#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৫৮.
পলাশের দলের সকলেই ছন্নছাড়া। যে যেমন পেরেছে আত্মগোপন করেছে, দেশে অথবা বাইরে। এমনটা একবার হয়েছিল যুগখানেক আগে।
২০০২-এ বিরোধী দলীয় নেত্রীর নেতৃত্বে গোটা দেশজুড়ে একটি সন্ত্রাস ও অপরাধীমুক্ত অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল–যা’অপারেশন ক্লিনহার্টʼ নামে পরিচিত। কয়েক মাসের এই দেশব্যাপী অভিযানে গোটা দেশের সন্ত্রাস ও অপরাধীরা সিংহভাগ আঁটকা পড়েছিল বিভিন্ন সংস্থার আইরক্ষাকারীদের থাবায়। তখন দেশটা হয়ে গেল শান্ত। সকল সন্ত্রাসদের হয় দেশ ছাড়তে হলো, অথবা দল-ধ্বংস। তখনই একবার হামলা হয়েছিল রাজন আজগরের কারবারে। কিন্তু তখন তেমন একটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পলাশ তখন বেশ ছোট।
কিন্তু এবার গোটা পরিস্থিতি অনুকূলে, আইনসংস্থা থেকে শুরু করে দালাল, নেতাগণ..তবু এক জয় আর নিজের ঘরে পালা এক মীরজাফর পলাশকে ধ্বংস করে ছেড়েছে।
রিমি কাপড় আয়রন করছে ঘরে। রাত এগারোটা। হামজা সোফায় বসে ছিল। চোখদুটো বোজা। বহুকাল রাতে ঘুমানো হয়নি। এটা অবশ্য অল্প ভুল। রিমিকে জড়িয়ে নিলে মেয়েটা যখন নিশ্চিন্তে ওর বুকে মাথা লুকাতো ছোট্ট কবুতর ছানার মতো, তখন দুনিয়াদারীর ঝঞ্ঝাট আপাত একরাত ভুলে সে ঘুমিয়েছে বারবার। তবে সেসব অনেকদিন আগের কথা। বহুদিন মেয়েটা তার কাছে তো আসে, কিন্তু সেই কাছে আসাতেই যেন যত দূরত্ব! তাতে সংশয়, ঘৃণা অথবা দ্বিধার সমন্বয় ছাড়া কিছু নেই। ভেতরটা প্রশ্ন করে ওঠে, “হামজা তুই কি ভুল করিসনি?ʼʼ
-“করলেও ভুলটা কী?ʼʼ
-“শত্রুকে ঘরে তোলা।ʼʼ
-“ওইটুকু একটা পুঁচকে, নিঃসঙ্গ মেয়ে আমার শত্রু?ʼʼ
-“এটাও নতুন বোকামি তোর। যার মনে তোদের জন্য সেই শুরু থেকে বে-হিসেবী ঘৃণা, সে কমজোর হোক, তবু মনে রাখতে হবে, সে তোর বিরুদ্ধে যেকোনো কিছু করতে পারে। আর অন্তত এ কারণে হলেও শত্রুকে ছোট করে দেখতে নেই। জেনেবুঝে কেন?ʼʼ
-“আমার রেপুটেশন বজায় রেখে সবটা বদনাম আরমিণের ওপর বয়ে নিয়ে যেতে আমার ওকে জয়ের বউ হিসেবে মেনে নেয়ার বিকল্প ছিল না। আমি যখন জয়ের বউ হিসেবে ওকে মেনে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিনি, তখন মানুষ আমার ওপর সন্তুষ্টিতে গোটা পাপটাই আরমিণকে নিবেদন করেছে। এটা ট্রিক্স অর পলিটিক্স, হোয়াটএভার! তাছাড়া ও এখন যা করছে, তার সবটাই আমার নাগালের ভেতর, এ বাড়ির বাইরে থাকলে আরও অনেক কিছুই করতে পারতো। চরম জেদি আর চতুর মেয়েলোক। ওর প্রতিটা বোকামির মতো দেখতে কর্মও ওর পরিকল্পিত।ʼʼ
-“তাহলে ওকে সরিয়ে দে। ওর এত ক্ষতি করেও তো দমেনি, ওকে-ই সরাতে হবে। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইতে কী লিখেছিলেন জানিস?—মানুষের যখন পতন আসে, তখন পদে পদে ভুল হতে থাকে।ʼʼ
হামজা একটু সপ্রতিভ হলো, উত্তেজিত হলো, ক্ষেপে উঠল, আবার নিভে গেল। সে শান্ত মানুষ। আস্তে করে শুধু বলল, “জয় মানবে না।ʼʼ
-“তুই জয়ের পরোয়া করিস?ʼʼ
হামজা নিজের দুহাতের তালু মেলে দেখে, এরপর মৃদু হাসে, “এ দুহাতে গড়েছি জয়কে। এই হাতে ওর ঘাম মুছে দেয়ার শক্তি থাকলেও ওকে মিটিয়ে দেবার শক্তি কি আছে?ʼʼ
-“থাকতে হবে। দরকার পড়লে ওর শেষ নিশানটুকুও মিটিয়ে দেবার শক্তি চাই হাতে। পেতে হলে দিতে হয়। ক্ষমতায়নের পথে ও হোক তোর প্রথম বিসর্জন।ʼʼ
হাঁপিয়ে ওঠে হামজা নিজের সাথেকার এই ভয়ানক আলোচনায়। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে জয়কে ডাকে, -“জয়, ও জয়!ʼʼ
জয় বেরিয়ে এলো রুম থেকে। হামজা জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অস্থিরতা অনুভব করে। লোকে বলে জয়ের ওই শক্ত কাঠামোর মুখটা নিষ্ঠুর, হামজা তাতে শুধুই মায়া দেখেছে।
জয় খেঁকিয়ে উঠল, “কী সমস্যা? ঘরে বউ নাই, আমায় ডাকাডাকির কী আছে?ʼʼ
গম্ভীর হয় হামজা, “বস।ʼʼ
জয় বসল না, চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ল হামজার কোলে। হামজা কাধ এলিয়ে সোফায় বসে, চোখ বুজে প্রশ্ন করে, “আমার যদি তোকে কোনোদিন বলি দিতে হয়?ʼʼ
হো হো করে হেসে উঠল জয়, “কোন দেবীর নামে?ʼʼ
-“কোন দেবীর নামে বলি হতে পছন্দ করবি তুই?ʼʼ
জয় জবাব না দিয়ে উঠে নিচের দিকে ঝুঁকে বসে হামজার পাশে, “পেরেশান কোনোকিছু নিয়ে?ʼʼ
হামজা তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ জয়ের দিকে, তারপর সামান্য হাসল। জয় গান ধরল, “জীবন মানেই তো যন্ত্রণা, বেঁচে থাকতে বোধহয় শেষ হবেনা।ʼʼ সুর থামিয়ে বলল, “অতএব বেঁচে থাকা ইজ ইক্যুয়েল টু বোকাচুদামি। যার নেশা আমার নাই। কবে দিচ্ছ বলি?ʼʼ
হামজা চুপচাপ বসে থাকে। তার আর জয়ের মাঝে কোনো দেয়াল নেই, যা সব সরাসরি। তাদের সম্পর্কের ঐতিহ্য একটাই—সেখানে কোনো লুকোচুরি নেই। সামনে কঠিন দিন। খুব কঠিন। হামজা জয়কে বলে, “তুই এখন বের হবি তো?ʼʼ
জয় তখন একটা টেনিস বলে রেড-টেপ জড়াচ্ছে। হামজা উঠে গিয়ে জয়ের দুটো ওষুধ ও পানি আনল। গম্ভীর হয়ে বলল, “এদুটো খেয়ে নে। আমি রুমে যাব।ʼʼ
-“যাও আমি খাচ্ছি।ʼʼ
মাড়ি চাপে হামজা, “কানসারার পর মারব একটা, শুয়োর। আমার সামনে খাবি, শরীর এখনও একটু গরম। গলা বসে আছে। ধর, নে।ʼʼ
বাড়িটা গা ছমছমে। একসময় বেশ লোকজনে ভর্তি ছিল। আজ নেই। তারা কেউ চলে-টলে যায়নি, এক একে করে পরপারে পৌঁছে গেছে! কী ভয়ানক! তুলির জীবনের কী ব্যবস্থা হবে, কে জানে! হামজা এখন অন্য তালে বেসামাল।
জয় ঘরে যায়। অন্তূ ডান-কাত হয়ে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে ডাকে অন্তূকে। অন্তূ একডাকে উঠে বসে, জয় বলে, “চলো। ঘুরে আসি।ʼʼ
-“কোথায়?ʼʼ
-“শহর ঘুরে আসি। মধুচাঁদে তো গেলাম না, আজ চলো যাই।ʼʼ
অন্তূ বোঝে, জয় অকারণে ঘুরতে যাচ্ছে না। বের হবার আগে জয় একটা চুড়ির বাক্স রাখল ড্রেসিং টেবিলের ওপর, “এ দুটো হাতে লাগাও।ʼʼ
-“কেন?ʼʼ
জয় শুধু ঠান্ডা চোখে তাকাল একবার।কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। অন্তূ মুচকি হাসল গোপনে। ভয় ও গোলামি দুটোই আপেক্ষিক। ভয় পেলে মানুষ ভয় দেখাবে, গোলামি করলে কেউ কারও মালিক হতে পারবে। ভয় না পেলে লোকে ক্লান্ত হয়ে আর চেষ্টা করবে না, গোলামি না খেটে যদি কেউ জান দেয়া কবুল করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার জান নেয়া হয়না, গোলামি খাটানোরও প্রবনতা কমে আসে সেক্ষেত্রে। এই খেলায় অন্তূ জিতে গেছে এতদিনের প্রচেষ্টায়। জয় ও হামজা দুজনের বদ্ধ ধারণা জন্মেছে, অন্তূকে জোর করে থামানো অথবা রাজী করানো যায়না।
জয়ের এই বাপ্পারাজ টাইপ ভাব দেখে অন্তূর মুখ বিকৃত হয়ে এলো। চোখ উল্টে মাথা ঝাঁকাল। জয়ের ভালো ভাব দেখলে, অন্তূর শুধু একটাই কথা মাথায় আসে, ‘পেছন মেরে বালুর সেঁক!ʼ
চুড়িগুলো চোখ ধাঁধানো সুন্দর। চিকন স্বর্ণের দুটো চুড়ি। অন্তূর ফর্সা হাতে চোখ কাঁড়ছিল। জয় গম্ভীর মুখে দেখল তা।
বাথরুমের ফেইক-রুফ থেকে একটা সাদা ধবধবে কাপড়ে মোড়া কিছু একটা বের করল জয়। তাতে একটা হাতে ব্যবহারের মতো ছোট চকচকে কুড়াল।
অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “এটা কী কাজে ব্যবহার করেন?ʼʼ
-“করিনি এর আগে।ʼʼ
-“তাহলে রেখেছেন কেন?ʼʼ
-“আমানত। আমানত না ঠিক, হাত বদল হয়ে আমার কাছে চলে এসেছিল মালটা।ʼʼ
-“কার?ʼʼ
-“কারও হবে।ʼʼ
অন্তূর কৌতূহল হয়, “কে সে? দায়সারা জবাব দেবেন না আমার প্রশ্নের।ʼʼ
জয় লুঙ্গি খুলে প্যান্ট পরতে পরতে জবাব দেয়, “এক নারী।ʼʼ অস্পষ্ট শুনতে লাগে। কারণ শার্টের প্রান্ত তখন দাঁত দিয়ে চেপে ধরে ছিল।
অন্তূ অবাক হয়। জয় কখনও কোনো মেয়েকে এমন সম্মান দিয়েছে, তা অন্তূর জানা নেই। সে জিজ্ঞেস করে, “নারীটা কে?ʼʼ অন্তূ ভ্রু কুঁচকে মিষ্টি, “এই, আপনার আগেকার প্রেমিকা-টেমিকা হবে নাকি?ʼʼ
জয় হাসল, “তার মধ্যে সেইসব সিস্টেমই নেই। তার সাথে যে-সময় দেখা হয়েছিল, তখন আমার ভেতরেও প্রেম-পিরিতির সিস্টেম ছিল না।ʼʼ
অন্তূ ভ্রু নাচিয়েঠোঁট উল্টায়, “তবু বিশেষ কেউ-ই হবে। নয়ত আপনার মতো লোক কাউকে এতখানি সম্মান তো দিতে পারেনা!ʼʼ
-“তোমাকে দেইনি?ʼʼ
অন্তূ শব্দ করে হেসে উঠল, তাতে অজস্র বিদ্রুপ ঝরে পড়ল, “তা দেননি আবার! দিয়েছেন তো।ʼʼ
জয়ের মুখটা চেক চেক প্রিন্টের লাল-সাদা গামছায় বাঁধা। জয় গাড়ি নিলো ক্লাবের ওখান থেকে। অন্তূ দেখল, সেই দুর্গের মতো ক্লাবঘর পুড়ে ধ্বংসপ্রায় হয়ে গেছে। কবীর সাথে যেতে চায়, “ভাই, আমি যাই আপনার সাথে?ʼʼ
-“তোর শ্বশুরের বিয়ে খাইতে যাচ্ছি, শালা? সাথে গিয়ে মুরগীর রানে কামড় বসাবা?ʼʼ
-“ভাই, আমি ড্রাইভ করবো। আপনে আর ভাবী বসে থাকবেন। আপনার তো শরীল খারাপ….ʼʼ
-“ন্যাকামি করিস না, বাপ। বাসায় যায়ে দুই প্যাগ মাল খেয়ে শুয়ে পড়, যা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু!ʼʼ
কবীর তবু পেছন ডাকে, “ভাই, আপনে ভাবীরে নিয়া একা একা যাবেন…ʼʼ
-“পরেরবার তোর বউটারে দিস সাথে। আজ নিজেরটা নিয়ে ঘুরে আসি। গুড নাইট।ʼʼ
গাড়ি চলছে। যেন ঘোড়া ছুটেছে। অন্তূর পরাণ যায় যায়। মনে হচ্ছিল রকেট ছুটেছে। অন্তূর চুলগুলো পতাকার মতো উড়ছিল, অন্তূ চিৎকার করল, “এত জোরে কোনো মানুষ গাড়ি চালায়? আমি নিশ্চিত, এই গুণের জন্যও মাঝেমধ্যে আপনার শরীরের ফাল্লা উড়ে যায়। আস্তে চালান বলছি, অথবা এক্ষুনি এই মাঝ রাস্তায় নেমে যাব। পাগল লোক।ʼʼ
জয় গা কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠল। গাড়ির বেগ আরও বাড়াল, অন্তূ বিতৃষ্ণায় আর কথা বলল না। জয় গাড়ির বেগের সাথে মিলিয়ে গান ধরল, ‘ওই ঝলমলে রোদ আকাশে, তুমি-আমি উড়ি বাতাসে….ʼʼ
অন্তূ কপালে হাত চেপে বসে রইল। অন্ধকার আকাশ, যেখানে চাঁদ অবধি নেই। এইরকম এক মাঝরাতে এমন ঝলমলে সূর্যের গান কেউ ভাবতে পারে? তাও আবার কী এক উদ্ভট গান! গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছে আর শিষ দিচ্ছে। খানিক পর স্পীড কমল। অন্তূ একটা কথাও বলল না। ও কমাতে বলেছিল বলে আরও বাড়িয়েছিল স্পীড।
এবার স্পীড স্বাভাবিক রেখে গলা ছাড়ল জয়,
এই ভাঙাচোরা বুক নিয়ে, অবাধ্য অসুখ নিয়ে
স্বপ্নে রাখা মুখ চলেছে খুঁজে…..
