[সতর্কতা: পুরো পর্বটি প্রাপ্ত মনষ্কদের জন্য।]
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৪০.
বিকেলের নরম রোদ দোতলার সিঁড়িঘরের জানালা পেরিয়ে চাঁদনীর মুখে পড়ছিল। কী যে মোহিণী লাগছিল দেখতে। অন্তূর কপালটা সন্তর্পণে কুঁচকে যায়। পা থেকে মাথা অবধি স্থির নজর ঘুরিয়ে দেখে বিস্ময়ে। ভ্রমের মতো লাগছিল।
আকাশী রঙা জামদানী শাড়ির পাড়টা সোনালী। দু-হাতে সোনালী রুলি বালা চাঁদনীর। বিশাল একটা খোঁপা করেছে ঘাঁড়ের ওপর। খোঁপাতে স্বর্ণালী মোড়ক। অন্তূ আন্দাজ করতে চায়, এটা ঠিক কতটা অভিজাত্যের পরিচয়! পরিমেয়, দুর্বোধ হাসি চাঁদনীর ঠোঁটে। ঊনিশ শতকের কোনো উচ্চ জমিদার বংশের ঠাকুরাইন/গিন্নি দাঁড়িয়ে আছে যেন তার সম্মুখে। দুটো দাসী সাথে। চাঁদনীর এই রূপ অন্তূর ভেতরে হাজারও সংশয় তৈরী করে। শাড়ির বিশাল আঁচলটা পিঠ পেঁচিয়ে এনে বাঁ হাতের তালুতে ধরেছে।
অন্তূর সূক্ষ্ণ পর্যবেক্ষক নজর এড়িয়ে চাঁদনী অদ্ভুতভাবে মুচকি হাসে, “তুমি কিন্তু এখনও আমায় ভেতরে আসতে বলোনি।ʼʼ রহস্যে ভিজে উঠছিল চাঁদনীর মুখখানা।
অন্তূ নজর নামায়, “আসুন।ʼʼ
চলনের ভঙ্গিমাই অন্যরকম চাঁদনীর। সেদিনের মতো স্লান নয় মুখশ্রী, হালকা প্রসাধনী আর অভিজাত্যে মেতে আছে চেহারাটা। রিমি চিনতে না পেরে তাকিয়ে থাকে। চাঁদনী সোফার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি কিন্তু বসতেও বলোনি, অন্তূ!ʼʼ চাঁদনীর চোখে-মুখে রহস্যের ঘনঘটা।
সোফায় বসে এদিক-ওদিক তাকাল চাঁদনী, “সকলে বাড়ি ফিরবে কবে?ʼʼ যেন সে সব জানে।
রিমি ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকে। সে চিনতে পারছে না মেয়েটিকে। এত ঐশ্বর্যপূর্ণ রূপ, নারীটি কে? আরমিণ পরিচিত বলেই মনে হচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণের পর্যবেক্ষণ ও নীরবতা কাটিয়ে অন্তূ স্থির গলায় প্রশ্ন করল, “কে আপনি?ʼʼ
হেসে ফেলল চাঁদনী, “তুমি চেনো আমায়।ʼʼ
-“ছদ্মবেশ! কিন্তু কোনটা ছদ্মবেশ? এটা অথবা ওটা?ʼʼ
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থেকে চাঁদনী মসৃণ হাসে, “তোমার কাছে কোনটাকে আসল আর কোনটা ছদ্মবেশ মনে হচ্ছে?ʼʼ
-“ধারণা নেই। কে আপনি?ʼʼ অন্তূর তির্যক নজর পলকহীন চেয়ে থাকে চাঁদনীর হাস্যবদনে।
-“নাশতার ব্যবস্থাও কিন্তু করোনি তুমি।ʼʼ
রিমির দিকে তাকাল অন্তূ, “নাশতা চলে আসবে।ʼʼ অন্তূর রাশভারী, গম্ভীর অভিব্যক্তি। নজর বুলায় চাঁদনীর ভূষনে, মুখে দৃষ্টি স্থির করে প্রশ্ন করে, “…..আপনি কে?ʼʼ
সুস্থির নজরে তাকায় চাঁদনী। খানিকক্ষণ চেয়েই থাকে অন্তূর দিকে। পরে বিন্যস্ত শব্দে উচ্চারণ করে, “রাজন আজগরের মেয়ে, রূপকথা আজগর আমি।ʼʼ
রিমি অবাক হলো। রাজন আজগরের মেয়ে এটা? এখানে কী করছে? আরমিণই বা চিনলো কী করে? অন্তূর নাকের পাটা ফুলে ওঠে, ভ্রুর মাঝে ভাঁজ পড়ে আলগোছে, “অর্থাৎ আপনি পলাশ আজগরের চাচাতো বোন?ʼʼ
-“বউ। পলাশ আজগরের বিয়ে করা বউ।ʼʼ স্থির কণ্ঠে বলে চাঁদনী। মুখে স্মিত হাসি।
অন্তূর বুকের স্পন্দন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে একটু। এক মুহুর্ত দম আঁটকে চেয়ে থাকে। রিমি ওদের কথোপকথনের অধিকাংশই বুঝতে পারছিল না। অথচ কিছু একটা আগ্রহ পাচ্ছিল। সে উঠল না নাশতার ব্যবস্থা করতে। বসে থাকল।
চাঁদনী অন্তূর নজর তাক করেই চেয়ে আছে। তার গোলাপী ঠোঁটে জুড়ে মৃদুমন্দ হাসি। হাসি বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “ঘেন্না লাগছে আমায়?ʼʼ
-“না। এখনও লাগছে না। যেহেতু পুরোটা জানিনি।ʼʼ
অন্তূর চিন্তাধারায় ধন্য হবার মতো হাসল রূপকথা, “সেদিন আমার সাথে কথা বলে তোমার আমার ওপর অনেক রকমের সন্দেহ কাজ করেছিল, ঠিক বলেছি?ʼʼ
অন্তূ নির্বিকার জবাব দেয়, “ঠিক বলেছেন।ʼʼ
-“চাঁদনীর চেহারার ঝলক দেখে সে যে ওই বাড়ির বউ, এতে সন্দেহ হয়েছিল, ঠিক বলেছি?ʼʼ
-“ঠিক বলেছেন।ʼʼ
-“চাঁদনীকে এসএসসি পাশ একটা সাধারণ মেয়ে মনে হয়নি। ঠিক বলেছি?ʼʼ
-“ঠিক বলেছেন।ʼʼ
“চাঁদনীর কথাবার্তা ওর অবস্থানের সাথে না মেলায় খুব সংশয় জেগেছিল ভেতরে। ঠিক বলেছি?ʼʼ
-“ঠিক বলেছেন।ʼʼ মুখস্ত পড়ার মতো কথা বলছিল অন্তূ।
রূপকথা হাসল, “তবে আমার কিন্তু সেই এক দেখায় তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছিল, সন্দেহ-টন্দেহ কিছু হয়নি। জানো?ʼʼ
-“না, আজ জানলাম।ʼʼ একরোখা তবে শান্ত কণ্ঠে বলল অন্তূ, “তাহলে সালমা খালা কি পলাশের মা?
রূপকথার হাসি বাড়ল, “বোকা অন্তূ! এজন্য বলা হয়, মানুষের বয়স যত বেশি হয়, যে যতদিন বেশি বাঁচে, তার অভিজ্ঞতা তত বেশি। কারণ মানুষ মরণের এক মুহুর্ত খানিক আগেও অসম্ভব এক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। তুমি যা জানবে, সেটাকে কখনোই চূড়ান্ত ভাবা উচিত নয়। তুমি যতক্ষণ বেঁচে আছো, প্রস্তুত থাকবে সম্পূর্ণ নতুন সব অভিজ্ঞতার জন্য, যার কোনো ধারণাও ছিল না আগে তোমার। পৃথিবী বৈচিত্র্যময়।ʼʼ
অন্তূ কথা বলল না। রূপকথা এবার শব্দ করে হাসল, “সালমা খালা যদি পলাশের মা হয়, আঁখি পলাশের বোন, সোহান পলাশের ভাই, তাহলে সোহেল কে?ʼʼ
অন্তূর ভেতরে অস্বস্তি প্রকট হয়ে উঠলেও চোখদুটো নির্লিপ্ত হয়ে চেয়ে রইল, “কে?ʼʼ
-“পলাশের চাকর। যাকে সে ওই বাড়িতেই খুন করেছে। সোহেলের বউকে দরকার পড়ল একসময় পলাশের। ছেলেটা রাজি ছিল না। সে আসলে জানতো না, খিদে পেলে বাঘ নিজের পাছার চামড়া কেটে খায়, আর পলাশ তো নোংরা কুকুর। নিজের লোকের বউকে ছাড়ার মতো নাকি সে? বেচারা মরল, বউটাও গেল।ʼʼ রূপকথা যেন খুব প্রফুল্ল এসব বলে।
-“আর..ʼʼ
-“আঁখি?…. হ্যাঁ, মেয়েটার ওপর বেশ মায়া জন্মে গেছিল আমার। যদিও মৃত্যুর আগে আমি ওকে দেখিনি।ʼʼ
অন্তূর ঘাঁড়ে মোচড় মেরে উঠছিল অভ্যন্তরীণ উত্তেজনায়। গাঢ় স্বরে বলল, “সোহান?ʼʼ
-“এ গল্পে সোহান বলতে কারও অস্তিত্ব নেই, শুধুই বিভ্রান্তিকর একটা নামমাত্র, গল্প তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল।ʼʼ ধীরে ধীরে রূপকথার হাসি কমে আসছিল, “সোহানের ব্যপারে তুমি কী জানো?ʼʼ
-“চাঁদনীর দেবর। জয় ওকে রাজনৈতিক দ্বন্দে খুব অত্যাচার করেছিল। সেইসব আঘাত ক্যান্সারে পরিণত হয়। ওর চিকিৎসার জন্য সামলা খালা জমি বন্ধক রেখেছিল। কোনো হিন্দুর কাছে সম্ভবত। …. এটাও বানোয়াট গল্প, তাই তো?ʼʼ
রূপকথা চুপ রইল ক্ষণকাল, এরপর বলল, “আঁখির নাম আঁখি না। একটা সুন্দর আছে ওই সুন্দর মেয়েটার, মনে নেই আমার। ওর ভাই সোহান না হলেও ভাইও ছিল একটা। যার কাহিনি সোহানের কাহিনির মতোই, তবে সত্যি।ʼʼ
অন্তূ মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত বোধ করছিল। পিঠে ব্যথায় সোজা হয়ে বসা দায়, তার ওপর চাপা বিস্ময়ে শিরদাড়া টনটন করছিল। কিছুক্ষণ মেঝের দিকে ঝুঁকে বসে থেকে বলল, “সালমা কে?ʼʼ
-“রূপকথা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায়, তুমি কখনও পতিতালয়ে যাওনি, না? ঘুরে দেখতেও যাওনি!ʼʼ
-“যাইনি।ʼʼ
-“ওখানে একটা সর্দারণী থাকে। যে মেয়েদের বেচা-কেনা করে, কাস্টমার ধরে, মহল্লার সব মেয়ের দেখভাল করে, লেনদেন করে, মেয়ে যোগাড় করে..এইসব। সালমা আমার বাবার দাসী। বাবার রেড লাইট আবাসিক হোটেলের সর্দারণী সে।ʼʼ
অন্তূ চোখ বুজে গায় শ্বাস ফেলল, “সে আয়া ছিল আমাদের ভার্সিটির।ʼʼ
-“সরি টু সে। কোনো ধরণই সবার ওপর খাটেনা। ক্ষেত্রবিশেষ যেকোনো সূত্র নির্দিষ্ট কিছু তত্ত্বের জন্য প্রযোজ্য হয়ে যায়। ঠিক তেমনই ভার্সিটির সব মেয়েই যেমন তোমার মতোন না, আবার সব মেয়ে ওইসব বেশ্যাদের মতোও না। সালমা খালার কাছে হলে থাকা মেয়েদের একটা জোট ছিল। যারা সেচ্ছায়, কোনো বিনিময় ছাড়াই দেহ বিলাতে আগ্রহী। যুবতী বয়স যাকে বলে আর কী! তাদের শরীরে জ্বলন কিছু কিছু পুরুষের চেয়েও বেশি। খারাপ লাগছে আমার কথা শুনতে?ʼʼ
অন্তূ চোখ বুজেই বলল, “না।…..এজন্য সে আয়ার কাজ করতো ভার্সিটিতে?ʼʼ
-“বাবার দাসী। বোঝোনি কথাটা? যেভাবে কাজে লাগাবে, লাগতে হবে তাকে। বাবার কাছে আসার আগে নব্বই দশকের যাত্রাপালার নাচনেওয়ালী ছিল। ওখান থেকে বাবা তুলে এনেছিল।ʼʼ
অন্তূ কেমন করে যেন চেয়ে রইল। রূপকথা কিছু একটা বুঝে স্লান হাসল, “আমাদের অভিনয় নিয়ে ভাবছো? খুব নিখুঁত ছিল তাই না?ʼʼ
-“আপনারটা বেশ কাঁচা ছিল। বাকিদেরটা ঠিকঠাক।ʼʼ
এবার রূপকথার অভিব্যক্তি খুব রহস্যময় দেখাল। চোখ চঞ্চল হয়ে উঠল। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল বারবার। অন্তূ কপালে আঙুল চেপে মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করল, “কেন করেছেন, এসব?ʼʼ
-“পতিভক্ত স্ত্রী, আমি। তার আদেশ এবং চাওয়া আমার ওপর অবশ্য পালনীয়। সে আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আর আমি তার জন্য এটুক করতে পারব না? জমিটা একটা হিন্দুর ছিল। হিন্দু সেটা বন্ধক রেখে পলাশের কাছে টাকা নিয়েছিল চড়া সুদে। সেই টাকা শোধ করেনি, জমি পলাশের। লোকটা লোকজন ধরা শুরু করল। কিন্তু পলাশ সেখানে তার একটা আবাসিক হোটেল বানাবে ভেবেই হিন্দুকে টাকা ধার দিয়েছিল। হিন্দু কান্নাকাটি করলেই ছেড়ে দেবে সে? কিন্তু সবখানে জোর-জবরদস্তি করতে নেই। রেপুটেশন বলতে একটা কথা আছে। সুতরাং গল্প বানাতে হলো। এর মাঝে আঁখি মানে ওই মেয়েটার মার্ডার হয়ে গেল। সব গুলিয়ে একটা জোরাতালির গল্প বানাতে হয়েছিল। সেখানে অভিনয় করেছিলাম আমরা কয়েকজন। খুব কষ্ট করতে হয়েছিল। কতগুলো দিন সারাদিন ওই টিনের ঘরে থাকতে হয়েছে। রাত গভির হলে তবে বাড়ি ফিরতে পেরেছি।ʼʼ
অন্তূ শ্বাস আঁটকে বসে ছিল। দুনিয়াটা আসলেই বৈচিত্র্যময়। একটুও ভুল বলেনি রূপকথা। তার পিঠের ব্যথা কমে গিয়ে মাথা ব্যথা প্রকট হচ্ছিল। হুট করে রূপকথা বলল, “সেদিন রূপটপে তোমার কান্না, চিৎকার খুব করুণ ছিল।ʼʼ
অন্তূ পাথর হয়ে গেল যেন। রূপকথা অন্তূকে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসল। মেয়েটা হাসে বেশি, অথচ সেগুলো হাসি নয়, অন্যকিছু। বলল, “এবার আমাকে খুব ঘেন্না লাগছে, তাই না?ʼʼ
-“না। পুরোটা শুনিনি এখনও।ʼʼ মূর্তির মতো কঠিন অন্তূর মুখের অবয়ব।
রূপকথা অবাক হলো, ভ্রু জড়িয়ে ফেলল। অন্তূ বলল, ওখানেই ছিলেন আপনি?
