অপ্রিয় সেই তুমি পর্ব-১৮+১৯

0
12

#অপ্রিয়_সেই_তুমি
#প্রিয়া_আফরোজ
#পর্ব১৮

মাঝখানে কেটে গেছে দুটো দিন।

আজ মায়াকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হবে। তাই তুর্য হসপিটালের সমস্ত ফর্মালিটি পূরণ করছিল।

ওদিকে হসপিটালের নিয়ম অনুযায়ী একজন গাইনোকোলজিস্ট ডক্টর মায়ার চেকআপ করছিল,
তখনই সেই ডক্টর মাকে বলে ওঠে :-

-আগামী ছয় মাস আপনারা বেবি প্ল্যানিং করবেন না প্লিজ। (ডক্টর)

মায়া চোখ ছোট ছোট করে কপাল কুচকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল :-

-কেন? (মায়া)

-মিস ক্যারেজ হওয়ার পরে ন্যূনতম ছয় মাস বাচ্চা নেওয়া উচিত না, এতে পুনরায় মিস ক্যারেজ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। (ডক্টর)

ডক্টরের কথা শুনে মায়ার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। সে কাঁপা কাঁপা গলায় ডক্টর কে প্রশ্ন করে :-

-আমি প্রেগনেন্ট ছিলাম?
আমার মিস ক্যারেজ হয়েছে? (মায়া)

-হ্যাঁ, কেন আপনি জানেন না? (ডক্টর)

মায়া ডক্টরের প্রশ্নের কোন জবাব দিল না।
এত বড় কথাটা শোনার পর মায়ার কোন রকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।
হঠাৎই মায়া যেন একদম পাথর হয়ে গেল।

হসপিটালে সমস্ত ফরমালিটি শেষ করে তূর্য মায়াকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হল। মায়ায় এ বিষয়ে আর কোন কথা না বলে, চুপচাপ তূর্য সঙ্গে চলে গেল।

________________

গত দুই দিনে অগ্নি এবং ইরার মধ্যেও সুন্দর একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের তৈরি হয়েছে

দুপুরে সবাই একসাথে লাঞ্চ করছিল,
তখনই শারমিন শেখ অগ্নিকে বলল :-

-অগ্নি, তোমাদের বিয়েটা তো হঠাৎ করেই দিয়ে দেওয়া হলো। তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে তো পরিবারের বাইরে কেউই জানে না।
তাই আমি সকল নিয়ম মেনে যাঁকজমকপূর্ণভাবে অনুষ্ঠান করে ইরাকে ঘরে তুলতে চাই। (শারমিন শেখ)

অগ্নি তার মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল :-

-ইরাকে ঘরে তুলতে চাও মানে?
ইরা কি এখন বাইরে আছে? (অগ্নি)

শারমিন শেখ ইরার মাথায় হাত রেখে বলে :-

-বিয়ে নিয়ে সব মেয়েদেরই আশা থাকে,
আমি চাই আমার মেয়েটার সকল আশা পূর্ণ হোক। (শারমিন শেখ)

-ইরা কি তোমাকে বলেছে ও আবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করতে চায়? (অগ্নি)

-না। (শারমিন শেখ)

-তাহলে এসব কি প্রয়োজন? (অগ্নি)

-প্রয়োজন আছে।
কারন, আমরা যদি ইরাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিতাম তাহলে নিশ্চয়ই এভাবে বিয়ে দিতাম না।
আর তুমি একজন এমপি,
তুমি এভাবে চোরের মতো নিজের বিয়ে সেরে ফেললে জনগণ কি ভাববে?
আর এটাও ভুলে যেও না যে, তুমি আমার বড় সন্তান। তোমার বিয়ে নিয়ে আমার কত আশা ছিল জানো? (শারমিন শেখ)

অগ্নি শারমিন শেখ-এর দিকে তাকিয়ে বলল :-

-ঠিক আছে আম্মু, বাবা একটু সুস্থ হোক। তারপর তুমি তোমার মনের মত করে সবকিছু। (অগ্নি)