কুয়াশা-ধোঁয়াশা ভরা রাস্তাতে,
নেমেছে বাজপাখি খালিহাতে….
কানামাছি খেলে যায়, কার সাথে মুখ বুজে
দুই পৃথিবী…. কীসের চাহিদায় ঘরছাড়া…
দুই পৃথিবী-ইইই..কোন চাওয়া-পাওয়ায় দিশেহারা…
গা শিউরে ওঠা জয়ের গলার সেই টান। শনশনে বাতাসের সাথে দিগ্বিদিক বাজিয়ে ছুটে চলল। গাড়ি চলছে। গরমের রাতে চলন্ত শীতল বাতাস বেশ লাগছিল গায়ে। অন্তূ চারপাশের ঘন অন্ধকারে হারিয়ে যেতে চায়। পাশে বসে আছে স্বয়ং এক প্রেহেলিকা-পাপ। অনবরত শিষ দিচ্ছে আর গাড়ি চালাচ্ছে। কখনও কখনও স্টিয়ারিংয়ে আঙুল বাজিয়ে গুণগুণ করছে।
একসময় একদম নির্জন গ্রামের দিকে চলে এলো। অন্ধকার রাস্তা, দূর-দূরান্ত অবধি আলো নেই। জয় গাড়ি থামাল, “নাঃ, বউ! আর পারছি না। স্যরি। রাত হলে আমার শরীরে সংগ্রামের আগুন জ্বলে। তাকে নেভাতে মাল ঢালতেই হবে পেটে।ʼʼ
পেছনের সিট থেকে মদের বোতল তুলে শব্দ করে কর্ক খুলল। তারপর একহাতে যতটুকু চালানো যায়, ততটুকু গাড়ি চালিয়ে আরেকহাতে বোতল মুখে ঠেকিয়ে গিলতে লাগল। উৎকট গন্ধ নাকে লাগছিল।
মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে লোকটা, এই নির্জন রাত, তার ওপর গাড়ি চলছে ধীরে। যেকোনো বিপদ হতে পারে। অন্তূর ভয় লাগছিল খুব। নিজের বোকামির ওপর ধিক্কার আসছিল। সে কী ভেবে জয়ের সাথে আসতে রাজী হলো, সেটাই বুঝতে পারছিল না। এই লোক আসলেই অযথা ঘুরতে বেরিয়েছে, ফূর্তি করতে বেরিয়েছে।
অন্তূ খানিকক্ষণ চুপ থেকে আর পারল না, কড়া স্বরে বলল, “বোতলটা কেঁড়ে নিয়ে আপনার মাথায় ভাঙি, তার আগে গেলা বন্ধ করুন। বেহেড হয়ে যাবেন যখন-তখন, সেই অবস্থায় একটা দুর্ঘটনা ঘটাতে চান?ʼʼ
-“আমার বেহেড হওয়া এত সস্তা না, ঘরওয়ালি।ʼʼ কেমন মাতাল মাতাল জড়ানো কণ্ঠে বলল, “আজ তোমাকে খুব আদর করতে মন চাচ্ছে, বুঝলে? ইভেন রাইট নাও। গাড়ির ভেতর বউয়ের আদর, আহঃ! ভাবা যায়?ʼʼ
বলেই মদের বোতলটা সিটের ওপর রেখে অন্তূর দিকে হাত বাড়াল। বোতলের তরল গড়িয়ে পড়ে পুরো গাড়িতে বিশ্রী গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। অন্তূ ঝারা মেরে জয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে চিবিয়ে বলে, “আপনি বেহেড হয়ে যাচ্ছেন। আমি এই রাস্তায় অন্তত আপনার জুলুম মেনে নেব না।ʼʼ
-“না নিলে। তাতে আমার কী?ʼʼ
আবার হাত বাড়াল। অন্তূর চোয়ালে আঙুল বোলালো। অন্তূ চুপ করে বসে থাকে। ওকে জ্বালানোই মূল উদ্দেশ্য জয়ের আপাতত। কাজ পাচ্ছে না কোনো।
রাত দুটো বাজল গন্তব্যে পৌঁছাতে। বিশাল গাঙ। চাঁদহীন আকাশের নিচে অত বড় গাঙ রহস্য ছড়াচ্ছিল। আশপাশ শ্মশান। তখনই জয় নামল, “পাশেই একটা শ্মশান আছে। যাবে?ʼʼ
অন্তূ ভ্রু কুঁচকাল। একদম স্বাভাবিকভাবে নামল জয়। ওর মনের কথা বুঝল যেন, “কী ভাবছো? বললাম তো, আমি সহজে বেহেড হইনা। ওই শালা মালও জোচ্চর। ট্যাকা দিয়ে কিনে খাই, অথচ মাতাল করেনা আমায়। শ্মশানে যাবে তো চলো ঘুরে আসি।ʼʼ
-“কেন যাব? আপনাকে দাফন করতে?ʼʼ
জয় খুব কাছে এসে দাঁড়াল, ফিসফিস করে বলল, “শশ্মানে মরা পোড়ায়, দাফন করে কবরে। মদ খেলাম আমি, মাথা গুলিয়ে গেছে তোমার? সব ঠিকঠাক তো, ঘরওয়ালি?ʼʼ
বিশ্রী গন্ধ জয়ের শরীরে। শার্ট ভিজে গেছে মদে। অন্তূ ধাক্কা দিলো, “সরে দাঁড়ান। এই, আপনার গাড়িতে ডিও নেই? থাকলে স্প্রে করে আসুন। আপনার মতো খাটাশের সাথে হাঁটতে পারব না। দুর্গন্ধ।ʼʼ
এক চড়ে দাঁত ফেলে দেব, “শালি। তোমার বাপেরা আশেপাশেই লুকিয়ে আছে হয়ত। তুলে দিয়ে আসব?ʼʼ
-“চলুন, তুলে দিয়ে আসুন। আপনিও যা ওরাও তাই। খালি পার্থক্য হলো, আপনার একটা তথাকথিত হালাল পরিচয় আছে, ওদের নেই।ʼʼ
জয় অন্তূর হাত মুচড়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে এলো। হাঁটতে খারাপ লাগছিল না। পরিবেশটা ভয়ানক সুন্দর। অন্ধকারে গাঙের পানি কালো দেখাচ্ছে, গাছগুলো যেন কাঁচা রাস্তার দুধারে জীবিত সব, সারি ধরে দাঁড়িয়ে।
ওরা ক্ষেতের মাঝ দিয়ে হাঁটছিল। দুপাশে ধানের ক্ষেত। অনেকক্ষণ পর অল্প পকেট থেকে ছোট্ট একটা বডিস্প্রে বের করে শরীরে লাগালো জয়। তারপর আবার চলতি পথেই হিপফ্ল্যাস্কে চুমুক দিচ্ছিল।
অন্তূ একবারও জিজ্ঞেস করেনি, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জয় ওকে। নিঃশব্দে হেসে জিজ্ঞেস করল, “ঘরওয়ালি, একবারও তো জানতে চাইলে না, কোথায় নিয়ে যাচ্ছি!ʼʼ
অন্তূ হাসল, “এই জগতে আমার হারানোর মতো কিছু নেই, সুতরাং পিছুটান নেই। আছে জানটা। অথচ পিছুটান না থাকলে জান হারানোর স্বাভাবিক ভয়টা থাকেনা মানুষের।ʼʼ
জয়ের মনে হলো, সে আবারও নিজের গুণগুলো তার ঘরের বিরোধীর বৈশিষ্ট্যে খুঁজে পেল। বেসিক ফিচার সব জয়ের, আর মিলেও যায় সবগুলো।
অন্তূ বলে চলে, “আর কী ক্ষতি করতে পারেন আপনি আমার?ʼʼ
-“তোমার আমাকে ভয় লাগেনা?ʼʼ গম্ভীর হলো জয়।
-“না। লাগেনা। আগে লাগতো, বিয়ের আগে। পরে আর লাগেনা।ʼʼ
অন্তূ ভালোভাবে দেখল, সে কখনও কাঠের বাড়ি দেখেনি। দাঁড়িয়ে আছে, তেমন একটা বাড়ির সামনে। একটা বাগান বাড়ি। অন্তূ মনে হলো, এটাই কি ‘আমির নিবাসʼ?
চারপাশে মাঠ। প্রাচীরের ভেতরের বাগানটা বড়। সেখানে শুধু গাছ আর গাছ। পেছনে অল্প কিছুটা মাঠ, তারপর বয়ে গেছে গাঙটা। অন্ধকারে অদ্ভুত লাগছিল গোটা পরিবেশটা। জয়কে জিজ্ঞেস করল, “এটা কি আপনাদের বাড়ি?ʼʼ
-“না। আমার বাপ-দাদারে কি পাগলে থাপাইছিল যে এইরকম ঝোড়জাতার মধ্যে বাড়ি করতে আসছিল? এসো। প্রাচীর টপকাতে হবে।ʼʼ
-“আশ্চর্য! আমরা কি চুরি করতে যাচ্ছি? যাব না আমি দরকা, পড়লে, তবউ প্রাচীর টপকাতে পারব না।ʼʼ
-“থাপ্পর মারি একটা? সময় নষ্ট না করে যা বলতেছি সেইটা করো। আমি উঠায়ে দিচ্ছি।ʼʼ
অন্তূ গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, “আমি প্রাচীর টপকাতে পারব না। আমি এমন একটা প্রয়োজন দেখছি না যে এখানে ঢুকতেই হবে।ʼʼ
-“মাগী মানুষ এত ত্যাড়া! শালীর মেয়ে, সবসময় ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিতে খাতা রেডিই রাখে।ʼʼ
জয় এক লাফে প্রাচীর টপকে ফেলল। সেই শব্দেই পাহারাদার সতর্ক হলো। এরপর যেই গেইট খুলতে গেল, ওমনি রাইফেল হাতে দাড়োয়ান উঠে দাঁড়াল, “এই শালা কেডা রে, থাম, শালা মাগীর চেংরা। বুক ঝাজরা কইরা দিমু একদম।ʼʼ
হামজা লোক নিযুক্ত করেছে, তা জানতো জয়। তবে সেই লোক যে জয়কেও চেনেনা ঠিকমতো, এ তো মুশকিল! জয় বোঝানোর চেষ্টা করল, “বসির ভাই, আমি…ʼʼ
লোকটা বিনা নোটিশে চট করে গুলি চালালো। শর্টরেঞ্জের ডাবল-বুলেট রাইফেল, দূরত্ব বড়জোর এক গজও না, বুলেট একটু ছুঁয়ে গেলেও জয় আমিরের মৃত্যু নিশ্চিত। গুলি সে তাক করল জয় আমিরের বুকের বাঁ পাশটা।লোকটা ভুল যেটা করল, গুলি ছোঁড়ার আগে রি-লোড করল একবার, এবং শব্দটা কানে যেতেই জয় নিচু হলো।
গুলিটা লাগেনি দেখে বসির আবার গুলি চালাতে প্রস্তুত, জয় বকে উঠল, “রাইফেলটা তোর শাউয়ার মধ্যে ভরে দিই, শালা খানকির বাচ্চা।ʼʼ
কাউকে ভেতরে যেতে দেবার অনুমতি নেই। সে কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পআলন করে হামজার মনোযোগ আয় করতে চায়। দ্বিতীয় গুলিটা চালালো বসির। অন্ধকারে নিশানাচ্যুত হয়ে গেল। জয় প্লেস-ক্রস করে এগিয়ে এসে হাতটা চেপে ধরল বসিরের, “ভ্যাড়াচ্চুদা, তোর মাইরে…..শালা গুলি চালাবা, দেখেশুনে চালাও সম্বন্ধির চেংরা। তোর আব্বা যে দাঁড়ায়ে আছি, হুশ করে ফায়ার করবি তো।ʼʼ
রাইফেলটা কেঁড়ে নিয়ে লোকটাকে মাটিতে ফেলে মুখের ওপর পায়ের হাই-বুটটা চেপে ধরল। স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে বসিরের মুখটা গেঁড়ে যাচ্ছিল, গা ছমছমে ভোঁতা গোঙানির আওয়াজ করছে বসির, দম আঁটকে আসছে। জয় তবু পা তুলল না। অনেকক্ষণ মাটিতে মাথাটা চেপে ধরে রইল জুতো দিয়ে। আনুমানিক মরার অল্প আগে ছেড়ে দিলো। উবু হয়ে বসে বলল, “আমি, জয়। জয় আমির। এরপর ফায়ার না শুনে তারপর করবি, শালা নোটকির পুত!ʼʼ
লোকটা উঠে দাঁড়াতে পারল না, তবু এবার হাত উঁচিয়ে সালাম ঠুকতে চেষ্টা করল। জয় চাবিটা নিয়ে গেইটটা খুলে দিলো। অন্তূ দৌঁড়ে ভেতরে ঢোকে, “কী হয়েছে আবার ভেতরে? গুলি চলল যে। বেঁচে আছেন?ʼʼ
জয় আলগোছে হাসে, “মরিনি এখনও।ʼʼ
অন্তূ বলল, “তাহলেই হলো। আমার আবার ফিরতে হবে এখান থেকে, একা তো যেতেও পারব না আপনি ছাড়া।ʼʼ
জয় হো হো করে হেসে উঠল। অন্তূ হাত ধরে কাঁদা পার করিয়ে গেইট আঁটকে ভেতরে এগিয়ে গেল।
দরজায় কড়া নাড়ল। দরজা খুলল মিনিট দুয়েক পরে। অন্তূ অবাক হয়ে যায়। রূপকথা মিষ্টি হেসে অন্তূর হাত ধরে, “কেমন আছো, মিষ্টি মেয়ে।ʼʼ
জয় বুট পরেই ভেতরে ঢুকছিল, রূপকথা চেঁচালো, “খবরদার কাঁদা পায়ে ঢুকবে না, জয়। জুতো খোলো।ʼʼ
জয় সারেন্ডার করার মতো দু হাত উঁচু করে জুতো খুলল।
বাড়ির ভেতরটা আলো-আঁধার। অন্তূ সেই আধারে দেখে কেউ সোফায় বসে আছে। সেন্টার টেবিলের ওপর ল্যাপটপ। সে তাতেই কিছু কাজ করছে। এবং ল্যাপটপের আলোয় মুখটা অর্ধেক দেখা যাচ্ছিল। পরাগ আজগর না! হ্যাঁ তাই তো। সে আর রূপকথা এখানে কী করছে? জায়গাটাই বা কোথায়?
