অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
37

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

২৮.

বিকাল তিনটায় আমজাদ সাহেবের শেষ দুপুরে শেষ গোসল হচ্ছিল। জয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল ভিটির ওপর। অনেক লোক জড়ো হয়েছে মূর্দা বাড়িতে। তারা কটূক্তি করতে ভুলছে না। গতকালের তাজা ঘটনা মরলেই চাপা পড়বে কেন? মেয়ের চরিত্রের দোষের ভাগ বাপেরও যায়।

বসার ঘরের মেঝেতে খুঁটির সাথে পিঠ ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে আছে অন্তূ। উঠানের ওপর ত্রিপল টাঙিয়ে ভেতরে তার আব্বুর শেষ গোসল হচ্ছে। সে চুপচাপ বসে দেখছে। কান্না পাচ্ছে না তার। আব্বুর সাথে খুব যেতে ইচ্ছে করছে। অবশ্য সে যাবেই। কেউ ঠেকাতে পারবে না তাকে। জয় তাকিয়ে দেখছিল অন্তূকে।

দুটো ছেলে এগিয়ে এলো। সালাম দিলো। জয় খেয়াল করল না। দুজন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও জবাব না পেয়ে ডাকল, “জয় ভাইয়া?ʼʼ

জয় আনমনার মতো বলে, “হু!ʼʼ

দৃষ্টি তখনও অন্তূর দিকে। রাগ হচ্ছে তার। মনে মনে ঠাস করে অভ্যাসবশত দুটো গালি দিলো, “মানুষ বাপ মরলে কাঁদে, শালী সেটাও করছে না। মানে হাগল-পাগল বিয়ে করাই দিছে আমার সাথে! তোর বাপ মরছে, তুই কাঁদবি, চিল্লায়ে কাঁদবি। তা না করে এমনভাবে বসে থাকার কারণ কী? কখন জানি ফিট খাইয়া পইড়া থাকবি। কাঁদলে একটু হালকা লাগে।ʼʼ

জয়ের ইচ্ছে করল, এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে একটা চড় মেরে বলতে, “কাঁদ, জোরে-জোরে কাঁদ। চুপচাপ আছিস, বেশি চাপ পড়তেছে মাথায়। মূর্ছা যাবি। সেন্স হারানোর আগে কেঁদে হালকা হ শালী।ʼʼ

ছেলেদুটো অধৈর্য্য হয়ে বলেই ফেলল, “ভাই, একটা সেলফি নিই? ফেসবুকে আপলোড করব।ʼʼ

উঠতি বয়সী ছেলেরা। রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ছবি তুলে ফেসবুকে দিতে পারাটাও একটা বাহাদুরী তাদের কাছে। এতে তারা এক ধরণের শক্তি অনুভব করে। জয় ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর হয়ে তাকায়, “তাতে উপকারটা কী?ʼʼ

ছেলদুটো চুপসে গেল, “না মানে… আচ্ছা সেলফি লাগবে না। আপনার ফেসবুক একাউন্টটা দেবেন ভাই? আমরা এড হতাম।ʼʼ

জয় চোখ বুজে ভারী শ্বাস ফেলল, মনে মনে বলল, “ফেসবুকের মাইরে…ʼʼ

গালিটা প্রকাশ্যে দিলো না। এরা এক প্রকার সামাজিক শক্তি। জয়ের খুব শক্ত ভক্ত, তা বোঝাই যাচ্ছে। জয় মাথা নাড়ল, “আমার কোনো ফেসবুক একাউন্ট নাই। ওসব বাল-ছাল পোষায় না আমার। ফেসবুকে কী কাম? কী করে ওই ধোন-বাল দিয়া?ʼʼ

ছেলেদুটো যারপর নাই অবাক হলো, “আপনার ফেসবুক একাউন্ট নাই?ʼʼ

-“হ, নাই। পারলে ফোনে একমাত্র কলিং সিস্টেম ছাড়া আর কিছু রাখতাম না। কিন্তু ফাংশনালভাবে বহুত কিছুই পড়ে আছে। যেসব আমার বালের কামেও লাগে না। যাহ, ভাগ।ʼʼ

একে তো ঘুম নেই তার ওপর কীসের যে এক বোঝা চেপে আছে মাথায়। অদ্ভুত এক প্রেশার-ফিল হচ্ছে। অস্থির লাগছে সবকিছু। লোকালয় থেকে দূরে যেকোনো এক নির্জন জঙ্গলে অন্ধকারে খানিকক্ষণ বসে কয়েক বোতল অ্যালকোহল গিলে আসতে পারলে ভালো লাগতো।

বিষাদ ঘিরে আছে বাড়িতে। গোসল করিয়ে এনে আমজাদ সাহেবের লাশ রাখা হলো। আজ মার্জিয়ার চোখদুটো ভেজা দেখা গেল। মেয়েটা উদ্ভ্রান্তের মতো বসে সেই শ্বশুরের জন্য অসুস্থ শরীরে চোখের পানি ফেলেছে, যাকে সে চিরদিন বিরূপ চোখে দেখে এসেছে, শুধু অভিযোগ ছাড়া কিছুই ছিল না ওই মানুষটার ওপর।

রাবেয়াকে সামলানো যাচ্ছে না, বারবার দাঁত আঁটকে যাচ্ছে উনার। হামজা বসে রইল সোফার ওপরে। তার ছেলেরা মৃতদেহ দাফন-কাফনের সমস্ত ব্যবস্থাপনা করে ফেলেছে।

অন্তূ আর অন্তিক মূর্তির মতো বসে ছিল দুই ভাই-বোন। অন্তূ দেখল সেই জায়গাটা, যেখানে সেদিন তাকে দাঁড় করিয়ে নষ্টা প্রমাণিত করা হলো, সেখানেই আব্বুর লাশের খাটিয়াটা রাখা হয়েছে। মেঝের ওপর বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে তাকিয়ে থাকল খাটিয়ার দিকে। তার চোখে-মুখে অবিশ্বাস। লোকজন যা ভাবছে তেমন কিছুই না। কী বাজে কথা! তার আব্বু নাকি আর নেই! এ-ও কখনও হয়?

লাশ নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি যখন চলছিল। জয় এলো অন্তূর কাছে। হাঁটু গেড়ে সামনে বসে আস্তে কোরে বলল, “আরমিণ! চলো, এখন তোমার বাপরে নিয়ে যাবে ওরা। চলো!ʼʼ

অন্তূ নিস্তেজ পায়ে উঠে দাঁড়াল আস্তে করে। জয় তাকে ছোঁয়ার সাহসটা করল না এ অবস্থায়। অন্তূ হেঁটে গিয়ে বসল খাটিয়ার পাশে মাটির ওপর। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আব্বুর মুখের দিকে। চেহারাটা উজ্জ্বল হয়েছে। চোখে সুরমা, মেহেরাঙা দাড়ি ভেজা। ভুরভুর করে আতর, গোলাপ জল, কর্পূরের গন্ধ ঢুকছে নাকে।

অন্তূ ডাকল, “আব্বু….আব্বু…. ও আব্বু! আব্বু, আব্বু গো…ʼʼ

আমজাদ সাহেব সাড়া দিলেন না। নিষ্ঠুরভাবে চুপটি মেরে ওভাবেই শুয়ে রইলেন। একটুও বুঝতে চেষ্টা করলেন না অন্তূর ভেতরে কী হচ্ছে!

-“আব্বু তুমি কী ভয়ানক স্বার্থপর! সকালে প্রতিদিন ডেকে ডেকে তো ঠিক আমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিতে। আজ এই যে ডাকছি, তুমি উঠছো না, ঠিক আরামে ঘুমাচ্ছ! এটা কি ঠিক আব্বু?ʼʼ

জয়ের ভেতরে কী হচ্ছে! আশ্চর্য এক ধরণের ব্যাপার। সে অন্তূর পেছেনেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার ভেতরে কী এক অদ্ভুত অনুভূতি চলছে। হনহন করে বেরিয়ে গেল গেইট দিয়ে। বাড়ি থেকে একটু দূরে গিয়ে একটা চুরুট ধরালো।

ছোট বাচ্চার মতো করে চোয়ালটা খাটিয়ার ওপর ঠেকিয়ে উদাস বাচ্চার মতো চেয়ে থাকে অন্তূ আব্বুর দিকে। আব্বুর ঠোঁটদুটো হাসছে যেন। লোকে দেখলে আরেকবার মেলাতে পারবে, অন্তূর সুশ্রী নাকটা আমজাদ সাহেবের কাছে পাওয়া। অন্তূর চোখের কোণা পেরিয়ে নিস্তেজ ঝরনার মতো পানিগুলো গড়িয়ে খাটিয়ার ওপর পড়ে। কিন্তু অন্তূ স্থির চোখে চেয়ে আছে আব্বুর মুখের দিকে। শেষ দেখা দেখছে সে আব্বুকে। আর কোনোদিন দেখতে পাবে না ওই অভিজাত মুখখানা, আর কোনোদিন গম্ভীর স্বরে অন্তূকে ডেকে পাশে বসাবে না, আর কখনও ধমকে বলবে, ‘রাতে খেয়ে তারপর ঘুমাবি।ʼ

অন্তূ আস্তে কোরে ঢলে পড়ে খাটিয়ার ওপর থেকে মাটিতে। পড়ে রইল ওভাবেই। তার জন্য অপেক্ষা করার নয়। লোকজন অন্তূর চেতনাহীনতার মাঝেই অন্তূর আব্বুকে অন্তূর কাছ থেকে চিরতরে সরিয়ে নিয়ে গেল।

খাটিয়ার একপাশ হামজা ধরে, অপর পাশ দুটো অন্তূর চাচাতো ভাইয়েরা। আরেকটা অন্তিকের জন্য খালি। অন্তিক বাথরুমে ঢুকেছে। বের হবার নাম নেই।

মুখ বিদ্ধস্ত, চোখ লাল, ফোলা। টুপি পরতে পরতে বেরিয়ে আসে অন্তিক বাথরুম থেকে। খাটিয়ার একপাশ হামজা ধরেছে, তাতেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না ছেলেটা। আমজাদ সাহেব বলতেন, ছাগল জবাই হবার পর মাংসের সাথে যাই করা হোক, ছাগলের আর যায় আসে না।


লোকে বলে, আজ মরলে কাল দু’দিন। আমজাদ সাহেবকে ছাড়া মাঝে দু’দিন কেটে গেছে।

অন্তূকে স্নায়ুর দূর্বলতা কাটানোর স্যালাইন দেয়া হয়েছিল। সে দুটো দিন প্রায় অবিরাম অচেতন। এর মাঝে খাওয়া-দাওয়া নেই। পাগলামি থামাতে বাধ্য হয়ে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে শুধু ওষুধ এবং পানির ওপর দুটো দিন কেটে গেছে। চোখদুটো বসে গেছে, চোখের পাতা ফোলা, ঠোঁটের চামড়া শুকনো, ত্বক ফ্যাকাশে। অন্তূকে দেখে লাগছিল, বহুদিন কোনো কবরে বাস করে ফের জীবিত হয়ে উঠে এসেছে।