-“তোমার বাবাকে সেবাও করেছিলাম, তিনি অবশ্য তখন বেহুশ ছিলেন। মেরে জ্ঞানহারা করে ফেলে রাখা হয়েছিল।ʼʼ
অন্তূর বুকটা ছলাৎ করে ওঠে। কোথা থেকে যেন কঠিন এক দলা যন্ত্রণা এসে বোধহয় হৃদযন্ত্রের রক্ত সঞ্চালনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। নিষ্পলক চেয়ে রইল রৃপকথার দিকে।
অন্তূ অনেকক্ষণ যাবৎ সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিল চুপচাপ, নজর ছিল ছাদের দিকে। কাঁদেনি মেয়েটা, সমস্ত কলজে ছেঁড়া ব্যথাটুকু শোষণ করেছে নিজের মাঝে। নিজেকে আঁটকে রাখতে পারবেনা এই ভয়ে আজ অবধি আব্বুর কবরখানা জিয়ারতে যায়নি। কীসব আব্বুর সাথেকার পুরোনো স্মৃতি ভেতরটাকে ঝাজরা করে তুলছিল। অন্তূ জোরে শ্বাস নিয়ে এক লহমায় নিজের কাঠিন্যে ফিরে এলো, “কেন করেছেন, এসব?ʼʼ
দীর্ঘ নীরবতা। গুমোট এক সন্ধ্যা। পাঁচজন নারী সামনা-সামনি বসে আছে। শুধু ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ জানান দিচ্ছে, সময় প্রবাহমান, সময় থামেনা।
-“সবার বাবা আমজাদ সাহেবের মতোন হয়না, অন্তূ। কিছু বাবা রাজন আজগরের মতোও হয়।…আমাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠানো হলো খুব অল্প বয়সে। স্নাতক শেষ করে ফিরলাম দেশে। বাবা ঢাকা থেকে ফিরল। রাতে ডেকে বলল, ‘রূপ! মামণি…আপনারে আর আমার কাছে রাখতে চাচ্ছি না।ʼ
আমি বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম, ‘আমি যাচ্ছি না কোথাও।ʼ
বাবা হাসতে হাসতে বলল, ‘কোথাও যেতে হবেনা। শুধু তোকে নিজের কাধ থেকে ঝারতে চাইছি।ʼʼ
এ পর্যায়ে মলিন হাসল রূপকথা, “জানতে পারলাম, পলাশ ভাইয়ার সাথে বাবা বাঁধতে চায় আমাকে। পালাতে চেয়েছিলাম আমি। লুকিয়ে দেশের বাইরে চলে যেতে চেয়েছিলাম। বাবা কেন এমন চাইল, জানো? বাবার ধান্দা সামলানোর ক্ষেত্রে বড় চাচার ছেলে পলাশ বাবার চেয়েও বেশি দক্ষ। আর তাকে হাতে রাখতে, সম্পত্তি নিজের রক্তের কাছে রাখতে সে নিজের ঔরসজাত মেয়েকে বলি দিতে পারে বাবা শখের সাথে। এ অবস্থায় তুমি হলে কী করতে, অন্তূ?ʼʼ
-“বাবাহীন সন্তান আমি, এই পরিচিতিতে জীবন কাটিয়ে দিতাম।ʼʼ
-“ওটা তো জারজের পর্যায়ে চলে যেত। তুমি বাস্টার্ড বলে পরিচিত হতে।ʼʼ
-“আপনার বাবার মতো বাবাকে বাবা মানার চেয়ে কি ভালো নয়, আমি পিতৃপরিচয়হীন, অজন্মা হয়ে বাঁচব?ʼʼ
উদাস হয়ে পড়ল রূপকথা, “আমি পারিনি। বাবার স্বার্থপরতার কাছে মানসিকভাবে হেরে গেছিলাম।ʼʼ
-“এরপর?ʼʼ
-“এই, তুমি আমার বাসররাতের গল্প শুনবে?ʼʼ
অন্তূ জবাব দিলো না। রূপকথা সোফাতে শরীর এলিয়ে শাড়ির কুচি গুটিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসল, দৃষ্টি ছাঁদে নিবদ্ধ। এত সুন্দরী এই রূপকথা। তার ওপর এমন সাজসজ্জা। ঠিক যেন রাজকুমারী লাগছে। অথচ মুখটা স্লান এখন।
-“পলাশ ভাইয়াকে একটা বাংলো বানিয়ে দিয়েছিল, বাবা। সেখানে কাঁচা গোলাপের বাসর। বসে আছি আমি, মৃত্যুর অপেক্ষা করছি। পলাশ এলো। হাতে অ্যালকোহলভর্তি হিপফ্লাস্ক। ফুলের ওপর ছেঁচড়ে আধশোয়া হয়ে পড়ল। দেরি করার সময় নেই তার। ঢকঢক করে খানিক গিলে একটানে আমার শাড়ির প্রান্ত ধরে টান দিলো। শাড়ির পাড় ছিঁড়ে পলাশের হাতে চলে গেছিল, জানো? খুব শক্ত হাত, বুঝলে?ʼʼ
অন্তূ চুপচাপ তাকিয়ে রয় রূপকথার দিকে। মেয়েটা ছাদের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, “স্যাডিজম বোঝো? স্যাডিস্ট?ʼʼ
-“না।ʼʼ
-“ভয়াবহ মানসিক রোগ। সাধারণ পুরুষেরা নারীকে স্পর্শ করে এবং আদরের মাধ্যমে নিজেদের শারীরিক চাহিদা মেটায়। এই রোগে আক্রান্তরা কী করে জানো?ʼʼ
অন্তূ তাকিয়ে রইল।
-“ধর্ষকামী হয়। অর্থাৎ সাধারণভাবে নারীদেহ ভোগ করে এরা সন্তুষ্টি পায়না। নারী শারীরিক যন্ত্রণায় যত বেশি চিৎকার করে, এদের কানে সেই চিৎকারের আওয়াজ, নারীর দেহের ক্ষত এবং মুখের করুণ কাতরতা এদেরকে যৌন সুখ দেয়। অর্থাৎ, এরা নারী শরীরকে অমানুষিক আঘাতের মাধ্যমে সুখ পায়।ʼʼ
অন্তূর ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। এই তৃপ্তিটা অন্তূ সেদিন রূফটপে পলাশের মুখে দেখেছিল, যখন অন্তূ কাঁদছিল। অন্তূ অবাক হলো। জয় অসংখ্যবার বলেছে, পলাশ পাগল, ওর মানসিক সমস্যা আছে, ও শালা সাইকো। জয় আমির সাধারণভাবে কাঠিন সব সত্যি বলে, বোঝার উপায় থাকেনা। অন্তূ কপাল চেপে ধরল। রূপকথা বলল, “আমার শরীরে অনেক দগদগে দাগ আছে, দেখবে?ʼʼ
অন্তূ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “এরপর কী হয়েছিল?ʼʼ
রূপকথা হাসল, “বাসর হলো। যা এতদিন অন্যসব মেয়েরা সঁয়েছে, তা আমি সইলাম। চাবুক দিয়ে পেটানো হলো আমাকে। আমার প্রতিটা আত্মচিৎকার পলাশের মুখে হাসি ফুটাচ্ছিল। একটা মজার কথা শুনবে, অন্তূ?ʼʼ
অন্তূ তাকায়। রূপকথা হাসল, “বাবা আমাদের বাসর ঘরের বাহিরে সোফায় বসে ড্রিংক করছিলেন। আমার চিৎকারে প্রতিটা ইটের গাঁথুনি কেঁপেছিল সেদিন। বাবা খুব শক্ত লোক, তাই না?ʼʼ
বাবারা এমন হয়? অবিশ্বাস্য! অন্তূর মনে হলো, তার সাথে কিছুই হয়নি। এই দুনিয়ার কোপানলে সে পড়েইনি। উহু! জয় এমন নয়। জয় ঘৃণ্য, তবে তুলনায় গেলে জয় অনেক সুস্থ্য। জিজ্ঞেস করল, “এরপর?ʼʼ
-“আমাকে উল্টো করে শক্ত করে খাটের সাথে বাঁধল পলাশ দড়ি দিয়ে।ʼʼ
অন্তূ আর শুনতে চাইল না। তার ভেতরে অদ্ভূত ধরণের এক হিংস্রতা কাজ করছে, সাথে ম্যান্টালি ডিপ প্রেশার ফিল করছিল, শরীরটা অবশ হয়ে আসছে। রূপকথা থামল না, “সারা পিঠে কোনো মাংসাশী প্রাণীর মতো কামড়েছিল পলাশ। যেন সে খুবলে মাংস খেতে চায়। আমার চিৎকার কমে আসলে তার আঘাত জোরালো হচ্ছিল। সে চিৎকার শুনে, এবং আমার কান্নায় তৃপ্তি পাচ্ছিল।ʼʼ
অন্তূ হাত উঁচিয়ে ধরল। সে আর শুনতে চায়না। নিতে পারছে না। রূপকথা সোজা হয়ে বসল, “তোমার মনে প্রশ্ন আসছে না? বাবা কী করে সহ্য করছিল? বাবারা আবার এমন হয় নাকি?ʼʼ
অন্তূ উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে আর নিতেই পারছে না। তার সামনে বাবা মানে আমজাদ সাহেব। এক ব্যক্তিত্ববান, গম্ভীর, কর্তব্যপরায়ন, নিখুঁত মানুষ। অস্থিরচিত্তে এদিক-ওদিক তাকাল। ঘেমে উঠেছে শরীরটা। তার মনে হচ্ছিল, সে কোনো ডার্ক ম্যাগাজিন পড়ছে, এসব বাস্তব হতে পারেনা। হাত পা ঘষতে ঘষতে বসে পড়ল। রূপকথা একদম স্বাভাবিক, চোখে-মুখে বরফের মতো শীতলতা। মনে হচ্ছে, সে খুবই রিল্যাক্সে আছে। অন্তূ বলল, “আপনার তথাকথিত বাবা অর্থাৎ রাজন আজগরও পাগল?ʼʼ
রূপকথা হেসে ফেলল, “পেডোফেলিয়া বোঝো?ʼʼ
-“বোঝান। আজ অনেককিছু বোঝার আছে আমার।ʼʼ
