অপ্রিয় সেই তুমি পর্ব-২৪+২৫

0
10

#অপ্রিয়_সেই_তুমি
#প্রিয়া_আফরোজ
#পর্ব২৪

মায়া এবং তূর্য দুজনে নিজেদের লাগেজ নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসতে বডিগার্ডরা লাগেজ গুলো তাদের হাত থেকে নিয়ে গাড়িতে রাখার জন্য চলে যায়।

মায়া এবং তূর্য ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে বাবা মায়ের থেকে বিদায় নিচ্ছিল, তখনই হঠাৎ আতিয়া বেগম তুর্যর দিকে তাকিয়ে বলল :-

-আমি বিশ্বাস করে তোর হাতে এই বাবা মা মরা মেয়েটাকে তুলে দিয়েছি।
আশা করি তুই আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবি,
দয়া করে ওকে একটু দেখে রাখবে। (আতিয়া বেগম)

-মা তুমি এভাবে বলছ কেন?
আমি কি ওকে দেখে রাখি না? (তূর্য)

-তুই যদি ওকে ঠিকভাবে দেখে রাখতি,
তাহলে খান বাড়ি আজ দ্বিগুণ আনন্দে সেজে উঠতো। তন্নীর মতো মায়াও ওর সন্তানের অপেক্ষায় দিন গুনতো। (আতিয়া বেগম)

হঠাৎ আতিয়া বেগমের মুখে এমন কথা শুনে তূর্য এবং মায়া দুজনেই একে অপরের দিকে তাকায়। তারা বুঝতে পারছে না যে আতিয়া বেগম এই ঘটনার কথা কিভাবে জানলো।
তখনই আতিয়া বেগম আবার বলতে শুরু করলেন :-

-অনেক আগেই তন্বী আমাকে সবকিছু বলেছিল।(আতিয়া বেগম)

তূর্য করুন চোখে তখন তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে :-

-বিশ্বাস করো আম্মু, আমি জানতাম না যে মায়া প্রেগন্যান্ট। আর কিচেন থেকে আসার সময় মায়া হঠাৎ পড়ে গিয়েছিল, মায়ার প্রেগনেন্সির কথা জানলেও হয়তো আমি কিছুই করতে পারতাম না।
ওটা হয়তো আমাদের ভাগ্যে ছিল। (তূর্য)

তূর্যর কথা শুনে আতিয়া বেগম এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালেন না।
সে তুর্য এবং মায়াকে জড়িয়ে ধরে বলল :-

-আল্লাহ তোদের উপর থেকে সকল মুসিবত দূর করুক। আল্লাহ তোদের সুখে রাখুক। (আতিয়া বেগম)

তারপর তুর্য এবং মায়া বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হয় এয়ারপোর্ট উদ্দেশ্যে।

তারপর তারা উড়াল দেয় লন্ডনের উদ্দেশ্যে।

তূর্য এবং মায়া লন্ডনে ফেরার পরে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে।

মায়া এখন প্রতিদিনই ভার্সিটি শেষ করে তূর্যর অফিসে চলে যায়। তারপর সারাদিন তূর্যর সঙ্গে অফিসের বিভিন্ন কাজ করে রাতে দুজন একসাথে বাড়ি ফেরে।

যেহেতু ইরাও এখন লন্ডনে নেই, তাই মায়া নিজেকে বড্ড একা অনুভব করে।
সারাদিন মায়া বাসায় একা একা মন খারাপ করে বসে থাকে।
বাংলাদেশ থেকে ফেরার কিছুদিন পরে তূর্য নিজেই মায়াকে বলেছিলো তূর্যর অফিসে জয়েন করতে।

মায়া ও তূর্যর কথা শুনে খুশি মনে তূর্যের সঙ্গে অফিসের কাজ করতে শুরু করে।

এভাবেই মায়ার পড়াশোনা, অফিস এবং সংসার সব মিলিয়ে খুব সুন্দর ভাবেই কেটে গেল আরো একটা বছর।

