অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব-৪৯+৫০+৫১

0
102

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৪৯.

হামজা ভেতরে এসে অন্তূর সামনে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল, “চাবিটা দাও।ʼʼ

-“ওদেরকে ছেড়ে দিন। ওদের সাথে কোনো শত্রুতা নেই আপনাদের। ওরা কষ্ট পাচ্ছে শুধু শুধু। ওদের খামোখা আঘাত করে নিজেদেরকে জানোয়ার প্রমাণ করার মাঝে বাহাদুরি নেই, মেয়র সাহেব।ʼʼ

-“ওরকম আঘাত আমরাও সঁয়েছি। বহুত সঁয়েছি। আরাম করে গড়িয়ে এতদূর আসিনি। জয়ের পিঠের দাগগুলো দেখেছ হয়ত। আমারগুলো দেখবে?ʼʼ

-“তার জিম্মেদার ওই ছোট ছোট শিশুরা ছিল না। শিক্ষিত এবং বুদ্ধিমান মানুষ আপনি। যুক্তিহীন কথা আপনার মুখে খুব কটু শোনায়।ʼʼ

-“চাবি দাও।ʼʼ

-“ছেড়ে দিন ওদের। বাড়ি ফিরতে দিন। যে যার মায়ের কোলে ফিরে যাক।ʼʼ

-“চাবি কোথায় রেখেছ?ʼʼ ঘরটা দুলে উঠল বোধহয়। গমগম করে প্রতিধ্বনিত হলো হামজার গর্জনের মতো ভারী ধমকটা। চোখ বিস্ফোরিত হয়ে এসেছে। এতটা উত্তেজিত দেখা যায়নি তাকে আগে।

জয় পোশাক পরছিল তখন আয়নার সামনে। গুনগুন করে গান গাইছে,
আমি কখনও যোদ্ধা, কখনও বিদ্রোহী,
কখনও কবিতার কলি..

গোটা ঘর শান্ত অথচ ক্ষুব্ধ হাতে উলোট-পালোট করে সেই চাবি পেল না হামজা। আর চাইলও না। ছেলেদের দিয়ে নতুন তিনটে বিশাল তালা আনালো। নিজের চাবি দিয়েও নয় বরং শাবলের আঘাতে পুরোনো তালা টুকরো টুকরো করে ভেঙে নতুন দুটো তালা পরপর মারল সিঁড়ির দরজায়। বেড়িয়ে গেল দুই ভাই।

এরপর রাতটা কাটল অস্থির। আর খাবারও পেল না বাচ্চারা। রিমি খাবার নিয়ে যায় রাতে একবেলা। আজ নতুন তালার চাবি কারও কাছে নেই, হামজা সাথে নিয়ে গেছে। অন্তূ কয়েকবার চেষ্টা করেছিল তালা ভাঙার, পারেনি।

নামাজে সে-রাতে খুব কান্নাকাটি করেছিল। শেষরাতে অল্প একটু পানি খেয়ে রোজা রাখার নিয়ত করল। উপবাস মানুষকে পরিশ্রুত করে, ভেতরের গ্লানি মুছে দেয়। এছাড়া অন্তূ টের পেতে চায়, ওই ছোট ছোট বাচ্চারা কী করে না খেয়ে বেলার পর বেলা ওই অন্ধ-কুটিরে কাটাচ্ছে।

এরপর থেকে অন্তূ বহুকাল যাবৎ একাধারে রোজা রাখতো দিনের বেলাটা। রাতে নামাজে কাটাতো। এরপর আর কখনও তেমন একটা জয় সঙ্গ পায়নি তার।


রিমি জানালা দিয়ে ভাঙা চাঁদটা দেখতে দেখতে টের পায় তার গাল বেয়ে বৃষ্টি নেমেছে। এই দোটানায় জীবন কাটবে, কাটতে কাটতে যাবে কতদূর?

হামজা ধূর্ত। কেবল বাড়ির নিঃশব্দ পরিবেশের কাছ থেকেও সে পুরো ঘটনার বিবৃতি পেয়ে যেতে পারে। তার দক্ষতা অথবা অভিজ্ঞতা! আজ যখন দুপুরের পর পৌরসভার অধিবেশন-বৈঠক শেষে হামজা বাড়ি ফিরল, তখন অন্তূ বড়ঘরে। একথা বুঝতে তার সমস্যা হলো না।জয় ঘুমাচ্ছিল। রিমি অন্তত হামজার সম্মুখে মুখের অভিব্যক্তি লুকোতে খুব কাঁচা। সে সামনে দাঁড়িয়ে চোরের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। হামজা রুমে এলো, পাঞ্জাবীটা খুলল। একটা ফতোয়া পরে জয়ের রুমে গেল। তখন জয় ঘুমোচ্ছে।

জয়কে ডেকে বলল, “আরমিণ রুমে নেই।ʼʼ

ব্যাস সংক্ষিপ্ত একটি তথ্য দিয়ে সে নিজের ঘরে চলে গেছে। জয়ের মাথায় স্ফূটন শুরু হয়ে যায়। অথচ অন্তূর সামনে গেলে আজকাল আর আগের মতো ক্ষ্যাপাটে হতে পারেনা। যে মেয়ের চোখে ভয় নেই, তাকে ভয় দেখানোটাও সময়ের অপচয় ছাড়া কিছু না।

হামজা রুমে এলো। রিমি অস্থির হয়ে বিছানায় বসছে, উঠছে, একাজ-ওকাজ করতে চাইছে, অথচ হাতে কাজ উঠছিল না। হামজা এসে বসল বিছানায়। রিমি তাকাতে পারেনা ওই শান্ত চোখে। আয়নায় দেখে ভারী মুখটা। চাপদাড়িতে শ্যামলা চেহারাটা দারুণ মানায়। রিমির দাদি বলতো, “পাঠার মতো শরীর, হেই দানবের লগে আমার কুট্টি রিমারে বিয়া দিসনা রে…ʼʼ

অথচ সেই বিশালাকৃতির লোকটা কখনও কিছু চাপিয়ে দেয়নি রিমির ওপর। বরং ওর ছোট্ট বয়সের জেদগুলোকে একজন অসীম ধৈর্য্যশীল অভিভাবকের মতো মেনে চলেছে। একবার রিমির কলেজে দুটো ছেলে রিমিকে কটুক্তি করেছিল। ‘হামজা পাটোয়ারীর বউʼ কথাটা উল্লেখ করে নোংরা কথা বলেছিল। হামজা সেই ছেলেদুটোর কী করেছে, তা অজানা। একদিন রাতে রিমিকে নিজের কোলে বসিয়ে নরম করে বলেছিল, “পড়ালেখার কি খুব ইচ্ছে আপনার, ম্যাডাম?ʼʼ

রিমি বলল, “না। আমার পড়তে একটুও ভালো লাগেনা। এক্সট্রা ঝামেলা।ʼʼ

হামজা হেসেছিল, “তো কী করতে ভাল্লাগে?ʼʼ

রিমি লজ্জায় লাল হয়ে হয়ে মাথা নত করে। মুখে বলতে পারেনি, আপনার সংসার করতে ভাল্লাগে। আমার বয়সটাই তো এমন। সংসারের কাজকাম করা, বউ-বউ সেজে থাকার শিহরণ, আপনার সেবা-যত্ন, স্পর্শ! এসব ছাড়া কিচ্ছু ভাল্লাগেনা।

হামজা বলেছিল, “তাহলে পড়ালেখা ছাড়িয়ে দিই? ইন্টার পরীক্ষাটা দিয়ে, আর পড়তে হবেনা। মন থেকে বলবে, তুমি রাজী?ʼʼ

-“বিয়ের কবুল পড়াচ্ছেন?ʼʼ খিলখিল করে হেসে উঠেছিল রিমি।

এরপর পড়ালেখা করা হয়নি আর। যখন ক্ষমতার অগ্রগতি হচ্ছিল হামজার, রিমির আনন্দ লাগেনি আবার! খুব লেগেছে। হামজার স্বপ্ন শুনতে শুনতে সেও চাইতো, হামজা সংসদ-নির্বাচনে অংশগ্রহন করুক। সে হবে মাননীয় সংসদ সদস্য, যাকে বলে ওই এমপির বউ।

কিন্তু মাজহারকে মারার পর তাদের মাঝে যে ভাঙনের সুর হবেজেছিল, তাও ঠিক মিটে যেত। কিন্তু তারপরই একদিন এলো রিমির ওপর এক জঘন্য প্রস্তাব। রিমিকে নিয়ে হামজা গেল একদিন বড়ঘরে। ও-ঘরে প্রথমবার গিয়ে রিমির দম আঁটকে এসেছিল। মনে হচ্ছিল হামজার সাথে সে কোনো কবরে নামছে। জাপটে ধরে ছিল হামজাকে। হামজা আশ্বাস দিয়েছে, ‘কিচ্ছু হবেনা। তুমি ওদের খাবার দেবে একবেলা।ʼ

আরমিণ বিয়ে হয়ে আসার কিছুদিন আগে এক পালা বাচ্চাদের আনা হলো। তাদের কিছুদিন রাখা হয়েছিল, একরাতে তাদের নিয়ে যাওয়া হলো মালটানা ভ্যানগাড়িতে করে। কোথাও নিয়ে গিয়ে হত্যা করে ফেলা হয়েছিল। শুধু বাচ্চাদেরই নয়, যুবকদেরও আনা হতো। টর্চার করা হতো ওদের। কিছু জিজ্ঞেস করা হতো, কিছু স্টেটমেন্ট চাওয়া হতো, না দিলে মৃত্যু অথবা কারাগার। আপত্তিকর স্টেটমেন্ট।

এসবের পর আজ অবধিও রিমি-হামজার মাঝে সেই পুরোনো সম্পর্ক ফিরে আসেনি। দোটানা, টানপোড়েনে কেটে গেছে বহুদিন। রিমি ঘেন্নায়, লজ্জায় দুটো বাচ্চা নষ্ট করেছে ভ্রুণ অথবা তারও আগের অবস্থায়, ওষুধ খেয়ে। তা হামজা জানেনা।

রিমি চায়না, তার বাচ্চা পৃথিবীতে এসে এমন বাপ-চাচার সংস্পর্শ পাক। এমন একটা বাড়িতে সে পালিত হোক, যে বাড়িটা কলুষিত, অমানুষদের বাস। যেখানের প্রতিটা সদস্যের মাঝে নোংরামির বীজ আছে। হামজাকে দেয়া তার সবচেয়ে বড় এবং নীরব শাস্তি বাবা হওয়া থেকে বঞ্চিত করা। কারণ যে লোক অন্যের সন্তানকে এভাবে অমানুষিক অত্যাচার করতে পারে, তার বাপ হওয়ার অধিকার নেই, কস্মিনকালেও নেই। অথচ হামজা মনে মনে একটা বাচ্চার জন্য মরিয়া। তবু কোনোদিন মুখ ফুটে রিমিকে কিছু বলেনা, হয়ত মেয়েটা নিজের অক্ষমতা নিয়ে কষ্ট পাবে। অথচ হামজা জানেনা রিমি সুস্থ। প্রথম দিকে তার বয়স কম থাকায় বাচ্চার কথা চিন্তা করা হয়নি, পরে হামজার ধারণা রিমি অসুস্থ হয়ত। অথবা নিতে চায়না।

এসব ভাবলে রিমির বুক পুড়ে যায়। খানখান হয়ে আসে ভেতরটা। সে মা ছিল সেই সকল অনাগত সন্তানদের। পাপ করেছে। পাপীদের আশপাশে থেকে সেও কঠোর পাপী হয়ে গেছে। তার বাবার বাড়িটাও রাজনীতির ছায়ায় ছিল, কিন্তু অন্দরে কখনও সেসবের দাগ লাগেনি। বাইরে বাপ-চাচারা কী করেছে, তা নিয়ে ভেতরবাড়ির কোনো সম্বন্ধ ছিলনা।

হামজা বিছানায় বসে থাকে অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে। রিমি আয়নাতে দেখছিল ওকে। মাথার ঘন চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। দুই ভাইয়েরই দাড়িটা অযত্নে বড় বেড়েছে। দেখতে অন্যরকম, সুন্দরই লাগে।

একসময় হামজা রিমিকে ডেকে পাশে বসায়। অল্প চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে, “এত নারাজ তুমি আমার ওপর?ʼʼ

রিমি কথা আঁটকে আসে। তবু বলে, “তা কেন বলছেন?ʼʼ

-“আমার বিশ্বাসকে তুমি…ʼʼ

-“আপনি কি আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলতে চাইছেন?ʼʼ

হামজা তাকায় চোখ তুলে। রিমি জমে গেল যেন। চোখ নামায় সঙ্গে সঙ্গে। হামজা জিজ্ঞেস করে, “আমার চাবি এখনও তোমার ড্রয়ারে, তোমার কাছে। আরমিণ চাবি কোথায় পেল, রিমি?ʼʼ