-“শিশু নির্যাতনের প্রবণতা। অর্থাৎ, যা পলাশ নারীর সাথে করে, বাবার তা ছোট্ট বাচ্চাদের সাথে করার নেশা আছে। পলাশ সেক্সুয়াল স্যাডিস্ট। বাবা পেডোফিলিক স্যাডিস্ট। অর্থাৎ এরা মানুষকে অত্যাচারের মাধ্যমে তাদের আত্মচিৎকারের আওয়াজে তৃপ্তি পায়।ʼʼ
রিমি পাথরের মতো বসে ছিল। এতক্ষণ সে যেন শুধুই ঠাকুরঘরে সাজিয়ে রাখা মূর্তি। নিঃশ্বাসও ফেলেনি বোধহয়। এবার বিক্ষিপ্ত, এলোমেলো একটা শ্বাস ফেলল। পুরো বংশটাই পাগলের কারখানার শ্রমিক! অন্তূ অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল, “এসব হয়েছে আপনার সাথে, আর আপনি কী করেছেন?ʼʼ
-“করিনি বলছো! অনেক কিছু করেছি। আমি যা করেছি, তা নিতে পারবে তো? …আমি কী করেছি, তা জানো তুমি।ʼʼ
অন্তূ স্থির চেয়ে থাকল। রূপকথা বলল, “মানুষ ব্যথার কাছে খুব স্বার্থপর হয়ে যায়, অন্তূ। যেকোনোভাবে সে নিষ্কৃতি চায়। আমিও তাই চেয়েছি, তার জন্য এমন সব নোংরা কাজ করেছি, যার ক্ষমা নেই। পলাশ যা বলতো, শুনতে শুরু করলাম, শর্ত— সে আমার কাছে আসবেনা। হাজার রাত নিজের ঘরে বসে অন্য মেয়েদের মরণ চিৎকার শুনতে শুনতে আমি জানোয়ার হয়ে গেছি, অন্তূ। কিচ্ছু মনে হয়না। শুধু মনে হয়, আমার সাথে তো হচ্ছেনা, আমি তো বেঁচে গেছি। শরীরের ব্যথাগুলো আর ওইসব নারকীয় রাত মনে পড়লে আমি আরেক পলাশ হয়ে যাই। নিজেকে ওই জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে সব কবুল।ʼʼ
অন্তূ আন্দাজ করে ফেলল অনেককিছুই। রূপকথা বলল, “পলাশকে সুস্থ করার জন্য চেষ্টাও করেছিলাম, জানো? নিজের রূপে, এবং দেহে আকৃষ্ট করতে চাইতাম, যেমনটা স্বাভাবিক পুরুষেরা হয়। বাবা ঢাকায় থাকতো। বাড়ি ফাঁকা। ওর চোখে পাগলামির নেশা দেখলে নিজেকে বাঁচাতে ওর কাছে গিয়ে ঘেষতাম, চুমু খেতাম, স্বাভাবিকভাবে উত্তেজিত করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু দিনশেষে আরেকবার ওর পাগলামির শিকার হতে হতো। এমনও হয়েছে গতরাতে বেহুশ করে ফেলে রেখেছে আমাকে। আমি উঠতে পারছি না। নিজেই ডাক্তার এনে চিকিৎসা করিয়েছে। কাঁচা ঘা। তার ওপর সেই রাতে আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একটা পাগলের সাথে দিনের পর থাকতে থাকতে, আর এইসব দেখতে দেখতে আমিও পাগল আর হিংস্র হয়ে উঠলাম। নিজের জায়গায় অন্য যেকোনো মেয়েকে ছেড়ে দিতে মন চাইতো, তবুও নিজেকে বাঁচানোর লোভ সংবরণ করতে পারিনি।ʼʼ
রিমির চোখ ভিজে উঠেছিল, হাত-পা তড়তড় করে কাঁপছে। এবার টুপ করে পানি পড়ল কোলের ওপর। একটা মেয়ে হয়ে আরেক মেয়ের মুখে যা শুনছিল, সহ্য সীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল সব।
অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “আপনি সেদিন ওই বাড়িতেই ছিলেন, যখন আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?ʼʼ
-“রুফটপের পাশের ঘরেই ছিলাম।ʼʼ আনমনা হয়ে উঠেছিল রূপকথা।
-“আর আঁখি?….ʼʼ
-“আঁখি না ওর নাম। ওই মেয়েকে যা করা হয়েছে, এই বাড়িতে করা হয়েছে। পলাশও ভাগ পেয়েছিল, শেষে। এখানে এসে।ʼʼ
অন্তূর শরীরটা অসাড়ল হয়ে উঠল। তাদের কথা মাঝে বারবার নিস্তব্ধতা নেমে আসছিল, আবার শুরু হচ্ছিল। দাসী মহিলা দুটো স্বাভাবিক। খুব পরিচিত ঘটনাই বলছে রূপকথা।
অন্তূ চট করে একটা হিসেব মেলালো, দামী হিসেব। শাহানার জরায়ুতে টিউমার। সে জানে, এ অবস্থায় স্বামীসঙ্গে যায় না মহিলারা, পারেনা। ডাক্তারের নিষেধ থাকে, তাছাড়া সহ্য না করতে পারার একটা বিষয় থাকে। হুমায়ুন পাটোয়ারীর হাস্যজ্জ্বল চেহারাটা মনে পড়ল অন্তূর। শরীরটা ঝিনিঝিন করে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল।
চলবে..
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৪১.
অন্তূর মাথায় শুধু ঘুরছিল, আচ্ছা! পলাশ কি এই পৃথিবীতে একাই এমন নির্যাতনকারী? হামজারা কি একাই ক্ষমতালোভী? আর জয়েরাই শুধু এমন শক্তিশালী সামাজিক ব্যক্তিত্ব! আর নেই? অন্তত বাংলাদেশেই অসংখ্যা রয়েছে। অন্তূ এটা ভেবে নাক ছিটকাতো, এদের বাড়ির লোক কী করে? বউ, মেয়ে…এরা কী করে? রুখতে পারেনা?
ধারণাটা এত বাজেভাবে হারবে, তা জানতো কে? সে নিজেও তো এতগুলো দিন এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছে। পেরেছে নাকি ওই স্টোর রুম পেরিয়ে কাঠের দরজা ভেদ করতে? অথবা বাগানের পেছনে, প্রাচীরের কাছের ওই লোহার গেইটের ভেতরে ঢুকতে? হামজার বিরুদ্ধে বলতে, জয়কে থামাতে? বরং সে নিজেই অবরুদ্ধ, বন্দি। রূপকথারা এভাবেই মরতে মরতে বেঁচে আছে? আচ্ছা, এসব পুরুষদের সঙ্গিনীরা সবাই কি এমন শিকার? নাকি ব্যতিক্রম আছে?
অন্তূ রূপকথাকে বলেছিল, “পলাশ ঘুমায় না? রান্নাঘরে বটি বা ছুরি থাকেনা? হাতও তো আছে আপনার!ʼʼ
রূপকথা হেসেছিল, “কেবল পলাশের একটা মানসিক রোগের ব্যাপারে শুনলে।ʼʼ
-“আর কত আছে? সে কি মানসিক রোগের ফ্যাক্টরি?ʼʼ
-“স্বাভাবিক মানুষদের মতো ঘুম আসেনা ওর। অর্থাৎ, শরীরে স্বাভাবিকাভাবে ঘুমিয়ে পড়ার হরমোন মেলাটোনিন ক্ষরণ হয়না দেহে। আর্টিফিশিয়ালি মেলাটোনিন পুশ করতে হয় দেহে। এরপর ঘুমায়। সেটাও নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে।ʼʼ
-“আপনি ফেরাউনের ঘর করছেন, রূপকথা!ʼʼ
-“আছিয়া বলে লজ্জিত কোরো না। মা আছিয়ার মতো ইমাণী জোর নেই আমার, আর না আছে প্রতিবাদের ক্ষমতা।ʼʼ
থেমে থেমে আরও অনেক কথাই হয়েছিল ওদের। হঠাৎ-ই অন্তূ নিষ্ঠুরের মতো জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি এখানে এসব জানাতে এসেছেন আমায়? কী বাবদে?ʼʼ
রূপকথা হেসে ফেলল, “উকালতি র-ক্তে জড়িয়ে তোমার? না না, সন্দেহ ভালো। বিশ্বাস করার নয় কাউকে।ʼʼ
-“শব্দটাকে ভীষণ সস্তা লাগে আজকাল।ʼʼ
-“লাগারই কথা। এমনিতেই সচেতন তুমি। আরও হচ্ছ।…পলাশের সাথে দেখা হবার পর কতদিন কেটে গেছে তোমার?ʼʼ
অন্তূ অবাক হলো। রূপকথা সেটাও জানে! সে বলল, “বেশ অনেকদিন।ʼʼ
“এরপর আর বের হওনি না?ʼʼ
-“বিয়ের পর ভার্সিটি যেতে দেয়া হয়নি, থার্ড ইয়ারের ক্লাস তো শুরু হয়েছে ক’দিন হলো। বন্দি জীবন যাপন করছি আপাতত।ʼʼ
-“বের না হলেই ভালো। এজন্যই জানাতে এসেছিলাম। কোনো স্বার্থ-টার্থ নেই। বলতে পারো তোমার নিজের অর্জন। তোমার মতো মানুষদের এড়িয়ে চলা মুশকিল, বুঝলে! জয় আমিরকে জিজ্ঞেস করলে সে যদি বলে কখনও, তো বুঝবে এটা। আর পাঁচটা মেয়ের মতো নও যেমন তুমি, এটা খুব সহজেই ধরা পড়ে তোমার চোখে তাকালে। ব্যতিক্রমের সাথে মানুষের আচরণ ব্যতিক্রমই হয় সচরাচর। আমিও তাই করছি। সাবধানে থেকো। পলাশ তোমায় ছাড়বে না। জয় নামক ঢালে বাঁধা পড়ে আছো এ বাড়িতে। বাইরের জগত তোমার জন্য ভালো নয়। পলাশ ছাড়াও বহুলোক আছে জয়ের সাথে সম্পর্কিত হিসেবে তোমার ক্ষতি করার।ʼʼ
অন্তূ ভাবল, হয়ত মাজহার। নাকি আরও কেউ, বা কারা?