_______________

গত একটা বছরে ইরা আর লন্ডনে ফেরেনি।
অগ্নি সঙ্গে ইরার সংসার টা খুব ভালোই যাচ্ছে।
অগ্নির ভালোবাসা এখন ইরাও উপলব্ধি করতে পারে, হয়তো ইরাও মনে মনে অগ্নিকে ভালোবাসে।

তবে এই এক বছরের সংসার জীবনে ইরা কখনো সেই ভালোবাসার কথা মুখে স্বীকার করেনি।

গত কয়েকদিন যাবত ইরা খুবই অসুস্থতা অনুভব করছে। সে কোন কিছুর স্মেল নিতে পারছে না, সাথে মাথা ঘোরা এবং বমি বমি ভাবতো লেগে আছে।

কিন্তু আজ সকাল থেকে শরীর খারাপের মাত্রাটা একটু বেশি বেড়ে গেছে।

তবুও ইরা কাউকে কিছু বলল না, কারণ কিছুদিন আগে বিপক্ষ দলের লোকজনেরা অগ্নির ছেলেপেলের ওপর হামলা করেছিল, সেই বিষয়টা নিয়ে আজ বিপক্ষদলের লোকজনদের সাথে অগ্নি’র গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে।

আর ইরা জানে যে,
অগ্নি যদি একবার বুঝতে পারে ইরা অসুস্থ, তাহলে কোনো ভাবেই সে ইরাকে রেখে বাড়ি থেকে বের হবে না।

তাই ইরা কোনভাবেই অগ্নিকে তার অসুস্থতার কথা বুঝতে না দিয়ে, খুব সুন্দর করে হাসিখুশি ভাবে অগ্নিকে বিদায় দিল পার্টি অফিসে যাওয়ার জন্য।

অগ্নি চলে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পরে ইরা শারমিন শেখের কাছে গিয়ে বলল :-

-মামি, আমি একটু বাইরে যাবো। (ইরা)

শারমিন শেখ স্বাভাবিকভাবেই ইরাকে জিজ্ঞেস করল:-

-কোথায় যাবে?
শপিংয়ে?
অগ্নি সঙ্গে গেলেই পারতে।
বিপক্ষ দলের লোকেরা যেভাবে আমাদের ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, এই মুহূর্তে আমাদের কারোরই একা বাইরে বের হওয়া ঠিক হবে না। (শারমিন শেখ)

ইরা তখন আমতা আমতা করে বলল :-

-আসলে কিছুদিন যাবত আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, তাই আমি ডক্টর দেখাতে যেতে চাইছিলাম। (ইরা)

ইরার অসুস্থতার কথা শুনে শারমিন শেখ উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করে :-

-কিরে মা, তোর কি হয়েছে?
তুই গত কয়েকদিন যাবত অসুস্থ অথচ তুই আমাকে সেটা আজ বলছিস? (শারমিন শেখ)

ইরা তখন শারমিন শেখের পাশে বসে আস্তে আস্তে বলতে শুরু করলো :-

-আসলে গত কয়েকদিন যাবত আমি নিজের ভেতরে দুর্বলতা অনুভব করছি।
কেমন যেন একটু পড়ে পড়ে মাথাটা ঘুরিয়ে ওঠে।
যেকোনো কিছু খেতে নিলেই কেমন যেন একটা ব্যাড স্মেল আসে। (ইরা)

শারমিন শেখ কিছু একটা ভেবে অভিজ্ঞ স্বরে ইরাকে জিজ্ঞেস করল :-

-তোর লাস্ট পিরিয়ড হয়েছিলো কবে?
(শারমিন শেখ)

-প্রায় আড়াই মাস আগে। (ইরা)

ইরার কথা শুনে শারমিন শেখের চোখে মুখে আনন্দের ঝলক দেখা গেল।

ইরা তখন বলল :-

-মামি, আমি জানি তুমি কি ভাবছো।
সত্যি বলতে আমিও একই কথা ভাবছি।
তবে আমি শিওর না হয়ে কাউকে কিছু বলতে চাচ্ছি না। (ইরা)

শারমিন শেখও ইরার কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল :-

-হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস,
আমিও চাই না গতবারের মতো লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে।
তার চেয়ে বরং চেকআপ করে, রিপোর্ট নিয়ে এসে, শিওর হয়ে তারপর সবাইকে জানাবো।
(শারমিন শেখ)