রিমি কথা বলেনা। হামজা পা টান করে দিয়ে রিমির কোলে মাথা রাখে। থরথর করে কেঁপে উঠল রিমি। একদৃষ্টে চেয়ে থাকে হামজা কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে। ফের উঠে বসে। রিমিকে ঘুরিয়ে নিজের মুখোমুখি বসায়। মুখ হাতের আজলায় ধরে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, “কী চাও, বলো? আরমিণের মতো ওদের ছেড়ে দেবার আরজি ছাড়া যেকোনো কিছু কবুল আজ। বলো, কী চাও?ʼʼ

রিমির চোখ ভরে উঠেছিল চট করে। এই লোকের সামনে টিকে থাকা বড় মুশকিল তার জন্য। যার প্রসস্থ বুকে মুখ না লুকোলে একসময় একটুও চলতো না, সেই লোকটা থেকে সে এত দূরে দূরে কেন আজ? পরিস্থিতির কাঠিন্য নিতে দম ফুরিয়ে যাবার জোগাড় যে! পানিটুকু চোখ বেঁয়ে গড়িয়ে পড়ার আগে রিমি বলে, “আপনি যা নিষেধ করছেন, আমি যদি সেটাই চাই?ʼʼ

হামজা শান্তভাবে মাথা দোলায়, “শর্তের খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। অন্য যেকোনো কিছু চাও।ʼʼ

-“তাহলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন তাহলে। অনেক প্রশ্ন।ʼʼ

রিমি হামজার হাতদুটো নিজের চোয়াল থেকে সরিয়ে দেয়। জিজ্ঞেস করে, “জয় ভাইয়ার মতোন আপনারও নারীদোষ আছে? আরমিণ বড়ঘরের পাশে অনেক খারাপ মেয়েকে দেখেছে।ʼʼ

হামজা হাসল, “অনেককিছুই দেখে ফেলেছে সে!ʼʼ

-“উত্তর দিন। নারীদোষ আছে?ʼʼ

-“ছিল।ʼʼ

বিস্ফোরিত, আহত চোখে তাকায় রিমি। হামজা ছটফটিয়ে ওঠে। বোধহয় প্রথমবার তার চোখে কাতরতা লক্ষ করা যাচ্ছিল। সাফাই গাওয়ার মতো করে বলে, “বহুবছর আগে ছিল। যখন আমি একদম যুবক। এরপর ধীরে ধীরে সোসাইটিতে যখন নামগাম বাড়ছিল, দায়িত্ব ও ব্যস্ততা বাড়ছিল, তখন সেসব কমে এলো। আবার তখনই একদিন ঝন্টু কাকার বাড়িতে তোমাকে দেখলাম। বিশ্বাস করো, আর কোনোদিন কোনো মেয়েলোককে ছুঁইনি।ʼʼ

চট করে রিমি মুখে হাত ছোঁয়ায়, “তোমাচে ছুঁয়ে বলছি, আর কাউকে ছুঁইনি আজ পর্যন্ত। এরপর আর বেশিদিন অপেক্ষাও করিনি এইজন্য, তাড়াতাড়ি বিয়ে করে তুলে আনলাম। বিয়ের আগে ছেলেমানুষের দোষ ধরতে আছে? তখন তো তুমি ছিলে না! বিভিন্ন ক্লাবে-ম্লাবে যেতে হতো, তখন নিজেকে সামলাতো যায়নি। কিন্তু তোমাকে দেখার পর আর না। নয়ত তুমি তখন একেবারে ছোট। অত ছোট বয়সে বিয়ে করতাম না। একটু বড় হতে দিতাম। কিন্তু আমি জানতাম, এই দিন একদিন আসবে। সেদিন জবাব দিতে গেলে লজ্জিত হতে হবে। কথা বলার সময় গাইগুই করা পছন্দ না আমার। যেকোনো পাপকে স্বীকার করব, সেটাও বুক ফুলিয়ে। নয়ত নিজেকে পাপীর চেয়ে বেশি ছোটলোক মনেহয়। এই স্বভাবটা জয় খুব পেয়েছে। এই দিনটাকে ফেস করতে চাইনি।ʼʼ

রিমি বুঝতে পারছিল না, কী করবে, কী বলবে। অথচ বুকে একপ্রকার ব্যথা জড়িয়ে ধরছিল।

-“ওদের কেন ধরে রেখেছেন?ʼʼ

-“কাজ আছে।ʼʼ

-“কী কাজ?ʼʼ

-“সব কী বলা যায়? বললেই বুঝবে?ʼʼ

-“তবু শুনি।ʼʼ

-“না। শুনতে হবেনা।ʼʼ কিছু কঠিন শোনায় হামজার স্বর।

দুজনেই চুপচাপ মুখ ফিরিয়ে বসেছিল অনেকক্ষণ। কারও কোনো কথা নেই। দুজনের ভেতরে জমাটবদ্ধ অপরাধবোধ নাকি তীব্র অনুযোগ—পালা দিয়ে উঠানামা করছিল। এক দুর্বোধ্য তিক্ত-আবেগানুভূতি নিঃশব্দ ঘরটাতে ঘুরপাক খাচ্ছিল বাতাসের দোলনে।

তখনই জয়ের ঘর থেকে চাপা বাক-বিতণ্ডা কানে এলো। হামজা উঠে গেলে পিছে পিছে যেতে হলো রিমিকে।

এরপর লোকটা তালা মেরে শেষ একবার ঘরে এসেছিল, তবু কোনো কথা হয়নি। আজ আর রিমির কাছে ঘড়িটা পরিয়ে চাইলো না, রিমিও এগিয়ে গেল না। বেরিয়ে গেল দুই ভাই।

রিমি চুপচাপ বসে থাকে জানালার ধারে। এত ভাবনা আর দ্বিধাদ্বন্দ ভেতরে উথাল-পাতাল হচ্ছে, মাথাটা যেন ছিঁড়ে পড়বে। একাধারে অনেকক্ষণ কান্না করার ফলে মাথাটা স্বাভাবিকের তুলনায় শতগুণ ভারী মনে হচ্ছে। বুক পোড়ার ধোয়া যেন আকাশে মেঘ হয়ে উড়ছিল, তা নির্বাক চোখে দেখে গেল সে পুরো রাত।


রাত দুটোর দিকে মুস্তাকিন দিনাজপুরে পা রাখল। ঢাকায় একটা কাণ্ড ঘটেছে। তা হয়ত এসে পৌঁছেছে দিনাজপুর, অথবা পৌঁছায়নি। বাস টার্মিনাল ফাঁকা। রাস্তাঘাট শ্মশান হয়ে আছে। তারা কয়েকজন যারা বাস থেকে নামলো, তারাই কেবল মানুষ। গাড়ি তেমন নেই। হেঁটে যেতে হবে। ফ্ল্যাটটা এখনও ছাড়া হয়নি। তবু সেখানে যেতে ইচ্ছে করল না। অন্য কোথাও যাওয়া দরকার।

কতমাস পরে সে দিনাজপুরে এলো আবার! মনে নেই তার। হাঁটতে হাঁটতে একসময় যখন অন্তূদের বাড়ির বেশ কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিল, তখন সেই অদ্ভুত দুঃসাহসী আর অল্প-সল্প বোকা নারীটির ভীষণ সুশ্রী মুখ ভেসে উঠল চেহারায়। ভীষণ স্নিগ্ধ। মাথার ওড়না ছাড়া সে একবার দেখার সুযোগ পেয়েছিল। সেই রাতটার কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে ছিল তখন পুলিশ অফিসার। পরিচয়টার মায়ায় পড়েছিল সে। তবু মেয়েটিকে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। আজ সেই পরিচয় নেই, পরিচয় রাখার দরকার নেই। নারীটির ওপর তার দূর্বলতা আজও মিথ্যা নয়। মনে পড়লেই বুকটা তিরতির করে জ্বলে ওঠে। তাতে কী! যে মেয়ের কপালে সুখ থাকেনা, কোথাও থাকেনা। তার কাছেও কি আরমিণ সুখী হতো! হাসল মনে মনে। সে এমনভাবে এসব ভাবছে যেন, সব ঠিকঠাক হয়ে গেছিল! কখনও তো সেই মনের দৌর্বল্য প্রকাশই করা হয়নি! তার সুদর্শন চেহারার মায়ায় পড়ার মতো মেয়েও নয় হয়ত সেই নারী!

দিনাজপুর ফেরা তার কিছু উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। তা ফুরোলে আবার সে ফিরে যাবে এ জেলা ছেড়ে। সেই ক’টাদিন সেই অস্থায়ী পরিচয়ের পুরো ফ্ল্যাটেই থাকবে বলে ভেবে নিলো। কিছুদিনের সেই অবাস্তব পরিচয়টায় একটা মায়া পড়ে গেছিল কেমন!

হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর এসে গেছে। টেরই পায়নি। সামনে রাস্তার মোড় পেরোলেই বিশাল হোটেল। এখান থেকে ভবনটির মাথা দেখা যায়। জ্বলজ্বলে ইংরেজি অক্ষরে নিজের নাম জানান দিচ্ছে। উদাস পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল সে সেদিকে।


ক’দিন আগে হঠাৎ-ই তরুর কাছে কল এলো সেই লোকটার, যে শুধু তার জন্মদাতা হিসেবে বাপ, আর কিছু না। তরু বিশ্বাসই করতে পারেনি। যে মূর্খ লোকটা মেয়ে বলে পরিচয় দেয়নি কখনও, সে কেন কল করে মিষ্টি করে ডাকছে! তার অপরাধ, তার মায়ের গর্ভে একের পর এক শুধু মেয়ে জন্মেছে। আর মেয়েরা তো কামাই করে খাওয়ায় না, ওদেরকেই আরও বসিয়ে খাওয়াতে হয়। উপরন্তু বিয়ে শাদী দিতে গেলে কত ঝামেলা, খরচা!

কথায় কথায় সেই লোক বলল, “একখান ইঞ্জিয়ার পাত্র পাইছি রে মা। সুখে থাকবি তুই। তোর মাও রাজী। শুক্কুরবারে বাড়িত্ আয়। ওরা দেখবার চায় তোরে। তুই কইলে আমি যামুনে। আমার সাথে আসিস।ʼʼ

তরুর আত্মা কেঁপে ওঠে। একবার তরুর বয়স যখন চৌদ্দ বছর, সেবার একবার এই লোক এসে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাড়ি নিয়ে গিয়ে অর্ধেক বিয়ে দিয়েই ফেলেছিল। জুয়া খেলে হটে যাবার পর অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছিল। এরপর এক বয়স্ক লোকের কাছে তরুকে বিয়ে দেবার বদলে সেই টাকা শোধ করতে তার সেই আয়োজন। বুড়ো পাত্র অনেক টাকা দিয়ে চৌদ্দ বছরের তরুকে বউ হিসেবে কিনতে চায়। তরু হাতে-পায়ে ধরে কেঁদেছিল বাবার, মাতাল বাপ শোনেনি। ওর মাকে ওর সামনে মেরে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের করে দিলো। সেদিন জয় গিয়ে একটা হাঙ্গামা করে তরুকে নিয়ে এসেছিল। আর কোনোদিন তরুকে নিয়ে যাবার সাহস পায়নি ওই লোক। আজ আবার কল করেছে। তরু বড় হয়েছে এখন, তবু সেই আতঙ্ক মস্তিষ্কে সংরক্ষিত হয়ে আছে এখনও।

ছটফটিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে, এদিক-ওদিক পায়চারী করে। এ বাড়িতে তার ভরসার স্থল, যাকে নাকি সে আজকাল ঘৃণা করে বসেছে, সত্যি কি-না বোঝা যায়নি কখনও। হামজাকে বললে জেলে দেবে বা অন্য পদক্ষেপ। তবু তার কোনো দাবি কখনও হামজার কাছে করার অভ্যাস নেই। ঘৃণ্য লোকটার কাছেই ছুটে যেতে হলো। আর কেউ নেই তরুর, কেউ না। ওই পুরুষটা আছে। তরুর দেবতা সে, তরুর অদ্ভুত রক্ষক।

জয় তখন খাচ্ছে। টেবিলের ওপর প্লেট রেখে পাশে দাঁড়িয়েই গপাগপ গিলছে। কোথাও বেরোবে। জয়ের সামনে আজকাল সে যায়না। বুকের ব্যথা সহ্য হয়না। লোকটাকে দেখলেই চিৎকার করে কান্না ছুটে আসে। যাকে তরু বিসর্জন দেবার নাম করে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, তরু ছাড়া কেউ জানেনা তাকে সে মনের মন্দিরের কেন্দ্রে দেব হিসেবে অধিষ্ঠিত করে ফেলেছিল সেই কিশোরী বয়সেই। তাকে সরানো যায়না, বড়জোর সান্ত্বণা দেয়া যায় মিথ্যা ঘৃণার আড়ালে।