শারমিন শেখ মুচকি হেসে ছেলের কথায় সম্মতি জানালেন।

খাওয়া শেষে যে যার রুমের দিকে চলে গেল, স্বাভাবিক ভাবে ইরাও চলে গেল অগ্নির রুমে।

ইরা রুমে ঢুকতেই দেখলো অগ্নি বিছানার ওপরে বসে ল্যাপটপে কিছু একটা করছে, তাই ইরা চুপচাপ বেলকনির দিকে চলে যেতে নেই।
তখনই হঠাৎ অগ্নি ইরাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে :-

-৪ টার সময় তৈরি থেকো, আমি তোমাকে নিয়ে শপিংয়ে বেরোবো। (অগ্নি)

-আমার তো কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। (ইরা)

-আমার প্রয়োজন আছে। (অগ্নি)

-মানে? (ইরা)

-তুমি আমার স্ত্রী, তোমার ভরণ পোষণ এর দায়িত্বও আমার। আমি চাইনা আমার স্ত্রী নিজের টাকার একটা সুতোও ব্যবহার করুক। (অগ্নি)

-এটা কেমন কথা?
আমি নিজেও স্বাবলম্বী, নিজের ছোটখাটো খরচ বহন করার মত ক্ষমতা আমার আছে। (ইরা)

-আমি জানি সে ক্ষমতা তোমার আছে,
তবে আমি চাইনা যে ওই ক্ষমতা তুমি প্রয়োগ করো।
স্ত্রী হিসেবে আমার সকল কিছুর প্রতি তোমার হক আছে।
নিজেরটা বুঝে নিতে শেখো। (অগ্নি)

অগ্নির কথার পৃষ্ঠে ইরার আর কথা বাড়ালো না।

ইরার বেশিরভাগ জিনিসপত্র এখনো তার আগের রুমেই আছে, তাই ইরা তার আগের রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে নিল অগ্নির সাথে শপিংয়ে যাওয়ার জন্য।

ইরা তৈরি হয়ে চলে গেল অগ্নির রুমের দিকে।

অগ্নির রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইরা নক করলো, তখনই ভেতর থেকে অগ্নি বলে উঠলো :-

-কে? (অগ্নি)

-আমি। (ইরা)

-এটা তো তোমারই রুম নক করছ কেন?
ভেতরে আসো। (অগ্নি)

অগ্নির কথা শুনে ইরা ভিতরে চলে আসলো।
কিন্তু ভেতরে আসতেই ইরা দেখল অগ্নির এক নতুন রূপ।
লন্ডন থেকে আসার পর বেশিরভাগ সময়ই ইরা অগ্নিকে পাঞ্জাবি পরা অবস্থাতেই দেখেছে,
আজ এই প্রথম ইরা অগ্নিকে ব্ল্যাক কালার জিন্স প্যান্ট, হোয়াইট টি-শার্ট আর ব্ল্যাক জ্যাকেট পরা অবস্থায় দেখল। যদিও অগ্নিকে এই লুক-এ বলিউডের হিরোদের থেকে কোন অংশে কম লাগছে না,
তবুও ইরা অবাক হয়ে অগ্নিকে জিজ্ঞেস করল :-

-আপনি কি এগুলো পড়েই যাবেন? (ইরা)

অগ্নি হাতে ব্ল্যাক কালার গ্লাভস পড়তে পড়তে বলল :-

-হ্যাঁ, কেন? (অগ্নি)

-আপনি তো সব সময়ই সাদা পাঞ্জাবি পরে বাইরে বের হন আজ হঠাৎ এসব পরলেন, তাই জিজ্ঞেস করলাম। (ইরা)

-আমি এসব পড়তে পারি না বুঝি? (অগ্নি)

-ঠিক তা না, আপনি এম.পি. মানুষ এসব পড়বেন তাই বললাম। (ইরা)

-কোন সংবিধানে লেখা আছে যে এম.পি. দের সব সময় সাদা পাঞ্জাবি পরে বিধবার মতো ঘোরাফেরা করতে হবে? (অগ্নি)

ইরা বুঝতে পারল যে সে অগ্নির সঙ্গে কথায় পারবে না তাই মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলল :-

-কথা এত প্যাচাচ্ছেন কেন?
আপনি তো সব সময় সাদা পাঞ্জাবি পড়েন।
আজ হঠাৎ পরেননি তাই জিজ্ঞেস করলাম।
আপনার ব্যবহারে তো মনে হচ্ছে যে, কথাটা জিজ্ঞেস করে আমি অনেক বড় পাপ করে ফেলেছি। (ইরা)