-আমিও সেটাই ভাবছি। (ইরা)

-অগ্নি কি এ বিষয়ে কিছু জানে? (শারমিন শেখ)

ইরা মাথা নিচু করে বলল :-

-না।
এই বিষয়টা নিয়ে আমি নিজেও এখনো শিওর না, তাই ওনাকে কিছু জানাইনি। (ইরা)

-আচ্ছা ঠিক আছে চল আমিও তোর সঙ্গে হসপিটালে যাবো। (শারমিন শেখ)

-OK মামি চলো। (ইরা)

________________

এমপির বউ বলে কথা, চেকআপ-এর অল্প কিছুক্ষণ সময়ের মধ্যে ইরার সব রিপোর্ট চলে আসলো। রিপোর্ট দেখে ডক্টর শারমিন শেখ কে বলল :-

-congratulation আপনি দাদি হতে চলেছেন।
এবং ডাবল congratulation আপনার ছেলের বউয়ের গর্ভে দুইটি ভ্রুণ রয়েছে। (ডক্টর)

ডক্টরের বলা কথাগুলো শুনে শারমিন শেখ আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়।

অভ্র এবং শুভ্র পরে আবারো শেখ ভিলাতে জমজ বাচ্চা আসতে চলেছে। কথাগুলো ভাবতেই শারমিন শেখের বুকের ভিতরে সুখময় অনুভূতি হানা দিচ্ছে।

শারমিন শেখ খুশি হয়ে ডক্টরের সহকারীর কাছে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে বলল :-

-আমার কাছে ক্যাশ আপাতত এটাই আছে।
এই টাকা দিয়ে মিষ্টি এনে হসপিটালের সবাইকে মিষ্টিমুখ করাবেন। আর বলবেন এমপি সাফওয়ান শেখ অগ্নি বাবা হতে চলেছে। (শারমিন শেখ)

ডক্টরের সেই সহকারী ও খুশি মনে টাকাটা নিয়ে মিষ্টি আনতে চলে গেল।

ইরার কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে,
ইরা মনে মনে ভাবছে,
সে প্রেগন্যান্ট এটা শোনার পরে সবাই তাকে দেখলে কি ভাববে?
সবাই তো বুঝে যাবে যে ইরার অগ্নি ওইসব করেছে।

পরক্ষণে আবার নিজেই নিজের মনকে বলছে:-
বিয়ের পর সব মেয়েরাই তো প্রেগন্যান্ট হয়,
এটা নিয়ে কেউ কিছু ভাববে কেনো?

ডক্টরের চেম্বার থেকে বেরিয়েই শারমিন শেখ অভ্রকে ফোন করলো, দুইবার রিং হতে ওপাশ থেকে অভ্র ফোনটি রিসিভ করল।
অভ্র ফোন রিসিভ করতে শারমিন শেখ খুশিতে গদগদ হয়ে অভ্রকে বলল :-

-অভ্র, আমি তোকে এখন এমন একটা খুশির সংবাদ বলবো যা শোনার পর তুই খুশিতে পাগল হয়ে যাবি। (শারমিন শেখ)

-আম্মু আমি তো এতদিন জানতাম যে আমি অলরেডি পাগল। (অভ্র)

-তুই তোর বাদরামো বন্ধ করবি? (শারমিন শেখ)

-OK, OK. বলো।
কি খুশির সংবাদ দিবে? (অভ্র)

-সবাইকে মিষ্টি খাওয়ানোর ব্যবস্থা কর, বাড়িতে দুই দুই জন নতুন সদস্য আছে। (শারমিন শেখ)

শারমিন শেখের এমন কথা শুনে অভ্র খুশিতে নাচতে নাচতে বলল :-

-আম্মু তোমার কথা শুনে সত্যি আমি খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছি, আমি ভাবতেও পারিনি যে তুমি আমাদেরকে না জানিয়ে আমার এবং শুভ্রর বিয়ে ঠিক করে ফেলবে। (অভ্র)