—
অন্তূ এটা বুঝল, সে অনেকটাই ব্যাক-আপ পেয়েছে জয়ের কাছে। অন্তূদের একটা বুড়ো হিন্দু স্যার ছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, “পেছন মেরে বালুর ছ্যাঁক দেয়া বুঝিস রে, তোরা?ʼʼ
তখন বোঝোনি অত। আজকাল আমজাদ সাহেবসহ এসব বুজুর্গ, প্রবীণদের কথার মর্ম খুব গাঢ়ভাবে মনে পড়ে। জয় হলো সেই লোক, যে পেছন মেরে আবার বালুর ছ্যাঁক দিয়ে ব্যথা কমাতে আসে! অন্তূর হাসি পায় এসব ভাবলে।
বোঝা গেল, জয়ের ফিরতে দেরি হবে ক’দিন। অন্তূ ভাবল, এই ফাঁকে বাড়ি থেকে ঘুরে এলে হয়না? ভাবি অসুস্থ, অন্তিক কী করছে না করছে? আম্মুকে দেখার ইচ্ছেটাও হচ্ছিল।
অন্তূকে অবাক করে দিয়ে সকাল এগারোটার দিকে পাটোয়ারী বাড়ির দরজায় অন্তিক এলো। অন্তূ ভাবেনি এমনটা। স্মিত হাসি ছেলেটার মুখে। হাতে দু প্যাকেট মিষ্টি, ছোট্ট দুটো অসময়ের তরমুজ, ব্যাগে অনেক রকম খাবারের পাত্র, নিশ্চয়ই রাবেয়া কিছু বানিয়ে দিয়েছেন! অন্তূর অদ্ভুত লাগল। অন্তিক ছোট বোনকে দেখতে এসেছে তার শ্বশুরবাড়ি, সাথে এনেছে কুটুমবাড়ি আসার ঐতিহ্য। এই হাসিটা অনেকদিন দেখা হয়নি অন্তিকের চোখে। সে খুব হালকা এবং খুশি যেন। অন্তূ বুঝতে পারল না তার কী করা উচিত! আব্বুর কথা মনে পড়ছিল খুব। অন্তিকের সাথে আব্বু থাকতে পারতো না কি? বুকটা হু হু করে ওঠে তার। ভোলাই যায় না আব্বুকে? তবুও খোদা তায়ালাদ ইই নিষ্ঠুরতা!
রিমি খুব যত্ন করল অন্তিকের। দুপুরে না খাইয়ে যেতে দিলো না। এতসব কিছু আনার জন্য ধমকালোও। অন্তূর কিছু করতেই হলো না। যা সব রিমিই সামলাচ্ছিল। যেন সে নিজের ভাইকে আপ্যায়ন করছে।
যাবার সময় আচমকা অন্তিক বোনের হাতটা ধরল, অদ্ভুত গলায় বলল, “ক্ষমা করিসনি, না?ʼʼ
-“ধরে রাখিনি। তুই এসেছিস, খুশি হয়েছি আমি। ভাবি ভালো আছে? আম্মু?ʼʼ
অন্তিক একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিলো, “এটা রাখ, অন্তূ। আমার নিজের রোজগারের টাকায় কেনা। সুদ বা অনৈতিকতা নেই একটুও, আমার খাটুনির আয়। ফুড-বেভারেজ কোম্পানির ড্রাইভারের চাকুরি পেয়েছি।ʼʼ
অন্তূ চেয়ে রইল অন্তিকের দিকে। কত বদলে গেছে অন্তিক! ঠিক সেই পাঁচ-সাত বছর আগের অন্তিক। অন্তিক চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই ভালো আছিস, অন্তূ?ʼʼ
-“ভালো নেই?ʼʼ স্লান হেসে চেয়ে থাকে অন্তূ।
অন্তিক হাসল, “ভাগ্যের পরিহাস?ʼʼ
-“জানিনা তো। তুই বলতে পারসি, কী ঘটছে এসব?ʼʼ
দু ভাই-বোনের বিদায়ের ক্ষণটাও অদ্ভুত ছিল। অন্তিককে এগিয়ে দিতে গেল না অন্তূ। অথচ যেই না সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল, অন্তূ দৌড়ে সিঁড়িঘরের জানালা খুলে দাঁড়ায়। রাস্তায় দেখা যাচ্ছিল অন্তিককে, হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে। যতদূর দেখা গেল, চেয়ে রইল। পেছনে এসে দাঁড়ায় রিমি। সে কাল সারারাত ধরে অন্তূর গল্প শুনছে।
দুপুরে গোসল করে পরল সেই পোশাকটা। সে বুঝল, ভাবি বানিয়েছে জামাটা। মার্জিয়া টুকটাক ভালোই দর্জির কাজ জানে। বারবার আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখছিল। বিয়ের পর বাপের বাড়ি থেকে আসা তোহ্ফা! রিমি মুগ্ধচোখে দেখে বলল, “খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে, অন্তূ!ʼʼ
অন্তূ চমকালো, এ বাড়িতে কে অন্তূ ডাকতো না তাকে।
হুমায়ুন পাটোয়ারী শাহানাকে নিয়ে ফিরলেন বিকেলের দিকে। অন্তূ সামনে গেল না। ওর মনে হচ্ছিল, ও বমি করে ফেলবে আর নয়ত হাত র-ক্তে ভিজে উঠবে। দিনের দুপুরে র-ক্তে হাত ধুতে নেই। তার হাত তো আর হামজার মতো দক্ষ নয়।
তরু তুলির কাছে একা ছিল। রিমি সন্ধ্যার পর বেরিয়ে গেল ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে। তরু একা একা সামলাতে পারবেনা।
সীমান্ত নিখোঁজ। এ নিয়ে চারদিকে তোলপাড় চলছে। পুলিশ ফোর্স নিয়ে চারদিকে খোঁজ চালাচ্ছে তারা। ঝন্টু সাহেব চেষ্টার ত্রুটি করছেন না। বোনের ছেলে গুম! প্রথম সন্দেহ পাটোয়ারী বাড়ি তাদের। কিন্তু হাতে ক্ষমতা না থাকলে সন্দেহ ভোঁতা। হামজাকে কল করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। সে বলেছে, তার কাছে এসেছিল ঠিকই, তবে চলে গেছিল দশ মিনিট পরেই। এরপর আর দেখা হয়নি।
সে মেয়র মানুষ। তাছাড়া দাপটই আলাদা। প্রসাশনের কর্মকর্তারা খুব বেশি জোর দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারেনা।
অন্তূ ঘরের দরজাটা ইশার আজান পড়তেই আঁটকে দিলো। তার মনে কীসের এক শঙ্কা জেগেছে। হুমায়ুন পাটোয়ারীর মুখটা মনে পড়লেই বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠছে। শরীরে এক প্রকার শিহরণ টের পাচ্ছিল। রাতে খেতেও বের হলো না আর। শাহানা কতবার ডাকলেন। নামাজ পড়ে খেয়ে নেবে, বলে কাটিয়ে দিলো। এত বড় বাড়িতে ওরা তিনজন, তার মাঝেও ও একা। গা শিরশির করছিল।
বেডসাইড টিবিলের ওপর পড়ে আছে জয়ের কাজুবাদামের পাত্রটা। সারা ঘরের দেয়ালে অনেক ছোট ছবি টাঙানো। ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে করতে বারবার সেসবে চোখ পড়ে অন্তরাত্মা পুড়ে উঠছিল। আঁখির লা-শটা চোখ থেকে সরছে না। বহুদিন ভুলে ছিল। তা তাজা হয়েছে। ত্বকের নিচে মাংসপেশীতে কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল, উত্তেজনায়।
জয় যদি আঁখির শরীরের একটা ক্ষতর জন্যও দায়ী হয়, অন্তূ ওয়াদা করে ফেলল চট করে—এক কোপে ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেলবে সে জয়ের। আর হুমায়ুন পাটোয়ারীর? হামজা, পলাশ? এরা ওর নাগালের বাইরে। তাই বলে মাফ?
রাত তখন একটা বাজে। অন্তূ তখনও উদাস পায়ে ঘরের মেঝেতে পায়চারী করছে। পা শিরশিরে অসহ্য উত্তেজনা। র-ক্তে আগুন জ্বলছে। অথচ নারীমনে দ্বিধা। হুমায়ুন পাটোয়ারীকে নিজের সন্দেহের ওপরই এত ভয় লাগছিল। অন্যকেউ হলে হতো। মামাশ্বশুর মানুষ যদি নোংরা হাত অল্পও বাড়ায় তার দিকে? অন্তূর গা’টা মৃগী রোগীদের মতো কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। নিস্তব্ধ, অবরুদ্ধ রাত। ঘরের জানালা-দরজা সব বন্ধ। তবুও অন্তূর মনে হচ্ছিল, কেউ যেন ওই দরজা ভেঙে এসে তার দিকে হাত বাড়াবে। সে এই ভয়টা প্রথম অনুভব করেছিল পলাশের রুফটপে।
জানালার বাইরে কেউ গুঙরে উঠল না? অন্তূ সজাগ হয়ে ওঠে। কোনো মানুষের চাপা ঘোৎ-ঘোৎ আওয়াজ। গা ছমছমে লাগছিল। যেন কেউ কোনো জীবন্ত কারও র-ক্ত পান করছে। জয়ের রুম সদর ঘরের শুরুর দিকেই। বাড়ির গড়নটাই আজব। বাইরে থেকে একরকম, ভেতরটা অন্যকিছু। অন্তূর মনে হলো, নিচ থেকে গোঙানি বা ধস্তাধস্তির আওয়াজ আসছে। পরে ভাবল, বদ্ধ ঘর, বাতাসের ঘাটতির কারণে এমন ভোঁতা আওয়াজ কানে বাজছে।
দোতলার সদর দরজায় টোকা পড়ছে এবার। অন্তূ সচেতন হলো। এই মাঝরাতে কে এসেছে? জয়? দ্বিধায় ভুগতে ভুগতে এক সময় ড্রয়ার খুলে পছন্দমতো একটা ড্যাগার তুলে নিলো হাতে। ছোটখাটো অস্ত্রাগারই বটে জয়ের রুমটা।
দরজার সামনে গিয়ে মিনিট পাঁচেকেও ওপাশ থেকে জবাব পেল না মনমতো। যতবার জিজ্ঞেস করল, “কে?ʼʼ প্রতিবার অস্পষ্ট স্বরে শুনতে পেল, “খোলো।ʼʼ
জয়? ‘তুমিʼ সম্বোধন ব্যাপারটি খুব গোলমাল তৈরি করল। ড্যাগার হাতে উচিয়ে ধরে দরজা খুলতেই কেউ একজন হুড়মুড়িয়ে ঢুকে দরজা আঁটকে তবে পেছন ফিরল। অন্তূ তখনও ড্যাগার নিয়ে প্রস্তুত। অথচ আগন্তুকের মাঝে তাকে আক্রমণ করার কোনো তাড়া নেই।
অন্তূ অবাক হলো। মুখটা কালো হাজী রুমালে বাঁধা। কালো জ্যাকেট, কালো প্যান্ট, হাই-বুট জুতো পায়ে, হাতে কালো গ্লাভস। শরীরের শুধুমাত্র চোখ এবং মাথাভর্তি ঘন চুল ছাড়া কিছু দেখতে পাবার উপায় নেই। চোখের মণি ডাইনিং স্পেসের ডিম লাইটের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল। অন্তূ পেছন ফিরে দেখল, হুমায়ুন সাহেবের রুমের দরজা এখনও ভেতর থেকে বন্ধ। গভীর ঘুম।
অন্তূ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল, “কে আপনি?ʼʼ
আগন্তুক ঠিক জয়ের মাফিক লম্বা। আশপাশ দেখে নিয়ে বলল, “আপনি জয় আমিরের স্ত্রী, সঠিক ধরেছি?ʼʼ ভরাট স্বর, গমগমে তেজ যেন কণ্ঠের আগায়।
অন্তূ সে জবাব না দিয়ে বলল, “আপনি কে? এভাবে ডাকাত অথবা আততায়ীর মতো কারও অন্দরে প্রবেশ করাটা অভদ্রতা বোধহয়।ʼʼ
-“তাহলে আমি আজ ভদ্রলোক নই। ভদ্রলোক হবার যুগ নয় এটা। পথ ছাড়ুন।ʼʼ
-“উদ্দেশ্য না জেনে ভেতরে যেতে দেবার নয়। কে আপনি, জবাব দিন।ʼʼ