ইরার সব কথা শুনে, অগ্নি ইরার দিকে এগিয়ে এসে ইরার কাধে হাত রেখে বলল :-

-জানো?
রাগলে তোমার সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ হয়ে যায়। (অগ্নি)

অগ্নির কথায় ইরা খানিকটা লজ্জা পেল,
তাই কথা ঘোরানোর জন্য ইরা বলল :-

-চলুন আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। (ইরা)

-হ্যাঁ, চলো। (অগ্নি)

অগ্নি এবং ইরা নিচ তলায় এসে শারমিন শেখ এর কাছে গেল,
তারপর অগ্নি শারমিন শেখ কে জানালো যে সে ইরাকে শপিং করতে নিয়ে যাচ্ছে।
শারমিন শেখ ও অগ্নির কথা শুনে খুব খুশি হলো এবং ওদেরকে সাবধানে যেতে বলে বিদায় দিলো।

অগ্নি ইরাকে বাড়ির সদর দরজায় দাঁড় করিয়ে গ্যারেজে চলে গেল, কিছুক্ষণ পরেই একটি চকচকে কালো রঙের কেটিএম বাইক এসে থামল ইরার সামনে।
ইরার সামনে হঠাৎ বাইক এসে থামায় এর খানিকটা ঘাবড়ে গেল।
কিন্তু পরক্ষণেই মায়া খেয়াল করলো হেলমেট মাথায় বাইকে বসে আছে স্বয়ং অগ্নি।

তখনই অগ্নি ইরাকে বলে উঠলো :-

-কি হলো?
উঠে বস। (অগ্নি)

ইরা কপাল কুচকে অগ্নিকে জিজ্ঞেস করল :-

-আপনি বাইকও চালাতে পারেন? (ইরা)

-তুমি হয়তো জানো না যে এক সময় তোমার হাজব্যান্ড চট্টগ্রামের টপ রাইডার ছিল।
তাই তুমি নির্ভয়ে বাইকে উঠে বসতে পারো। (অগ্নি)

ইরা বাইকের পেছনে বসতেই অগ্নি ফুল স্প্রিডে বাইক চালিয়ে রওনা হলো শপিং মলের দিকে।

_____________

লন্ডনে রাত ১০টা,

হসপিটাল থেকে আসার পরে মায়া একবারের জন্যেও তূর্যর সাথে কথা বলেনি।

এখনো মায়া একা একা বসে আছে সুইমিং পুলের পাশের সেই দোলনাটায়।

মায়া কে এখন ঔষধ খাওয়াতে হবে তাই তূর্য কিছু খাবার এবং মেডিসিন নিয়ে আমার কাছে গেল।

তুর্যর উপস্থিতি বুঝতে পেরেই মায়া তার চোখের পানি মুছে ফেলল।

মায়াকে চোখ মুছতে দেখে তূর্য বুঝতে পারল যে মায়া এতক্ষন কান্না করছিল, তাই তূর্য উতলা হয়ে মায়াকে জিজ্ঞেস করল :-

-মায়া, কি হয়েছে তোমার?
কান্না করছো কেন?
হসপিটাল থেকে আসার পর থেকেই দেখছি তুমি আমার সাথে কথা বলছো না, আমি কিছু বললেও এড়িয়ে যাচ্ছো।
তোমার কি হয়েছে তা আমাকে বলবে তো। (তুর্য)

মায়া এবার তুর্যর দিকে তাকালো।
মায়ার চোখে পানি টলমল করছে যে কোনো সময় টুপ করে পড়বে গাল বেয়ে।

মায়ার চোখে পানি দেখে তূর্য তার দুহাত দিয়ে মায়ার দুগাল আগলে নিয়ে বলল :-

-কি হয়েছে baby কষ্ট হচ্ছে?
কোথায় কষ্ট হচ্ছে আমাকে বলো। (তুর্য)

মায়া তূর্যর একটা হাত নিজের বুকের উপর রাখল তারপর ভাঙা গলায় বলল :-

-এখানে কষ্ট হচ্ছে,
বিশ্বাস করো অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছে বুকের ভিতরে।
এই যন্ত্রণা শারীরিক না, এটা মানসিক যন্ত্রণা। (মায়া)