ছেলের কথা শুনে শারমিন শেখ অবাক হয়ে গেল।
সে বলল কি, আর ছেলে বুঝলো কি।

তাই সে অভ্রকে বোঝানোর জন্য আবারও বলল :-

-আমি তোদেরকে বিয়ে করিয়ে বউ আনার কথা বলিনি। আমি বলতে চেয়েছি বাড়িতে দুটো নতুন ক্ষুদে সদস্য আসছে। (শারমিন শেখ)

এদিকে ইরা লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।

তখনই অভ্র ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠলো :-

-আম্মু এই বয়সে তোমাদের এটা করা ঠিক হয়নি,
বাবার বয়স হয়েছে বলে সে রাজনীতি থেকে রিটার্ন নিল, আর এই বয়সে এসে কিনা তোমরা আবার নতুন করে ফ্যামিলি প্লানিং শুরু করলে?
তাও আবার জমজ? (অভ্র)

এবার ছেলের কথা শুনে শারমিন শেখ রেগে আগুন হয়ে গেল, সে দাঁতে দাঁত চেপে ধমকের সুরে ছেলেকে বলল :-

-বাদর ছেলে, আমাকে আজ বাসায় ফিরতে দে।
তোর হাড় মাংস যদি আলাদা করে রেখে না দিয়েছি,
তবে আমার নাম ও শারমিন না। (শারমিন শেখ)

-কি হলো আম্মু?
তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?
তুমি তো বললে বাড়িতে নতুন ক্ষুদে সদস্য আসছে। (অভ্র)

শারমিন শেখ নিজেকে কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল :-

-হ্যাঁ, আমি বলেছি যে ক্ষুদে সদস্য আসছে।
তারমানে এই না যে আমি আর তোর বাবা এই বয়সে এসে ফ্যামিলি প্ল্যানিং করছি। (শারমিন শেখ)

অভ্র মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল :-

-তাহলে? (অভ্র)

-ইরা মা হতে চলেছে। (শারমিন শেখ)

-আম্মু, আমাকে কি বলদ পাইছো?
গতবছর এই সেম ডাইলগ দিয়া আমার আর শুভ্র পকেট থেকে প্রায় 2 লক্ষ টাকা খসাই ছিলা।
পুরা এলাকায় ১৭ মন মিষ্টি বিলানোর পরে জানতে পারলাম পুরাই মিসটেক।
আমি কি পাগল হইছি যে এবার আবার তোমার কথা শুনে ধেই ধেই করে নাচবো?
আমি তোমাদের কথা বিশ্বাস করি না।
আগে ভাইয়া এই বিষয়টা কনফার্ম করুক।
আগে শিওর হইযে সত্যি আমি চাচ্চু হব,
তারপর দরকার হলে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে এলাকায় ৩০ মন মিষ্টি বিলাবো। (অভ্র)

ছেলের মুখে এমন কথা শুনে শারমিন শেখ আর কথা না বাড়িয়ে কলটা কেটে দিল।

তারপর শারমিন শেখ এবং ইরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়, হঠাৎই শারমিন শেখ একটি শপিং মলের সামনে এসে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন।
এবং ইরাকের সাথে করে শপিং মলের ভিতরে নিয়ে গেলেন।

ইরা শারমিন শেখ কে জিজ্ঞেস করল:-

-মামি, আমরা শপিং মলে আসলাম কেন? (ইরা)

-তোর জন্য কিছু জিনিস কিনা প্রয়োজন।
(শারমিন শেখ)

-কি জিনিস?
আমার তো কিছু প্রয়োজন নেই। (ইরা)

-গর্ভকালীন সময়ে মেয়েদের যা যা প্রয়োজন হয়,
সেসব আমি নিজের হাতে কিনে নিয়ে যাব।
(শারমিন শেখ)

ইরার প্রেগনেন্সির কথা জানার সাথে-সাথে শারমিন শেখের এমন পাগলা ও দেখে এরা মুচকি হাসলো।

