#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৪৩.
অন্তূ যখন উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যাবে, জয় বাহু চেপে ধরল, “ঘরওয়ালি, ঘরওয়ালি! যাচ্চ কোতায়?ʼʼ
অন্তূ তাকাতেই চোখ বুজে মাথা ঝারা দিয়ে চোখ ঝাপটে ফের বলল, “কোথায় ছুটলে?ʼʼ
অন্তূ হতবাক হয়ে গেল। জয় জানায়, “এ বাড়ির বউয়েরা যখন-তখন বাপের বাড়ি যায়না। ভাবীকে দেখেছ একবারও বাপের বাড়ি যেতে?ʼʼ
-“পাগলামি করছেন, আপনি?ʼʼ অন্তূ কণ্ঠে বিস্ময়। তার কণ্ঠস্বর কাঁপছে।
-“না। পাগলামি করব কোন সুখে? আমি একটা ভালো জাতের মাতাল, পাগল না।ʼʼ
জয়ের রসিকতা সহ্য হলো না অন্তূর। ব্যাকুল হয়ে বলল, “অন্তিকের—ʼʼ
-“দেখার মতো না। দেখেই এসেছি রাতে—ʼʼ
অন্তূ তড়িতাহতের মতো ছিটকে তাকায়। জয় অপ্রস্তুত হবার নাটক করে যেন, ভ্রু উচিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে ঘাঁড় চুলকায়। অন্তূ খানিকক্ষণ কথা বলতে পারেনা, পরে নিস্তেজ গলায় বলল, “কী অপরাধ করেছিল আপনাদের কাছে আমার ভাবীর গর্ভের সন্তান?ʼʼ
জয় দুপাশে মাথা নাড়ে, “চ্যাহ্! জন্মের আগে কেউ অপরাধ করেনা।ʼʼ
অন্তূ হাত ছড়ানোর চেষ্টা করল একবার, পরে থেমে গেল। দৃষ্টি সরালো না জয়ের মুখ থেকে। পাগলের মতো অল্প হাসল, “আমি করেছি অপরাধ! বলছেন না কেন?ʼʼ
জয় দরজাটা একহাতে আঁটকে দিয়ে অন্তূকে টেনে এনে বিছানায় বসিয়ে কপালে একটা চুমু খেয়ে সিগারেট জ্বালালো। অন্তূ বিছানায় আঘাত করে হাত দিয়ে, “শিট! অপরাধ করলাম আমি, আর ওই বাচ্চাটা দুনিয়ায় এসে বাপকে দেখবে না। ড্যাম, ড্যাম, ড্যাম! ড্যাম অন মি।ʼʼ টুপ টুপ করে কয় ফোঁটা পানি পড়ে বিছানায়। আবার শুকিয়েও যায়না, অন্তূ জীবনে কেঁদেছে খুব কম, আমজাদ সাহেব পছন্দ করতেন না।
জয় বসল পাশে। অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “আমাকে যেতে দেবেন না ওই বাড়ি?ʼʼ
-“না। তোমার একটু রিল্যাক্স দরকার। কিছুদিনের দৌড়-ঝাঁপে ক্লান্ত, তুমি। হামজা ভাই এতক্ষণে চলে গেছে। গিয়ে বলেও দিয়েছে হয়ত, তুমি যাবেনা। অন্তিকের ওপর রাগ তোমার। ঠিক না?ʼʼ
অন্তূর মেঝের দিকে তাকিয়ে যান্ত্রিক গলায় বলে, “হ্যাঁ, ঠিক। কিন্তু ওর সন্তানের ওপর ছিল না, জানেন? তা সত্ত্বেও ওর সাথে আমি পাপ করে ফেলেছি। আমার ক্ষমা নেই।ʼʼ
জয় সিগারেটে টান দেয়, “ওসব কাটাছেঁড়া দেখতে পারবে না, তুমি।ʼʼ
-“আচ্ছা। দেখতে যাব না, ওসব।ʼʼ তোতাপাখিকে শেখানো বুলির মতো বলে অন্তূ।
জয় মেঝের দিকে ঝুঁকে বসে সিগারেটের আগায় টোকা দিয়ে জমাট ছাই ফেলে মেঝেতে। হামজার কল আসছে বারবার, তারা দুজন মরা বাড়ি যাবে, কত কাজ পড়ে আছে তাদের। অন্তূ আস্তে করে উচ্চারণ করে, “কেন?ʼʼ
খানিক সময় নেয় জয়, তারপর বলে, “রাজনীতি পুরোটাই একটা নীতির ভাণ্ডার, ঘরওয়ালি। হোক তা দূর্নীতি অথবা সুনীতি। নীতি। তার মাঝে মেজর একটা নীতি কী জানো? জনগণকে কাবু রাখা। কিন্তু আমাদের দ্বারা কখনোই সম্ভব না জনগণের মন জিতে তাদের হাতে রাখা। তাহলে উপায়? কিন্তু হাতে তো রাখতে হবে!ʼʼ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “ভয়। এটা কার্যকর। জনগণের মনে যতদিন আমাদের জন্য কলজে কাঁপা ভয় আছে, ততদিন আমরা আছি। ওটা পুঁজি আমাদের। তোমার ভেতরে তা নেই হয়ে যাচ্ছিল। বিদ্রোহী আর রাজ-প্রতিদ্বন্দীরা জানের ভয়হীন হয়। তাই বলে কি এদের কাবু করার জায়গা নেই? থাকে। এদের পরিবার..ʼʼ
একটু থেমে বলে, “আমি বলেছিলাম, তোমার পরিবারকে আঘাত করতে দুঃখ পাবো আমি। অন্তিককে আঘাত করার সময় খারাপ লেগেছিল আমার। তোমার ভাবী গর্ভবতী, অসহায় মা। জেদ কি ভালো কিছু বয়ে আনে, আরমিণ?ʼʼ ঠোঁট একপাশে বাঁকা করে ‘চ্যাহ চ্যাহʼ শব্দ করে মাথা দোলায় জয়।
অন্তূ মন্ত্রপুতের মতো দুপাশে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়, “না। ভালো কিছু বয়ে আনেনা। খুব খারাপ অবধি যায়। আমি…আমি আমার অপরাধগুলো সব গুলিয়ে ফেলেছি, মনে করান তো পাপগুলো—মনে পড়েনা পাপ। তবে এত বড় বড় দাম যখন দিচ্ছি, কিছু তো করেছি। কী?ʼʼ
‐“তোমার ভয়হীনতা।ʼʼ হ্যান্ডপ্রেসিং বলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, ”হামজা ভাই আর আমার পথ একটা, গন্তব্য দুটো। বিষয়টা এমন—এক রাস্তার মিলিত মোড়ের ওপর লাগোয়া দুটো বাড়ি। আমি যাব একটাতে, হামজা ভাই অপরটায়। কিন্তু পথ তো একটাই, একই স্থানে। সেখানে তুমি একটা বেরিকেট। হয় সেটা সরিয়ে দিতে হবে নয়ত আধভাঙা করে পথ ক্লিয়ার করতে হবে। তোমার নিজস্ব দূর্বলতা নেই। কিন্তু তোমার ভাবী, মা…তাছাড়া অন্তিক আমার আর হামজা ভাইয়ের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা করেছিল। রেপুটেনশ বলতে তো কিছু আছে নাকি? এসব কি ঠিক করেছে?ʼʼ
-“না। ঠিক করেনি।ʼʼ অন্তূ চোখ তুলে তাকায়, “এত হিংস্র মনে হয়নি কখনও আপনাকে।ʼʼ
-“তুমি আমায় চেনোই কতটুকু?ʼʼ জয় ঠোঁট কাঁমড়ে হাসে। আবার জিহ্বা বের করে ঠোঁট ভেজায়।
-“আমি মূর্খ, নির্বোধ। ঠিক বলিনি?ʼʼ
জয় হো হো হা হা করে হাসে। এই হাসিটা অবর্ণনীয়। আনমনে কেউ জোরে হাসলে ভৌতিক লাগে। জয় পারে। তার আনমনা চোখ, ঠোঁটে ফেঁড়ে গা দুলানো হাসি, এটা তার বৈশিষ্ট্য। পাখির মতো ঘাঁড় নেড়ে ওদিক-এদিক তাকায়। অস্থির-চঞ্চল জয় আমির।
সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে মেঝের ওপর। গতরাতে এসে গোসল করেছিল সেই মাঝরাতে। খুন করে এসে গোসল করতে হয়? হামজার জন্যও গরম পানি করতে দেখছে রিমিকে। হামজাও গোসল করেছে? অন্তূ ভাবে। তার মাথায় আবোল-তাবোল ভাবনারা আসছে। কে যেন ডাকছে। সে স্পষ্ট শুনছে। নাম ধরে ডাকছে ওকে। সারা দিলেই বলছে, “মরে যা। যন্ত্রণা কমে যাবে। তোর মতো মেয়ের মরে যাওয়া খুব দরকার।ʼʼ
অন্তূ শুধায়, “মরলেই সব যন্ত্রণা শেষ হয়ে যাবে?ʼʼ
সে বলে, “পাক্কা। তোর বাঁচার হক-ই তো নেই। তুই তোর বাপকে খেয়েছিস, নিজের পর্দা, ক্যারিয়ার, পরিবার, সম্মান, শান্তি, অবশেষে ভাইটাকে, সাথে কিছু অমানুষ শত্রুও লেলিয়ে নিয়েছিস নিজের পেছনে। একটা বাচ্চার বাপকে তার জন্মের আগে খেয়ে বসে আছিস। তোকে বাঁচার হক কে দিয়ে রেখেছে?ʼʼ
-“তাহলে মরে যাওয়াই উচিত, আমার?ʼʼ
-“আলবাৎ তাই। জয়ের ড্রয়ারে অনেক রকমের মেডিসিন-ড্রাগস থাকে। কোনোটা অভার-ডোজ হলেই তুই মুক্ত। তোর মতো নির্বোধদের বাঁচতে নেই, অন্তূ। মুক্ত হ, ব্যথা কমিয়ে ফেল। এত যন্ত্রণা গিলে এমনিতেও সুস্থ থাকবি না।ʼʼ
সাদা পাঞ্জাবীর ওপর আলমারী খুলে নতুন আতরের শিশি বের করে পুরো শরীরে আতর লাগায় জয়। পাঞ্জাবীর কলার টেনে বোতাম আটকায়। হাতে থাকা শিকলের মতো রিস্টলেট খুলে কালো ঘড়ি পরে, গলার চেইনটা পাঞ্জাবীর গলার আড়ালে রাখে। মরা বাড়ি ভদ্র হয়ে যাওয়া উচিত।
অন্তূর নাকে আতরের ঘ্রাণ যেতেই পরিবেশ ভুলে অন্য টাইমলাইনে বিচরণ করতে শুরু করল। সে দেখতে পায়, সামনেই আমজাদ সাহেবের লাশ। চোখে সুরমা, গোলাপজল ছেটানো হচ্ছে, আতর, কর্পূর ইত্যাদির গন্ধ আসছে। চট করে আমজাদ সাহেবের মুখটা বদলে অন্তিক হয়ে যায়। অন্তূ কেঁপে ওঠে থরথর করে। তার জন্য হয়েছে সব। সে কী করে ফেলেছে! তার দুঃসাহস, তার লাগামহীন জবান, তার আপোষহীন চিত্ত— ফলসরূপ মার্জিয়ার শুকনো মুখ অন্তূর বুকে চিড় ধরায়। ওই ছোট্ট জানটা যখন দুনিয়ায় আসবে, বাবাকে পাবেনা, সে কি জিজ্ঞেস করবেনা, ‘কেন আমার বাবা নেই?ʼ মার্জিয়া কি বোঝাবে না, ‘তোর ফুপুকে জিজ্ঞেস কর।ʼ কী জবাব দেবে অন্তূ?
অন্তূর মনে হয়, সে বোধহয় তলিয়ে যাচ্ছে কোথাও। সে কি চেতনা হারাচ্ছে? না, এত দূর্বল তো না সে! প্রতিবাদ! বিদ্রোহ, সত্যের সন্ধান, অন্যায়কে অন্যায় বলা, আপোষ না করে রুখে চলা—এসব কী দিলো তাকে? অভিজ্ঞতা! প্রকৃতি কিছু নিলে বিনামূল্যে নেয়না। এই তো অন্তূকে কতশত অভিজ্ঞতা দিলো, এসব কি টাকায় পাওয়া যায়? জয়ের অনেক অভিজ্ঞতা, তারও নিশ্চয়ই হারাতে হয়েছে?অন্তূ ভাবে, এরপর জয় পশু হয়ে গেছে। অন্তূও তাই হবে একদিন? চুপচাপ মানুষ মারতে হাত কাঁপবে না? মানুষকে গাড়ি চাপা দিয়ে খণ্ড খণ্ড করে এসে রাতে সে চুপচাপ শান্তির ঘুম ঘুমাবে? জয়ের মতো?
