#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৩৪.
বিগত ২০১৪ এর ৫ই জানুয়ারী দশম জাতীয়সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ভোট দিতে গেছিলেন না আমজাদ সাহেব, কাউকে যেতেও দেননি। অন্তূ তখন নতুন ভোটার। সে আব্বুকে খুব আগ্রহের সাথে বলে, “কাল আমি নাগরিক হব, আমার প্রথম ভোট দেব।ʼʼ
আব্বু হেসেছিলেন, “তোর জন্য ব্যালট পেপার বেঁচে থাকলে নাহয় ভোট দিতি। আজ রাতেই সেসবে সিল পড়ে যাবে। কষ্ট করে ভোট দিতে যাবার ঝামেলা নেই। জনগণের খাটুনি কমাতে সরকার দেখ কত কী করে! তবুও লোকে বলে, রাজনীতি আর রাজনৈতিকতা ভালো না।ʼʼ
সে খবরের কাগজে পড়েছিল, নির্বাচনের আগের রাতে কমপক্ষে পাঁচশো ভোটকেন্দ্র আগুনের হল্কায় দাউদাউ করে জ্বলেছে। বিশ-পঁচিশ জনের মৃ-ত্যু-র খবর যদি ছাপাই হয়, আমজাদ সাহেব ধারণা করলেন, মৃত্যু এর চেয়ে অনেকবেশি হয়েছে, আহত অগণিত। তার মধ্যে নিশ্চয়ই শিবির আর বিরোধীদলীয় বিএনপির ছেলেরা বেশি মরেছে! অন্তূ সতর্ককণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিল, “আব্বু! তুমি কি জামায়াত শিবিরকে সমর্থন করো?ʼʼ
আমজাদ সাহেব বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলেন, “আমি অন্তত এ দেশের বর্তমান ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচার নেতাদের সমর্থন করি না।ʼʼ
অন্তূদের ভার্সিটি ছুটি হয়ে গেল। চারদিকে হাহাকার। মাসজুড়ে স্কুল-কলেজে ছুটির পর ছুটি। একে একে জেলে যায় লোকে, তার কয়েকদিন পর তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। সুবিচারে দেশ ভরে উঠতে লাগল কানায় কানায়। লোকে রাতে বাইরে বের হয় না সুবিচারের ভয়ে। কোথাও তাদের ওপর না সুবিচার ঘটে যায়! এমনিতেই এত সুবিচার এই ১৪৭৫৭০ বর্গ কি.মি. সীমানার দেশে আঁটছে না, উতলে পড়ে যাচ্ছে।
বাইরে বের হওয়া লোকের নিশ্চয়নতা নেই ঘরে ফেরার। বিনা নোটিশে কারাদন্ড হয়ে যায় আজকাল মানুষের। এভাবে পেরিয়ে যায় প্রায় ছয়মাসের মতো। জুলাই মাসে সবকিছু সামান্য স্বাভাবিক হওয়ার পরেই সবকিছু চলতে শুরু করল। কতদিন এভাবে চলা যায়? উত্তাল ঢাকা শান্ত যেন। নির্বাচন থামানো যায়নি, ঠিক ক্ষমতায় বসে পড়েছে ভক্ষকগণ। এই শোক এবং হতাশায় আর বিরোধী বিপ্লবীরা একে একে জেলে যাওয়ায় হতাশায় নিমজ্জিত তারা। আইনস্টাইন বলেছিলেন, পৃথিবীর প্রায় সকল তুলনাকে আপেক্ষিকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। আপেক্ষিকভাবে বিরোধীদলগুলো নির্বাচনের পর ঠিক যতটা হতাশা নিয়ে দমে গেল, হামজা জয়ের মতো ছাত্রলীগের তরুণেরা উপরমহলের প্রশ্রয়ে তত বেশি হুংকার দিয়ে নিজেদের জাহির করার সুযোগ হাতিয়ে নিলো।
অন্তূ জয়কে কবুল করেছিল ২৬ নভেম্বর, ২০১৪। ষোলো দিন পর আজ ১২ই ডিসেম্বর, ২০১৪; রোজ শুক্রবার। অন্তূ বিয়ের সাজে বসে এসব ভাবে। অবাক হয়, জীবন তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে? সে ধীরে ধীরে সাধারণ একটা স্বপ্নদেখা মেয়ে থেকে কেমন আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের দিক ঝুঁকে পড়ছে। কীসের সংগ্রামের আগুন বুকে ধিকধিক করে জ্বলছে? পরিস্থিতি তার ভেতরে যে আগুন জ্বালিয়েছে তা তাকে আর কতদূর নিয়ে যাবে?
অন্তূ মাঝেমধ্যেই বিরক্ত হয় নিজের ওপর। সে আজ এমন প্রতিবাদ করতে না গেলে, সহ্য করা শিখলে জীবনটা এর চেয়ে অন্তত ভালো হতো। তখনই আব্বুর সেইসব শিক্ষা এসে সামনে দাঁড়ায়, “অন্তূ! পরিণামের চিন্তা যদি তোকে প্রতিবাদ করা থেকে পিছপা করে তোলে, সহ্য করতে শেখার পরামর্শ দেয়, সেই চিন্তাধারায় অল্প একটু কেরোসিন ঢেলে ছোট্ট একটা দিয়াশলাই জ্বালিয়ে দে। আর যদি সবাই এটা করতে পারতো দেশে কখনোই স্বৈচারার সোচ্চার হয়ে ওঠার সুযোগ পেত না। পৃথিবীতে ক্ষমতা এবং দূর্বলতা আলো এবং অন্ধকারের মতো। অন্ধকার না থাকলে আলো কখনও দৃশ্যমান হতো না। এখানে আপেক্ষিকতার সূত্র খাটে। দূর্বলতার আপেকিকতায় ক্ষমতা জাহির হয়। তুই যতক্ষণ দূর্বল, তার তুলনায় বরং তোর সম্মুখে কেউ শক্তিশালী। যখন তুই-ও শক্তিশালী, তখন তোরা দুজন বরাবর। কাটাকাটি হয়ে যাবে শক্তির, আর কারোটাই তখন শক্তি থাকবে না। ঠিক যেমন আলোর বিপরীতে আলো অতুলনীয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ফলে যে ক্ষতিগুলো জীবনে নেমে আসে, এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যারা ক্ষতি ও অবিচারের সম্মুখীন হয়, আল্লাহ তায়ালা তাদের বলেছেন, মজলুম। আর তিনি স্বয়ং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—নিশ্চয়ই তিনি তার মজলুমদের সাথেই আছেন।ʼʼ
অন্তূ ভেতরে বিপ্লবের আগুন জ্বলে ওঠে। শুরুটা হয়েছিল, একটা বোরকা পরা মেয়েকে সিগারেট হাতে তুলে দেয়ার মাঝ দিয়ে। এরপর প্রতিটা দিন একটা মেয়েকে নিয়ে রঙ্গ-তামাশা কথা তরুণ যুবনেতার বিরুদ্ধচারণ দিয়ে শুরু এই কাহিনি আজ অন্তূকে, পর্দাহীন, মনুষত্বহীন, সুস্থতাহীন এক অস্বাভাবিক চিন্তাধারার মানুষের পরিণত করেছে।
মেয়েরা যুদ্ধে ইজ্জত দিয়েছে, গর্ভের ছেলে, মাথার সিঁদুর, গায়ের কাপড়…কেন? কেন শুধু ওরা দিয়েছে? ওরা কেন কেড়ে নিতে পারেনি? ওরা কেন কেঁড়ে নিতে আসা হানাদারের বুকে বটির কোপ বসাতে পারেনি, চালের বাটাম খুলে কেন দিতে পারেনি মাথায় একটা বাড়ি, সেসব কুকুরদের র-ক্তে কেন চুড়ি পরা হাতদুটো ধুয়ে ফেলতে পারেনি? আজও কী হচ্ছে? সেদিন আঁখি কেন একাধিক নারকীয় পিশাচদের দৈহিক খোরাক হয়েছে? কেন দিখণ্ডিত করে ফেলতে পারেনি সেইসকল ক্ষুধার্ত জন্তুদের পাপী দেহপিণ্ডটাকে? অন্তূর সাথে কি এর কম কিছু হয়েছে?
এত হানাহানি কীসের? যারা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা কেন জেলে পঁচে মরছে? গত ২০১৩ এর ১২ই ডিসেম্বর এক ইসলামি রাজনৈতিক নেতাকর্মী আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। তার অপরাধ, সে মুক্তিযুদ্ধের মানবতাবিরোধী অপরাধী। টুপি, দাড়ির সাজে একজন মুসলমানবেশী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, তা কতটুকু সত্যি? যদি এভাবে সকল জামায়াত পার্টির সদস্যরা অপরাধী হয়, তাদের তো ধরে জেলে পুড়ে দেয়া হচ্ছে, অথবা পড়িয়ে দেয়া হচ্ছে কালো মুখোশ, ঝুলে পড়ছে ফাঁসির কাষ্ঠে। এরপর ক্ষমতায় আছে নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধা, এবং দেশপ্রেমিকে মানুষেরা! তাহলে এই রাহাজানি, সহিংসতাগুলো কাদের কাজ? সকল অপরাধীর শাস্তি হয়ে গেছে। এখন গোটা বাংলা শান্তিতে ছেয়ে যাওয়ার কথা। তবুও কেন শহরে শহরে বাস-ট্রাম পুড়ছে, মানুষ মরছে, ছিনতাই, নির্যাতন, অপরাধের সীমা থাকছে না? জয়েরা কেন এত শক্তিশালী? হামজারা কী করে জনসাধারণের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে? বাংলাদেশ তো মুসলিমের দেশ, বাংলাদেশ তো সকল ধর্মের ঐক্যের দেশ! তাহলে শান্তি কেন নেই? অথচ প্রতিটা ধর্মেই তো জীবনবিধান রয়েছে। তবুও কেন এখানে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানের ধার ধারার মতো সংবিধান নেই? সংবিধানে কেন ধর্ম নেই? ধর্মের ডাক দেয়া মানুষগুলো কেন শেলের শিক ধরে দাঁড়িয়ে কালকুঠুরিতে?