ইরা এখন ভাবছে অগ্নিকে কিভাবে প্রেগনেন্সির কথাটা জানাবে।

আর অন্যদিকে শারমিন শেখ মাদার হরলিক্স থেকে শুরু করে গর্ভকালীন সময়ে মেয়েদের যা যা প্রয়োজন হয় তার সবকিছুই কেনা শুরু করে দিয়েছে।

এমন সময় হঠাৎ ইরা দেখল শপিংমলের Digital Display-তে একটি সংবাদ চলছে, যেখানে অগ্নির ছবি দেখিয়ে বলা হচ্ছে যে :-

-পার্টি অফিস থেকে বেরোনোর সময় এমপি সাফওয়ান শেখ অগ্নির ওপরে প্রাণহানি আক্রমণ করা হয়েছে। বুকে দুইটি গুলি লাগার ফলে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে সিটি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বর্তমানে ওনার অবস্থা আশঙ্কাজনক।

সংবাদটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে ইরার হাত-পা অবশ হয়ে গেল, তখনই ধুপ করে ইরা ফ্লোরে ঢলে পড়ল।

তারপর কি হয়েছে ইরার তা জানা নেই।

চলবে….

#অপ্রিয়_সেই_তুমি
#প্রিয়া_আফরোজ
#পর্ব২৫

ইরার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে নিজেকে হসপিটালের একটা কেবিনে আবিষ্কার করল।

প্রথমে সে কোনো কিছু বুঝে উঠতে না পারলেও,
পরে তার ধীরে ধীরে সবকিছু মনে পড়ল।
এবং অগ্নির কথা মনে পড়লেই ইরা এক টানে তার হাতে লাগানো স্যালাইন টা খুলে ফেলল।

তারপর তাড়াহুড়ো করে বেড থেকে নামতে নিলেই দুজন নার্স এসে তাকে আটকে ফেলে।
ইরা তখন কোন রকমে নার্সদের বলল।

-প্লিজ আপনারা আমাকে যেতে দিন, আমি আমার হাজবেন্ড এর কাছে যাব। আমার হাজব্যান্ড কে হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে। আমি উনার কাছে যাবো। (ইরা)

-ম্যাম, এমপি সাহেব এই হসপিটালেই আছে।
আপনি একটু শান্ত হোন, আমরা আপনাকে ওনার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। এই অবস্থায় আপনার এতটা উত্তেজিত হওয়া ঠিক না। (নার্স)

তবুও ইরা কোনোভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। ইরার এমন পাগলামো দেখে, নার্সরা গিয়ে শেখবাড়ির সবাইকে খবর দেয় যে ইরার জ্ঞান ফিরেছে।

ইরার জ্ঞান ফিরেছে শুনে অভ্র এবং শুভ্র গিয়ে ইরাকে অপারেশন থিয়েটারের কাছে নিয়ে আসে।

এদিকে শেখ বাড়ির প্রতিটা সদস্যের অবস্থাই খুব খারাপ হয়ে আছে। ছেলের এমন অবস্থা দেখে শারমিন শেখ শোকে পাথর হয়ে গেছে। অগ্নির বাবা এমনিতেই কিছুদিন যাবত খুব অসুস্থ হয়ে আছে,
এই মুহূর্তে সে এত বড় ধাক্কা সামাল দিতে পারবে না।
তাই তাকে এখনো কোনো কিছু জানানো হয়নি।

বিপক্ষ দলের নেতা মাজেদ শিকারি কোনোভাবেই অগ্নির সঙ্গে পেরে উঠছিল না। আজকের মিটিংয়েও সে অগ্নির কাছে হেরে গিয়েছিল, হাঁটুর বয়সী একটা ছেলের কাছে হেরে গিয়ে নিজের ক্রোধ সামলাতে না পেরে, পার্টি অফিস থেকে বেরোনোর সময় হঠাৎ করেই সে অগ্নিকে গুলি করে বসে।

একটা গুলি কোনরকমে অগ্নির হাত ছুঁয়ে বেরিয়ে গেলেও অন্যগুলিটা সোজা অগ্নির বুকে গিয়ে লাগে।

অগ্নির বুকে যেগুলিটা লেগেছে সেটা অগ্নির হার্টকে খুব বাজে ভাবে ড্যামেজ করে ফেলেছে।