অন্তূ দু’দিন পর উঠল সন্ধ্যার পর। প্যারালাইজড রোগীর মতো উদ্দীপনাহীন শরীর। চোখ খুলে কিছুক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। কিছু মনে পড়ছে না। সব মনে পড়ছে, কিন্তু সেসব কেমন যেন জটলা বাঁধা, ঝাপসা। কুণ্ডলীর মতো মস্তিষ্কে জট পাকিয়ে আছে, স্পষ্ট হতে সময় লাগল।

আচমকা শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে বমি করে ফেলল অন্তূ। বমিতে শুধু পিচ্ছিল সর্দি আর কালচে তরল উঠে আসছিল। পুরো শরীরে এক রত্তি জোর নেই উঠে বসার মতো। বমি হবার পর আর কোনো জীবিত মানুষের মতো লাগছিল না অন্তূকে। ঘরের সকলে এক পর্যায়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল অন্তূর নির্জীব অবস্থা দেখে।

অন্তিক দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনলো। পার্লস রেট নেই বলা চলে। কোনোরকম বিট করছিল। অন্তূ চোখের মণি ঘুরিয়ে দেখল ডাক্তারকে, আর নজর ফেরালো না। চেয়ে রইল ডাক্তারের দিকে। ডাক্তারসাহেব একের পর এক প্রশ্ন করছিলেন।

-“কেমন লাগছে তোমার? কোনো রকম ভ্রম দেখছো চোখে? কিছু খেয়েছ? দেখো, তুমি শিক্ষিত মেয়ে। পৃথিবীর চিরন্তন সত্যগুলোর মাঝেমৃত্যু সবচেয়ে উপরে রয়েছে, যেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এভাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ, যা বোকামি হচ্ছে। কিছু খেয়ে নাও। আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা, কিন্তু…

ডাক্তার সাহেব থামলেন। অন্তূ প্রতিক্রিয়াহীন, কোনো রকমের উদ্দীপনা নেই তার চোখে-মুখে। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই নিশ্চুপ থেকে হঠাৎ-ই বলল, “ডাক্তার কাকা!ʼʼ

-“হ্যাঁ, মা।ʼʼ

-“দুটো ঘুমের ওষুধ দেবেন আমায়?ʼʼ

ডাক্তার অন্তূর মুখের সেই কাতরতা দেখে আৎকে উঠলেন। অপার্থিব কাকুতি। যেন কোনো মৃতর ডাক!

-“না রে মা। আর না। যে পরিমাণ ঘুমের ইঞ্জেকশন আজ দুইদিন দিয়েছি, তোমার শরীরের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির জন্য যথেষ্ট। এখন তুমি উঠবে, কিছু খাবে। এরপর আমি কিছু ওষুধ দেব সেগুলো খাবে। সুস্থ হওয়া লাগবে তোমার। বুঝছো?ʼʼ

অন্তূ আচমকা কী করল! হুড়মুড়িয়ে উঠে ডাক্তারের পা জড়িয়ে ধরল, “ডাক্তার কাকা, দিন দুটো ঘুমের ওষুধ। শুনুন কাকা, আমি চুপচাপ শুয়ে আছি জন্য আপনারা বুঝতে পারছেন না। ওই যে ওই, ওই বিছানার ওখানে এসে আব্বুর বসার কথা এখন। আমি অসুস্থ, আব্বু এসে ওইখানে বসে থাকার কথা। বসছে না, দেখেছেন? ডাক্তার কাকা, দিন দুটো ঘুমের ওষুধ কাকা। কাকা আমার ওপর এইটুকু দয়া করুন।ʼʼ

অন্তূকে ছাড়ানো যাচ্ছিল না। ডাক্তার সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্তূর ফুপুকে বললেন, “ওকে সামলান। ট্রমা নিতে পারছে না। ওর কেমন চিকিৎসা দিলে কোনো উন্নতি হবে, বুঝতেই পারছি না। আমজাদ ভাই যে করলেন মেয়েটার সাথে!ʼʼ

ডাক্তার বুঝলেন, অন্তূ বেশিক্ষণ এই অবস্থায় চেতনা ধরে রাখতে পারবে না। মানসিকভাবে পুরোপুরি ডিস্ট্রয়েড মেয়েটা। অন্তূ উঠে বসে পাগলের মতো এদিক-ওদিক তাকায়, আর শুয়ে পড়ে। শুয়ে ঠিক গলাকাটা মুরগীর মতো ছটফট করে। আবার উঠে বসে বুকের মাঝে আঙুল চেপে ধরে মালিশ করে বারবার। হাঁ করে শ্বাস নিয়ে আবার মাথার চুল টেনে ধরে। এদিক-ওদিক তাকায়, কাউকে খুঁজছে ওর বিকৃত মস্তিষ্ক। চোখের পানিগুলো আঁটকে আছে, পড়ছে না। দাঁত চেপে বুক চেপে ধরে। আবার নিঃশব্দে ডুকরে উঠে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে আর্তনাদ করে।

মাথা তুলে বলে, “ডাক্তার কাকা, আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিন। আমায় ঘুম পাড়ানোর ওষুধ দিন। আমায়….দুটো ঘুমের ওষুধ দিন। আপনার কাছে অনুরোধ করছি, কাকা।ʼʼ হাতজোর করে অন্তূ।

ডাক্তার চেয়ার থেকে নেমে অন্তূর সামনে বসে মাথায় হাত রাখেন, “আমজাদ ভাই কী করলেন, বুঝতে পারছি না। এই পাগলিকে রেখে খোদা তাকে টান দিলেন কেন? ধৈর্য্য ধরো তুমি, আম্মা।ʼʼ

অন্তূ অনেকক্ষণ ওরকম চামড়া ছিলা পশুর মতো তড়পে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আস্তে কোরে মেঝে ঘেষে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। সামনের দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। আজ ২৯-ই নভেম্বর, ২০১৪। তার বিয়ে হয়েছে ২৬-ই নভেম্বর ২০১৪। অন্তূ অপার্থিব দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল দিনপঞ্জিকার দিকে।

ডাক্তার সাহেব বিস্মিত চোখে দেখলেন অন্তূকে। তিনি যা বুঝলেন, তা ভয়ানক। অন্তূ নিজের একাধিক সত্ত্বার ওপর চমৎকার নিয়ন্ত্রণ পেয়ে বসেছে। এমন নয় যে সে যখন সত্ত্বা হারাচ্ছে, তখন অন্য সত্ত্বাকে ভুলে যাচ্ছে। মাইন্ড কন্ট্রোল করতে পারছে মেয়েটা। ভয়ানক এক মানসিক রোগ। সে নিজেই নিজের ভয়াবহতা বুঝতে পারছে। আবার ভয়াবহতার ওপর কাবুও রয়েছে। অর্থাৎ তার নিজ নিয়ন্ত্রিত একাধিক মানসিকতা তার ভেতরে জায়গা পেয়েছে।

অন্তূ চট করে নিজেকে শান্ত করে তুলেছে। এখন দেখে মনে হচ্ছে, কিছু ভাবছে। চুপচাপ হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে মেঝের দিকে চেয়ে আছে। হাঁটুসহ পুরো শরীর দুলছে রকিং চেয়ারের মতো।

তার ঘুম পাচ্ছে খুব। ঘোর লেগে আসছে। ক্ষুধা লাগেনি, তবে অল্প পানি পিপাসা পেয়েছিল। ডাক্তার চলে গেলেন। ঘর ফাঁকা হয়ে এলো। অন্তূ টের পেল, আব্বু এসে পাশে বসেছে। অন্তূ হেসে জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছো, স্বার্থপর আব্বু?ʼʼ

আমজাদ সাহেব মৃদু হাসলেন, “আমি ভালো আছি। তোকেও ভালো থাকতে হবে। কিছু খাসনি কেন?ʼʼ মৃদু ধমক দিলেন আমজাদ সাহেব।

অন্তূ ফুপুকে ডেকে বলে, “আমার জন্য খাবার নিয়ে আসুন তো। আর পানি আনবেন বেশি করে, গলা শুকিয়ে আসছে খুব।ʼʼ আব্বুর উদ্দেশ্যে হাসল, “এবার খুশি?ʼʼ

আমজাদ সাহেব জবাব দেন না। চুপচাপ বসে থাকেন অন্তূর পাশে। অন্তূ গপাগপ খেলো অনেকটা খাবার। বমি হবে বোঝা যাচ্ছে। তবু খেলো। খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল আব্বুকে, “আমি কি পাগল হয়ে গেছি, আব্বু?ʼʼ

আমজাদ সাহেব মাথা নাড়েন, “উহু। তুই কূটিল হয়ে গেছিস। আর এই কূটিলতা তোকে অনেক কিছু দেবে। বুঝলি অন্তূ, গন্তব্যে পৌঁছাতে অত স্বাভাবিক আর সরল থাকা নয়, বরং নিগূঢ় পাগল আর জটিল হতে হয়।ʼʼ

প্রথম কথাটা আব্বুর মতো লাগল না। আব্বু এরকম কথা বলতো না, অন্তূ বলে এমন কথা। তবে শেষের কথাটা আব্বুর হতে পারে।

অন্তূ খাবারের লোকমা মুখে তুলে আব্বুর দিকে তাকায়। আব্বু বসে আছে তার পাশেই দেয়াল ঘেঁষে। অন্তূ টের পায়, তার আর যন্ত্রণা হচ্ছে না বুকে। একটুও কষ্ট লাগছে না। একদম স্বাভাবিক, সুখী লাগছে নিজেকে। হ্যাঁ, অবশ্য একটু অস্বাভাবিক লাগছে সবটা। চারপাশটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। অদ্ভুত!

চলবে..

[রিচেইক করিনি। হিউজ ভুল থাকতে পারে। ক্ষমা করবেন।]

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

২৯.