মার্চের ষোলো তারিখে অন্তূ গেল থানায়। চাচার নামে কেইস ফাইল করতে। আমজাদ সাহেব জানতেন না, যে অন্তূ টুকটাক বিষয়গুলো জেনেও আরও জানার জন্য না-জানার ভান করছে। পরেরদিন বঙ্গবন্ধুর ৯৪তম জন্মদিন। থানার গেইটে এক পুলিশ থামিয়ে অন্তূকে বলল, “বোরকা খুলে ভেতরে যান। হিজাব খুলে ফেলুন। মুখ দেখান।ʼʼ
-“বোরকার ওপর দিয়েই তল্লাশি করুন।ʼʼ
-“ম্যাডাম, যা বলছি তা করুন। আজ জঙ্গির দল বোরকার আড়ালে বের হবে কত এমন। এসব পর্দা সব স্থানে চলেনা। খুলে ভেতরে যান।ʼʼ
অন্তূ ধৈর্য্য হারায়। জ্বালা ধরানো হাসি হেসে বলেছিল, “কোথাও শুনেছিলাম, ‘ধান পোড়ে চুলায়, পানি ঢালে পাছায়।ʼ আপনি সারাদেশে আছেন? যেখানে বোরকার তলে আসলেই ধান পুড়ছে, সেসব জায়গায় গিয়ে পাহারা দিন বরং। কর্তব্যপরায়নতার নাটক করে অজায়গায় পানি ঢালবেন না। নয়ত দেখবেন ওদিকে ধান পুড়ে সিদ্ধ-পাতিলটাসহ ব্লাস্ট হয়ে গেছে।ʼʼ
অন্তূ আর দাঁড়ায়নি সেদিন। সেই কর্তব্যপরায়ন পুলিশ অফিসারকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই চলে এসেছিল।
অন্তূর বরযাত্রী আসলেই খুব বেশি নয়। হুমায়ুন পাটোয়ারী, হামজা, পার্টির বিশিষ্ট কিছু ছেলেরা ছাড়া আর কেউ আসেনি। জয়ের পরনে সাদা শেরওয়ানি। মাথাটা খালি, পাগড়ি নিয়ে পিছে পিছে ঘুরছে রাহাত।
খাওয়া শেষ করে অন্তূকে বের করে নিয়ে যাওয়া হলো। অন্তূ একফোঁটা কাঁদল না। অন্তিক বোনের হাতটা চেপে ধরে গেইট অবধি নিয়ে যায়। রাবেয়া দূরে দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঝরঝর করে পানি পড়ছিল অসহায় মায়ের চোখ দিয়ে। অন্তূ এগিয়ে গিয়ে বলে, “আম্মা! বিদায় দাও। নতুন এই জীবনে কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই। বেঁচে থেকে কিছু নতুন অভিজ্ঞতায় ভিজিয়ে ফেলতে চাই হাতদুটো। সেই অভিজ্ঞতা সামলে নেয়ার দোয়া কোরো। আমি আসব তোমায় দেখতে। খবরদার ওই পাপের ইট-বালুতে গড়া দালানে তোমার পা ফেলো না, আম্মা। আব্বু আমায় যেদিকে দিয়ে গেছে, তা আমার মাঝে থাক। তোমরা পা নোংরা করতে যেও না। দেশের পরিস্থিতি ভালো না, আর না মানুষ, সমাজ ময়লা হয়ে গেছে। তোমরা সরল মানুষ কোনোরকম বেঁচে থাকলেই অনেক।ʼʼ
রাবেয়া হু হু করে কাঁদেন। অন্তূ বড় হয়ে গেছে। ছোট ছোট প্রতিবাদ থেকে জন্ম নেয়া অন্তূ কিছু বিঁষমাখা অভিজ্ঞতার আয়োজনে আজকাল কেমন যেন লাগামছাড়া হয়ে গেছে।
অন্তিক ফিসফিস করে বলে, “যতদিন ছিলি, কথা হয়নি বহুবছর। আজ বহুত কথা টের পাচ্ছি ভিতরে। বলার সুযোগ নেই। বহুদিন রাতে ঘুমাইনি, চোখদুটো খুব জ্বলছে। তোর চোখ জ্বলছে না?ʼʼ
-“জ্বলছে না। আম্মার খেয়াল রাখিস। ভাবী আর তোর বাচ্চার হাল ধর। হতাশা হলো দূর্বলদের দেহে লেগে থাকা জীবাণু। যা তোকে গ্রাস করেছে। হতাশা ঝেরে একবার জিতে ফেরার মতো করে গা ঝারা দে। দেখবি নিজেকে পুরুষের মতো মনে হবে। যা করেছিস, সেইকাল পেরিয়ে এসেছিস। আমিও তো জীবনে কতকিছু করেছি। পর্দাও করেছি। আজ এই বিয়ে সাজে শ মানুষ দেখছে। এখন কি সেই অতীতের বোরকা পরা অন্তূকে ভেবে কাঁদবো? নতুন করে শুরু কর। আম্মার তোকে প্রয়োজন, ভাবীর তোকে প্রয়োজন, তোর বাচ্চার তোকে প্রয়োজন।ʼʼ অন্তূর স্বর হালকা কাঁপলো পর্দার কথা বলতে গিয়ে।
-“আর তোর? তোর প্রয়োজন নেই আমাকে?ʼʼ
-“আমার আমাকে খুব প্রয়োজন। এছাড়া আশপাশে প্রয়োজনীয় কিছু তেমন চোখে পড়ছেনা আপাতত।ʼʼ
—
গাড়ি তখন চলছে হাইওয়ের ওপর দিয়ে। অন্তূর পাশে জয় নেই। সে পেছনের গাড়ির ড্রাইভার। উদ্ভট কর্ম খুব মানানসই তার সাথে। সামনের গাড়িতে হামজা ড্রাইভারের পাশে ছিল। রিমি বসেছে অন্তূর পাশে, ওর কোলে কোয়েল। একদৃষ্টে অন্তূকে দেখছে, বোঝার চেষ্টা করছে। কবীর আর একজন মুরব্বী এবং হুমায়ুন পাটোয়ারী পেছনের সিটে। অন্তূ তাকিয়ে আছে নিজের বাঁ হাতের তালুতে। মেহেদিতে রাঙা হাতে কী খুঁজছে কে জানে!
বিকট একটা আওয়াজে কানের তালা লেগে গেল। রিমি কান চেপে ধরে নিচু হয়। গাড়ি থামতেই ছুটে বেরিয়ে যায় হামজা ও হুমায়ুন পাটোয়ারী। ককটেল পুড়ছে জয়ের গাড়ি থেকে দুই হাত দূরত্বে। গাড়ি ছিটকে এসে উল্টে যাবার আগে ব্রেক কষতেই জয়ের কপালটা স্টিয়ারিংয়ে সজোরে ধাক্কা খায়। কপালটা চিড়ে দিখণ্ডিত হয়ে গেছে। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। হামজা পাগলের মতো ছুটে যায়। গাড়ির কাঁচ তোলা ছিল। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে আশপাশে তাকায়। কিচ্ছু নেই। একদৌড়ে সামনের গাড়িতে ফিরে ভরা বোতলটা আনে। গ্লাসের ওপর দুটো আঘাত করে। কাঁচ চিড়ে গিলেও ভাঙে না। এবার দুটো ককটেল ফাটে রাস্তার ওপর। গাড়ির পেছনে আগুন জ্বলে ওঠে। কেউ কেউ সজাগ হয়ে উঠলেও রক্তাক্ত শরীরে নেই একফোটা জোর। কেউ-ই বের হবার মতো অবস্থায় নেই।
রিমি কোথা থেকে যেন একটা ভাঙা ইটের টুকরো এনে হাতে ধরিয়ে দেয় হামজার। হামজা এক পলক সেদিকে তাকিয়ে জয়কে বলে, “মাথা তুলিস না কিন্তু।ʼʼ
ইটের চারটে আঘাতে কাঁচ ভেঙে হাত ঢুকিয়ে কাঁচের লক খোলে। যা ধারণা করেছিল তাই। জয় অর্ধচেতন। ওকে হিচড়ে বের করে বুকের সাথে চেপে ধরে দৌড় লাগায় সামনের দিকে। যখন তখন অ্যালকোহল ভর্তি বোতল এসে পড়তে পারে গায়ে। হামজা অপরহাতে রিমির হাতটা ধরে ছোটার চেষ্টা করে। আরও দুটো ককটেলের বোতল সামনে এসে পড়ে। পরেরগুলো গাড়ির ওপর। কে মরল কে বাঁচলো তা পরে হবে। আরও কিছুদূর এগিয়ে আসার পর গাড়িতে এসে তিনটা কাঁচের বোতল গ্রেনেড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তরলগুলো গড়িয়ে পড়তেই বোতলের কর্কের আগুনে দহন শুরু হয়ে যায়।
জয়ের হাতের চামড়া ছিলে মাংস উঠে এসেছে। কপালে চাপটি ধরা র-ক্ত। ভ্রুতে এসে র-ক্ত চাপ ধরেছে। গোটা সাদা শেরওয়ানি রক্তে ভেজা। এবার হামজা খেয়াল করে, কপাল অল্প, আসলে কপালের কোণা দিয়ে মাথার ডানপাশ ফেটে গেছে। কান দিয়ে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। এতক্ষণে জয় একেবারে জ্ঞান হারায়। হাত-পা ছেড়ে দেয় হামজার কাঁধে। লোকজন দূর থেকে দেখে দৃশ্য। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ফুল সাজানো গাড়ির পেছনটা জ্বলছে। লাল টুকটুকে শাড়ি পড়া বউ দাঁড়িয়ে সামনে গাড়ির দরজার সামনে।
হুমায়ুন পাটোয়ারী জয়ের হাতটা ধরে ঝাঁকায়, জয়? মামা? ও জয়…
হামজা বলে, “আব্বু, আপনি আরমিণকে বাড়ি নিয়ে যান। এখানে কিচ্ছু হয়নি। মাঝপথে কল আসায় আমরা জরুরী কাজে ঢাকা গেছি, কেমন? বউভাত দু’দিন পর হবে। গান-বাজনার কমতি রাখবেন না। লোকজন যা আছে, সবার ভালো আপ্যায়ন করবেন। খুব শীঘ্রই ফিরব আমরা। এ খবর নিজে থেকে লিক না হওয়া অবধি এরকম কিছুই হয়নি, ঠিক আছে?ʼʼ
পথ এখনও বেশ খানিকটা বাকি পাটোয়ারী বাড়ির।
—
গাড়ি থেকে নামার পর সামনে শত শত লোক। পুরো পাড়া এসেছে জয় আমিরের বউ দেখতে। তার উপর যে তামাশা করে জয় আমির বিয়ে করেছে! আজ অন্তূর রাঙা গম্ভীর সুশ্রী চেহারাটা গিলে খেল কত-লোকে। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে চোখের নজর ঘোরায় অন্তূ। দোতলা বাড়ি। বেশ বড় বাড়ি। তখনই অন্তূর মাথায় আসে, হামজা করে কী? মেয়র হয়েছে সেদিন। জনগণের টাকা-পয়সা মেরে বড়লোক হতেও তো সময় লাগার কথা। এত বড় বাড়ি, গাড়ি বিলাসিতার উৎস কি শুধু এই ওয়ার্কশপ? লোহার ব্যবসায় এত আয়? অন্তূর বিশ্বাস হয়না। আবার মাথায় ঘুরছে জয়ের রক্তাক্ত মুখটা। ঘাঁড়ের পেছন দিয়ে সেই র-ক্তের স্রোত। এরকম র-ক্ত প্রথমবার আব্বুর দেহে দেখিছিল সে।
পার্টির ছেলেরা ভরা চারদিকে। সবার মাথায় লাল গামছা বাঁধা। এই বাড়িতে যে এত বড় আয়োজন, তা বরযাত্রীর সংখ্যা দেখে বোঝা যায়নি। কিছু বিশেষ লোক মোতায়েন করা হয়েছে, তাদের হাতে লাঠি, ফাঁড়া খড়ি, কেউ কেউ চাদর পড়েছে। হাঁটার সময় হাতের রাম-দা গুলো বেরিয়ে আসছে চাদরের প্রান্ত থেকে। এইসব নিরাপত্তা কেন? হামলার ভয়? কীসের হামলা?
ছোট বেলা। সন্ধ্যা লেগে যায় বউ ঘরে তুলতে তুলতে। আজ পাটোয়ারী বাড়ির মেইন গেইট খুলে দেয়া হয়েছে। সিড়ি বেয়ে বেয়ে উঠে আসছে দলে দলে লোক। গেটের ডানদিকে ছোট্ট বাগান, তার বাঁ পাশে ওয়ার্কশপের সীমানা শুরু। ডানদিকের ঝোপের পাশ ঘুরে গেছে একটা গলি। তা বোধহয় বাড়ির পেছনের দিকে যায়। কিন্তু বাড়ির পিছনে বিশাল প্রাচীর তোলা। ওদিকে এই রাস্তা কীসের?