ডক্টররা যখন একদমই আশা ছেড়ে দিয়েছিল,
ঠিক তখনই বাইক এক্সিডেন্ট করা একটা ছেলেকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়, ছেলেটা মাত্র দু বছর আগে বিয়ে করেছে, ঘরে তার ছয় মাসের ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান। তার পরিবারের সকলে কান্না করে করে আল্লাহর কাছে তার জীবন ভিক্ষা চাইছিল, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অল্প কিছু সময়ের মধ্যে সেই ছেলেটি মারা যায়।

ভাগ্যক্রমে অগ্নিসঙ্গে ওই ছেলেটির সমস্ত কিছু ম্যাচ করায়, ডক্টররা দুই পরিবারের লোকেদের সঙ্গে কথা বলে। এক্সিডেন্ট করা লোকটির স্ত্রীর প্রথমে রাজি না হলেও, শারমিন শেখ যখন বলেন যে সে নগদ ২০ লক্ষ টাকাসহ তার সন্তানের সারা জীবনের দায়িত্ব নিবেন। তখন মেয়েটি তার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট এর জন্য রাজি হয়ে যান।

অপারেশন থিয়েটার এর মধ্যে অগ্নির হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করা হচ্ছে ।

অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শেখ পরিবারের সকল সদস্য এবং বড় বড় কিছু রাজনীতিবিদরা।

অভ্র ইরাকে বেশ কয়েকবার বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলেও ইরার জেদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি।
সবাই মিলে ইরাকে অনেক বুঝায় বাড়িতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ইরার এক কথা, অগ্নির যতক্ষণ জ্ঞান না ফিরছে সে হসপিটাল থেকে এক পাও নড়বে না।

________________

দেখতে দেখতে পুরো দুটো দিন কেটে গেল।
সেদিন অগ্নির অপারেশনটা খুব ভালোভাবে হয়ে গেলেও এখনো অগ্নির জ্ঞান ফেরেনি। ডক্টর বলেছিল ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেও অগ্নির জ্ঞান না ফিরলে হয়তো অগ্নি কোমায় চলে যাবে।

৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও অগ্নির জ্ঞান না ফেরায় সকলেই ভেঙে পড়েছে।
গত দুই দিনে ইরা এবং শারমিন শেখ একবারের জন্যও হসপিটাল থেকে কোথাও যায়নি।

কিন্তু আজ বিকেলে সাইদুল শেখের অসুস্থতার কথা শুনে শারমিন বেগম আর বাড়ি না গিয়ে পারল না।

বর্তমানে অগ্নির বেডের পাশেই একটা টুল নিয়ে ইরা বসে আছে।
ইরা মন খারাপ করে অনেকটা সময় অপলক ভাবে অগ্নির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ করেই অগ্নির একটা হাত নিজের দুহাতের বন্ধনে আবদ্ধ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

টানা অনেকটা সময় ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করার পরে ইরা কোনোভাবে নিজেকে শান্ত করে বলতে শুরু করল :-

-কে বলেছে ভালোবাসা একবারই হয়,
আমাকে দেখো একজনকে নিয়ে সূচনা করতে চেয়েছিলাম অথচ এখন অন্য একজনকে নিজের সমাপ্তি পর্যন্ত চাইছি।
এতদিন ভাবতাম আমি তোমাকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি, তবে এখন বুঝতে পারছি যে বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে বাঁধা পড়ে আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার এই এক বছরের ভালোবাসা আমাকে গত আট বছরের অতীত ভুলিয়ে দিয়েছে।
বিশ্বাস করো অগ্নি,
আমি পারবো না তোমাকে ছাড়া থাকতে।
তুমি উঠে পড়ো তাড়াতাড়ি,
আমার এখনো পূর্ণিমা রাতে তোমার সঙ্গে ছাদে বসে গল্প করা বাকি,
সব পিছুটান মুছে দিয়ে তোমার সঙ্গে পথ চলা বাকি।
সবে তো ভালোবাসা হলো,
এখনো তোমার সঙ্গে সংসার করা বাকি।
আমার গর্ভে তোমার অংশ,
সে কথা তোমার কে জানান দেওয়া বাকি।
আর সব চেয়ে বড় কথা হলো তোমাকে এখনো ভালোবাসি বলা বাকি। (ইরা)