লতিফের কেবিন নং-৪। জ্ঞান ফেরার পর সে বিশেষ কোনো কথা বলেনি। আসমাও জিজ্ঞেস করেনি কিছু। কেবল সে মনে মনে তৈরি মাজহারের বিরুদ্ধে একটা বিহিত করতে।

রাত আটটার দিকে মাঝারি উচ্চতার এক লোক ঢুকল কেবিনে। ডান হাতে তার আর্ম স্লিং বাঁধানো।

-“ভালো আছেন, ভাবী? আমি মাজহার আলমগীর। লতিফ ভাই কেমন আছে এখন?ʼʼ

লতিফ কথা বলার চেষ্টা করল। মাজহার নিজেও খুব সহজ মুখে কথা বলে সবসময়। আসমা সিঁটিয়ে বসে রইল। এই মাজহারই তার স্বামীর এই হাল করেছে। মাজহার একটা চেয়ারে বসে লতিফকে বলল, “কী দল করতেন এতদিন, এবার কি বুঝতে পারছেন কিছু? ওই দুই শুয়োরের বাচ্চা মানুষের বাচ্চাই না।ʼʼ

আসমা বুঝতে পারছিল না কিছু। মাজহার ফের বলে, “আপনি এই অবস্থায় আমার বহুত কাজে আসতে পারেন। জয়কে ধরার একটা সূবর্ণ সুযোগ আপনার এই অবস্থা। পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিতে হবে কিন্তু আপনার! পাটোয়ারী বাড়িকে ফোকলা না করা অবধি মরণ নেই আমার। জিন্দা হয়ে ফিরে আসছিই একমাত্র ওই বাড়ির তিন ব্যাটার কবর খুঁড়বো বলে। আব্বা আসতে চাইছিল, পরে-টরে এসে দেখে যাবে। আপনার কোনো খরচা-পাতি দরকার?ʼʼ

লতিফ মাথা নাড়ল মৃদু। মাজহার আশ্বাস দেয়, “তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবেন আপনি। আমি একটা কেইস ফাইল করে দিই। আর আমার হিসেব আমি পুলিশ দিয়ে না, নিজে মেটাবো। তবে একটু সময় নেব।ʼʼ

চোখের ইশারায় জানতে চায় লতিফ, “দেরি কেন?ʼʼ

-“কিছু হিসেবে বাকি আছে, এখনই দুইজনকে উড়ানো যাচ্ছে না, মাঝখানে পলাশ ভাই দাঁড়ায়ে আছে। পলাশ ভাই ধৈর্য্য ধরতে বলতেছে। সে কী চাচ্ছে, বা কারণ কী বুঝতেছি না। কিন্তু কিছু করারও নেই তার ওপর দিয়ে। আর হারামজাদা দুইটা আরও খানিক সময় পাবে আমার কাছে। অথচ লতিফ ভাই, যতদিন আমার রক্তের বদলা আমি না তুলব ওদের থেকে আজরাইলও আমায় মারতে পারবে না।ʼʼ
মাজহার আরও কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যায়। আসমার মনে হলো, মাজহার ছেলেটা খুব বদমেজাজী আর বোকা। কিন্তু এতক্ষণের কথায় সে যা বুঝেছে, তা বিশ্বাসই হচ্ছিল না। সংশয় কাটাতে স্বামীকে জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে আসলে মারছে কে?ʼʼ


ক্লাবের ছাদ থেকে পলাশের শহরের ভেতরের নাইটক্লাবের বিল্ডিংটা দেখা যায়। রঙ বেরঙের আলো জ্বলছে বিল্ডিংয়ের গা বেয়ে।

হামজা এসে দাঁড়াল পাশে। কাচের বাটি ভর্তি করে কাঠবাদাম, পেস্তা ও কাজু নিয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে জয়। কাজু বাদাম খেলে গা চুলকায়, এলার্জি আছে তার। তবু খাওয়া বাদ দেওয়া যাবে না। এক মুঠো ভরে নিয়ে মুখে পুড়ল। হামজা এসে দাঁড়ানোর পরেও কোনো কথা বলল না, চোখও ফেরালো না।

হামজা নীরবতা ভেঙে বলল, “নারীর চোখের পানি অম্লের মতো। তা জারে সাজিয়ে রাখলে ঠিক আছে, তাতে বেশি মনোযোগ দিয়ে কাছে টানলে ক্ষয় হয়ে ঝলসে যাবি।ʼʼ

ওয়াহ ওয়াহ! কবি কবি মেজাজ, কবির নেই তো লজ্জা লাজ! আমার কবিতাডা কেমন হইলো কও!

হামজা হাসল, কথার লাইন কাটছিস।

-“তাই নাকি? তাইলে তো বড় দুর্দিন চলে আসছে আমার, হ্যাঁ? আইজকাল মাগী মাইনষের চোখের জলে ডুবে ডুবে মরে যাচ্ছি? মেজাজ খারাপ করা কথা না বলে বাড়ি যাও।ʼʼ

-“তাকা তো আমার দিকে।ʼʼ

জয় তাকাল, হেসেও ফেলল হো হো করে। জয়ের অট্টহাসির আওয়াজটা খুব অদ্ভুতুরে শোনায়। হেসে বলল, “কী বোঝাইতে চাচ্ছ?ʼʼ

-“ঘায়েল হলে পুরুষ মাতাল হয় আর নারী কুচক্রী। নারীর কুচক্র অম্লের চেয়েও বেশি ক্ষয়সাধক।ʼʼ

জয় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, “জয়কে ক্ষয়ও করা যায়? জেনে ভাল্লাগলো। এমন ভাবনা ভাবার ক্ষেত্রে অধঃপতনটা তোমার নাকি আমার?ʼʼ

-“যেহেতু আমি সঠিক ভাবছি, তাই অধঃপতনটা তোর।ʼʼ

মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়ায় জয়, “হামজা ভাই জিন্দাবাদ!ʼʼ

-“জয়, তুই যদি মাটির তৈরি ফুলদানী হোস, তো সেই মাটি দিয়েছে জমিন অর্থাৎ তোর বাপ। কিন্তু সেই মাটি পিটিয়ে হাতের দক্ষতায় সাজিয়েছি কিন্তু আমি তোকে। তোর চেয়ে তোকে ভালো জানা মানুষটা আমি। আমার লেখা বই তুই।ʼʼ

দুটো কাজুবাদাম মুখে তুলে নেয় জয়, আওয়াজহীন হাসে, “তোমার লেখা বই? তা হোক বা না হোক, শয়তানী কালামের বই আমি। যার প্রতিটা মন্ত্র প্রয়োগ করো নিজের স্বার্থে।ʼʼ

-“এ আর পুরোনো কথা কী? আমি স্বার্থপর, এ কথা পূর্বদিকে সূর্য ওঠার মতোই চিরন্তন সত্য।ʼʼ

জয় কাজু বাদাম চিবোচ্ছে। খানিক চুপ থেকে হাসে হামজা, “মাঝেমধ্যেই অভিযোগ হয় তোর আমার ওপর, তাই না?ʼʼ

-“অভিযোগ? ওসব সস্তা লোকেদের হয়। আমি হাইফাই, ভিআইপি মানুষ, ওসব ছোটলোকি ব্যাপার আমার হয় না। তবে হওয়া উচিত। তুমি ভালোবাসো না আমায়। সব ভণ্ডামি। তবে হয়না কেন জানো, কারণ আমি ভালোবাসার মতো লস প্রজেক্ট টাইপ অনুভূতির আশা রাখিনা কারও কাছে। অদ্ভুত এক সম্পর্ক, বর্ণনা করা যায়না তোমার-আমার প্যাঁচ। না আমি তোমায় ভালোবাসি না তুমি আমায়। তবুও দূরত্ব সঁয়না, জটিল কেইস। ঠিক বলিনি?ʼʼ হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙে জয়।

হামজা গা ঘেঁষে দাঁড়ায় জয়ের, জয়ের জ্যাকেটের চেইন খোলা ছিল। তা লাগিয়ে দিয়ে বলল, “ঠান্ডা লাগেনা তোর? ধাক্কা মেরে ফেলে দিই ছাদ থেকে।ʼʼ

-“এক শর্তে ধাক্কা মারার অনুমতি দিতে পারি।ʼʼ

হামজা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। জয় আবদার করার মতো নাটক করে বলে, “আমার জন্য একটা ফাইভ-স্টার কবরের ব্যবস্থা করতে হবে।ʼʼ

হামজা হেসে ফেলল। এরপর অনেকক্ষণ নীরবতা। হামজা টের পায়, জয় অস্থির, অশান্ত। বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা ভেঙে বলে, “তোর জন্য আমার অনুভূতি শূন্যের মতো, জয়। সংখ্যার আগে বসাবি তো ওটা মূল্যহীন লাগবে, যেটাকে তুই আমার প্রশ্রয় বলিস। কিন্তু সংখ্যার পরে বসালে দেখবি, সমান্তরাল হারে সংখ্যার মান বাড়ছে। একক থেকে দশক, শতক, হাজার, অযুত… ওটা ভালোবাসা কিনা জানি না, তুই যা ধরে নিবি তাই।ʼʼ

জয় কিছু গাল থেকে উগরে দেবার মতো হেসে ওঠে, “এসব কাব্যিক কথা রাখো। ভালোবাসা আবেগী অনুভূতি, আবেগের সাথে জয়ের কোনো আপোষ নেই। মেয়েলোক চাহিদার সামগ্রী আমার কাছে, নাথিং ইলস।ʼʼ

জয়ের কথা কানে গেল না যেন, আচমকা স্বর বদলে গেল হামজার, “তোর চোখে আফসোস দেখার অভ্যাস নেই আমার। পাপ করে এসে সেই পাপের খেয়ালে ডুবে থাকতে দেখার অভ্যাস নেই, তা শেখাইনি আমি। পাপ যেখানে হয়েছে, সেখানেই রয়ে গেছে, তুই ফিরে এসেছিস। তা সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে শেখাইনি। জয়, আমি ছাড়া অন্য কিছু তোর অস্থিরতার কারণ হয় তা সহ্য করতে পারি না আমি।ʼʼ

হাতের কাজু বাদাম দুটো হাতে ধরে জয় তাকিয়ে থাকে হামজার দিকে।

-“তোকে গড়েছি আমি। খারাপ হোক ভালো হোক, একটু একটু করে গড়ে তুলেছি তোকে। সেই তোর ভাঙনের কারণ অন্যকিছু হলে তা বরদাস্ত করতে পারব না আমি। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে জান দেয়, কেড়ে নেয়ার মালিক সে। তোকে গড়েছি আমি, ভাঙার হলে, আঘাত করার হলে তা করব শুধুই আমি। তোর ওপর আঘাতের অধিকার শুধু আমার, আমার। বিয়ে দিয়েছি, বউকে ভালোবাসবি, চলবে। কিন্তু আমি ছাড়া কোনো ভাঙন তোর চোখে দেখা গেলে দুনিয়াটা জ্বালিয়ে দেব, কসম।ʼʼ

জয় কাজুবাদাম দুটো গালে পুরে গলা জড়িয়ে ধরল হামজার, “তুমি তো দেখতেছি মহিলা মাইনষের চেয়েও বেশি হিংসুটে! রাশিগত সমস্যা আছে নাকি? কন্যারাশি? আমার কিচ্ছু হয় নাই। খালি শান্তির অভাব। একটা গান গাই? ওরে শান্তি কেন নাই রে দুনিয়ায়..ʼʼ

-“সান্ত্বণা আশা করছিস আমার কাছে?ʼʼ

-“করতেছি না। যা তুমি দেবে না, সেই আশা করব ক্যান? আরে বাপ, কিছুই হয় নাই আমার। মেয়ে মাইনষের মামলা বোঝোই তো। আগুন জ্বলতেছে বুকে, আগুন নেভানো দরকার। হোটেলে যাই চলো, একটু সুখ দরকার। আমি গরম হয়ে আছি খুব, ঠান্ডা হলেই সব ওকে। ওহ, তোমার তো ঘরে বউ আছে, তুমি ক্যান যাবা? আমরা বাল বিয়াইত্তা ব্যাচেলর পাবলিক… ʼʼ

হামজা বিরক্ত হয়, “মিথ্যা হাসি সবার ঠোঁটে মানায় না। বিশেষ করে তোর ঠোঁটে পাপের হাসি আর নিষ্পাপ হাসি ছাড়া হাসিই মানায় না। হাসিস না, বিরক্ত লাগছে। কিছুক্ষণ আনমনে দাঁড়িয়ে থাক, দুঃখগুলো ক্লান্ত হয়ে গেলে চলে যাবে। আমি আসছি।ʼʼ