তরুর চোখ টলমলে হয়ে উঠেছিল কেন, জানা নেই। দৌড়ে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে জয়ের হাতে ফোন ধরিয়ে দেয়। অস্থিল হয়ে চেয়ে থাকে।

জয়কে কিচ্ছু বলতে হলো না। সে যেন সব জানে। ফোন কানে নিয়েই বকে উঠল, “খালি রাত জেগে জন্মালেই বাপ হওয়া যায়না, চাচা। ওরকম তো কার্তিক মাসে কুত্তাও বাচ্চা জন্মায়। তাই বলে বাপের ঠিকানা থাকে ওদের? এতগুলা দিন যখন খাওয়া-পড়াসহ যাবতীয় ভরনপোষন দিয়ে মানুষ যখন করতে পেরেছি আমরা, ওর বিয়ের বালডাও দিয়েই দেব। আর আপনিও জানেন আমি বিয়ে দিলে কোনো ছোটখাটো রাজার ঘরেই যাবে, তরু। নিজের বিজনেস হিসেবে ব্যবহার করতে চান মেয়েকে, তা ভালো। তবে তা মনেই চেপে রাখুন। বারবার সে কথা কানে এলে কবে মাথার পোকাটা নড়েচড়ে ওঠে, দেখা যাবে বংশ-নির্বংশ করে রেখে আসব।ʼʼ

বাপ লোকটা কল কেটেছিল দিয়েছিল ভয়ে। ভীষণ জয় পায় জয়কে।

কিন্তু আজ সকালে তার মা কল দিয়ে কান্নাকাটি করেছে। তরু জানে, মা এটা নিজ থেকে করছে না। ওই লোক মারধর করেছে খুব। বাধ্য করেছে মাকে দিয়ে এসব বলাতে। জয় নেই। তরু কার কাছে যাবে? সে তো কারও কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে শেখেনি। যার কাছে তার দুঃখ সঁপে এসেছে, তাকে তো মুখ ফুটে বলতেই হয়নি কখনও। মুখ-চোখ দেখলেই অন্তর্যামীর মতো সব বুঝে যেত।

অনেকক্ষণ বসে রইল জয়ের কবুতরগুলোর সাথে। জয়কে বিসর্জন দেবার পর থেকে যখনই বুকে যন্ত্রণা উঠেছে, সে এসে জয়ের কবুতরগুলোর কাছে কষ্ট বলেছে। অবলা প্রাণীরা বোঝে কিনা কে জানে। তবু বলে তরু।

তরুর ইচ্ছে করল, দৌড়ে জয়ের কাছে যাবে। কষে চেপে ধরবে জয়কে। জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে কাঁদবে, অনেকক্ষণ। তারপর বলবে, ‘আমি আপনাকে পেলাম না, সে ঠিক আছে। কিন্তু অন্য কাউকে গ্রহণ করতে পারব না। আমি কিন্তু মরে যাব জয় ভাইয়া। সত্যি বলছি। আপনারা আমাকে আপনি ছাড়া অন্য কারও হতে বাধ্য করলেই আমি মরে যাব, বলে দিলাম। ছোটবেলা থেকে যার সমস্ত কাজকাম করতে করতে নিজে, দেহ-মন সবখানে শুধু একজনকে জায়গা দিয়ে দিয়ে এত বড় হয়েছি, হোক সে না হলো আমার, তবু সে ছাড়া আর কারও হবার নয়। বুঝেছেন, আপনি? বুঝেছেন?ʼ

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই কখন যেন হু হু করে কেঁদে ফেলেছে, নিজেও টের পায়নি। সামলালো না, ঝরতে দিলো পানি। কল্পনা করল, জয় সামনে বসে বিরক্ত হয়ে চেয়ে আছে। কখন জানি একটা ধমক মারবে। তারপর বলবে, “কিছু খাবি? আচ্ছা, পাঠাই দিচ্ছি। আইসক্রিম পাঠাবো নাকি পেঁয়াজু? মুড়ি মাখাবি? আচ্ছা, আমি আনি। মুড়ি মাখা, খেয়েই বের হবো।ʼʼ

তরুর চোখ বাঁধ মানেনা। শব্দ করে কেঁদে ফেলল আবারও।


পলাশের হুকুম অথবা পারিবারিক রেওয়াজ, বাড়ির বউয়েরা শাড়ি পরে থাকবে। রুপকথা একটা নীলচে-সবুজ শাড়ি পরে রান্না করছিল। খুব ভালো রান্না জানে সে। পলাশ মদ-গাঁজা বাইরে খেলেও খাবারটা রূপকথার হাতের খায়, তিনবেলাই।

সকাল তখন নয়টার মতো। গতরাতে কোনও কারণে স্বাভাবিকভাবেই ঘুমিয়েছিল পলাশ। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চেঁচালো, “রূপ! ও রূপ?ʼʼ

-“বেঁচে আছ, মরিনি। এত জোরে জোরে চেঁচানোর কী আছে? আশ্চর্য!ʼʼ

রূপকথা শাড়ির আঁচলটা পিঠ ঘুরিয়ে এনে কোমড়ে গুঁজে রেখেছে। পলাশ এগিয়ে গিয়ে অনাবৃত ফর্সা কোমড়টা চেপে ধরল। রূপকথা অবাক হয়, এরকম ভালোবাসা সে স্বামীর কাছে পাবার ভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি। স্বাভাবিক ভালোবাসা সে পলাশের কাছে পেল আর কই! পেয়েছে শুধু শরীরের দাগগুলো।

-“তোমার সাথে প্রেম মানায় না, পলাশ ভাইয়া। তুমি জানোয়ার রূপেই সুন্দর আমার কাছে।ʼʼ

হো হো করে হাসল পলাশ, “তুই বউ হবার পরেও তোর মুখে ‘পলাশ ভাইয়াʼ ডাকটা শুনতে এত ভাল্লাগে। মনেহয় সেই ছোট্ট রূপ আমার পিছু পিছু ঘুরছে একটা পাখির খাঁচা কিনে এনে দেবার জন্য।ʼʼ

রূপকথা কথা বলেনা। সে কি জানতো, তার সুদর্শন পলাশ ভাইয়া সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ নয়! সে একজন সাইকো সাথে কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও কালোব্যবসায়ী। বাবাই যে শিখিয়েছে পলাশকে এসব। সেটাও তো জানতো না রূপকথা!

‘“কী রান্না করছিস?ʼʼ

-“চিৎড়ি মাছ।ʼʼ

-“নাশতা না বানিয়ে সকাল সকাল চিংড়ি?ʼʼ

পলাশ রূপকথাকে সরিয়ে দিয়ে নিজে দাঁড়ায় চুলোর সামনে। এইসব সময় রূপকথা আচমকাই আশা করে বসে, পলাশ যদি আসলেই সুস্থ হতো, ভালো হতো। সে একটা সুন্দর সংসার পেত। তার স্বামী সুন্দর, বেশ সুন্দর! রূপকথা চেয়ে থাকে। তার আর পলাশের চেহারায় সূক্ষ্ণ মিল আছে, আর তারা দুজনেই সুন্দর। পলাশকে দেখে অল্প সন্দেহ করার অবকাশও নেই যে সে এমন হিঃস্র টেরোরিস্ট। জিজ্ঞেস করে, “আজ হাবভাব এমন লাগছে কেন? কী হয়েছে তোমার?ʼʼ

-“আজ মুড ভালো। ভাবছি তোকে নিয়ে কয়দিন কাকার কাছ থেকে ঘুরে আসব। বহুদিন ঢাকা যাওয়া হয়না। ওদিকের সব কী হাল, আল্লাই জানে।ʼʼ

-“সেসব ছেঁড়েছুঁড়ে দিলে হয়না?ʼʼ কঠিন করে বলল রূপকথা।

-“তোরা মেয়েলোকেরা এই কথা ছাড়া আর কথা জানিস না? কী ছেড়ে দেব? আমি একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসা ছেড়ে দেব? খাবি কী? আমি আর কাকা ব্যবসায়ী। খারাপ কী?ʼʼ

-“ওগুলো ব্যবসা? তুমি আর বাবা মিলে সন্ত্রাসদল পরিচালনা করো, তা জানিনা আমি?ʼʼ

-“জানলে কী? তুই জানবি না তো কে জানবে? কাকা সেইদিন বলল, একটা বাচ্চা কাচ্চা নিতে। এত বছরে একটা উত্তরাধিকারী আসলো না। এসব তো তোরই, আর তোর সন্তানদের।ʼʼ

রূপকথার কথা বলার রুচি থাকল না। আগে এসব কিছু মনে হতো না। সেও ভাবতো, এসব তো ব্যবসাই। আসলেই তো, তার বাবা একজন বড় ব্যবসায়ী আর পলাশ ভাইয়া দেখাশোনা করে সব। পরে বুঝলেও কিছু মনে হতো না। এটা স্বাভাবিক। পরিবারের লোক যারা এসব ভোগ করে, তাদের কাছে কোনোকালেই এসব ভুল লাগেনা। কিন্তু যখন পলাশের অত্যাচারের শিকার হতে শুরু করল সে, তারপর থেকেই কালোবাজারী ব্যবসা, নোংরামি, চাঁদাবাজি, খুন, স্মাগলিং—এসবে ঘেন্না ছিটকে পড়তে শুরু করল।

পলাশের ফোন বাজছে। বকতে বকতে ফোন আনতে গেল। এত সকালে কল আসা তার অপছন্দ।

ঢাকা থেকে কল এসেছে। রূপকথা শুধু এটুকু শুনতে পেল, পলাশ চেঁচিয়ে বলছে, “কাকার লাশ? কোথায়? কাকার এপার্টমেন্টে?ʼʼ

রূপকথা থমকে যায়। বাবার লাশ? রাজধানীতে তার নিজের এপার্টমেন্টে?

চলবে..

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৫০.

রাজন আজগর তার টাকার পাহাড়ের একাংশ দিয়ে বিশাল একটা ভবন তৈরি করেছে ঢাকা শহরে। ভবনটি একুশ তলা। প্রতিটা ফ্লোর ভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। আবাসিক একটা ফ্লোর ছিল আঠারো তলায়। সেখানেই তাকে মারা হয়েছে, খুব নৃশংসভাবে। পুরো সাত ঘন্টা পর তার লাশের হদিস পাওয়া গেছে। সেটা পেয়েছে একজন সার্ভেন্ট। সে সকালের ড্রিংক দিতে এসেছিল।

পলাশ সোফাতে গেড়ে বসে থাকে। কাকার জন্য তার কষ্ট হচ্ছে। সে যখন ছোট, তখন তার বাপ ক্রশফায়ারে মারা গেল। মা-টা পাগল ছিল। পলাশকে অমানুষিক অত্যাচার করতো। যখন-তখন পশুর মতো মারা, খেতে না দেয়া, ভাঙচুর করতো মহিলা। পড়ালেখা থেকে শুরু করে সবটুকু ঠাঁয় সে কাকার কাছেই পেয়েছে। পলাশ জীবনে প্রথম খুনটা তার মাকে করেছিল।

একদিন সকালে পলাশ ঘুমিয়ে আছে। তার মা তাকে ঘুম থেকে ডেকে জাগানোর বদলে অন্যভাবে জাগিয়ে তুলল। চামচের দণ্ড গরম করে এনে পলাশের শরীরে ঠেকিয়ে দিলো। উপরের চামড়া পুড়ে শরীরের মাংস ঝলছে গেল। পলাশ খুব কাঁদছিল, যদিও সে জানতো তার মা কান্নার আওয়াজ পছন্দ করেনা। এরপর তার মা এলো বাথরুম পরিষ্কার করার দাহ্য-রাসায়নিক নিয়ে। সেদিন পলাশ তার পাগল মাকে মেরে ফেলেছিল। তখন সে স্কুল-ছাত্র

তার চোখে নারী মানে অমানুষ, ঠিক তার মায়ের মতো। পরে জেনেছে তার মাকে পাগল বানিয়েছিল, তার বাপ-চাচা মিলে। কড়া ড্রাগ দিয়ে দু’ভাই ওর মাকে নিয়ে ফূর্তি করেছে বছরের পর বছর।

তবু কাকাকে সে কিছু বলেনি। মায়ের অত্যাচারগুলো ছাড়া আর কোনো কিছুই তার স্মৃতিতে ছিল না। তার মনে হয়েছে, তার মায়ের সাথে ওরকম আচরণ করা ভুল না। ততদিনে যে সেও স্যাডিস্ট হয়ে গেছে, তা বোঝেনি। পাগল বোঝেনা, সে পাগল।