অন্তূর আনন্দে বুক নেচে ওঠে। সে তো খালি শিখেছে, মুখ চালাতে। ক্ষমতা আসলে চোখের চাহনিতে, হাতের অস্ত্র চালনার দক্ষতায়, নীরবে উপড়ে ফেলায়। অন্তূ নিজেকে অভিশাপ দেয়, ‘পুড়ে মরে যা তুই। সেবার মনে হয়েছিল, এবার বুঝি কী না কী করে ফেলবি! তোর বাপ মরেছে, টাল হয়েছিস তুই, এবার দুনিয়াটা শাসন করে ফিরবি। তোর মতো মূর্খ আর জাহিরি লোকের তো মরে যাওয়া উচিত। মরে যা তুই।ʼ
নিজেকে দেয়া অভিশাপ অন্তূর খুব পছন্দ হয়। সে হালকা হাসে। সে কেবল চায়—জয়ের মতো বহুরূপী, আর হামজার মতো শীতল হতে। পাবরে? ওরা কথা বলেনা। ওদের মুখ অচল, হাত ও মাথা সচল।
অন্তূকে ঘরে আটকে রেখে জয় বেরিয়ে যায়। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে জয়কে। ঠিক যেন শ্যামা-রাজকুমার সাদা ভূষনে। খাঁটি বনেদি পুরুষ লাগছিল। অন্তূ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘বাদের প্রতি-বাদ করবি আর?ʼ
অন্তূর মনে হয়, আয়নার ভেতরের অন্তূ সাঁয় দিচ্ছে, ঘাঁড় নেড়ে বলছে, ‘আমৃত্যু করে যাব। তাতে এ জান থাক আর যাক। এ মাথা নোয়ানোর নয়, জুলুমকারীদের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলানোর নয়, মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করার নয়…ʼ
দুম করে ভরা পানির বোতলটা তুলে ছুঁড়ে মারে কাঁচের ওপর। ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ে ড্রেসিং টেবিলের কাঁচ। এখন আর ওই অন্তূকে দেখা যাচ্ছে না। অন্তূ জোরে জোরে শ্বাস ফেলে। সেই অন্তূকে বলে, ‘আর কখনও আমার কাছে এলে জ্যান্ত পুঁতে রাখব। এই তুই আর তোর নীতি যা কেঁড়ে নিয়েছিস আমার কাছে, সেসব আমার গেছে, তোর তো একফোঁটা আঁচড়ও লাগেনি গায়ে। সমাজ তোকে কিছুই বলেনা, তুই যে কত বেপরোয়া, তুই উজানের টানে বেতাল-উত্তাল সমুদ্রের বিক্ষিপ্ত আগুন জরা ঢেউ, তা কেউ দেখেনা। অথচ তোর মোহে, তোর নির্দেশনায় আমি নিঃস্ব, আমি কাঙাল, আমি পাগল, আমি বোকা!ʼʼ
অন্তূ চিৎকার করে চুল টেনে ধরে। ছুঁটে এসে হাতের কনুইতে লেগেছে এক টুকরো কাঁচ। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোলে অন্তূ সুখের শ্বাস ফেলে। কার্যকর তো ভীষণ! মানসিক যন্ত্রণাকে ভুলতে শরীরের ব্যথা ভীষণ কার্যকর ঠেকল অন্তূর কাছে। ক্ষততে যে জ্বলুনি উঠেছে, তা মানসিক যন্ত্রণা থেকে মনোযোগ সরিয়ে আনছিল। কোনো ব্যথাই অনুভূত হচ্ছে না। চোখ বুজে আসতেই একটা দুধের বাচ্চা এসে মাথায় হাত রাখে অন্তূর। দেখতে অনেকটা আমজাদ সাহেবের মতো, চোখদুটো অন্তিকের মতো। অন্তূ চমকে ওঠে।
হামজা সাদা পাঞ্জাবীর সাথে সাদা ধবধবে একটা টুপি হাতে নেয়। নাগরা জুতোটা পায়ে চড়াতে চড়াতে জয়কে বলে, “জানাজা কয়টায়?ʼʼ
-“দেরি হবে।ʼʼ
জয় চামড়ার স্যান্ডেলের বেল্ট লাগায় না জীবনে। ওভাবেই বেরিয়ে যাচ্ছিল। কলার ধরে পেছনে টেনে আনে হামজা, “থাপড়ে মুখের নকশা বদলে দেব, শুয়োর। পা তোল।ʼʼ
বাঁ পা দিয়ে মোড়া টেনে এনে ডান পা মোড়ার ওপর রাখে জয়। হামজা ওর স্যান্ডেলের বেল্ট লাগিয়ে দিয়ে কষে একটা চাপড় মারে পিঠে। পিঠ ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে যায় জয়।
—
হামজা ও জয় প্রধান প্রতিনিধিত্ব করল অন্তিকের লা-শ দাফনের। অন্তিক জয় ও হামজার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ করেছিল। শুধু এই কারণ হলে চলতো। এটাই তো শুধু কারণ না ওকে মারার। অন্তূর এত বাড়াবাড়ি মানা যাচ্ছিল না। বাড়িতে শত্রু ঢুকে ওর কারণে বাপ-মাকে মেরে বেরিয়ে গেছে। বাইরের একতলা বিল্ডিং জ্বালিয়ে গেছে, পার্টির দুটো ছেলে মরেছে, কয়েকজন চিকিৎসাধীন। অন্তূ খড়ের গাদায় লাগা আগুনের মতো ধিকধিক করে বাড়ছিল। জয়ের সাথে যা করে অন্তূ, সবই তো কানে যায় ওর। এমনকি স্বয়ং তাকেও তোয়াক্কা করেনা মেয়েটা।
সেদিন অন্তূ মুস্তাকিনের কাছে বের হবার পর রাস্তায় যখন পলাশের লোক অন্তূকে ধরতে এলো, মাজহার এসে ওকে রক্ষা করে বাড়ি নিয়ে গেছে। অন্তূ গিয়েছে, কথাবার্তা বলেছে, আবার সেটা স্বীকার না করে চাবি চায়। চোখে ভয় নেই, জানের মায়া নেই, থামার সম্ভাবনাও নেই। হামজা কত ধৈর্য্য ধরবে?
রাবেয়াকে হামজা বলল, “খালা মা। আরমিণ আসল না। পরে-পাছে এসে দেখা করে যাবে। আপনারা গেলেও পারেন, নিষেধ নাকি? যান না কেন?ʼʼ
রাবেয়া তখন শোকে বিহ্বল। মার্জিয়ার জ্ঞান থাকছিল না, বারবার দাঁত লেগে যাচ্ছিল। কথাটা শুনেও বিশ্বাস করল না মার্জিয়া। কথাও বলল না।
হামজা ও জয় লা-শ মাটি দিয়ে বাড়ি ফিরল মাঝরাতে।
—
-“সেদিন কোথায় গেছিলে?ʼʼ
হামজার প্রশ্নটা চরম শান্ত। জেনেশুনে প্রশ্ন করছে, তবুও মুখটা আন্তরিক। অন্তূ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে, “ঝন্টু কাকার ছেলে মাজহার নিয়ে গেছিল।ʼʼ
-“তুমি গেলে?ʼʼ
-“তো কি মারামারি করার ছিল রাস্তায়? তাছাড়া সে উপকার করেছিল আমার। কৃতজ্ঞতা কাজ করছিল তখন।ʼʼ
হামজা মসৃণ হাসল। একহাতে সে জয়ের চুলে হাত বুলাচ্ছে। পায়ের ওপর পা তুলে বসা। কালচে খয়েরী ফতোয়ার সাথে সাদা পাজামা। অভিজাত দাম্ভিক চেহারা।ঘরে পরার কালো চামড়ার স্যান্ডেল। নেতাগিরি মানায় হামজার সাথে বেশ। অন্তূ মুচকি হাসে, ”আপনার হাসি সুন্দর, মেয়র সাহেব। যে কেউ বিভ্রান্ত হবে এতে।ʼʼ
জয় হামজার কোলে শুয়ে পা তুলে দিয়েছে সোফার মাথায় নকশার ওপর। সে টিভি দেখছে। ইংরেজি সিনেমা চলছে। হরর, সাই-ফাই মুভি—প্যান্ডোরাম। ভয়ানক সব সাউন্ড, দৃশ্য। সে চোখ বড় করে গিলছে।
অন্তূর কথা শুনে ঘাঁড় ফেরালো, “এএ চেংরী, এই! মুখ সামলে। তোর ভাসুর লাগে। মানিস বা না মানিস, খারাপ নজর দিবি না। আমি জীবিত এখনও।ʼʼ
অন্তূ জবাব দেয়না। অনুশোচনা বা আফশোস শব্দদুটো এ বাড়িতে বড়োই অকার্যকর। নিজের বাপ-মা মরায় যে মানুষের চোখে অল্প একটু কাতরতা পরিলক্ষিত হয়নি, শুধু ভেতরে পুড়েছে বোধহয়, তাদের কাছে আশা করতে নেই শোক। অন্তূও আজকাল চেষ্টা করে সেইরকম হতে।
হামজা বলল, “এরপর?ʼʼ
-“ঝন্টু সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, সীমান্তকে এই বাড়িতে বাড়িতে মারা হয়েছে কি-না?ʼʼ
-“হু?ʼʼ ভ্রু উঁচিয়ে মাথা নাড়ে হামজা।
-“আমি বললাম, ‘আমার সামনে।ʼʼ
-“বলে দিলে?ʼʼ হামজা হেসে ফেলল। গম্ভীর মানুষ হুটহাট হাসলে ভালো লাগে না ভয়ানক?
অন্তূ হাসল না, মুখের আকৃতির একটুও পরিবর্তন হলো না। সে বলল, “হ্যাঁ, বলে দিলাম। আব্বু কী বলতো জানেন? বলতো, ‘অন্তূ, সবচেয়ে সস্তা পাকস্থলী কোন প্রাণীর, বলতো?ʼ আমি ভাবতাম, সেই প্রাণীর পাকস্থলী বোধহয় বাজারে খুব অল্প দামে বিক্রি হয়। অনেক খুঁজেও না পেয়ে বলতাম, ‘তুমি বলো, আব্বু।ʼ আব্বু বলতো, ‘যাদের পাকস্থলী অন্যায়-সত্যকে হজম করে ফেলতে পারে ভেতরে।ʼ এরপর আমিও শিখলাম, আমার পাকস্থলীকে দামী বানাতে হলে অন্যায়-সত্যকে উগড়ে দিতে হবে। তবে এখন আমি ভয় পাই। আর এসব করব না।ʼʼ
-“ভয় পাও?ʼʼ দাঁতে জিহ্বা ঠেকায় হামজা।
অন্তূ হাসে, “পাই তো। আপনাকে পাই, জয় আমিরকে পাই। পাবো না কেন, বলুন? এইটুকু বয়সে শুধু কথা বলে যত বড় বড় পর্যায়ের শত্রু কামিয়েছি আমি, আপনারা এতদিনের রাজনৈতিক জীবনে কামাতে পেরেছেন? তাই সেসব বাদ। আমি ভালো হয়ে যাব। আর দু-একটা ভাই থাকলে নাহয় রিস্ক নিতাম। আর নেই। এবার বা কার পালা আসবে! তারচেয়ে চুপচাপ মেনে নেয়া কি ভালো না?ʼʼ
-“ওখানে তারপর কী হলো?ʼʼ
-ঝন্টু সাহেব বললেন, ‘তুমি সাক্ষী দেবে?ʼ আমি বললাম, ‘এরপর আমায় বাঁচাবেন আপনি?ʼ তিনি বললেন,
‘হ্যাঁ, অবশ্যই। তুমি শুধু প্রত্যাক্ষদর্শী সাক্ষী নও। বরং ওই বাড়ির বউ-ও। আরও অনেককিছুই জানো ওই বাড়ির ব্যাপারে। সেইসব বলবে। এর বদলে ঝড়ঝাপটা আসবে, আমি সামলে নেব।ʼʼ
জয় এ পর্যায়ে চট করে বলে উঠল, “সম্বন্ধির নাতি আমার। আমার বউ সাক্ষী দিলেই ব্যাটাশ্শালা একেবারে আমার বালগুলো ছিঁড়ে বোঝা বেঁধে ফেলতো! শালা এবোর্টেড!ʼʼ
অন্তূ বলল, “আমি হেসে বললাম, ‘ওদের হাত থেকে নিজেদের সামলাতে পারছেন না, নিজের ভাগ্নিকে সামলাতে পারলেন না, এখন মরে গেছে, তবুও কোনো প্রমাণ পেলেন না। আমাকে সামলে নেবেন?ʼ ঝন্টু চাচা খুব অপমানিতবোধ করছিলেন বোধহয়, কিন্তু কিছু বললেন না। এতে খালি আমার একটা উপকার হলো, আরেকটা নতুন শত্রু জোগাড় হলো।ʼʼ
জয় হো হো করে হেসে ওঠে। হামজা হামজা কপালে হাত চেপে নিঃশব্দে হাসল। অন্তূ উদাস হবার ভান করে বলল, “নিজেকে আজকাল মাফিয়া হয়। ওদেরও মনেহয় একসাথে এত শত্রু পাড়ি দিতে হয়না। শুধুই আমার মুখের জন্য। শ্যাহ!ʼʼ
রিমি কিছু নাশতা আর শরবত দিয়ে বসল পাশের সোফায়। অন্তূ চুপচাপ চেয়ে থাকে জানালার বাইরে। আনমনা দৃষ্টি। চোখদুটো ঘোলা হয়ে আবার পরিষ্কার হয়। সে কেমন নাটকবাজ হয়ে যাচ্ছে। বুকে পাথর চেপে ঠোঁটে হাসা সহজ না। এটা তার জন্য সুবিধার হবে নাকি ক্ষতির?