তারপর ইরা অগ্নির হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল,
হুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করতে করতে বলল :-

-প্লিজ উঠে পড়ো,
আমাদের বেবি আসছে।
তাদের তো বাবার প্রয়োজন, আমি চাইনা আমি যে কষ্ট বুকে নিয়ে বড় হয়েছি সেই কষ্ট আবার আমার সন্তানেরাও অনুভব করুক। (ইরা)

কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ ইরা অনুভব করল ইরার হাতের ওপরে থাকা অগ্নির হাতটি কিছুটা নড়ে উঠলো। ইরা মাথা তুলে অগ্নির দিকে তাকাতেই দেখল অগ্নি তার দিকে তাকিয়ে আছে।

অগ্নির জ্ঞান ফিরেছে দেখে ইরাক খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল, এরা অগ্নির আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে অগ্নির কপালে একটি গভীর চুমু অংকন করে দিল।

অগ্নি নিজের মুখ থেকে অক্সিজেন মাক্সটি সরিয়ে কোনরকমে ইরাকে জিজ্ঞেস করল :-

-সত্যি আমাদের বেবি আসছে? (অগ্নি)

অগ্নির প্রশ্ন শুনে ইরা বুঝতে পারল যে এতক্ষন ইরা যা যা বলেছে সেই সব কথাই অগ্নি শুনে ফেলেছে।
তাই লজ্জায় ইরা মুচকি হেসে বলল :-

-আমাদের বেবি আসছে না,
বেবিরা আসছে। (ইরা)

শারীরিক এবং মানসিক দুর্বলতার কারণে অগ্নি প্রথমে ইরার কথার অর্থ বুঝতে পারল না।

তাই ইরা আর হেয়ালি না করে, অগ্নিকে পরিষ্কারভাবে বলল :-

-আমাদের টুইন্স আসছে। (ইরা)

ইরার মুখ থেকে কথাটি শুনে অগ্নির বুকের ভিতরে এক অজানা শিহরণ বয়ে গেল, প্রশান্তিতে অগ্নি চোখ বন্ধ করে নিল।

______________

সাত দিন পরে অগ্নিকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হলো।

পরিবারের সকলের যত্নে অগ্নি ধীরে ধীরে সুস্থ হতে শুরু করল।

একদিন রাতে ইরা অগ্নির বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে থাকতে অগ্নিকে জিজ্ঞেস করে :-

-আমাকে ভালবাসেন? (ইরা)

-ভালো না বাসলে তোমাকে পাওয়ার জন্য ৯ বছর নিজের বাবার সঙ্গে যুদ্ধ করতাম বুঝি? (অগ্নি)

-আমি তখনকার কথা জিজ্ঞেস করিনি,
আপনি আমাকে এখন ভালবাসেন কিনা সেইটা জিজ্ঞেস করেছি। (ইরা)

-তখন আর এখন এর মধ্যে তফাৎ কি? (অগ্নি)

-অনেক বড় তফাৎ রয়েছে।
আপনার যে হৃদয়ে আমার বসবাস ছিল সেই হৃদয়টাই তো আর আপনার মাঝে নেই। (ইরা)

অগ্নি মুচকি হেসে বলে :-

-হৃদয়টা যারই হোক।
যখন থেকে এটা আমার শরীরে স্থাপন করা হয়েছে,
তখন থেকেই এই হৃদয়ের প্রতিটি শিরায়-উপসীরায় তুমি বিরাজমান।
এই হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দন তোমার নামের।
চাইলে বুক চিরে দেখতে পারো। (অগ্নি)

অগ্নির এত সুন্দর এবং গোছানো উত্তর শুনে ইরা খুশি হয়ে যায়।

এদিকে ইরার প্রেগনেন্সির দিন যত বাড়ছে,
শেখ বাড়িতে ইরার আদরও তত গুণ বেড়ে যাচ্ছে , শারমিন শেখ সব সময় ইরার মুখের সামনে কোন না কোন খাবার ধরেই রাখে।

