনায় আজ তূর্যর ঘুম থেকে উঠতে একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে।
মায়ার ডাক শুনে তূর্য ঘুম থেকে উঠে পরে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তূর্য অবাক হয়ে যায়।
ঘড়িতে তখন আটটা বাজে,
তূর্য কখনো এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না।
অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাবে বলে তূর্য তাড়াতাড়ি গোসল করে এসে, মায়াকে নিয়ে একসাথে ব্রেকফাস্ট করে,
তারপর মায়াকে সাথে করে বেরিয়ে পড়ে ফ্ল্যাট থেকে।
লিফটে করে নিচে নামার সময় মায়া তূর্যকে বলল:-
-সকালে ইরা আপু কল করেছিল, সে বাংলাদেশ পৌঁছেছে সেটা জানানোর জন্য। (মায়া)
-ওর মামা এখন কেমন আছে? (তুর্য)
-আপু বলল ওনার মামার অবস্থা নাকি খুব একটা ভালো না। (মায়া)
-ও (তুর্য)
এমনিতেই আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আজ আবার অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংও আছে, তাই তূর্য আর কথা বাড়ালোনা
প্রতিদিনের মতো আজও প্রথমে মায়াকে ভার্সিটিতে নিয়ে যাবে, তারপর মায়াকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিয়ে সে অফিসে চলে যাবে।
________________
অন্যদিকে বাংলাদেশের এক প্রাইভেট হসপিটালের করিডোরে বসে আছে ইরা।
ইরার পাশেই বসে আছে তার বড় মামি, ছোট মামা এবং বড় মামা সাইদুল শেখের জমজ দুই ছেলে অভ্র এবং শুভ্র যারা বয়সে ইরার থেকে ২ বছরের বড়।
ইরার মা স্বামী সন্তান নিয়ে বর্তমানে কানাডায় বসবাস করেন, তাই তিনি এখনো আসেননি। তবে ইরার মাও ২-১ দিনের মধ্যেই চলে আসবে।
এদিকে স্বামীকে এভাবে দেখে ইরার বড় মামি শারমিন শেখ-এর অবস্থাও খারাপ হয়ে গেছে।
গত কয়েক ঘণ্টা যাবৎ ইরাই তাকে সামলাচ্ছিলো।
হসপিটালে পরিবারের সবাইকে দেখা গেলেও সাইদুল শেখের বড় ছেলেকে দেখা গেল না।
মায়া তাই শুভ্রর কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল:-
-অগ্নি ভাইয়া কোথায়?
আমি আসার পরে একবারও ভাইয়াকে দেখলাম না। (ইরা)
-ভাইয়া তো হসপিটালেই ছিল, তুমি আশার আধা ঘন্টা আগে ভাইয়া কোথায় যেন গিয়েছে। (শুভ্র)
মায়া আর শুভ্র যখন কথা বলছিল তখনই একজন নার্স বাইরে এসে বলল,
-এমপি সাহেবের জ্ঞান ফিরেছে। (নার্স)
হসপিটালের বাইরে থেকে শোরগোল ভেসে আসছে।
ইরার মামা সাবেক এমপি তাই তার অসুস্থতার কথা শুনে হসপিটালের বাইরে সাধারণ জনতার ভিড় জমে গেছে।
কিছুক্ষণ পরে,
হসপিটালের সামনে সারিবদ্ধ ভাবে ৪টি গাড়ি এসে থামল,
সামনের গাড়ি থেকে নামলো
সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত বর্তমান এমপি ‘সাফয়ান শেখ’ যার ডাকনাম ‘অগ্নি’।
হসপিটালে ঢুকে অগ্নি সোজা চলে গেল তার বাবার কেবিনে। কেবিনে ঢুকতেই অগ্নি দেখলো তার মা শারমিন শেখ তার বাবার পাশে বসে আছে, আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ইরা।
অগ্নি এগিয়ে এসে একটা টুল টেনে তার বাবার পাশে বসলো, তারপর বাবার হাতে হাত রেখে অশ্রুসিক্ত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল :-