—
হামজার বাড়ি ফিরতে রাত হয়। জয় বাড়ি ফিরেছে বিকেলে। গোসল করে বের হলে রিমি ঘরে খাবার দিয়ে এসেছে। অন্তূ তুলির ঘরে ঢুকল।
তুলি মরার মতো বিছানায় পড়ে থাকে। আজকাল কোয়েলের সবটুকু যত্নও তরুর। তার কাছে প্রায় রোজই ইন্টেরোগেশনে আসে তদন্ত সংস্থার লোকজন। তারা যখন তুলির সাথে হওয়া ঘটনা শুনল, এরপর থেকে সন্দেহ জোরালো হয়েছিল, যে ও অথবা এ বাড়ির লোকই সীমান্তর খুনটা করেছে। কিন্তু আজ ক’দিন দেখা যায় লোকজন আর আসেনা। গতরাতে শোনা গেল, হামজা তার এক পার্টির গুপ্ত কালপ্রিটকে সীমান্তর খুনি সাজিয়ে আইনের আওতায় দিয়ে দিয়েছে অলরেডি। আর ফাঁক নেই তাকে সন্দেহ করার। কালপ্রিট স্বীকার করেছে সে সীমান্তকে খুন করেছে, পুরোনো শত্রুতার জেরে। কেইস ডিসমিস।
ঝন্টু সাহেব ক্ষমতা হারানো এক দাঁড়কাক। মাজহার শুধু ফণা তোলা সাপের মতো ফুঁসে বেড়াচ্ছে চারদিকে। এখন কেইস চলছে, বাপ-মা মরার। হামজা খুব লড়ছে। নয়ত সন্দেহ করে বসবে পাবলিক। বাপ-মার খুন হলো, তবু থানা-কাচারিতে দৌড়াদৌড়ি নেই? সে দৌড়াচ্ছে। অথচ কালপ্রিটকে সে জীবন থাকতে পুলিশের হাওলা করবেনা। তাকে তার প্রয়োজন, জয়ের প্রয়োজন।
অন্তূ তরুকে ডেকে নিয়ে বারান্দায় এসে বলল, আমার একটা উপকার করবে?
-“কেন করব তোমার উপকার?ʼʼ
গম্ভীর মুখে তরুকে একটুও মানায় না। অন্তূ হাসল মৃদু, “অকারণে।ʼʼ
তরু চুপ। সে চারদিকে দেখছে, জানছে। অন্তূ সেই লুব্রিকেন্ট, যে আসার এ বাড়ির বদ্ধ জানালার মরিচা ধরা সিটকিনিগুলো একে একে খুলতে শুরু করেছে। অন্তূ বলল, “আমার সাথে যাবে।ʼʼ
-“কোথায়?ʼʼ
-“আমি কোনো খারাপ বা ক্ষতিকর জায়গায় যেতে পারি বলে মনে করো, তুমি?ʼʼ
-“হেঁয়ালি করবেনা।ʼʼ
-“আচ্ছা, করব না।ʼʼ
তরু দাঁড়াল না, ভেতরে চলে গেল চুপচাপ। অন্তূ ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। ঘাঁড় ফেরায় না। তরু বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বললে, “দ্রুত তৈরি হবে। হাত-ধুয়ে নিই আমি।ʼʼ
আলতো হাসে অন্তূ। এই বারান্দা থেকে বাড়ির পেছন দেখা যায়। বিশাল ডোবা ওই সামনে, কালো কাদামাটিই বেশি তাতে পানির চেয়ে। হামজা ও জয়কে দেখে আন্দাজও করা যায়নি ওরা এত গভীর। ছিঁচকে রসিক আর অল্প-সল্প দাপুটেই লাগতো কেবল।
জয় খাচ্ছিল। কোয়েল বারবার প্লেটের ওপর হাত চালাচ্ছে, আমার চলকেত দিয়ে তারপর খাও। জয়, ও জয়, জয়ইইইই! জয়, আমার কথা শোনো..
জয় এতক্ষণে মাছের কাটা বেছে বেশ একটা মিশন কমপ্লিট টাইপের ভাব নিয়ে তাকাল কোয়েলের দিকে, “ক, সম্বন্ধির চেংরী, ক। কী সমস্যা, তোর? ওই ভাবী শালির মেয়েকে বলি, আমি বাঙালি তবে মাছে-ভাতে না। ও শালি! আমারে মাছ দিয়েন না, মাছের বালডা আমি বাছতে পারিনা, আমারে দিয়েন না। ভাতের নিচে পানি উঠে বন্যা হয়ে যাচ্চে, তবুও মাছের কাঁটা বাছা শ্যাষ হয়না।ʼʼ
কোয়েল জোরে করে খামচি দিয়ে ধরল জয়ের হাত, “আমার চলকেত দাও।ʼʼ
-“বাংলা ভাষার সাথে জোচ্চরি করছিস, বেইমান। তোর তো দেশদ্রোহীতার শাস্তি হওয়া উচিত। চলকেত কী? চকলেট। বল, মামা… ও থুক্কু; আমাকে তো আবার কেউ বালের দামটুকুও দেয়না। ক যে, জয়! চকলেট দাও, চকলেট।ʼʼ
অন্তূ রুমে ঢুকতে ঢুকতে শুধরে দিলো, “চকলেট কোনো বাংলা শব্দ না।ʼʼ
-“দ্যাহো! আরেক বেইমান হাজির। এ আবার দেশের সাথে না স্বয়ং ঘরের স্বামীর সাথে বেইমানী করা বেইমান।ʼʼ
অন্তূ কিছুক্ষণ এমনভাবে ইতস্তত করল, যেন সে বাড়িওয়ালার কাছে চুরি করার অনুমতি চাইবে। জয় বলল, “এমনি তো মুখটা হাওড়ার ব্রিজের মতো। এখন এমন লাউডগা সাপের মতো কুঁচকে যাবার কী হলো? কী সমস্যা?ʼʼ
-“আমার কিছু টাকা লাগবে।ʼʼ
অন্তূর টাকা চাওয়ার এই কঠিন সংকোচ দেখে জয়ের একটু হাসিই পেল, তাছাড়া আজ তার মনটাও ভালো। জিজ্ঞেস করল, “কী দরকার?ʼʼ
-“সব দরকার বলা যায়না। ফার্মেসির দোকান তো আছে আশেপাশে, না?ʼʼ
-“আমাকে বলো আমি এনে দিচ্ছি অথবা কাউকে দিয়ে আনিয়ে দিই।ʼʼ
-“তা যদি হতো, তো করতাম নিশ্চয়ই! টাকা দেবেন কি-না!ʼʼ
-“তোমারে টেকা-পয়সা দিয়ে পুষে আমার কী লাভ? লস প্রোজেক্ট মাল ঢালতেছি।ʼʼ
অন্তূ কথা বলল না। জয় সোফার ওপর উড়িয়ে ফেলে রাখা প্যান্টের দিকে ঈশারা করে বলে, “ওখান থেকে নাও।ʼʼ
মাত্র বিশটা টাকা অন্তূ বের করে নেয় হাতে, তবুও মনে হলো তার হাত কাঁপছিল, শিরশির করে কাঁপছিল, চোছে-মুখে অন্ধকার নেমে এসেছিল।
অন্তূ যখন রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, জয় মনোযোগসহকারে খাবার মাখাতে মাখাতে বলল, “বাপের বাড়ি যাচ্ছ।ʼʼ
অন্তূ পেছন ফিরল, অকপটে বলল, “হ্যাঁ।ʼʼ
জয় চোখ তুলে তাকায় না, অন্তূ বেরিয়ে যায় চুপচাপ।
জটিল এক সম্পর্ক-রেখার ওপর দৌড়ে কতদূর পৌঁছা যায়? মানুষের জীবন-পরিণতিতে নিশ্চিতভাবে মৃত্যু দাঁড়িয়ে, কিন্তু সম্পর্কগুলোর?
চলবে…
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৪৪.
অন্তূদের বাড়ির গলিটা ঢালাই রাস্তা, দুপাশে সারি সারি বাড়ি। তরু চুপচাপ হাঁটছিল। অন্তূ বলল, “তোমার কি খারাপ লাগছে?ʼʼ
-“আগে বললে কী হতো যে বাপের বাড়ি আসছো?ʼʼ
অন্তূ মুচকি হাসল। হাসিটা মিথ্যা। অন্তূর চোখে-মুখে নিদারুণ এক অস্থিরতা। এই গলিটা! এই সেই গলি, সেই পাড়া। আজ পাড়ার লোকেরা দেখছে সে ননদের সাথে বাপের বাড়ি আসছে। অন্তূকে দেখে এক মাঝবয়সী মহিলা থামলেন, “কী রে চেংরী! ভাই মরল, দেখলাম না তো তোরে! আসিস নাই?ʼʼ
অন্তূ কিছু না বলে কেবল মুচকি হাসল, হাঁটা থামালো না। তার শরীরে বোরকা নেই। সেলোয়ার-কামিজ। চওড়া ওড়না শরীরে জড়ানো। তবুও নিজেকে নগ্ন লাগে, মনেহয় শরীরটা খোলা। বোরকা ছাড়ার পর হাতে গুণে দু একবার বাইরে বেরোনো হয়েছে।
নীরবতা ভেঙে কঠিন এক প্রশ্ন করে তরু, “হ্যাভ ইউ বিন রেপড বাই জয়, আরমিণ?ʼʼ
আশ্চর্যজনকভাবে অন্তূ হাসল, “যদি বলি তার চেয়েও বড় কিছু, মানবে?ʼʼ
তরু তাকিয়ে রইল। অন্তূ বলল, “ধর্ষিতা হয়ে বদনাম হলে সান্ত্বণা থাকে। কিন্তু মিথ্যা অপবাদ কতটুকু সয়, তরু?ʼʼ
তরু কথা বলতে পারল না। অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি তোমার মায়া হারিয়েছ তার প্রতি?ʼʼ
-“জানিনা। তবে সামনে যেতে কেমন গা গুলিয়ে আসে আজকাল, অপ্রস্তুতবোধ করি। কেন—তা ভেবেছি। উত্তর পাইনি। আর কতদূর?ʼʼ
-“সামনেই।ʼʼ
বাড়িটা আর বাড়ি নেই। পুরোনো মর্গের মতো গা ছমছমে, নিস্তব্ধ যেন, প্রাণের অভাব। হু হু করে কান্নার আওয়াজ আসছে। অসময়ে রাবেয়া নামাজে বসেছেন। অন্তূ রান্নাঘর দেখল, মনে হলো কমপক্ষে দু’দিন কোনো রান্না হয়নি। ঘরবাড়ি মাকড়সার জালের দখলে। জানালাগুলো কতদিন ধরে বন্ধ। কাপড়চোপড় ছিটিয়ে আছে।
আমজাদ সাহেবের ঘরটার দিকে চোখ যেতেই অন্তূর বুকটা সজোরে ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠল। পুরো শরীরটা ঝনঝন করে কেঁপে উঠল। অন্তূ পা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানেই। চোখ ফেটে পানি এসেছে, তা ততক্ষণ টের পেল না, যতক্ষণ না ঝরঝর করে ঝরে পড়ল সেগুলো। সাহস হয়না অন্তূর ওই ঘরে ঢোকার। বোঝা গেল, রাবেয়া ওই ঘরে যান না। হয়ত শূন্যতা সহ্য হয়না!