তূর্য বুঝতে পারল না মায়া কেন এই কথা বলছে।
কারণ, তুর্য এখনো মায়াকে বাচ্চা নষ্ট হওয়ার ব্যাপারে জানায়নি।

তখনই তুর্যকে অবাক করে দিয়ে মায়া কান্না করতে করতে বলে উঠলো :-

-আমি হয়তো কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা,
আমি খুনি,
আমি নিজের সন্তানকে খুন করেছি।
এই কথাটা সারা জীবন আমাকে তাড়া করে বেড়াবে। (মায়া)

চলবে…

#অপ্রিয়_সেই_তুমি
#প্রিয়া_আফরোজ
#পর্ব১৯

কান্নার একপর্যায়ে মায়া তূর্যকে জড়িয়ে ধরল,
তারপর তুর্যর বুকে মুখ গুঁজে অসহায়ের মতো বলতে থাকলো :-

-আমার বেখেয়ালিপনার জন্য আমাদের বাচ্চাটা পৃথিবীর আলো দেখতে পারলো না।
ওর তো কোন দোষ ছিল না তাহলে আমার ভুলের শাস্তি কেন ও পেল? (মায়া)

মায়ার এমন কান্নার মাঝেই তূর্য হঠাৎ মায়াকে প্রশ্ন করল :-

-আচ্ছা এই বাচ্চাটা তোমার পেটে আসলো কিভাবে? (তুর্য)

মায়া স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে এই মুহূর্তে তূর্য এমন প্রশ্ন করে বসবে।

এতক্ষণ তুর্যর বুকে মাথা গুজে রাখা মায়া এমন প্রশ্ন শুনে এক ঝটকায় তূর্যর বুক থেকে মাথাটা সরিয়ে নিলো।

তারপর কিছুক্ষণ তূর্য দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থেকে বলল :-

-সিরিয়াসলি?
আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে,
আমরা কখনই ইন্টিমেট হই নাই। (মায়া)

-তুমি যেরকম ভাবছো আমি সেরকম কিছু মিন করিনি।
আমি জিজ্ঞেস করছিলাম যে:-
আমি তো তোমাকে পিল খেতে দিতাম,
তাহলে আমাদের বেবি তোমার পেটে আসলো কিভাবে? (তুর্য)

মায়া মাথা নিচু করে বলল :-

-আপনার দেওয়া পিলগুলো কখনো আমি খাইনি, (মায়া)

-কেন? (তুর্য)

-কারণ আমি শুরু থেকেই চাইতাম, খুব দ্রুত আমাদের মাঝে কেউ একজন আসুক।
যে আমার সারাদিনের সঙ্গী হবে,
যার সাথে আমি সারাবেলা খুনসুটিতে মেতে থাকবো।(মায়া)

কথাগুলো বলতে বলতে মায়া আবারও কান্না শুরু করে দিল।
তারপর কান্না করতে করতে বলল:-

-ও আসতে চেয়েছিল, কিন্তু আমার জন্য পারেনি।
আমার বেখেয়ালিপোনার জন্য ও আসতে পারল না পৃথিবীতে।
আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।
আমি তো ওকে খুব করে চেয়েছিলাম,
তাহলে আমার সাথেই কেন এমন হলো? (মায়া)

মায়ার কথা শুনে তূর্য আবার মায়াকে বুকে আগলে নিল।

নিজের ভালোবাসার চিহ্ন এভাবে বিলীন হয়ে যাওয়ায় তূর্য নিজেও ভেতর থেকে অনেকটা আহত হয়ে পড়েছে।

তূর্য মায়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মায়াকে সান্তনা দেওয়ার জন্য বলল :-

-কষ্ট পেয়ো না,
আল্লাহ্ যা করে মানুষের ভালোর জন্যই করে।
বেবি টা এখন পৃথিবীতে আসলে তোমার স্বপ্নটা মাঝপথে থেমে যেত।
তুমি পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারতে না। (তুর্য)

-আপনি কি মানুষ?
হ্যাঁ মানছি যে, “University college of London”-এ পড়াশোনা করাটা আমার স্বপ্ন ছিল।
কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না,
মানুষের জীবনে এমন অনেক স্বপ্ন থাকে,
তবে মায়েদের কাছে সন্তানই তাদের জীবন। (মায়া)