রূপকথার কান্না পাচ্ছিল। হাজার হোক বাবা। বিয়ের আগ অবধি বাবা তাকে, সেও বাবাকে ভালোবাসতো। পলাশের সাথে বিয়ে না হলে হয়ত আজও তেমনই থাকতো।

পলাশ যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল, তখনই খবর এলো, হোটেল এবং সবগুলো ডেরায় আইনরক্ষাকারী বাহিনী গোটা ফোর্স নিয়ে ঢুকেছে। পলাশ বুঝল না, একসাথে এতকিছু হচ্ছে কী করে? কে করছে? কিছুক্ষণের মাঝে যে ফোর্স বাড়িতে ঢুকে পড়বে তা নিয়ে মোটেও সন্দেহ নেই পলাশের। রূপকথার হাতটা ধরে দ্রুত রুমে নিয়ে যায়। তাড়া দেয়, “দ্রুত বের হ। বের হতে হবে এক্ষুনি।ʼʼ

‘“আমি তোমার সাথে কোথাও যাব না। অপরাধ করো তুমি, তোমাকে ধরা হবে। আমি বাবার কাছে যাব। তুমি পালিয়ে বাঁচো।ʼʼ

পলাশের চোখের মণি লাল হয়ে উঠল। অথচ ভয় পেল না রূপকথা। বারবার কল আসছে ম্যানেজারের। দলছূট হয়েছে ওদিকে, সেটা নিশ্চিত। দেশের বাইরে লিগ্যালি যাওয়া সম্ভব নয় এ অবস্থায়। কোথাও আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে ক’দিন পর বর্ডার পার হতে হবে। ওপারে বার্মা( মায়ানমার ) পৌঁছাতে পারলেই হলো। সেখানে তার ব্যাকআপের অভাব নেই।

পলাশের হোটেলে একটা ফ্লোর শুধু মদ আর অনৈতিক নেশাদ্রব্যে ভরা। সেটা পুলিশ জব্দ করল। ম্যানেজারকে বাড়িতে গিয়ে ধরা হয়েছে। হোটেলে সকাল সকাল মেয়েলোক নিয়ে কত কাস্টমার ঘুমাচ্ছিল। তারা সবাই পুলিশের জিম্মায়। কতগুলো থানায় পলাশের পেইড-এজেন্ট আছে, তার হিসেব পলাশ নিজেও রাখেনা। সেসব অন্যকেউ সামলাতো। অথচ সেইসকল কিনে রাখা লোকদের পার করে এতবড় ফোর্স উদয় করতে পারে কারা, তা বুঝতে পলাশের খুব বেশি সময় লাগল না।

তার লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, সেটা পলাশ শেষরাতের দিকে জানতে পেরেছিল। কিন্তু কাকাকে কে মেরেছে? সে-ই? নাকি অন্যকেউ?


অন্তূ এসব খবর পেল ওয়ার্কশপের ছেলেদের কাছে। রতন দোতলায় উঠে অন্তূকে ডেকে বলল, “ভাবী। আজ কোথাও বের হইয়েন না। অনুরোধ লাগে।ʼʼ

-“কেন? বিশেষ কিছু হয়েছে?ʼʼ

গাইগুই করছিল রতন। অন্তূ বলল, “নিঃসংকোচে বলুন রতন ভাই।ʼʼ

-“ভাই মানা করছে। আপনারে পাহাড়া দিতে কইছে।ʼʼ

‘“আমাকে?ʼʼ

-“হ। বিশেষ কইরা আপনারে। গোটা বাড়িডাও।ʼʼ

-“কেন, তা কিছ বলেনি?ʼʼ

রতন জয় আমিরের বউয়ের সম্মুখে একটু থতমত খেয়ে যায়। মেয়ে মানুষ, অথচ কথাবার্তার ভাঁজ কেমন জানি, কড়া।

-“ভাবী। আপনে বাইর হইয়েন না। প্লিজ!ʼʼ

অন্তূ অবাক হলো, “এমনভাবে বলছেন কেন? আমি কি খুব অবাধ্য, এমনটাই জানেন আপনারা?ʼʼ

রতন কথা বলে না। কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। অন্তূ ভ্রু নাচায়। রতন মেকি হাসে, “না মানে, আমর জানি, ভাইয়ের কথা আপনে শোনেন না। ভাইরে মানেন না আপনে। সরি ভাবী। মানে…ʼʼ

অন্তূ কপাল চেপে ধরে মুচকি হেসে ফেলল, “আপনারা ভয় পান, আমাকে?ʼʼ

-“হ। না মানে, না। ভয় না…ʼʼ

-“আমি কি খুব অসভ্য?ʼʼ

-“ছিঃ কী কন? তা কইছি নাকি? আল্লাহ মাফ করুক। ওমন কথা কমু নাকি? ও ছিঃ। আপনে খুব ভালো।ʼʼ

-“কী করে বুঝলেন?ʼʼ

-“এই লাইনে আছি বইলা কি অমানুষ হইয়া গেছি? মানুষ চেনার ক্ষ্যামতা আছে আমাগো। আমি খালি কইছি, ভাই আপনারে খুব মান্যি করে। মানে আগে কুনুদিন কাউর সামনে থামতে দেহি নাই জয় ভাইরে। আপনে…ʼʼ

-“আচ্ছা আচ্ছা! সেসব যাক। আপনার ভাইয়ের নম্বরটা দেবেন তো।ʼʼ

অন্তূর ফোন জয় নিয়ে নিয়েছে। তুলির ফোন এনে নম্বর তুলল। রতনকে বলল, “আজ যেহেতু আমরা সব বন্দি। চলূন পিকনিক করি! আমি রান্না করব। দুপুরে সবাই খেতে চলে আসবেন, কেমন!ʼʼ

অবাক এবং খুশিতে একাকার হয়ে চিৎকার করতে করতে নেমে যায় রতন। অন্তূ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকে। কয় বছর আগের কথা? অন্তূ কতই না ডানপিটে আর চঞ্চল ছিল। আজকাল মানুষ নাকি তাকে ভারী মনে করে। ভয় পায়! জয় নেই, আজ সে রোজা রাখেনি।

প্রথম দুই তিনবার কল রিসিভই হলো না। পরে রিসিভ করেই জয় ঝারি মারল একটা, “বালডা আমার, এখন কল করেছিস ক্যান? দাওয়াত খাইতে আসছি, আমি? কী দরকার তোর? ফোন রাখ।ʼʼ ধমক মারল একটা।

অন্তূ শান্ত স্বরে বলে, “আমি। আমি কথা বলছি।ʼʼ

জয় বোধহয় অবাক হলো, “ঘরওয়ালি! আপনি কল করছেন আমায়?ʼʼ

অন্তূ সেইসব আন্তরিক প্যাঁচালে সাঁয় না দিয়ে বলল,
“কোথায় আপনি?ʼʼ

-“আপনার টেনশন হচ্ছে?ʼʼ

-“কথা বাড়াবেন না। জবাব দিন।ʼʼ

-“রাজধানীতে আছি। ফিরব আজই। চিন্তি কোরো না। ঠিক আছি আমি।ʼʼ

-“আমি চিন্তা করিনা আপনার।ʼʼ

জয় হাসল। অন্তূ বলল, “রাজন আজগর মারা গেছে, শুনলাম।ʼʼ

অলস কণ্ঠে বলল জয়, “হ, আমিও শুনলাম।ʼʼ

রতন এসে দাঁড়াল। অন্তূর কিছু লাগবে কিনা তা জানতে এসেছে সে।

-“আমি বের কেন হবো না? আজ বিশেষ কীসের রেস্ট্রিকশন রেখেছেন?ʼʼ

-“পলাশের ব্যবসায় রেড মারছে বেয়াই বাড়ির লোকজন।ʼʼ

-“তাতে আমাদের কী?ʼʼ

-“আমাদের? আমি-তুমি মিলে আমাদের নাকি?ʼʼ

-“আপনার রসিকতা বিরক্ত লাগছে।ʼʼ

-“লাগেনা কখন? সেদিন পলাশ একটা দাবি করেছে।ʼʼ

-“কী দাবি?ʼʼ

-“তোমাকে পলাশের লাগবে। এতকাল তো পাটোয়ারী বাড়ির ভীত ভেঙে তোমার গায়ে টোকা লাগাতে পারে নাই। তার ওপর পার্টনারশীপের একটা ধর্ম আছে না! কিন্তু পুরাতন মেলা হিসাব রয়ে গেছে। জানো মনেহয় সেসব। আমরা-পলাশরা ভুলিনা, কিছুদিন চুপ করে থাকি। তারপর খপ করে ধরি। ওরও কিছুদিন হয়ে গেছিল। তো সেদিন ফাইনালি বলল, তোমাকে লাগবেই। এতদিন ভার্সিটি গেলে ধরে-টরে ফেলতো। যাও নাই, পারে নাই।ʼʼ

অন্তূর নিঃশ্বাসের গতি বাড়ল, “এরপর?ʼʼ

-“এরপর কী? আমার ওপর কৃতজ্ঞতা আসতেছে না?ʼʼ

অন্তূ ইশারায় রতনকে চলে যেতে বলে। রতন বাধ্যর মতো আদেশ পালন করল অন্তূর। জয় বলল, “আমার মনে হলো, তোমাকে পলাশের কাছে দিতে চাইলে তুমি রাজী হতে না কোনোভাবেই। হতে?ʼʼ

-“হতাম না।ʼʼ

‘“এই তো! আর কী? এজন্যই একটু লাড়াচাড়া দিছি। এইটা বুঝতে পলাশের দেরি লাগবে না, যে আমিই দিছি বেয়াইবাড়িতে লাড়াচাড়া। ব্যবসা হারায়ে পাগল শালা আরও পাগল হবে এবার। ফেরোয়ার হয়ে ঘুরবে। বিপদ চারদিকে। বাড়ির আশপাশে তিন-চার রকমের শত্রু ঘুরছে। বের হবেনা বাড়ি থেকে, খবরদার। আমি আসি। বসে কথা বলবোনে। ব্যস্ত আছি, এত কথা বলার পরিস্থিতি নাই।ʼʼ

অন্তূ কল রেখে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। পলাশ তাকে বলেছিল, তাকে পলাশ ছাড়বে না। অথচ এ বাড়িতে আসার পর বাইরের সবকিছু ভুলেই বসেছে। বাড়ির ভেতরেই একের পর এক যা ঘটে চলেছে! মুস্তাকিন মহান কোথায়?

আচ্ছা! সে কি স্বার্থপরের মতো ভাবছে? এই জয় আমির শুধু তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দু-একটা পদক্ষেপ নিয়েছে বলে সে কি আসলেই কৃতজ্ঞতা বোধ করছে লোকটার প্রতি? আর সব অপরাধ? অন্তূ গা ঝারা মারে। সে স্বার্থপর, তবে এমন স্বার্থপর নয়। এখনও বাচ্চাগুলো প্রায় দু’দিন না খাওয়া। অন্তূ অস্থিরতা ও ক্লান্তিতে সোফাতে বসে পড়ল। কী হচ্ছে চারদিকে। সংকট কি কাটবে না? ঝড় ঘনিয়ে আসছে। আম্মুকে কল দিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলল, খোঁজখবর নিলো। তারা ভালো আছে ওখানে। অন্তূ জানতো, এই শহর ছাড়লে ভালো থাকবে ওরা।


ঝন্টু সাহেবের স্টোররুমটা কতটা নিরাপদ, তা জানা নেই পলাশের। তবু মানুষগুলো নিরাপদ। মাজহার সিগারেট ফুঁকছে একটা বস্তার ওপর বসে। সরু আলো অন্ধকার দূর করেনি ঘরের। পলাশ একটা কাঠের খণ্ডে তবলা বাজাচ্ছিল আঙুল দিয়ে। যেন সে খুব আরামে, নিশ্চিন্তে আছে।

ঝন্টু সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “ও পলাশ! তোমার কথা মতোন এতকাল চুপ করে আছি। এইবার যখন নিজের পেছনে ঘা লাগছে, তখন ওই দুই শালার চেংরার পিছে লাগবার চাও? আগেই কইছিলাম ব্যবসা গুটাও, দুইডারে খতম করে দাও। আমি আমার বাড়ির মেয়ে এক শুয়োরের কাছে বিয়ে দিছি। রাক্ষস, নটকির পো।ʼʼ