অন্তূ আস্তে করে ওখানেই মেঝের ওপর বসে। চেয়ে থাকে ঘরটার দিকে। সেই ফতোয়া, শার্ট ঝুলছে আলনায়, ওই তো জায়নামাজটা। টুপি কোথায়? টুপিটা রোজ হারাতো। অন্তূকেই তা খুঁজে দিতে হতো মসজিদে যাবার আগে। আব্বুর মশারীটাও বাঁধা হয়না কতকাল! অন্তূ নিজেকে সামলাতে পারেনা। কতদিন, কতকাল নাকি প্রথমবার এত জোরে, চিৎকার করে কেঁদে ওঠে অন্তূ। ইটের দেয়ালে কাঁপন ওঠে সেই কান্নায়। সব তার পাপ। তার কর্মের ফল। এই অবধি যা সব হারিয়েছে সবই নিজের দোষে।
হুড়মুড়িয়ে সেখানে আসেন রাবেয়া। মার্জিয়া কাছে আসেনা, দূরে দাঁড়িয়ে দেখে। তরু এসে ধরে অন্তূকে।
বিকেল হয়ে আসছিল। অথচ অন্তূ যাবার নাম নেয়না। তরু বলতে পারছিল না। তার জিভ সরে না অন্তূকে বলতে, ‘চলো, ফিরতে হবে।ʼ
মার্জিয়ার পেট উঁচু হয়েছে খানিক। রাবেয়া চেয়ারে বসা। মার্জিয়া বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলে অন্তূ আলগোছে মেঝের ওপর ঠেসে বসে। থরথরে গলায় ডাকে, “ভাবী?ʼʼ
মার্জিয়া তাকায়, নিষ্প্রভ দৃষ্টি তার। বদমেজাজ বা কড়মড়ে দৃষ্টি নেই আর।
-“আমি কি ক্ষমা চাইব আপনার কাছে?ʼʼ
-“তাতে তোমার ভাই সামনে এসে দাঁড়াবে আমার সামনে, অন্তূ?ʼʼ ঠিক ছোট্ট বাচ্চার মতো অবুঝ শোনায় মার্জিয়ার কথাটা।
কঠিন ভালোবাসার স্বামী মার্জিয়ার। বয়স কত হবে? পঁচিশ? ভরা জীবন-যৌবন, পেটে প্রথম সন্তান। সে নাকি বিধবা। মানা যায়?
-“আপনি আম্মাকে নিয়ে কুষ্টিয়া চলে যান।ʼʼ
মার্জিয়া চুপ করে থাকে। অন্তূ বলে, “ওখানে ব্যবস্থা আছে? আম্মুর থাকার জায়গা হবে?ʼʼ অন্তূ ডাকে, “ভাবী, ডাক্তারের কাছে যাবেন? আমার হাতে সময় নেই। আপনারা গতকাল সকালের গাড়িতে কুষ্টিয়া রওনা হবেন। আমি টুকটাক জিনিস বেঁধে দিয়ে যাচ্ছি। আপনি খান না কতদিন? আমার পাপের শাস্তি আমি পাচ্ছি, পাব চিরকাল, পেতে থাকব। ও নিয়ে ভাববেন না। কিন্তু বাচ্চাটাকে কষ্ট দেবেন না।ʼʼ
অন্তূ পায়ে হাত রাখে। মার্জিয়া চমকে ওঠে। অন্তূর দ্বারা এমন কাজ অবিশ্বাস্য। অথচ আজ চট করে ফেলেছে। অন্তূ হাত সরায়না, দু’হাতে মার্জিয়ার পা ছুঁয়ে বলে, “ওই ছোট্ট জানটাকে ভালো রাখবেন ভাবী? আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে, শুধু আপনার স্বামী ছাড়া একদিন আপনাকে সবকিছু দিয়ে ভরিয়ে দেব আমি। আমার ওয়াদা রইল আপনার কাছে। আপনার ছেলে থেকে শুরু করে আপনার লাইফটাইম রিসপন্সিবলিটি আমার। শুধু কিছুটা সময় দিন আমায়। আর নয়ত মেরে ফেলুন। কিন্তু আমি মরলে উকিল হবে কে? বেঁচে থাকার চেয়ে বড় কথা হলো, উকিল হওয়া। আব্বু রোজ তাগাদা দেয়, ধমকে যায় এসে। আমার নামের আগে অ্যাডভোকেট লাগাতে হবে তো। এইজন্য মরতে পারছি না। আপনি এটুকু সুযোগ দিন আমায়, কেমন?ʼʼ
মার্জিয়ার চোখ ভরে উঠলেও পানি গড়ায় না। কোনো কথাও বলেনা সেই বদমেজাজী মার্জিয়া।
অন্তূ রান্নাঘরে যায়। রান্না বসায় চুলোয়। তরু কী ভেবে কী করল কে জানে? সে আন্দাজ করে করে অধিকাংশ প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে ফেলল বড় বড় কয়েকটা ব্যাগে। অন্তূ রান্না করছিল। তরু থালাবাসনগুলো ধুয়ে ফেলল। রাবেয়ার সাথে অনেকক্ষণ বসে কথা বলল। মার্জিয়াকে সান্ত্বণা দিলো।
সন্ধ্যার পর দুজন যায় বাসের টিকেট কাটতে। টাকা দিলেন রাবেয়া। জয়ের কাছ থেকে আনা বিশ টাকার অবশিষ্ট দশ টাকা তাদের এবারের গাড়িভাড়া গেল।
সব ঋণমুক্ত। রাবেয়ার কাছে জমি বিক্রির বেশ কিছু টাকা এখনও গচ্ছিত আছে। তা নিয়ে মার্জিয়ার মায়ের বাড়িতে গেলে খুব একটা অসুবিধা হবেনা। অন্তূ নিজহাতে জোর করে মার্জিয়াকে খাওয়ালো। রাবেয়াকে খাইয়ে দেবার সময় অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইলেন রাবেয়া, “মা হয়ে গেছিস আমার?ʼʼ
-“মা কি মেয়ের স্বামী-ছেলে-সুখ কেড়ে নেয়, আম্মু? অভিশাপ বলো অভিশাপ।ʼʼ
রাবেয়া অন্তূকে জড়িয়ে ধরে এত কাঁদলেন, তা দেখে তরু কখন যে শব্দ করে কেঁদে ফেলল, খুব লজ্জা পেয়েছিল মেয়েটা পরে। অথচ কেন যে বুক ফাটছিল! অন্তূ বলল, “আম্মা! রোজ নামাজে দোয়া কোরো তো তোমার অভিশাপের জন্য! একা থাকবো, বুঝতেই পারছ! কবে দেখা হবে জানিনা। তবে হবে আবার ইনশা-আল্লাহ। ফৌন করব আমি রোজ।ʼʼ
আমজাদ সাহেবের একটা জিনিসও নিতে দিলো না অন্তূ। স মাঝেমধ্যে আসবে তো আব্বুর ঘরে। ঘরটাতে তিনটা তালা মারল। কেউ যদি হামলা করেও, ওই ঘরে আগুন না লাগা অবধি কোনো ক্ষতি যাতে না হয়। নিজের ঘরের দিকে তাকিয়ে হাসল অল্প, “ভুলে গেছিস আমায়? অনেক পর হয়ে গেছি আমি। যদি কখনও ফিরে আসি স্থায়ীভাবে, আবার তোর বিছানায় গা ছেড়ে ঘুমাবো, ইনশা-আল্লাহ।ʼʼ
নিজের বই-খাতা সব বেঁধে সাথে নিলো। পথে তরু জিজ্ঞেস করল, “এখন কোথায় যাচ্ছি আমরা?ʼʼ
-“তালা-চাবির দোকানে।ʼʼ
-“তালা কিনবে? তালা তো মারলে, আর নেই? উনারা তো সকালে বের হবেন!ʼʼ
-“একটা চাবির নকল বানাবো।ʼʼ
-“মানে?ʼʼ
-“রিমি ভাবী গতরাতে একটা চাবি দিয়েছে।ʼʼ
তরু চেয়ে রইল অনেকক্ষণ, তারপর আস্তে করে বলল, “স্টোররুমের চাবি, তাই না?ʼʼ
-“গিয়েছ কখনও সেখানে?ʼʼ
-“গোডাউন তো ওটা। লোহা-ইস্পাত ইত্যাদি থাকে। আমি যাইনি কখনও।ʼʼ
অন্তূ মোড়ে এসে রাস্তা পার হবার জন্য তরুর হাতটা চেপে ধরল। আজ খুব দক্ষ পথচারীর মতো সে-ই কাউকে হাত ধরে রাস্তা পার করল। তরু জিজ্ঞেস করে, “আমায় নিয়ে এসব করছো, ভয় করছে না? ভরসা করো?ʼʼ
অন্তূ আনমনে হাসে, “অ-ভরসার কিছু তোমার চোখে কোনোদিন দেখিনি আমি, তরুনীধি। আমার একটা বোন থাকলে তোমার মতো হতো।ʼʼ
—
জয় সকাল সকাল বেরিয়েছিল ক্লাবে। পৌরসভায় যাবার আগে হামজা কল করে খানিক ঝারল বাড়ি ফেরার জন্য। সে ফিরল দুজনকে সাথে করে। তাদের টানতে টানতে দোতলায় নিয়ে আসছে, “আয়। আজও নিশ্চয়ই আমার শালীরা আমার পছন্দের কোনো মাছই রান্না করে রেখেছে। তোরা খেয়ে যাবি, আয়।ʼʼ
ব্রাশ তখনও হাতে। ব্রাশ করতে করতে সকালে শহর ঘুরে আসা পুরোনো স্বভাব তার। টানতে টানতে এনে ডাইনিং রুমে ওদের দাঁড় করিয়ে ডাকে, “ভাবীই? আরমেইণ! খেতে দে। তরু কইরে? কই রে তোরা সব। এ যা বস টেবিলে। আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসি।ʼʼ
বাথরুমে ঢুকে মুখে-চোখে পানি দিতে গিয়ে লুঙ্গির তলা ভিজে গেল। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে একটু রোগা লাগল। শুকিয়ে গেছে শরীরটা। এমনিতেই ছিমছাম, লম্বু গড়ন দেহের, তার ওপর আরও শুকনো লাগছিল। আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে, “হরি রে হরি। সবাইক বানাইলা মোটা-তাজা, আমারে বানাইলা খড়ি!ʼʼ
হামজা, জয়, ছেলেদুটো সব একসাথে বসে হুড়পাড় করে খেল। হামজা বলল, “তোকে একবার থানায় ডাকা হয়েছে।গিয়ে দেখা করে আসিস।ʼʼ
-“ধ্যাৎ! আমি একা যাইতে পারব না।ʼʼ
-“তো চল, কিছু লোক ভাড়া করে নিয়ে যাই! ষাঁড়!ʼʼ
বাঁকা চোখে তাকায় জয়, হুমকি দেয়, “আমি যদি এখন ঝোল ফেলে তোমার সাদা পাঞ্জাবী নষ্ট করে দিই?ʼʼ
না চাইতেও হেসে ফেলল হামজা। স্নেহভরে খানিকক্ষণ জয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, “বয়স কত তোর? বড় হবি না?ʼʼ
প্লেটে একটা মাছ তুলে দিয়ে সেটার কাঁটা বেছে দিয়ে বলল, -“এবার খা। যদি আসল সমস্যা কাঁটা বাছাই হয়, তাইলে সমস্যা শেষ। এবার মাছ খা।ʼʼ
জয় খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে হামজার দিকে। চট করে বলে, “আজ কী বার?ʼʼ
-“মঙ্গলবার।ʼʼ
-“মঙ্গলবারে মাছ খাইনা আমি।ʼʼ
হামজা হাসে। দুম করে একটা মারে জয়ের পিঠে। উঠতে উঠতে বলে, “আজ দুই-তিনটা বোতল আনিস। ছাদে বসব রাতে।ʼʼ
ত্যাড়ার মতো বলে জয়, “পারব না।ʼʼ
-“লাত্থিটা ঠিক ঘাঁড় বরাবর মারবো।ʼʼ
-“মুখ খারাপ করায়েন না, ভাই।ʼʼ গম্ভীর হয়ে বলে জয়।
হামজা জয়ের কপালের দাগে হাত ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করে, “ব্যথা আছে?ʼʼ
-“ওভাবেই একটু হাত বুলাও তো। ভালোই লাগতেছে।ʼʼ
নিচে হট্টোগোল শোনা যাচ্ছিল। জয় এগিয়ে গিয়ে গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী রে, মিনাজ? কী সমস্যা?ʼʼ
-“ভাই, চাঁদা নিতে আইছে কারা জানি।ʼʼ
-“ওয়ার্কশপে চাঁদা? তাও আবার এই ওয়ার্কশপে? কিডারে আইছে, পাগলে থাপাইছে নাকি তারে?ʼʼ
-“চিনিনা, ভাই। চাঁদা চাইতেছে।ʼʼ
-“চাঁদা ওর শ্যাঁটার মধ্যে ভরে দিচ্ছি, আমি। আসতেছি দাঁড়া।ʼʼ
ধুপধুপ করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে যায় জয়। হামজা পিছে পিছে যায়।
—
রাত পৌনে একটায় বাড়ি ফিরে আর খেল না, জয়। অন্তৃ জিজ্ঞেস করে, “এখন নিশ্চয়ই গিলতে বসবেন?ʼʼ
-“ছাদে যাব। ভাই বসে আছে।ʼʼ
-“মদের বোতলের কর্ক খোলে কীভাবে?ʼʼ
-“এক শট মারবে নাকি, ঘরওয়ালি?ʼʼ
-“না। হারাম।ʼʼ
-“খেয়ে-টেয়ে ইস্তেগফার পড়ে তওবা করে নিও।ʼʼ ঠোঁট বেঁকিয়ে চোখ টিপ মারে জয়। অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “সাথে কিছু স্ন্যাক্স টাইপের কিছু নেবেন?ʼʼ
জয় ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে আসে অন্তূর দিকে। অন্তূ যতটা পিঠ বাঁকালো, ঠিক ততটা ঝুঁকে এক ইঞ্চ দূরত্ব রেখে ফিসফিস করে বলে, “চোরের বাণী মিষ্টি হয়, ভক্তিতে ভরপুর হয়, ঘরওয়ালি। এনিথিং রং?ʼʼ
অন্তূ ছিটকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনাদের বিরোধীতা করার সাধ্যি আর কোথায়, আমার? তার চেয়ে বরং মেনে নিয়ে বেঁচে থাকা ভালো না?ʼʼ