তুর্য যেন মায়াকে শান্তনা দেওয়ার সকল ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তাই তুর্য মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল :-

-ধৈর্য ধরো, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। (তুর্য)

তুর্যর কথা শুনে মায়া কান্নারত অবস্থায় বলল :-

-আমি একজন ব্যর্থ মেয়ে,
আমি নিজের গাফিলতির কারনে নিজের সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে পারিনি। (মায়া)

কথাগুলো বলে কান্না করতে করতে এক সময় মায়া তুর্যর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

__________________

অগ্নি এবং ইরার বিয়ের আজ তিন মাস পূর্ণ হলো।

সময় কারো জন্য থেমে থাকে না,
মায়াও এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
মায়া এখন আগের মত তার পড়াশুনা,সংসার এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

মাঝেমধ্যে ইরার সঙ্গে কথা হয় তার।

দুই মাস আগে ইরা এবং অগ্নি কোথায় একটা ঘুরতে গিয়েছিল, ইরাকে গাড়ি থেকে নামানোর জন্য অগ্নি তার হাত ধরেছিল।
তখনই একজন লোক ইরা এবং অগ্নির একটি ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেন, এবং ক্যাপশনে লেখেন “এমপি সাফওয়ান শেখ অগ্নির রাসলীলা”।
তারপর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়ে যায় অগ্নি এবং ইরাকে নিয়ে নানান রকমের ট্রোল।

অগ্নি তখন তার বাবা-মা এবং ইরার থেকে মতামত নিয়ে একটি প্রেস-মিটিং এর আয়োজন করেন।
এবং তখনই অগ্নি প্রেসের লোকদের সামনে ইরাকে নিজের বউ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন।

সেদিনের পর থেকে অগ্নি এবং ইরার বিয়ের বিষয়টা সোশ্যাল মিডিয়ায় জানাজানি হয়ে যায়।

——–

আজ অগ্নি এবং ইরার বিয়ের তিন মাস পূর্ণ হওয়ায় অগ্নি ইরাকে নিয়ে ঘুরতে বেরোবে বলে ঠিক করেছে।

বিকেলে পার্টি অফিসে অগ্নির কিছু কাজ আছে,
তাই ইরাকে নিয়ে সকাল সকালই ঘুরতে বেরিয়ে পড়ল।

ঘুরতে বেড়নোর কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ গাড়ির ভেতর থেকে ইরার নজর পড়লো রাস্তার পাশের এক ফুচকার দোকানের দিকে।

ফুচকার দোকান দেখেই ইরা তাড়াহুড়ো করে অগ্নিকে বলল :-

-এই তাড়াতাড়ি গাড়ি থামান। (ইরা)

অগ্নিও ইরার কথা মতো গাড়ি থামালো, তারপর ইরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল:-

-কি ব্যাপার হঠাৎ গাড়ি থামাতে বললে কেন? (অগ্নি)

-ফুচকা খাবো। (ইরা)

-কি? (অগ্নি)

-কানে কম শোনেন? (ইরা)

-না।(অগ্নি)

এরা অগ্নিকে ঝাড়ি দিয়ে বলল :-

-তাহলে এক কথা বারবার বলতে বলেন কেন? (ইরা)

অগ্নি ইরার দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে কপাল চুলকাতে চুলকাতে বলল :-

-ম্যাডাম, আপনার কি মনে হচ্ছে না যে কিছুদিন যাবৎ আপনার তেজ একটু বেশি বেড়ে গেছে। (অগ্নি)

-মানে? (ইরা)

-না, কিছু না।
বলুন, ফুচকার কথা কি যেন বলছিলেন। (অগ্নি)

-অনেক বছর হলো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাই না, চলুন আজ ফুচকা খাবো। (ইরা)

-মাথা ঠিক আছে তোমার? (অগ্নি)

ইরা চোখ দুটো ছোট ছোট করে অগ্নির দিকে তাকিয়ে, অগ্নিকে জিজ্ঞেস করল :-

-কেন?
আমাকে দেখে কি পাগল মনে হয় আপনার? (ইরা)

অগ্নি গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল :-

-হ্যাঁ। (অগ্নি)