জয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সম্পর্কে সবসময় খাঁটি অনুভূতি প্রয়োজনীয় না, সম্পর্কে সততা দরকার, একমাত্র সততা। তার আর হামজার সম্পর্কের বিশেষত্বই এটা। দুজনের কাছে দুজনের কোনো কপটতা নেই। যা মনে তাই মুখে। বানোয়াট কিছু দেখানোর চেষ্টা নেই, এখানেই দুজন অবিচ্ছেদ্য। জয় চেয়ে থাকে অন্ধকার আকাশের দিকে। হামজা খুব হিংসুটে একটা ব্যাপারে। জয়ের কোনো ক্ষতি হামজার ওয়াস্তে হলে ঠিক আছে, কিন্তু অন্যকিছুর জন্য নয়। কারণ, হামজা মানে জয়ের দুঃখের অধিকার শুধু তার, সুখের অধিকার যে কারো হতেই পারে।

মদের বোতল এনে রাখে হামজা টেবিলের ওপর। অলস ভঙ্গিতে চেয়ারে বসতে বসতে বলে, “পাপীদের ধ্বংস কোথায় জানিস?ʼʼ

-“জানা দরকার।ʼʼ

-“এক পাপের পর, পরবর্তী পাপের আগে কিছুটা সময় নেয়ায়। মানুষের ভেতরে আবার বিবেক নামক এক চুলকানি আছে। পাপ করে কিছুটা সময় দিলেই ওই শালা কুরকুর করে ওঠে। আর সেখান থেকেই এক ক্রমশ বর্ধনশীল ছিদ্র তৈরি হয়— ধ্বংসের ছিদ্র। এজন্য বুদ্ধিমান পাপীরা থামে না, একাধারে অবিরত পাপ করে যায়, বিকেককে কুরকুর করে ওঠার সময় দেয় না।ʼʼ

জয় হাসল, “আমি পাপের মাত্রা কমিয়ে এনেছি, তাই তো? বিবেকানন্দ নাচছে ভেতরে।ʼʼ

-“বিবেকানন্দ ভালো লোক ছিল, বিবেকের মতোই ভালো। বস। বহুদিন পর তোর নামে জাস্ট এক প্যাগ মারব। তোর ভাবী কিছু বললে তোর দোষ।ʼʼ

-“ভাবীর অবস্থা কী? সে কি ঠিকঠাক হয়েছে?ʼʼ জয় বসে চেয়ারে।

হামজা চোখ খিঁচে এক ঢোক গিলে বলে, “মেয়ে মানুষ তৈরির মাটিতে সৃষ্টিকর্তা সামান্য পরিমাণ বিষ মিশিয়ে দেয়। যেটা সাধারণত মায়া হয়ে রয়ে যায় মেয়েলোকের মাঝে। কিন্তু কোনো আঘাত পেলেই সেই মায়া বিষ হিসেবে প্রকট হয়। এজন্যই ওই জাতের থেকে সাবধানের মার নেই। গলা জ্বলছে আজ।ʼʼ

-“রেকর্ডার অন থাকলে ভাবীর জন্য একটা স্পেশাল গিফট তৈরি হতো।ʼʼ

-“অন করিসনি কেন? আমার সব কথা জরুরী। সবগুলো বিশ্ব-সংবাদ হবার যোগ্য।ʼʼ

জয় হো হো করে হেসে ওঠে, “তোমার কি চড়ে গেছে?ʼʼ

-“আমার চড়েনি, তবে আর একবার এমন পেট বানানো বাটপারি হাসি হাসলে কান সারার নিচে এমন একটা মারব, তোর চড়ে যাবে। হাসি যখন আসছে না, মাথা ভার লাগছে, মন মতো গিলে গিয়ে ঘুমা। নাটক করছিস কেন?

জয় ঠোঁটে আঙুল চাপল, “ওকখে। চুপ করলাম। হাসি পেলে অনুমতি নিয়ে হাসব। সরি সরি।ʼʼ

-“কাল রাতে মাজহার গেছিল লতিফের কাছে। আগামীকাল তোকেও একবার সাক্ষাৎ করে আসতে হবে। এরপর তোকে ট্যুরে পাঠাব কয়েকদিনের। ট্যুর থেকে ফিরলে বউ এনে দেব। ঢাকা যাবি?ʼʼ

জয় নিঃশব্দে হাসল। জয়ের মতো আজগুবি কথা বলার চেষ্টা করছে হামজা। আর জয় উল্টো চুপচাপ আজ। হামজা গ্লাস শেষ করে নিজস্ব ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে নির্মল হাসল, “আমি তোর শিক্ষক নই, জয়। শিক্ষকের মনে থাকে ক্ষমা আর হাতে থাকে দণ্ড। আমার মনে তোর জন্য ক্ষমার ভাণ্ডার থাকলেও হাতে কোনোদিন দণ্ড উঠাইনি। কারণ আমি শিক্ষক নই, তোর কারিগর। আর গড়ে তুলতে শুধু যত্নের প্রয়োজন হয়, প্রশ্রয় দিতে হয়। ভালোবাসা আমার কর্ম নয়। আমি তোকে ভালো-টালো বাসি না।ʼʼ

-“বাসা লাগবে না। ওসব আমার পোষায় না। চলো গান ধরি।ʼʼ জয় উদাস চোখে আকাশের দিকে মুখ তুলে গেয়ে ওঠে,

ইট গামলায় ইট বানাইয়া, চৌদিকে ভাটা সাজাইয়া
মাঝখানে আগুন জ্বালাইয়া দিলো গো…
ভিতরে পুড়িয়া সারা, মাটি হইয়া যায় অঙ্গারা
এখন আমি কী করি উপায়…

সাতদিন পর শুক্রবার বাদ জুম’আ মসজিদে কিছু মিলাদ ও দান-সদকা, দোয়া করা হলো। ততদিন অন্তূর চাচা-ফুপুরা ছিলেন দিনাজপুরে।

শনিবার সকাল সকাল উনারা তৈরি হলেন ফিরে যাবার জন্য। অন্তিকটা কেমন মৃতপ্রায় হয়ে উঠেছে। সে সাতদিনে দু তিনবেলা খাবার খেয়েছে। সেটাও উল্লেখযোগ্য হারে সামান্য। মার্জিয়া ধমকে, জোরপূর্বক খাইয়েছে। সে চাচাদের জন্য গাড়ি ডাকতে গেল বাসস্ট্যান্ড অবধি পৌঁছে দেবার।

আফজাল সাহেব অন্তূকে ডেকে কাছে বসালেন। অন্তূর হাড্ডিসার দেহটা পোশাকের নিচেও লুকোনো যায় না। একটা কালো ওড়না শরীর ও মাথায় জড়িয়ে অল্প একটু জায়গা নিয়ে সোফায় বসে রইল।

চাচা বললেন, “আইজ কয়দিনে তো ম্যালা পাওনাদারের যাওয়া-আসা দেখলাম। বিষয়টা খারাপ লাগছে আমার, বুঝছো? ভাই তো আর নাই। তুমি আর অন্তিক এক সময় আসো কুড়িগ্রাম সময় করে। জমিজমা বিক্রির আর দরকার নাই। ও আমার খামার যেমনে চলতেছে চলুক। পাওনাদারের টাকা মিটমাট করে দিবানি আমি। ভাইয়ের দেনা শোধ না করে যাব কই?ʼʼ

অন্তূ সামান্য হাসল, “তার প্রয়োজন হবে না, কাকা।ʼʼ

-“ক্যান? এই কথা ক্যান?ʼʼ

অন্তূ কথা শেষ করতে চাইছিল পাশ কাটিয়ে। মাথার চাঁদিতে তীক্ষ্ণ এক চিনচিনে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে। তা খুব শীঘ্রই মারাত্মক পর্যায়ে যাবে।

সে তাকাল চাচার দিকে, “আপনি যা বলছেন, তা শুনতে দয়া করার মতো লাগছে, কাকা। আমার ধারণা আপনি সেটাই করতে চাইছেন। যেটা গ্রহন করতে শেখানো হয়নি আমাকে।ʼʼ

-“কথা বেশি শিখছিস? পাকনা মাইয়া এক থাপ্পরে দাঁত ফালায়া দিমু। বেলেহাজ মেয়েলোক। কাকার সামনে কেমনে কথা কইতে শিখাইছে তর বাপে ওইডা আগে শুনি।ʼʼ

অন্তূ আর কথা বলল না। হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে রইল মনোযোগ সহকারে। তার নির্লিপ্ততায় ধৈর্যহীন হলেন আফজাল সাহেব, “কথা ক। কী চাস?ʼʼ

-“ওই জমি আপনার কাছ থেকে হাসিল করার পেছনে দৌঁড়ে ভালো পেরেশানি গেছে, আব্বুর! পাওনাদারদের এতদিন যখন ঠেকাতে পেরেছি, আর ক’টা দিন সবুর করে নেবে ওরা। আমি ওই জমি হাসিল করে তা বিক্রি করেই বরং পাওনা মেটাবো। আবার আসবেন, কাকা! বাইরে গাড়ি এসে গেছে বোধহয় আপনাদের।ʼʼ

আফজাল সাহেব অপমানে ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, “বাপরে কথা! সাহস ভালোই তর। ওই চেংরি! আমি না দিলে কেমনে হাসিল করবা জমি? কিচ্ছু তো আর নাই, তবুও দেমাগ কমে নাই? ভালো বুইঝা পাওনা টাহা দিতে চাইলাম, আবার দেমাগ দেহাও? আমি দেখমুনে কেমনে আমার থেইকা জমি আদায় করো, আর পাওনা মিটাও। হ দেখুমনে আমি।ʼʼ

অন্তূ মুচকি হাসল, “আপনি সে চিন্তা কোরে চাপ নেবেন না, কাকা। বয়স হয়েছে। এ বয়সে উত্তেজিত হওয়া উচিত না। সে-সব আমার জিম্মা, ইনশাআল্লাহ সামলে নেব। আপনার গাড়ি এসে গেছে। আবার আসবেন। আল্লাহ হাফেজ।ʼʼ

অন্তূ বসে থাকে ওভাবেই। বাড়ি ফাঁকা হতেই রাবেয়া কাঁদতে শুরু করলেন। অন্তূর মাথার ব্যথাটা চিটমিটিয়ে উঠল। অন্তূ ধমকে উঠল, “কান্না থামাও। জোয়ার নেমেছে চোখে? কান্নার জন্য বিশেষ পরিস্থিতির দরকার হয়। লোকের আর স্বামী মরে না? তারা আজীবন কাঁদে? কাঁদলে আড়ালে কাঁদবে, খেয়াল রাখবে কান্নার করুণ সুর যেন আমার কান অবধি না পৌঁছায়। অসহায়ত্ব ও চোখের পানিকে ঘৃণা করি আমি।ʼʼ

অন্তূ চেয়ারটার ওপর মাথা এলিয়ে দিয়ে চেয়ে থাকে ছাঁদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে। মার্জিয়া এসে বসে। অন্তূ ওভাবেই জিজ্ঞেস করে, “শরীর ভালো আপনার?ʼʼ

-“অন্তূ……ʼʼ

মার্জিয়ার ক্ষমাপ্রার্থী সুরের ডাকটা অন্তূর কানে পৌঁছাতেই ছাদ থেকে চোখ সরিয়ে সোজা হয়ে বসে, হাত উঁচিয়ে ধরে মার্জিয়ার উদ্দেশ্যে। থেমে যায় মার্জিয়া।

অন্তূ স্থির নজরে তাকিয়ে বলে, “আমি বাংলা সিনেমার মমতাময়ী নায়িকা নই, ভাবী। পুরো সিনেমাতে যে যা-ই করুক, শেষে সব মাফ করে বুকে জড়িয়ে নেয়া, তারপর খালি ভালোবাসা আর প্রেম। আমি ছাড়িও না ধরিও না।ʼʼ

শোনো অন্তূ!