-“বাড়ি ফাঁকা তোমাদের। ওরা আবার মেনে নিয়ে কোথায় গেল?ʼʼ
অন্তূ একদৃষ্টে তাকিয়ে হাসে, “আপনি খুব শেয়ানা, জয় আমির।ʼʼ
জয় কপাল উঁচিয়ে বলে, “আর তুমি?ʼʼ
-“গর্দভ।ʼʼ
দুপাশে মাথা নেড়ে অন্তূর কথার বিরোধীতা করে বলে, “কোথায় গেছে, ওরা?ʼʼ
-“আমাকে বলেনি। শুধু বলল, দূরে কোথাও চলে যাবে, যেখানে আমার মতো মেয়ের মুখ না দেখতে হয়।ʼʼ
জয় হো হো করে হেসে উঠল। আচমকা হাসি থামায়। অন্তূর গলাটা ঘর্মাক্ত হালকা। ওড়নাটা বুকের ওপর পড়ে থাকলেও গলার নিচ থেকে বুক অবধি উন্মুক্ত। চিকন একটা স্বর্ণের চেইন, মসৃণ গলাটাকে নেশাদ্রব্যের মতো করে তুলেছে। সেই নেশায় জয়ের নিঃশ্বাস ভারী হলো। ঠোঁট ফাঁক করে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলে। নজর সরিয়ে অন্তূর হাত থেকে বোতলদুটো নিয়ে চটপটে পায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
অন্তূ চিন্তিত মুখে পায়চারী করছিল ঘরে। খানিক বাদেই জয়কে ফিরে আসতে দেখে চমকে উঠল। অস্বাভাবিক লাগছিল জয়কে দেখতে। এদিক-ওদিক পাখির মতো তাকাতে তাকাতে জিজ্ঞেস করে, “আমি কাছে আসি, তা তুমি চাও না, না?ʼʼ
-“হ্যাঁ।ʼʼ অকপট স্বীকারক্তি।
-“আমি কি তোমার চাওয়ার ধার ধারি? এসব ম্যানার্স আমার সাথে পোষায়?ʼʼ হাঁপানোর মতো শ্বাস ফেলে জয়। চোখে-মুখে আবেদন।
অন্তূ আতঙ্কিত চোখে পিছিয়ে যায় কয়েক কদম। আচমকা হাতটা চেপে ধরে টেনে আনে জয় ওকে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে আদেশ করে, “শার্টটা খুলে দাও।ʼʼ জয়ের রোজকার এই অভ্যাস। ঘরে ঢুকে প্রথমে বলবে, ‘শার্টটা খুলে দাও।ʼ অন্তূ কোনোদিন মানেনা সেই কথা। কিন্তু আজকের বলাটা আলাদা শোনায়। মাতাল হয়ে ফিরলে সে যে অন্তূর কাছে আসার চেষ্টা করেনা, এমন নয়। কিন্তু খেলে খায় অতিরিক্ত, জবরদস্তি করার বিশেষ শক্তি থাকেনা ভেতরে, ঘুমে ঢলে পড়ে।
অন্তূর মনে হলো, আজ বুঝি নিস্তার নেই। জয় আবার বলে, “শার্টটা খোলো, কুইক।ʼʼ
অন্তূ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জয় আকস্মিক অন্তূর খোলা ঘাঁড়ের ওপর মুখ থুবরে পড়ে। দুটো চুমু খায় সেখানে। অন্তূর চুলের পেছনে হাত দেয়, আলতো করে আঙুল নাড়ায় সেখানে। গায়ের অনেকটা ভার অন্তূর ওপর ছেড়ে দিয়ে বলে, “শরীর ভালো লাগছে না, মনটাও। আজ হয় অভার-ডোজ অ্যালকোহল নয় তুমি। মনটা তোমাকেই বেশি টানছে, ঘরওয়ালি।ʼʼ
জয়ের আজকের ছোঁয়া নমনীয়, অথচ অন্তূর শরীরে যেন বিঁষ প্রবাহিত হয়ে শিরা-উপশিরায় পৌঁছে যাচ্ছিল। হুট করে ভাবে, সে তো বিবাহিতা মেয়ে। জয়-ই হোক, জয় যদি এই জয় না হয়ে একটা স্বামী জয় হতো, সে কি এই সুন্দর স্পর্শগুলোকে অনুভব করতো না, সায় দিতো না? ততক্ষণে ঘেন্নারা অন্তূর লোমকূপগুলোতে খোঁচা দেয়, শিউরে ওঠে তীব্র আক্রোশ আর বৈরাগে।
বোতলের কর্কটা কেমন এক কায়দায় যেন জয় একহাতে খুলে ফেলে। একটা শব্দ হয়, বুদবুদ আকারে অনেকটা কোমল পানীয় মেঝেতে ছিটকে পড়ে ছোট হুইস্কির বোতলটা থেকে। অন্তূ সেটা কেড়ে নেয়। বোতলগুলোর মাঝে কোনোটাতে ডায়াজিপাম ড্রাগ মেশানো আছে। রিমি মিশিয়ে আবার কর্ক আঁটকেছে। আজ আর পরিকল্পনা সফল হবেনা বোধহয়। জয় মুখ তুলে চায়, অসভ্যর মতো হাসে, “তুমি কি চাচ্ছ ইনডাইরেক্টলি? মদ না তুমি, তুমি না মদ?ʼʼ হা হা করে হাসে।
অন্তূ জয়কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে, “কোনোটাই না। বসুন বিছানায়। চোখ-মুখ বসে গেছে, আপনার। রাতে আজকাল কোথাও থাকছেন, সকালে ফিরছেন। কী হয়েছে?ʼʼ
লম্বা শরীরটা অল্প কুঁজো করে লুঙ্গি উঁচিয়ে ধরে খাটের কাছে এগিয়ে গিয়ে ধুপ করে শুয়ে পড়ে, অর্ধেকটা পা ঝুলে থাকে মেঝের দিকে। চোখ বুজে বলে, “এভাবে কথা বলোনি কখনও আমার সাথে তুমি।ʼʼ
-“কী করব? ঘেন্না লাগে যে!ʼʼ
হাসে জয়, “জায়েজ।ʼʼ
যখন হাসে, তখন সারাক্ষণ ঠোঁটে হাসি থাকে। বিরক্ত হয় অন্তূ। সোফায় বসতে যাচ্ছিল। জয় বলে ওঠে, “এখানেই বসো। ধরব না তোমায়। তুমি অনুমতি দিলে হোটেলে যাই? আধাঘন্টার মধ্যে ফিরব, ততক্ষণ বই-টই পড়ো একটা। চট করে এক পাক মেরে আসি, খিদে পেয়েছে।ʼʼ
অন্তূ খাটের কাছে এসেও দু কদম পিছায়, মুখ দিয়ে ছিটকে বের হয়, “ছিহ!ʼʼ
জয় হো হো করে হেসে ওঠে, “আমাকে কি হাফ-লেডিস মনে হয়, তোমার?ʼʼ
-“তো, রোজ আমায় না পেয়ে হোটেলে যান? আপনি লম্পট, নোংরা, চরিত্রহীন, ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ।ʼʼ
জয় উঠে বসে অন্তূর হাত ধরে টেনে বিছানায় পাশে বসতে ইশারা করে জয়, “বসো।ʼʼ
অন্তূ বসে চুপচাপ, জয়ের হাতটা সরিয়ে দেয় আস্তে করে। জয় পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকায় অন্তূর চোখের দিকে, জিজ্ঞেস করে, “একটা ছেলে পূর্ণ যৌবন পায় কত বছরে, জানো?ʼʼ
অন্তূ জবাব দেয়না। জয় বলে, “কম-বেশি পনেরো বছরে।আমার জন্ম ১৯৮৭। সেই হিসেবে এখন বয়স সাতাশ পার। অর্থাৎ যৌবন প্রাপ্তির পর একযুগ কাটিয়ে এসেছি। শুকনো শুকনো কাটাতে বলছো? পুরুষের দ্বারা সম্ভব? সম্ভব, সন্ন্যাসীদের দ্বারা। শুনেছি তাঁরাও নাকি পাগল হয়ে যায়।ʼʼ
অন্তূর বিরক্ত লাগছিল এসব শুনতে। তবু চুপ করে চেয়ে রইল। জয় বলল, “বিয়ে করলাম এইতো পরশুদিন। সেদিন নারীসঙ্গ হালাল হলো। তাও আবার দেনমোহর বাকি।ʼʼ হেসে ফেলল জয়, “বিশ বছরের ওপারে কোনো ম্যাংগো পুরুষকে চরিত্রবান ভাবলে হয় তুমি মূর্খ নয়ত কঠিন বোকা। চরিত্র শুধু মেয়েলোকের কাছে নষ্ট করতে হয়না, মোরওভার, বহুত উপায় আছে। আমি কিন্তু বিজ্ঞানের ছাত্র।ʼʼ
অন্তূ কথা বলছিল না। জয় আচমকা অন্তূকে চমকে দিয়ে ওর কোলের ওপর মাথা রেখে পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে পড়ল। অন্তূর হাতটা টেনে চুলে রেখে চোখ বুজল। অন্তূ মনে হলো, তাকে কয়েক গ্রাম বিঁষ টুপ করে গিলে ফেলে যেন সেটা হজম করে নিতে হলো। চোখ বুজে ভারী শ্বাস ফেলল।
জয় খানিকক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকে ওভাবেই। হঠাৎ-ই আনমনে বলল, “আমি প্রথম সিগারেটে টান দিয়েছি কবে, জানো? তেরো বছর বয়সে। সাল–২০০০। গলা জ্বলতো খুব। প্রথম খুন করেছি পনেরো বছর বয়সে। সাল—২০০২। প্রথম মেয়েলোকের কাছে গেছি আঠারো বছর বয়সে।
সাল–২০০৫। তুমি তখন কোথায় ছিলে? কবে এসেছ, তুমি? তুমি এলে এই তো সেদিন। ততদিনে আমি বহুত কিছু পার হয়ে এসেছি।ʼʼ
অন্তূ চেয়ে রইল জয়ের বন্ধ চোখ-জোড়ার দিকে। ভ্রুর নিচে অনেকটা জায়গা, চোখের পাতার ওপরে। চটা পড়া ভ্রু। ডাগর ডাগর চোখ জয়ের, গভীর, খাঁদে পড়া। আচমকা সেই চোখ খুলে অন্তূর চোখের মণি বরাবর তাকালো জয়। অন্তূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একটুও নড়চড় আসেনা, জয় তা দেখে হাসে, “২০০৭ এর এক সম্মেলনে মারামারি করতে গিয়ে বিরোধী দলের দুটো লোক মার্ডার হয়ে গেছিল। কিছুদিন পর আমাকে নিয়ে গিয়ে….লেপ-তোষক সেলাই করার সুঁচ দেখেছ?ʼʼ
-“দেখেছি।ʼʼ
-“সেই সুঁচ সারা শরীরে ফুটিয়েছিল। পিঠে একটা বিশাল ক্ষত আছে। ওখানে চাপ্পর দিয়ে কুপিয়ে লবন লাগিয়েছিল। সেগুলো এখন সারাদেহে…ʼʼ
-“ইশপেশাল ট্যাট্টু, তাই তো?ʼʼ
জয় হো হো করে হাসল, “এই না হলে আমার ঘর-ওয়ালি।ʼʼ
-“এখন প্লিজ চুপ করুন। এসব শুনতে বিরক্ত লাগছে। অন্য কথা বলুন, আর নয়ত ঘুমান। আমার পরিবারে কেউ কোনোকালে কসাই ছিল না, এসব শুনতে ভালো লাগার কথা না আমার।ʼʼ
-“কষ্ট লাগছে না, তোমার?ʼʼ ঠোঁট কামড়ে হাসে জয়।
-“না। ওরা কোনো খারাপ কিছু করেনি। আপনি দুটো প্রাণ নিয়েছেন, সেই হিসেবে ওরাই মহান। অন্তত আপনার প্রাণটা দিয়েছে, যার মূল্য অমূল্য। আপনি কিন্তু দুটো প্রাণ নিয়েছেন, শুধুই অহেতুক ক্ষমতার লড়াই, যার কোনো ভিত্তি নেই। কেবল ওই সকল স্বৈরাচার, পুঁজিবাদী, সুবিধাবাদী লোকদের পা চাটতে গিয়ে এইসব করেন আপনারা। ভাগ দেয় ওরা আপনাদের? যা তো সব ওরাই ভোগ করে, আপনারা কুকুরের মতো লেজ নাড়িয়ে বেড়ান মাঝ থেকে। আবার এই পার্টির হয়ে মারামারি করার মূর্খতাকে আজকের যুবসমাজ বাহাদুরী হিসেবেও নিয়েছে, কে বোঝাবে ওরা যে আসলে ওইসকল নেতাদের পা চাটা জিভ বের করা কুকুর।ʼʼ
জয় অনেকক্ষণ চেয়ে রইল, “কোনো আপোষ না, না? একটুও আপোষ না, কোথাও না?ʼʼ
-“অন্তত অন্যায়ের সাথে না।ʼʼ
চট করে উঠে বসে জয়। খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, “ঘরওয়ালি! আপনি মারাত্মক এক উকিল হবেন, আই স্যোয়ার! তবে ভালো উকিলদের কিন্তু জানের ঝুঁকিও ভালো থাকে। তখন হয়ত আমি থাকব না! আমি আর বেশিদিন বাঁচব না।ʼʼ
অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “আপনার খারাপ হবার গল্প নিশ্চয়ই বেশ ট্র্যাজেডিক?ʼʼ
-“আমার খারাপ হবার কোনো গল্প নেই। ওসব সিন্যামাটিক চিন্তা বাদ দাও। অতীত কোনোদিন মানুষকে খারাপ বানায় না, বড়োজোর বিদ্রোহী বানায়। লোকে আমায় খারাপ বলে, যদিও আমি আমার মধ্যে কোনো খারাপ দেখিনা। আমার খারাপ হবার পেছনে কোনো কারণ নেই। আমি খারাপ, তাই আমি খারাপ, কারণ আমি খারাপ। কারণহীন কারণে আমি খারাপ।ʼʼ
অন্তূ হতাশ শ্বাস ফেলে। ‘যতবার বোঝার চেষ্টা করবে, ততবার ব্যর্থ হবে।ʼ এরকম একটা অদৃশ্য ব্যানার ঝুলিয়ে রেখেছে যেন জয় নিজের চারপাশে। অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “ড্রয়ারে এইসব ড্রাগ কীসের? কী করেন এগুলো দিয়ে?ʼʼ
চলবে..