-“উদ্দেশ্য জানলে যেতে দেবেন, এমনটাও মনে করছি না।ʼʼ
-“কেন এসেছেন এখানে? সোজা জবাব দিন।ʼʼ
-“আমার মনে হয়না, আপনি আমায় আসলেই রোধ করতে চাইছেন। কারণ আপনি নিশ্চিত এতক্ষণে, আমি আপনার বিশেষ ক্ষতি করব না। আর আপনি ছাড়া আপাতত বাড়িতে উপস্থিত আর কারও চিন্তাও বিশেষ নেই আপনার মাঝে।ʼʼ
-“হুশিয়ারী করছেন?ʼʼ
-“ধারণা করছি। সময় কম হাতে, সরে দাঁড়ান।ʼʼ
-“ভেতরে কী কাজ আপনার?ʼʼ
“আপনার মামাশ্বশুরের ঘরটা কোনদিকে? ঘরটা দেখিয়ে দিন।ʼʼ
অন্তূ ভ্রু জড়াল। তার ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় তাকে কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছিল যেন। আগুন্তুককে তার কেন জানি ভয় লাগছিল না আশ্চর্যজনকভাবে। এত কড়া পাহারার পর লোকটা দোতলায় উঠে এসেছে, অথচ কোনো আক্রমণাত্মক অভিব্যক্তি নেই…আজব! আগুন্তুক অন্তূকে বলল, “আসুন আমার সঙ্গে।ʼʼ
হুমায়ুন সাহেবের দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল, “ডাকুন।ʼʼ
অন্তূ ডাকল। আগুন্তুক দরজার সামনের থেকে সরে একপাশে দাঁড়াল। যেই না হুমায়ুন সাহেব দরজা খুললেন, অমনি পা বাড়িয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল হুড়হুড় করে। হুমায়ুন সাহেব চমকে বলল, “কে রে? কে তুমি? কে, কে? কে এইটা, আরমিণ?ʼʼ
-“বসুন, চাচা। উত্তিজত হবেন না। ভেতরে এসে বসুন।ʼʼ
শাহানা হৈ চৈ শুরু করে দিলেন। আগুন্তুক বলল, “চাচিমা, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি অসময়ে এসেছি ঠিকই, তবে আমার কাছে এটাই সময়।ʼʼ
হুমায়ুন সাহেব তাকিতুকি করছেন। বোধহয় অস্ত্র-সস্ত্র কিছু খুঁজছেন। আগুন্তুক বলল, “আমি একটা গল্প শুনতে এলাম আপনার কাছে। আল্লাহ পাক আমাকে সবর দিয়েছেন, আমি তার কাছে আরও সবর প্রার্থনা করছি। যা জিজ্ঞেস করব, কোনো রকম শিরোনাম বা অজুহাত ছাড়া বলে যাবেন।ʼʼ
-“কে তুমি?ʼʼ
-“আজ পরিচয় থাক। আখিরাতে জাহান্নামে যাবার পথে আমার-আপনার আবার দেখা হবে। মৃত্যূর আগে কিছু মহাপাপ আর কুফরি করে মরব আমি। জাহান্নামের দিকে এগিয়ে যাবার পথে পরিচিতিসহ অনেক আলাপ হবে। আপাতত মূলকথায় আসি।ʼʼ
অন্তূ অবাক হয়ে গেল। হুমায়ুন সাহেব দরদর করে ঘামছেন! পাপ তার চোখে-মুখে চামড়ার মতো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। কে এই আগুন্তুক? বিছানায় বসে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করছে, “মুমতাহিণাকে এই বাড়িতেই মারা হয়েছিল, তাই তো?ʼʼ
হুমায়ুন সাহেব হাত দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখ মুছলেন। শাহানা স্বামীর কাছে এগিয়ে গিয়ে বাহু চেপে ধরলেন। আগুন্তুক ফের বলল, “কী হয়েছিল মুমতাহিণার সাথে আসলে? আপনি কখন গেছিলেন ওর কাছে?ʼʼ
অন্তূ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। মুমতাহিণা ওরফে আঁখি! এটা কে তাহলে? মুমতাহিণার ভাই? কিন্তু সে তো মরে গেছে। কী সুন্দর নামটাকে এই জানোয়ারের দল বিকৃত করে রেখে দিয়েছিল। কোরআনুল কারিমে একটা সুরা আছে মুমতাহিণা নামে।
হুমায়ুন সাহেব মুখ খুলছিলেন না। এক পর্যায়ে আগুন্তুক উঠে দাঁড়িয়ে পিস্তলটা ধরল ঠিক হুমায়ুন সাহেবের গালের ভেতর। ট্রিগারে বারবার ছটফটে হাত রেখেও আবার সরিয়ে নিচ্ছিল।
শাহানা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছিলেন। আগুন্তুক অনুরোধ করল, “চাচিমা, আপনি চিৎকার করবেন না। আমার হাতে সময় কম। রাত ফুরিয়ে আসছে। আমি কিছু জানতে এসেছি, তা উনি বলছেন না, সময় কেটে যাচ্ছে, এভাবে ছাড়া উপায় নেই। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না। আল্লাহর ওয়াস্তে, চিৎকার করবেন না। এটুকু রহম করুন।ʼʼ
মুমতাহিণাকে যখন আনা হলো এখানে, তার আগে তাকে পলাশের হোটেলে রাখা হয়েছিল। এখানে আনার পর বেশ কিছদিন আঁটকে রাখা হলো। মেয়েটা চমৎকার মায়াবতী ছিল। যেন এরাবিয়ান সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা কোনো শাহজাদী। লম্বা হাতার ঢিলা পোশাক, চুলগুলো দেখা যেত না কখনও, ওড়না মাথায় থাকতো সবসময়। ওকে রোজ খাবার দিতে যাবা বা দেখাশোনার দায়িত্ব হুমায়ুন সাহেবের ছিল। বাড়ির মেয়েদের কিছু জানানো যাবেনা। জয় তখন ঢাকাতে। তার সামনে মাস্টার্স পরীক্ষা। হামজা সারাদিন বাইরে থাকে, বিভিন্ন কাজে। হুমায়ুন সাহেব যেতেন তিনবেলা বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরের নিচের ঘাঁটিতে। স্ত্রী থেকেও বিপত্নীক হয়ে গেছিলেন স্ত্রীর রোগের জন্য। কিন্তু পৈশাচিক পুরুষত্ব কি বাঁধ মানে? এমনও হয়েছে, রোজ দু-তিনবার তিনি ধর্ষণ করেছেন মুমতাহিণাকে।
তবুও মেয়েটা বেঁচে ছিল কোনোরকম, তাকে বাঁচিয়ে রাখা হলো। কিন্তু পলাশের হোটেল থেকে ওই চাঁদের টুকরো কিশোরী অক্ষত চলে এসেছে, পলাশ সুযোগ পায়নি তাকে নষ্ট করার, পাগলামী করার। পলাশ চুপচাপ বসবে? কেন বসবে? সে-ই গেল শেষবার ষোলো বছরের সেই অর্ধমৃত মুমতাহিণার কাছে। এরপর আর মুমতাহিণাকে দৈববলেও বাঁচানো সম্ভব নয়।
অন্তূর শরীরটা থরথর করে কেঁপেছিল সেসব শুনে। মুমতাহিণার লাশ নীলচে হয়ে উঠেছিল। কতদিন পর লা-শ ছেড়েছিল কে জানে? অথচ অচেনা যুবক জমাট বরফের মতো শীতল।
আগুন্তুক সে- রাতে হুমায়ুন পাটোয়ারীর বুকে কম-বেশি সত্তরটা ছুরিকাঘাত করেছিল। তাকে থামানোর উপায় নেই, থামানোর কেউ নেই-ও। অন্তূ একদৃষ্টে চেয়ে দেখছিল যুবকের খুবলে খাওয়া। রক্তে ছুটে এসে দু এক ফোঁটা অন্তূর শরীরে লাগতেই শরীরটা শিহরণে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিল। জয় ভুল বলেনা, মানুষের র-ক্ত কখনও কখনও অমৃত সুধার মতো লাগে। অন্তূ ভাবছিল, এত সন্তুষ্টিদায়ক দৃশ্য সে কি আগে দেখেছে জীবনে?
হুমায়ুন পাটোয়ারীর যকৃত এবং হৃৎপিণ্ডের টুকরোগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছুরির ডগায় উঠে এসেছিল। অন্তূ তৃপ্তির সাথে দেখেছিল তা। বুক ভরে শ্বাস নিয়েছিল।
এসবের আগে শাহানা আর্তনাদ করে আগুন্তুকের পায়ের কাছে বসে পড়েছিল, “বাপ! মারিস না, বাপ। আমার নাকফুল খুলে নিস না, তুই। আমি উনারে খুশি করতে পারিনাই। যা করার করেই তো ফেলছে, আমার নাকফুল কেড়ে নিস না, তুই। ছেড়ে দে। তোর দোহাই লাগে। ভাব তো, তোর মা যদি এমনে বলতো! পারতি, পারতি কথা না রাখতে। ছেড়ে দে, বাপ। মারিস না। আমার সুখ-দুঃখের সাথী। আমার পাপ-পূণ্যের সাথী…..ʼʼ
অন্তূ এগিয়ে গিয়ে শাহানার ঘাঁড়ের কাছে বাঁ-পা দিয়ে কষে একটা লাত্থি মেরেছিল। শাহানা ছিটকে পড়ে গেলেন। দমলেন না। আবার উঠে এসে যুবকের পায়ের কাছে বসে আহাজারি করে উঠতেই কাঁচের ফুলদানিটা তুলে অন্তূ বিকট আওয়াজে শাহানার মাথায় আঘাত করে। কাঁচের ফুলদানী চুরমার হয়ে গেঁথে যায় শাহানার কপাল ও মাথায়। আগুন্তুক ততক্ষণ বিমূঢ় চেয়ে ছিল। আক্রমণ করেনি, সরায়নি শাহানাকে, একটুও খারাপ খারাপ আচরণ করেনি, যেন সে শেখেনি সেসব। কিন্তু অন্তূর সহ্য ক্ষমতায় আসেনি। শাহনার র-ক্তে হাত ভিজতেই একটা অদ্ভুত সুখ অনুভূতি হলো। ইচ্ছে করল, যে ঠোঁট দিয়ে মিনতি করেছে শাহানা স্বামীকে বাঁচানোর, সেই ঠোঁটদুটো কেটে পশু দিয়ে খাওয়াতে। অনেক রকম হিংস্র ইচ্ছে জাগছিল অন্তূর শাহানার জন্য।
এইসকল নারীদের সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই পঁচা গু মাটিতে পরিণত হওয়া মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন! এদের চেয়ে জঘন্য নারীও কি আর আছে সৃষ্টিকর্তার এই সুন্দর দেখতে দুনিয়াতে? নেই বোধকরি। এরা ময়লা, এরা নরকের ক্ষুধা মেটানোর খাবার। এজন্যই বোধহয় বুজুর্গজনেরা বলে গেছেন, সৃষ্টিকর্তা জুড়ি বেছেই মেলান। খারাপ লোকের বউ সচরাচর ভালো হয়না।
আগুন্তুক যখন থামল, তখন পুরো ঘর একটা লা-শকা-টা ঘরের চেয়ে কম লাগছিল না। ছুরির আঘাত হুমায়ুন পাটোয়ারীর পাঁজরের হাড় গুড়ো করে মেরুদণ্ড ছেঁদ করে বেরিয়েছিল। আগুন্তুকের কালো জ্যাকেটে লাল র-ক্তের ছিটা দৃশ্যমান না হলেও উন্মুক্ত চোখের পাতা, ভ্রুতে র-ক্তের চাপড়ি পড়েছিল।
আগুন্তুক চলে যাবার সময় একবার অন্তূর দিকে তাকিয়েছিল। দুর্বোধ্য সেই দৃষ্টি বিনিময়। সন্তুষ্ট দুটো প্রাণ একে অপরকে শুকরিয়া জ্ঞাপন করল? বোঝা গেল না। ওই চোখদুটো অন্তূ ভুলবে না কখনও। মুখটা দেখা হলো না, জানা হলো না পরিচয়, হলো না বিশেষ কথা। তবুও তারা খুব পরিচিত একে অপরের। তাদের মানসিকতা এবং পথ তো এক!