অন্তূর মাথাটা নত ছিল। যখন দরজায় পা রাখল, শাড়ির কুচি ধরে এগিয়ে অল্প মাথাটা তুলতেই একটা মেয়ের জ্বলজ্বলে চোখ নজরে এলো। অন্তূকে গিলছে যেন চোখদুটো, দুটো ঢোক গেলাও নজরে আসে অন্তূর। কৌতূহল তৈরি হলো মেয়েটার প্রতি।
বাসরটা সাজানো হয়েছে কাঁচাফুলে। জয়ের ঘরে পা রাখতেই যে জিনিসটা চোখে বাঁধে—ঘরের দেয়ালভর্তি জয়ের ছবি। সবচেয়ে বড় ছবিটা সাদা পাঞ্জাবী পরা, গলায় চাদর পেঁচানো। ওটা দরজার সামনের দেয়ালে টাঙানো। একটা খাট, ড্রেসিং টেবিল, কাঠের আলমারি, ছোট্ট দুই সিটের সোফা(কাউচ), বুকশেল্ফ, কর্ণার শোপিসটা রাখা বাথরুমের দরজা থেকে একটু দূরের দুই দেয়ালের কোণায়। অন্তূর তাচ্ছিল্যই এলো। এসব বড়লোকির চলাফেরার সোর্স কী? চাঁদাবাজি! জয় এখন কোথায়?
একের পর এক লোক আসছিল। দেখছিল, কেউ কেউ মুখ দেখে টুকটাক উপহার বা টাকা হাতে গুঁজে দিচ্ছিল। সেই সময় কোথা থেকে কোয়েল ছুটে এসে কোলে চড়ে বসে অন্তূর মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে শুরু করে। হাস্যকর ছিল দৃশ্যটা। কোলে চড়ে বসে মুখ দেখা। তুলি পাশে জিজ্ঞেস করল, “পছন্দ হয়েছে বউমণিকে?ʼʼ
-“বউ?ʼʼ
-“জয় মামার বউ এটা। তোমার রিমি মামির মতো আরেকটা মামি। মামিকে ভালো লেগেছে তোমার? কোলে চড়ে বসলে যে!ʼʼ
কোয়েল আধোস্বরে বলে, “জয় তো…ʼʼ
থেমে গিয়ে চেয়ে থাকে অন্তূর দিকে বাচ্চাসুলভ দৃষ্টিতে, যেন বুঝতে চেষ্টা করছে ব্যাপারটা। দারুণ মায়া লেগে গেল অন্তূর। গালটা টেনে দিয়ে ভালো করে টেনে কোলে বসিয়ে একহাতে জড়িয়ে রাখলো কোয়েলকে। তুলি মিষ্টি হেসে নিজের পরিচয় দেয়, “আমি তোমার এক ননদ। তোমার তো আপন ননদ, ভাসুর কেউ নেই। আমি হামজার ছোটবোন।ʼʼ
অন্তূ হাসল অল্প। তুলি অল্প টিস্যু ছিঁড়ে সযত্নে অন্তূর মুখের ঘাম মুছে দেয়, “কী করে কী হলো, সেটাই ভাবছিলাম। জয় এমন ঘর বাঁধার ছেলে না। তবুও দেখেছ সাথে আসেনি! তুমি তো ভীষণ সুন্দরী! এত ঘামছো কেন? চিন্তা করছো কী নিয়ে? চার্জার ফ্যান দেব?ʼʼ
-“উহু। ঠিক আছি।ʼʼ অন্তূর পর্যবেক্ষক দৃষ্টি কিছু আবিষ্কার করে ফেলে তুলির মুখে। ফর্সা ধবধবে চেহারায় কালচে দাগগুলো খুব দৃষ্টিকটু। ঘাঁড়ের কাছের জখমটা ওড়নার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে। চোখের নিচে কালি পড়া, যা জানান দেয় বহুরাত ঘুমায়নি চোখদুটো। অথচ দারুণ সুন্দর চেহারা তুলির। হামজার মতোই নাক-চোখ, তবে হামজা পুরুষ হিসেবে এমন ফর্সা না।
রিমি এসে দাঁড়াতেই তুলি চমকায়, “মুখটা এমন ছোট লাগছে কেন তোমার, ভাবী? জয় আর হামজা ভাই কই? ওরা কি আজকের দিনটাও স্বাভাবিক পালন করতে পারতো না?ʼʼ রেগে উঠল তুলি।
রিমি যান্ত্রিক স্বরে জানায়, “রাস্তায় গাড়িতে হামলা হয়েছিল। জয়কে বোধহয় আপনার ভাই রাজধানীতে নিয়ে গেছে।ʼʼ
আঁৎকে ওঠে তুলি। মুখটা বিবর্ণ হয়ে যায়। দরজার বাইরে ধপ করে বসে পড়ে তরু। মৃত ঝরনার মতো ঝিরঝির করে গড়িয়ে থুতনি ছোঁয় নোনাজল। শাহানা জানতে পেরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে হামজার জন্য। তার ভয় হয়, ঢাকা যেতে যেতে আবার যদি হামলা হয়?
লোকের আনাগোনা কমলো রাত এগারোটার দিকে। তোড়জোড় কমে গেল। ঠিক খবর হয়ে গেছে, বিয়ের গাড়িতে হামলা হয়েছে। পুলিশ এসেছিল। হুমায়ুন পাটোয়ারী সামলে নিয়েছেন।
অন্তূ ঘরটা দেখল দৃষ্টি ঘুরিয়ে। বেড-সাইড টিবিলের ওপর কাঁচের বৌল ভর্তি কাজুবাদাম রাখা। তার পাশে ছোট্ট একটা হিপফ্লাস্ক পড়ে আছে। অন্তূ কর্ক খুলে শুঁকলো। মদের বিশ্রী গন্ধ, তবে তরল নেই। হলুদ একটা স্মাইলি হ্যান্ড প্রেস বল পাওয়া গেল ড্রয়ারে। এটা ব্যবহার করা হয় মেজাজ ঠান্ডা রাখতে। মানসিক বিশেষজ্ঞরা এটাকে হাতের মুঠোয় রেখে প্রেস করার পরামর্শ দেন মেজাজ শান্ত রাখতে। ড্রয়ারে ছোট-বড় ছুরি অনেকগুলো। বুলেট-কেস পড়ে আছে। অনেকগুলো সিগারেটের বাক্স, দেয়াশলাই, লাইটার। কাগজের মোড়কে বিভিন্ন রকম বড়ি পেল অন্তূ। দুটো খালি সিরিঞ্জ। স্লিপিং ড্রাগের বলেই মনে হলো।
ভারি গহনা ও শাড়ি খুলে সুটকেস থেকে একটা সাদা লম্বা জামা বের করে নিলো। বাথরুমে এগোনোর পথে গয়না তুলে রাখার জন্য আলমারি খুলল। সারি সারি শার্ট, পাঞ্জাবী, টি-শার্ট, প্যান্ট ঝুলছে। দুধ-সাদা থানের মতো লুঙ্গি ভাঁজ করে রাখা। নিচের তাকে পারফিউমের কৌটো, বেশ কয়েকটা ঘড়ির বক্স সাজিয়ে রাখা। অন্তূ অবাক হয়ে দেখল, একটা দুমড়ে যাওয়া আধখাওয়া সিগারেট। অন্তূ থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। জয়ের সাথে প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে পড়ে। এই সিগারেটের টুকরো পায়ে পিষে ফেলার মাঝ দিয়ে জয় নামক অভিশাপের আগমন হয়েছিল তার জীবনে।
চলবে…
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৩৫.
নবমদিন অন্তূর পাটোয়ারী বাড়িতে। সারাদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা, ঘুরে ফিরে জয়ের ঘরটা দেখা, রান্নাঘরে গিয়ে রিমির পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আবার রুমে আসা। সকালে হুমায়ুন পাটোয়ারী ডেকে বললেন, “আরমিণ, আম্মা!ʼʼ সুমধুর ডাক।
অন্তূ কাছে গেলে সহস্যে বললেন, “মামা শ্বশুরকে এক কাপ চা দিতে পারো?ʼʼ
অন্তূ রান্নাঘরে যেতে যেতে ভাবে, “আসল শ্বশুরের খবর নাই, মামা শ্বশুরের ঘুম নাই, তার আবার চা চাই।ʼʼ বাংলার সব ঘরে চা এর চলন নেই নিয়ম করে। উচ্চবিত্তরা এসব মানে।
পাটোয়ারী সাহেব ভালো লোক। ব্যবহার, কথাবার্তা সব আন্তরিক। অন্তূর উনাকে ভালোই লেগেছে। কিন্তু শাহানা অন্তূকে সহ্য করতে পারছেন না। অন্তূ বাড়িতে পা না-ই রাখতে বাড়িতে র-ক্তের ছাপ লেগেছে। রিমির হাতের কব্জি বয়ে জয়ের রক্ত এসেছিল সেদিন, জয় আসেনি। দুই ভাই রাজধানীতে পড়ে আছে। কল করলেও হামজা কিছু বলেনা বিশেষ। বলে, “সব ঠিক আছে। জলদি দিনাজপুর ফিরব।ʼʼ জয়ের অবস্থা কিছুই বলেনা। সেসবের জন্য তার অন্তূকে দায়ী মনেহয় শাহানার।
আগামীকাল থেকে দু’দিন হরতাল। বহুদিন থেমেছিল এইসব অবরোধ। আবার শুরু হলো কীসে, কে জানে! ওরা আসতে যে আরও কয়েকটা দিন লাগবে, এটা বোঝা যাচ্ছে। শাহানার শরীরে কোনো উন্নতি নেই। সে সারাদিন পেটের ব্যথায় কাঁতরায়। কথা বলার লোক নেই তার। অন্তূ গিয়ে বসেছিল। দু চার কথা শুনিয়ে রুম থেকে বেরোতে বলেছেন।
বিকেল বেলা তুলির রুমে ঢুকতেই ফিডার রেখে দৌড়ে এসে ঝেপে পড়ল কোয়েল, “আরিণ! চলো চক্কেত কিনে আনি। জয়টা আসছেনা। তুমি ওর বউ, তুমি চলো।ʼʼ
অন্তূ কানে গলিত সিসার মতো ঢোকে ‘জয়ের বউʼ কথাটা। সে হাসে, “পরে যাব, আম্মা। চলুন, এখন দুধটুকু শেষ করুন। নয়ত চকলেট কিনে দেব না।ʼʼ
অন্তূ বসে থাকে কিছুক্ষণ। পরে দ্বিধা ভেঙে জিজ্ঞেস করে, “দুলাভাইকে তো দেখলাম না আসতে! মেয়েকে দেখতে আসেনা? আপনি কি এখানেই থাকছেন?