প্রথম প্রথম এই যত্নগুলো ইরার খুব ভালো লাগলেও এখন যত দিন যাচ্ছে, ততই ইরার কাছে এগুলোকে অত্যাচার মনে হচ্ছে।

আর এভাবে খাবার খাওয়ার ফলে গর্ভকালীন সময়ে ইরার শরীরে বিশাল পরিবর্তন দেখা দেয়।
ইরার ওজন ৫৫ কেজি থেকে সোজা ৭৬ কেজিতে চলে যায়।

ইরা সব সময় মন খারাপ করে সে অনেক মোটা হয়ে গেছে বলে।
অন্যদিকে অগ্নির কাছে এই গোলুমোলু ইরাকেই বেশি ভালো লাগছে।

অগ্নি মাঝে মাঝে ইরাকে জড়িয়ে ধরে বলে :-

-এমন গোলুমোলু ১টা বউ থাকলে জাজিমের কি দরকার? (অগ্নি)

অগ্নির মুখে এমন কথা শুনলে ইরা ভীষণ রেগে যায়। আর অগ্নিকের শাস্তি দেওয়ার জন্য ইরা সব সময় কোন না কোন নতুন ফন্দি আকতে থাকে।

গর্ভকালীন এই কয়েক মাসে ইরা একদম অগ্নির হাড়-মাংস সব জ্বালিয়ে খেয়েছে।

মাঝে মাঝে ইরা মাঝরাতে উঠে অগ্নির কাছে ফুচকা, চটপটি এবং আইসক্রিম জাতীয় খাবার খেতে চাই।

অগ্নি যদি বলে যে:- এত রাতে আমি এগুলো পাব কোথায়।

তাহলে ইরা অগ্নিকে ব্যঙ্গ করে বলে :-
-রাত তিনটের সময় যদি সামান্য ফুচকা, চটপটি এবং আইসক্রিমই জোগাড় করতে না পারেন তাহলে আপনি কি বা*লের এমপি? (ইরা)

ইরার মুখে এমন কথা শুনে অগ্নি একদিন ইরাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য মাঝরাতে ইরার কাছে অনেকগুলো ফুচকা, চটপটি এবং আইসক্রিম নিয়ে আসে। কিন্তু ইরা সেগুলো খেতে খেতে অগ্নিকে বলে:-

-এই মাঝ রাতে এগুলা এনেছেন কেন?
মাঝরাতে কেউ এসব খায়?
নিহাত আমি ভালো মেয়ে, তাই আপনার সম্মান রক্ষার্থে এত রাতে এসব খেলাম। (ইরা)

ইরার এমন কর্মকাণ্ডে এবং কথাবার্তায় অগ্নি এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে, প্রতি ৩০ মিনিট পরপর ইরার মুডসুইং হয়। আর বেচারা অগ্নিকে সেটার জন্য তৈরিও থাকতে হয়।

এভাবেই খুনসুটিতে কেটে গেল কয়েকটা মাস।
ইরা এখন নয় মাসের গর্ভবতী।
একে নিজের শরীরের এত ওজন, তার ওপর জমজ বাচ্চা নিয়ে পাহাড় সমান পেট। সব মিলিয়ে এখন ইরার হাঁটাচলা করতেও খুব অসুবিধা হয়।

ইরার সুবিধার কথা ভেবে অগ্নি নিজেদের রুম নিচ তলায় শিফট করেছে, এতে করে ইরার সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা করার কোন ঝুঁকি নেই।

সারাদিন পার্টি অফিসের সমস্ত কাজকর্ম শেষে,
অগ্নি সবে মাত্র ঘুমিয়ে ছিল।
তখনই হঠাৎ ঘুমের মধ্যে কারো ব্যথায় কাতরানোর আওয়াজ শুনতে পায়।

চোখ খুলে পাশে তাকাতেই দেখে ইরা ব্যথায় ছটফট করছে।

তৎক্ষণাৎ অগ্নি বুঝতে পারে যে ইরান লিভার পেইন উঠেছে।

চলবে….