—
সকালে দেখা গেল, ওয়ার্কশপের সামনে এবং বাগানের ধারে ছেলেদের যে আবাসিক একতলা বিল্ডিংটা আছে, সেখানে লা-শ বিছিয়ে আছে। ধ্বংসলীলা চলেছে অন্ধকার এক অবরুদ্ধ রাতে।
ঢাকায় সম্মেলনের জেরে রোডে-ঘাটে হানাহানি তো চলেছেই। আবারও জামায়াত ইসলামীর কয়েকজনের ফাঁ-সি-র রায় কার্যকর হলো। দেশে উত্তাল শিবিরগোষ্ঠী। বিরোধী দলের নেতৃবর্গরা তখন অবরুদ্ধ আছে। কতজনের মৃত্যুদণ্ড জানান দেয়া হলো, কতগুলো গোপন হলো, সে খবর রাখল কে? জনগণ তখন নিজেদের জীবন নিয়ে অতিষ্ট। চারদিকে হাহাকার। রাজধানীর জনজীবনে শোক লেগেছে। মাসের হিসেবে তখন দেশে শতাধিক করে লোক মরে। আসলে কত মরে, জানে কে? মেধাবী ছাত্ররাও নজরে পড়ছিল তখন। গণপিটুনি, গুলি করে মারা, অথবা না জানা সব মরদেহ উদ্ধার রোজকার কাহিনি। তখন দেশটা সন্ত্রাশদের, তখন দেশটা ক্ষমতাসীনদের ও বিশৃঙ্খলের রাজত্বে বন্দি গোটা দেশটা।
সেসব ছেড়ে হামজা ও জয়কে দিনাজপুর ফিরতে হলো। জয়ের পায়ের গোড়ালিতে ব্যান্ডেজ। হাতের কনুইতে টেপ মারা, ভ্রুর ওপরে কেটে গেছে। হামজার ডানহাত মারাত্মক আহত।
তারা পৌঁছাল ইশার নামাজের পর। শাহানা হাসপাতালে, অবস্থা খারাপ। তুলি অসুস্থ অবস্থায় চলে এসেছে বাড়িতে। বাড়ি ভর্তি লোকজন আর পুলিশ। কিন্তু কোথাও অন্তৃ নেই।
জয় ঘরে ঢুকতেই হতবাক হয়ে গেল। মেয়েটা কোথায় গেছে? মামার লাশের পাশে পুলিশসহ বিভিন্ন গভমেন্ট এজেন্সি থেকে লোক এসেছে। মেয়রের বাড়িতে মেয়রের তারই বাবার এমন নৃশংস হ-ত্যাকাণ্ড!
সেসব ফেলে জয় ছুটল অন্তূকে খুঁজতে। গালির খই ফুটছে মুখ দিয়ে। এই অসময়ে হয়রানী না করালেই না! অন্তূদের বাড়িতে গিয়ে যখন জানল, অন্তূ যায়-ইনি সেখানে। তখন টনক নড়ল। বকে উঠল, “শালির মেয়ে! পেরেশানী ছাড়া আর কিছু করালো না জীবনে!ʼʼ
কোথায় যেতে পারে? এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে অন্তূর মতো ঘরবন্দি মেয়ে যেতে পারে। হন্য হয়ে চারদিকে খুঁজল। কোথায় খুঁজবে এই রাতের বেলা মেয়েটাকে? মাথা গরম হয়ে উঠছিল। গোটা শহর ঘুরল। এতক্ষণের উত্তেজনা শেষে চট করে মাথায় এলো, খু-নি অন্তূর কোনো ক্ষতি করেনি তো?
চলবে..
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৪২.
ঘড়িতে রাত বারোটা। শেয়াল আর ঝিঝি পোকার ডাক কবরস্থানের এই নিশুতি নীরবতায় গা ছমছমে একটা পরীবেশ তৈরি করেছে। জয় খাদেমকে খুঁজে পেল না। শরীরের ব্যথাগুলো টনটন করছে। শরীরটা ছোট হয়ে গেছে, ক্ষত বেশি এই জীবনে। এমন কোনো স্থান কি বাকি আছে, যেখানে ক্ষতর দাগ নেই? জয় হুটহাট ভাবে, গায়ের ব্যথার কথা আরমিণ জানলে এখন বলতো? নিশ্চয়ই বলতো, “কর্ম অনুযায়ী ফল পেয়েছেন। আঘাত কেউ অকারণে করেনি নিশ্চয়ই আপনাকে।ʼʼ
দীর্ঘশ্বাস গোপন করে এদিক-ওদিক তাকাল। এখানে না পেলে কোথায় খুঁজবে? মনে মনে ঠিক করল, দেখা হওয়া মাত্র কান-সারার ওপর কষে একটা ঘুঁষি মারবে। এখানে এলেও, আসলে যে এখানে আসার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়নি, এটা নিশ্চিত সে।
কবরস্থানের গেইটটা এত রাতেও খোলা। জয় সন্দেহমাফিক এগিয়ে গিয়ে আশানুরূপ দৃশ্যটাই দেখল। অন্তূ কবরস্থানের গেইটের কাছে হাঁটু ভেঙে বসে অনুরোধ করছে খাদেদের কাছে, “চাচা, একটাবার আব্বুর কবরের কাছে যেতে দিন…আমি আব্বুর সাথে দুটো কথা বলেই চলে আসব। দোয়া এখানে দাঁড়িয়েই করব। কথা দিচ্ছি।ʼʼ
পেছন থেকে অন্তূকে চিনতে এক রত্তিও ভুল হলোনা জয়ের। দম ছাড়ল এবার। অবুঝের এই আবদারে খাদেম ব্যথিত কণ্ঠে বললেন, “মা’রে! এত করে বলা লাগতো না আমারে। কিন্তু কবরের সীমানায় তোদের মায়ের জাতদের ঢুকতে নেই যে…ʼʼ
অন্তূ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। জয় গিয়ে সামনে বসল। অন্তূর মানসিক অবস্থা দিনদিন বিগড়ে অপ্রকৃতস্থ হয়ে উঠছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চাচা! আজ চলুন নীতি ভাঙি। আমি সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি ওকে। দু মিনিটে ফিরব।ʼʼ
খাদেমের নিষেধ শোনার লোক না জয়। অন্তূ লুটিয়ে পড়ে বাচ্চা শিশুর মতো আমজাদ সাহেবের কবরের ওপর। হু হু করে কেঁদে ওঠে। জয়ের কানে খুব লাগছিল কান্নাটা। কী যে করুণ সেই স্বর এই নির্জন রাতে বাপের কবরে পড়ে মেয়ের কান্না! নিয়ম মানেনা মায়া, না মানে রীতি! অন্তূকে টেনে উঠানো যাচ্ছিল না। জয় আপাতত ভুলে গেল সমস্ত হিংস্রতা, যা এতক্ষণে অন্তূর ওপর জন্মেছিল। হাঁটু মুড়ে সামনে বসে বলল, “আরমিণ! রাত হয়েছে। কখন এসেছ এখানে? কোথাও গেছিলে, তুমি। কোথায়— তা এখন জানতে চাইলাম না। এমন একটা পরিস্থিতি, পারছি না টেনে একটা থাপ্পর লাগাতে। আর কত জ্বালাবে আমায়? ওদিকে কেয়ামত হয়ে যাচ্ছে। চলো, আবার আনবো তোমায়।ʼʼ
অন্তূ হাত ছড়িয়ে নিলো। জয় বসে থাকে চুপচাপ। শরীরটা ব্যথা। কী যে দৌড় ঝাঁপ গেছে শরীরটার ওপর! দুজন মিলে দোয়া করল কবরের পাশে দাঁড়িয়ে। জাভেদ আমিরের লাশ পাওয়া গেছিল না। জয়ের তা মনে পড়ল। এখানে তাঁর লাশ থাকলে সে কি আসতো জিয়ারত করতে? সে তো এসব শেখেইনি অন্তূর মতো! পাপী সে। তার প্রার্থনা রব কবুল করে?
রোডে পলাশের বাহিনীর সাথে দেখা হলো। তাঁদের পাঁয়তারায় স্পষ্ট, আজ পারলে জয়কেও ছাড়বে না। পিষে রেখে যাবে। হামজার ভয় পাবেনা আজ, অর্ডার আছে এমন। জয় মিটমাট করার চেষ্টা করল, পারল না যখন, পিস্তল বের করতে হলো। তাতেও ভয় পেত না বোধকরি! কিন্তু কিছু ডিল, কিছু স্বার্থ!
—
হুমায়ুন পাটোয়ারীর লা-শ পচন ধরেছে, তবু তদন্ত ফুরায়নি। হামজাকে বহুবার জিজ্ঞেস করা হলো, “আপনার বাড়িতে কার এত বড় সাহস? এ বাড়ির পাহারা ও নিরাপত্তা…ʼʼ
বাড়িতে থৈ থৈ করছিল বিভিন্ন তদন্ত সংস্থার লোক।জয়-হামজ চুপ। তাদের কাছে জবাব নেই, তবে ব্যখ্যা আছে। বিশ্বব্যাংকেও ডাকাতি হয়, অর্থাৎ সেরকম ডাকাতও আছে। হবে হামজাদের বাড়ি খুব ক্ষমতায় ঘেরা। কিন্তু সেই ক্ষমতার সাথে টক্কর দিতে পারা লোকটাই তো হয় প্রতিদ্বন্দী? এ আর অবাক হবার কী? প্রতিদ্বন্দী কি কখনও দূর্বল হয়? বাহিনী বিশাল ছিল। কিন্তু অন্তূ বলল, ওপরে শুধু একজন এসেছিল। নিচের ধস্তাধস্তিও সে শুনেছে।
এরপর? আর জবাব নেই। জয় কোনো প্রশ্ন করল না। সে তার বউকে যেন মুখস্ত করে রেখেছে। সারাদিন আইনী কর্মকর্তাদের আনাগোনা। মেয়রকে টপকে অন্তূকে তারা প্রশ্ন করতে কমই সুযোগ পেল। তার ওপর অন্তূ কথা বলছিল না। সে পারমাণবিক বোমার মতো। ওকে প্রশ্ন করতে দিলে, ঢাকনা খুলে যাবে। মেয়র নামক ব্যাক-আপটা অতটাও শক্ত নয়, সেই ঝাপটাকে ঠেকাতে পারবে না। হামজা সচেতন।
হামজার বাপ মরেছে। মা মৃত্যুসজ্জায়। অথচ সে নির্লিপ্ত। তার কোনো হুটোপাটা নেই। মানুষ যখন অমানুষিকতার উচু পর্যায়ে চলে যায়, দুনিয়ার পার্থিব ‘মায়াʼ ব্যাপারটা বুঝি ঘোলা হয়ে আসে।
—
সময় পেয়ে জয় শান্ত স্বরে অন্তূকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় গেছিলে?ʼʼ
-“আব্বুর কবরখানা জেয়ারত করতে।ʼʼ
জয় শান্ত চোখে তাকাল, “আমি, জয় আমির। বুঝে চুপ থাকা লোককে তুচ্ছজ্ঞান করতে নেই, আরমিণ। সাতাশে জন্মাইনি আমি। পূর্ণ দশমাস পেটে থেকে জন্মেছিলাম।ʼʼ
-“আমি কোথায় গেছিলাম, সেটা তেমন জরুরী কিছু না। তবু যদি জানতে চান, আমার একটা শর্ত আছে। সুযোগ লুফে নেয়া ভালো।ʼʼ
-“কী শর্ত?ʼʼ
-“আপনাদের ওই গোপন ঘরের চাবি কার কাছে থাকে? এটা জানতে চাই।ʼʼ
-“গণ্ডির বাইরে মৃত্যু থাকে, আরমিণ! তা পার কোরো না। তোমায় মারতে আমার খুব বেশি কষ্ট হবেনা।ʼʼ
-“ঠিক আছে, তাহলে বাদ দিন।ʼʼ
-“আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।ʼʼ
-“আমিও তো শর্ত দিলাম। চাবি চাইছি না তো, শুধু জানতে চাইছি চাবি থাকে কোথায়?ʼʼ
-“বিশেষ কিছুই নেই ওই ঘরে। তুমি কখনও যাওনি, তাই এত কৌতূহল। যা জিজ্ঞেস করছি, জবাব দাও, নয়ত একটানে কণ্ঠনালী ছিঁড়ে আনবো। ধৈর্য্য নেই আমার।ʼʼ