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৪৫.
জয় ড্রয়ার থেকে কিউব বের করে নিয়ে মেলাতে মেলাতে বলল, “ড্রাগ দিয়ে কী করে মানুষ?ʼʼ
-“আপনাকে কখনও নিতে দেখিনি।ʼʼ
-“তুমি আমায় চোদন খাইতেও দেখো নাই, ঘরওয়ালি। তোমারে ঘরে আনার পর প্যাদানি দিয়ে ফেলে রাখলে দেখতে পেতে।ʼʼ কিউব মেলাতে খুব মনোযোগী সে, “মেরে যখন ছাল ছড়িয়ে ছেড়ে দিতো আমায়, তখন কী করতে বলো? হাসপাতালে পড়ে থাকব, কোন আমলে সেই ব্যথা কমবে, সেই আশায় বসে থাকব? অত ধৈর্য্য কোনোকালেই নাই আমার। অভার-ডোজ ড্রাগ পুশ করে বসে থাকি। দেহের সেন্সিটিভিটির ওপর সাডেটিভ কাজ করা শুরু করলে ব্যথা অনুভূত হয় না ঠিকঠাক। অনুভূতি নাশ হয়ে, রিফ্লেক্শনলেস হয়ে যায় শরীর। এরপর আল্লাহর ওয়াস্তে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঘুম বা সাবকনসেশন। জেগে থাকলেও দুনিয়ার খেয়াল নাই। ড্রেসিং করাও আমার পক্ষে সম্ভব না সেন্সিটিভ অবস্থায়। বিরক্ত লাগে শরীরে ব্যথা লাগলে। রাগ হয়। একে তো থকথকে কষানি ঝরা ঘা, তার ওপর যদি কাঁচি, ছুরি, ওষুধ, তুলো মেরে খোঁচায়…তখন কড়া ড্রাগ ছাড়া উপায় নাই।ʼʼ
অন্তূ কপাল চেপে ধরে আস্তে করে বলে, “টাল লোক।ʼʼ স্পষ্ট জিজ্ঞেস করে, “আপনি এডিক্টেড হয়ে যাননি?ʼʼ
-“তখন কিছুদিন করে রিহ্যাবে থাকি।ʼʼ আনমনে বলল। সে খুবই মনোযোগ সহকারে কিউব মেলাচ্ছে।
অন্তূ চোখ বুজে আঙুল দিয়ে কপাল চেপে ধরল, “কতবার মার খেয়েছেন জীবনে?ʼʼ
জয় এবার তাকাল চোখ তুলে, চোখে-মুখে রসিক ভাব ফুটিয়ে তুলে বলে, “মেলা-বার।ʼʼ
-“কেন?ʼʼ
-“অকাম করছি, চোদন খাইছি। সোজা হিসাব। তুমিই তো বললে, অকারণে কেউ কাউকে মারেনা।ʼʼ
-“ভুল বলিনি। আপনি অকাম করেছেন কেন?ʼʼ
-“আমার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য কী, জানো? আমার কোনো যুক্তি নেই। তুমি যদি আমার এক কাজের সাথে আরেক কাজ রিলেট করতে যাও, প্যাচ ওখানেই লাগবে। আমার যখন যা-আআ মন চায়, তা-ই করি। সেই ক্ষমতাটুকু হাতে রাখি। মন আর মেজাজ মুহুর্তে মুহুর্তে ব্যতিক্রম কিছু করতে চায়, আমি তা-ই করি। তো আমার কাজে যুক্তি খোঁজা আর টাকলার কাছে চিরুনী খোঁজা এক হলো না?ʼʼ
অন্তূ চুপ রইল। সে আজকাল নিজেকেই বোঝেনা, জয়কে বোঝার প্রশ্নও ওঠেনা। নিজের মানসিকতার এমন কঠোর পরিবর্তন ওকে প্রতিক্ষণে অবাক করে। জয় কিউব এলোমেলো করে ফের মেলাতে মেলাতে বলল, “মেরে ফেলোনি কেন আমায়?ʼʼ
অন্তূ বেশ কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত থেকে অল্প হাসল, “মৃত্যু যদি শাস্তি হিসেবে দিতে চাওয়া যায়, তাহলে শর্ত কী বলুন? সামনের জনের চোখে মৃত্যুর ভয় থাকতে হবে, ঠিক বলিনি?ʼʼ
জয় চোখ তুলে তাকায়। অন্তূ বলল, “সেটা আপনার নেই। আমি নিজেকে দিয়ে বুঝি—আমাকে মৃত্যু দেয়া এক প্রকার মূল্যবান উপহারের সমান আজ। সেটা কেউ দিলে সেটা কি আমার জন্য শাস্তি হবে? আপনার চোখে মৃত্যুর ভয় নেই, শরীরে আপনার ব্যথা নেই, জয় আমির।ʼʼ
জয় শব্দ করে হেসে ফেলল, “তো…ছেড়ে দেবে আমায়?ʼʼ
অন্তূ মুচকি হেসে মাথা নামায়, ঠোঁটের কোনের হাসি চওড়া হয়। অল্প চোখ তুলে ফিসফিস করে বলে, “আঘাত ভুলতে আছে, তবু আঘাতকারীকে নয়। শরীর ও মন ক্ষত রাখেনা, ভরাট করে নেয় কোষের বিভাজনে। তাই বলে দাগ মিলিয়ে যায়না। বোকামি হোক অথবা অন্যায় সহ্য করতে না পারার ব্যর্থতায়; হারানো তো আর কম হারাইনি। তার একটা দায় আছে তো আপনাদের, নাকি?ʼʼ
-“ভুলবে না আমায়, তাই বলছো তো?ʼʼ
-“আসামীকে ভোলা উচিত নয়, জয় আমির।ʼʼ
জয় গা দুলিয়ে আলতো হাসে, একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বলে, “স্বামী নই, না?ʼʼ
-“আসামী হিসেবে খারাপ তো নন। এই ঢের।ʼʼ
জয় আবার শুয়ে পড়ল অন্তূর কোলে। আরাম করে মাথা রাখে। কোমড়টা আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে পেটের দিকে মুখ লুকোনোর মতো করে মুখ গুঁজে জায়গা খোঁজে। অন্তূ মাড়ির দাঁত আঁটকে চোখ বুজে শ্বাস ফেলে।
খানিকক্ষণের জন্য যখন বোতল নিয়ে বাইরে গেছিল, ছাদে যায়নি। সেই স্টোররুমের ওপারের দরজার ওপার গেছিল। অন্তূ টের পায়। আজকাল খুব যেতে দেখা যায় সেখানে। দিনে কয়েকবার, বারবার। বাড়িতেও থাকছে না ঠিকমতো। বিক্ষিপ্ত ঘুড়ির মতো বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ফনফন করে ঘুরছে। উদ্দেশ্য অজানা। কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে যেন। কিছু করছে। হুমায়ুন পাটোয়ারী মরার পর থেকে দুই ভাইয়ের গতিবিধি অস্বাভাবিক। রাতে বাড়ি ফেরে ক্লান্ত হয়ে। চোখে-মুখে এক প্রকার তাড়া, খুঁজে ফেরার ব্যর্থতা।
—
একবার সকাল সকাল পুলিশ এলো পাটোয়ারী বাড়িতে। হামজা ওয়ার্কশপে ছিল, পুলিশদেল সাথে নিয়ে দোতলায় এলো। জয় সকালে উঠে কোথায় বেরিয়েছিল। সে এলো খানিক পর। সদর দরজায় ঢুকেই পুলিশ দেখে চওড়া হাসল। ইন্সপেক্টর রশিদের দিকে চেয়ে কপালে হাত তুলে সালাম ঠুকে বলল, “কী অবস্থা, স্যার! ঠিকঠাক?ʼʼ
-“তোমার খবর ভালো?ʼʼ
মাথার ওপর হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল, “আমি অলওয়েজ বিন্দাস থাকি।ʼʼ
-“এখন কেমন আছো?ʼʼ
-“বরাবরের মতো ফার্স্ট ক্লাস।ʼʼ
-“থানার আলমারিগুলোর তাক যদি সব তোমার ফাইলেই ভরা থাকে, চলবে তাতে?ʼʼ
-“চলতেছে তো। সাবানের ফেনার ওপর পা পিছলে যেমন ছোঁৎ করে চলে যায় না? ওইরকম চলে যাচ্ছে।ʼʼ
-“তারপর যে ধপাস করে পড়ে যেতে হয়, সেটা ভুলে যাচ্ছ।ʼʼ
-“বি পজিটিভ, স্যার। নিজেকে সামলে নেবার দক্ষতা থাকলে পড়তে পড়তে না পড়ে সোজা খাঁড়া হওয়াটা বিশেষ কোনো আশ্চর্য ব্যাপার না।ʼʼ
পুলিশ মাথা নাড়ল, “আর পারবে না। পিছলাতে পিছলাতে দেয়ালের দিকে যাচ্ছ। পিঠ ঠেকে যাবে এবার।ʼʼ
-“দেয়ালটা কোন ব্র্যান্ডের সিমেন্টে তৈরি, স্যার? মজবুত খুব? না মানে, দুই নম্বর সিমেন্টের তৈরি হলে, বেশি জোরে যদি ধাক্কা খাই, দেখা গেল দেয়াল ধসে পড়ল। আমার পিঠ-টিঠ দুই-চার খণ্ড হয়ে যাবে, সেটা পরের হিসাব। তবে দেয়াল পেরিয়ে যেতে পার।ʼʼ
জয়ের রসিকতা অবিরাম চলতে থাকল। জয় ফ্যানের রেগুলেটর ঘুরিয়ে স্পিড হাই করে এসে গা এলিয়ে সোফায় বসল। পুলিশ বলল, “কী কী করে বেড়াচ্ছ আজকাল?ʼʼ
-“গলায় একটা খাঁকারি মারেন। কিছু আঁটকে আছে। জোরে কোরে কাশি দেন একটা।ʼʼ
-“সব অভিযোগ বাদ দিয়ে যেটা মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে—তোমার স্ত্রীকে তুমি জোরপূর্বক তুলে এনেছ
মানহানিসহ বিভিন্ন নির্যাতন এবং মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছ, পরিবারকে জিম্মি করে।ʼʼ
-“যাহ শালা! সাংঘাতিক কেইসে ফেঁসেছি তো এবার। তবুও কিছু নারীবাদী বিটিশ্শালী গলা ফাঁটাবে— আমাদের অধিকার দাও। আমরা নারী, আমরা বাল ছিঁড়তে পারি।ʼʼ মুখ চেপে ধরল নিজের, “ক্ষমা, স্যার, ক্ষমা। কীসব ভালো কথা যে খারাপ সময়ে বেরিয়ে যায় মুখ দিয়ে!ʼʼ
-“অভিযোগ কি সত্যি?ʼʼ
জয় বুকে হাত দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর ভঙ্গিতে বলল, “অভিযোগ করেছেন আমার স্বর্গীয় শালা সরি সম্বন্ধিবাবু। যেহেতু সে স্বর্গীয়, তাই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার চান্স নেই, কবর থেকে কেউ ইন্টারভিউ দেয়নি কোনোদিন। তার বোনকে ডাকুন। আমি কী বলব? আমি বললে নিজেকে ডিফেন্সই তো করব, নাকি নিজের সম্মানের হরির লুট বিলাবো?ʼʼ
জয় গলা হাঁকালো। অন্তূ এসে দাঁড়াল কিছু সময় পর। জয় বলল, “বেয়াই বাড়ির লোকজন এসেছে, কিছু প্রশ্ন করবে তোমায়। সসম্মানে জবাব দাও, গিন্নি!ʼʼ
অন্তূ বসল না, দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। জয় তরুকে ডাকে। তরু এসে দাঁড়ায় আস্তে করে। জয় আদেশ করল, “আমার জন্য ফুল এক প্লেট ভাত আন তো। মাছ-টাছ দিস না, কেমন? মাছ আমার অত্যাধিক পছন্দের। এজন্য খাইনা। ফ্রিজে রান্না করা মাংস থাকলে তা গরম করে আন।ʼʼ
পুলিশদের দিকে তাকিয়ে বলল, “খেয়ে নিই, কেমন! আপনারা কথা বলেন। জেলের পঁচা রুটি খেলে ডায়রিয়া হয় আমার। বাড়ির ভাত ভালো করে গিলে যাই, তাও দু একদিন পেট ঠান্ডা থাকবে অন্তত। তারপরের দিনগুলো বরফ লাগাবো।ʼʼ
সেন্টার টেবিলের ওপর পুরো ভুরিভোজ নিয়ে বসে প্রোগ্রাসে গিলতে থাকল জয়। আশপাশের পুলিশের দল ঘিরে আছে। অন্তূকে প্রশ্ন-টশ্ন করছে। জয় দুনিয়া-দারী ভুলে খেয়ে যায়। বিশাল হাতের তালুতে একেকটা লোকমা বড় বড় করে মুখে দেয়া তার স্বভাব। ছোট লোকমায় খাবার খেতে পারেনা। খাওয়া ছাড়া এই মুহুর্তে আর কিছু তার বোধে নেই যেন। সে খাচ্ছে, পানি নিচ্ছে মুখে, তরুকে ডেকে সালাদ আনাচ্ছে, লবন কম হয়েছে বলে ঝারি মারছে। খাওয়ার হিড়িক বাঁধল তার।
বাড়ির লোক এবং পুরাতন অফিসারেরা অবাক হলো না ওর এমন আচরণে। কিন্তু নতুন যারা এসেছিল, তারা হতবাক চোখে দেখে গেল জয়ের অদ্ভুত নির্লিপ্ততা। যার চোখে পুলিশের ডর নেই, জেলে যাবার উদ্বেগ নেই। বরং সে পুলিশ বসিয়ে রেখে খাচ্ছে।
অন্তূকে জিজ্ঞেস করা হলো, “আপনাকে রোজ টিজ করতো, জয় আমির। কথাটা সত্যি?ʼʼ
জয় খুব আশাবাদী, অন্তূর তেজদীপ্ত কণ্ঠে ‘হ্যাঁʼ শোনার জন্য। এরপর তাকে দু একদিন হাজতেও কাটাতে হবে, ভেবে কষ্ট লাগছিল। হাজতে গেলে তার কবুতর কে দেখবে, মদ পাওয়া যাবেনা ওখানে, অন্তূর সাথে ঝামেলা করা হবেনা, সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগছিল, যে বউকে সে খাওয়া-পড়া দিয়ে পুষছে, সে তার সাথে বেইমানি করবে, তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে। কষ্টে পেট ফেটে হাসি আসছিল, হাসল না। পুলিশরা পাছে পুরাটাই পাগল ভাববে। অল্প-সল্প ভাবলে চলে, পুরোটা পাগল প্রমাণিত হওয়া ঠিক না।
কিন্তু খাওয়া রেখে তড়াক করে চোখ তুলে তাকাল, যখন অন্তূ বলল, “না।ʼʼ
একে একে সকল অভিযোগ নাকচ করল অন্তূ। জয় এঁটো হাত প্লেটে ডুবিয়ে হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে অন্তূর দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী মুখের দিকে। তার মনে হলো, সে হ্যালুসিনেট করছে। অথচ সত্যিই অন্তূ সবগুলো অভিযোগ অস্বীকার করল। জয় গভীর চোখে তাকিয়ে থাকে শুধু, চুপচাপ…।
পুলিশেরা অবাক হয়ে, কর্কশ স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আপনার ভাই এমন একটা অভিযোগ ডায়েরি করলেন কেন?ʼʼ
অন্তূ পেশাগত মিথ্যাবাদীর মতো স্পষ্ট স্বরে জানায়, “বাড়ির কেউ সম্মত ছিল না বিয়েতে। ওদের পছন্দ ছিল না, জয় আমিরকে। ওরা এই বিয়ে মেনে নেয়নি। আমাকে অনেকবার ফিরিয়ে নিতে চেয়েছে, আমি যাইনি। এক্ষেত্রে তাদের ধারণা হলো, জয় আমির হয়ত প্রেসার ক্রিয়েট করে আমায় ধরে রেখেছে। তেমন কিছুই নয়। আমি সদিচ্ছায় এবং সজ্ঞানে সংসার করছি। ওটা শুধুই মাত্র আমার বাড়ির লোকের আক্রোশ ছিল।ʼʼ
সন্দিগ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করল রশিদ, “আপনি কি কাউকে ভয়য় পাচ্ছেন? সত্যি লুকোচ্ছেন?ʼʼ
-“আপনার তাই মনে হচ্ছে?ʼʼ
রশিদ উপহাসের হাসি হেসে মনে করিয়ে দিলো, “এ ঘটনার দিন দুয়েক পর আপনার ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছি আমরা।ʼʼ
-“সড়ক দূর্ঘটনার ঘটনা এই প্রথম শুনেছেন?ʼʼ
-“সড়ক দুর্ঘটনা?ʼʼ
-“খু-ন মনে হচ্ছে?ʼʼ
-“আমি কিছু বলিনি, আপনিই বলছেন, ম্যাডাম।ʼʼ
-“আপনি যা ঈঙ্গিত করছেন, আমি সেটাই কেবল স্পষ্ট করে দিলাম, অফিসার।ʼʼ
আর কিছু বলার থাকেনা। অগত্যা আপাতত চলে গেল তারা। জয়, হামজা তখনও হিসেব মেলাতে ব্যস্ত। তরু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। রিমি রান্নাঘরে কাজবাজ করছে। জয় অবশিষ্ট খাবারে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে উঠে পড়ে। তার অস্থির লাগছে। মেজাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে অকারণেই অথবা অজ্ঞাত কারণে। অন্তূর দিকে বারবার তাকায়। অস্থির-চঞ্চল চোখে তাকায়। মেয়েটার দৃষ্টি জানালার বাইরে।
—
কোত্থেকে যেন একটা লাল রঙা শাড়ি কিনে আনল জয়। লাল তার প্রিয় রঙ। আর কোনো রঙ প্রিয়র তালিকায় নেই। র-ক্তের রঙ লাল, জীবনে প্রথমবার র-ক্তের রঙ দেখার পরেই রঙটাকে জয়ের ভালো লেগেছিল, অতিরিক্ত ভালো। এরপর কোনো রঙকে ভালো লাগেনি আর।
অন্তূকে বলল, “ঘরওয়ালি, এটা পরবেন আজ গোসল করে। শালার বিয়েই তো করলাম আমি। বাসরে বউ ফেলে গেলাম হাসপাতালে। তেলতেলে কপাল। শাড়ি পরা অবস্থায় দেখিই নাই তোমায়। ওই বাড়ি থেকে বের হবার সময় একবারই দেখেছিলাম, তাও ভালোমতো না। আজ পরো, একটা ছবি তুলবোনে দুজন। ঠিক আছে?ʼʼ
-“নেই।ʼʼ
-“ঠিক নেই?ʼʼ
-“না।ʼʼ
-“পরবে না?ʼʼ
-“উহু!ʼʼ
-“কেন?ʼʼ
-“ইচ্ছে করছে না।ʼʼ
-“পরবেই না?ʼʼ
-“পরবোই না।ʼʼ
হাসে জয়। খানিকক্ষণ কেমন করে যেন চুপচাপ তাকিয়ে থাকে অন্তূর উদাস মুখখানির দিকে। অন্তূ জয়ের দিকে না তাকিয়েই বলে, “এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না। অস্থির লাগে।ʼʼ
জয় আস্তে করে বলে, “আমারও।ʼʼ
বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। বসন্তের রোদে ছাদে কবুতরের ঘরের সামনে বসে শাড়িতে খানিক মদ ঢেলে দিয়াশলাই জ্বালায়। কাপড়ের লাল রঙটা পুড়ে যখন ছাই হয়ে কালো হয়ে আসছিল, রাগ লাগে জয়ের। পছন্দের রঙটা বদলে অন্ধকারে ছেঁয়ে যাচ্ছে। র-ক্ত আর অন্ধকার তো প্রায় একই। দুটোই বিনাশী। তবুও আজ দুটোকে এক করতে পারে না জয়। অন্ধকারকে তার অপছন্দ না। তবু আজ আগুনের ওপর রাগ হচ্ছিল খুব। অথচ নেভালো না। আগুন আর পাপের মধ্যে তফাত নেই। এক প্রান্তে ধরে গেলে পুরোটাকেই পোড়া অথবা গোটা মানুষটাকেই পাপী সম্বোধন করা হয়। ফেরার পথ?
জ্বলতে দেয় শাড়িটা। ভাবে, আচ্ছা! ছাই হয়ে যাওয়া ওই কালো রঙকে কি আর লালে ফেরানোর উপায় নেই? উত্তর আসে, না। সময়ের মতোই তো ছাই আর পাপ। খড়ি পুড়ে ছাই হয়, তার স্তূপ থেকে পুনরায় খড়ির জন্ম হয়না। পাপের স্তূপ থেকে পূণ্যের জন্ম হয়না। রঙহীনতা থেকে রঙের জন্ম হয়না। চলে যাওয়া কিছুই ফেরে না। যা ফেরে, তা গেছিল না।
গা ঘামলে সহ্য করতে পারেনা জয়। আজ শার্টটা ভিজে উঠল। তবু জলন্ত আগুনের খুব কাছে তপ্ত সূর্যকিরণের নিচে বসে রইল। কবুতরগুলো গা ঘেঁষছে, আজ তাদের মালিক আদর করছে না, কথাও বলছে না। তারাও হতাশ হয়ে ফিরে ফিরে যাচ্ছিল।
—
ডাইনিং টেবিলের ওপর আঙুল বাজাতে বাজাতে গান ধরে জয়,
প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে,
জীবনের পাতার কত যে খবর রয়ে যায় অগোচরে
কেউ তো জানেনা প্রাণের আকুতি বারেবারে সে কী চায়
স্বার্থের টানে প্রিয়জন কেন দূরে ঠেলে সরে যায়…
ধরণীর বুকে পাশাপাশি কভু কেউ বুঝি কারও নয়..