-“একটা কথা বলব ভাবী?ʼʼ

-“হু!ʼʼ

অন্তূ শূন্যে দৃষ্টি মেলে উদাস স্বরে বলল, “যাকে জীবিত অবস্থায় দেখেনি মৃত্যুর পর তাকে দেখতে হায় হায় করতে করতে ছুটে যাওয়ার বিষয়টা মানুষের ভেতরে থাকা আবেগের সবচেয়ে ময়লা দিকের একটা। মৃতদেহ একটা ঘরের আসবাবের চেয়েও মূল্যহীন জড়, তা দেখাতে ফজিলত কী? আব্বু আজও যদি এই সোফায় এসে বসতো, আপনি এখানে এসে দাঁড়াতেন না আব্বুর সামনে।ʼʼ

মার্জিয়া কেঁদে ফেলল।

অন্তূ কপাল চেপে ধরে বড়ই অনীহার সাথে বলল, “আপনি কেন কী করেছেন তার বিচারে যাবার রুচি নেই আমার আপাতত। কিন্তু আমার আব্বু অবহেলিত হবার মতো মানুষ না। কিন্তু আপনি তার একমাত্র ছেলের স্ত্রী হিসেবে তাকে একবার ‘আব্বা’ বলে ডাকেননি। তার নাতিকে গর্ভে ধরেছেন, সামনে গিয়ে সেই খবরটা দেননি। কিন্তু তিনি খেলনা কিনে এনে আম্মুর আলমারীতে রেখেছে।ʼʼ

অন্তূ আলগোছে উঠে চলে যেতে যেতে বলল, “পরবর্তিতেও অন্তত আব্বুকে নিয়ে কোনো শব্দ যেন আপনার মুখে উচ্চারিত না হয়, অন্তত আমার সামনে।ʼʼ

পড়াটা হচ্ছিল না। আব্বু এসে বিছানায় বসে অন্তূর খাতাপত্র নেড়েচেড়ে দেখে বলছে না, “লেখা তো ডাক্তারদের মতোন হয়েছে, অথচ হবি উকিল। কাহিনি কী?ʼʼ
রাত বারোটা বাজছে। অন্তূ ছটফটিয়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আব্বু এসে পাশে দাঁড়ায় অন্ধকারে দাঁড়ালে। আগামীকাল সকালে তার পরীক্ষা। আব্বুকে ছাড়া সে প্রথমবার পরীক্ষা দিতে পারবে। অন্তূ রুমে এসে ঘুমের ওষুধ খুঁজল। নেই। অন্তিক সরিয়ে নিয়েছে। আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।

অন্তিক এসে পাশে দাঁড়ায়। বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কাটার পর অন্তূ বলে, “তোর বউ-বাচ্চার পরিবারে আম্মাকে শামিল করে নে। আর পরিবার চালাতে একটা কাজের ব্যবস্থা কর। টাকা-পয়সা যা লাগবে, ব্যবস্থা করা যাবে।ʼʼ

অন্তিক হাসে, “খুব গৃহিনী হয়ে গেছিস? কখনও জিজ্ঞেস করিসনি আমাকে কিছুই আমার ব্যাপারে।ʼʼ

-“রুচি নেই রে।ʼʼ

-“ভালোই। আচ্ছা, আম্মার ব্যবস্থা হলো, আর তোর? তোর কী?ʼʼ

-“আমার কী? আমার বড়লোকের ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে। আমি ফিট থাকব। এ আর কী!ʼʼ

অন্তিক চুপ রইল। অন্তূ হঠাৎ-ই জিজ্ঞেস করে, “পলাশ আজগরের কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছিলি?ʼʼ

-“পাঁচলক্ষ।ʼʼ

-“মার্জিয়া তোকে স্টিমেটলি গহনা দিয়েছিল কত টাকার?ʼʼ

-“দুই লাখ টাকার মতো।ʼʼ

-“এছাড়াও কিছু আছে। বলছিস না।ʼʼ

-“তুই শুনতে চাইছিস না।ʼʼ

-“হ্যাঁ। চাওয়াটা অপ্রয়োজনীয়। আর হারানোর কিছু নেই। হারানোর থলি ভরপুর। এখন কারণ জানাটা সময়ের অপচয় আর শব্দ দূষণ হবে।ʼʼ

-“শব্দ দূষণ?ʼʼ

-“হ্যাঁ। তুই বলবি, সেই আওয়াজ আমার কানে যাবে। যা সময়মতো আসেনি, যখন তোর বলার ছিল।ʼʼ

-“বলার মতো উপযুক্ত সময় ছিল না। তাই অনেককিছু হয়ে গেছে।ʼʼ

-“এখনও এমন কিছু ঘটেনি যে বলার উপযুক্ত সময় এসেছে। বাদ। কিছুই হয়নি।ʼʼ

-“ভুল বুঝতেছিস।ʼʼ

-“আচ্ছা, বুঝতে দে। তো তোকে পলাশ আজগর দুই লাখ টাকার গহনার বদলে পাঁচ লক্ষ টাকা দিলো?ʼʼ

অন্তূ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, “শিক্ষা মানুষের মূর্খতা দূর করতে পারে হয়ত, তবে বোকাদের তো কোনো চিকিৎসা নেই। মহাজনদের কাছে যা বন্ধক রাখা হয়, তার মোট মূল্যের ততটুকু তারা মানুষের হাতে দেয়, যতটুকু বাদ দিয়ে মূলটাকা এবং সুদসহ তাদের হাতে থেকে যায়। যাতে সময়মতো টাকা পরিশোধ না করলেও জিনিসের মূল্য মূলটাকা ও সুদের যোগফলের সমান হয়। সেখানে পলাশের মতো একজন নরকের কীট তোর কাছ থেকে দুই লক্ষ টাকার জিনিস রেখে পাঁচলক্ষ টাকা ধরিয়ে দিলো, তুই তা নিয়ে ব্যবসা শুরু করলি, সাহস বটে…. উমম দুঃসাহস বলা চলে।ʼʼ

অন্তিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, জবাব দিলো না। অন্তূ বলে, “জিদ আর পলাশ তোর দোকান খেয়েছে, বাপটাকে খেয়েছে, বোনের ইজ্জত খেয়েছে। আফসোস, অন্তিক তোকে খেয়ে ফেলেনি। পলাশ তোকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেললে আব্বু বেঁচে যেত, আমি বেঁচে থাকতাম, পরিবার বেঁচে যেত।ʼʼ
অন্তিক অদ্ভুতভাবে হাসে, “তুই নিষ্ঠুর হয়ে গেছিস, আব্বুর চেয়েও বেশি।ʼʼ

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। বরাবরের মতো আজও রিচেইক করার সময় পাইনি।]

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৩০.

শনিবার দিবাগত রাত। প্রায় আড়াইটা বাজছে। লতিফকে ব্যথার ওষুধ খাওয়ানোর ফলে শুয়ে পড়েছিল। আসমা বসে ঝিমোচ্ছে। তার মেয়ে জ্বালাতন করছে, শুতে পারা যাচ্ছে না। পুঁচকে সন্ধ্যার পর ঘুমিয়ে রাতে জাগে।

কেবিনের দরজায় ধাক্কা পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগে দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা আঁটকে দিলো জয়।

আসমার আতঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে জয় নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাসল, লাইট জ্বালান, ভাবী। বেশি অন্ধকারে থাকলে চোখ নষ্ট হয়। আল চেঁচাবেন না যেন ভুলেও, তাতে শব্দদূষণ হয়।ʼʼ

মহিলা ভয়ে জুবুথুবু হয়ে বলে, “ক্যান আসছেন?ʼʼ

জয় দু’পাশে মাথা নাড়ল, “লাইট জ্বালান।ʼʼ

লতিফের ঘুম ভাঙল। ভয়ে শীতের রাতে ঘাম ছুটেছে বেচারার শরীরে।

জয় কোমড় থেকে পিস্তল বের করে ম্যাগাজিন খুলে বুলেট চেইক করতে করতে বলল, “শরীর ভালো, লতিফ ভাই?ʼʼ

লতিফ উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না।

জয় পিস্তল লোড করে তাকাল, “বিশ্বাসঘাতকদের বাঁচিয়ে রাখতে নেই, লতিফ ভাই। সব নীতিতেই তাই। তবে বিশেষত রাজনীতিতে বিশ্বাসঘাতকতা শুকনো খড়িতে দাউদাউ করে জ্বলা আগুনের মতো। আজ আমাদের সাথে গাদ্দারি করেছেন, কাল মাজহারের সাথে করবেন। আপনাকে মেরে ফেলা উচিত। আপনি যে-কারো জন্যই ক্ষতিকর। এখন যেহেতু মাজহারের হয়ে কাজ করছেন, কয়দিন পর আপনার ছোবল মাজহারও খাবে। তোহ….আজ শত্রুপক্ষের একটা উপকার করব। সবার ভালোর জন্যই মারব আমি আপনাকে, মাইন্ড কইরেন না।ʼʼ

লতিফ কিছু বলতে চাইছিল। জয় হাত নেড়ে থামায়, “শুনেছি, ফেরাউন মৃত্যুর দূতকে সামনে দেখে তওবা করেছিল, আপনাদের আল্লাহ কিন্তু ওর তওবা কবুল করেন নাই। মৃত্যুকে সামনে রেখে গুনাহ কবুল করলে সেই গুনাহগার ক্ষমা পায় না, লতিফ ভাই।ʼʼ

লতিফ অবাক হয়। এই জলদগম্ভীর জয়কে সে দেখেনি। জয় চঞ্চল, বদমাশ, সবসময় তার চোখে-মুখে ফুটে থাকে এক বিদঘুটে রসিকতা ভরা শয়তানী হাসি। যার কথার উচ্চারণ অশুদ্ধ, মূর্খতায় পূর্ণ। আজ জয়কে লাগছে উচ্চ শিক্ষিত মৃ-ত্যুদূত। এই জয় বরফশীতল পিণ্ড।

পিস্তল তাক কোরে ধরল জয়। আসমা এক কোণে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে জাপটে ধরে কাঁপছে। জয় জিজ্ঞেস করল, “ছেড়ে দেবার কথা ছাড়া আর কিছু বলতে চান, ভাবী? সংক্ষেপে শেষ করুন।ʼʼ

জয়ের নিষেধ করা কথাটাই বলে আসমা, “ছেড়ে দ্যান। ক্যান মারতেছেন? ছেড়ে দ্যান…ʼʼ

জয় সঙ্গে দাঁতে দাঁত চেপে, এক চোখ বুজে ট্রিগার প্রেস করে। ঠিক যেমন কিশোরেরা বন্দুক হাতে পাখি তাক করে রাবার বুলেট ছোঁড়ে, ভীষণ মজা ফুটে ওঠে মুখে। ক্যাচছ করে একটা আওয়াজ বেরোয়। আসমা খিঁচে চোখ বুজে ফেলে। ছোট্ট মেয়েটা ডুকরে কেঁদে ওঠে।