পলাশ চোখদুটো বুজে রেখেই বলল, “মামা, কথা কম বলুন। মেজাজ গরম করবেন না।ʼʼ

মাজহার সিগারেট ফেলে আরেকটা ধরালো। একের পর টেনে যাচ্ছে। রাগ নিয়ন্ত্রণ সহজ কাজ নয়। আপন মনেই বলল, “শালার হাসপাতালের সেই দিনগুলা ভুলছি আমি? নেহাত বোন জামাই না হইলে কবে বানচোতটারে পুঁতে ফেলতাম। রিমিরে ওই বেজন্মার কাছে বিয়ে দেয়া ভুল হইছিল সেইকালে। আমার একেকটা আঘাত আর ব্যথার শোধ না তুলে পলাশ ভাই তোমার হাতি দিব না দুইডারে। তুমি দিনের পর দিন থামায়ে রাখছো। নয়ত কবে দুইটারে জবাই করে ফেলতাম। খালি তুমি….নয়ত…ʼʼ

-“নয়ত কী করতি?ʼʼ পলাশ চোখ খুলে তাকায়। জ্বলজ্বলে মণির দুপাশে শিরায় শিরায় রক্ত জমেছে।

মাজহার রাগে কাঁপতে কাঁপতে তাকায়, “আব্বা বসে আছে। কিছু বলতেও পারতেছি না। শোনো পলাশ ভাই! একবার ওই বাড়িত ঢুকলে সবগুলা মাগী-মিনসের পেছন মেরে তবেই ফিরব।ʼʼ

পলাশ হাসল। সাধারণের চেয়ে বেশি ভয়ানক দেখালো তার ফ্যাসফ্যাসে হাসি। আধো-অন্ধকারেও চোখদুটো জ্বলছে সাপের মতো। বলল, “জয়ের বউ মেইন ফ্যাক্ট রে, মাজু। ওই চেংরী যেদিন থেকে কাহিনিতে এন্টার করছে, শালার বাজিই পাল্টে গেছে। জয় আর জয় নাই। আমার সাথে কী কী না করছে, তবু কিচ্ছু কইনাই। ক্যান বল তো!ʼʼ হেসে উঠল জোরে করে পলাশ।

মাজহার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল। তার কালো চেহারা আরও কালো হয়ে উঠেছে। সে সহ্যই করতে পারেনা জয়-হামজার কথা। আজ ওই দুই শুয়োরের বাচ্চা রাস্তায় না এলে তারা থাকতো জেলার রাজনীতিতে জমজমাট। অথচ দশটা বছর ধরে তারা মন্দায় পড়ে আছে। বাপ-চাচার নাম লুটপাট হয়ে গেছে। এক এক করে কাকা-বাপ সব গুটিয়ে নিয়েছে নিজেদের রাজনীতি থেকে।

পলাশ বলল, “রাজনীতিবিদগুলারে আমার ঠিক ততটা দরকাল, যতটা মনে কর ঠিকমতো হাঁটতে গেলে শক্ত মাটি দরকার হয় পায়ের তলায়। ওরা ছাড়া তো গতি নাই। দেশের টেরোরিজমে ওরাই শক্তি-ওরাই মুক্তি। জেল থেকে বাঁচাবে, ব্যবসায় নিরাপত্তা দেবে, পুলিশ-প্রশাসনকে কুত্তার মতোন চালাবে, বর্ডার পার করবে….ওরা ছাড়া গতি আছে? হাতে রেখেছিলাম। কিন্তু আমার ইগোর চেয়ে বড় কিছু নাই। ওইডা চটকাইছে জয় প্রথম ওর বউয়ের জন্য। অথচ আমি আজ পর্যন্ত চুপচাপ। কিচ্ছু করিনাই সেই মেয়ের। নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকে।ʼʼ

সিগারেটটা কেঁড়ে নিলো মাজহারের থেকে। দুটো লম্বা টান দিয়ে বলল, “একটা মাগীর কাছে হার মেনে গেল। সেই মাগীরে ছাড়ব? না ওই দুইটারে? ক। দিন খারাপ চলছে, চলতে চলতে নতুন দিন আসবে না? ওরা যাবে কোথায়?ভাবে না এসব?ʼʼ

মাজহারের খারাপ লাগল না পলাশের কথা শুনে। পলাশের মতো সন্ত্রাসরা রাজনীতিবিদদের টিস্যুর মতো হাতে রাখে, এই স্বীকারক্তিতেও খারাপ লাগল না। কারণ তারা তো আর রাজনীতিতেই নেই। সব ডাউন। নাম-খ্যাতি-ক্ষমতা সব গেছে। মানুষের নীতি এটা। যা নিজের কাছে নেই, অথচ থাকলে লাভ ছিল। এরকম জিনিসের ক্ষতি সাধনে মানুষ সুখ পায়। ব্যাপারটা ওরকম—আমার নেই, তোর থাকবে কেন? অথবা হয় আমার হ, নয়ত ধ্বংস হ। মাজহারের মনে এখন তাই চলছে। যে ক্ষমতা তাদের নেই, সেই ক্ষমতার নামে বদনাম শুনতেই আরও সান্ত্বণা লাগছিল।

পলাশ চোখ বুজে দেয়ালে পিঠ হেলান দিয়ে বসে থাকে। পরিকল্পনা সাজায়। রূপকথাকে পুরোনো বাড়িতে রেখে এসেছে। পোস্ট-মর্টাম শেষে কাকার লাশ আসতে দু’দিন দেরি হবে। শুধু জয়-হামজা না। তার নিজের লোক বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যাকে সে আইন সামাল দিতে মিথ্যা পরিচয়ে বসিয়ে রেখেছিল। রক্ত ফুটছে ভেতরে। বাই এনি চান্স, সে ধরা পড়লে তার ফাঁসি অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। সে একটা প্রতিজ্ঞা করল, কারাবরণ অথবা ফাঁসির আগে সে সবগুলোকে অন্তত তার পাগলামী দেখাতে চায় একবার। এরপর সব শাস্তি মঞ্জুর। তবে তার আগে প্রতিশোধ। যারা তার এত সাধের ত্রাসের সাম্রাজ্যে ফাঁটল ধরিয়েছে, তারা বেঁচে থাকতে দেশ ছেড়ে পালাবে না সে।

হোটেল থেকে শুরু করে প্রতিটা ডেরায় সিল পড়েছে। সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্তও হয়ে গেছে বোধহয় এতক্ষণে। হন্য হয়ে পুলিশ খুঁজছে তাকে। তাকেই সন্দেহ করা হচ্ছে কাকার খুনের জন্য। জয়ের এই রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সে পণ্ড না করে দেশের সীমান্তের ওপারে পা রাখবেনা।


ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ খুব কানে লাগে। নিঃশব্দ রাত।
রাত তিনটা বাজছে। অন্তূ জায়নামাজের ওপর ঘাঁড়ের নিচে মাথা রেখে শুয়ে থাকল অনেকক্ষণ। জয় উপুড় হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। খুব ক্লান্ত সে। ঘরে ঢোকার পর থেকে ঘরের ভেতরে একটা উৎকট গন্ধ বদ্ধ হয়ে আছে। সে শুয়েছে মিনিট দশেক হবে। রুমে এসেছে তার অল্প কিছুক্ষণ আগে।

অন্তূর ধারণা, কাউকে টর্চার করে ঘরে ফিরছে সে। রাজধানী থেকে ফিরেছে রাত এগারোটার দিকে। অথচ বাড়ির ভেতরে ঢোকেনি একবারের জন্যও। মাঝরাতে গোসল করার অভ্যাস পুরোনো। ঝটপট গোসল করে এসে শুয়ে পড়ল। রাত বাড়ছে, সাথে অন্তূর ভাবনারাও।

আজ ওরা কাউকে জিম্মি করে নিয়ে ফিরেছে, এটা অন্তূর ধারণা। একজন নয়, একাধিক ছিল তারা। অন্তূ উঠে দাঁড়াল। তার মন টিকছে না। বাচ্চাগুলো না খেয়ে আছে হয়ত এখনও। অন্তূর মুখে খাবার রোচে না, গলা দিয়ে নামেনা। খিদেও লাগেনা।

সে যখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, জয় উপুড় হয়ে বালিশের ওপর মুখ গুঁজে জড়ানো কণ্ঠে বলল, “আরমিণ! বাইরে যাবি না।ʼʼ

অন্তূ কয়েক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকল সে-কথা শুনে। তারপর তা অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।

এ সময় বাগানে যাওয়া সম্ভব নয়। লোহার গেইটটা দিয়েই ঢোকানো হয়েছে লোকগুলোকে।

লম্বা বারান্দার সিঁড়ির দরজায় তালা ঝুলছে। অন্তূ দু তিনবার টানল, ব্যর্থ চেষ্টা তালা ভাঙার। আব্দুল আহাদ সাধারণত ভিতরে বসে কোরআন তেলওয়াত করে। কী যে সুন্দর শুনতে লাগে! অন্তূ এই দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে শুনতে পায়। খিদেতে হয়ত চুপ করে আছে বাচ্চাগুলো! অন্তূর বুক পুড়ছিল। সে নিজেও কিছু খায়নি। রান্না করেছে, সকলকে খাইয়েছে, কিন্তু নিজের পেটে খিদের অনুভূতি টের পায়না আজকাল বিশেষ।

দরজায় হেলান দিয়ে বসল অন্তূ। রুমে যেতে ইচ্ছে করছেনা। ঘুম আসবে না কোনোভাবেই। চোখদুটো বুজতেই আব্বুর মুখটা ভেসে ওঠে। চমকে তাকায়। অন্তূর মনে হলো, আব্বুর গায়ের গন্ধ পেল খুব কাছে। কয়েকফোঁটা নোনাজল টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে। ক্লান্ত হয়ে উঠেছে রুহুটা। আর চলছে না। প্রগাঢ় অন্ধকারে বসে থাকে অন্তূ। ঝিঝি পোকার ডাক ছাড়া চারপাশ নিস্তদ্ধ। কোথাও আলো নেই, নেই জনমানব। বাচ্চাগুলো কুটুরিতে বন্দি। আজ বুঝি আরও কিছু এসেছে!

অন্তূ টের পায়, আমজাদ সাহেব এসে বসলেন পাশে। অন্তূ কাধটা হেলিয়ে দিয়ে কল্পনা করে, সে আব্বুর কাধে মাথা রেখেছে। আমজাদ সাহেব বললেন, “শক্ত হ, অন্তূ। বি স্ট্রং। তীর সম্মুখে। এ নৌকা ভিড়বে না। চলন্ত নৌকা থেকে ঝাঁপ দিবি। একটু গড়িয়ে গিয়ে আঘাত প্রাপ্ত হবি। পরক্ষণে গা ঝেরে উঠে তোকে তীরের গভিরে দৌড়াতে হবে। তুই তৈরি। অন্তূ?ʼʼ

তখনই লৌহ কপাটের ওপারে, ভেতর থেকে এক পৌরুষ কণ্ঠস্বরে সুতীব্র সুর ভেসে আসে কিছু শব্দগুচ্ছ প্রতিধ্বনিত হয়ে,

সেদিন আর রবে না হাহাকার, অন্যায়, জুলুম, অবিচার
থাকবে না অনাচার, দূর্নীতি, কদাচার..
সকলেই শান্তিতে থাকবে।
সেদিন সবাই খোদায়ী বিধান পেয়ে দুঃখ-বেদনা ভুলবে….

অন্তূর গা’টা শিউরে ওঠে। সে ছটফটিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দরজায় হাত রাখে। তার ভেতরে কাঁপুনি উঠেছে। উত্তেজনায় বুক টলছে! এ কীসের সুর, নীরব যুদ্ধের দামামা! কোনো পুরুষের সাধারণ স্বরের গাওয়া এক সংগীতে এত বিদ্রোহ থাকতে পারে? এত সুকরুণ, তবু যেন রণ-ঝংকার বাজছে। কণ্ঠস্বরটা চেনার চেষ্টা করে অন্তূ। সেই অস্ত্রের মতো ঝনঝনে স্বর ফের সুর টানে,

কোনো একদিন….. এদেশের আকাশে….
কালিমার পতাকা দুলবে
সেই দিন আর নয় বেশি দূরে, কিছু পথ গেলে মিলবে…

অন্তূর শরীরটা ঝাঁকি মেরে ওঠে। মনেমনে বলে ওঠে, “ওরে টান! কে আপনি যুবক! এত বিরোধ-অগ্নি!ʼʼ কখনও আবার বলে ওঠে, “মাশাল্লাহ!ʼʼ

অন্তূ চাতকের মতো পিপাসার্ত হয়ে চেয়ে থাকে অন্ধকারেই সেই দরজার পানে। মাথাটা ঠেকায় সেখানে। তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। কীসের অশ্রু! সাহসের? অথবা পথহারা পথিকের পথ পাবার আশংকা!

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৫১.