অন্তূ চুপ। জয় অধৈর্য্য হয়ে এগিয়ে আসতেই অন্তূ চট করে হাতে কাঁচের লম্বা ভারী পারফিউমের কৌটা তুলে নিলো। জয় হতবাক হয়ে যায়। অন্তূ বলল, “মৃ-ত্যুটা বিষয় না, কিন্তু কারও ক্ষমতার দাপট দেখাটা অন্যায়। ক্ষমতার দাপট নিয়ে কাছে আসলে জান না নিয়ে ছাড়ব না।ʼʼ
জয় বাউচি কেটে অন্তূর বাহুর নিচে হাত গলিয়ে সোজা অন্তূর চুলের মুঠি চেপে ধরল। মেয়েরা কাত এই এক জায়গায়। হাত শিথিল হতেই কাঁচের কৌটা কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলল জয়। বলল, “দুঃসাহস কতখানি তোর কলিজায়, আরমিণ? একদিন কলজেটা বের করে ওজন করে দেখব।ʼʼ
-“আল্লাহ আপনার ইচ্ছা পূরণ করুন।ʼʼ
-“কোথায় গেছিলে?ʼʼ
-“চাবি কোথায়?ʼʼ
-“কোথায় গেছিলে?ʼʼ
-“চাবি…ʼʼ উচ্চারণ করতে পারে না অন্তূ। একটা গাঢ় চুমু খেয়ে বসে জয়। অন্তূ কষে দুটো আঘাত করল বুকের ওপর, জয় নিরুদ্বেগ। লম্বা সময় পর অন্তূকে ছেড়ে বলল, “এর চেয়েও খারাপ কিছু করি, তার আগে প্রশ্নের উত্তর দাও। যে লোকটা এসেছিল, ওর সাথে কী কথা হয়েছে তোমার? আমরা না থাকা অবস্থায় বাড়িতে কী কী হয়েছে? অনেক কিছু হয়েছে। লোকটার ব্যাপারে বল্। খুব দরকার আমার। বছরের পর বছর ধরে যাকে খুঁজছি, সে বাড়িতে এসে ঘুরে গেছে। বল বল, কী জানিস ওর ব্যাপারে? সাহায্য কেন করেছিস?ʼʼ জয়কে অন্তর্যামী মনে হলো।
-“কিছুই জানিনা। কথা হয়নি, তবে আমি সাহায্য করেছিলাম আপনার মামাকে নরকে পাঠাতে। এ নিয়ে কোনো দ্বিধা তো নেই আপনার! এবার বলুন, চাবি কোথায় রাখা হয়?ʼʼ
-“এত জেদ তোর? এত জেদ কেন তোর? এত সাহস কোথায় পাস, বান্দির বাচ্চা?ʼʼ অন্তূকে বিছানায় ফেলে বুকের ওপর উঠে বসল জয়। গলা চিপে ধরে অশ্রাব্য ভাষায় আরও দুটো গালি দিয়ে বলল, “তুই কী চাস? বাড়িটা জাহান্নাম হয়ে গেছে যেদিন থেকে এসেছিস। এত কীসের তেজ, তোর?ʼʼ
অন্তূর মুখে রক্ত জমে লালচে হয়ে উঠল মুখটা, শ্বাস আঁটকে গেছে, চোখের শিরা লাল হয়ে উঠেছে, তবুও সামান্য ‘উহʼ শব্দ করল না বা কোনোরকম দূর্বলতা প্রকাশ করল না। ছেড়ে দিয়ে হাঁপাতে লাগল জয়। অন্তূকে আঘাত করা আর মূর্তি ভাঙা একই কথা। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে ক্ষিপ্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, “শালি, তোর চাবি চাই, না?ʼʼ
অন্তূ ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল। জয় বলে উঠল, “তোর পা-ছা যদি তুই দড়ি ছিঁড়ে কুত্তা দিয়ে মারা দিস, তো আমি কতক্ষণ লাঠি নিয়ে বসে থাকব?ʼʼ
খাটের এক কোণায় মশা-নাশক অ্যারোসোলের ভর্তি লোহার কৌটা রাখা থাকে। আকস্মিক অন্তূ সেটা তুলে ঠিক জয়ের মুখ বরাবর কষে ছুঁড়ে মারল। থুতনিতে লাগতেই গাঢ় এক জখম তৈরি হয়। জয় হাত সামনে এনে দেখল, র-ক্ত ঝরছে থুতনি থেকে। অন্তূ তাকিয়ে দেখছে তা। তার মুখে তৃপ্তি, চোখদুটো গমগম করছে জলন্ত শিখার মতো, “তোকে বসে থাকতে বলিনি তো। তোর ভালোমানুষি তোর কাছে রাখ। তোকে কে বলেছে, আমায় বাঁচাতে লাঠি নিয়ে বসে থাকতে? তুই যা করেছিস, সে তুই ভুল করেই কর, আর জিদে অথবা ক্ষমতায়, তা যদি আমি অন্তূ কোনোদিন ভুলে যাই, আমি এক বাপের সন্তান না। অথচ আমার বাপ একটাই—আমজাদ আলী প্রামাণিক।ʼʼ
—
দু’দিন বাদে শাহানা মরে গেলেন। সীমান্তর লা-শ পাওয়া গেছে। প্রথম সন্দেহ হামজা পাটোয়ারী। এবার আবার দু’দল করে ইন্টেরোগেশনে আসে। একদল ওর বাপ-মায়ের জন্য, আর একদল সীমান্তর জন্য। রোজ রাজধানী থেকে কল আসে, তদন্তকারীরা বাধ্য হয়ে চলে যায়। উপরমহলের কথা না শুনলে চলে বুঝি প্রসাশনের?
পরিস্থিতি সবার জন্য কেয়ামতের সম। অন্তূকে পলাশ ছিঁড়ে খাবে, হামজা কী করবে তা বোঝা যাচ্ছেনা, জয় কী করছে তা ঘোলা ঘোলা। জয়ের পেছনে কত কেইস ফাইলে জমা হয়ে আছে। এসব সন্দেহ তার ওপর হামজার সমান এসে পড়ছে। অথচ সে দিব্যি ঘুরছে, খাচ্ছে, ভার্সিটি যাচ্ছে, কার্যালয়ে বসছে, কবুরতকে দানা খাওয়াচ্ছে, অন্তূর সাথে সাথে সেধে সেধে ঝগড়া করছে। তার দিন যেন ভালোই কাটছে। আজকাল খুব সিগারেট টানতে দেখা যায় তাকে।
হামজা বেশিদিন এভাবে টিকতে পারবেনা, তা তার বাড়ির পিঁপড়ের দলও জানে। কতদিন তাকে প্রোটেক্ট করবে উপরমহল? যতদিন স্বার্থ আছে? পূরা না করতে পারলে তারাই হামজাকে উড়িয়ে দিতে দ্বিধা করবে নাকি? তার মাথার ওপর ফাঁসির দড়ি রঙ্গ করে নাচছে।
তবুও পৌরসভার উন্নতি করে চলেছে সে। রাস্তাঘাট তৈরি করছে, সরকারী প্রাইমারী স্কুলগুলোতে বেঞ্চি বানিয়ে দিচ্ছে নতুন। সরকার যা বাজেট দিচ্ছে, তার পুরোটা সেসব কাজে লাগাচ্ছে না, সেটা আলাদা বিষয়। জন্মনিবদ্ধনের একটা সামান্য কাগজ সাইন করাতেও হাজার টাকা নিচ্ছে, রাস্তাগুলো বছর না ঘুরতেই পিচ উঠে গর্ত তৈরি হবে, সেসব আলাদা বিষয়। তবে সে শীতে কম্বল দেয়, গরমে টিউবয়েল বসায়, ভাতার কার্ড দেয়। আর জয় ছাত্র সংসদ দেখছে।
তবুও কেন যে বদনাম খড়ের গাদায় আগুনের মতো ধিক ধিক করে বাড়ছিল চারদিক। এটা রাজনীতিবিদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বদনাম না হয়ে পলিটিক্স করা যায়না।
—
এ বাড়িটা স্বাভাবিক না। বাড়ির প্রতিটা ইটও অস্বাভাবিক। কাল এ বাড়ির বাপ-মায়ের শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান। গোটা এলাকার লোক খাবে। সে-রাতে অন্তূকে ডাকা হলো। হামজা প্রশ্ন করল, “আম্মাকে তুমি আঘাত করেছিলে?ʼʼ
-“হ্যাঁ।ʼʼ
-“আর আব্বুকে?ʼʼ
-“ওই লোকটা।ʼʼ
-“চিনতে পারোনি তাকে?ʼʼ
-“না।ʼʼ
-“লম্বা ছিল?ʼʼ
-“হ্যাঁ।ʼʼ
-“আর?ʼʼ
-“আর কিছু দেখতে পাইনি। মুখ বাঁধা ছিল।ʼʼ
-“তবুও সাহায্য করলে?ʼʼ
-“আমি সাহায্য করেছি, তা কী করে বলছেন, আপনি?ʼʼ
-“তুমিও বোকা না, আরমিণ। আর আমিও হামজা পাটোয়ারী।ʼʼ
-“তাহলে তো সব ধারণাই আছে আপনার। আর জিজ্ঞেস করছেন কেন?ʼʼ
-“তবে তোমার ধারণা নেই নিজের অবস্থা সম্বন্ধে।ʼʼ
-“না না, আছে। আছে বলেই তো কিছু মনে হয়না। দেখুন, মানুষের দূর্বল ক্ষেত্র দুটো—শরীরের ব্যথা আর সবশেষে প্রাণটা। কিন্তু মেয়েদের দূর্বল ক্ষেত্র তিনটা—ইজ্জত, শরীরের ব্যথা আর সবশেষে মৃত্যু। বাহ্যিকভাবে আমার সম্মান নেই, তা রাখেননি আপনারা, ঠিক। কিন্তূ আসলে তো আছে। আর সেটা রক্ষা করতে আমার কোনোমতো শ্বাস চলাই যথেষ্ট। আজ আর আমি বোধহয় সেই পলাশের রূফটপের অন্তূ রইনি, মেয়র সাহেব। আর রইল, মরণ! ওটা তো শখে শখে কবুল। এটা কোনো জীবন হলো? ছিহঃ!ʼʼ
হামজা জয়কে বলল, “তোর বউয়ের পড়ালেখাটা বন্ধ করে দে। এত না পড়লেও চলবে। যথেষ্ট শিক্ষিত হলো, এখন সংসার সামলাক, সংসারে কাজও বাড়বে। একটা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে নে।ʼʼ
অন্তূর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। হামজা ভয়ানক সে জানে, কিন্তু শান্ত মানুষের ভয়াবহতা ঠিক কতটা ভয়ানক হতে পারে? পড়ালেখা না করা, জয়ের সংসারে জয়ের বাচ্চা পালন করা, এর চেয়ে বড় দূর্বলতা নেই তো, নাহ নেই আর কিছু অন্তূর! হামজা ঠিক তা-ই পয়েন্ট করেছে। অন্তূ আজ সত্যিই ভয় পেয়ে গেল আরেকবার হামজাকে। কঠিন ভয়। চোখে-মুখেও সেই ভয় ফুটে উঠল। সে পাগলের মতো পেছন থেকে ডেকে উঠল, “মেয়র সাহেব! পড়ালেখা বন্ধ করে আপনি আমায় আঁটকে রাখতে পারবেন বলে মনে করেন?ʼʼ
হামজা পেছন ফিরে সুমিষ্ট হাসে, “শুধু তোমায় বাঁচিয়ে রেখে আমি শেষ অবধি অনেক কিছুই করব, আরমিণ! চোখ দুটোর যত্ন নাও, দেখতে হবে সেসব।ʼʼ
—
বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ি। কাঁচের সমোরহ চারদিকে। সুস্থ চোখে অভিজাত্যের কমতি চোখে পড়ার অবকাশ নেই। দেয়ালগুলো অবশ্য রোজ আওয়াজহীন চিৎকারে বলতে চায়, আমি অমুকের র-ক্তের বদলে আদায় করা টাকায় কেনা, অথবা কোনো আসবাব হয়ত অভিমান করে স্বীকার করেনা, ওটা কেনার টাকা পলাশ কারও বউ ছিনিয়ে নেবার ভয় দেখিয়ে আদায় করে নিয়েছে, মেঝের টাইলসগুলোও অবশ্য বলেনা মুখে—আমার মূল্য অমুক মুদি দোকানদারের সারাদিনের পরিশ্রমের টাকা চাঁদাবাজিতে খোঁয়া যাওয়া পয়সায় কেনা। ওরা জড় বস্তু, ওরা এসব কেন বলবে?