গুলিটা বালিশ ফুঁড়ে ঢুকে যায় লতিফের মাথা থেকে এক ইঞ্চি ফাঁকে। নিখুঁত নিশানা। লতিফের শ্বাস ছুটছে। জয় বাচ্চা মেয়েটাকে কাছে ডাকে বাচ্চাটা আসতে চায় না। জয় হাসে, হাসিটা আসমার কাছে ভয়ানক লাগে। কিন্তু বাচ্চাটা কেন জানি এগিয়ে যায়। জয় মেয়েটার ঝুঁটিতে হাত নেড়ে জিজ্ঞেস করে, “চলো, তুমি বলো। তোমার আব্বুর ওপর গুলি চালাবো, না ছেড়ে দেব? তুমি যা বলবে তাই করব। ভেবেচিন্তে বলবে কিন্তু।ʼʼ

-“গুলি তালালে কী হবে?ʼʼ

জয় হাসল, “গুলি চালানোর পর, তুমি তোমার আব্বুকে হাজার ডাকলেও সে আর উত্তর দেবে না তোমার ডাকের। কিন্তু একটা মজার ঘটনা দেখতে পাবে তুমি। আমার হাতের এই পিস্তল থেকে একটা বুলেট ছুটে গিয়ে তোমার আব্বুর ঠিক কপাল বরাবর বিঁধবে। খুব চমৎকার একটা দৃশ্য, আমি ট্রিগার দাবাতেই শাঁআআ করে একটা বুলেট ছুটে যাবে তোমার আব্বুর দিকে। দারুণ মজা লাগবে তোমার দেখতে বিষয়টা।ʼʼ

মেয়েটা জয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, “দালুন লাগবে দেখতে?ʼʼ

-“খুবই দারুণ লাগবে।ʼʼ

-“কিন্তু আব্বু কথা বলবে না কেন?ʼʼ

জয় সোজা হয়ে দাঁড়াল, “বুলেট গিয়ে কপালে লাগার পর আর কথা বলতে ইচ্ছে করবে না তোমার আব্বুর। শ্বাস নিতে ইচ্ছে করবে না, হাঁটতে ইচ্ছে করবে না, তাকাতে ইচ্ছে করবে না, উঠে বসতে ইচ্ছে করবে না। চুপচাপ শুধু চোখ বুজে শুয়ে থাকতে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে। শুয়ে থাকবে।ʼʼ
-“তাল মানে আমি চক্কেত আনতে বললে সেতাও আনবে না? আমার সাথে খেলবে না আর?ʼʼ

-“না।ʼʼ

জয় চোখ নত করে বাচ্চা মেয়েটার দিকে কেমন করে যেন চেয়ে থাকে। মেয়েটার নিষ্পাপ মুখ। জয়ের ভেতরটা বিদ্রোহ করে ওঠে। তার কিছু হচ্ছে, কপালের ডানপাশে চিরচির করছে।

মেয়েটা বলল, “তালে গুলি মেলো না।ʼʼ

জয় গম্ভীর হয়ে উঠল, “মজাদার দৃশ্যটা? সেটা দেখতে চাও না?ʼʼ

-“চাই তো। তুমি তোমাল কপালে কলো গুলি। আমি দেখি দালুন দিশ্য।ʼʼ

জয় চোখ বুজে দাঁত চেপে ধরে, “স্বার্থপর!? বাচ্চা মেয়েটাও স্বার্থপর!ʼʼ

দৌঁড়ে লতিফের কাছে যায় মেয়েটা, “আব্বু তুমিও দেখবে? ও আমাদের মজা দেখাবে? কী হলো, কলো গুলি তোমাল কপালে। আব্বু আল আমি দেখি।ʼʼ

জয় তির্যক চোখে মেয়েটাকে দেখল। ইচ্ছে করে মাথার ওপর তুলে এক আঁছাড় মারতে। ভ্রু জোড়ার ওপরে ফেঞ্চ-কাট চুলের এক গোছা পড়ে আছে। তা হাত চালিয়ে উপরে ঠেলে বলল,

-“চলে যান, লতিফ ভাই। শহর নয়, জেলা ছেড়ে। আশপাশের জেলায় নয়, দূরবর্তী কোনো জেলায় চলে যান বউ-বাচ্চা নিয়ে। দেশের শেষ সীমানায় চলে যান। কতক্ষণ এই সিদ্ধান্তে কায়েম থাকতে পারব বুঝতে পারছি না। কসম দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হলে আর মিস হবে না টার্গেট। এখন এক হাঁটায় বেরিয়ে যাব এখান থেকে। ফের ফিরে আসার ইচ্ছা জাগার আগে আমার নাগাল সীমানার বাইরে চলে যাবেন।ʼʼ

আসমার দিকে চেয়ে হাসল জয়, “উনাকে বোঝাবেন, আজ ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু একটা ভাবনা মাথায় আসতে পারে যে, মারতে তো এসেছিল জয়। বেঁচে গিয়ে সুযোগ যখন পেয়েছি, বদলা নিয়ে নিই, মেরে ফেলতে পারতো, সুযোগ পেয়ে আমিই বদলা নিয়ে নিই। আসতে পারে লতিফ ভাইয়ের মাথায় এমন কথা। তাই বলছি, একটু বোঝাবেন, এমন ভাবার দরকার নেই। বোকামি করে ছাড়ছি না, আসলে বুঝতে পারছি না কেন ছাড়ছি। যতক্ষণে বুঝতে পারব, ততক্ষণে আর ছাড়ার মানসিকতা থাকবে না। তাই এখন আপাতত বুঝতেই চাইছি না। কারণ এখন আপাতত ছাড়তে চাইছি।ʼʼ

লতিফকে বলল, “লতিফ ভাই, আমার মানুষ মারতে ওয়েপন লাগে না, হাতের প্র্যাক্টিস আছে কমবেশি। বংশ পরম্পরার রক্ত-দোষ তো। বদলা নিতে আজকের উপহার পাওয়া জীবনটা হারাতে আসবেন না। আমার দেয়া উপহার কেউ যত্নে না রাখলে খুব রাগ হয় আমার। চলি ভাবী। আর হয়ত দেখা হবে না কোনোদিন। ভালো থাকবেন। মেয়েটাকে ভালোভাবে মানুষ করবেন, যেহেতু ওর কাছে বাপ-মা দুটোই রইল।

বেরিয়ে যায় জয়। বাচ্চা মেয়েটা দৌঁড়ে আসে খানিকটা পিছনে, তবে দরজার বাইরে যায় না। জয় আড়াল হয়ে যায়। আসমার চোখ ঘোলা হয়ে আছে, উদ্ভ্রান্তের মতো চেয়ে থাকে জয়ের যাওয়ার পানে। ছেলেটা এলো, কী থেকে কী করল, কিছু কথা বলল, চলে গেল। অদ্ভুত, অদ্ভুত, ভয়ানক অদ্ভুত!


জয়ের নামে দুটো কেইস ফাইল করেছেন ঝন্টু সাহেব। অনেকগুলো অভিযোগওকরতে ছাড়েননি। সুযোগ পেলে কারও নামে মামলা কম দিতে নেই। এটার একটা কারণ আছে। বাংলাদেশের আইন কখনও কখনও কোনো অপরাধীর বিশ-পঁচিশটা অপরাধ ফাইল আলমারীতে ফেলে রেখেও অপরাধীকে সুখে জীবন কাটাতে দেয়। হতে পারে মামলা শ-খানেক হলে একটু মাঠে নামল!

ঝন্টু সাহেব কাঁচা লোক না। তিনি জয়ের সবরকম বদগুণ ও কর্ম নিয়ে আলাদা আলাদা অভিযোগ মেরে এসেছন।

পুলিশকে বলেছেন, “শুনুন অফিসার। জয় জুয়া খেলে। তো একবার একজনের বউ অবধি কেড়ে নিয়েছিল।ʼʼ

আপনি জানলেন কী করে?

খুব বিপাকে পড়লেন উনি, “আমার কাছে খবর থাকে।ʼʼ

-“আচ্ছা, তারপর?ʼʼ

-“তারপর আর কী? মাইনষের বউ তাসে জিতে কী করে? সেও তাই করেছে!ʼʼ

কথাটা আংশিক সত্যি। কিন্তু পুরোটা না।

জয়ের সবরকমের বদভ্যাস উল্লেখ করা হয়েছে। জয় জুয়া খেলে, নারীবাজীর দোষ আছে, মারিজুয়ানা সেবনের অভ্যাস আছে। এমনকি রাজনৈতিক দায়িত্বসূমহ ঠিকমতো পালন করে না সে। ভার্সিটির কাজে বিশেষ এক্টিভিটি নেই তার। সেসব ব্যক্তিগত দোষ জয়ের, কিন্তু আপাতত আসল দোষ হলো, সে একজন লোককে মারাত্মক জখম করেছে। এছাড়াও বহু মিথ্যা দোষ আরোপ করে কেইসকে শক্ত করার চেষ্টাও করেছেন ঝন্টু সাহেব। কিন্তু ভাবার বিষয় হলো, তিনি হামজার ব্যাপারে কিছু বলেননি। হামজা মাজহারকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ঘুরিয়ে এনেছে। সেটা উল্লেখ করেননি।

কথাগুলো জানিয়ে কবীর দম ফেলল। হামজা চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে জয়কে ডাকল। জয় ঘুমাচ্ছিল। বসার ঘরে ঢুকতেই হামজা ধমকে উঠল, “লুঙ্গি উচু করে বাঁধ্। ঘর ঝাড়ু দেবার জন্য আর ঝাড়ু কিনব না। তোর লুঙ্গি যথেষ্ট।ʼʼ

এবার লুঙ্গিটা উঁচু করে ঠিক কোমড় অবধি তুলে বাঁধল। আরেকটু তুললে ইজ্জতহানি হতে পারতো। কবীর কপাল চাপড়াল।

তার পিঠে চাপড় মেরে সোফায় বসে তরুকে ডাকল জয়, “আদা-মশলা-মরিচ-পেঁয়াজ, রসুন মেরে একটু পানি গরম করে দে রে, তরু। গলায় কুঁড়কুঁড়ানি উঠতেছে।ʼʼ

তরু কটমট করতে করতে এসে বলল, “একটু হলুদ-ধনিয়ার গুড়ো, সয়াবিন তেল, জিরেও দিই?ʼʼ

-“যদি গলার ব্যথা সারাতে কার্যকর হয়, তাইলে আলবাৎ দিবি। সাথে একটু মাল মেশাতে পারিস। অত্যান্ত সুন্দর একটা ড্রিংক তৈরি হবে।ʼʼ

হামজা গম্ভীর মুখে বলল, কর্কশ স্বরে বলল, “লতিফকে রেহাই দিতে পাঠিয়েছিলাম তোকে?ʼʼ

-“রেহাই? ছিঃ! অপবাদ দিচ্ছ। জয় বাংলার নামে শপথ করে বলতেছি, আমার-তোমার পেছন বাঁচাইছি আমি।ʼʼ