-“এত দ্বিধা করছো কেন? সৌজন্যের কিছু নেই। সরাসরিই প্রশ্ন করো, যা মনে আছে।ʼʼ হাসল তুলি।
-“কী হয়েছে আপনার দুলাভাইয়ের সাথে?ʼʼ
তুলির মনে হয়, জয়ের বউটা অন্তর্যামী। নতুন এ বাড়িতে এসে শুধু সবার চাল-চলনে অন্তূ যেসব সত্যগুলো বুঝে গেছে, তা সাধারণ চিন্তার মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। তুলি করুণ হাসে, “এতগুলো দিন এসে রয়েছি। এ বাড়ির কেউ-ই জিজ্ঞেস করেনি একবারও। তুমি কেন করছো?ʼʼ
-“আমি এ বাড়ির কেউ নই।ʼʼ
তুলি চেয়ে থাকে অন্তূর মুখের দিকে। চোখে-মুখে অনেককিছু, কিন্তু সেসব নীরব। চোখ যেসব কথা বলে এই মেয়ের, তা বোঝা যায়না। শুধু বোঝা যায়, বহু কথাই বলে যায় নিঃশব্দে।
ওড়নাটা মাথায় পরে শাড়ির আঁচলের মতো করে। কপাল অবধি পড়ে থাকে। চলনে একটা অভিজাত্য আছে। তুলির খুব পছন্দ হয়েছে জয়ের বউকে। এখন সে বুঝতে পারে, যা তা ধরে আনেনি, জয়।
—
অন্তূ নামাজ শেষ করতেই ঘড়িতে—১১:৪৩।
বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার কোনো ঠিক নেই এদের। কেউ অসুস্থ, কেউ বা বিষণ্ন, কেউ ঘুমন্ত। অন্তূ নিজেই খাবার বেড়ে নিয়ে খেতে বসল। খানিক পরে হুমায়ুন পাটোয়ারী এসে বসে বললেন, “খাবার দে তো, আম্মা! কেউ খাক না খাক, আমি তুই খেয়ে বাঁচি।ʼʼ
অন্তূ খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে, “আপনার হাই-প্রেশার আছে, মামা?ʼʼ
-“না। কিন্তু অ্যাজমার ভাব আছে।ʼʼ
-“তাহলে মাংস খাবেন না। ওটা আমি আমার জন্য বের করেছি। আপনি ডাল দিয়ে খেয়ে নিন। আমি তরুকে ডেকে আনছি।ʼʼ
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন হুমায়ুন সাহেব। সিরিয়াস, গম্ভীর, আবার কেমন অদ্ভুত মেয়েটা বাড়িটাকে দুই বাহুতে আঁকড়ে ধরেছে নাকি নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
তরুকে রুমে না পেয়ে ছাদের দিকে পা বাড়াল অন্তূ। সে ওখানেই বেশি কাটায় আজকাল। একা একা, নির্জনে। অন্তূর দিকে তাকায় না। অন্তূর এটাও বোঝা হয়ে গেছে, তার কাছে সর্বোচ্চ ঘৃণ্য পুরুষটারও একটা বিরহিনী আছে! আশ্চর্য হলেও আশ্চর্য নয়। কারণ মানুষের মন বড় বিচিত্র। তরুর কাছে হয়ত জয়কে ভালোবাসার কারণ আছে!
অর্ধেক সিঁড়ি উঠতেই রিমির চিৎকারে বাড়ি কেঁপে উঠল। অন্তূ পিছু ঘুরতেই ওর আগে তরু নেমে আসে পাশ কাটিয়ে। ধাক্কায় অন্তূ পড়ে যেতে নিলে তরু বাহু চেপে ধরে গম্ভীর হয়ে বলল, “এত নড়বড়ে হলে চলবেনা। সিড়িঘরের দরজা আঁটকে দ্রুত নেমে এসো।ʼʼ
এবার সকলে শুনতে পায়, সজোরে ঠাস করে কাঁচ ফাটার আওয়াজ। বেরিয়ে আসে রিমি, তার বাহুর ওপরে কামিজের হাতা রক্তে ভেজা। কাঁচের আঘাত পেয়েছে। অন্তূ ভেতরে ঢুকে দেখে, রিমির ঘরের জানালার কাঁচে তিনটে ছিদ্র। পাথর ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। অন্তূ থাকা অবস্থায় আরও দুটো পাথর এসে অন্য জানালার কাঁচ ভেঙে দেয়ালে ছিটকে পড়ে। নিচে যেন বিক্ষোভ শুরু হয়েছে এত রাতে। দলে দলে পদচারণার আওয়াজ বাড়ির চারপাশে টহলের মতো ঘুরছে। অন্তূ বেরিয়ে আসে দ্রুত। রিমি সাবধান করে, “আরমিণ, এখানেই দাঁড়ান। ঘরে যাবেন না। জয় ভাইয়ার ঘরে হামলা সবসময় আগে হয়।ʼʼ
দরজায় করাঘাত পড়লে খুলে দেয় অন্তূ। কবীর অন্তূকে সালাম দেয় কপালে হাত ইশারা করে। হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢোকে। রিমিকে বলে, “রাহাত মরে গেছে, ভাবী। ক্লাবঘরে আগুন জ্বলছে। সব শেষ। ক্লাবের সব শেষ। বিরোধী দলের শুয়োরের বাচ্চারা ক্লাবঘর জ্বালিয়ে দিয়ছে।ʼʼ
রিমি চেয়ারে বসে পড়ে শ্বশুরকে বলে, “আব্বু! আপনার ছেলেকে কল করুন তো। এই সময় বাড়ির লোকগুলোকে মারবে সে? জয় ভাইয়ার চিকিৎসা বাড়িতে হবে। জেলায় ফিরতে বলুন। আমি আর এসব নিতে পারছি না। আমি কিন্তু ও বাড়িতে চলে যাব।ʼʼ
তুলি বলল, “শান্ত হও, ভাবী। আব্বু আপনি নিচে যান। গেইট খোলার দরকার নেই। এসব করছে ওরা গেইট খেলানোর জন্য। নিচে যান। মেইন ফটকে লোক দাঁড় করান।ʼʼ
হুমায়ুন সাহেব বললেন, “কবীর? নিচে কে কে আছে রে?ʼʼ
-“সবাই আছে, মামা। আপনি বললে একশান নেবে।ʼʼ
-“দরকার নেই। দুই ভাই জেলায় নেই। এখন একশান নেবার কিছু নেই। ওর ফিরুক, যা করার করবে। চল।ʼʼ
তুলি তরুর হাতে কোয়েলকে দিয়ে পেছনের বারান্দায় যায়। খানিক বাদে ফিরে এসে রিমির পাশে বসে বলে, “পেছনের জঙ্গলে দলে দলে ঢুকেছে সব। হরতাল ডেকেও একটা রাত সহ্য হয়নি হারামজাদাগুলোর! আবার ক্ষমতা চায়? গদিতে বসলে এইসবই করে বেড়াবে!ʼʼ
অন্তূ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল। সবাই যেন পেশাগত এসব ব্যাপারে। খুব অভ্যস্ত লাগছিল সকলকে। এবার বলে উঠল, “বিএনপির কথা বলছেন? আওয়ামীলীগই বা গদিতে বসে কী শান্তি প্রতিষ্ঠা করে ফেলল? মোটকথা, গদিতে যেই থাকুক, খেলা একই রঙের দেখাবে। দলের লোকে কিছুই না। যা যায় সব তো জনগণের! ওরা তো শুধু নিজেদের মধ্যে ধরাধরি খেলে বিনোদন নেয় জীবনের!ʼʼ
অনেকক্ষণ আর কেউ কথা বলল না। বারবার সবাই অন্তূর দিকে তাকাচ্ছিল। অন্তূ সযত্নে একটু স্যাভলন মাখিয়ে রিমির হাতে একটা কাপড় বেঁধে দিলো। রিমি জিদ ধরে বলে, “কাল সকালে যদি এ বাড়ি না ছেড়েছি, আমার জিহ্বা কাটা পড়ুক। ওই লোক আসুক বাড়িতে। না নিজের জীবনের গ্যারান্টি রেখেছে, না আমার। আমার বাপ চাচা রাজনীতি করেনি? এমন কখনও বাড়ির লোক নির্যাতন সঁয়নি। কারণ ওদের এ বাড়ির লোকদের মতো ক্ষমতার লালসা ছিল না। রাজনীতি বহুলোকে করে, এদের মতো জান হাতে করে মাঠে নামা রাজনীতিবিদের মুখে আগুন দেই আমি।ʼʼ রাগে কটমট করে ওঠে রিমি।
কল লাগালো হামজাকে, “আপনি আসবেন? নাকি আমি বাড়ি ছাড়ব? কী করছেন কোথায়? বাড়ির নিরাপত্তা দিতে পারেন না, কীসের নেতাগিরি দেখান? বাড়িতে এরকম মরতে রেখে কোথায় মরতে গেছেন নিজে?ʼʼ
-“শান্ত হও তুমি। আজ রাতে রওনা দেয়া হলোনা। নিচে এখন দেখো হাঙ্গামা থেমেছে। পুলিশ গেছে, ছেলেরা এসে জমেছে। ওরা সারারাত থাকবে ওখানেই। আর কিছু হবেনা। শান্ত হও, আসছি আমি। জয়কে চাইলেও হাসপাতালে রাখার উপায় নেই। ও তিনদিন আগে হাসপাতাল ছেড়েছে জ্ঞান ফিরতেই। আমি গাড়িতে, পরে কথা বলছি।ʼʼ
-“ফিরবেন কবে?ʼʼ গর্জে উঠল রিমি।
-“কাল রওনা দেব। বললাম তো, আর কিছু হবেনা। খেয়ে নাও। ভেতরের ঘরে শুতে যাও। ঘরে থাকার দরকার নেই।ʼʼ
আসলেই বাইরের গেটের ওপর ধুমধাম আঘাত কমেছে। পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি বন্ধ হয়েছে। অনেকের সমস্বরের আলোচনার গোঙানি ভেসে আসছে। অন্তূ নিজের ঘরে এসে বারান্দায় দাঁড়াল। জয়ের ঘর ডান পাশে। পেছন থেকে, সামনে থেকে সমান। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তায় ভিড় দেখা যায়। পোলের লাইট বোধহয় ভেঙে ফেলেছে ওরা। অন্ধকারে জটলা বাঁধা লোকজন। আগামী দু’দিনের হরতালে বাড়ি ফেরাও মুশকিল হবে জয়েদের। অবশ্য ওদের জন্য মুশকিলের কিছু নেই। একটা কথা খুব খঁচখঁচ করছিল, জয় যদি তিনদিনে চেতনা ফিরে হাসপাতাল ছাড়ার শক্তি পায়, তাহলে তো ঢাকা নেবার প্রয়োজন ছিল না। ঢাকাতে নিশ্চয়ই অন্যকাজে গেছে দুইভাই! আবার হতে পারে, জয়ের শরীরে ব্যথাটাই কম!
—
ক্লাবঘর পুরোটা পুড়ে যায়নি। আবাসিক যে বিল্ডিংটা ছিল, ওটার ভেতরটা ঠিক আছে টুকটাক। বাইরের দেয়ালে কালি পড়েছে।
জয় ফিরল তারও সপ্তাহখানেক পর। সকলে স্বাভাবিক নিলেও অন্তূ অবাক হয়েছিল। এখনও মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ব্যান্ডেজ। চোখ-মুখে অসুস্থতা স্পষ্ট। অথচ জয় দিব্যি হেঁটে ভেতরে ঢুকেছিল। কাউকে ছুঁতে দেয়নি নিজেকে। আঘাত নেহাত কম ছিল না। হামজা পরিস্থিতি সামলে নিতে পটু। মিথ্যা বলেছিল। এতদিনের চিকিৎসার সাথে সাথে কিছু কাজ করেও ফিরেছে।
বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসা ছিল জয়। তখন রাত সাড়ে এগারোটা। পরনে ঘিয়ে রঙা প্রকাণ্ড শাল জড়ানো। সকলে ভিড় করে আছে জয়কে। হামজা বিছানার ওপর জয়ের পায়ের কাছে ক্লান্ত ভঙ্গিতে টানটান হয়ে শোয়া। জয়ের মুখ অসম্ভব গম্ভীর। চোখে-মুখের ভাব গাঢ়। শুধু মামিকে জিজ্ঞেস করল, “শরীর কেমন?ʼʼ
শাহানার ব্যথা অসহ্য পর্যায়ে চলে গেছে। জরায়ুতে ঘা তার। এই সংকটের মাঝে অপারেশনের সুযোগ নেই বললেই চলে। হুমায়ুন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “বিএনপি হঠাৎ ক্ষেপেছে কেন আবার?ʼʼ
হামজা বলল, “ওরা ক্ষেপে ছিল না কবে? ক্ষমতা হারানোর পর থেকেই ক্ষেপে আছে। এবারের নির্বাচনের পর মাঝখানে কিছুদিন হতাশা পালন করেছে, তাই মনে হয়েছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে সবকিছু। সংসদ নির্বাচনের বছর পূর্তি হবে। ওদের জ্বলন আবার বেড়েছে। ঢাকার পরিস্থিতি ভয়াবহ।ʼʼ
-“সেদিনের হামলা ওরাই করেছিল?ʼʼ
-“না। আবার হ্যাঁ-ও। বিএনপির দল ভারী হয়েছে, বুঝতে পারছ না? ক্ষমতায় এসেছে একদল। আর আসেনি বহুদল। ওই বহুদল এখন ধীরে ধীরে আর-এক দল হচ্ছে।ʼʼ
-“মাজহার নাকি তোর সাথে কথা বলতে চায়।ʼʼ
-“কথা নেই আমার কোনো। ও শালা ধান্দাবাজ। ওর বাপের অফিসে কাল কয়েকটা জঙ্গি ঢুকেছিল, এখন হাত মেলাতে চাইবেই। না মেলালে আবার নতুন ফন্দি আঁটবে আমাকে বাঁশ দেবার।ʼʼ
-“রাস্তার কাজ থেমে আছে। কনট্র্যাক্টর এসে ঘুরে গেছে কয়েক দফা।ʼʼ
-“ওদের তো ওলিফলি বেঁধে গেছে। রাস্তার কী বাল হয়েছে? কয়েকদিন আগেও প্রাইমারী স্কুলের সম্মেলনে নতুন বিল্ডিং মঞ্জুর করা হলো। ভরে না জনগণের? এই পরিস্থিতিতে রাস্তার কাজ হয়? কয়েকটাকে বোম মেরে উড়িয়ে দিয়ে গেলে তবে হয়ত সুখে থাকার চিন্তা দূর হবে জনগণের!ʼʼ
আর কেউ কথা বলল না। শান্ত হামজার এই কথাগুলোই আগুনের মতো গরম। সহজে না রাগা মানুষটার সামান্য একটু চেতে যাওয়াও অনেক। রিমি বেরিয়ে গেল ভারী পা ফেলে। জয় চুপচাপ খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ছিল।
অন্তূ গরম পানি নিয়ে ঘরে ঢুকল। হামজা বলল, “পেসক্রিপশনটা আমার কাছে দাও। বুঝিয়ে দিচ্ছি। এন্টিবায়োটিক দিয়েছে। সময়মতো খাওয়াবে।ʼʼ
অন্তূ কাগজ এগিয়ে দিয়ে দাঁড়াল। জয় চোখ খুলে তাকায়। আটসাঁটো জামা যদিও পরেনি অন্তূ, তবুও শরীর মাপা হয়ে গেল ওর চোখ দিয়েই। অভিজ্ঞ চোখদুটোর একটুও অসুবিধা হলোনা নারী শরীরের ভাঁজগুলো কাপড়ের ওপর দিয়ে পরিমাপ করে নিতে। তাতেই নিঃশ্বাস ভারী হলো। এদিক-ওদিক তাকালো বারবার।
অন্তূ ওড়নাটা শাড়ির আঁচলের মতো মাথায় দিয়েছে। আগের চেয়ে যেন ভিন্ন দেখতে লাগছে। এটাই বোধহয় বিয়ের জাদু! হাতে, গায়ে কোনো ধরণের অলংকার না থাকা সত্ত্বেও বউ বউ লাগছিল। জয়ের বুক ওঠানামা করে। র-ক্তে তেজ বাড়ে। অধৈর্য্য হয়ে উঠল এক মুহুর্তে। রাশভারী গলায় বলে উঠল, “মামা, বের হও রুম থেকে।ʼʼ
সকলে একে একে বেরিয়ে যায়। হামজা গম্ভীর হয়ে বলল, “ডাক্তার তোকে উত্তেজিত হতে নিষেধ করছে। নতুন রক্ত দেয়া হয়েছে শরীরে।ʼʼ
জয় গোঁয়ারের মতো বলল, “বাইরে যাও।ʼʼ
অন্তূ ওষুধ খুলছিল। অস্বস্তিতে হাত-পা অসাড় হয়ে আসে। ইচ্ছে করছিল, ছুট্টে পালিয়ে যেতে এই সীমানা যেতে। ঘৃণ্য এই লোকটার সাথে একঘরে কী করে থাকবে, তা ভাবার শক্তিটুকুও ভেতরে নেই। তার ওপর বেলেহাজ লোকেরা খুব বিপজ্জনক। অন্তূর র-ক্ত জমাট বেঁধে আসে যেন। জয় আদেশ করে, “দরজা আঁটকে দিয়ে এসো।ʼʼ
ভালোভাবেই ওষুধগুলো খেলো আস্তে আস্তে। অন্তূর পা দুটো যেন চাকা হয়ে গেছে। একা একাই ছুটতে চাইছে। আড়ষ্ঠতায় শরীরটা ভার হয়ে উঠছিল, ঠিক যেমন ভূতের ভয়ে মানুষ ভার হয়ে ওঠে। হেলান দিয়ে বসে আছে জয়। শার্টের বোধহয় নিচের দুটো বোতাম লাগানো। ওপরের খোলা বোতামেল মাঝ দিয়ে পশমে ভরা বুকে নজর যেতেই গা ঝিমঝিম করে ওঠে অন্তূর। আল্লাহকে ডেকে উঠল, পানাহ চেয়ে উঠল ভেতরটা। মিনতি করে উঠল যেন, মুক্তি চায়।
জয় ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিল। শরীর ঘেমেছে অল্প। অন্তূ উঠে যেতে উদ্যত হতেই বলল, “পানি দাও। আরেকটু পানি খাবো। ওষুধ আঁটকে আছে গলায়।ʼʼ
অন্তূ গ্লাস এগোতেই জয় থাবা দিয়ে খপ করে ধরে হাতের কব্জি। অন্তূর হাতের শিথিলতায় ঝনঝনিয়ে গ্লাসটা পড়ে ভেঙে যায় মেঝেতে। ঝাঁকি মেরে ওঠে অন্তূর দেহটা। হাতটা মুচড়ায় জয়ের মুঠোর মাঝে। মুখটা শক্ত হয়ে ওঠে অন্তূর। তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় জয়ের দিকে। জয় শীতল চোখে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে, “হাত মুচড়াচ্ছো কেন, ঘরওয়ালি? এতগুলো দিনে একা শুতে খারাপ লেগেছিল, হ্যাঁ?ʼʼ
চোখদুটো হেসে ওঠে জয়ের। সেই হাসি, সেই হাসি জয়ের। ভ্র-টা নাচায় নিজস্ব ভঙ্গিতে। একটানে অন্তূকে বিছানায় ফেলে ব্যান্ডেজ জড়ানো হাতেই ওড়নাটা হিঁচড়ে খুলে ফেলে। হাতের ক্ষততে বোধহয় টান লাগতেই মুখ কুঁচকায়। মাথার ব্যান্ডেজর ওপর রক্তের তরল দেখা দেয়। কারণটা বোঝা যায়না। প্রথমে একটা চুমু ঠিক কণ্ঠনালির ওপর খেয়ে মুখ তুলে আস্তে করে বলে, “মোহরানা বাকি রইল। পরে শোধ করব সেসব।ʼʼ
সে-রাতে জয়কে খু-খার জঙলির খাদকের মতো লেগেছিল। অন্তূর চোখের আর্তনাদ, হাতের প্রতিরোধে জয় বোধহয় শক্তি পাচ্ছিল আরও। ধীরে ধীরে জয় যত উত্তাল হলো, ওর কপালের ব্যান্ডেজে তাজা রক্তের দাগ গাঢ় হচ্ছিল।
অন্তূর কান্না পেয়েছিল, কতকিছু ভাবনা এসেছিল। কিন্তু সে কাঁদেনি, অন্তত জয়ের সামনে না। একদিন এরকম কিছুরই আশঙ্কাকে জনগণ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে কত কী করে ফেলছে! এই পর্যন্ত এনে ফেলেছে ওকে। অথচ আজ আসলেই তেমন কিছু হচ্ছে। জয় নামক অভিশাপ আজ অন্তূকে ছুঁয়ে দিচ্ছে, তাও আবার দলিল আছে হালালের। কিন্তু কেউ আজ ধরতে আসছে না, বদনাম রটতে আসছে না। আচ্ছা আজ বলাৎকার হচ্ছে না? অন্তূর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে ছোঁয়া হচ্ছে। ওহ! আজ তো জয়ের কাছে হালাল সার্টিফিকেট আছে।
জয় শুয়ে পড়ার পর অন্তূ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। তার শরীরে তখন জয়ের বিশাল শালটা জড়ানো। এই বারান্দা দিয়ে বাঁয়ে তাকালে বাড়ির সামনের রাস্তা দেখা যায়। আর ডানে বাড়ির পিছনের পতিত জায়গা। বেশ কিছুক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে রইল ওভাবেই। আব্বুর কথা মনে পড়লে এখন আর কান্না পায়না। কলিজাটা চিড় ধরে, তবে ফোট ফাটে না। আজ ফাটল। ঝরঝর করে অশ্রু গড়ালো চোখ দিয়ে। নিজেকে খুব অপবিত্র লাগছিল। খুব গভীরভাবে লেগে আছে জয় আমিরের ছোঁয়া গোটা দেহে।
দূরে কোথাও বাচ্চা কাঁদছে। কেউ কাঁদছে। অন্তূ চমকালো। এত রাতে আবার কে কাঁদছে? করুণ সেই স্বর। কোথা থেকে আসছে কান্নার আওয়াজ? গা-টা ছমছম করে ওঠে। ঘড়িতে তখন রাত চারটা। আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল অন্তূ। ভেতর থেকে জড়ানো গলায় জয় ডাকে, “ঘরওয়ালি? ভেতরে এসো। এত রাতে মেয়ে মানুষ বাইরে দাঁড়ানো ঠিক না।ʼʼ
অন্তূ জবাব দেয়, “অভিশাপ তো ভেতরে শুয়ে আছে, জয় আমির। বাইরেটাই বরং আমার জন্য নিরাপদ।ʼʼ
চোখ বুজেই ঠোঁট এলিয়ে হাসে জয়, “ভুল বলোনি। তবে এটা আমার বিশেষত্ব।ʼʼ
চলবে..
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৩৬.
ব্যান্ডেজ থাকা অবস্থায় গোসলে সমস্যা হচ্ছিল জয়ের। ক’দিন ওভাবেই গোসল করেছে। গোসল না করে থাকতে পারেনা কিছুতেই। একদিন বেশি বিরক্ত হয়ে একটানে ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে দেওয়ার সাথে সাথে র-ক্ত বের হয়ে এলো ক্ষত থেকে। ওপরের চটা উঠে গেল কাপড়ের সাথে। অভ্যাসবশত চিৎকার করে ডাকল, “তরুউউউ…!ʼʼ পরে বিরবির করল, “যাহ! শালা, ভুল বাড়ির কলিংবেল চেপে ফেলেছি। বউয়ের হাতে ঝাটার আদর খাওয়ার মোক্ষম সুযোগ। এমনিতেই আমার যে খান্নাস বউ!ʼʼ ভুল শুধরে অন্তূকে ডাকল।
অন্তূ আসবেনা, সেটা জানা কথা। জয়ের ডাক শুনে সে আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অবসরে বসে থাকলে, কাজ তৈরি করে নিয়ে সেই কাজে মন দেয়। সেদিন রাতে ওষুধ দেবার জন্য ডাকল জয়। অন্তূ কোয়েলের সাথে খেলছিল। কোয়েলকে রেখে শো-কেসের সকল শোপিস নামিয়ে আবার সেগুলো ঝেরে পরিষ্কার করতে শুরু করল। জয়কে ওষুধ দিয়েছে হামজা, পানি গরম করে দিয়েছে রিমি।
সকাল সকাল ভার্সিটি গিয়ে ঘুরে এসেছে একবার। কপালে মেডিটেপ লাগানো। এরপর ফিরে কোনোমতো খেয়ে আবার ক্লাবে গেছে। ক্লাবের মেরামত চলছে। হরতালে হাইওয়ে বন্ধ প্রায়। মোড়ের ওপর চায়ের দোকানে বসে দু-কাপ চা খেয়ে, একটা কড়া জর্দা মেশানো পান চিবোতে চিবোতে বাড়িতে ঢুকলো। পানের পিক ফেলতে গিয়ে তা লেগে গেছে সাদা লুঙ্গিতে। ওয়ার্কশপে কাজ চলছে। সেখানে ঢুকে আবোল-তাবোল কিছুক্ষণ ঠুকঠাক কাজ করল। লোহার দন্ড বানানো হচ্ছিল। আগুন থেকে গলিত লোহার পিন্ড উঠতেই তাতে চোখ আঁটকালো ওর। টকটকে লাল, গলিত আগুন যেন। দৌড়ে গিয়ে হাতুর তুলে পেটাতে আরম্ভ করল সেটাকে। বেশ মজার কাজ শীত শীত এখনও আছেই প্রকৃতিতে। তবুও ঘেমে গা ভিজে উঠল।
কাঁচা ফুলগুলো শুকিয়ে মড়মড়ে হয়ে গেছে। হামজা পৌরসভর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবার সময় অন্তূ ডাকে, “মেয়র সাহেব!ʼʼ
হামজা থামে। পাঞ্জাবীর হাত গুটিয়ে বলল, “কিছু বলবে?ʼʼ
-“ফুলগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। আমি খুলতে পারছি না। শক্ত করে সেট করা হয়েছে ওগুলো। একটা লোক পাঠাবেন, ওগুলো খুলে দিয়ে যাবে।ʼʼ
হামজা বেরিয়ে যেতেই শাহানা বললেন, “এইভাবে কথা বলতে শিখছো?ʼʼ
-“কীভাবে?ʼʼ
-“বড়ভাই ডাকা যায় না? ‘মেয়র সাহেবʼ কী?ʼʼ
-“বড়ভাই একটা ছিল। সেটাকেই ডাকা হয়নি বহুদিন। তাছাড়াও কাউকে সম্বোধন আমি আমার মনমতো করি, মামিমা। উনি মেয়র, মেয়র ডাকলে ক্ষতির কিছু নেই। ভুল বলেছি?ʼʼ
ফুলগুলো যেভাবে আঁটকানো হয়েছে, বিছানার ওপর বো-মা পড়লেও তার ছিঁড়বেনা যেন। তোষক তুলতে হলো। ছেলেদুটো তোষক উচু করে তুলতেই খাটের ক্লেটের ফুটো দিয়ে কিছু চোখে পড়ল অন্তূর। দ্রুত থামালো ছেলে দুটোকে। আদেশ করল, ক্লেটগুলো টেনে তুলে ফেলতে।
খাটের ক্লেটের নিচে মেঝের ওপর সারি সারি টাকার বান্ডিল সাজানো একপাশে। এত টাকা যে কেউ একসাথে দেখেনি জীবনে। বাকিটা রিভলবার, পিস্তল, রাইফেল ইত্যাদি ধরণের অ-স্ত্র-তে সজ্জিত। অন্তূ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ক্যাটারিংয়ের ছেলেদুটো যেন জমে গেছে। জয়ের পদচারণার আওয়াজ আসে। সে গান গাইতে গাইতে ঢুকছে,
এই আছি এই নাই, হাসি গাই কষ্ট ভুলে যাই
জীবনটা সিগারেটের ছাই, ছোক দিয়ে তাকে উড়াই
কী হবে ভেবে আর, যে জীবন দম গেলে নাই…
মুখে পান থাকায় গান জড়িয়ে যাচ্ছিল কণ্ঠে। চট করে থেমে হেসে ফেলল ঘরের অবস্থা দেখে। ছেলেদুটোকে চলে যেতে আদেশ দিয়ে অন্তূর খুব কাছে পেছনে এসে ফিসফিস করে বলল, “চেনো, ওগুলো কী?ʼʼ
অন্তূ ছিটকে দূরে সরে যায়। কয়েকবার মুখ চিবিয়ে থুহ করে পানের পিক ফেলল ঘরের ভেতরেই। পরে বলল, “আমি ছুঁলে ফোঁসকা পড়ে যায়, ঘরওয়ালি?ʼʼ
-“ঝলসে যায়। আপনি ছুঁলে ক্ষয় হয়ে যায় যেকোনো কিছুই, তা তো জানেন!ʼʼ
-“একেই বলে ঘরের বউ। কয়দিন হয়েছে, এর মধ্যে একদম মুখস্ত করে ফেলেছ আমায়, হ্যাঁ?ʼʼ
-“এই টাকা কীসের?ʼʼ
মুখ ঝামটি মারল, যেন মোটেই কোনো ভালো জিনিস নয়, নাক কুঁচকে নাটক করে বলল, “জাল টাকা। নজর দিলে চোখের ক্যালরি লস। লাভ নাই। পলাশের মাল সব।ʼʼ
অন্তূ সম্মতি জানালো, “আমিও ভাবছিলাম, বাংলাদেশে লিগ্যাল পয়সায় বড়জোর ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা যায়, সেটাও র-ক্ত ঘাম করে ঝরিয়ে। কিন্তু আপনারা ভালো কোনো পজিশন না পেতেই এত ফুলে ফেঁপে উঠেছেন, সোর্সটা কী? জাল টাকার ব্যবসা! ওয়াহ! হাততালি আপনাদের জন্য। পলাশ আপনাদের পার্টনার?ʼʼ
জয় বুকে হাত রেখে মাথা নত করল, যেন সে তার কর্মের বাহবা নিচ্ছে, প্রশংসায় বুক ভরে উঠেছে তার। এরপর বলল, “অথচ তোমার জন্য সেই পার্টনারের সাথেও তিড়িংবিড়িং করেছি। তবুও তোমার ভেতরে কোনো কৃতজ্ঞতা নেই। পেলাম তার বদলে থুতু। এটা কি ঠিক?ʼʼ
অন্তূ গর্বে বুক ফুলিয়ে বলল, “তার বদলে আমিও পেয়ছি, অনেককিছু পেয়েছি। কী পেয়েছি, জানেন?….থাক ওতসব প্রাপ্তি খেয়ালে এলে র-ক্তে জ্বালা ধরে যায়। পাপ কাজের দুর্দমনীয় ইচ্ছেরা খুব জ্বালায় আমাকে। হাতটা আরেকটু শক্ত হোক। মুখে যতই যা বলি, হাত কিন্তু এখনও নরম রয়ে গেছে আমার।ʼʼ
দাঁতকপাটি আঁটকে বলল জয়, “থুতু কেন দিয়েছিলে আমায়?ʼʼ
-“প্রথম থেকে শুরু করে পলাশ আমার সাথে যা যা করেছে আপনার সামনে, আপনি বাইস্কোপ দেখছিলেন?…ʼʼ
কথা কেড়ে নিলো জয়, “তুমি আশা করেছিলে আমার কাছে?ʼʼ
আক্রোশে মুখ লাল হয়ে ওঠে অন্তূর, “এক মুহুর্তের জন্য আমি আপনাকে মানুষ ভাবতে চেয়েছিলাম সেদিন। নিজের স্বার্থে মানুষ কত সত্যি ভুলে যায়। আমিও ভুলে গেছিলাম, আপনি জঙলি। এরপর পরিস্থিতি যখন চরমে, তখন এসে জীবন দান করছেন…! ব্যাপারটা কেমন হলো বলুন তো, বলির পাঠাকে যত্নে লালনের মতো। ঠিক বলিনি?ʼʼ
পান চিবোতে চিবোতে মুচকি হাসি ঠোঁটে রেখে মাথা নাড়ল জয়, “ঠিক বলেছ।ʼʼ
অন্তূ দৃঢ় চোখে তাকিয়ে শান্তভাবে বলল, “শুকরিয়া আদায় করুন, এই যে এতগুলো দিন নির্দিধায় রাতে মাতাল হয়ে ঘুমান, বন্ধ ঘরে। সেই সুযোগে আপনার গলাটা কেটে দুইভাগ করে ফেলিনি। ওটা খুব সস্তা কাজ হয়ে যাবে। মাঝেমধ্যেই ইচ্ছে করে, তবে আপনাকে ওভাবে মারাটা খুব নিচু কাজ হবে। আপনি জানেন, আপনি থুতু পাবার কতটা যোগ্য। ইউ নো হোয়াট! একে বলে বাটারফ্লাই ইফেক্ট। সেদিন থুতু দেবার মতো ছোট্ট একটা কোএন্সিডেন্স থেকে আমি-আপনি বহুদূর পৌঁছাবো, দেখবেন। তার মূলে থাকবে এক বন্ধ রাত, এক অবরুদ্ধ নিশীথ। তার ফলে নেমে আসবে হাজারও অবরুদ্ধ নিশীথ, যার সংমিশ্রণে থাকবে একেকটা অবরুদ্ধ নিশীথ।ʼʼ
একদৃষ্টে চেয়ে থেকে ছোট ছোট শব্দে হাসতে হাসতে হো হো করে হেসে উঠল জয়, “এতদিনে লাইফে এডভেঞ্চার এসেছে। সেই কবে বন্দি দশা ছেড়েছি, এরপর আর কেউ আঁটকাতে পারেনি আমায়। শালার…ঘরে মউত নিয়ে জীবনযাপনের চেয়ে বড় এডভেঞ্চার আর হয়-ই বা কী? হু দ্য ফা-কিং সে, লাইফ ইজ আগলি? ইজ দেয়ার ইজ সাচ এন এডভেঞ্চার ইন লাইফ, এক্সাক্টলি হেয়ার ইজ দ্য আলটিমেট ফান ইন লাইফ!ʼʼ
অন্তূ প্রলম্বিত এক শ্বাস টেনে বলল, “এগুলো?ʼʼ
খুব উৎসাহিত হলো জয়, “এগুলো? চেনো না? শ্যাহ! এত ভালো হওয়া ঠিক না। ওগুলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মাল। কালাশ’নিকাভ-এর ডিজাইন করা রাইফেল, AK-47। চালিয়ে দেখবে একটা? বের করব? আমার ওপরেই চালাও একটা, যাও, হাত শক্ত হোক.. কপালে মেরো না। পায়ে-টায়ে মেরে চর্চা করো… বের করি দাঁড়াও…ʼʼ
অন্তূ চোখ বুজে গাঢ় শ্বাস ফেলল। তার কাছে এটাকে বাড়ি কম, জাহান্নাম বেশি লাগতে শুরু করেছিল এই সময়টাতে। একের পর ঘটনাগুলো খুব বিষণ্ন করে তুলছিল অন্তূকে। মানসিক ভাঙন ধরে যাচ্ছিল মাঝেমধ্যেই। জয়কে মারার আগে ওকে আবিষ্কার করার একটা অদম্য কৌতূহল ছুটে বেড়াচ্ছিল রন্ধে রন্ধে।
—
একরাতে খেতে বসে ছোট মাছের তরকারী মুখে নিতেই মুখ চেপে ধরে উঠে যায় তুলি। বেসিন অবধি পৌঁছানোর আগেই গলগলিয়ে বমি করে ফেলে। তরু দৌড়ে গিয়ে ধরে।সেদিন জানা গেল, তুলি গর্ভবতী। আড়াইমাস চলছে। কাউকে জানায়নি। তরু যেহেতু সাথে থাকে, তরু জানতো শুধু। তুলি জানাতে দেয়নি কাউকে।
অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “কতদিন হলো এসেছেন এখানে?ʼʼ
-“দুইমাস পেরিয়ে যাচ্ছে।ʼʼ
অন্তূ বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “কী হয়েছিল, বা সমস্যা কী, জিজ্ঞেস করলে কি অনধিকার চর্চা হয়ে যাবে?ʼʼ
তুলির বোধহয় কান্না পেল। কাঁদল না। তরু কোয়েলকে নিয়ে ছাঁদে উঠে যায় কবুতর দেখাতে। তুলি বলল, “প্রেমের বিয়ে ছিল। যতদিন মেয়ে হয়নি, হামজা ভাই মেনেই নিয়েছিল না। অথচ ওর কাছে রোজ সীমান্তর যাওয়া-আসার মাঝ দিয়েই সম্পর্ক হয়েছিল আমাদের। সীমান্ত ভাবীর কাজিন। মেয়ে হবার পর যখন এ বাড়িতে আসা যাওয়া শুরু করলাম, তারপরও ভালো ছিল। কিছুদিন পর থেকে কথায় কথায় গায়ে হাত তুলতো। কোনোদিন এ বাড়িতে বলিনি। সেই সুযোগ ছিল না। আব্বু তো বাড়ির ধার ধারেনা। সব হামজা ভাই। কিন্তু ওকে কখনও এসব বলার সাহস হয়নি। ভুল আমি করেছি, ও তো কোনোকালেই মেনে নেবেনা এসব। পরে বুঝলাম, ঝন্টু মামার নির্দেশ এসব।ʼʼ
-“ঝন্টু সাহেব মাজহারের বাবা না?ʼʼ
-“আমার মামা শ্বশুরও। রিমি, মাজহারের বড়ফুপুর ছেলে আমার স্বামী।ʼʼ
-“এরপর?ʼʼ
-“আমি ভাবতাম, আমার ওপর অত্যাচার করতো যাতে আমি হামজাকে মাজহারের বিরোধিতা করা থেকে থামাই। রাজনীতিকে ঘেন্না করার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ দুটো নেই আমার কাছে। কিন্তু র-ক্তে জড়িয়ে থাকা এই নষ্ট নীতিকে এড়িয়ে চলতে আর পারলাম কই!
নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসার সাথে সাথে তা আরও বেশি খারাপদিকে গেল। আমি যেকোনো কিছুতে বাঁধা দিতে গেলেই অমানুষিক অত্যাচার সঁয়েছি। নেশা করা, স্মাগলিং, মানুষ মারা, চাঁদাবাজি—সহ্য করতে পারতাম না আমি। আর কত? মারও খেয়েছি গা ভরে। ভালোই লাগতো, জানো? কারণ আমার তো যাওয়ার জায়গা নেই। কোথায় যাব, যেখানে আসব, এখানে সেসবের ঘাঁটি গাড়া। তবুও মেয়েকে রেখে চলে এলাম। অথচ কিছুই জানানোর রুচি হয়নি।ʼʼ
-“শুধুই মারধর করতো?ʼʼ
-“নেশাও করে। মারাত্মক নেশা। আমি এবোর্শান করিয়ে ফেলব, আরমিণ। আমার মনেহয় আমার ছেলে হবে। বাপের ছেলেও যদি বাপের মত হয়? ওকে দুনিয়াতে আনার ইচ্ছে নেই। ওই বাপের ছেলে হয়ে ও দুনিয়াতে না আসুক। আমি বহুদূর চলে যাব এসব থেকে। আমার ভাল্লাগেনা। আই কান্ট টলারেট এনিমোর…ʼʼ উত্তেজিত হয়ে ওঠে তুলি।
অন্তূ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাধারণ মানুষের কাছে এসব বেশ অজানা। অথচ উচ্চশ্রেণীর মানুষের সমস্যাগুলোও কেমন উচ্চ উচ্চ পর্যায়ের। এসবের মাঝে আছে কী? নে-শা, র-ক্ত, নোংরামি, বিশ্বাসঘাতকতা, অনাচার, অবিচার, লোভ, প্রতিহিংসা…! সেই বা এসব থেকে কম কীসের? এই সকল লোকদের বউদের অন্তূ আগে বেশি ঘেন্না করতো—তারা থামাতে পারেনা পুরুষদের? আজ সে নিজে কোথায়? সে কী করতে পারছে? নিজের ওপর ঘৃণা চেপে যায় অন্তূর।
বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আবারও ভাবে বিষয়টা। রাজনৈতিকতায় ভালো কি কিছুই অবশিষ্ট নেই আর? এত হাহাকার কেন? এর সাথে জুড়ে থাকা মানুষগুলো এত নোংরা কেন? সবাই কি নোংরা? ভালো নেই কেউ?
তুলির শরীরের অনেক দাগ দেখেছে অন্তূ। সেসব দেখলেই অন্তূর মন চায়, বউকে আঘাত করা পুরুষদের কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দিতে। পরে মনে পড়ল, তার সাথে কী হচ্ছে? সে জয়কে মেরে ফেলেছে? অন্তূ চিটমিট করে উঠল নিজের ওপর বিতৃষ্ণায়। আজকাল নিজেকে সহ্য হয়না অন্তূর। নাপাক, নির্লজ্জ, আত্মমর্যাদাহীন রাস্তার মেয়ে মনেহয়। ‘মূল্যহীন পতঙ্গʼ বলে মাঝেমধ্যেই ডেকে ওঠে নিজেকে।
—
জয় বাড়িতে ঢুকে রুমে আসেনা প্রথমে। ডাইনিং স্পেস পেরিয়ে ওপারের স্টোরের দিকে যায়। বহুবার হামজা এবং হুমায়ুন সাহেবকেও যেতে দেখেছে অন্তূ। নেশা করতে যায় নিশ্চয়ই তিনজনই! জায়গাটায় যাওয়ার রুচি আসেনি কখনও অন্তূর। এ বাড়িতে অনৈতিক কাজ হয় সেটা ধরে ফেলেছে অন্তূ। পেপার পড়ে অন্তূর কাছে তার বিশদ ব্যাখ্যা করা আমজাদ সাহেবের স্বভাব ছিল। অ-স্ত্রের ব্যবসা নাকি রাজনীতিবিদের লেওয়াজ ছাড়া স-ন্ত্রা-সরা করতে পারেনা, অন্তূ শুনেছে আব্বুর কাছে। কারণ প্রশাসন রাজনীতিবিদদের চেটে বাঁচে। প্রশাসনকে হাতে রেখে নিজেদের ধান্দা চালাতে রাজনীতিবিদের যদি অল্প কিছু ভাগ দিলেই চলে, তো স-ন্ত্রা-সরা সংসদের এই জিহ্বা বের করে শ্বাস নেওয়া কুকুরগুলোকে হাতছাড়া করবে কোন দুঃখে?
এই পাটোয়ারী বাড়িটি হলো একটা অস্ত্র সংরক্ষণাগার, জাল টাকার বাক্স, শয়তানের নিরাপদ বাসস্থান। অন্তূর দমফাটা হাসি আসে এসব ভাবলে। আরেহ! কী বুদ্ধি এদের! প্রশাসনের সাহস কী যে, কোনো পলিটিশিয়ানের বাড়িতে হানা দেয়? রেড মারে! তল্লাশি চালায়! সরষের মধ্যে ভূত! সেই সরষে দিয়ে দেশের ভূত ছাড়াতে গেলে ব্যাপারটা যেমন হওয়া উচিত, তেমনই হচ্ছে, সেভাবেই পরিচালিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলা, জয় বাংলা। পুলিশফাঁড়িতে ড্রাগ, অস্ত্র, নারী, শিশু পাচারের কারখানা— এমন কাহিনি পুরোনো। সাথে এটাও পুরোনো, যে সাদা খানদানী পোশাকে আবৃত জনদরদী, নেতাগোছের মানুষগুলোর শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত বাড়িগুলোও একই কাজে ব্যবহৃত হয়। অন্তূ ভুল ঠিকানায় চলে এসেছে। অথবা হতে পারে, ভুল ঠিকানাকে সঠিক করে তুলতে জানটা হারাতে হয়!
জয় মদ গেলে সোফায় বসে। এক প্যাগ করে ঢালে, গ্লাস উচিয়ে ধরে অন্তূকে বলে, “এক সিপ নেবে?ʼʼ
অন্তূ বলে, “আপনি অভার-ডোজ খেয়ে মরে যান, প্লিজ।ʼʼ
জয় গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি মরলে তোমার কোনো লাভ নেই।ʼʼ
অন্তূ তাচ্ছিল্য করে হাসে, “লাভ!ʼʼ গাঢ় চোখে তাকিয়ে বলল, “মানুষের মতো দেখতে আপনার মতো জঙলি পশুগুলো আরও কত মানুষের অমানুষ হয়ে ওঠার কারণ হয়! দেখেছেন, কতটা নিচে নামিয়েছেন আপনি আমায়, কারও মৃত্যু কামনায়ও কী এক অদ্ভুত সুখ পাচ্ছি! দিনদিন ঠিক আপনারই মতো র-ক্তচো-ষায় পরিণত হচ্ছি।ʼʼ
জয় হেসে ফেলল, “আমার মৃত্যু কামনা করার লোকের অভাব নেই। অত ভিড়ের মধ্যে তোমার নামটা নিমেষেই হারিয়ে যাবে। অন্যকিছু কামনা করো। এই যেমন ধরো, পঙ্গু হয়ে যাওয়া, কুষ্ঠোরোগে আক্রান্ত হওয়া, প্যারালাইজড হয়ে পড়ে থাকা—এসব।ʼʼ দুই চুমুক গিলে আবার বলল, “আর বললেই তো আর এখনই মরে যাওয়া যায়না! কয়দিন পর মরব। কিছু কাজ বাকি।ʼʼ
-“কয়দিন পর কেন?ʼʼ
-“তুমি আর কয়দিন বেঁচে থাকো।ʼʼ
-“আমাকে সাথে নিয়ে মরবেন?ʼʼ
-“হ। নয়ত পরে যদি আবার আমি মরার পর আমার সম্পত্তি নিয়ে অন্যকারও সাথে ভেগে যাও?ʼʼ
-“আপনার কোনোকিছুকেই কিছু মনেহয় না, না? অল ইজ ওয়েল, অল থিংস আর নরমাল, ফাইন!?ʼʼ
জয় মাথা দুলিয়ে গানের তালে নাচার মতো চোখ বুজে হাসল, “অভিজ্ঞতা বেশি তো! বহুতকিছু দেখেছি, বহুত কিছু ঘটেছে আমার সাথে।ʼʼ চোখ মারল অন্তূকে। এরপর হো হো করে হেসে ফেলল।
জয়ের পুরো শরীরে বিশ্রী সব দাগ আছে। গোসল করে যখন খালি গায়ে বের হয়, উন্মুক্ত দেহটা কী যে ভয়ঙ্কর লাগে দেখতে! অত ভয়ানক দাগ কীভাবে হয়েছে তা মেলাতে পারেনা অন্তূ। জিজ্ঞেস করল, “শরীরের দাগগুলো কীসের?ʼʼ
জয় বাচ্চাদের মতো অন্তূকে মুখ ভেঙচালো, “কীসের দাগ ওগুলো?ʼʼ বেশ ভাব নিয়ে বলল, ”ইশপেশাল ট্যাট্টু। এই ট্যট্টুগুলো শরীরে খোদাই হবার সময় যা লেগেছিল না! উফফ!ʼʼ রসিকতা করে উচ্চারণ করল কথাটা। ভ্রু নাচিয়ে বলল, “ভালো না?ʼʼ
অন্তূ আবারও খেয়াল করে, চটা ধরা ডান ভ্রু-র চুলের ভেতরে একটা গভীর ক্ষত আছে জয়ের। কাছে না গেলে খেয়াল করা যায়না। বিয়ের পর বিষয়টা নজরে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে বলল, “সকালে উঠে সারাদিন আবার বহু পাপ করতে হবে আপনার! আপনার বোধহয় মাথায় চড়ে গেছে। শুয়ে পড়ুন।ʼʼ
জয় হাসল, “দুই-চার বোতলেও চড়বেনা। এই মদ শালাও ভীষণ ধরিবাজ। মাতাল হবার জন্য খাই, এত টাকা খরচা করে কিনি, অথচ মাতাল করেনা। তোমার মতোই। বিয়ে করলাম, দেনমোহরবাবদ নাকি টাকা দিতে হবে, আবার বস বসে খাওয়াচ্ছি তিনবেলা, পোশাক, যাবতীয় খরচা দিচ্ছি। কোনো কামে তো আসোই না, আবার একটু কাছে গেলে কারেন্ট লাগা রোগীর মতো ঝিরঝির করে ওঠো। লস প্রজেক্ট।ʼʼ
অন্তূ বিছানায় জয়ের দিকে মুখ করে শুয়ে গায়ে চাদর তুলে নিয়ে বলল, “খুন করেছেন কয়টা?
-“বেশি না।ʼʼ
-“প্রথমটা কবে করেছিলেন?ʼʼ
জয় ঘাঁড় ম্যাসাজ করতে করতে বিরবির করল, “শালী ইন্টারভিউ নিতে বসে গেছে রাত্তিরবেলা।ʼʼ বোতল ধরে কয়েক ঢোক গিলে বলল, “উমমম….২০০১ এ সম্ভবত। বয়স তখন পনেরো বছর আমার যতদূরসম্ভব। ক্লাস টেনে ছিলাম, আমি।ʼʼ
অন্তূ ভ্রু কুঁচকাল। ২০০২-এ সংসদে ছিলেন বিরোধীদল। আর উপদেষ্টা ভূমিকায় ছিল জামায়াতে ইসলামী। সেই সময় জয় কাকে খুন করেছে? পনেরো বছরে মানুষ খু-ন! আর কী কী করে রেখেছে জয় আমির!
—
বেলা না পেরোলে ঘুম ভাঙেনা জয়ের। অন্তূ সকাল সকাল উঠে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে রিমি আর কাজের মহিলা রান্না করছে। রিমি বলল, “আরমিণ, জয় ভাইয়ার বাগানে লেবুগাছ আছে। কয়েকটা লেবু ছিঁড়ে এনে দিন। সাব-মার্সিবল অন করে জগগুলোও ভরে ফেলুন। মেয়র পৌরসভায় যাবে।ʼʼ
ডাইনিং রুমে তরু বসে ছিল। মটরশুটি ভাঙছে একমনে অন্তূ গিয়ে কিছুটা তুলে নিয়ে বলল, “তোমার আমার ওপরে রাগ অথবা ঘেন্না, কোনটা বেশি প্রকট?ʼʼ
মুখ না তুলে বলল তরু, “কোনোটারই অধিকার নেই।ʼʼ
-“রাগ, ঘৃণা, পছন্দ, ভালোবাসা…এসবের জন্য অধিকার লাগেনা। অধিকার অভিমান, অনুরাগ, অনুযোগ, অভিযোগে লাগে। তোমার অনুভূতি আমার ওপর অভিমান টাইপের না। ঘৃণা টাইপেরই হবে কিছু!ʼʼ
তরু চোখ তুলল, “কারণ নেই কোনোটারই। তবুও তা কেন মনে হলো?ʼʼ
অন্তূ অদ্ভুতভাবে হাসল, “চোখ লুকাতে খুব কাঁচা, অদক্ষ তুমি।ʼʼ
তরুর চোখে এবার পানি উপচে পড়তে চায়। পানি যেন সবসময় সেখানে মজুতই থাকে। অন্তূ সামনে এলে তার বাঁধ ভাঙে। ওড়নার প্রান্তটা মাথার ওপর তুলে আঁচল হাতি ধরে বেরিয়ে যায় অন্তূ। টুপ করে একফোঁটা পানি পড়ে তরুর চোখ বেয়ে।
বাগনটা বেশি বড় না। ফুলগাছ নেই। এ বাড়িতে ফুল বোধহয় কারও পছন্দ না। তিনটা লেবু পেড়ে আরেকটু এগিয়ে যেতেই একটা লোহার গেইট। অন্তূ ভ্রু কুঁচকায়। প্রাচীরঘেরা জায়গাটায় শেষ প্রান্ত ঘেঁষে গেলেই ওয়ার্কশপের বিশাল এড়িয়ার দেয়াল। তাহলে বাড়ির পেছন দিকে এই দরজা কীসের? বাড়ির নকশাটাই অদ্ভুত। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে দেখেও কোনো সমাধান বা নকশা আয়ত্ত্বে এলো না। লোহার গেইটটা ধরে দু তিনটা ঝাঁকি দিয়েও লাভ হলোনা। বাইরে থেকে তালা মারা নয়। অর্থাৎ ভেতর থেকে আঁটকানো। এখানেও আবার কেউ থাকে নাকি?
আনমনে পেছন ফিরতেই থমকে দাঁড়াল অন্তূ। হামজা জিজ্ঞেস করল, “এখানে কী করছো?ʼʼ
-“এত নিঃশব্দে তো বিড়ালও পা ফেলতে পারেনা, মেয়র সাহেব! তার ওপর শুকনো পাতার ওপর হেঁটে এসেছেন!ʼʼ
-“আরও অনেককিছুই পারি আমি। আপাতত তোমার ধারণাও সে অবধি পৌঁছায়নি।ʼʼ
-“বলাবাহুল্য। অভিজ্ঞ মানুষদের কথাই আলাদা। আমার পিছু নিয়ে এসেছেন?ʼʼ
-“তুমি নিজেকে খুব দক্ষ গোয়েন্দা ভাবছো?ʼʼ সূক্ষ্ণ হাসল হামজা।
-“উহু! কৌতূহলি হয়ে পড়েছি আপনাদের বাড়িতে এসে।ʼʼ
-“কৌতূহলি বিড়ালের সামনে ফাঁদ ছাড়া অন্যকিছু থাকার সম্ভাবনা খুব কম।ʼʼ
-“বিড়ালকে ফাঁদে ফেলার এমন কী দরকার?ʼʼ
-“মাছ না খেয়ে যায়।ʼʼ
অন্তূ হেসে ফেলল, “আপনি কি ভয় পাচ্ছেন আমায়, মেয়র সাহেব?
-“তুমি হালকাভাবে নিচ্ছ আমায়।ʼʼ
-“ছিহঃ! এতবড় ভুল আমি কখনোই করব না।ʼʼ
-“এই-যে নজরদারী! এটাও তো মস্তবড় ভুল।ʼʼ
-“ভুল জীবনের চালিকাশক্তি। যে ভুল করতে ভুলে যায়, তার জীবন ওখানেই থেমে যায়। ভুলের পেছনে ছুটেই তো আমরা পরিণতিতে পৌঁছাই।ʼʼ
হামজা এবং অন্তূর একটা দূর্জ্ঞেয় দৃষ্টি বিনিময় হয়। হামজা কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেসে ফেলল, “তোমাকে বিয়ে দিয়ে এনেছিলাম কেন, বলো তো!ʼʼ
-“আমাকে আটকাতে। আপনি জানতেন আমি বাইরে থাকলে, আমার ওপর নজর রাখা একটু টাফ হবে। তাই পাশের ঘরে এনে রাখলেন! ভুল করেছেন, বিশাল ভুল।ʼʼ
-“ভুল জীবনের চালিকাশক্তি।ʼʼ অন্তূর বলা কথাটা অন্তূকে মনে করিয়ে দিয়ে চোখ মারল হামজা।
—
রাতের বেলা হাইওয়ে ব্রিজে দাঁড়িয়ে হামজা জয়কে বলল, “বাঘিনীর চেয়ে আহত বাঘিনী বেশি ভয়ানক হয়। কমন তবে গুরুত্বপূর্ণ কথা। তোর বউকে নিয়ে বিপত্তি বাঁধবে দেখছি।ʼʼ
হাসতে হাসতে “মেরে ফেলব?ʼʼ কথাটা এমনভাবে বলল জয়, দুজনের চোখাচোখি হওয়ায় হো হো করে গা দুলিয়ে হেসে ফেলল।
-“তুই কি প্রেমে পড়ে যাচ্ছিস?ʼʼ
-“দেখতে, শুনতে ভালো। শরীরটা টানে, কিন্তু শালি খুব কড়া। প্রেম-টেম টের পাচ্ছিনা।ʼʼ
-“পড়লেও বেশি পড়িস না।ʼʼ
-“আচ্ছা।ʼʼ পিচ করে এক খাবলা থুতু ফেলল ব্রিজের নিচে।
-“মেয়েলোকের প্রেমে পড়া আমাদের শরীরের জন্য হানিকারক।ʼʼ
দুজন বেশ কিছুক্ষণ পাগলের মতো দম ছেড়ে হাসলো। থামেই না হাসি। উল্টাপাল্টা কী কথা বলে আবার হাসে। জয় প্রস্তাব দেয়, “রাস্তা ফাঁকা। চলেন, একটা দৌঁড় প্রতিযোগীতা হয়ে যাক।ʼʼ
বহুদিন পর জয় ‘আপনিʼ সম্বোধন করল হামজাকে। হামজাকে রেখে ঝরঝর করে ‘রেডি, 1, 2, গোওʼ বলে ঝেরে দৌড় লাগায়। কিছুদূর পৌঁছে চিৎকার করে বলে, “আমি জিতে গেছি। তোমার শরীর ভারী হয়ে যাচ্ছে। বউয়ের সঙ্গ কমাতে হবে।ʼʼ
হামজা তেড়ে যায় জয়কে মারতে। জয় দৌড়াচ্ছে, বহুদূর দৌড়ে যায় দুজন। সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ। অল্প কুয়াশা। দুজন থেমে দুটো সিগারেট জ্বালায়। জয় গান ধরে,
ভেবে দেখেছ কি..তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে;
তারও দূরে, তুমি আর আমি ক্রমে যাই সরে সরে…
—
এক সকালে দোতলার দরজায় কলিং বেলে চাপ পড়ছিল। অন্তূ দরজা খুলল। ডাকপিয়ন দাঁড়িয়ে আছে। তুলির নামে পত্র এসেছে। রেজিস্টার করা পত্র। তুলি তখনও কোয়েলকে নিয়ে ঘুমাচ্ছিল। অন্তূ চিঠিটা গ্রহন করল তবে খুলল না। স্বভাব নেই তার এরকম।
দুপুর গড়িয়ে যাবার পর অন্তূর মনে পড়ল, তুলিকে চিঠি দেবার কথা। তুলি চিঠি খুলে ধুম ধরে বসে রয়। চোখে-মুখে প্রতিক্রিয়া নেই। অভিব্যক্তিহীন নজরে চেয়ে রইল দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারের দিকে। জানুয়ারীর ৩ তারিখ আজ। দেশ উত্তাল ঢেউয়ে ভাসমান। অবরোধ, হরতাল, র-ক্তার-ক্তিতে পিচের রাস্তা রঞ্জিত হয়ে উঠছে চারদিকে। সহিংসতা, বর্বরতার খবরে কান পাতা যায়না। তার মাঝ দিয়েও পারিবারিক, ব্যক্তিজীবনের টানপোড়েনে একটুও ভাঁটা পড়েনি। জীবনটা কেমন যেন! খুব পাগল, খুব এলোমেলো এই জীবনের পরিকল্পনাগুলো। ওর এসব পরিকল্পনা মোতাবেক পরিচালিত হতে হতে মানুষ কবে কবে যেন নিথর হয়ে যায় তবুও থামেনা জীবন।
অন্তূ পত্র খোলে। ডিভোর্স পেপার। জ্বলজ্বল করছে এক সিগনেচার—সীমান্ত এহমাদ। তুলির সিগনেচারের জায়গা ফাঁকা।
চলবে…