মাথা দুলিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছিল। হামজা আসবে, এই সন্ধ্যা মাথায় নিয়ে চারটে গপাগপ খাবে দুজন, এরপর বেরোবে। হামজা এসে জিজ্ঞেস করে, “তোকে আবার স্বার্থের টানে দূরে কে ঠেলল?ʼʼ
-“হ্যার বাল। সবসময় জরুরী না গানের সাথে জীবনের কাহিনি মিলবে। মন চাইতেছে গাইলাম। গানটা প্রিয় আমার। তুমি চান করতে যাবা?ʼʼ
-“তুই করবি না?ʼʼ
-“তোমার মতোন খাইস্ট্রা তো না আমি। সবসময় পরিষ্কার থাকি। ডেটল সাবান মাখি। নিরানব্বই ভাগ জীবাণুমুক্ত থাকি।ʼʼ
হামজা গোসলে যায়, জীবনে তোয়ালে নেয় না। সেটা রিমিকে দিয়ে আসতে হয়। রিমি একটা নতুন পাঞ্জাবী ও পাজামা ইস্ত্রি করে বিছানায় রাখল। চিরুনি, পারফিউম, মুজিব কোট ইত্যাদি রেখে বেরিয়ে যাচ্ছিল। হামজা ধরল, “আমাকে এড়িয়ে চলতে ভালো লাগে?ʼʼ
-“কিছু লাগবে, আপনার?ʼʼ
গম্ভীর হামজা কড়া স্বরে জোরালো করে বলল, “তোমাকে লাগবে।ʼʼ
-“আছি তো।ʼʼ
রিমিকে ঘুরিয়ে নেয় হামজা নিজের দিকে। মুখটা উঁচু করে ধরে। রিমির চেহারায় বদল এসেছে, সেই চাঞ্চল্য আর নেই, পুরোদস্তুর পুরোনো গিন্নির মতো রূপ। যেখানে শুধু কর্তব্য পালনের তাগিদ, মনের চাহিদার অভাব।
হামজা বলল, “আমার দিকে তাকাও। আরমিণের রোগ লেগেছে, হ্যাঁ? তোমার, তরুর… ওর মতো বিদ্রোহী হয়ে গেছ সকলে? খুব তাড়াতাড়িই কাবু করে ফেলেছে সে তোমাদের?ʼʼ
-“খারাপ তো কিছু করেনি। একসময় আমিও বিমুখ ছিলাম ওর থেকে। চট করে একদিন বুঝলাম, গোটা বাড়ি ভয় পায় ওকে, ওর তেজ এবং নির্ভীক চোখকে। আমি আকাশ থেকে পড়েছিলাম যখন টের পেলাম, আপনি চিন্তিত ওকে নিয়ে। কিছু তো আছে। নেই? সত্যকে বলে দেবার এবং অন্যায়কে অন্যায় বলার জন্য মাত্রার চেয়ে বেশি দুঃসাহস আছে ওর। হারাতে ভয় নেই। কিছু তো ক্রেডিট পাওয়া উচিত। হারালে লোকে দমে যায়। ও প্রতিবার দ্বিগুন জেদে ঝলসে ওঠে।ʼʼ
-“তাতে ক্ষতিটা কার?ʼʼ নিঃশব্দে হাসে হামজা। চোখদুটো জড়িয়ে যায়, নাকের দুপাশে ভাঁজ পড়ে, কাধটা দুলে ওঠে।
রিমি চোখ ফেরায়, “অথচ আপনারা শঙ্কিত ওকে নিয়ে।আমি তো রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে আসা মেয়ে। তবুও আপনার কাছে কাবু হয়ে পড়ে আছি দিনের পর দিন। পতিসেবা করে চলেছি। একটা সাধারণ মেয়ে বাড়িতে ঢুকতেই গোটা নকশা বদলে ফেলেছে, আপনার-জয়ের ভিত নড়িয়ে রেখে দিয়েছে।ʼʼ
-“ভুল মানুষের আঁছড় লাগিও না, গায়ে। ওর কাছে কিছুই নেই, নিঃস্ব ও। শুধু শুধু আমাদের কাজে বাগড়া দিতে আসছে। আচ্ছা রিমি, তোমার কি নিজেকে আমার বাধ্য মনে হয়?ʼʼ
রিমি বিভ্রান্ত হয়ে তাকায়। হামজা বলে, “আজ থেকে আমার কোনো কাজ করতে হবেনা তোমাকে। রাগ করে বলছি না কথাটা। তবে আজ তুমি আমার কোথাও একটা আঘাত করে বসলে। ভাবতাম, শুধু একটু অভিমানে জড়িয়েছ। নয়ত তুমিও খুব একটা পবিত্র পরিবারের নও। তোমার সব স্বাভাবিক লাগার কথা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, গোটা রঙ বদলে গেছে তোমার। তোমার ধারণা তোমার সই, রিমি।ʼʼ
রিমি অপ্রস্তুত হয়ে যায়। হামজা শান্ত মানুষ, ফায়সা কথা বলেনা। যা বলে তার একটাও অহেতুক না। হামজা বলল, “নন দ্য লেস, লেট মি রিমিইন্ড ইউ ওয়ান থিং—ওর সাথে যা হয়েছে, তার সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই। ও তুমি নও। আর না আমি জয়। ওদের সম্পর্কটাই একটা যুদ্ধ-বিগ্রহের ওপর স্থাপিত। আমার-তোমার তা ছিল না। কিন্তু তুমি ছোট্ট একটা বিষয় থেকে অনেগুলো দিন দূরত্ব বাড়িয়েছ। এত চাপা হতে নেই। ছোট মানুষ তুমি।ʼʼ
রিমি তাকিয়ে থাকে। হামজার মুখটা অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে উঠেছে। রিমি মুখ ফিরিয়ে নেয়। তবু তীব্র অভিযোগ আর অভিমান তাকে কথা বলতে দেয়না। হামজা জিজ্ঞেস করে, “কিছু বলবে?ʼʼ
-“কী বলার আছে? কী বলব আমি?ʼʼ কেঁপে ওঠে কণ্ঠটা। এইসব সময় রিমির কখনোই বিশ্বাস হয়না, এই লোকটা তাকে ভালোবাসেনা। কোনোদিন মারেনি, কড়া কথা বলেনি। চোখে সবসময় গভীর এক অনুভূতি। রিমি বোকা বনে যায় এই লোকের সামনে বরাবর। সেই ছোট্ট রিমিকে কত ভালোবেসে ওর বাবার কাছ থেকে চেয়ে এনেছিল। বাপ-ভাইয়ের স্বার্থ ছিল হামজার সাথে বিয়ে দেওয়ায়, হামজা ছিল নিঃস্বার্থ।
হামজা চট করে আলতো হাসে। কাছে আসে রিমির। দুই চোয়ালে হাত রেখে দাড়ি-গোফের মুখটা এগিয়ে নিয়ে শব্দ করে রিমির ঠোঁটের কিনারায় চুমু খায় একটা। রিমির চোখ বুজতেই এক ফোটা তপ্ত জল গাল বেয়ে যায়। ভেজা ঢোক গেলে একটা। আচমকা হামজা ফিসফিস করে বলে, “তুমি জানো, আমি কোনো পাটোয়ারী বাড়ির ছেলে-টেলে কেউ নই?ʼʼ
রিমি বিদ্যুতে শক খাওয়ার মতো ছ্যাৎ করে দু পা সরে যায়। হামজা হাসে, শব্দ হয়না। পাজামা-পাঞ্জাবী পরে, চুল ঠিক করে, পারফিউম লাগায়। কোট গায়ে চড়াতে রিমির দিকে তাকালে রিমি আস্তে কোরে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কে আপনি?ʼʼ
-“ঢাকা মোহাম্মদপুর বস্তির কোনো এক কুটুরিতে অত্যান্ত অবহেলায় জন্ম নেয়া একটা ছোটলোক, নোংরা, নিঃস্ব প্রাণ, আমি।ʼʼ ভ্রু নাচায়, “কী? এবার একেবারে তালাক? হা হা হা!ʼʼ এত জোরে শব্দ করে কখনও হাসেনি হামজা। গা’টা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে রিমির। কথা বেরোয় না।
হামজা বলে, “আমার মা বলে যাকে জানো, শাহানা পাটোয়ারী। সে সন্তান জন্মদানে জন্মগত অক্ষম নারী। নারীত্ব ছিল না তার মাঝে। ছোটবেলা থেকে হুমায়ুন পাটোয়ারীকে এ থালায়-ও থালায় মুখ দিতে দেখেছি। তাকে বাঁধা দিইনি, কারণ সে আমার বাপ না বরং আমিই তার বাপ হয়ে উঠেছিলাম। কৃতজ্ঞতা অথবা বাপের ধর্ম যা-ই বলো, খানিক প্রশ্রয় দিতে হয়, দিয়েছি তাকে, বাপ হিসেবে ছেলেকে যা দিতে হয়, আমি তাকে সব দিয়েছি। আমাকে শাহানা মা নিয়ে এসেছিল এখানে, আমি তখন দুই বছরের বাচ্চা। রাজধানীর রাস্তার ধারে ময়লায় গড়াগড়ি খেতাম। পাটোয়ারী বাড়ির সবাই বড়লোক হলেও হুমায়ুন পাটোয়ারী চিরকালের চরিত্রহীন আর কামলা। কোনোদিন কাজ-কাম করেনি। এখানে এসেও সেই অভাবেই মানুষ আমি, যতদিন না অন্যায়ের পথে গেছি। আমাকে স্কুলে পড়িয়েছিল জয়ের মা। হুমায়িরা ফুপু। কতদিন? শ্বশুরবাড়ি থেকে কতদিন চালাবে আমাদের সংসার, আমাকে? আমার যখন বয়স চৌদ্দ, সে-সময় তারও…ʼʼ
রিমি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। হামজা হাসে, “আমার তখন ক্লাস নাইনের রেজিস্ট্রেশন। ফুপু নেই আর… বাড়িতে চাউল কেনার টাকা নেই, আমার স্কুলের ফি দেবে কোত্থেকে? পাটোয়ারী বংশের কেউ কাউকে দেখেনা। নিজেদের অর্জন নিজেদের করে নিতে হয়। আমিও একসময় ক্ষমতা অর্জন করে সবগুলোকে উপড়ে ফেলেছি। এখন দেখবে যেদিকে তাকাবে, সব আমার নামে। গোটা পাটোয়ারী নামটা আমার, হামজার। আমার আসল নাম জানিনা আমি। দরকার নেই। শুধউ আরও ক্ষমতা চাই, আরও… তা ছাড়া আমি আজ আমি হতাম না, আমি হতাম না, রিমি।
তখন দেশে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান চলছে। স্বৈচারার বিরোধী আন্দোলনে দেশ তোলপাড়। আমাকে বলা হলো, পড়ালেখা ছেড়ে দিতে। তা সম্ভব ছিল না। আমি ছোটলোকের ছেলে হলেও আমি ছোটলোক হয়ে জন্মাইনি। আমার জন্ম হয়েছে ক্ষমতা কামাতে, এই সমাজে নিজের বিশিষ্ট নামের ঝংকার তুলতে। ছোটলোক হয়ে মরার কথা তো ভাবতেও পারিনি কোনোদিন। আমি চলে গেলাম পার্টিতে। মেট্টিক পরীক্ষার প্রবেশপত্রের টাকাটা নিজের ভালোমানুষি বিক্রি করে পাপের টাকায় যোগাড় করা ছেলেটা এত বড় ব্যবসা, এত বড় বাড়ি আর এত নাম কী করে কামিয়েছে, সেসব তোমাদের না জানলেও চলবে। কল্পনা করে নিও। শুধু জেনে রাখো, তুমি, তোমার পরিবার আমায় বাল দিয়েও নাড়তো না, যদি না সেইসব পেরিয়ে, সব ডিঙিয়ে আমি নিজেকে এই অবস্থানে দাঁড় করাতাম।ʼʼ
হামজা থামে। খানিক দম নেয়, এরপর বলে, “বহুত কিছু পাড়ি দিয়েছি আমি আর জয়। তোমার মতো লাখখানেক রিমি, আর আরমিণের মতো হাজারখানেক আরমিণ জয়-হামজার পথ রুখতে পারেনা, আর না ভাঙন ধরাতে। এ পথ একদিনের না। যখন তোমাদের জন্ম হয়নি, অথবা খালি গায়ে পুতুল খেলতে তোমরা, তখনকার ধরা হাত। না ছাড়বে, হয় মরবে।ʼʼ
কেমন অপ্রকৃতস্থর মতো হাসে হামজা গা দুলিয়ে, “অনেক ক্ষমতা কামানোর আছে। অনেক অনেক অনেক…..যার অন্ত নেই, থাকবে কোনো সীমা। এই অবধি পৌঁছাতে যে পথ পাড়ি দিয়েছি, সামনের পথে আরও র-ক্ত, আরও চিৎকার আরও হাহাকার আছে। সে-সবে থামলে আজ আমি মানুষের প্রতিনিধি হতাম না। আজ কত মানুষ আমার কাছে এসে ধর্না ধরে একটু সাহায্যের আশায়। আমার গর্ভধারিণী হয়ত এই লোকগুলোর মতো হাত পাতাওয়ালার কাতারেও ছিল না। অথচ আজ আমি তাদের হাতে সাহায্য তুলে দেয়া মানুষটা। আমি সেদিন অন্যায় দেখে থেমে গেলে হতো? আর না আজ থামলে হবে। তুমি বিরোধীতা করো, আরমিণ করুক। জয় আর আমার পথ একটা, সেখানে গিয়ে অর্জন দুটো দুজনের। দুজনেই অতৃপ্ত হয়ত চিরকাল, তবু তৃপ্ততা। আমার থামার নয়, আমার ক্ষমতা লাগবে, আরও উঠতে হবে। সিড়ি পড়ে আছে, অনেক সিড়ি। উপরে ওঠার সিড়ি। ক্লান্তিতে জড়িয়ে আসা পা-দুটো ঝাড়া মেরে উঠে যেতে হবে। বুঝতে পারছো তুমি, বুঝতে পারছো….ʼʼ
হামজা জয়কে ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে যায়, “ও জয়! শুয়োর, বেরোবি নাকি আসব আমি? দেরি হচ্ছে, জলদি আয়।ʼʼ
চলবে…
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]