হামজা শীতল চোখে তাকিয়ে রইল। জয় বলল, “সামনে ইলেকশন, মাজহার আর ওর আপন বাপ আমার নামে অলরেডি মামলা মারছে, পলাশের সাথে পুন্দাপুন্দি চলতেছে, ভার্সিটির হলে সিন নিয়ে ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। এই বাঁশগুলাই আমি-তুমিসহ পুরা পার্টি মিলে পেছন পেতে দিয়েও নিতে পারব না। তো মনে করো, এইসবের মাঝেও যদি লতিফের ইন্নালিল্লাহ করে আরেকটা বাঁশ বাড়ানোর কি খুবই দরকার?ʼʼ

হামজা শব্দহীন হাসল, তুই শুধু এই কারণে ওকে ছাড়িসনি।

জয় কথা বলল না। হামজা বলল, “লতিফকে যেন কোনোভাবেই খুঁজে পাওয়া না যায়। তবেই ওর গুম হবার সাসপেক্শনটা শুধু মাজহার আর ওর বাপের ওপর থাকবে।ʼʼ

জয় উঠে যায়। সদর ঘরে দুটো মহিলা এসেছে। হামজার কাছে জন্ম নিবন্ধনের কাগজ সাইন করাতে। এটা কাউন্সিলরের কাজ, অথচ এখানে কেন এসেছে বুঝতে পারল না।

মশলার ঝাঁঝ রিমির সহ্য হয় না। কাশি উঠে যায়। মুখে শাড়ির আচল চেপে মসলা কসাচ্ছে। শাহানা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কাজের মহিলাগুলোর হাতের রান্না খাওয়ার অভ্যাস নেই এই বাড়ির পুরুষদের। তরু পানির পাত্র চুলোয় বসিয়ে গরম মশলা বের করল। খুব তাড়ায় আছে সে। দুটো লবঙ্গ, এলাচি, দুই টুকরো আদা, এক চিমটি লবন দিলো পানিতে। দারুচিনি দেবে কিনা তা ভাবার বিষয়।

-“এত তাড়াহুড়ো করে পানি গরম করছো কার জন্য?ʼʼ

‌“জয় গলার ব্যথায় পাগল হয়ে যাচ্ছে।ʼʼ

রিমি কূটিল হাসল, “পাগল হচ্ছে না-কি তোমায় বানাচ্ছে?ʼʼ

-“কী বলো, কিছুই বুঝলাম না, ভাবী।ʼʼ

-“এজন্যই তোমার এই দুর্দশা।ʼʼ

-“কী দশা?ʼʼ

-“বললে কূটনামি হবে। নিজে দেখলে ভালোভাবে অনুভব করতে পারবে।ʼʼ

-“ওরে বাবা! ধাঁধা বানাচ্ছো কেন? বলো না কী হইছে আবার? আবার কী করেছে সে?ʼʼ

-“তোমার এই আহ্লাদের কতটুকু মর্যাদা আছে তোমার পরাণপ্রিয় জয় আমিরের কাছে?ʼʼ

তরু দু’পাশে মাথা নেড়ে মুচকি হাসল, “তোমার যে কেন এত শত্রুতা ওর সাথে? অবশ্য আমার ভালোই লাগে তোমাদের এই ফাইট।ʼʼ

-“আমার খুব খারাপ লাগে, তরু। তোমার জন্য। চোখ থাকতে অন্ধ, মাথার দরজা বন্ধ, এমন লোকেরা খুব ভালোভাবে ঠকে যায়। বুঝলে?ʼʼ

-“ধুরু! যা বলবে, বলো তাড়াতাড়ি। আমার কিন্তু পানি গরম শেষের দিকে।ʼʼ

-“কোন আশায় করছো এসব?ʼʼ

তরু বিরক্ত হলো একটু, কিন্তু চেপে বলল, “আরেহ! কী করছি? খুলে বলো না!ʼʼ

-“আগে বলো, এই যে জয় আমিরের পেছনে নিজেকে লুটিয়ে দিচ্ছ, কোন আশায়? কী ভেবে?ʼʼ

মুখটা ছোট হয়ে গেল তরুর। কথা বলতে পারল না। চোখদুটো এক মুহূর্তে ঝাপসা হয়ে এলো।

-“জবাব দাও। কেন করছো এসব?ʼʼ

তরু ছলছলে চোখে রিমির কঠিন মুখের দিকে চেয়ে বলল, “এভাবে বলছো কেন ভাবী? আমার কিছুই চাওয়ার নেই ওর কাছে। মায়া, ভাবী। খুব মায়া লাগে। ওর তো কেউ নেই। আমি ছাড়া কে দেখবে ওকে?ʼʼ

রিমির মুখে আচমকা মলেন হাসি নেমে এলো, স্নেহভরে তরুর দিকে চেয়ে বলল, “গর্দভ মেয়েলোক! এটাই বোঝতে চাচ্ছি। ওর অনেকে আছে। তোমার কেউ নে পাগলি মেয়ে। ওর তুমি ছাড়াও লোক আছে।ʼʼ

তরু বিভ্রান্ত হয়ে বলল, “কে আছে? না, ভাবী। যেদিন থেকে ওকে পেয়েছি, আমি ছাড়া ওর কেউ নেই।ʼʼ

-“রাগাবে না আমায়। আমি যা জানি, তুমি জানো না। শুধু ভাবছি কথাটা বললে কীভাবে সহ্য করবে? সাহস হচ্ছে না আমার। শুধু বলছি তুমি আজ থেকে ওই নিমোকহারামের ফরমায়েশ খাটবে না। তাহলে আমি তোমাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দেব।ʼʼ

তরু অবিশ্বাসে বোবা হয়ে গেল। চোখটা এবার ভরে উঠল। আস্তে কোরে ডাকল, “ভাবী!ʼʼ

রিমি চোখ ফিরিয়ে নিলো। সে কঠিন হবার চেষ্টা করে বোধহয় পারছে না। তরু রিমির আচরণে আহত হয়ে চেপে ধরল, “কী হয়েছে, ভাবী? তোমার কসম লাগে, খুলে বলো। তুমি আমার ওপর রাগ-টাগ ঝারো, কিন্তু তো কখনও এভাবে কথা বলো না আমার সাথে?ʼʼ

-“আগে ভাবতাম, দেরিতেই হোক, তবে জয় তোমাকে এড়াতে পারবে না। অথচ মনেই ছিল না, এই বাড়ির ছেলেরা শয়তানকেও শয়তানী শেখায়।ʼʼ

তরু ভ্র জড়াল, “আগে যা ভাবতে, এখন ভাবতে দোষ কী?ʼʼ

রিমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলল, “তা জানলে তো আর এভাবে ফরমায়েশ খাটতে দৌঁড়ে আসতে না। সত্যি বলতে আমার তোমাকে কথাটা জানাতে কষ্ট হচ্ছে, মেয়ে। কিন্তু তুমি ওই নিমোকহারামটার জন্য এত উতলা হয়ে ওর গোলামি খাটবে, এটা আমি দেখতে পারব না।ʼʼ

তরু কথা বলল না। তার বড় অস্থির লাগছে।

রিমি বলল, “তোমার আশিক জয় আমির বিবাহ করিয়া সারিয়াছেন, তরুনীধি খাতুন। চমকে গিয়ে নিজেকে বোকা প্রমাণিত কোরো না, তরু। বরাবর জয়ের ওপর তোমার পাগলামীতে আমার তোমার উপর শুধুই মায়া হয়েছে। আমি জানতাম, শীতের মৌসুমের গাছের পাতার মতো ঝরে পড়তেই হবে তোমাকে একদিন। সে-দিন এলো শেষমেষ।ʼʼ

শেষের দিকে উদাসীন হয়ে পড়ল রিমি, ”তোমার হামজা ভাইকে আমিও ভালোবেসেছিলাম, তরু। তার বদলে সে শুধুই নিজের রূপ দেখিয়ে আমাকে খানখান করে ফেলেছে। ক্ষমতালোভী, নোংরা একেকটা রাজনীতিবিদকে ভালোবেসেছি আমি এই জীবনে। আব্বু, কাকা, মাজহার ভাইয়া, অবশেষে এই লোকটাকে। আমি সব বুঝি, জানো! তবুও এদের মায়া কাটাতে পারিনা।ʼʼ

তরু এই জগত ত্যাগ করেছে যেন। সে চমকে গেছে কিনা বোঝা গেল না, তবে অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল চুলার পাশে। জয় আমির মিথ্যা বলে না। সে সেদিন বলেছে, সে সেদিন তরুকে খুন করে এসেছে। জিজ্ঞেস করলে, বিয়ের কথাও স্বীকার করতো। কিন্তু তরু জিজ্ঞেস করেনি। জয় নিজের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরণের জঘন্য মিথ্যাকে নির্বিঘ্নে স্বীকার করার জোর রাখে, আর এ তো সত্য।

জয়ের ডাক শোনা গেল, “তরু! মরে গেছিস? গরম পানি দিয়ে যা হেহ, গলা আঁটকে আছে একদম। বের হব আমি, তাড়াতাড়ি আয় বাল। শার্টটাও আয়রণ করে রাখিসনি, কার বালডা পরে বের হব আমি?ʼʼ

তরুকে তবুও চুপচাপ চুলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল রিমি, “এ বাড়ির কোনো বেটাছেলেই মানুষ না, সবগুলো একেকটা রক্তখেঁকো জানোয়ার। প্রমাণ না পাওয়া অবধি বিশ্বাস না করলেও চলবে। একথা খুব তেতো শোনায় আমার মুখে, তাই না? সত্যি কথা তো, এইজন্য।ʼʼ


আজ রবিবার। রবি মানে সূর্য। তাই সূর্যটাও নিজের সবটুকু তাপ ছেড়ে টগবগ করে উদিত হয়েছে আজ।

সকাল সাড়ে দশটার দিকে মুস্তাকিন এসেছে। বসে আছে। অন্তূ বই-খাতা গুছিয়ে রেখে বসার ঘরে যাবার আগে অভ্যাসবশত মাথায় ওড়না তুলতে গিয়ে হাসে, বেশ্যার মাথায় ওড়নার পর্দা! হাস্যকরই তো। মুস্তাকিন মাথা নত করে বসে আছে। তার অভিব্যক্তিটা অব্যক্ত।

-“কেমন আছেন, মুস্তাকিন সাহেব?ʼʼ

অন্তূর আওয়াজে নিরস মুখে তাকায় মুস্তাকিন, “ঢাকা ছিলাম। কিছুই জানতাম না। কী থেকে কী হয়ে গেছে এই ক’দিনের ব্যবধানে!ʼʼ

অন্তূ হাসার চেষ্টা করল, “কোনো একদিনের ব্যবধানে দেখবেন এই পৃথিবীতে কেয়ামতও ঘনিয়ে এসেছে। যা ঘটবে, তার আভাস খুব কমই পাওয়া যায়, মুস্তাকিন সাহেব। কী ব্যাপার, তাকাচ্ছেন না কেন আপনি?ʼʼ

-“ইচ্ছে করছে না।ʼʼ

-“কেন?ʼʼ

-“বুঝতে পারছি না। আমার এতক্ষণেও বিশ্বাস হচ্ছিল না, এই সবে আপনার কথার ধরণে বিশ্বাস করার তাগিদ টের পাচ্ছি। কী থেকে কী হয়েছে?ʼʼ

মুস্তাকিনের দিকে চেয়ে অন্তূ মলিন হাসল, “সেদিন আব্বুদের কোথায় নামিয়ে দিয়েছিলেন?ʼʼ

-“সেদিন স্যারের নিষেধ না মেনে আমি ওনাদের সাথে আসলে এসব কিছুই…ʼʼ

-“কিছুই বদলাতো না। কিছুই করার ছিল না ওখানে। রটনা রটে যাওয়া, আর বাঁধ ফুঁড়ে পানির স্রোত মুক্ত হয়ে যাওয়া একই। সেই পানিকে ফেরানো যায় না, রটনা মুছে ফেলা যায় না। ছাড়ুন সে কথা।ʼʼ

মুস্তাকিন বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল অন্তূর দিকে। নিজেকে সামলে চোখ ফিরিয়ে বলল, “কেউ অন্তত অসম্মান করার সাহস পেত না আমার সামনে আপনাকে। আর লোকে কী বলল, তাতে প্রভাবিত হবেন কেন আপনি? লোকের কথায় আসে-যায় না।ʼʼ

অন্তূ আলতো হাসল। উদাসীন হাসি, “খুব আসে যায়, মুস্তাকিন সাহেব। আত্মসম্মান অবধি ঠিক আছে, কিন্তু যখন প্রশ্ন সম্মানের ওঠে, তখন লোকে আপনাকে সম্মান দিলেই সেটা কেবল সম্মান। সম্মানের ব্যাপারটা হলো, আপনারে বড় বলে বড় সে-ই নয়, লোকে যারে বড় বলে, বড় সে-ই হয়।ʼʼ
-“কিন্তু লোকে যদি বড়কে ছোট বলে?ʼʼ

-“সেটাও ভুল নয়। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে তো তা ঠিক। তাদেরকে দেখানো হয়েছে বিধায় তারা ছোট দেখছে। নয়ত এত ছোট করে দেখার সযোগ ছিল কোথায় তাদের?

মুস্তাকিন আস্তে কোরে মাথাটা নত করল। কিছু ভাবল। সোফার হাতলে হাত এলিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল। হাতের ঘড়িটা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আজ অবধি মুস্তাকিনকে কখনও পুলিশের ইউনিফর্মে দেখেনি অন্তূ। প্রতিবার এমন ফরমাল গেট-আপে দেখা গেছে।

-“পরীক্ষা চলছে না আপনাদের? আজ নেই?ʼʼ

-“আজ শেষ হবে। দুপুর দুটোয় পরীক্ষা আছে।ʼʼ একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, “আপনার তদন্ত কতদূর? কোনটা নিয়ে আগাচ্ছেন?ʼʼ

অন্তূ কাটাতে চাইছে। মুস্তাকিন টের পেল।

-“নতুন কিছু হাতে এসেছে।ʼʼ নিস্তেজ লাগছিল মুস্তাকিনের স্বর। তাকাচ্ছিল না অন্তূ দিকে। নিজের বাঁ হাতের তর্জনীতে থাকা গাড়ির চাবির দিকে চেয়ে আছে।

-“নতুন কিছু? পুরনোগুলো আনসলভড রেখে নতুন কেন?ʼʼ

-“পুরোনো কোনটার কথা বলছেন?ʼʼ

অন্তূ গভীর চোখে মুস্তাকিনকে পরখ করে চোখ নামালো, “আখির রেপ এণ্ড মার্ডার মিস্টিরি, ওর মেজো ভাই সোহানের খু-নের রহস্য, বড় ভাই সোহেলের লা’শ পাওয়া গেছে ওই বাড়িতে যেখানে সালমা খালারা থাকতেন, কিন্তু এখন তারাও নিখোঁজ। চাঁদনী ভাবী, সালমা খালা গেছেই বা কোথায়, হুট করে হারিয়ে গেছে, সেখানেই বড় ছেলের লাশ পাওয়া গেল। এগুলো কি পছন্দ হয়নি আপনার কেইস হিসেবে?ʼʼ

মুস্তাকিন একটু চুপ থেকে শান্তভাবে মাথা নাড়ল, “সব মাথায় আছে। তবে যেটা নেই সেটা হলো তদন্তের উপাদান—ক্লু। ক্রাইমগুলো শুধু হয়েছে, তবে সেগুলোর বিশেষ কোনো সূত্র নেই যা ধরে অপরাধী অবধি এগোনো যায়। আঁখির কেইসটা বন্ধ হয়েছে ফরেন্সিক রিপোর্ট পাওয়ার সাথে সাথেই। কারণ, সেখানে একটা সাসপেক্টেরও বিরুদ্ধে কোনো রকম ক্লু ছিল না। সোহানের মৃত্যুর ব্যাপারটা সবার জানা। আর সেদিন সোহেল মরল, ওটারও কোনো সূত্র নেই শুধু ওই রক্ত পুঁজ আর মেলাটোনিন হরমোন সেম্পল ছাড়া।ʼʼ

অন্তূ ভ্রু জড়াল। মেলাটোনিন হরমোন? সে যেটাকে নোংরা জিনিস ভেবে ভুল করেছিল। এখনও তার সন্দেহ আছে বিষয়টা নিয়ে।

-“ভার্সিটির এক মেয়ে বলেছিল সোহানের মৃত্যুর ব্যাপারে, সেটা ঝাপসা। আপনারা আঁখির লাশ পাঠিয়েছিলেন, আপনাদের জানার কথা, চাঁদনীরা কোথায় আছে? কোথায় পাঠিয়েছিলেন লাশ?ʼʼ

-“আমি পাঠাইনি। ডিপার্টমেন্ট থেকে পাঠিয়েছিল।ʼʼ

-“ওদের থেকে তথ্য কালেক্ট করতে পারবেন না?ʼʼ

-“পারলে দেব আপনাকে। কিন্তু আপনার এসব জেনে কী হবে? কী প্রয়োজন?ʼʼ হাসল মুস্তাকিন।

অন্তূ হাসার চেষ্টা করল, কিছু বলল না।

-“কালেক্ট করে জানাবো আপনাকে। উকিল হতে এখনও বছর কয়েক বাকি, এখনই এত খাটবেন না, এনার্জি বাঁচিয়ে রাখুন, নয়ত বিতৃষ্ণা ধরে যাবে নিজের পেশার প্রতি।ʼʼ

অন্তূ কিছুক্ষণ নির্বিকার পরে জিজ্ঞেস করল, “সোহানের ব্যাপারটা কী?ʼʼ

কিছুক্ষণ নীরবতা। পরে চোখ তুলে তাকিয়ে একটা দম ফেলে বলল, “যদি বলি, সোহানকে জয় আমির মেরেছে, বিশ্বাস করবেন?ʼʼ

অন্তূ ভ্রু কুঁচকাল সামান্য, “অসম্ভব কিছু নয়। অবিশ্বাস করার মতো ব্যাপার দুনিয়াতে খুব কম। কেন মেরেছে জয় আমির সোহানকে?ʼʼ

-“রাজনৈতিক মামলা। সোহান মাজহারের পার্টির লোক ছিল। তখন হামজা সবে ঝন্টু সাহেবের ভাতিজাকে বিয়ে করেছে। হুমায়ুন পাটোয়ারী কাউন্সিলর, জয় ছাত্রনেতা হয়ে উঠেছে, হামজা পুরোদমে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল রাজনীতিতে। কিন্তু এতে ঝন্টু, মাজহার বা হামজার শ্বশুর কোনোরকম সুবিধা করতে পারেনি হামজার ক্ষমতার ওপর। একটা ভাঙন। এরপর কিছু একটা ঝামেলা হয়েছিল মাজহারের সাথে, যা এখনও চলছেই। সেই জের ধরেই জয় সোহানকে অমানুষিক মার মেরেছিল। এরপর ছেলেটার ক্যান্সার হলো, আর ওর চিকিৎসার জন্যই সালমা খালা জমি বিক্রি করেছিল।ʼʼ

অন্তূ বিশেষ আগ্রহ পেল না। কিছু কথা নতুন অবশ্য, তবে শেষের কথাগুলো তানিয়ার কাছে সে শুরুতেই শুনেছিল। কোনো চমকপ্রদ কাহিনি লাগল না। কিন্তু চাঁদনীর ওই কথাটা খুব ধাক্কাধাক্কি করছিল ভেতরে—’সাবধান না হয়ে একটাকে হারিয়েছি।ʼ চাঁদনীর সব কথাই ভারী, তবে এটা যেন মেয়েটা খুব উদাসীনতা আর রহস্য ভরে বলেছিল। মুস্তাকিনের বর্ণনা সাদৃশ্য আনতে পারল না তার সাথে।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অন্তূ প্রসঙ্গ বদলায়, “আপনার মা-বাবা কোথায় থাকেন? স্কুলে আমি আপনাকে দেখেছি খুব কম, তেমন দেখা হয়নি, আর উনাদের ব্যাপারে কিছু জানিইনা।ʼʼ

-“আম্মা দিনাজপুরেই তবে পাশের গ্রামে থাকেন। বাবা ঢাকায়।ʼʼ

-“আচ্ছা, উনারা একসাথে থাকেন না। আর ভাইবোন? আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারটা বুঝলাম না..ʼʼ

-“পরে বলব কোনোদিন।ʼʼ মুস্তাকিন হাসল সামান্য।

দরজায় করাঘাত পড়ল। অন্তূ আৎকে উঠল অজান্তেই। এই করাঘাত তাকে আতঙ্কিত করে তুলল। মস্তিষ্কের স্মৃতিতে দরজার করাঘাতে এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা সংরক্ষিত রয়েছে।

দরজা খুলতেই জয় প্যাচপ্যাচে হাসল, “হোয়াটস-আপ, ঘরওয়ালি?ʼʼ

সানগ্লাসটা শার্টের নিচ প্রান্তে মুছে মুঠো করে ধরে তবে তাকাল চোখ তুলে অন্তূর দিকে। তবুও যতক্ষণ মাথা নিঁচু করে ছিল, বোঝা যাচ্ছিল জয়ের ঠোঁট এবং সাথে ধূর্ত চোখদুটোও হাসছে।

কথা শেষ হতেই বাতির সলতে কমানোতে ক্রমশ আগুনের বহর ছোট হওয়ার মতো জয়ের হাসিটা নিভলো। কণ্ঠ চেপে জিজ্ঞেস করল, “ও এইখানে কী করতেছে?ʼʼ

অন্তূ জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করল না।

জয় ফিসফিস করে বলল, “আমার অনুমতি আর ইচ্ছা ছাড়া তুমি পরপুরুষের সাথে সাক্ষাতে যাবে, এইটা কি ঠিক? নোপ! দিস ইজ নট ফেয়ার, ঘরওয়ালি। খু-উ-ব রাগ হচ্ছে ব্যাপারটাতে।ʼʼ

অন্তূ কিন্তু এবার মুচকি হাসল, “আপনার রাগের কারণ হওয়ার জন্য আমি খুব দুঃখিত, জয় আমির। কিন্তু পরপুরুষ ঘরে ঢোকানোটাই কি আমার বৈশিষ্ট্য নয়?ʼʼ

অন্তূর এই দুঃসাহস আর ঔদ্ধত্যে জয়ের ভেতরের রক্ত টগবগিয়ে ফুটিয়ে তুলল। জয় দাঁত চেপে ধরে চোখ বুজে বকে উঠল, “শালীর মেয়ে..ʼʼ

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]