-বাবা এখন তুমি কেমন আছো? (অগ্নি)
সাইদুল শেখ কোনরকম উত্তর দিলেন :
-এখন অনেকটা ভালো আছি। (সাইদুল শেখ)
তারপর অগ্নি ইরার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুই কেমন আছিস? (অগ্নি)
এরা আস্তে করে উত্তর দিল
-ভালো (ইরা)
সাইদুল শেখের এই মুহূর্তে বেশি কথা বলা ঠিক না,
তাই অগ্নি বাবা-মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল ডক্টরের কাছে।
অনেকটা সময় নিয়ে ডঃ এর কাছ থেকে তার বাবার রিপোর্ট সম্পর্কে বিস্তারিত সবকিছুই শুনতে থাকলো।
ডক্টর অগ্নিকে বলল :-
-ব্রেন স্ট্রোক, যা মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটায়, তার প্রধান কারণগুলো হলো: রক্তনালীতে ব্লকেজ (ইস্কেমিক স্ট্রোক) বা রক্তনালী ফেটে যাওয়া (হেমোরেজিক স্ট্রোক)। এই সমস্যাগুলো শরীরের বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তবে স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান ঝুঁকির কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ। এটি রক্তনালীগুলিকে দুর্বল করে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
আপাতত তোমার বাবা আউট অফ ডেঞ্জার।
তবে তোমাদের সব সময় খেয়াল রাখতে হবে, উনি যেন হাইপার না হয়, কোন স্ট্রেস না নে, আর ওনাকে সব সময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করবে।
উনাকে মেন্টালি প্রেশার দিলে পুনরায় ওনার মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
সেরকম হলে আমাদের হাতে আর কিছুই থাকবে না। (ডক্টর )
ঠিক আছে আঙ্কেল আমি বাবার সম্পূর্ণ খেয়াল রাখব।
ডক্টরের সাথে কথা বলে অগ্নি আবার যায় তার বাবার কেবিনে।
সাইদুল শেখ তখন ঘুমাচ্ছিল,
শারমিন শেখ ছেলেকে দেখেই বলে উঠলো :-
-অগ্নি একটা কথা বলব রাখবি বাবা? (শারমিন শেখ)
-এভাবে বলছ কেন আম্মু? কি বলবে বলো। (অগ্নি)
-ইরা অনেকটা জার্নি করে এসেছে, আবার এখানেও অনেকক্ষণ যাবত রয়েছে। তুই ওকে তোর সাথে করে বাসায় নিয়ে যা, ওর ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন।
(শারমিন শেখ)
অগ্নি মায়ের কথা শুনে বাধ্য ছেলের মতো ইরাকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
বাড়িতে যাওয়ার পথে তাদের মধ্যে কথা হলো খুবই স্বল্প পরিমাণ।
____________
ইরা বাংলাদেশে গিয়েছে আজ ৭ দিন হলো,
প্রথম ৪ দিন ইরার সাথে মায়ার কথা হলেও গত ৩ দিনে তাদের দুজনের কোন যোগাযোগ হয়নি।
সকাল ৭টা,
মায়া ব্রেকফাস্ট রেডি করছিল, তখনই মায়ার ফোনে নোটিফিকেশন টোন বেজে ওঠে।
কিসের নোটিফিকেশন আসলো তা দেখার জন্য মায়া ফোনটা হাতে নেয়। তখনই দেখে ইরা তাকে whatsapp-এ মেসেজ দিয়েছে। আজ তিনদিন পরে ইরার মেসেজ দেখে মায়া খুশি মনে whatsapp ওপেন করে, কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ ওপেন করতেই মায়া অবাক হয়ে যায়।
whatsapp ওপেন করতেই মায়া দেখল, ইরার বধু বেশে থাকা এক ছবি এবং তার সাথে ছোট্ট একটি বার্তা:-
“কাল হঠাৎ করেই কিভাবে যেন বিয়েটা হয়ে গেল, পরিস্থিতির কারনে তোমাদের জানাতেও পারলাম না”।
চলবে…..