চলবে..
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন]
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৫৯.
বিছানায় শুয়ে অল্প একটু চোখ লেগে গেছিল হামজার। আচমকা জেগে উঠল। রিমি বিছানার এককোণে জানালার ধারে বসে আছে। হু হু করে এসির ঠান্ডা বাতাস আসছে, তবু জানালার কাঁচ খুলে রেখেছে। আন্দাজ করা যায়, রাত প্রায় শেষ। আজকাল রাতটা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়েছে। তবে কোনো ভাগেই ঘুমের সুযোগ নেই।
হামজা এদিক-ওদিক তাকাল। গলাটা ঘেমে ভিজে গেছে। ফতোয়াটা চিটচিট করছে। এসির হাওয়া বেরিয়ে যাচ্ছে বাইরে। আনমনে বসে থাকা রিমিকে আঁধারে অদ্ভুত লাগছিল। হামজার কপালে চিরবির করে উঠল। ঘুমের প্রচণ্ড ঘাটতি পড়ে গেছে কিছুদিন। উঠে বসতেই প্রথমত জয়ের চিন্তা মাথায় এলো। পাগলটা কী করছে, কে জানে!
রিমি জানালা থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলল, “উঠলেন কেন? কিছু চাই?ʼʼ
-“তুমি ঘুমাবে না?ʼʼ
-“ঘুম আসছে না।ʼʼ
-“এভাবে শরীর খারাপ করতে চাও?
রিমি কিছুটা সময় নিয়ে বলল, “গতকাল আব্বু কল করেছিল।ʼʼ
-“তোমার চাচার লাশ তো এখনও মর্গে, বাড়িতে আনলে নিয়ে যাব, দেখে আসবে।ʼʼ
-“যেতে চাইনি তো।ʼʼ
-“তাতে কী? কাকা তো! দেখতে যাবেনা শেষবার?ʼʼ
রিমি স্লান হাসল, তা কেমন যেন দেখালো। উদাস স্বরে বলল, “আপনার মস্তিষ্ক এত ধারালো আর জটিল, হামজা!ʼʼ
-“হঠাৎ একথা!ʼʼ
-“এখনকার কথাই চিন্তা করুন না! আমি শুধু বললাম, আব্বু কল করেছিল। ব্যাস, গোটা কাহিনিটা মুখস্ত পড়ার মতো বুঝে তার উপস্থিত জবাব দিয়ে দিলেন। ঠিক যেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।ʼʼ
হামজা হাসে, “বোকা বেগম! আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সটাও স্বয়ং মানুষের বুদ্ধিমত্তার সামান্য অংশ মাত্র।ʼʼ
রিমি চমকালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আনমনে বলল, “আপনাকে আমার আজকাল ভীষণ ভয় করে।ʼʼ
-“বুঝি। তবে তার যুক্তি নেই।ʼʼ
ফিরে তাকায় রিমি, “নেই?ʼʼ
-“আমি তোমার জন্য ভয়ংকর না।….নারীদেরকে আমার ভয়ও নেই, ভরসাও নেই। আমি বিশ্বাস করি, নারী মমতময়ীর জাত। ওদেরকে আদর ও মমতায় ভিজিয়ে থামাতে হয়, অথবা কৌশলে। যতক্ষণ না তারা নিজের গণ্ডি পেরিয়ে পুরুষের কাজে বাগড়া দিতে আসে। তবু যথাসম্ভব খোলাখুলি জখম করতে নেই।ʼʼ
-“করলে কী?ʼʼ
-“ওরা কুচক্রী হয়ে ওঠে। আর একজন কুচক্রী নারী যদি কোনো ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে, সারা দুনিয়া একাকার হয়েও তার সমাধান দিতে পারে না।ʼʼ
রিমির মনে হলো, তার নিখুঁত উদাহরণ যেন আরমিণ। এই লোক পারিপাশ্বিকতা সব বোঝে, তবু অনড়। অন্ধকারেই হামজার ভরাট, বলিষ্ঠ, বুদ্ধিদীপ্ত মুখটার দিকে চেয়ে রইল। এরপর জিজ্ঞেস করল, “আমি বুঝিনা কেন আপনাকে একটুও? আপনি আসলে কোনদিকে এগোচ্ছেন?ʼʼ
-“আমি দিক ঠিক করি চলতি পথে। যখন চলতে শুরু করেছিলাম তখন কোনো গন্তব্য বা পথ ঠিক করে রাখিনি। শুধু একটা পণ করেছিলাম, এ পথচলা মৃত্যুর রোধ ছাড়া থামাবো না। মাঝপথে যা পেয়েছি, সব কুড়িয়ে নিয়েছি। এখনও ঠিক সেইভাবেই চলছি। সামনে যা পাবো, তা হাতভরে কুড়িয়ে নেব। থামবো কোথায়, তা অজানা।ʼʼ
-“সামনে রাস্তা বন্ধও তো থাকতে পারে!ʼʼ
তার বউ বুদ্ধিমতী হয়ে উঠছে। হামজা আওয়াজহীন হাসে, “কেউ একজন বলেছিলেন— যতদূর রাস্তা দেখা যায়, ততদূর অন্তত এগিয়ে যাও, পরের পথ সামনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পেয়ে যাবে। মানুষ অভিযোজনসম্পন্ন প্রাণী। পরিবেশ যা-ই হোক, তারা মানিয়ে নিয়ে বাঁচতে জানে।ʼʼ
রিমোট তুলে এসিটা অফ করে দিলো। জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। শেষরাতে ঘর ঠান্ডা হয় এমনিই।
রিমি জানালার দিকে পিঠ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। কেমন ভঙ্গুর স্বরে বলে, “হামজা, আপনি কি জানেন, আমি আপনার এক অপূরণীয় রকমের ক্ষতি করেছি? এবং সেটা ছিল আপনার শাস্তি!ʼʼ
হামজা ভ্রু জড়ায়, “শাস্তি?ʼʼ
-“বিশাল শাস্তি।ʼʼ
হামজা দাড়িতে হাত বুলায়। রিমি অদ্ভুতভাবে হাসে, “আপনার দুটো নিষ্পাপ সন্তান খেয়েছি আমি। যদিও আমি জানিনা, পাপী বাপের সন্তানেরা নিষ্পাপ হয় কিনা!ʼʼ শেষের দিকে নারীকণ্ঠটা কেঁপে ওঠে রিমির।
হামজা নিথর হয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। তাকে থমকাতে, চমকাতে দেয়া যায়না। আজ যেন বিমূঢ় হয়ে গেছে।
বেশ খানিক পর হামজা গা ঝারা মেরে রিমির কাছে এসে দুই বাহু চেপে ধরল, গলার স্বর বর্বর হয়ে উঠল, “কী করেছ, তুমি?ʼʼ
রিমি ফুঁসে ওঠে, “আমি আপনাকে পুরুষত্বহীন করে দিয়েছি। একবার নয় দু’বার। শুনেছি, পুরুষ পরিপূর্ণ হয় তার শৌর্য-সন্তান দ্বারা! আমি আপনাকে তা থেকে বঞ্চিত করেছি। কারণ যে অন্যের সন্তানের প্রতি সামান্য মানুষিকতাবোধ রাখেনা, তার নিজের বাপ হবার অধিকার নেই। আমার তো এইটুকু ভরসাও নেই আজ আপনার ওপর, যে আপনি ক্ষমতার লড়াইয়ে আপনার নিজের সন্তানকেও কোথাও বাজি রেখে ঘরে ফেরেন….ʼʼ কথা শেষ করতে পারেনা রিমি, হিঁচকি উঠে গেল গলার কাঁপুনিতে।
হামজার নিঃশ্বাসের আওয়াজ হিংস্র হয়ে উঠছিল। হতবাক হয়ে গেল সে। এ কাকে দেখছে সে? এটা তার রিমি নয়। কার আছড় লেগেছে তার নমনীয়, বোকা রিমির গায়ে! ক্ষিপ্র শ্বাসগুলো বিক্ষিপ্ত স্রোতের মতো আঁছড়ে পড়ছিল রিমির ওপর। বুকের ওঠানামা বেড়ে গিয়েছিল নিঠুর-মানবটার।
রিমি ভেজা চোখেও তা দেখে এক প্রকার জিতে যাওয়ার সুখ ভেসে উঠেছিল। সে পেরেছে, সে একটু হলেও পেরেছে তার ঘরের দুর্যোধনের অশান্তির কারণ হতে। অথচ সে একসময় লোকটাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিল, আজকের কথা বলতে পারেনা। আজ তার অনুভূতিরা হামজার ওপর আজব রঙে রঙচটা।
হামজা ঝাঁকি মারল রিমিকে ধরে, “দুটো সন্তান এসেছিল তোমার পেটে? আমার সন্তান….দুটো সন্তান!ʼʼ হামজা দু হাতে মুখ ঢেকে অস্থির হয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে।
রিমি চাপা ক্ষোপে ফুঁসে উঠল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। আর তাদের আমি খুন করেছি।ʼʼ এরপর ঝরঝর করে কেঁদে উঠল তার মাতৃচিত্ত, “এই দুই হাতে ধ্বংস করে দিয়েছি তাদের। তারা জানুক, আপনার মতো একটা নিষ্ঠুর বাপই নয় শুধু, একটা নিষ্ঠুর মা-ও আছে তাদের।ʼʼ
হামজার সৌম্য-শ্যাম শরীরটা ভিজে উঠেছে। একটানে ফতোয়াটা খুলে ফেলল। সুস্থির পুরুষটির মাঝে অস্থিরতা বড্ড বেমানান। যে লোকটা নিকটাত্মীয়দের মৃত্যুতে অনড়, পাথুরে, সেই লোকটা যখন ছোট্ট রিমির এক বিমূর্ত নিষ্ঠুরতায় এমন পাগলপারা হয়ে ভঙ্গুর হলো, রিমির কাছে ভীষণ আজব লাগছিল। সে মুখে দু হাত চেপে হু হু করে কেঁদে উঠল। প্রতিটা ক্ষণে তার নারীহৃদয়ে ক্ষরণ চলে, প্রতি মুহুর্তে সে জলন্ত চিতায় দগ্ধ হয়! এত উৎপীড়ন, হুট করেই যেন নাজিল হয়েছে তার জীবনে, আর পথ দেখানোর জন্য আরমিণ। ভুল-সঠিক জানেনা, শুধু রিমি জানে, আরমিণ বিশেষ-অ-বিশেষ এক চরিত্র, যাকে এড়ানো যায়না।
আরমিণের প্রতি অদম্য ঝোঁক অনুভূত হচ্ছিল। ওই মেয়েটার প্রতিটা কথা অব্যর্থ তীর। আরমিণ বলেছিল, ‘রিমি! আপনি দেখবেন, এই সমাজের ক্ষমতাসীনেরা একই ঘটনার পেক্ষিতে নিজের ও সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে রাত ও দিনের মতো দুই রকম ধর্মের খেলা দেখাবে। রাজার ছেলে লাউ চুরি করলে হাত কাটার বিধান নেই, রিমি।ʼʼ
এই হামজা ও জয় প্রতিক্ষণে তা-ই তো দেখায়। রিমি অবাক হয়। সে রাজনৈতিক পরিবারে জন্মেও কখনও মানুষ ও সমাজের গঠনগত দিক নিয়ে এমন ভাবনায় অবতীর্ণ হতে পারেনি, যেসব আরমিণ ভাবে ও করে। সতরাং ক্ষেত্র মানুষের জীবনধারা ঠিক করেনা, মানুষের নিজস্বতা বরং একেকটা ক্ষেত্রকে বেছে নেয়।
—
জয় পরাগকে বলেছিল, “উনাকে নিয়ে বাইর হয়ে যান, আপনি।ʼʼ
রূপকথা দৃঢ় স্বরে বলে উঠল, “আমি কোথাও যাব না, জয়। তুমি আমাকে ঠিক কতটা দূর্বল ভাবো?ʼʼ
জয় জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করল না। মহিলা মানুষকে লাই দেবারও নয় আবার তাদের সামনে বাহাদুরী দেখানোরও নয়। এমনিতেই ওরা পুরুষের অধীনস্থ, দূর্বল, অবলা। তাদের ওপর বাহাদুরী দেখানো অথবা মূল্যায়ন করা, দুটোই ছোটলোকি ব্যাপার-স্যাপার জয়ের কাছে।
অন্তূ অন্তত মুস্তাকিনের পরাগ হয়ে যাবার বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন করেনি, তাতে জয় অবাক হলো। রূপকথা জেদ ধরে বসে থাকে, “আমি কোথাও যাব না। কী করবে, তুমি?ʼʼ