অন্তূ চুপচাপ ঘরে ফিরে এসেছিল। ডাইনিং স্পেসের কমন বাথরুমটার দরজায় জোরে জোরে শব্দ করল। যেন মনে হলো, সে বাথরুম থেকে বের হলো অনেকক্ষণ পর।

সাথে একগ্লাস পানি আর দুটো রুটি নিয়ে রুমে এলো। উদ্দেশ্য জয়কে বোঝানো, সে খাবার-পানি আনতে গেছিল। জয় চোখ বুজে শুয়ে ছিল, ঘুমন্ত কি’না বোঝা যাচ্ছিল না।

সকালটা খুব স্বাভাবিক কাটলো। অন্তূর চেহারাটা ভেঙে গেছে। চোখের নিচে কালি, ফর্সা মুখে বিভিন্ন প্রকার দুশ্চিন্তার ছাপ, কালচে ছোপ। রিমি এবং সে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রান্না করল, তবু বিশেষ কথা হলো না। সবার সব কথা বুঝি ফুরিয়ে গেছে এ বাড়ির! তরু আসছে, টুকটাক কাজকাম করছে, তুলির মেয়েটাকে দেখাশোনা করছে। হামজা বেরিয়ে গেল। অন্তূর ধারণা হামজা সামনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাগানের লোহার গেইট দিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরের কুটুরিতে ঢুকেছে।

অন্তূ পুরোটা বেলা নিজের ঘরে বসে পড়ল। অনেকদিন পর বইখাতাগুলো নেড়েচেড়ে দেখল সে। একসময় পড়তে বসলে, আব্বু এসে চুপটি করে পাশে বসতো। অনেকক্ষণ চুপচাপ চেয়ে দেখতো পড়তে থাকা অন্তূকে। ঠিক যেন অন্তূ তখনও প্রাইমারী স্কুলের ছাত্রী-ই। অন্তূ আমজাদ সাহেবের কাছে কোনোদিন বড় হয়েছিল না। তারপর ঝাপটা-টা এলো কবে?

অন্তূ নিজের ভুলগুলো ভাবে একমনে বসে। সে কথা বেশি বলে। খুব বেশি কথা বলে। অথচ লোকে তাকে গম্ভীর ভাবতো। তারা জানেনা সে অজায়গায় চুপচাপ সহ্য করতে পারেনা। তার অনেক ভুল। তার কারণে গোটা পরিবারটা তছনছ হয়ে গেছে। সে প্রচণ্ড স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক মেয়ে। মহানুভবতা নেই ভেতরে। অন্তূ টের পেল, আব্বু এসে পাশে বসেছে। জয় উল্টো দিক ফিরে শুয়ে ছিল। তখন সকাল নয়টা।

আব্বু জিজ্ঞেস করল, “এখন কী চাস, অন্তূ?ʼʼ

-“ভুলগুলো শুধরাতে।ʼʼ

-“কীভাবে?ʼʼ

-“সেটা বুঝতে পারছি না।ʼʼ

-“ভুলগুলো কী তা বুঝতে পারছিস?ʼʼ

‘“সবই তো ভুল, আব্বু!ʼʼ

-“সব কোনগুলো?ʼʼ

“সেই তো আমার সবই ভুল। তোমাকে হারিয়ে ফেলা…ʼʼ

“তোর ছাড়া আর কারও বাপ মরেনা?তকারও জীবনে তোর চেয়ে বেশি সংকট নেই, ভাই মরেনা? পরিবার ভাসে না? তারাও ভুল করে, তাই জীবন এমন? তাহলে তো সবই ভুলের দোষ, ভুলের ভুল। তোর দোষটা কোথায়? কারও কোথাও দোষ নেই…ʼʼ

বরাবরের মতো আব্বুর যুক্তির কাছে হারল। তবু তর্কে জড়ায়, “আমি অনেক পাপ করেছি আব্বু। তা ধরাতে দিচ্ছ না কেন?ʼʼ

‘“শুনি পাপগুলো।ʼʼ

অন্তূ উপহাস করে হাসে, “জয় আমিরের সাথে পাঙ্গা নিতে গেছিলাম। তারপর আরও কত নাটক করলাম! সব তো নিজের ন্যাকামিতে। তাই না, আব্বু? তোমার ধিক্কার জানানোর নেই আমাকে? আমি কোনো পদক্ষেপই শান্তভাবে নিতে পারিনি, পরিস্থিতি খুব ভালো ছিল। আমার জন্য সুখকর। তবু কেন যে চুপচাপ পেশাগত বুদ্ধিজীবীদের মতো ছক কষে কাজ সারতে পারলাম না? আমি পাগল হয়ে গেছি আব্বু, বদ্ধ পাগল, বে-তাল।ʼʼ

আমজাদ সাহেব গম্ভীর মুখে চেয়ে থাকেন। তারপর চট করে হাসেন, “নিজের ভেতরের সাথে খুব তর্ক হয় তোর তাই না? সে তোকে পছন্দ করেনা, সমর্থনও করেনা! তাকে জবাব দিচ্ছিস?ʼʼ

অন্তূ মুখ নামায়, স্বগোতোক্তি করে, “আমি কী কী করেছি, জানো, আব্বু?

-“না। জানি না।ʼʼ

-“শোনো, বলছি।ʼʼ তবু অনেকক্ষণ চুপ রইল অন্তূ। কথা বলল না কোনো।

-“চুপ কেন?ʼʼ

-“মেলাতে পারছি না, আমি কী কী করেছি। অনেক পাপ আর ভুল তো, আব্বু! মেলাতে বেগ পাচ্ছি বড়।ʼʼ

-“চেষ্টা কর দেখি!ʼʼ অসন্তোষ প্রকাশ পেল আমজাদ সাহেবের অভিব্যক্তিতে।

অন্তূ মুখ তুলে চায়। আমজাদ সাহেব মাথা দোলান, “কিচ্ছু করিসনি। জীবন আমাদের নিয়ে খেলে, অথচ আমাদের সাহস নেই জীবনকে দোষ দেবার। আমরা জীবনকে ভয় পাই। তবু দোষারোপ তো করতে হবে। তখন হয়ত নিজের কর্মগুলোকে দোষারোপ করে নিজেকে দোষী বানিয়ে মনোবল হারিয়ে বসি।ʼʼ

-“আমি কী করব, আব্বু? আমি পুরো ব্ল্যাঙ্ক। আমার মাথায় কিচ্ছু আসেনা। আমি দূরে কোথাও চলে যাব। আমি সব ছেড়েছুড়ে চলে যাব। কীসে জড়িয়েছি? আমার তো কিচ্ছু না। আমি নিজেই গলা সমান ডুবে আছি আগে এত ভালোমানুষি দেখাতে গিয়ে, আমি কার কী উপকার করব? কেন করব? যার যারটা সে বুঝে নিক। আমি খাবো, ঘুরব, ঘুমাবো। আর নাহয় পালাবো এই শহর ছেড়ে।ʼʼ

-“তারপর?ʼʼ

অন্তূ অল্প চুপ থেকে মলিন হেসে বলে, “কোথায় যাব? জায়গা বা ঠাঁই নেই তো, আব্বু। আমার যে আব্বু নেই। আমার একটা তুমি নেই, আব্বু। আমার কাছে আমার আম্মা নেই। আমার বাপটা বড় স্বার্থপর ছিল গো। সে আমায় বছরের পর বছর স্বপ্ন দেখিয়েছে। তারপর একদিন হুট করে রেখে পালিয়েছে। এমন এক জায়গায় রেখে, যেখানের চার দেয়াল বিষাক্ত কাঁটার বেষ্টনিতে ঘেরা। অল্প নড়লেও আঘাত অনিবার্য, অনস্বীকার্য।ʼʼ

-“তো দমে যাবি?ʼʼ

-“কী করতে বলো?ʼʼ অন্তূ চড়ে উঠল।

হেসে মাথা দোলালেন আমজাদ সাহেব, “তোকে উকিল হতে হবে, অন্তূ। আরও স্বার্থপর হতে হবে। আমার আদেশ রইল, এর পেছনে যুক্তি খুঁজতে যাবিনা। লোকে তোকে সর্বোচ্চ পাপীর কাতারে দাঁড় করাক, তুই বাকি জীবনে তোরটা আদায় করতে যা করতে হয়, সব করবি। কী বললাম? সব। সেটা অযৌক্তিক হোক অথবা অল্প পাপ অথবা হোক খাঁটি স্বার্থবাদীত্ব।ʼʼ

-“আমার কী করার আছে? আমি কেন জড়াচ্ছি নিজেকে? কোথা থেকে কী হচ্ছে আমার সাথে? চারপাশে কী চলছে? কেন? কবে থেকে? কীভাবে?ʼʼ অন্তূ বদ্ধ পাগলের মতো ছটফট করতে থাকে।

-“শান্ত হ। বল তোর ভুলগুলো কী কী? কী কী ভুলের জিম্মেদার ভাবিস নিজেকে?ʼʼ

-“আমার ভুল?ʼʼ

-“হ্যাঁ। তোর মতে তোরই তো। শুনি বল।ʼʼ

-“সে-তো অনেক! জয় আমিরকে ঘেন্না না করে সেই ভার্সিটিতে দেখা হবার প্রথম দিন মেনে নিলে আর কিচ্ছু হতো না। এরপর যা সব হয়েছে, সেসব হতো না। খালি পলাশের সাথে একবার দেখা হতো অন্তিকের বদৌলতে।ʼʼ

-“হু, আর?ʼʼ

অন্তূ খুব উৎসাহিত হয়ে ওঠে, “আব্বু ব্যাপারটা অনেকটা টাইম প্যারাডক্সের মতো। ব্যাখ্যা করব?ʼʼ

আমজাদ সাহেব চেয়ে রইলেন। অন্তূ বলল, “টাইম প্যারাডক্স হলো, ধরো—তুমি যেকোনোভাবে অতীতে গিয়ে তোমার দাদাকে তার ছোটবেলায় খুন করে এলে। এখন এখানে অনেক ‘কিন্তুʼ রয়ে যায়। তোমার দাদা যদি তার ছোট বয়সেই খুন হয়ে যায়, তাহলে সে বড় হয়নি, বিয়ে করেনি অর্থাৎ তোমার বাবার জন্ম হয়নি। আর তোমার বাবার জন্ম না হলে তুমি জন্মালে কোত্থেকে? আর যদি তুমি জন্মেই না থাকো, তাহলে তোমার দাদাকে খুনটা করল কে?ʼʼ

আমজাদ সাহেব মৃদু হাসলেন, “সমাজবিজ্ঞান ছেড়ে কীসে মন দিয়েছিস?ʼʼ

মলিন হাসে অন্তূ, “সমাজবিজ্ঞান! যে সমাজের সিস্টেম এবং বসবাসরত একেকটা মানুষের দৃষ্টিকোণকে আমি মৃত্যুর মতো ঘেন্না করি, সেই সমাজবিজ্ঞান নিয়ে ভাবার রুচি কোথায় আব্বু? সে তুমি যা-ই বলো। বিষয়টা মিলল না?ʼʼ

-“বুঝতে পারছি না।ʼʼ

“আমি বুঝতে পারছি খুব। আমি যদি সেদিন জয় আমিরকে প্রতিহত না করতাম, তাহলে পরবর্তিতে আর এতসব তামাশা হতো না। আর তামাশা যখন হয়েছে, একবার প্রতিহত করার ফলে। আর প্রতিহত যে একবার করতে পারে, সে কি আর পরের বার মেনে নেয়? আজীবনেও মেনে নেয়না। তুমি বলতে আব্বু।ʼʼ

-“এখনও বলছি।ʼʼ

‘“তাহলে তো হলোই। এ তো চিরধার্য ছিল।ʼʼ

-“তাহলে আর ভুল বলছিস কোনটাকে?ʼʼ

-“ভুল?ʼʼ অন্তূ হাসে, “সবই ভুল। জন্মানো ভুল, বেঁচে থাকা ভুল।ʼʼ

-“কী চাস?ʼʼ

-“দূরে যেতে। আমি আর নিতে পারছি না।ʼʼ

‘“তাতে কী হবে?ʼʼ

-“আমি ফুরিয়ে যাব।ʼʼ

-“এটাই চেয়েছিলি?ʼʼ

-“পারছি না আর নিজেকে টানতে। কী করতে বলো? মোকাবেলা করার শক্তি, বুদ্ধি অথবা দক্ষতা আমার নেই। আমি যা করি তা-ই ভুল হয়ে যায়। অথচ আমার ধারণা, সে-সব আমি না করলে ভুল হতো না। অর্থাৎ ব্যাপারটা এমন—যা আমি করব তা ভুল। যা ভুল তা আমি করব।ʼʼ

-“আধ্যাত্মিকতা?ʼʼ

‘“হতে পারে। ওসবই মাথায় ঘুরছে আজকাল। এই ক্লান্তির শেষ দরকার বুঝলে? তাতে আমি ভিলেন হবো, অযোক্তিক আর খারাপ হবো।ʼʼ