অগ্নি সোজা সাপটা উত্তর শুনে ইরা খানিক ভরকে গেল।
এর পরের মুহূর্তেই অগ্নির দিকে তাকিয়ে রাগি গলায় বলতে শুরু করলো:-

-আগে যদি জানতাম আপনি আমার সাথে এমন ব্যবহার করবেন, তাহলে আপনার সাথে ঘুরতেই বের হতাম না।
আপনার সাথে ঘুরতে বের হওয়ার থেকে বাড়িতে বসে থাকা অনেক ভালো।
আজকের পরে আমি আর কখনো আপনার সঙ্গে বের হবো না।
যার নিজের বউকে এক প্লেট ফুচকা খাওয়ানোর মতো ক্ষমতা নেই সে আবার এমপি হয় কিভাবে? (ইরা)

-তুমি আমার বউ সেটা মানছো তাহলে।(অগ্নি)

-না মানার কি আছে? (ইরা)

-কেমন মানা মানলে যে বিয়ের তিন মাস পরেও আমি ভা*র্জি*ন অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। (অগ্নি)

অগ্নির কথা শুনে লজ্জায় ইরার দুগাল লাল হয়ে গেল।
তবুও অগ্নির কথায় লাগাম টানার জন্য ইরা বলে উঠলো :-

-আপনাকে আমি ভাল ভেবেছিলাম,
আপনার চরিত্র যে এমন তা আমার জানা ছিল না। (ইরা)

অগ্নি কাঁদো কাঁদো ফেস বানিয়ে বলল :-

-তোমার কাছে নিজের চরিত্র পরীক্ষা দিতে দিতে,
আমি নিজেই এখন নিজের পুরুষত্বের দিকে আঙ্গুল তুলছি।
একটু ভাবো তো,
তিন মাস হলো বিয়ে করেছি।
গত তিন মাস যাবৎ সুন্দরী বউ নিয়ে এক ছাদের নিচে থাকছি, একই বিছানায় ঘুমাচ্ছি।
অথচ গত তিন মাসে আমার গাড়ির চাকা এক চুলও এগোয়নি।
এ কথা লোকে জানলে কি আমায় পুরুষ বলে স্বীকৃতি দেবে? (অগ্নি)

অগ্নিকে এভাবে কাঁদো কাঁদো ফেস বানিয়ে কথা বলতে দেখে ইরা অন্যদিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসলো।

তারপর আবার রাগী গলায় অগ্নিকে বলল :-

-আজাইরা প্যাচাল বাদ দিয়ে আমাকে ফুচকা খাওয়াবেন নাকি সেইটা বলেন। (ইরা)

-ফুচকা খাবে? (অগ্নি)

-হুম।(ইরা)

-Ok, রেস্টুরেন্টে চলো। (অগ্নি)

-না, রেস্টুরেন্টের ফুচকা খাবো না।
রাস্তার ফুচকার মধ্যে যে ব্যাপারটা আছে সেটা রেস্টুরেন্টের ফুচকায় পাওয়া যায় না।
প্লিজ, আমাকে ওখানে নিয়ে চলুন।
সত্যি বলছি শুধু এক প্লেট ফুচকা খাবো(ইরা)

-বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ,
রাস্তার পাশের এসব খাবার অস্বাস্থ্যকর। (অগ্নি)

-অস্বাস্থ্যকর হলে হোক, কিন্তু এই সব ফুচকার মধ্যে অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে।
আপনার মতো বোম্বাই মুলারা রাস্তার পাশের ফুচকার মর্ম বুঝবে কিভাবে?(ইরা)

অগ্নি ইরার সঙ্গে তর্কে না পেরে ইরাকে নিয়ে গেল সেই ফুচকার দোকানে।

গাড়ি থেকে নেমেই ইরা দুই প্লেট ফুচকা অর্ডার করে দিল।

দুই প্লেট ফুচকা অর্ডার করতে দেখে অগ্নি বললো :-

-আমি খাবো না এসব। (অগ্নি)

-আপনাকে খেতে বলেছে কে? (ইরা)

-তাহলে দুই প্লেট অর্ডার করলে কেন? (অগ্নি)

-আমার জন্য। (ইরা)

-তুমি না তখন বললে এক প্লেট খাবে। (অগ্নি)

ইরা ফুচকা খেতে খেতে বলল :-

-আপনি কি এতটাই গরীব হয়ে গেছেন যে নিজের বউকে দুই প্লেট ফুচকাও খাওয়াতে পারবেন না। (ইরা)

অগ্নি আর কথা বাড়ালো না।
ইরা ফুচকা খাচ্ছে, আর অগ্নি মুখে মাক্স পড়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

অগ্নির হাজারো বারণ শর্তেও ইরা তিন প্লেট ফুচকা এবং দুই প্লেট চটপটি খেলো।

তারপর ওখান থেকে অগ্নি ইরাকে নিয়ে গেল পাশের এক পার্কে।

সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পরে, দুপুর দেড়টা নাগাদ অগ্নি ইরাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজে চলে গেল পার্টি অফিসে।

এদিকে দুপুর 2 টার পর থেকে ইরার প্রচন্ড বমি শুরু হয়। ইরার এ অবস্থা দেখে সবাই খুব ভয় পেয়ে যায়।
বমি করতে করতে একপর্যায়ে গিয়ে ইরা ড্রয়িং রুমেই মাথা ঘুরে পড়ে যায়।

ইরাকে এভাবে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে দেখে অভ্র এবং শুভ্র দুজনে মিলে ইরাকে নিয়ে যায় তার রুমে।

ওদিকে শারমিন শেখ তো কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।

শুভ্র ডক্টর কে কল করতে নিলে বাড়ির এক বয়জষ্ঠ কাজের মহিলা যে কিনা শুভ্র এবং অভ্রর জন্মের থেকে এই বাড়িতে কাজ করছে,
সে শুভ্র এবং অভ্রর সামনেই হাসতে হাসতে শারমিন শেখকে বলল :-

-ভাবি সাহেবা, ডাক্তাররে কল করার কোন দরকার নাই, আমি বুঝছি কি হয়েছে। (মালেকা বেগম)

-আপনি কি বুঝেছেন মালেকা আপা? (শারমিন শেখ)

-তিন পোলার মা হইছো এখনো বুঝনা?
কখন মাইয়াগো বেশি বেশি বমি হয়?
মাথার মধ্যে ঘুরান দেয়, শরীর দুর্বল লাগে।
(মালেকা বেগম)

-প্রেগনেন্ট হলে? (শারমিন শেখ)

-হ ওইটাই, পোলাপান পেটে আইলেই এমন হয়। (মালেকা বেগম)

তখন কিছু একটা ভাবতেই শারমিন শেখ-এর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়।
খুশিতে তার নাচতে ইচ্ছে করে।
শারমিন শেখ দৌড়ে গিয়ে তার স্বামীকে খবরটা দেয়।

সাইদুল শেখ এখন আগের থেকে অনেকটা সুস্থ,
সে দাদা হবে এই খবরটা শোনার পরেই আনন্দে সে শুভ্র এবং অভ্রকে ডেকে পুরো এলাকা এবং পার্টি অফিসে মিষ্টি বিলাতে বলে।

শুক্র এবং অভ্রও আজ মহা খুশি,
তারা চাচা হবে বলে কথা।
তাই শুভ্র লোকজন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সারা এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করতে, এবং দুই মোন মিষ্টি নিয়ে অভ্র চলে যায় পার্টি অফিসের দিকে।

অগ্নি এতক্ষন পার্টি অফিসে একটি মিটিং করছিল।

মিটিং শেষ হতেই অভ্র সেই কেবিনে ঢুকে, কেবিনে অবস্থানরত সকলের হাতে একটি করে মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে দেয়।

অগ্নি বুঝতে পারে না হঠাৎ এভাবে সবাইকে মিষ্টি দেওয়ার কারণ কি।

তখনই হঠাৎ অভ্র একটি মিষ্টির প্যাকেট থেকে মিষ্টি বের করে অগ্নির মুখে ঢুকিয়ে দেয়।

অগ্নি মিষ্টি খেতে খেতে অভ্রকে জিজ্ঞেস করে :-

-কি হয়েছে রে?
হঠাৎ মিষ্টি কেন? (অগ্নি)

সকলের মাঝে দাঁড়িয়ে অভ্র নির্দ্বিধায় বলে ওঠে :-

-তুমি বাবা হতে চলেছ তাই সবাইকে মিষ্টি খাওয়ানো হচ্ছে….

[চলবে]