-“আসলে আপনি থাকলে আমি আমার কাজে সামান্য অপ্রস্তুতবোধ করতে পারি। মেয়েলোক, তার উপর..ʼʼ
-“কী? বলো! মেয়েলোক…?ʼʼ তাচ্ছিল্য হাসে রূপকথা, “নারী বিদ্বেষ বা অবমাননা যায়নি এখনও। অন্তূ, তুমি কী করলে এতগুলো দিনে? ওর ভেতরে এখনও পৌরুষ অহংকার ভরপুর দেখছি।ʼʼ
-“কথা না বাড়াই, কথা আপা। পরাগের সাথে চলে যান।ʼʼ
-“যাব না আমি। বলেছি তো। আর কোথায় যেতে বলছো?ʼʼ
জয়ের চোখেমুখে নিদারুণ গাম্ভীর্য। সোফাতে বসে টাখনুর কাছের প্যান্ট ঠিক করছে অকারণে।
ঢোকার পর মুচকি হেসে পরাগ একবার অন্তূকে জিজ্ঞেস করেছিল, “ভালো আছেন, ম্যাডাম?ʼʼ
অন্তূ বিনিময়ে কেবল অতি-সামান্য হেসেছিল। সে বুঝছে, জয়ের মতো ধূর্ত শেয়াল অকারণে এমন একটা জায়গায় আসার লোক নয়।
জয় খানিক বাদে আচমকাই হাসল, কেমন অপার্থিব ভয়ানক সেই হাসি রূপকথাকে বলল, “যান। দেখা করে আসুন একবার।ʼʼ
কাঠের এই বিদেশী গড়নের বাড়িটা রাজন আজগর পলাশকে উপহার দিয়েছিলেন। বাগান বাড়ি অবসর কাটানোর জন্য ভালো। চমকপ্রদ সুন্দর বাড়ির ভেতর-বাহিরের পরিবেশ।
বেসমেন্টের দরজা ঠেলে রূপকথা ভেতরে ঢোকে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কারও রুদ্ধশ্বাসের ভোঁতা আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আলো জ্বালায় রূপকথা।
মেঝেতে পড়ে আছে পলাশ। ডান পায়ে শিকল আঁটকানো। সেটা না থাকলেও ছোটার ক্ষমতা নেই। শরীরে ড্রাগের মাত্রা অত্যাধিক। দুটো দিন মেলাটোনিন পুশ করা হয়নি। অর্থাৎ পলাশ ঘুমায়ওনি দু’দিন। প্রায় মরণ সমান তা। তার একাধিক মানসিক রোগের মাঝে তীব্র ঘুমহীনতা একটা।
ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, মৃত্যুর পর একবার নরকবাস করে আবার পৃথিবীতে ফিরেছে।
ফর্সা দেহটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, যেন দেহের র/ক্ত সবটুকু বের করে নেয়া হয়েছে কোনো চোষক দিয়ে। চোখের মণিতে রক্ত জমাট বেঁধেছে দানা হয়ে। শুধু হালকা আলোতে চোখের মণিটা জ্বলজ্বল করছিল। হাতের বিভিন্ন স্থানে ফুটো, এবরোথেবরো ইঞ্জেকশন পুশড হয়েছে। তবু যেন কৈ মাছের জান। এ অবধি যে সাঁজাটুকু পলাশ পেয়েছে, যে কারও সাধ্যি নেই তা সহ্য করে বেঁচে থাকার।
—
দু’দিন আগে পলাশকে ধরে আনা হয়েছে এখানে। ক্রস ফায়ারের অর্ডার ছিল। পলাশসহ ওর দলের আঠারো জন অথবা বেশি এখনও দেশেই এবং তাদের মাঝে কমপক্ষে পনেরোজন সশস্ত্র দিনাজপুরে অবস্থান করছিল। সরাসরি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন টিম রাজধানী থেকে নাজিল হয়েছিল পলাশের খাতির করতে।
বছরের পর বছর ধরে রাজন আজগর দেশের টেরোরিজমে বহুত অবদান রেখেছেন। তার রাখা অবদানে মানি-লন্ডারিং তার মাঝে অন্যতম।
কঠিন এক অপরাধ। যদিও এটা গোটা বাংলার সর্বত্র ও সর্বোচ্চ প্রচলিত অপরাধ। তাই এটাকে অপরাধ না বলা ভালো। কারণ মানি-লন্ডারিং কার্যক্রমটা আম জনতার দ্বারা সাধারণত ঘটে না। এটা ঘটে দেশের উচ্চাসনে বসে থাকা তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা অথবা তাদের সাপোর্টে থাকা ক্রিমিনালদের মদদে। যাদেরকে রাজনীতিবিদ বলা হয়, জনসেবক ও উন্নয়নের কর্ণধারও বলা হয়। তারা কিছু করলে নিশ্চয়ই জনগণের ভালোর জন্যই করেন! দেশের অর্থ-সম্পদ চুষে নিয়ে গিয়ে বিদেশি ব্যাংকের লকার ভর্তি করাটা নিশ্চয়ই এক প্রকার দেশসেবাই! হোক সেটা নিজের দেশের পেছন মেরে অন্যদেশের অর্থব্যবস্থাকে সাপোর্ট করা।
এই অর্থ চোরাচালানের কাজে রাজনীতিবিদ ও সন্ত্রাসগোষ্ঠী একে অপরের তালা-চাবি। একটা ছাড়া আরেকটা অচল। সন্ত্রাসরা সাধারণত পুঁজিবাদের নামে বিশাল ব্যবসার মতো দেখতে একটা ক্ষেত্রে তৈরি করে, তার মাধ্যমে দেশের বাইরে একদম নিরাপদ উপায়ে অর্থ চালান করার সুগম সুযোগ করে দেন দেশের সম্মানিত উচ্চশ্রেণীর জনপ্রতিনিধিগণ। অথচ এই অর্থ আসছে কোত্থেকে এবং মূলখাত কোথায়, তা জানার উপায় থাকেনা হাত বদল হতে হতে। সর্বশেষে যে হাত থেকে অর্থ হস্তান্তর হয়, তা দেখে লাগে অর্থ পুরোটাই বৈধ, এক লিগ্যাল বিজনেস-ইন্টারেস্ট টাইপ কিছু। অপরাধ কোথায় এই অর্থে?
মূলত পলাশের মাধ্যমে চালান করা অর্থগুলোর অধিকাংশ ছিল দেশের জনপ্রতিনিধিদের দেশ শোষিত মাল। ভদ্র ভাষায়–রাজনৈতিক দুর্নীতির মুনাফা। সেটার একটা দৃশ্যমান খাত ছিল রাজন আজগরের বিশাল কারবার— মাদক, পতিতাবৃত্তি, চাঁদাবাজি, সম্পত্তি নিলাম, পাচার,
খু/ন, জুয়া ইত্যাদি।
পলাশ দিনাজপুরে একজন টাটকা চাঁদাবাজ, সুদখোর। তাদের মূল কারবার রাজধানীতে। বিভিন্ন স্থানে আবাসিক হোটেল, ক্যাসিনো, জাল টাকা, নারীব্যবসা প্রভৃতির ধান্দা সব রাজধানীতে চলে।
প্রথমত ২০০২-এ দেশ থেকে প্রায় সন্ত্রাসবাদ নিপাত হয়েই গেছিল ‘অপারেশন ক্লিনহার্টেʼর বদৌলতে। এর কিছুকাল পর রাজধানীতে ঢাকার সর্দার ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক জুলফিকার সর্দারের নাতির হাতে পলাশের বাবা খুন হলো। পলাশের কিছু করার থাকল না। মূলত তখনই পলাশ ভার্সিটির পড়া ছেড়ে পুরোদমে অন্ধকার রাজনীতি ও কাকার কারবারে মনোনিবেশ করে। কিন্তু সর্দারের নাতির কাছে ঘেঁষার মতো শক্তি হয়ে উঠল না তার। তারপর সবকিছু দমে গেছিল। এবং কী থেক কী হলো, সর্দারের নাতি— অ্যাসট্ররয়েডটা কোথাও গুম হয়ে গেল যেন। তার সন্ত্রাসীর ধারা ছিল কেমন যেন। নিজে এক মাফিয়া ও পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী। অথচ তার হাতে অসংখ্যা পলাশেরা ঝলসে মাটি হয়ে গেছে। সেই এক মহাপ্রলয়ের নাম ছিল–রুদ্র ইয়াজিদ।
এরপর যখন ২০০৮-এর নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের মহাজোট দেশের ক্ষমতায় এলো, রাজন আজগর ও পলাশ নতুন উদ্যোগ ও উদ্যমে জেগে বসল। হামজা তখন উঠতি রাজনীতিবিদ। ভার্সিটি, যুবসমাজ ও ছাত্র সংগঠন তার অধীনস্থ প্রায়। তখন তার উঠাবসা শুরু হলত উচ্চশ্রেণীর রাজনীতিবিদদের সঙ্গে। পলাশ ও রাজন হামজাকে হাতে করল, হামজাও পলাশকে সঙ্গ দিলো নিজের স্বার্থে। জয় আমির তখন একুশ বছরের তরতরে যুবক, অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র; তার কলেজ-জীবন শেষ হয়ে ত্রাসের পথের যাত্রা শুরু হয়েছে।
এরপর রাজন আজগর যেমন রাঝধানীতে নতুন নতুন রাজনীতিবিদদের সহচর্য পেতে শুরু করলেন, কারবারেও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার খুলে পড়ল। পলাশকেও আর নিজের নামের ভীতি গড়তে বেগ পেতে হয়নি। গরীব কৃষক থেকে শুরু করে সর্বসাধারণ, মুদি ব্যবসায়ী থেকে বড় ব্যবসায়ী অথবা কেউ একটা একাধিকতলা বাড়ির পিলার গাড়লেও চাঁদার দায়ে জিম্মি হয়েছে, তার বদলে বউ থেকে শুরু করে ঘর-বাড়িসহ তাদের শেষ সম্বলটুকুও পলাশের হয়েছে।
বাংলাদেশে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন সংস্থা গঠিত হলো–২০১২-তে। সৈয়দ মুস্তাকিন মহান তখন সেই সংস্থার নতুন পিবিআই অফিসার। তার পোস্টিং ছিল ঢাকাতে। ঢাকাতে রাজন আজগরের ব্যবসায় অপরাধের তদন্ত করতে গিয়ে খুঁড়তে খুঁড়তে সেই জাঁদরেল আইন-কর্মকর্তা এলো দিনাজপুর। পলাশের এখানকার কারবারে সেটাই আইনত প্রথম বাঁধা, এবং তা ছিল মুস্তাকিনের দ্বারা। কিন্তু মুস্তাকিন মহানের এই দুঃসাহসিক কর্ম-কেই তার কাল হতে হলো। কারণ এটাই বাংলার নীতি, মূলত রাজনীতি।
মুস্তাকিন মহান কেঁচো ইতোমধ্যেই খুঁজে পেয়ে গেছিল, বহু প্রমাণ আর তথ্য একত্র করে ফেলেছিল। তাকে আর কিছুদিন খুঁড়তে দিলে সরাসরি সাপের পুরো বংশধর টেনে বের করে আনতো। সেই সুযোগ তো দেয়া যায়না। এর মাঝে সে একবার গেল কারাগারে জামায়াত শিবিরের এক বন্দি কর্মীর সঙ্গে দেখা করতে। ব্যাস, জনসেবকদের কাজ সহজ হয়ে গেল।
পিবিআই অফিসার সৈয়দ মুস্তাকিন মহান একজন সরকারী কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও সে দেশোদ্রহী মনোভাব পোষন করে। এবং দেশবিরোধী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর সাথে লেওয়াজ রয়েছে তার। সুতরাং তাকে বরখাস্ত করা হলো। বন্দিরা হলো যুদ্ধাপরাধী সব। তাদের সাথে দেখা করা অপরাধ, এবং সেই অপরাধে বরখাস্ত কর্মকর্তা সৈয়দ মুস্তাকিন মহান কাজ থামিয়ে দিলে বোধহয় বেঁচে থাকতো কিনা বলা যায়না। কিন্তু তার কার্যক্রম চলছিলই। এতে করে গোপনে তাকে সরিয়ে দেবার অর্ডার এলো। যেটা কোনও পার্টির লোক অথবা পলাশ শখের সাথে করে দিতো। অথচ তাদের শিকারকে ছিনিয়ে নিলো একদিন জয় আমির। সালটা ২০১৩-এর মাঝামাঝি। জয় আমির মুস্তাকিন মহানকে খু/ন করে ফেলল।
যখন মুমতাহিণার কেইসটাকে মিছেমিছি হ্যান্ডেল করছিল মুস্তাকিন নামধারী পরাগ আজগর, তখন তার কাছে একটা হুমকিসরূপ চিরকুট এসেছিল। ধারণা করা হয়, ওটা পাঠিয়েছিল মুরসালীন মহান অথবা ওদেরই কেউ।
—
দু’দিন আগে রাত দুটোর দিকে পলাশ ছিল তার দিনাজপুরের তিন নম্বর আবাসে। ওটা চেহেল গাজীর মাজারের অদূরে ঢাকা-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে। তিনতলা বাড়ি। ওর বাড়ির সীমানা থেকে চার ফুট দূরে পাশের দোতলা বিল্ডিংটা একটা এনজিওর অফিস। এই বাড়িতে কিছু অস্ত্র, চেইকবই, ক্যাশ টাকা নেবার উদ্দেশ্যে ওখানে যাওয়া তার। সেই রাতেই তার দক্ষিণ দিনাজপুর হয়ে হাকিমপুর দিয়ে হিলি বন্দরের ওপারে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পেরিয়ে চলে যাবার কথা ছিল। হিলি বন্দরে পলাশের ভারতীয় মাল আসে মাঝেমধ্যেই। বহু চেনাজানা লোক আছে।
কিন্তু ব্যাটেলিয়ন ফোর্স যে রেডি, এবং পলাশকে তাকে তাকে রেখেছে, তা পলাশ জানতো না তখনও। মাজহার মরার আগে জয়কে পলাশের সম্ভাব্য অবস্থান বলেছিল। কিন্তু হামজার কাছে খবর এলো, সে দেশ ছাড়ছে। বড় অঙ্কের একটা ক্যাশপাতি থাকে ওই বাড়িতে। দেশ ছাড়ার আগে ওই বাড়িতে যাওয়ার সম্ভাবনা নব্বই শতাংশ।
এটা কথায় কথায় পরাগ জেনে গেছিল। তথ্যটা সে-ই আইন-সংস্থার কাছে পৌঁছে দিয়ে সেরেছে লোক মারফতে। জয়ের মুখের বাংলা গালিও শুনতে হয়েছে এর বদলে, “অকাম ঠাপানো সারা? একটা কাম করে রেখে দিলা? তোমার তর সয়না? এতকাল বাল চেটে খাইছো, এখন আর সইতেছিল না? তোমার শ্বশুরআব্বাদের যদি বলতেই হয়, তো কি আমি বলতে পারতাম না? এবার যদি কোনোভাবে পলাশ হাতছাড়া হয়ে যায়, পুলিশ যদি ওকে ধরে ফেলে, ওর বদলে তোমার কোরবানী হবে, বিনা চাঁদে। সম্বন্ধির চেংরা আমার।ʼʼ
পরাগ খিঁচে উঠল, “কথাবার্তা সাবধানে বলবে। পলাশকে তোমার অথবা পুলিশের হাতে দেওয়ার সাথে আমার সাধ নেই, আমি শুধু চাই, ও শেষ হয়ে যাক। তুমি তোমার মতো ভাবছো, আমি আমার মতো ভেবেছি। একটু খেটে ধরো। ও এখনও ওই বাড়িতেই আছে। পারলে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়ে নাও। মনে রেখো, ও কিন্তু একা না। ওর কাকার রেখে যাওয়া চেলা এসে দিনাজপুর জুটেছে ওকে সঙ্গ দিতে। বেস্ট অফ লাক।ʼʼ
পলাশ তখন মাতাল। সবকিছু গুছিয়ে রেখে সোফায় বসল। শরীরটা আওলে গেছে। কয়দিনের হয়রানীতে যাচ্ছেতাই হাল। পরাগকে না মেরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না পলাশের। তার কানে সবই এসেছে, পরাগ কী কী করেছে। খাওয়া-পরা দিয়ে পালন করে তার সহায়তায় ধ্বংসের মুখ দেখা, আবার তাকে জীবিত রেখে ফেরারি হওয়া পলাশের সঁইছিল না। তবু এই অবস্থায় দেশের মাটি তার কাল। তাই কিছুদিন দেশের বাইরে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে পরে আবার ফেরাটাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ। সব পরিকল্পনা পাক্কা তার। কিন্তু রূপকথা! সে বাগানবাড়িতে তখনও। দশ-বারোবার কল করেছে, রূপকথা রিসিভ করেনি। পলাশের মাথায় আগুন জ্বলছিল। ইচ্ছে করছিল, পরাগকে পরে মারলেও উচিত আগে বউটাকে অন্তত মেরে রেখে যাওয়া। ঘরের বউয়ের বিপদের সময়ে এমন জোচ্চুরি সওয়া যায় না।
তখন রাত বারোটা পার। ভাবাও যায়না, আইনের বিচ্ছুগুলো এই অসময়ে হানা দিতে পারে। ওর যাত্রা শেষরাতের দিকে। আজ বন্দর, আগামী রাতে বর্ডারের ওপার।
কিন্তু তার আগেই বাড়ি ঘিরে পুলিশের সাইরেন বেজে উঠল। পলাশের বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে ভাবল, বেশি মাল খাওয়ার কারণে এমনটা হচ্ছে।
ততক্ষণে লোহার গেইটে তাণ্ডব শুরু হয়েছে। প্রাচীরের ওপরে কাঁচের টুকরো থাকায় প্রাচীর টপকানো যাচ্ছিল না। দাড়োয়ান ছুটে এলো, “পলাশ ভাই, পুলিশ আইছে, ভাই।। সামনে-পিছনে চারদিক খালি পুলিশ।ʼʼ
বাড়ির পেছনে ছোট্ট ডোবা। তার ওপারে একটা আমবাগান। সেই আমবাগানে পলাশ জুয়ার আসর বসাতো মাঝেমধ্যেই। ওখানেই রুদ্র ইয়াজিদ পলাশের বাপকে মেরে দাফন করে রেখে গিয়েছিল। হাতটা কবরের ওপর ফুলের তোড়ার মতো বিছিয়ে রেখে গিয়েছিল। সেটা দেখে টের পেয়েছিল, কবরে ওর বাপের দেহ শোয়ানো।
পলাশের বাড়ির মূল-ফটক ভেঙে কালো পোশাকের ফোর্স ঢুকলো ভেতরে। রাইফেল, পিস্তল রেডি। পলাশ অনেকটা বেহেড তখন। টলমলে পায়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে দরজাটা বাইরে থেকে আঁটকে দিলো। প্রাচীরের সাথে বাড়ির ব্যাকসাইডে আসার যে রাস্তাটা সেটাও আঁটকানো। পিছনের দরজাটা না ভাঙা অবধি অন্তত সময় পাবে পলাশ।
ছোট্ট পুলটা পেরিয়ে যাবার সময় ওপরতলা থেকে আলো পড়ল ওর ওপর। দ্রুত লুকিয়ে পড়ল ঝোপের আড়ালে। পেছনের দরজা অবধি আসতে একটু ঘুরতে হবে ওদের। বাড়ির নকশা জটিল।
কিন্তু ততক্ষণে বাহিনীর কয়েকজন সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেছে। সেখান থেকে গোটা বাড়ির বাইরে আশপাশ ও প্রাচীরের ভেতরটা চোখের আয়ত্তে। পলাশ আঁটকা পড়ে গেল প্রায়। কম-বেশি দশ-পনেরোজন বাড়ির ভেতরেই ঢুকে পড়েছে, বাইরে আরও আছে। পলাশ ঝোপ থেকে বেরোতেই তাকে উদ্দেশ্য করে ফায়ার করা হবে, এতে সন্দেহ নেই। ক্রস-ফায়ার জায়েজ হয়ে আছে ওর জন্য। ওর দলের গুলি করা লাগবেনা, শুধু পুলিশের একপাক্ষিক গুলি করে পলাশকে ঝাঝরা করেও ক্রস ফায়ারের নামে চালিয়ে দেবে। অথচ পলাশের বাহিনী কাছেকোলে ঘেঁষার সুযোগ পাচ্ছেনা আপাতত। পলাশের নিষেধ আছে।
পরিকল্পনা নম্বর-দুই ওটা। পলাশ জানতো না ঠিক কবে বা কখন, তবে এটা ঠিকই জানতো, দেশ ছাড়ার আগে একবার জীবন-মরণ ঝুঁকি পাড়ি দিতে হবে; যেহেতু তার প্রতিদ্বন্দিতা জয়-হামজার সাথে। সুতরাং পরিকল্পনা নং-২-তে আছে—যদি কোনোভাবে পলাশ গ্রেফতার হয়েও যায়; কারণ চট করে রাজন আজগরের ভাতিজা পলাশকে ক্রসে দেবে না আইনরক্ষাবাহিনী। তারা এতটা ন্যায়পরায়ন হলে তো পলাশরা জন্মাতেই পারতো না। তাই পলাশ যদি পাকে পড়ে যায়, সে কোনোভাবেই বাঁচতে চাইবেনা, বরং গ্রেফতার হতে চাইবে। জয়-হামজা যতদিন বাইরে আছে, তার জন্য কারাগারের চেয়ে নিরাপদ জায়গা নেই।
আর বাংলাদেশের কারাগার হলো সবচেয়ে বড় কারবারের জায়গা। বিচারের পর পলাশের যদি ফাঁসির আদেশও আসে, তবু সে কারাগারে নিরাপদে সময় পাবে। সুতরাং তখন বাইরে থাকা দলের লোক সরকার প্রধান অথবা বাহিনীর মূল হোতাদের মাঝে কারও সঙ্গে র্যাকেটিয়ারিং টাইপ কিছু মিছেমিছি তামাশা খাঁড়া করে, বিনিময়ে গোপনে পলাশের মুক্তি দাবী করবে। এতে পলাশ বরং আরও সরকারী কর্মকর্তাদের হেফাজতে কারামুক্তি ও আত্মগোপনের সুযোগ পাবে।
এই পরিকল্পনাকে মাথায় রেখে পলাশ বসে রইল ঝোপের মাঝে। দোতলার জানালা দিয়ে দুজন কর্মকর্তা মেশিগান তাক করে আছে। তবে গুলি চালাচ্ছেনা। চালায় অঁআ সাধারণত। এরকম একটা সাংঘাতিক অপরাধী মবস্টার যদি হাতের মুঠোয় থাকে, তাকে গুলি করার মানেই হয়না।জিজ্ঞাসাবাদ ও বিচার এবং আইনত শাস্তি এদের জন্য অবধারিত।
প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে পলাশ যখন দু’হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণ করে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে বাগানের খোলা পুলের পাশে দাঁড়াল, তখনই একদম গটগটিয়ে নেমে এলো অনেকজোড়া পা। দ্রুত দৌঁড়ে এলো পলাশকে ধরতে। পলাশ হাসছে। নির্লজ্জের মতো সেই তার চিরায়ত প্যাচপ্যাচে হাসিতে জ্বলজ্বলে চোখদুটো আরও ভয়ানকভাবে জ্বলছে। ওকে এসে চারজন ঘিরে ধরলে পলাশ কেবল দু’হাত বাড়িয়ে দেয় হাতকড়া পরতে। তখনই বিকট আওয়াজে কানে তালা লেগে গেল।
পলাশকে ঘিরে ধরা দুজন পুলিশ ধপ করে পড়ে গেল নিচে। সময় থেমে গেছে যেন। ভোঁতা হয়ে গেছে কান সকলের। তীক্ষ্ণ স্নাইপারের ফায়ারিং-সাউন্ডে। সাধারণত স্নাইপার ব্যবহার করা হয় চোরা খুনে। এমন পরিস্থিতিতে ক্রস ফায়ারিং প্রচলিত বেশি।
তিনতলার ছাদের ওপর যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের মাঝে একজন শেষ। বাকি দুজন তার দিকে ছুটে যায়। গোটা বাহিনী লণ্ড-ভণ্ড হয়ে গেল তিন অফিসারের এমন আকস্মিক মৃত্যুতে।
তাদের বসের নজরে ঠিকই পড়ল ফায়ারিং পাশের সেই এনজিওর বিল্ডিং থেকে হয়েছে। কিন্তু কোন জানালা বা ছাদ, কিছুই বোঝা গেল না। বাকি দু-তিনজন তখন পলাশকে সামলাতে এগিয়ে আসে, তখনই একাধারে পাঁ-ছয়টা আগুন লাগা ককটেলের বোতল এক যোগে ছুটে এলো প্রাচীরের ওপাশ থেকে। এমন আকস্মিক আততায়ী হামলায় গোলমাল বেঁধে গেল একটা। এরকম সশস্ত্র গোলাগুলি, সেটাও অদেখা কোনো আততায়ী দল অথবা কেউ।
পলাশের হাসি অল্প দ্বিধান্বিত হয়ে উঠল। তার দল এমন করবে না বোধহয়। তাহলে?
চলবে….
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৬০. (প্রথমাংশ)
পলাশের হাসি পাচ্ছে। দুঃখে না আনন্দে বুঝতে পারছিল না। পায়ের কাছে দুজন অফিসাদের মরদেহ পড়ে আছে।তার একটুও ইচ্ছে নেই জয়-হামজার হাতে ধরা পড়ার। এত নিখুঁতভাবে স্নাইপার চালানোর দক্ষতা হামজার আছে। অর্থাৎ দুজন তাকে পুলিশের হাতে পড়তে না দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
হাতের হ্যান্ডকাফের দিকে তাকালো। এত বছরের পাপের জীবনে প্রথমবার এটা হাতে পড়েছে। বাইরে বোধহয় আততায়ীদের সাথে টুকটাক লুকোচুরিও চলছে পুলিশদের। পাশের বিল্ডিংয়ে জানালা বা ছাদে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। অর্থাৎ হামজা নিচে নেমে গেছে। তাহলে জয় কোথায়? গণ্ডগোল বাঁধানো শেষ। ফোর্স লণ্ড-ভণ্ড হয়ে গেছে। পলাশ ভুলেও পালানোর চেষ্টা করল না। সে পুলিশের হাতছাড়া হতে চায়না।
আগুন জ্বলছে চারদিকে। পেছনের ডোবার কাছের প্রাচীরের ওপার থেকে আরও কয়েকটা ককটেল এসে পড়ল বাগানে। জয়ের ছেলেরা আর পলাশের দলের চ্যালারা সব একাকার হয়ে গেছে। উদ্যেশ্য আলাদা হলেও আপাতত কাজ একই দুই দলের। পলাশকে পুলিশের হাতে না পড়তে না দেয়া। ককটেল একটা পলাশকে ঘেঁষে গেল, দ্রুত মাথা নামিয়ে বকে ওঠে পলাশ। রূপকথার জন্য বেশ টেনশন হচ্ছিল। ওকেও কি ধরা হবে? ও তো কোনো দোষ করেনি! তার নিজের বউকে আঘাত করার অধিকার শুধু তার আছে।
পাশের বিল্ডিংয়ে বাহিনীর তিনজন ঢুকে পড়ল, হামজা তখনও বিল্ডিংয়ের ভেতরেই। দোতলায় নেমে এসেছে ছাদ থেকে। দোতলায় প্রধান কার্যালয় এনজিওটির। একাধিক কেবিন আর ডেস্ক সাজানো একেক ইউনিটে। বাথরুমের দেয়ালের আড়ালে দাঁড়াল হামজা। বাহিনীর লোক প্রথমত ছাদে উঠবে। কারণ ওরা নিশ্চিত বুঝেছে ফায়ারিং ছাদের ওপর থেকে হয়েছে।
হাতের এম-টুয়েন্টি ফোর স্নাইপার রাইফেলটির ওজন কম-বেশি পনেরো-ষোলো পাউন্ড। সেটাকে ঠ্যাং-য়ে ঠেকিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ-মাথা বেঁধে ফেলল। চোখদুটোও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। এরপর গিয়ে দোতলার প্রবেশ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। ঘুটঘুটে অন্ধকার গোটা বিল্ডিং। ওদের হাতে টর্চ আছে অবশ্য। তবে সেটার আলো সরু সামনের দিকে। বাকিটা অন্ধকার। ওরা যখন দরজা পেরিয়ে সোজা হুরহুর করে দোতলার ইউনিটের ভেতরে ঢুকে পড়ল, হামজা পায়ের স্যান্ডেল খুলে হাতে ধরে আস্তে করে বেরিয়ে এলো অন্ধকারে। নিঃশব্দে সিড়ি দিয়ে নেমে বাড়ির পেছনের ডোবার ধার এগিয়ি গিয়ে আমবাগানের ধারে ঝোপের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।
জয় কারও অস্তিত্ব টের পেতেই পেছন না ঘুরেই পিস্তলের মুজেলটা হাত বাঁকিয়ে তার পেটে তাক করে। হামজা শান্ত স্বরে বলল, “এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকিস না। এই ঝোপটাকেও সার্চ করা হতে পারে। এগিয়ে যা।ʼʼ
জয় খ্যাকখ্যাক করে উঠল, “ভাই, তুমি এইখানে কার বাল লাড়তে আইছো? ফোর্স ছড়ায়ে পড়ছে চারদিকে। কবীর দাঁড়ায়ে আছে মোড়ের ওপারে, বাড়ি যাও। আরমিণ, ভাবী, তুলি বাড়িতে একা। কেউ নাই কিন্তু বাসায় ওরা ছাড়া।ʼʼ
হামজা জয়কে ছোট্ট একটা পকেট চাকু ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা রাখ।ʼʼ মুখের রুমালটা খুলে জয়ের হাতে পেচাতে পেচাতে বলল, “সাবধানে ব্যবহার করবি ওটা। হাতে লাগলে সর্বনাশ।ʼʼ
জয় ঠেলে বের করে দেয় হামজাকে, “যাও তুমি। আমার কিছু হবেনা।ʼʼ
তখনও চারদিকে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। আরও ব্যাক-আপ টিম এসে ভরে গেছে চারদিকে। সব ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। তিনজন অফিসার অজানা আততায়ীদের গুলিতে নিহত। তাতে ক্ষেপা মৌমাছির মতো ছিটকে পড়েছে গোটা এলাকায় সবগুলো। বাহিনীর লোক ভাবেনি পলাশকে ধরতে এমন কাণ্ড হবে। হবার কথা তো নয় আসলেই, কিন্তু…।
হামজা স্পটটা পেরিয়ে বাকিটা পথ আরাম করে আম পাবলিকের মতো হেঁটে এসে মোড়ের এপারে কবীরকে বলল, “সিচুয়েশন হ্যান্ড-আউট হয়ে গেছে। জীপ নিয়ে তুই জয়ের কাছে যা। উল্টো পথ ধরে যাবি, তারপর পলাশের বাড়ির পেছনের আমবাগানের ভেতর থেকে ঢুকবি। জয় ওদিক দিয়ে বের হবে। অন্য উপায় নেই আর।ʼʼ
-“আচ্ছা, ভাই।ʼʼ কবীর কোনোমতো মাথা নেড়ে গাইগুই করা শুরু করল, “জয় ভাই বলছে আপনারে বাড়ি পৌঁছায়া দিতে।ʼʼ
হামজা নীরব চোখে তাকাল, “আর আমি কী বলছি?ʼʼ
কবীর আর একটা কথাও বলল না। চুপচাপ সোজা জীপে উঠে বসল। যাবার আগে শুধু আস্তে করে একবার বলল, “ভাই, আপনি কি আলাদা গাড়ি করে বাড়ি যাবেন?ʼʼ
-“বাড়ি যাব না আপাতত। বাড়িতে কয়েকজনকে রেখে এসেছি। তুই দ্রুত যা।ʼʼ
কবীর চুপচাপ চলে যায়। হামজা জয়কে এমন অবস্থায় ফেলে বাসায় যাবে, এই ভাবনা ভাবার মতো কঠিন বোকামি করেছে সে, বুঝল।
পলাশ তখনও পুলের ধারে দাঁড়ানো। ওর হাতে হ্যান্ডকাফ পরানোর পর পুলিশদের ওর দিকে আর খেয়ালই নেই। পুরো মনোযোগটা তিন মরদেহ ও অজানা হামলাকারীদের ওপর পড়েছে। পলাশের কাছে তখন মাত্র দুজন রক্ষী। তবু বেশ দায়সারাভাবে দাঁড়িয়ে। কারণ পলাশের কোনো হেলদোল নেই, সে যেন হাতকড়া পরে বেশ সুখেই দাঁড়িয়ে আছে। হাত দিয়ে মাঝেমধ্যে পকেট হাতরানোর চেষ্টা করছে। একটু লেবুপানি পেলে ভালো হতো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার।
জয়ের মুখ বাঁধা। তবুও বোতলের কর্ক খুলতেই ঝাঁজালো এক শ্বাস আটকানো ধোঁয়ার মতো গন্ধ এসে নাকে ঠেকল। হালকা কেশে উঠল। লোহার গেইটের ছিটকিনির ওপর অল্প-অল্প করে তরল ঢালছিল, তাঁতাল ছোঁয়ায় প্লাস্টিকের মতো ক্ষয় হয়ে হয়ে পড়ছিল ধাতুগুলো।
মাটিতে পড়ার পর চিরচির করে শব্দ হচ্ছিল। এক সময় গোটা ছিটকিনির সিস্টেমটাই ক্ষয় হয়ে পুরো নিঃশেষ হয়ে গেল। জয় বোতলটার কর্ক কোনোমতে আঁটকে বোতলটা দূরে ছুঁড়ে মারল। হাতের রুমালের ওপর পড়েছে বোধহয় দু-এক ফোঁটা। রুমাল না পেঁচানো থাকলে হাতে লাগতো।
পিস্তলের ম্যাগাজিন খুলে কয়েকটা এম্মো রি-লোড করে সাইলেন্সর লাগিয়ে নিয়ে আস্তে করে গেইটটা খুলে ভেতরে ঢুকলো। শুকনো পড়ে গাদা হয়ে আছে। হাই-বুটের নিচে মরমর করছিল।
পলাশ এদিক-ওদিক তাকিতুকি করছিল। জয়কে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল, তারপর কেমন একটা অস্থিরতা ঘিরে ধরল পলাশকে। হাজার হোক, এই জয়কে পলাশ ছোট থেকে দেখেছে, হোটেলে একসাথে বসে মদ খাওয়া, আড্ডা দেয়া…তার সামনে এমন নিকৃষ্ট অপরাধীর মতো দাঁড়াতে বেশ অপ্রস্তুত লাগছিল পলাশের। তারা দুজনই পাপীষ্ঠ, অথচ সেইসব পাপকে ছাপিয়ে আজ এক পাপীর কাছে আরেক পাপী, পাপী হয়ে ধরা দিলো।
জয় ইশারায় সালাম দেয় পলাশকে। পলাশ ছাড়া আর কারও সাধ্যি নেই জয়কে চেনার, এমনভাবে প্যাকিং করেছে নিজের। পুলিশদুটো জয়কে খেয়াল করে রাইফেল তাক করার আগেই লুটিয়ে পড়ল মাটিয়ে। জয়ের সেমি-অটোমেটিক পিস্তলের তিনটা বুলেট, দুটো প্রাণহীন দেহ।
পলাশ দৌঁড়ে ভেতরের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। ফোর্সের সবাই সামনের দিকে। এটাই বোকামি ওদের। দুজনকে রেখে ওরা নিশ্চিন্তে আততায়ী খুঁজছে। অবশ্য কারণ আছে। এখনও খণ্ড যুদ্ধ চলছে সামনে।
পলাশ বাড়ির পেছন দরজা অবধি পৌঁছালো না, জয় নিখুঁত নিশানায় পলাশের ডান পায়ে গোড়ালি বরাবর শ্যুট করল। থুবরে পড়ে যায় পলাশ। তখনই ঢুকল কবীরের সাথে তিনজন। পলাশের মুখে খানিকটা কাপড় গুঁজে ওকে টেনে বাগারের ভেতরে নেবার পর পুলিশের কয়েকজন এপারে এলো।
গোটা ঘটনাটা পুলিশ বাহিনী পলাশের বাড়িতে ঢোকার পাঁচ মিনিটের মাঝে ঘটে গেল। একই সাথে বিভিন্নদিকে বিভিন্নভাবে সেট-আপ হয়ে শেষ অবধি জয় গাড়ি ভাগিয়ে আমবাগান পেরিয়ে ঢুকে পড়ল এক গ্যারাজে। সেখানকার সাটার ডাউন হলো। পুলিশের বাহিনীর নাগালের ভেতরেই তারা তখন নাগাল ছাড়ানো ফেরারি।
পলাশের পায়ের গুলিটা কোনোমতো পা ছুঁয়ে গেছিল। নেহাত থামানোর উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়া। কোনোমতো রক্ত বন্ধ করে ওকে সাডেটিভ ড্রাগ দেয়া হলো।
শেষরাতের দিকে যখন গাঙের পাড়ের বাড়িতে পৌঁছানো ওরা। রূপকথা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে জানালার ধারে। কবীর অবাক হয়ে যায়। হামজা বসে আছে সোফায়।বাড়িতে না গিয়ে এখানে এসে জয়ের অপেক্ষা করছে। কী দৃঢ় বিশ্বাস, জয় জয়ী হয়েই ফিরবে, সে জয়কে সেই ধাঁচেই গঠনগতভাবে কাঠামো দিয়েছে।
পলাশের বাড়ি, নির্জন জায়গা। কারও সন্দেহও হবার কথা নয়, যে পলাশ এভাবে পালিয়ে নিজের কোনো বাড়িতে যাবে। হলেও সে ব্যবস্থা আছে। পুলিশের ধারণা পলাশকে নিয়ে পালিয়েছে ওর দলের লোকেরা।
—
রূপকথা স্বামীকে সেই রাতে একবার দেখেছিল অচেতন অবস্থায়। জয় ওকে ধরে নিয়ে এসে বেসমেন্টের এই কক্ষে শিকল পরিয়ে রেখে গেছে। তারপর যেসব অমানুষিক অত্যাচার করা হয়েছে, সেসব সময় রূপকথা দূরে থেকেছে। ওসব ভালো লাগেনা।
পলাশের গোঙানি কানে এলে নিজের সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে যায়। বিশেষ করে বিয়ের সেই প্রথম রাত। তার ফর্সা, নমনীয়, অক্ষত চামড়ায় পলাশের পাগলাটে থাবা পড়েছিল। এরপর আর সব…. কত যন্ত্রণা, কত ছটফটানি, প্রতারণা, আর বাধ্যগত সেইসব পাপ! নিষ্পাপ এক চাঁদ মুমতাহিণা! রূপকথার নিজেকে নোংরা কীট মনে হয় সর্বক্ষণ!
রূপকথা মেঝেতে আঁচল বিছিয়ে বসে। জয় তাকে কতটুকু সময় দেবে পলাশের কাছে কাটানোর, জানা নেই। তার কেমন লাগছে? কে জানে কেমন লাগছে! এই লাগার নাম নেই, বর্ণনা নেই। সে কি শেষবার মানুষের মতো দেখতে এই পশুকে দেখছে! বিয়ে আগ অবধি যে তার পলাশ ভাইয়া ছিল, এরপর হলো নরকের দ্বাররক্ষী!
আচ্ছা রূপকথার অস্থির লাগছে কেন? কীসব হিসেব-নিকাষের অংক ঘুরপাক খাচ্ছে জীবনের! অবর্ণনীয় সব অযাচিত অনুভূতিরা নৃত্যরত চারধারে।
অনেকক্ষণ বসে থাকে পলাশের মাথার কাছে। খুব ধীরে নিঃশ্বাস পড়ছে পলাশের। রূপকথার অবচেতনা ভাঙলো, হিংস্র এক লাত্থি পড়ল দরজায়। রূপকথা নড়ল না, উঠল না, শুধু বলল, শব্দ কোরো না, “জয়। নিশ্চুপ থাকো কিছুক্ষণ।ʼʼ
চলবে…
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৬০. (বর্ধিতাংশ)
অন্তূ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে চুপচাপ। বাইরের পরিবেশটা ভীষণ সুন্দর! গাঙের পানি ছলছল রবে বয়ে যাচ্ছে, আকাশে চাঁদ নেই, গাঙেল কূলের আবহাওয়া একটু মঘলা বোধহয়!
রূপকথা যাবার পর পরাগ ল্যাপটপ ছেড়ে বসল, অন্তূর দিকে তাকিয়ে বলল, “পলাশ ভাইয়ের শুভাকাঙ্ক্ষীরা যখন-তখন হামলা করবেই। আর যদি তা না পারে, তো পুলিশ নিয়ে আসবে। পলাশের জন্যে এই মুহুর্তে জেলখানার চাইতে সুখকর জায়গা দুইটা নাই।ʼʼ
জয় বিশাল এক হাঁ করে হাই তুলল, “ব্যাপার না। তুমি আছো না? তুলে দেব ওদের হাতে। তুমিও তো একই কম্পানির প্রোডাক্ট। আমি আমার বউটা নিয়ে ভাগতে পারলেই হলো।ʼʼ
পরাগ কাঠের ভারী চেয়ারটা ঠেলে মারল জয়ের দিকে, জয় দ্রুত সরে গিয়ে বাঁচল, লাগলে নির্ঘাত হাসপাতাল। পরাগ শান্ত স্বরে বলল, “তোমার মতো বেইমানের ওপর ভরসা করাও শালার এক চরম ফাতরামি ছিল।ʼʼ
জয় উঠে দাঁড়িয়ে মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়ল, “আমি তো জন্মগত আর খানদানী বেইমান। আমি বেইমানী করি পুরো ইমানদারীর সাথে। আমার বেইমানীতে কোনও গাফলতি থাকেনা, খাঁটি বেইমানী। কিন্তু ভয় হলো, তোমার মতো ইমানদারদের নিয়ে..পবিত্র গাদ্দার…ʼʼ
পরাগ মুখ বাঁকিয়ে হাসল, “যেমনে তোর পেয়ারের পলাশ ভাই আজ শালা হয়ে গেছে, ওরকম কিছু ঠাপ আমিও খাইছি, বুঝলি না রে!ʼʼ
জয় অন্তূর দিকে তাকাল। তার খেয়াল নেই ওদের দিকে। পরাগ ল্যাপটপে কিছু দেখে চট করে উঠে দাঁড়াল, “আজ পলাশকে আমার হাত থেকে তুমি বাঁচাইতে পারবা না। তোমার নাটক আর নিতে পারতেছি না। মারবাই যখন, তখন ফিল্ডিং মারাইতেছ ক্যান এমনে?ʼʼ
জয় তাড়াহুড়ো করে পরাগের পিছে যাবার আগে হাতের বোতলের মদ গিলে শেষ করে আগে। তারপর পরাগের পেছনে দৌঁড়ায়। আবার কী মনে পড়ে দৌড়ে ফিরে আসে, এরপর একটা ভরা বোতল নিয়ে আবার দৌড়।
পরাগ গিয়ে দরজায় দুটো সজোরে লাত্থি মারল। রূপকথার কথা শুনে রেগে উঠল, “জয় না, আমি। খোল, দরজা! আমার মা’র কিছু হইলে তোর চৌদ্দগুষ্ঠির অবস্থা আমি তোর ওই বেজন্মার মতো করে ছাড়ব, রূপ। দরজা খোল।ʼʼ
রূপকথা অবাক হয়ে দরজা খোলে, “বুয়ার কী হয়েছে?ʼʼ
-“আমি কেন এসেছি এখানে?ʼʼ
-“বলিসনি কিছুই। এসে থেকে ল্যাপটপে বসে আছিস।ʼʼ
-“তোর ওই..বানচোত.ʼʼ বিশ্রী ভাষায় বকে ওঠে পরাগ, “আমার মাকে কোথায় পাঠিয়েছে সেটা শোন্, যতক্ষণে বলবে, ততক্ষণ ওর আয়ু আছে। চিরকাল তোদের ফরমায়েস খেটেছে, তার বদলে লাত্থি, মানহানি ছাড়া কিছু পায়নি। তোর বাপ মরেছে, এবার ওই শুয়োরের বাচ্চাও মরবে, বাকিটার ভোগ আমার আর মা’র। তোল ওকে।ʼʼ
জয় এসে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল পরাগকে। পরাগ সমানতালে বকে যাচ্ছে। জয় একবার খামচে মুখটা চেপে ধরল। পরাগ ঝপাট করে এক ঘুষি মারে জয়ের নাকের ওপর। তখন ওরা গাঙের কূলে চলে এসেছে। অন্ধকার চারদিক, প্রায় সকাল হয়ে এসেছে, পাখি ডাকছে।
জয়ের নাক দিয়ে রক্ত পড়ে প্রায়ই। ঘুষির আঘাতে কপকপ করে রক্ত বেরিয়ে এলো। আঙুলের ডগায় রক্ত মুছে পরাগকে দুটো ঘুষিসহ শেষ অবধি এক লাত্থিতে গাঙের পানিতে ফেলে দিলো। টাল সামলাতে না পেরে নিজেও গাঙের কূলের কাদায় পা পিছলে পড়ল। পরাগ পা ধরে টেনে পানিতে নামানোর চেষ্টা করে। জয় শক্ত করে কীসের একটা শিকড় টেনে ধরে নিজেকে পানিতে পড়া থেকে বাঁচালো তো, অথচ পুরো শরীর ইতোমধ্যে ভিজে গেছে, কাদামাটিতে পরনের পোশাক শেষ। শেষ অবধি ঝারা মেরে পরাগকে পানিতে ফেলে রেখে বকতে বকতে উঠে এলো। পরাগ পড়ে রইল পানিতে, ফজরের আজানের আগে গাঙে গোসল করা ভালো।
গাঙের এধার ঘেঁষে অনেকটা দূর দেখে এলো জয়। তেমন কেউ ছিল না।
কাদামাটিসহ ভেজা শরীরে বেসমেন্টে এসে বসল। আরও কয়েক প্যাগ মারা দরকার। নয়ত ঘুম আসবে না।
রূপকথা পলাশের কপালে হাত রাখে। কপালটা গরম। তাকিয়ে রইল। নিজের শরীরের শুকনো ক্ষতগুলো চিরবির করে উঠছে যেন। পলাশের সামনে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত পড়ে থাকতে দেখেছে অজস্র বেলা, কিন্তু পলাশকে কখনও এভাবে দেখা হয়নি।
রূপকথা আনমনে বলে ওঠে, “জানো, জয়! বিয়ের তিন বছরের মাথায় আমার গর্ভে একটা সন্তান এসেছিল।ʼʼ
জয় হিপফ্ল্যাস্কে দুটো চুমুক দিয়ে বলল, “হু, শুনেছিলাম।ʼʼ
রূপকথা বলে চলে, “তখন আমার গর্ভাবস্থার চার মাস। সেই সময় একরাতে পলাশের হাতে পড়লাম। পরদিন সকালে আমার গর্ভপাত হলো। দুই সপ্তাহ হাসপাতালে থেকে আমি খুব কেঁদেছিলাম.. জানো!ʼʼ
জয় মাথা নাড়ল, “কাঁদা তো ভালো। চোখের জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া, ময়লা সব চোখের পানির সাথে ধুয়ে-মুছে যায়। হোয়াট এভার, এক সিপ মারবেন? দুঃখের সময় এটা ভালো কাজ দেয়।ʼʼ
রূপকথা তাকাল, একই সুরে বলতে লাগল, “তুমি জানো, পাপীর ঘর করা কারাবাসের চেয়েও কঠিন! পাপীষ্ঠর সাথে বাস করতে করতে বড়জোর পাপী হওয়া যায় ঠিকমতো, এর বেশি উপকার নেই!ʼʼ
জয় ঘাঁড় ঝাঁকাল, “উহু! আপনি এইসব মেয়েলী দুঃখের কথা আমায় শুনিয়ে কোনো ফায়দা পাবেন না, একফোঁটা সান্ত্বণা অবধিও না। রাদার, আমার বউকে শোনান, সে নিজেও ভুক্তভোগী। তাই সে আপনার দুঃখ বুঝবেও, সহমত পোষনও করবে, আবার মাল-মশলা মেরে নিজের দুঃখের প্যাঁচালও শোনাবে। আলাপ জমবে ভালো। তার চেয়ে বড় কথা, আমিও আপনার স্বামীর তরিকারই মুরীদ! আমার কাছে এসব কাহিনী শোনানোর ধান্দাটা লস প্রজেক্টে যাবে।ʼʼ
রূপকথা বসে রইল চুপচাপ কিছুক্ষণ। সে বিদেশ থেকে পড়ালেখা সেরে দেশে ফিরে কয়েদ খাটছিল এতগুলো বছর! পরিস্থিতিবিশেষ পারিপার্শ্বিক সকল অর্জন ফিকে পড়ে যায়! যার বাবা জঘন্য অপরাধী, স্বামীটা হিংস্র পশুকেও হার মানায়, রূপকথার কী করা উচিত ছিল সে অবস্থায়!
শেষরাতের দিকে পলাশ চোখ খুলে উঠে বসল আস্তে কোরে। রূপকথাকে বসে থাকতে দেখে চমকে গেল, জড়ানো গলায় বলল, “রূপ!ʼʼ
রূপকথা জবাব না দিয়ে তাকিয়ে আছে। পলাশ বলল, “ওরা তোকে আঁটকে রেখেছে, রূপ?ʼʼ
রূপকথা অপলক তাকিয়ে বলে, “নিজের বাড়িতে আঁটকে রাখা কেমন? আমি তো এখানেই ছিলাম।ʼʼ
পলাশের হাত দুটোয় গভীর ক্ষত। পেরেক গাঁথা হয়েছে হাতে। দক্ষ এই কাজটা হামজার। কাঠের আসবাবে পেরেক গাঁথার মতো করে পলাশের হাতে পেরেক মারা হয়েছে।
চাপটি ধরা রক্তের দানা হাতে কাদামাটির মতো শুকিয়ে আছে। সেই হাত বাড়িয়ে পলাশ ছোঁয় রূপকথাকে। রূপকথা চোখ বোজে। বুকের মধ্যিখানটায় যেন ত্রিশূল বিঁধছে, বুকটা চিড়ছে ধীরে ধীরে, গেঁথে যাচ্ছে গভীরে। তার জীবনটা জীবন হলেও পারতো, তার স্বামীটা মানুষ হলেও পারতো, সে এক জোড়াতালি দেয়া ছিন্নভিন্ন শরীরের অধিকারিনী না হয়ে একজন সুন্দর পুরুষের সুশ্রী স্ত্রী হলেও পারতো, সে কোনো ঘৃণ্য রুচিসম্পন্ন পিতার সন্তান না হয়ে আমজাদ সাহেবের মতো বাবার মেয়ে হলেও পারতো। চোখ খোলে রূপকথা। কই! আমজাদ সাহেবের মেয়েটাও যে ভালো নেই। মূলত ভালো থাকাটা জীবন নয়!
পলাশ হাসল। সে হাসলে চোখদুটো ছোট হয়ে যায়। ভয়ানক দেখায়। হেসে বলল, “তুইও বিশ্বাসঘাতকতা করলি, রূপ?ʼʼ
রূপকথা মলিন হাসে, “বিশ্বাসের সম্পর্ক ছিল নাকি আমাদের? উত্তর যেহেতু ‘নাʼ। সেখানে বিশ্বাসের ঘাতক হবার সুযোগটা কোথায়, বলো?ʼʼ
পলাশ গলা টিপে ধরল রূপকথার। হাতের ক্ষত থেকে মরা রক্ত গড়িয়ে রূপকথার গলায় লাগে। পলাশ হাতটা আরও দৃঢ় করে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল, তবু রূপকথা নির্লিপ্ত। পলাশ বলল, “শিকল খুলে দিতে বল তোর, লাংকে। খানকিগিরি করতে রয়ে না গেছিস এখানে? ওদের স্পেশাল সেবাযত্ন করার জন্য রাখেছে ওরা তোরে? আমি মরলে ওই কাজই করে খাস…লোটির চেংরি। মারা খাইতে খাইতে জীবন যাবে তোর…তোর আমি…ʼʼ
পলাশের হাতের থাবা শক্ত হলো। তাতে হাত থেকে রক্ত পড়ছিল। জয় এসে সেই ক্ষততে লবন লাগিয়েছে।
শরীরের জোর নেই নেই করেও অমানুষিক শক্তি যেন। চোখ উল্টে এলো, গোঙরাচ্ছিল রূপকথা। পলাশ ছাড়ল না। অকথ্য ভাষায় বকে গেল। পায়ে গুলি লাগা জায়গাটাতে একটা নোংরা কাপড় বাঁধা। সেই কাপড়ের ময়লা-জীবাণুর জোরে ক’দিন ওভাবে থাকলে ক্ষততে ইনফ্যকশন হয়েই ক্যান্সার ধরে যাবে যেন। না খাওয়া আজ দু’দিন।
খানিক পর ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিলো রূপকথাকে। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইল। রূপকথা কিছুক্ষণ কাশতেও পারল না। শ্বাস ছাড়ল বেশ কিছুক্ষণ পর। তারপর বলল, “আর কোনো ইচ্ছা আছে তোমার মৃত্যুর আগে? আমাকে আর কোনোভাবে টর্চার করতে চাও? আমি জানি, তোমার শেষ ইচ্ছা হিসেবে তুমি আমার শরীরটাকেই বেছে নেবে ছেঁড়া-ফাঁড়ার জন্য।ʼʼ
পলাশ একবার তাকিয়ে আবার মাথা নত করল। কয়েক সেকেন্ড পর টুপ করে এক ফোঁটা রক্ত পড়ে মেঝেতে। পলাশ দ্রুত মাথা তুলল। নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। তার শরীরটাকে অচল করে ছেড়েছে ওরা। এ পর্যায়ে পলাশের ভেতরে একটা ভিক্ষুক জেগে উঠল, যে ভিক্ষুকটা মৃ/ত্যু ভিক্ষা করতে চায়। মেঝের ওপর টান হয়ে শুয়ে পড়ল। দুই হাতের প্রতিটা রগে রগে পেরেক গাঁথা হয়েছে। হাতুরি দিয়ে ধীরে ধীরে পেরেকগুলো গেঁথে আবার তোলার সময়ও বেশ সময় নিয়ে দুই আঙুলে পেরেক টেনে টেনে বের করেছে হামজা। কতটা রক্ত বেরিয়ে গেছে, মাপা গেলে ভালো হতো। তাহলে একটা হিসেব পাওয়া যেত, শরীরে আর কতটুকু রক্ত বাকি আছে।
শ্বাস ধীর হয়ে এলো পলাশের। চোখ বুজে খানিকক্ষণ শুয়ে থেকে আস্তে কোরে পানি চাইল।
জয়-হামজা ততক্ষণ মানুষকে অত্যাচার করে, যতক্ষণ সে সজ্ঞানে থাকে, জ্ঞান হারালে মাফ। আবার চিকিৎসা করে, সুস্থ করে, জ্ঞান ফিরলে নতুন মাত্রায় শুরু। পলাশ দুটো দিন আয়ুও পেয়েছে এই বদৌলতেই। আজ রাতটাও পেল। কারণ সে অজ্ঞান ছিল। ভিক্টিমের চোখে কাতরানি না দেখলে জয় টর্চার করে সুখ পায়না। এটা ওদের গোটা সোসাইটির উসুল। এই নীতির মূল হোতাটা রুদ্র ইয়াজিদ। তারপর হামজা, জয়, পলাশ….!
রূপকথা পলাশকে উচু করে ধরে পানি খাওয়াতে গেলে পলাশ গা দুলিয়ে হাসে, আজব দেখতে লাগে তখন। দাঁতের ফাঁকে কালো রক্ত। হেসে জিজ্ঞেস করে, “তোর কি আমাকে এই অবস্থায় দেখে কষ্ট হচ্ছে, রূপ?ʼʼ
-“হচ্ছে তো। তুমি জানোনা, আমার কতটা কষ্ট লাগছে, যখন ভাবছি আমার স্বামীকে এমন যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর মুখে দেখেও আমার তাকে বাঁচাতে ইচ্ছে করছে না, তাকে মুক্তি দেবার তাগিদ পাচ্ছি না ভেতরে, এটা ভাবলেই বুক ভেঙেচুড়ে কষ্ট আসছে, তখন কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। অথচ তুমি না আমার পলাশ ভাইয়া, আমার স্বামী…! আমি ছাড়া এই দুনিয়ায় আপন বলতে তোমার কেউ নেই এই মুহুর্তে, আর আমিটাও তোমার খুব কাছের আপন কেউ। তোমার এই শেষ মুহুর্তে সেই আমি তোমার সামনে আছি, পাশে আছি, তোমাকে পানি খাওয়াচ্ছি, এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়? অথচ তোমার জন্য স্বাভাবিক মায়াটুকউ লাগছে না। এটা কতটা ব্যথাদায়ক, ভাবতে পারো? এটা ভেবে তোমার কষ্ট হবার কথা? হচ্ছে?ʼʼ
পলাশ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। আশ্চর্য! শরীরের মরণসম ব্যথাটা এখন ঝাপসা লাগছে, বুকে কীসের যেন অস্থিরতা! পলাশ অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেল। এই জীবনে সে কখনও আবেগবোধ করেনি। কসাইয়ের মতো মানুষ জবাই করা, নারীদেহ ছিঁড়ে খাওয়া, মানুষের শেষ সম্বলটুকু হস্তাগত করে নেয়া, কারও ব্যবসার গোটা পুঁজি, মুনাফা সবটা এক হানায় চাঁদা হিসেবে হাতিয়ে নেয়া। বাপের সামনে মেয়ে, মেয়ের সামনে বাপকে মারা….কী যে সুখ লাগতো এসবে! তার মস্তিষ্কের কোনো অংশে আবেগ, অনুভূতি নামক দুটো শব্দের অস্তিত্ব নেই, এটা চিরন্তন সত্যের মতো। অথচ আজ পলাশ বুকের ভেতরে হাতরে নতুন এক রকম কিছু অনুভব করল। এই জীবনে এই রকম কিছুর সাথে তার পরিচয় ঘটেনি। এই রূপকথা তার পা দুটো দু’হাতের বাহুতে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা মেয়ের মতো মিনতি করেছে, “ও পলাশ ভাইয়া, ছেড়ে দাও আমায়। ও পলাশ ভাইয়া, পলাশ ভাইয়া গো…ʼʼ এই চিৎকার আর মিনতি করা কান্নাগুলো পলাশের কানে বাঁশির সুরের মতো সুখকর ঠেকতো। নিজেকে পুরুষ মনে হতো তখন।
আজ পলাশ হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকল। তার এই দুনিয়ায় কেউ নেই আপন। রূপকথা আছে, সে খুব আপন তার। তার স্ত্রী, চাচার মেয়ে। অথচ সে তাকে বাঁচাবে না, রূপের নাকি ইচ্ছেই করছে না একটুও। কঠিন মৃত্যু তার সামনে। এই একমাত্র আপনটার সাথে সে খুব অন্যায় করেছে, তাই একমাত্র আপনজন সামনে আছে, তবু তার এই নারকীয় হাল দেখেও মায়া লাগছে না!
রূপকথা নিচু স্বরে কিন্তু কণ্ঠস্বরে অনুযোগের দৃঢ়তা মিশিয়ে বলল, “আর এই মায়া না লাগার পেছনের পেক্ষাপটগুলো খুব ভয়াবহ, বুঝতে পারছো তুমি?ʼʼ
পলাশ ঝারা মেরে উঠতে চেয়ে পড়ে যায়। তার রূপকথা ভীষণ রুপবতী, ঠিক রূপকথার রাজকুমারীদের মতোন, শিক্ষিত, কথা বলে কী সুন্দর করে! আজ এসব মনে পড়ছে তার। উঠে বসে পলাশ। হাত বাড়িয়ে রূপকথার ঠোঁট ছোঁয়, কিন্তু কিছু বলতে পারে না।
রূপকথা যান্ত্রিকভাবে উঠে দাঁড়ায়। পলাশের ক্ষতবিক্ষত দূর্বল হাতটা তখনপিছলে যায় রূপকথার জামদানী শাড়ি ঘেঁষে। রূপকথা আর পেছন ফিরে তাকায় না। আচমকা তার বুক জ্বলছে, পুরোনো দিনগুলো ভয়ঙ্কর ভাবে স্মৃতিপটে আক্রমণ করছে। এখন আর পলাশের সামনে থাকা চলবে না। সেও তো একা হয়ে যাবে। তার আর কেউ থাকবে না। হাসল রূপকথা, পলাশ থাকলে কেউ থাকা হতো?
—
চোখ দুটো জ্বলছে অন্তূর। ঘুম নেই কত রাত! যাকে ভোলা হয়নি, তাকে মনে পড়ার প্রশ্ন ওঠে না। তবু গতরাত থেকে আব্বুকে মনে পড়ছে, এ কেমন মনে পড়া, তার তো ব্যাখ্যা নেই! আছে কেবল খণ্ড খণ্ড ব্যথা। অন্তূর মনে হলো, এই তীব্র যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তার উচিত এখন ওই গাঙের জলে মুখ চুবিয়ে দশ মিনিট ধরে রাখা, তাতে সব থেমে যাবে— তার হৃদঘড়িটা, সাথে সকল ব্যথাও।
বাগানের ঘাসগুলোও অযত্নে বেড়েছে। সকাল সকাল কবীর পুরো দলবল নিয়ে পলাশের এই বাড়িতে হাজির।জয় একটা কোরবানীর আয়োজন করবে, তরুর জানের ছদকা হিসেবে, ওদের দাওয়াত এখানে। অন্তূ ঝোপের কিনারে পাকা ঢিলার ওপর বসে থাকে।
জয় প্যান্ট, হাইবুট ছেড়েছে। কবীর সকালে সাদা লুঙ্গি ও চিরায়ত চামড়ার স্যান্ডেল এনে দিয়েছে।
রূপকথা এসে নিঃশব্দে বসে অন্তূর পাশে। অন্তূ স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে, মুখে যেন দুঃখ ফুটে না ওঠে, তাই হাসার অভিনয় করে।
জয় চুলো জ্বালাচ্ছিল। ভাঙা ডাল কুড়িয়ে এনে এনে জড়ো করছে ছেলেরা। ধোঁয়া চোখে লেগে কেদেকেটে অস্থির অবস্থা তার, লুঙ্গিতে কালি ভরে গেছে। অনেক কষ্টে চুলো জ্বলেই উঠেছিল সবে, পরাগ কোত্থেকে এক বালতি পানি এনে ঢেলে দিয়ে আরাম করে হেঁটে গিয়ে মুরগী জবাই করতে লাগল।
জয় চোখের মণি ঘুরিয়ে দেখল পুরো ব্যাপারটা। এরপর আস্তে করে বকলো দুটো, “শালার জাঙ্গিয়ার ভেতরে কাঁকড়া ঢুকাইতে পারলে শান্তি লাগত। ল্যাউড়ার বাল!ʼʼ
জীবনেও কখনও ভালো সম্পর্ক ছিল না জয়ের সাথে পরাগের। তখন জয় ক্লাস এইটে। ঘুরতে গিয়ে দুজন বাজি ধরে এক দ্বীপে গেল পালিয়ে নৌকা নিয়ে। জয়কে দ্বীপে নামিয়ে নৌকা নিয়ে চলে যাবার সময় একটা পকেট ছুরি ছুঁড়ে দিয়ে পরাগ বলল, “নে, এটা দিয়ে মাছ শিকার করে খাস, আর মাছ না পেয়ে বেশি খিদে লাগলে মরে যাস। আমার দোয়া থাকবে তোর সাথে। সালাম, বন্ধু।ʼʼ
এরপর জয় কীভাবে দু’দিন পর সেখান থেকে ফিরেছিল, সে এক ইতিহাস। তারপর আর দুজনের জীবনে বনিবনা হয়নি।
অন্তূ সেদিন রূপকথাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি জয় আমিরকে বেশ জানেন, তাই না?ʼʼ
রূপকথা কিছুটা সময় নিয়ে জবাব দেয়, “আমার বিয়ে হয়েছে ২০০৯-এ। তখন জয় অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। সেই সময় হোটেলে রোজ ওর যাতায়াত ছিল। কখনও কখনও অতিরিক্ত মদ খেয়ে সাথে চুরুট টেনে কাশতে কাশতে বমি করে ভাসিয়ে ফেলতো। জ্বরে গা পুড়ে যেত, তবু কোনো মেয়ের সাহস ছিল না ওর কাছে গিয়ে ওকে সেবা দেয়।ʼʼ
রূপকথা সামান্য হাসল, “জানো তো, সে আবার কারও সেবা, আদর-যত্নের ভুক্তভোগী না। তখন আমাদের আগের ভিলার পাশেরটা বিল্ডিংটা হোটেল ছিল। কোনো কারণে গেলে দেখেছি, বেহুশের মতো পড়ে আছে, তবু কাউকে সেবা করতে দিচ্ছে না। আমি গিয়ে ধমকে-ধামকে জোর করে টেনে বাড়িতে নিয়ে যেতাম। প্রথমদিন এক থাপ্পরও খেয়েছিল আমার হাতের বেশি ভাব ধরায়।ʼʼ
অন্তূ মুখ তুলল, “কখনও সরাসরি তাকে স্নেহের কাঙাল মনে হয়নি।ʼʼ
-“জয়ের যেটুকু যা দেখা যায়, সবটাই ওর নিজের স্ক্রিপ্টেড। তুমি তাকে খুব ভালো জানো, এবং আরও অনেকে জানবে হয়ত, কিন্তু তোমার মতো করে কেউ জানেনা। কত রাত জ্বরের ঘোরে কাতরেছে, মাথায় পানি দিতে গিয়ে শার্ট খুললে দেখেছি শরীরে অজস্র দাগ, কোনোটা তাজা-কোনোটা অনেক পুরোনো। অথচ এত এত রাত পড়ে থেকেছে বেহেড অবস্থায়, তবু কোনোদিন ওর অতীত বা ভেতর সম্পর্কে একটা কথা জানতে পারিনি।ʼʼ
অন্তূ কথা ঘোরায়, “থাপ্পড় খেয়ে কী করল?ʼʼ
দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে উদাসীন স্বরে বলল রূপকথা, “বেক্কেলের মতো চেয়ে রইল। এরপর চুপচাপ যা বললাম, শুনল।ʼʼ রূপকথা একটু চুপ থেকে বলল, “সেসব দিনে ঘুমের ঘোরে তরুকে ডাকতো–দুটো ঘুমের ওষুধ দেবার জন্য।ʼʼ
অন্তূ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, “সকল যন্ত্রণার একটাই ওষুধ, ঘুমের ওষুধ আর নয়ত মদ গিলে ঘুমানো? চমৎকার তো!ʼʼ
রূপকথা তাকাল অন্তূর দিকে, “তুমি জানো, তোমার আর ওর মাঝে অসংখ্য মিল আছে?ʼʼ
অন্তূ তীব্র প্রতিবাদ জানায়, “প্রশ্নই ওঠে না।ʼʼ
রূপকথা শাড়ির আচলে ঘাম মুছে বলল, “অস্বীকার করে অনস্বীকার্যকে এড়াতে পারবে না। জয়ের আয়নায় দেখা যাওয়া প্রতিবিম্বটা হলে তুমি। একই তবে বিপরীত।ʼʼ
দুজন একযোগে তাকাল জয়ের দিকে। সে এখন ঘাসের ওপর টান টান হয়ে শুয়ে পড়েছে। ঘাঁড়ের নিচে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। গাঙের পাশে সবসময় শনশনে বাতাস। কপালের কাছের চুলগুলো উড়ছে। অপর হাতটাও এবার ঘাঁড়ের নিচে গুঁজে গলা ছেড়ে এক ভারী টান ধরল,
আমি চলতি পথে দু’দিন থামিলাম,
আরেহ ভালোবাসার মালাখানি গলে পরিলাম….
আমার সাধের মালা যায় রে ছিঁড়ে….
রইব না আর বেশিদিন তোদের মাঝারে
ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে,
রইব না আর বেশিদিন তোদের মাঝারে…
রূপকথা একদৃষ্টে জয়ের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “জয়কে আমার একটা মানচিত্রের মতোন লাগে। একেক দিকের দৃষ্টির কোণ থেকে তাকে একেকভাবে আবিষ্কার করা যায়।ʼʼ
-“পাপের কোনো দিক-কোণ নেই। যেদিক থেকেই দেখুন, ওটা পাপ এবং পাপ।ʼʼ
রূপকথা হাসে, “ভুল বলোনি। পলাশের হাত থেকে এই জয় কতবার আমাকে ছাড়িয়েছে! এরপর একবার পলাশের সাথে ঝামেলা করে আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখল, তখন…ʼʼ
নিশ্চিত হতে শুধায় অন্তূ, “কোন বাড়িতে?ʼʼ
-“আমির নিবাস।ʼʼ
-“আপনি ওখানে ছিলেন?ʼʼ
-“ছিলাম। মজার কথা শুনবে? রেখে এলো আমায়, অথচ জীবনে দেখতে গেল না আর–বেঁচে আছি না মরেছি। আমি যে ওকে না জানিয়ে চলে গেছিলাম ও বাড়ি থেকে থেকে, সেটাও জেনেছে ও এক সপ্তাহ পর।ʼʼ
অন্তূর হাসি পেল। এছাড়া এরা আর কী আশা রাখে জয় আমিরের কাছে? বলল, “বাড়িটা কেমন, বলতে পারেন?ʼʼ
-“তোমার শ্বশুরবাড়ি তো। সেটার ব্যাপারে আমার কাছে জানা কেন? নিজে গিয়ে জানবে।ʼʼ
-“আমি? সে হিসেব থাক আপাতত। আপনিই বলুন!ʼʼ
অল্প চুপ থেকে রূপকথা চোখ তুলে তাকাল অন্তূর দিকে, “তুমি আমাকে ঘৃণা করো, অন্তূ?ʼʼ
অন্তূ প্রসঙ্গ বদলায়, “বাড়িটা কি পুরোনো আমলের?ʼʼ
রূপকথা আর জবাব দিলো না। পদে পদে অন্তূর মাঝে জয় আমিরের ছাপ ফুটে ওঠে। যা মুখে প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নয়, সেই কথাটা ভীষণ সন্তর্পণে এড়িয়ে যায় এরা। রূপকথার বুক আরেকটু ভার হলো। অন্তূর সুপ্ত ঘৃণা রয়েই গেছে তার উপর আজও।
চলবে…