-“হয়ে যা।ʼʼ

-“কিন্তু কী করব?ʼʼ

‘“কিচ্ছু করিসনা। সুযোগ বলবে।ʼʼ

-“আর বাচ্চাগুলো?ʼʼ

-“যেগুলোকে তুই ভুল বলিস, এই ভাবনাগুলোই সেগুলো, অন্তূ। তোকে এত প্রতিবাদী হতে হবেনা। স্বার্থপর হ, লোকের বাহবাসহ জীবনে সব পাবি।ʼʼ

-“সত্যি নাকি?ʼʼ

-“হতেও পারে, নাও হতে পারে।

-“দায়সারা কথা বলছো।ʼʼ

‘“জীবনটাও তো দায়সারাই, অন্তূ। চলছে না তবু চালাও, পারছি না তবু পেরে ওঠো, কোনোমতো কেটে গেলেই মৃত্যু। দায় সারতেই আমরা জীবনকে টানি। কোনোমতো শেষদ্বারে পৌঁছে দিয়ে দায় সারি।ʼʼ

অন্তূ এবং আমজাদ সাহেব বসে থাকেন পাশাপাশি। কেউ অনেকক্ষণ কোনো কথা বলেনা। হঠাৎ-ই আমজাদ সাহেব বলেন, “অন্তূ?ʼʼ

‘“হু, আব্বু?ʼʼ

-“তুই কোনো ভুল করিসনি। আজ অবধি তুই যা করেছিস। তা একটাও ভুল ছিল না, আর না ছিল বোকামি। তুই যে কতটা শক্তিশালী তা তুই জানিস না। গভীর দৃষ্টিকোণ ছাড়া বোঝা যাবেনা। তোর প্রতিটা কাজের বহুল ব্যাখ্যা আর যুক্তি আছে। সেসব বোঝার দৃষ্টিকোণ সবার থাকবেনা। পরিস্থিতি মাফিক সব ঠিক ছিল। সবশেষে হতে পারিস তুই ভুল অথবা ঠিক। তাতে যায় আসেনা। যা মন বলবে করবি। পিছুটান নেই কোথাও। সবাই পিছুটান রাখলে সবাই যে মায়ার গোলাম হয়ে পড়বে। মায়ার গোলামেরা অধম হয়। পরিবার-পরিজন, সুন্দর জীবনের আশায় ব্যক্তিত্ব ত্যাগ ভালো নয়। তারা একেকটা অদামী, অকর্মণ্য।ʼʼ

-“আব্বু আমি ভুল করেছি। আর তার ফলেই এসব ঘটছে।ʼʼ

-“কোনটা ভুল, অন্তূ? আর এসব থেকে বাঁচতে কী করার ছিল? তুই ওই কবিতা পড়িসনি? এক লোক রাস্তায় বের হতোনা, গাড়ি চাপা পড়ার ভয়ে। নৌকা চরতো না, ডুবে মরার ভয়ে। ফ্যান চালাতো না, ফ্যান ভেঙে পড়ার ভয়ে..ওই জীবনযাপন করলে সব ঠিক থাকতো? জীবনে টানপোড়েন আসবেই। তার শর্ত—জন্মগ্রহণ করা। আর জন্মগ্রহণেল পর আর ধারাবাহিকতা থামানো যায়না। এসব ভাববি না।ʼʼ

-“আব্বু, গতকাল তুলি আপু বলছিল, জয় আমির আমার ঢাল।ʼʼ

-“হু, ঢাল। আগুনের তৈরি জলন্ত ঢাল।ʼʼ

অন্তূ অবাক হয়ে যায়। আমজাদ সাহেব বললেন, “যেটাকে হাতে চেপে ধরে রেখে তুই সামনের শত্রুর যাবতীয় আঘাত থেকে রক্ষা পাচ্ছিস।ʼʼ

অন্তূ অদ্ভুতাভাবে হাসল, “এদিকে আমার হাত যে ঝলছে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, আব্বু!ʼʼ

আমজাদ সাহেব সাঁয় দেয়া মুচকি হাসলেন, “তাতে কী?
জয় আমিরের ক্ষয়—তোর জয়। এটাই নিয়ম। চেঙ্গিস খানও আজ মাটিতে মিশে গেছে। সবার ধ্বংস হতে হয়। আর একেক ধ্বংসের মাঝে বৈপরীত্যের নতুন সৃষ্টি থাকে। এটা সূত্র। এটা চক্র।ʼʼ

-“আব্বু, তুমি বদলেছ? শতভাগ কথা তোমার নয়। তোমার কথাতে আমার সংমিশ্রণ!ʼʼ

-“আমি? আমি আজ কে?ʼʼ

অন্তূ অবাক হয়ে তাকায়। আসলেই তো! কার সাথে কথা বলছে সে! কেউ তো নেই। তবে কে?


জয়কে কল করেছিল পলাশ সন্ধ্যার পর। হামজা তখন কিছু ফাইল দেখছে সোফাতে বসে। জয় লম্বা একচা সালাম দিলো, “স্লা-মা-লে-কুম, পলাশ ভাই।ʼʼ

পলাশ হাসল, “সালাম, বস। ভালো?ʼʼ

-“বলেছি, এই প্রশ্ন জয়কে করবেন না। সে সদাসর্বদা ভালো। মানুষটাও ভালো, থাকেও ভালো। ভালো থাকা একটা পেশা, একটা ব্যবসা।ʼʼ

-“পুঁজি কী এই ব্যবসার?ʼʼ

-“মানুষকে খারাপ রাখা। ইটস ল অফ রিলিটিভিটি পলাশ ভাই। মানুষ খারাপ থাকলে, তার তুলনায় আমি ভালো থাকব।ʼʼ

-“তোর বউকে আমার হাতে দিবি না, সেটার জন্য ডিসকাশনে আসা যেত। এইডা কী করলি বাপ?ʼʼ চাপা হিঃস্রতা পলাশের হাসি হাসি রবে বলা কথাতেও লুকায় না

হামজা বলল, “স্পিকার লাউড কর।ʼʼ

তরু এসে দুইকাপ আদা চা দিয়ে গেল। সারাবছর জয়ের ঠাণ্ডা লেগে থাকে। তরুর ধারণা, কবে জানি এই লোকের নিউমোনিয়া বা অ্যাজমা ধরা পড়বে।

জয় মাথা নাড়ল, “বোকা সাজবেন না, পলাশ ভাই। আপনাকে বিশাল বেমানান লাগে। বউ তো আমি দেবই না। বউ হবার আগে দেইনাই। এখন কেমনে কী? কাহিনি অন্যডা। বউ রক্ষা করা কোনো বিষয় না, ভাই। ওটা আমি না চাইলেও হবে। আমার বউ যে-সে জিনিস না।ʼʼ

-“কাহিনি? কী কাহিনি?ʼʼ

-“মাজহার মাজহার। আমি আপনারে কইছিলাম, ওর সাথে মিলে কোনোদিন আমাদের পেছনে লাগবেন না। তবু আপনি বরাবর তাই করে আসতেছেন। আমি আপনারে কোনোদিন বিশ্বাস করি নাই যদিও, তবু আপনি একটা বিশ্বাসঘাতকতা টাইপের বিট্রে করছেন। যার ফকিরের সিরনি খান, সেই ফকির চেনেন না, নাআআ! হলো মিয়া? মাজহার তো বাদামের খোসা। আপনাকে ব্যাক-আপ দিই আমরা। তবু ছলচাতুরি?ʼʼ

-“আমি কিছু করিনি। মাজহার যা করতে চেয়েছিল আমি বাঁধা দিয়েছি।ʼʼ

-“বাচ্চা দুষ্টুমি করলে মা’দেরও ওরকম দু চারটে মিঠা ধমক দিতে দেখছি। ও ব্যাপার না। ওটাকে প্রশ্রয় বলে। আমার চেয়ে বেশি কেউ পায়নি ও জিনিস।ʼʼ

-“তুই ভুল বুঝে কাম ভালো করিসনি, বাপ।ʼʼ

-“এই একটা কথা বললেন? ইমেজ নষ্ট করা কথা। আমি জীবনে ভালো কাম করিনি। এটা আমার পারমানেন্ট ইমেজ। অথচ আপনি এমন টোনে কথাটা বললেন, যেন রোজ ভালো কাম করি, আজ একটা খারাপ করছি। এইটা হইলো? নাহ। আমি মরব খুব তাড়াতাড়ি। তবু শুধরাবো না, নিজেকে কন্ট্রোল করব না। ছোট্ট জীবনে অত ভাবনাচিন্তা রাখিনা। যখন যা মনে চায় করি। কল রাখেন। কল করে ফ্যারফ্যার করার চেয়ে আমার পেছনে বাঁশ না কঞ্চি দেবেন, সেটা দেবেন কীভাবে, সেইসব পরিকল্পনা করেন। ইয়া হাবিবি। আল্লাহ হাফেজ।ʼʼ

হামজা কপালে হাত চেপে হেসে ফেলল। জয় বলল, “ঘাপলা আছে ভাই। ওর মতোন মাতানষ্ট পাগল শালা এমন বাংলা সিনেমার মতো সরল ফোনালাপ করতে কল লাগাইছে। কাহিনিটা এডজাস্ট হচ্ছে না শরীরে। কিড়মিড় করতেছে।ʼʼ

হামজা শান্ত স্বরে বলল, “তোর ফোন ট্র্যাকডাউন করার জন্য হতে পারে।ʼʼ

-“এত উন্নত ডিভাইস তো কোনো এসবি ডিপার্টমেন্টেও নাই।ʼʼ

-“ওর কাছে থাকলে কী?ʼʼ

-“তা মানে বুঝছো?ʼʼ

-“দিনাজপুরে নেই ও। আই গ্যেস, ঢাকাতে কোথাও আছে। কঠিন প্লান-প্রোগ্রাম চলছে।ʼʼ

কাগজপত্র ছুঁড়ে ফেলার মতো টেবিলে ফেলল হামজা। একটাতেও মনের মতো কিছু নেই। জয়কে বলল, এগুলো স্টেটমেন্ট? এসব রাজধানীতে পাঠালে উপরমহল মাজায় লাত্থি ছাড়া কিছু দেবেনা।

কল করে কাউকে ডেকে বসে রইল দুজন চুপচাপ। আদা-চা ঠান্ডা হয়ে এসেছে। শরবতের মতো সেই চা জয় শব্দ করে বাচ্চাদের মতো চুমুক দিয়ে খেতে লাগল।

হামজার উপরমহল দেশের ক্ষমতাসীন দলের মহাকর্তারা। তারা অ-বিনিময়ে কিছু দেয়না। বিরোধী দলের ছেলেদের আঁটক করা, অত্যাচার করা, মিথ্যা অপরাধ সাজিয়ে কারাগারে ঢোকানোর মতো কাজগুলো হামজার মতো উঠতি নেতাকর্মীদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। তাদের প্রোফিট তারা কাজের স্কোর অনুযায়ী নিবার্চনের আগ আগ দিয়ে পেয়ে যাবে—নীরব চুক্তিটা এমন হয়।

যে যতটা ভালো কাজ দেখাতে পারবে, ক্ষমতা পাবার ক্যান্ডিডেটদের মাঝে তারাই অবশ্যই অগ্রগামী থাকবে। হামজা যা করছে, যা করতে চাইছে; ২০১৮ এর সংসদ নির্বাচনে একটা মনোনয়ন পাবার সম্ভাবনা নেহাত কম নয়।

ডাউন পার্টি মাজহার। সে মানতে পারল না বিষয়টা। প্যাঁচ লাগালো। কঠিন প্যাঁচ। যে কাজ হামজা এবং জয় মাসখানেক আগে করে ফেলতে পারতো, তা গতরাতে সম্ভব হয়েছে। মাজহারকে পুরোটা সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছে পলাশ। নয়ত পলাশের বাপ বেকার বসে আছে, দলছূট হয়ে গেছে। তারা এখন আম-জনতার চেয়ে বেশি কিছু না।

শত্রুর শত্রু নিজের বন্ধু। মাজহার নীতিটা পালন করেছে। পলাশের ব্যবসায়ীক পার্টনারশীপের জেরে হামজাদের অধিকাংশ কাজের খোঁজ পলাশের কাছে থাকে। পলাশ তা লিক করতো মাজহারের কাছে। মাজহার নিজে ক্ষমতাসীন দলের চামচামী করলেও এবার হিংসাপরায়নতা তাকে বিরোধী দলকে গোপন তথ্য দেবার কাজে নিয়োজিত করেছিল। এলার্টেশন পেয়ে পেয়ে ওরা নিজেদের গুটিয়েছে। জয়-হামজার পেরেসানী চরমে পৌঁছেছিল। দিনের পর দিন দুই ভাই ছুটেছে।

শেষ অবধি বাচ্চাগুলোর অসহায়ত্বের চিত্র, ভিডিও, বিবরণ তাদের সফল করেছে। অতগুলো বাচ্চার জীবন বাঁচাতে তাদের ধর্মের বড় ভাইয়েরি ছুটে আসবেনা, তা হয় নাকি? ধরা দিয়েছে। শর্ত ছিল, বাচ্চাদের ছেড়ে দেয়া। হামজা দেয়নি। ওরা জানের ভয় অল্পও পায়না। বাচ্চাদের ছেড়ে দিলে ওরা মৃত্যু কবুল করবে, তবু কোনো জবানবন্দি দেবেনা।

আজ বাচ্চারা পেট পুড়ে খেয়েছে। খেতে পায়নি তাদের আমিরেরা। খেয়েছে—মার। সেসব হজম করতে না পেরে লুটিয়ে পড়েছে কেউ কেউ জ্ঞান হারিয়ে।

হ্যাংলা পাতলা চেহারারার রন্টু এসে দাঁড়াল হামজার সামনে। কপালে হাত ঠেকিয়ে মাথা নুইয়ে সালাম ঠুকলো।।সে হাঁপাচ্ছে। হামজা জিজ্ঞেস করল, “কী অবস্থা?ʼʼ

-“ভাই। পাথরের মতোন মার খাইতেছে। তবু কথা কয়না। আমার কাছে আবার ওযুর পানি চাইছে, ইশার নামার পড়ব।ʼʼ

জয় উঠল। এক মগ পানি নিলো বাথরুম থেকে। হলরুম থেকে বেরিয়ে যাবার সময় হামজা ডাকে, “কোথায় যাচ্ছিস?ʼʼ

জয় ফিরে তাকায়, “একটু সাক্ষাৎ করে আসি। আর ওযুর পানি দিয়ে আসি।ʼʼ

-“আঘাত করিস না এখন আর।ʼʼ

-“করব না।ʼʼ

রন্টু ডাকে, “ভাই?ʼʼ

আনমনে জবাব দেয় হামজা, “হু!ʼʼ

-“ভাই, একটা কথা কই?ʼʼ

-“বল।ʼʼ

-“আগে বহুত এমন কেস সাল্টাইছি। একটু মারলেই ওগোরে ধর্ম-টর্ম সব গোড়ের ভিত্রে পালায়। এইরকম শক্ত জান দেহি নাই। ভাই, আমার কাছে আবার ওযুর পানি চায়। একটু টু শব্দ করেনা, ব্যথাও লাগেনা মনেঅয়। কেডা ভাই ওইডা? আগেও বহুত শিবিরের ছাওয়ালরে খালাস করছি। উরা মরার আগে বাঁচতে চাইছে। নামাজ কালাম পড়তে চায় নাই। আজকের বাকিগলাও ওই লোকটার মতোন না। অত শক্ত ছিল না। এইটা আলাদা…ʼʼ

হামজা শান্ত চোখ তুলে তাকালে রন্টু ঢোক গিলল। ভয়ে আর কথা বলল না। চলে গেল দ্রুত হামজার সামনে থেকে।


নিচতলার আঙিনা পার্টির ছেলেদের আনাগোনায় গমগম করে সারাক্ষণ। নিচে যেন বহুদিনব্যাপী উৎসব চলে সারাবছর পাটোয়ারী বাড়িতে। সেটা আরও বেড়েছে হুমায়ুন পাটোয়ারীর মৃত্যূর পর। একগাদা সৈন্য মোতায়েন রেখে দুই ভাই বেরিয়ে গেল সন্ধ্যার আগে। চারদিকের ঝামেলা সামাল দিতে হচ্ছে একসাথে। অন্তূ বেশ কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখল নিচের আঙিনায় ভেতরবাড়ির পাহারাগুলো। ক্লাবঘরে আগুন লাগার পর থেকে ওখানের আড্ডাটা তুলে এনে এখানে বসানো হয়েছে যেন। রাতের রান্না চড়িয়েছে তরু।

অন্তূ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। কতরকম ভাবনা মনেমনে খেলা করে যায়। জয় আমিরের ওপর সে কৃতজ্ঞ। জয় আমির তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কৃতজ্ঞ সে। ঠিক যেমন মানুষ কৃতজ্ঞ থাকে এন্টিবায়োটিক ওষুধের ওপর। যেটা রোগ সারানোর সাথে সাথে শরীরের ইমিউন সিস্টেম দূর্বল করে, শক্তিমত্তা হনন করে, মাস খানেকের জন্য অকেজো করে মানবদেহকে এবং বৃক্কে এক প্রকার স্থায়ি ক্ষতিসাধন করে যায় চলমান-হারে। জয় আমির দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্যগুলোর মতোই ভালো। অন্তূ এসব ভেবে হাসে।

রিমি এসে কখন পেছনে দাঁড়িয়েছে, টের পায়নি। জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবেন?ʼʼ

-“আপনার রুম বহুদূরে। কানে কিছুই আসেনা, না?ʼʼ

-“হবে হয়ত। তাতে তো ভালো। কান ভালো আছে।ʼʼ

-“আমার নেই।ʼʼ

-“ঘর পরিবর্তন করুন।ʼʼ মুখ ফিরিয়ে অনীহার সাথে বলল অন্তূ।

-“আপনার কী হয়েছে, আরমিণ? অন্যরকম লাগছে।ʼʼ

-“শুধরাতে চাই নিজেকে।ʼʼ

-“মানে?ʼʼ

-“কেন এসেছেন?ʼʼ

-“চাবি এনেছি।ʼʼ

“ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে রেখে দিন জায়গার চাবি জায়গায়।ʼʼ

-“আপনি যাবেন এখন বড়ঘরে।ʼʼ

-“প্রশ্নই ওঠেনা। আমি নিজের আর বিপদ বাড়াবো না। এই বিপদে পড়ার ফলে কার কার ওপর যে কৃতজ্ঞতা রাখতে হচ্ছে, রিমি। ভাবতে পারেন? আমি বিপদে আছি, তা থেকে প্রোটেক্ট করছে আমায়। আর আমার তার ওপর কৃতজ্ঞতা রাখতে হচ্ছে। এর চেয়ে আর কী খারাপ খেসারত গুনলাম? এটাই সবচেয়ে কঠিন। তাই আর বিপদ নয়, আর না নতুন কৃতজ্ঞতা। ʼʼ

-“এত অহংকার আপনার?ʼʼ

-“ভুলভাল শব্দ উচ্চারণ করছেন, রিমি। ওটা আত্মমর্যাদাবোধ। কোনো পাপীষ্ঠর ওপর কৃতজ্ঞতাবোধ একপ্রকার আত্মগ্লানি। এত আত্মগ্লানি বইতে পারছি না।ʼʼ

“ওদের প্রতিটা আঘাতের আত্মচিৎকার আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে। এতদিন এভাবে টর্চার করা হয়নি ওদের।ʼʼ

-“হয়নি, এখন হবে। খারাপ কী? তাতে আমারই বা কী? আমি মানুষ, সাধারণ এক অসহায় মেয়ে। আমার ক্ষমতা নেই ওদের সহায়তা করার।ʼʼ

-“এমন কেন করছেন কেন? এত শক্ত হচ্ছেন কেন? প্লিজ, আরমিণ। আপনি সাহসী। আমি পারিনা ওসব দেখতে, মোকাবেলা করতে। আপনি পারেন। আপনার সাহস আছে।ʼʼ

অন্তূ শক্ত গলায় চিবিয়ে বলল, “সাহস? কীসের সাহস? হারানোর সাহস, তাই তো? বাপ-ভাই-ক্যারিয়ার-সুন্দর জীবন—সব হারিয়ে ফেলার বোকা সাহস আছে তাই তো? অথচ আপনারা চালাক। নিজেদের গা বাঁচিয়ে যা হয় করেন। আপনাদের কোনো শত্রু নেই, ক্ষয় নেই। ড্যাম অন মি। এই কথাগুলো বুঝতে এতগুলো দিন লেগেছে আমার।ʼʼ

রিমি কেমন কাতর হয়ে উঠল, “আমি মানছি। সব মানছি। কিন্তু ওদের শরীরের ব্যথার কাতরানির আওয়াজ সহ্য হচ্ছেনা আমার। আপনি একটু দেখে আসুন। পায়ে পড়ি, আরমিণ। যান বড়ঘরে একবার। সমস্ত ভার আমার। ওরা এখনও ব্যথায় ছটফট করে চিৎকার করছে। আমার কানে সইছেনা।ʼʼ

সিঁড়ির দরজা খুলতে এইদিন অন্তূর খুব হাত কেঁপেছিল। সে জানে না ভেতরে কী দেখবে। সেই কণ্ঠস্বর, সেই বিদ্রোহী সংগীতের মালিক!

বড়ঘরে পা রাখতে পা টলছিল খুব। হাত-পা জড়িয়ে আসছিল। পশ্চিম কোণের লোহার দরজার ওপাশে ছেলেদের আওয়াজ আসছে। ওরা যদি ভেতরে ঢুকে আসে, কী করে সামাল দেবে সে? খালি হাত তার।

সে কম্পিত পায়ে বড়ঘরের ভেতরে গিয়ে দাঁড়ায়। কড়া পাওয়ারের স্পটলাইট ঝুলছে মাথার ওপরে। দুজন কাত হয়ে শুয়ে আছে। আব্দুল আহাদকে দূর থেকে চিনতে পারল অন্তূ।

তার পা উঠছিল না। তবু হেঁটে এগিয়ে গেল। ওরা সবাই মিলে আহতদের সেবা করছে। অন্তূ মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। চারজন নতুন পুরুষ। দুজন পড়ে আছে। একজন পা ছড়িয়ে বসে পায়ের ক্ষততে হাত বুলাচ্ছে। রডের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে চামড়া, ত্বক বিদীর্ণ হয়ে মাংস থেতলে যাওয়া স্থানে হাত বুলাচ্ছে।

চতুর্থজন দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখ বুজে বসে আছে। হাতে ব্যন্ডেজ। কপালে শুকনো রক্ত। মুখটা ওপাশে কাত হয়ে থাকায় দেখতে পেল না অন্তূ। পায়ে শিকলের বেড়ি আঁটকানো। তা তালাবদ্ধ লোহার বীমের সাথে। অন্তূ কয়েক কদম এগিয়ে গেল। মাথার চওড়া ওড়নার প্রান্তটা আরেকটু টেনে দিলো। সকলেই ফিরে তাকায় ওর দিকে। অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।

চতুর্থজন বাহিরের মানুষের উপস্থিতি টের পেয়েও মুখ ফেরানোর তাড়াবোধ করছিল না যেন। অন্তূ আব্দুল আহাদকে বলল, “খেয়েছ কিছু?ʼʼ

শুকনো মুখে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায় আব্দুল আহাদ। অন্তূ, কাছে মিথ্যা ঠেকল। নারীকণ্ঠের আওয়াজ পেয়ে সেই পুরুষ মুখ ফেরায়। অন্তূর রক্ত সঞ্চালন থামল। কাঠের আসবাবের মতো জমে দাঁড়িয়ে থাকল।

সেই চোখ। রুমালে বাঁধা মুখোশের আড়ালে যে চোখদুটো তেজস্ক্রিয় রশ্মির মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলেছিল সেদিন। সেই চোখজোড়াকে অন্তূ ভুলবে কোনোদিন? চাপদাড়িতে প্রসস্থ মুখখানা স্লান সেই পুরুষের। পরনে খাদি কাপড়ের ফতোয়া। কালো প্যান্ট। তার কয়েক স্থানে ছেঁড়া। হাতের কালো বেল্টের ঘড়িটার কাঁচ ফেটে গেছে।

অন্তূ খেয়াল করে পায়ের যে স্থানে শিকলের বেড়ি, স্থানটায় রক্ত জমাট বেধে দগদগে ঘা তৈরি হয়েছে। পুরুষটি সোজা হয়ে বসল। নিজের দৃষ্টি সংযত করে অন্যদিকে তাকিয়ে অন্তূকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এখানে এসেছেন কেন? ফিরে যান ভেতরবাড়িতে। নিজের ঝুঁকি বাড়াবেন না।ʼʼ

সেই সুতীব্র ভরাট কণ্ঠস্বর। সেদিন রাতের বিদ্রোহী স্বর! অন্তূ চোখ নামায়। শুধু এটুকু উচ্চারণ করতে পারে, “কে আপনি?ʼʼ

-“আমি….সৈয়দ মুরসালিন মহান।ʼʼ

অন্তূ দু কদম পেছায়। চোখের পলক ফেলেনা।

চলবে..

[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। বেশি বেশি মন্তব্য চাই কিন্তু😑]