পলাশ হেলে-দুলে ঢুকল হলরুমে। তার কানে এসব চিৎকার মধুর ঠেকে। আজ মদ-টদ খেয়ে আসেনি। সোফায় বসে চেঁচাল, “রূপ?..রূপ! নিচে আয়।ʼʼ
রূপকথা এসে জিজ্ঞেস করল, “কিছু লাগবে, তোমার?
-“হু, পাশে বস।ʼʼ
রূপকথা জানে, পলাশের কী লাগবে। কিছু প্রশ্নের উত্তর।পলাশ রূপকথার ঘাঁড়ে মুখ থুবরে আধশোয়া হয়ে বলল, “পাটোয়ারীদের বাড়িতে গেছিলি কেন রে? একা একা ভালো লাগেনা বাড়িতে, তাই তো?ʼʼ
রূপকথা চোখ বুঁজল, “আমায় মেরে ফেলো না কেন? তোমার নিষ্ঠুরতা আজকাল ব্যথাও দেয়না আমায়।ʼʼ
-“ধুর। মারব কেন? ছোটবেলা থেকে ভালোবাসি তোকে। এতদিনের ভালোবাসায় কেউ একেবারে মারে?ʼʼ
-“ঠিকই বলেছ। রোজ মারতে হলে একেবারে মারা উচিত নয়।ʼʼ
-“কিন্তু তুই আমায় মারতে চাস। এটা জেনে কষ্ট পেলাম। আমি তো খারাপ না।ʼʼ
-“না। আমি মারতে চাই না তোমায়। কিন্তু তুমি যাদের ওপর অন্যায় করো, তারা যদি তোমায় মারে, আমি তাদের বাঁধা দেবার পাপটুকু করতে চাই না।ʼʼ
পলাশ অবাক হবার ভান করে, “এই সাহস কোথায় পেয়েছিস, রূপ? আগে ছিল না। তুই বদলেছিস অনেক।ʼʼ
পলাশের চুলের মাঝে হাত গলায় রূপকথা, “ব্যথার ওপর ব্যথা দিলে আর ব্যথা লাগেনা। আমার মনেহয় তাই হয়েছে। আমার মনেহয় ধৈর্য্য ফুরিয়ে গেছে, অথবা পাগল হয়ে গেছি।ʼʼ
কী সুন্দর দেখতে লোকটা! চোখ, নাক, চুলের বাহার! সুদর্শন স্বামী রূপকথার। তার সাথে খুব মানায় পলাশকে। লোকটা হাসলে খুব সুন্দর দেখায়, নাকটা কুঁচকে চোখদুটো ছোট হয়ে যায়। রূপকথা চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। অদচ মনটা বিষে জেরে আছে। মানুষ মনের কথা শোনে, কে বলে? মনকে লুকিয়ে উপরি রঙে নিজেকে রঙ দিয়ে বছরের পর বছর কেটে যায় এই দুনিয়ায়। তাদের সম্পর্কটা অবর্ণনীয়।
-“জয়ের বউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলি কিছুক্ষণ? চোখ দিয়ে কিছু ইনপুট করেছে তোর ভেতরে?ʼʼ
রূপকথা হাসল, “ওকে তুমি ভয় পাও?ʼʼ
-“না। ও আমাকে ভয় পায়না, এটার জন্য দুঃখ পাই আমি।ʼʼ
-“ঠিকই। ভয়ানক মানুষদের যারা ভয় পায়না, তাদের চেয়ে ভয়ানক নেই।ʼʼ
-“তুই কি ওর মতো হতে চাচ্ছিস?ʼʼ সোজা হয়ে বসে রূপকথার পেট জড়িয়ে ধরে পলাশ। এই সুন্দর শরীরে হাজারও শুকনো ক্ষত।
-“চাইলেই কি সম্ভব? আমি তো তোমার শিকার। ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে মনুষ্যত্বহীন কুকুরে পরিণত হয়েছি। আমি নোংরা। আমি কেন ওর মতো হতে যাব।ʼʼ
-“তুই প্রতিবাদ করছিস, রূপ। আগে করতি না।ʼʼ
-“না, করছি না। সে সাধ্যি আমার নেই। তবে আজকাল আশা রাখি, খুব তাড়াতাড়ি মুক্ত হবো আমি।ʼʼ
-“না। হবিনা। আমি এত দূর্বল না। গোড়া থেকে উপড়ে ফেলব একদম সবকটাকে। তুই চিন্তা করিস না, তুই মুক্তি পাবি না।ʼʼ
আবারও এক নারকীয় রাত। অনেকদিন পরেই। আজ মেয়ে আনেনি পলাশ। মানসিক বিশেষজ্ঞ একবার বলেছিলেন, “অধিকাংশ সাইকো খুব লজিক্যাল এবং কুল হয়। বদমেজাজও এক প্রকার সাইকোপ্যাথ, তবে সেটা হালকা, ভয়ানক নয়। কিন্তু যত শান্ত, তত মারাত্মক।ʼʼ
তবুও আজ রূপকথার সুখ সুখ লাগল। সে কীসের যেন আশা করে আজকাল। কেন যেন মনে হয়, এসবের দিন ঘনিয়ে আসছে। সব বদলাবে। এই অবরুদ্ধ রাত কাটবে। স্বপ্ন দেখাও এক প্রকার সুখ।
—
জয় রোজ অন্তূকে অত্যাচার করে, বিভিন্ন প্রশ্ন করে, কোনো কাজ হয়না। মাঝেমধ্যেই জয়কে সর্বজান্তা মনে হয়। মানুষের আন্দাজশক্তি কতটা প্রখর হতে পারে!? জয় যেমন সেদিন চট করে বলল, “পলাশের বউ এসেছিল বাড়িতে?ʼʼ
অন্তূ চুপ। জয় বলল, “এসে কী কী বলে গেছে?ʼʼ
-“আপনি তো সব জানেন, আপনার সব ধারণা শতভাগ মিলে যায়। এত তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা নিয়েও…আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। অতীত-টতীত ভুলিনি, সেটা আলাদা বিষয়। সেটা বড় কথা না। বড় কথা হলো, আমি জানি, আপনি সব জানেন। আমার এমন কোনো প্রশ্নই নেই, যার উত্তর আপনার কাছে নেই। জিজ্ঞেস করলে বলবেন সেসব?ʼʼ নরম করে বলল অন্তূ।
-“না।ʼʼ
অন্তূ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “চলুন, কিছুটা ডিসকাস করা যাক।ʼʼ
জয় কথা না বলে সিগারেট জ্বালিয়ে দিয়াশলাই রেখে বলল, “তুমি স্বার্থপর, ঘরওয়ালি।ʼʼ
-“নিঃসন্দেহে।ʼʼ মাথা দুলিয়ে হাসল অন্তূ।
জয় তাকায়। অন্তূর চোখে একটুও গ্লানি নেই, আত্মগরিমায় পরিপূর্ণ চোখদুটো। যেখানে বারবার জয়ের মরণ হয়। জয় আজকাল গম্ভীর হয়ে পড়েছে, দুষ্টু সত্ত্বার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেসব ভেঙে আজ হেসে ফেলে গান গেয়ে উঠল,
দুই নয়নে তোমায় দেখে
নেশা কাটে না…. দেখার আশা মেটেনা,
হাজার নয়ন দাও না আমায়, লক্ষ নয়ন দাও না…
এক হৃদয়ে…
আর গাইল না, চট করে থেমে গেল। অন্তূ নির্লিপ্ত। জয় কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে মন্ত্রপুতের মতো চোখের ভাব করে বলল, “আমার কাছে যদি একটা মন থাকতো না! পাক্কা তোর ওপর পিছলা খেত, আরমিণ!ʼʼ
অন্তূ নির্বিকার মুখে চোখ ফেরায়, “আল্লাহ বাঁচিয়েছে, ভাগ্যিস নেই।ʼʼ
জয়ের মুচকি হাসির দমক বাড়ল, “ভাগ্যিস নেই।ʼʼ গা দুলিয়ে হাসল অপলক চেয়ে থেকে।
অন্তূ প্রসঙ্গ বদলায়, “আপনি খেয়াল করেছেন কিনা জানিনা। এত কিছুর পরেও কিন্তু মুস্তাকিন মহান এ বাড়িতে এলো না। এত সব তদন্ত সংস্থার মেলা হলো বাড়িতে, পিবিআই ডিপার্টমেন্টের কত কর্মকর্তা এলো-গেল। অথচ সে আসেনি একবারও। বিয়ের পর তাকে একবার দেখিওনি। বিষয়টা ঘাপলা লাগেনা, আপনার?ʼʼ
-“না, লাগেনা।ʼʼ লম্বা একটা টান দিয়ে ধোঁয়াটুকু গিলে ফেলল।
অন্তূ অনেকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলতে পারল না হতবিহ্বলতায়। জয় জিনে আঁছড় করা লোকের মতো গটগট করে বলল, “তুমি সেদিন মুস্তাকিনের সাথে দেখা করতেই বের হয়েছিলে বাড়ি থেকে। তার বাড়িতে দেখলে, পিবিআই অফিসে দেখলে, কোথাও পেলেনা। এরপর পলাশের ছেলেদের তাড়াও খেয়েছিলে রাস্তায়… এরপর আরও কোথাও গেছিলে, বলছো না… সেটা কোথায়?ʼʼ
অন্তূ হতবুদ্ধি হয়ে গেল, “আপনার ঘাঁড়ে জিন চালান করা আছে?ʼʼ
-“সবটা আন্দাজ।ʼʼ
-“এত নিখুঁত?ʼʼ
জয় হাসল, তো গাল ভর্তি ধোঁয়া বাতাসে মিশলো। হাসি চওড়া করে বলল, “অভিজ্ঞতা বেশি আমার, বারবারই তো বলি। তুমি এই যে ছুটছো, কৌতূহলের পেছনে, একদিন তুমি আমার চেয়েও বেশি ভয়ানক হয়ে উঠবে, ঘরওয়ালি। আমি বুঝি তোমাকে।ʼʼ
-“আমিও বুঝি আপনাকে।ʼʼ
-“আমি জানি। তাই তো দূরত্ব মেটেনা।ʼʼ
-“না মিটুক কখনোই।ʼʼ
জয় অন্তূর দিকে চোখ তুলে অস্পষ্ট হাসে, “না মিটুক।ʼʼ
—
সকাল সকাল জয়ের ফোন বাজছে। অন্তূ রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো। অথচ জয় তখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। উপুড় হয়ে ঘুমায় জয়। অন্তূ দু’বার ডাকল, “জয়? জয় আমির! আপনার ফোন বাজছে। গরম খুন্তির সেঁক দিয়ে ঘুম ভাঙাতে হবে? নাকি মরে-টরে গেলেন?ʼʼ
-“না। জীবিত।ʼʼ চোখ খুলল জয়।
ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে আবার ফিরিয়ে দিলো অন্তূকে, “তোমার ভাবী। কতা কও।ʼʼ
ভ্রু জড়ায় অন্তূ, “নম্বর কোথায় পেলেন?ʼʼ
-“সেদিন তোমায় খুঁজতে গিয়ে নিয়েছিলাম।ʼʼ
মার্জিয়া কথা বলতে পারছিল না। কণ্ঠস্বর দিয়ে রীতিমত ফুপড়ি উঠছে। অন্তূ স্পিকার লাউডে দিয়ে বলল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে, ভাবী?ʼʼ
-“তোমার ভাই…তোমার ভাইয়ের গাড়ি….অন্তূ, কারা জানি তোমার ভাইয়ের গাড়ি পিষে দিয়ে গেছে, অন্তূ।ʼʼ
কেউ একজন কেঁড়ে নিলো ফোন। ভালোভাবে বলল, “অন্তূ! তোর ভাইয়ের নাড়ি-ভুড়ি সব রাস্তায় রাস্তায়। কোম্পানির গাড়ি ছানাবড়া হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে ছাই। অন্তিক খণ্ড খণ্ড হয়ে গেছে, অন্তূ।ʼʼ
জয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসল। অন্তূ মেঝের ওপর বসে পড়ার আগে হামজার শান্ত, জমাট বরফের মতো শীতল মুখটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। অন্তূর চোখ পরিষ্কার তো! নাহ, ঘোলাটে জলে ভরে উঠেছে। হামজা চোখ পরিস্কার রাখতে বলেছিল।
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন]