অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব-৭৮+৭৯

0
30

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৭৮.

একটি বিস্তৃত জনমানবহীন মরু প্রান্তর। হঠাৎ-ই তা নিশীথের অন্ধকারে অবরুদ্ধ হয়ে উঠল। জয় সেখানে একা দাঁড়িয়ে। অনেকটা দূরে আবছা দেখা যায়–ছোট্ট জয় আমির তার দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসছে। তখনই একটি শুকনো-লম্বা হাত জয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে লাগল। নিশীথের অন্ধকার তখনও বেহায়ার মতো তাদের পিছু পিছু ভেসে আসছে। চলতে চলতে কিছুদূর পেরিয়ে সেই হাতের মালিক বলিষ্ঠ, শ্যামরঙা এক দানব-মানব হয়ে উঠল। জয় আরও অনেকটা পথ নিশ্চিন্তে হাঁটে সেই পুরুষটির হাত ধরে।

কিন্তু হঠাৎ-ই আকাশ ফুঁড়ে এক টুকরো বিদ্যুতের ঝললকানি জমিনের ওপর পড়লে সামান্য একটু আলোকিত হলো অন্ধকার মরুপ্রান্তর। চিরসঙ্গীর হাত ছেড়ে জয় বড় আগ্রহে এগিয়ে যায় নিভু নিভু আগুনের টুকরোর দিকে।

নিভু আগুন জয়কে ইষৎ হেসে শুধায়, “আপনাকে ফেরানোর দায় আমার ছিল না। তবু দু-একবার চেষ্টা করিনি বললে মিথ্যা হবে। কিন্তু আপনি রাজী নন। আপনার পথ রুখার সাধ্যি তো আমার নেই, আমি তাই আপনার পায়েই শিকল পরাবো, আজ যারা শিকলে বন্দি, তাদেরকে আমি মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড় করাবো।ʼʼ

জয় হাসল, “এতে আপনি জিতে যাবেন, উকিল ম্যাডাম?ʼʼ

-“আবার হার-জিতের প্রশ্ন কেন, জয় আমির? আপনি সমাজের জন্য দাবানলের মতো বিপজ্জনক। আপনার তান্ডব চলতে দিলে বনের পর বন ছারখার হয়ে আমার মতো অন্তূরা জন্মাবে। তা আর না হতে হলে আপনাদেরকে এখানেই থামতে হবে।ʼʼ

-“আমরা থেমে গেলে তোমাদের সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে তো?ʼʼ

-“মানুষ চিরকাল বাঁচবে না জেনেও চায় অন্তত আর ক’টাদিন বাঁচতে। সমাজের সকল কীট-পতঙ্গ নাশের সাধ্যি আমার কই, হাতের নাগালে যা আছে তারাই অন্তত সই? এটাকে নিজের পরাজয় ধরলে ধরুন, বাঁধা দেবার ইচ্ছে নেই।ʼʼ

জয় হেসে বিরবির করে আওড়ায়,

-‘পরাজয় আমার হলো বৈকি, জেনেবুঝে সব ছাড়ি,
বিজয়ের কৌশল রপ্ত আমার, তোমার তরে হারি!’

নিভু আগুন আপত্তি কোরে মৃদু হেসে মাথা দোলায়,

-‘জেনেবুঝে ছাড়ে, কারও তরে হারে, যে বা যেই জন,
পরাজয় ছিল একক পরিণাম—জেনেছে আগে তার মন।’

জয় ভ্রু কুঁচকায়। সে নিজের পরাজয় সুনিশ্চিত জানার পর হার মেনেছে? এ কেমন কথা? সে চাইল, বড়ঘরের বন্দিদেরকে রক্তে চুবিয়ে এলো। আবার এখন চাইলেই আরমিণের পরিবারসহ আরমিণকে জীবিত দাফন করে ফেলতে পারে…তারপর ক্ষমতার চূড়ায় দাঁড়িয়ে মুক্ত পাপী রাজা হিসেবে নিজেকে ঘোষনা করতে পারে, অতঃপর বিজয় উল্লাসের নামে আরও শ খানেক নরবলী সে দিতেই পারে। তাহলে পরাজয় কোনটা?

নিভু আগুন তার কানে ফিসফিস করে যায়, “আপনি চাইলেই জিততে পারেন–কিন্তু আপনি চেয়েও চাইছেন না; এই না চাওয়াটার চাইতে বড় পরাজয় আর কই?ʼʼ

জয়ের মস্তিষ্ক এ পর্যায়ে শরীরে মরণ-যন্ত্রণা টের পেল। এই ব্যথা তার পরিচিত। দেহে বিঁধে থাকা বুলেট বের করার ব্যথা এটা। মরুপ্রান্তরের অন্ধকারটা গাঢ় হলো, বলিষ্ঠ হাতখানা এখন বহুদূর পেছনে দাঁড়িয়ে, নিভু আগুনে রক্তের ছিটা পড়ছে, তাই তা আরও নিভু নিভু হচ্ছে। জয় খুব অস্থির হয়ে উঠল–তার পরাজয়টা কী?

মরুপ্রান্তরে ধ্বনি উঠল, “বরং তুই বল দেখি বিজয় কোনটা? সীমাহীন পাপ করার ক্ষমতা থাকাটা যদি বিজয় হয়… তুই বিজয়ী এক পাপের সম্রাট। কিন্তু একখানা সংসার, একটা জীবন–মানুষের মতো জীবন, নিজের ঠিকানা-পরিচয়, তোর আকাঙ্ক্ষিত সঙ্গিনী, নিজের বংশধর….কিছুই তোর হবার নয়। …..তবু তুই দাবী করিস জিতে যাবার! বিজয়ের মর্ম না বোঝা নির্বোধ পাপীষ্ঠ! তোর পরাজয় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে তোর অপেক্ষায়।ʼʼ

জয় দেখে, নিভু নিভু আগুন নিভে যাবার শেষক্ষণেও হাসছে। অন্ধকার জয়কে পরম যত্নে আগলে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। ব্যথার অনুভূতি ফুরিয়ে আসছে। বিজ্ঞানকে শুধালে বিজ্ঞান এটাকে মানব মস্তিষ্কের চেতনাহীনতা বলবে। ভদ্রলোকেরা বলবে, মস্তিষ্কের মৃত্যু।


সকালে কাস্টডি রুমে বসে থেকে জয়ের খুব খিদে পাচ্ছিল। তার খিদে পেলে অমানুষিক সব হিংস্রতা ও ভাবনা আসে। যেমন কাস্টডি রুমের চেয়ার-টেবিলগুলো দেখে তার মনে হলো, এগুলোকে ডুবোতেলে মচমচে করে ভেজে খেলে খুবই টেস্টি লাগবে।

খানিকবাদে দুজন কনস্টেবল ধরাধরি করে পরাগকে নিয়ে এলো সেখানে। চেনা যাচ্ছে না চেহারাখানা। নিজে দাঁড়ানো অথবা হাঁটার শক্তি নেই। যেন অনেকদিন পর কবর থেকে একটি মরদেহ তুলে আনা হয়েছে, অর্ধেকের বেশি মাংস ঝরে গেছে শরীর থেকে, সামান্য কিছু কঙ্কালের সাথে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ঝুলছে।

জয় পরাগকে দেখেই নাক চেপে ধরল, “সকাল সকাল মুড নষ্ট! দরকার পড়লে আমার নামে আরও পনেরো-বিশটা মামলা ঠুকে দ্যান, তবু এই ধরণের চামবাদুরের মুখোমুখি বসায়ে রাখবেন না, স্যার। আমার খুবই বমি আসতাছে।ʼʼ

পরাগ টেবিলের ওপর মাথা রেখে নিস্তেজ গলায় আলতো হেসে বলল, “তাইলে তুই মনেহয় পোয়াতি, জয়। এতে আমার দোষ নাই।ʼʼ

আজ পলাশ ও রাজন বেঁচে থাকলে পুলিশদের সাহস হতো না পরাগকে এভাবে টর্চার করার। থাকলে এতক্ষণে পুলিশদের পরিবারের কমপক্ষে চার-পাঁচটা মেয়েলোক পলাশের জন্য ডিলেশিয়্যস ডিনার হতো…

রউফ কায়সারকে দেখে জয় কপালে হাত তুলে সালাম ঠুকল। পরাগের কানে কানে বলল, “ দেখতে তো একদম ঝিংকু হয়েছিস রে, ফ্রগ! যাকগে, তো শ্বশুরবাড়ির মেহমানদারি কেমন উপভোগ করলে, দোস্তো?ʼʼ

পরাগ হাসল, “তুই টেস্ট করারই পথে, নিজেই টেস্ট করে বুঝে নিবি।ʼʼ

-“আমার এত সৌভাগ্য কই রে পাগলা?ʼʼ

পরাগ হাসে, “তোর ভাগ্য খুলে দিয়েছি আমি।ʼʼ

-“হু?ʼʼ

-“পলাশ আজগরকে তুই মেরেছিস।ʼʼ

-“তাই নাকি? কই আমার তো মনে নেই! কিন্তু স্বীকার যখন করবিই, এতদিন ভাউ খাইলি ক্যান? দে শালা মাওরাচো%দা, আমার কৃতজ্ঞতা ফিরায়ে দে।ʼʼ

-“কৃতজ্ঞ হয়ে তুমি আমার বালডা ফালাইছো, হুমুন্দির পুত! তোর জন্য জান তো দিতে পারি না।ʼʼ

তার সঙ্গে জয়ের সম্পর্ক আগে-পরেই প্যাঁচ খাওয়া। তবু সে কেন শুরুতেই জয়ের নাম নেয়নি, এটা ভাবনার বিষয়।পরাগকে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে, সে জানে না। কিন্তু কারণ একটা আছে, অদ্ভুত কারণ।

পরাগ তখন ছদ্মবেশী প্রশাসন কর্মকর্তা। একদিন তার মিছেমিছি কার্যালয়ে এক নারী এলো। তার চোখে চিকচিক করছিল ন্যায়ের তেজ, আচরণে বিচক্ষণতা। পরাগের বুকে ধাক্কা লাগল—তার মনে হলো, নারীটির বিশ্বাস অনুযায়ী সে আজ কেন সত্যিই মুস্তাকিন মহান নয়? সে কেন পারছে না নারীটির চাহিদামতোন ধর্ষিতা মেয়েটিকে ইনসাফ দিতে? আবার কিনা সে সেই পলাশের অনুগত জারজ ভাই, যে এসবের পেছনে কাঠি নাড়ছে।

এ পর্যন্ত পরাগ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল কষে। কিন্তু যেদিন সেই নারীটিকেই আবার আরেকজন মুমতাহিণা হবার জন্য পলাশের ডেরায় পাঠাতে হলো, সেই বিশ্বাসঘাতকতার অনুশোচনা কি আজও গেছে পরাগের ভেতর থেকে? সে কেন সেদিন নারীটির সরল বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেনি? কোন সুঁতোয় তার হাত বাঁধা ছিল? সেই সুঁতোর নাম যদি পাপ হয় তো সেদিন কী করে সেই সুতো ছিঁড়ে তার সম্মুখে জিতে গেল জয় আমির? যেখানে জয় আমিরের পাপের সুঁতো যে তার চেয়ে হাজারগুণ শক্ত, পরিপোক্ত!? এমন তো কথা ছিল না! নারীটির কাছে জয় আমির মৃত্যুর মতো ঘৃণ্য, জয় আমিরের কাছে নারীটি কেবল একটি শিকার–অথচ সেইরাতে সম্মান বাঁচিয়ে এনে নারীটিকে জয় আমির বিশ্বাসঘাতক পরাগের হাতে তুলে দিয়ে এক টুকরো বিদ্রুপমাখা হাসি হেসে চলে গেছিল। এই স্ব-ধিক্কার কি পরাগ ভুলতে পেরেছে আজও?

সে জয় আমিরের কাছে বিশ্বাস ও ভরসার মামলায় হেরে যাওয়া আনাড়ি। পরাগের বুকে নারীটির জন্য অগাধ টান। সেই টানে পাপ নেই, এটুকু নিরেট। তবে সেই টান অদ্ভুত, একজন কাপুরুষ বিশ্বাসঘাতকের কলিজার টান কিনা! তাই ততদিন সেই নারীর ভরসাস্থল–জয় আমিরকে কেঁড়ে নিতে পরাগের সাহস হয়নি যতদিন না রূপকথার মামলা এসেছে। পলাশ আজগরের খুনী হিসেবে সন্দেহের তীর রূপকথার ওপর স্থির হয়ে যাচ্ছিল। তদন্তে উঠে এসেছিল—রূপকথা ছিল পলাশের কাছে অমানুষিক অত্যাচারের শিকার। রূপকথার কাছে যথেষ্টর চেয়েও বেশি কারণ ছিল অসুস্থ পলাশকে খুন করে নিজেকে বাঁচিয়ে নেবার।

পরাগের সাথে রূপকথার সম্পর্ক আরও জটিল। সৎ ভাই-বোন, প্রতিদ্বন্দী। কিন্তু পরাগের না বলা আরও একখানা কথা আছে—পরাগ রূপকথাকে বোনের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছে সেই ল্যাংটা-কাল থেকে। সেই নারীটির জয় আমির আছে! রূপকথার আজ এক পরাগ ছাড়া কেউ নেই। পরাগ বলে দিয়েছে পলাশের খুনীর নাম।

জয় বলল, “তুই এমনিতেও বাঁচবি না। তোর খয়রাতে আমি বোয়াল মাছ দিয়ে আলু ঘাটার অনুষ্ঠান করব।ʼʼ

পরাগ মাথা নাড়ল, “ওইজন্যই বলে দিছি। তোর মরার ব্যবস্থা না করে মরলে নরকবাস হবে।ʼʼ

-“নয়ত তুই কি জান্নাতুল ফেরদাউসে যাইতি? তোর মতো শাউয়ার নাতিরে নরকে দিলেও তোর জায়গা হবে নরকের হাগাখানায়।ʼʼ

পরাগ টেবিলের নিচ দিয়ে জয়ের পায়ের ওপর দুম করে একটা লাত্থি মারল। রউফ এসে বসল দুজনের সামনে। জয় বলল, “স্যার, এই উগ্রবাদী পাঠাটার এখনও ফাঁসি হয় নাই ক্যান? আমি আপনাকে খুব ন্যায়পরায়ণ অফিসার বলেই জানি।ʼʼ

-“আজই আমার সঙ্গে আপনার প্রথম দেখা।ʼʼ

-“দেখা তো আমাদের আজরাইলের সাথেও জীবনে প্রথমবার আর একবারই হয়, তাই বলে কি মরার আগে আমরা জানি না তাকে?ʼʼ

-“আমাকে আপনি নিজের আজরাইল বলছেন?ʼʼ

জয় মুচকি হাসল, “হতেই পারেন! সুযোগ দিয়েছি তো!ʼʼ

-“না, জয় আমির। আপনি নিজেকে খুব বেশি শক্তিধর ভাবলে আমি তার প্রতিবাদ করব।ʼʼ

জয় ঠোঁট বাঁকাল, “কোচের ছুরি কোচ কাটলে স্যার, আপনার মতো প্রতিবাদীরা একটু-আধটু প্রতিবাদ করলেও মেনে নিতে হয়। ও সঁয়ে যাবে।ʼʼ

খুব গভীর চোখে এবার দেখল রউফ জয় আমিরকে। রসিক-গম্ভীর চেহারা। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ততায় কাতর, কিন্তু উদ্বেগ নেই একটুও। সেও কি জানে তার স্ত্রী তাকে ধ্বংসের কত কঠোর ফর্দ তৈরি করেছে? জানে বৈকি! ওই গভীর বাজ পাখির মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গভীর সতর্কতা আর বিচক্ষণতা।

-“যখন কামরুজ্জামান ঝন্টু সাহেবের মার্ডার হয়, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?ʼʼ

-“সামনেই।ʼʼ

রউস হেসে উপর-নিচ মাথা নাড়ল, “যাহোক, পেছনে থেকেও খুন করা যায়।ʼʼ

-“পেছন থেকে কুত্তা দাবরায়, স্যার। আমি ধরলে সামনে থেকেই…বাই দ্য ওয়ে আপনি দু চারটে করেছেন নাকি খুন…পেছন থেকে?ʼʼ

একটু অবাক অবশ্যই হলো রউফ কায়সার জয়ের অকপট স্বীকারক্তিতে। খানিক চুপ থেকে আচমকা জিজ্ঞেস করল, -“রাজন আজগরকে কেন মেরেছেন?ʼʼ

রউফের উদ্দেশ্য ছিল হঠাৎ-ই এমন প্রশ্নে ভড়কে যাবে জয়, কাচুমাচু হবে। কিন্তু অবাক হয়ে তড়াক করে মাথা তুলল পরাগ। জয় শুধু সামান্য ঠোঁট উল্টায়, “একটুও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু জানেন দুনিয়া কক্ষনোই চায় নাই আমি পাপ কম করি।ʼʼ

আরমিণ যেদিন প্রথমবার বড়ঘরে পা রাখল তখন জয় রাজধানীতে। সেখানকার একটি চেম্বারে রাজন আজগরের ব্যবসার মাল–মদ, অস্ত্র ও মেয়েলোক দেখে ফেলেছিল আরমিণ। খবরটা জয় জেনে যখন আশপাশে পাহারা বাড়িয়ে দিলো, সেই পাহারাদারদের মাঝে বেশ কয়েকটা পলাশের ছেলে ছিল অবশ্যই। তারা রাজন আজগরকে কল করে জয় আমিরের স্ত্রীর স্পর্ধার কথা বলে দিলো।

সেবার দিয়ে রাজন আজগর তিনবার শুনলেন জয় আমিরের স্ত্রীর দুঃসাহসিকতার গল্প। আগেও বহুবার হাতে চেয়েও পাননি, কিন্তু এবার আর না দেখলে চলছিলই না সেই মেয়েটিকে। জয়কে সেই সকালেই তিনি কল করে আবদার করলেন—

-“তোর বউডারে তো লাগতো, আব্বা। পাঠায়ে দে। পলাশের কাছে বহুত শুনছি তার ব্যাপারে। সচক্ষে দেখতে না পাইলে কলজে তড়পাচ্ছে।ʼʼ

আরমিণ তখন বড়ঘরের লোহায় পা কেটে, জ্বর এসে অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে। জয় একবার আরমিণকে দেখে হেসে বলল, “কলজে তড়পানো কোনো বিশেষ ঘটনা না, কাকা। কলিজা তড়পাচ্ছে মানে হইলো আপনি জিন্দা আছেন। নয়ত এতক্ষণে হরি বোল..ʼʼ

-“না না, জয়। নাহ্। এই তড়পানি অন্যরকম রে। নিয়ে চলে আয়। ও জিনিস তো কবেই আমাগোর সম্পত্তি হইছে, তুই খালি বারবার কাইড়া নিছোস। আমি তরে স্নেহ করি, আমি আবার উল্টা কাইড়া নিলে কেমন দেখায় না? তুই নিয়ে চলে আয় আমার ফ্ল্যাটে। বুঝলি?ʼʼ

জয় দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে বলল, “আচ্ছাহ্! অপেক্ষা করেন তাইলে। আসতেছি। আজই আসি, নাকি কাকা? পলাশ ভাইরে আগেই কিছু জানায়েন না। কাউরেই জানায়েন না। পলাশ ভাইয়ের জন্য খুব ডিমান্ডেবল ব্যাপার আমার বউ, বুঝলেন? তারে সারপ্রাইজ দেব। আপনে কইলাম বইলেন না আগেই।ʼʼ

জয় আবার সেদিনই দুপুরে রওনা দিলো রাজধানীর উদ্দেশ্যে। হামজাকেও জানালো না। রাত এগারোটায় ঢাকা পৌঁছে একটু ড্রিংক করে, শহর ঘুরে রাজন আজগরের ফ্ল্যাটে ঢুকল রাত দেড়টার পর। একুশ তলা ভবন। রাজন আজগর থাকেন চৌদ্দ তলার লেফ্ট-ইউনিটে।

রাজন বললেন, “কই রে? সেই মহিয়সী কই? বাপরে, দম বন্ধ করে দেয় মাঝেমধ্যে। কোত্থেকে পাইলি বাপ এরম কড়া মাল? কই সে?ʼʼ

জয় ঠোঁট গোল করে খুব ধৈর্যশীলের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আনিনি, কাকা।ʼʼ

রাজন আজগর রসিকতা ভেবে হাসতে চাইলেন, কিন্তু তিনি জানেন জয়কে। বিভ্রান্ত হলেন, ধীরে ধীরে হিংস্রতা চাপতে লাগল ভেতরে।

জয় খুব হতাশ কণ্ঠে বলল, “যখন একটা সাধারণ মেয়ে ছিল, আমার চোখের বিষ ছিল, তখনই দেই নাই আমি। আইজ তো সে আমির পরিবারের বউ–কোয়েশ্চেন অফ ফ্যামিলি অউনার, কাকা। আপনি কি ঠিক করছেন আমির পরিবারের বউকে এইরকম সস্তাভাবে চেয়ে বসে?
যেইগুলারে আপনি বেচাকেনা করেন, সে কি সেইরকম কিছু? শ্যাহ্! আপনি ওরে চাইলেন সেইটা সমস্যা না, সমস্যা হইলো আপনে আমার পরিচয়ের ওপর হাত মারছেন।ʼʼ

জয় উঠে দাঁড়ায় এ পর্যায়ে, “আমি কে?ʼʼ

রাজন আজগর বুঝতে পারছিলেন না পরিস্থিতি। জয় কী চায়?

জয় রাজন আজগরকে খুব একটা শাস্তি দিয়ে মারল না। ভুলবশত বয়স্ক একজন মানুষ একটু বেয়াদবী করে বসেছে, এই আর কী! রাজন আজগরের বুকের ওপর উঠে বসে চোয়ালের একপাশ দিয়ে একটি মাঝারি আকৃতির ড্যাগার গেঁথে দিলো। একপাশ দিয়ে ঢুকে অপরপাশের চোয়াল ভেদ করে বেরিয়ে গেল তা।

জয় বলল, “আমি, জয় আমির। সি’জ মাই লেডি, মাই বেটার হাফ, নাও দ্য হেরিটেজ অফ মাহ্ ফ্যামিলি! কারবারের খাতিরে সব মাফ, কিন্তু ঘরের সম্মানে নজর রাখা মহাপাপ। কোনো লোটির বাচ্চা তোর মতো এমন সাহস করলেই একদম জবাই করে ফেলব। আমি এখনও বেঁচে আছি।ʼʼ

জয় করলও তাই। ড্যাগার দিয়েই রাজন আজগরের গলাটা ঘষে ঘষে কেটে ফেলল। ভোঁতভোঁত আওয়াজ হয়ে কণ্ঠনালি দু’ভাগ হলো, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসে জয়ের মুখ-বুক, শার্ট ও হাতে ভরে গেল। ঘাঁড়ের কাছে অল্প একটু চামড়ার সঙ্গে বাঁধিয়ে রাখল মাথাটা। যাতে তদন্ত ও দাফনের কাজে একটু সুবিধা হয়।

পরাগ মাথাটা চেপে ধরে বসে ছিল। তার কষ্ট লাগছে এমন নয়, কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছে এক প্রকার, আবার সাথে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। তার মনে হলো এটাই কি পার্থক্য নয় তার আর জয়ের মাঝে? জয় তার ঘাতকিনীকে নিজে লাঞ্ছনা ও যন্ত্রণা দিয়ে আবার পদে পদে নিজের ঐতিহ্যে লালন-পালন করেছে বরাবর। কিন্তু সে সেই নারীটির ওপর দূর্বলতা অনুভব করার পর জয় আমিরের মতো এই পাগলাটে দুষ্কৃতির আশপাশেও যেতে পারেনি। এটাই কি কারণ নয় যে জয় আমির সেই নারীটিকে লাভ করেছে আর পরাগ কেবল নীরব এক প্রতারক!

রউফ কায়সার কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখল জয় আমিরকে। তবু এই লোকের স্ত্রীর এত নিরাসক্তি এই লোকের ওপর? কেন? গল্পটা কি কোনোদিন শোনা দরকার না সেই নারীটির কাছে?

পরাগ দূর্বল গলায় আস্তে কোরে জিজ্ঞেস করল, “তোর প্রতিদ্বন্দীর খাতিরে বারবার এতকিছু করেছিস, তুই!?ʼʼ

জয় হাসল, “এক হেলেনের জন্য গ্রিকরা দশ বছর যুদ্ধ করেছিল, ফ্রগ! সেই হেলেন কিন্তু চরিত্রহীনা এক ঘাতকিনী নারী ছিল। যার জন্য গ্রীক বীরদের রক্তে ধুয়ে উঠেছিল ট্রয় নগরী। কারণ সে ছিল রাণী, গ্রীকদের সম্মান।ʼʼ

পরাগ হেসে উঠল, “তোর অবাধ্য রাণী!ʼʼ

জয় ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে হাসল, “রাণী কখনোই রাজার প্রতি ততটা অনুগত হয় না যতটা রাজ্যের প্রজারা। তবেই সে রাণী। আর রাণী ছাড়া রাজ্য ও রাজা দুটোই চাবিহীন তালার মতো। হয় অবরুদ্ধ নয় চূর্ণ-বিচূর্ণ, অথবা অকেজো-অসম্পূর্ণ!ʼʼ

পরাগ অদ্ভুতভাবে হেস মাথা দোলায়, “সব রাখ। তবে হেলেনের খাতিরে তুই যদি অ্যাকিলিস হতে যাস, তোর তাহলে মৃত্যু সুনিশ্চিত, তোর সাম্রাজ্যের ধ্বংসও–জেনে রাখ।ʼʼ

-“কোন শালা চিরকাল বাঁচতে জন্মাইছে রে?ʼʼ


একটা বুলেট জয়ের ডান হাঁটু থেকে বেশ কিছুটা উপরে বিঁধে ছিল, আরেকটা অন্ধকারের বদৌলতে বুকে না লেগে হাতের বাহু ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে।

কবীরের দেহের বিভিন্ন স্থানে তখনও থকথকে ঘা। তার ওপর জয়ের রক্ত শুকিয়ে লেপ্টে আছে। দূর্ঘটনার সময়টা অসময় ছিল। সেই অসময়ে বাঁশেরহাট মোড় থেকে আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজে জয়ের দেহ পৌঁছানো কবীরের জন্য দুঃসাধ্যই হয়ে উঠেছিল বটে। কবীরের হঠাৎ-ই মনে হলো–বড়ঘরে জয় যা করেছে, ঠিক করেছে। এই জয়ের আছে কে এবং কী হামজা ছাড়া? আজ হামজা থাকলে দিনাজপুর সদর এলাকায় কাঁপন ধরে যেত এই শেষরাতে। সেই হামজার ওপর হামলা করা লোকদের সাথে জয়ের ওই ব্যবহার একদম ঠিক।

কবীরের শরীরটা থরথর করে কাঁপছিল। জয়ের রক্তের দানা এত ভারী কেন? হাসপাতালে গিয়েও কবীর হামজার দাপটের কমতি অনুভব করল। তার কথায় কেউ তোড়জোর করে জয়কে এই অসময়ে অপারেশন রুমে শিফ্ট করছে না। হামজা এসে দাঁড়ালে হাসপাতালের জড় বেডগুলোও সচল হয়ে উঠতো।

ডাক্তার বললেন, “রক্তক্ষরণের মাত্রা অতিরিক্ত। এ অবস্থায় অপারেশন ঝুঁকিপূর্ণ। অপারেশন শেষে সেন্স না ফিরলে আমাদের কিছু করার থাকবে না।ʼʼ

কবীর হাতের কব্জি এগিয়ে দিলো, “ওই ডাক্তাল কী মনে হয় আপনার, আমার শরীলে কি রক্ত নাই? নেন নেন। এই যে রক্ত, নেন। কতখানি লাগবে, কয় ব্যাগ কয় ব্যাগ?ʼʼ

কবীরের পাগলামিকে অগ্রাহ্য করে ডাক্তার বললেন, “রোগীর রক্তের গ্রুপ ও-নেগেটিভ। রেয়ার এনিহোয়ার। দ্রুত জোগাড় না করতে পারলে রোগীর কোমায় যাবার সম্ভাবনা রয়েছে, সেন্স ফেরার নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। যা করার দ্রুত করুন।ʼʼ

কবীর কী করবে এবার? সে অনেকক্ষণ হাপাতালের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে রইল। ও-নেগেটিভ রক্ত দুনিয়ায় বিরল। এই রক্ত নেই দুনিয়ার মানুষের। পরে তার মনে পড়ল জয়ও তো নেই দুনিয়ায় অহরহ! আরও মজার ব্যাপার হলো ও-নেগেটিভ রক্তওয়ালা সবাইকে রক্ত দিতে পারলেও সে নিজে শুধু ও-নেগেটিভ রক্ত নিতে পারবে, আর কারওটা না। এটাও কি জয়ের ভালোবাসার মতো?

কিন্তু জয়কে হামজা ভালোবেসেছে, ভালোবাসতে পেরেছে, পাগলের মতো। তার রক্তের গ্রুপও ও-নেগেটিভ– কারণটা বোধহয় এটাই!

ছেলেদেরকে বিকেল পর্যন্ত থামিয়ে রাখল কবীর এই খবর হামজাকে দেয়া থেকে। হামজা উন্মাদ হয়ে উঠবে এই খবরে, যেখানে সে নিজেও জখম। কিন্তু বুলেট অপসারণ করে জয়কে বেডে দেবার কয়েক ঘন্টা পরেও সে চোখ খুলে তাকিয়ে হেসে উঠল না।


দিনাজপুরের পুলহাট পুলিশ ফাঁড়ি থেকে রাত একটায় দুজন বেরোলো। জয়ের ডানহাতে হ্যান্ডকাফ ঝুলছে তখনও। কেবল বাম হাতটাকে মুক্ত হয়ে দেয়া হয়েছে।
পাশের চায়ে দোকানে ঢুকে দোকানির কাছে এক প্যাকেট সিগারেট চাইল। দোকানি সিগারেট দিলে হুরহুর করে বেরিয়ে আসছিল। খুপরি থেকে। পেছন থেকে ডাকে দোকানি, “আমার ট্যাহা দিবা না?ʼʼ

-“বাকি খাইলাম। পরে-টরে দেব। ট্যাহা নাই আমার কাছে। ওহ্, মনেই নাই। শ’দুয়েক টাকা ধার দেন তো। গাড়ির ভাড়া নাই আমার কাছে।ʼʼ

দোকানি চোখ গোল্লা করে বলল, “অ্যাহ্!ʼʼ সে বুঝল না, এই ছ্যাঁড়া কী কয়! একে তো বাকি সিগারেট, তার উপর টাকা ধার!

জয় এগিয়ে গিয়ে দোকানির কানের কাছে বলল, “আপনের দুকানে কোনোদিন চাঁদা তুলতে আইছে আমার চ্যাংরারা?ʼʼ

দোকানি নিজের ভালো বোঝে। এসেছে বললে বিপদ হতে পারে বুঝে ঘাঁড় নাড়ল, “নাহ্, আহে নাই।ʼʼ সে মূলত জানে না জয়ের ছেলেরা তার কাছে চাদা খেয়েছে কিনা।

জয় বলল, “ব্যাস, শোধ-বোধ। যদি ধরেন টপকে-মপকে যাই, এই ট্যাকার দায় আবার বাঁধায়ে রাইখেন না। মাফ করে দিয়েন।ʼʼ

রাস্তায় চলার সময় সিগারেট টানতে টানতে গান ধরল,
আই অম এ ডিস্কো ড্যান্সার
বিড়ি খাইলে হয় ক্যান্সার…

পথে ডাবে ভরপুর নারকেল গাছের দেখা মিলল। মাস ছয়েক কোনো নারকেল গাছে হামলা দেয়া হয় না। শুধু চেহেলগাজী ইউনিয়ন না, দিনাজপুর সদরের প্রায় সব গাছের নারকেল তাদের পেটে যায়। গাছওয়ালা সন্ধ্যায় নারকেল গুণে রাখে, সকালে গাছ পরিস্কার। পেঁপে, পেয়ারা, আমের ক্ষেত্রেও ঘটনা এক।

পরস্পরের সাথে চোখাচোখি করে হাসে দুজন। হুট করে জীবনটা গম্ভীর হয়ে গেছে। আগে জটিল ছিল, কিন্তু ছিল ছন্নছাড়া। এখন ভারী হয়ে গেছে।

বাড়ির রাস্তা তুলনামূলক বেশি গুমোট লাগল। যেন কিছু ঘটেছে ঘটেছে বা ঘটবে নিশ্চয়ই। সে যে আশঙ্কা করে বাড়িতে ঢুকল, তার সূক্ষ্ণ চিহ্ন ছিটে আছে স্থানে স্থানে। গতরাতে তাকে নিয়ে যাবার পর পরই উন্মত্ত দল রাজধানীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। বাড়ির পাহারায় যে দু’একজন রয়ে গেছিল, তাদেরকে পেল বাহির বাড়ির খোলা বারান্দার এক কোণে। ভয়ানক জখম তারা। হামজার নির্দেশে সবসময় পরিপাটি পাটোয়ারী বাড়ির আঙিনায় লন্ডভন্ড হাল জয় অন্ধকারেও টের পেল–অনেকগুলো পায়ের বিক্ষিপ্ত পদচারণা চলেছে বারবার।

এমপির দুটো ছেলে দৌড়ে এলো কোত্থেকে যেন জয়কে দেখে। জয়কে ঘুরে ঘুরে সব দেখাল। বড়ঘরের বাইরের লোহার দরজা হাতরালো। পুরোনো বিশাল তালাখানা ভেঙে নিচে পড়ে আছে, আর শাবলটাও। সিটকিনিতে নতুন তালা লাগানো। জয় হাসল একচোট। অসুস্থ কবীর বোঝার চেষ্টা করছিল সবকিছু।

-“ভাই, এইসব কারা করতে পারে?ʼʼ

-“মুরসালীনের শুভাকাঙ্ক্ষীরা।ʼʼ

-“জঙ্গির দল?ʼʼ

জয়ের আন্দাজ বাস্তবের চেয়ে শক্তিশালী। সে মাথা নেড়ে হাসল বলল, “হ, আনসারী মোল্লা মনেহয়, কবীর। মজার ব্যাপার কী জানিস? আমার ঘরওয়ালির আয়োজন এইসব।ʼʼ

কবীর চমকে উঠল, “ভাবী?ʼʼ

জয় সেই শাবল দিয়েই দোতলার সদর দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকল। রিমি চাবি কোথায় রেখে গেছে, জানা নেই। রুমে ঢুকে লুঙ্গি পরতে পরতে কবীরকে বলল, “বড়সাহেবের রুমে যা। বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে চাবি আছে। দেখ আবার সেখানে আছে নাকি মুরসুর শুভাকাঙ্ক্ষীরা সঙ্গে নিয়ে গেছে।ʼʼ

-“আমি?ʼʼ ইতস্তত করে কবীর

-“যা, শালা। ভাবী নাই এখন, যা।ʼʼ

সে তো সেই আমির নিবাসেই আন্দাজ করেছিল অন্তূ ভয়ানক কিছু ঘটিয়েছে, কিন্তু সেটা এতকিছু, তা ভাবার ফুরসত পায়নি। হেসে ফেলল সে। ঘরে সে আসলেই এক ঘাতকিনীকে পালছে। এত নিখুঁত পরিকল্পনাকারী তার স্ত্রী, এটা ভেবে গর্বে বুক ফুলাতে গিয়ে আবারও হেসে ফেলল। যোগ্য স্বামী থুক্কু যোগ্য আসামীর যোগ্য বউ। নাহ্ আইনজীবী।

বড়ঘরে ঢুকল জয় তিন চারখানা মদের বোতল সঙ্গে নিয়ে। তার গ্লাসে ঢেলে পানি অথবা মদ কোনটাই পান করার অভ্যাস নেই। পানি জগ ধরে, মদ বোতল ধরে। সিঁড়ির তালা বাইরে থেকে ঠিকঠাকই বন্ধ। সিঁড়ি পেরিয়ে প্রথম ইউনিটে পা রাখতেই খচ করে পায়ে কিছু গেঁথে গেল। জয় কবীরকে ধাক্কা দিয়ে সামনে সরিয়ে বলল, “সাবধান। শালারা মনে হয় কালাজাদুটাদু করে রেখে গেছে। লাইট-মাইট সব ভেঙে অন্ধকার করে কালাজাদু করছে, বুঝলি?ʼʼ

আন্দাজমতো বড়ঘরের স্পট লাইটখানাও ভাঙা পেয়ে ভেতরে আরও আত্মবিশ্বাস টের পেল জয়। বহুদিন পর অসুস্থ শরীরে বড়ঘরে ঢুকে কবীর অস্বস্তিতে গুটিয়ে যাচ্ছিল। আচমকা দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলে চমকে উঠল।

জয় মদের বোতলের মুখে দিয়াশলাই মেরেছে। নীল আগুন জ্বলে ওঠার সাথে সাথে মুখে “হু হুউউ হুহ্!ʼʼ রকমের আওয়াজ করে ছুঁড়ে মারল সামনের দিকে। উন্মাদের মতো কাজ। সামান্য আলোয় দৃশ্যমান মেঝেতে লুটিয়ে থাকা কয়েকটি দেগুলোর পশম ছুঁয়ে ছুটে গেল বোধহয় বোতলটা, বিকট আওয়াজে ভেঙে কাচগুলো ছিটিয়ে গেল চারদিকে। জয় খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল। সবগুলো হাতছাড়া হলে সে নিজেকে সামলাতে পারতো না। আজ তার রক্ত চাই-ই-চাই।

দ্রুত চার্জার লাইট জ্বালায় কবীর। জয় খুঁড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে মুরসালীনের সামনে বসে। কবীর আঁৎকে উঠল। পায়ের তালুতে তিন ইঞ্চিমতো ফেঁড়ে গেছে, এক টুকরো কাচ বিঁধে আছে। জয় এক টানে তা তুলে ফেলল, রক্ত ছিটে এলো খানিকটা। সেই ক্ষততে গবগব করে খানিকটা মদ ঢাললো। অ্যালকোহল ভালো জীবাণুনাশকের কাজ করে।

মুরসালীনসহ চারজন যুবক ও আব্দুল আহাদ এবং তার সমবয়সী তিনজন কিশোর এখন বড়ঘরের বাসিন্দা। তারা বিগত দু’দিন পানি ও খাবারবিহীন। এ বাড়িতে তাদের একজন মমতাময়ী ছিল, সে আমির নিবাসে বন্দিনী। পিপাসায় কাতর প্রাণগুলোর শক্তি নেই সামান্য মাছিকেও প্রতিহত করে হাত নেড়ে। যুবক চারজন অচেতন। ওদের শরীরের ক্ষততে ইনফ্রাকশন ধরে গেছে, সেখানে মাছি উড়ে বদরক্ত ও পুঁজের গন্ধ শুঁকছে। জয়ের সামনেই মুরসালীন বমি করে ফেলল আবার। শুধু পিচ্ছিল মিউকাসের থকথকে রক্ত উঠে এলো।

জয় জিজ্ঞেস করে, “তুই যাসনি ক্যা, মুরসালীন? আমার টানে রয়ে গেছিস?ʼʼ

মুরসালীন কথা বলতে পারল না। জয় বোতল খুলে বসল। একেবারে ঢকঢক করে এক বোতল শেষ করে ছেলে দুটোকে ডেকে বলল, “এই চারটাকে পাশের ঘরে নিয়ে যা।ʼʼ

জয় পিছে পিছে গিয়ে কুকুরগুলোর সামনে পরিবেশন করে এলো দেহগুলো। কুকুরগুলো মাংস খেয়ে অভ্যস্ত–পিট বুল। নামকরা মাংসাশী জাত। তারা জয়ের কাছে আসার পর থেকে প্রায় সময়ই ক্ষুধার্ত থেকেছে। আজ চারটে রক্তাক্ত আধমরা মানবদেহ পেয়ে খুবই সন্তুষ্ট হলো জয়ের ওপর। ছেলেদুটো কক্ষের দরজা বাইরে থেকে আঁটকে দিলো। কবীর দাঁতের মাড়ি শক্ত করে চোখ বুজে রইল। জয়ের অনেক কর্মকান্ড আছে যা তাকে ভীত ও অপ্রস্তুত করে তোলে।

পাশের ঘর থেকে রক্ত ঠান্ডা করা আওয়াজ আসছিল। তাজা রক্ত-মাংস ছিঁড়েছুটে আসাও চারটে ক্ষুধার্ত কুকুরদের মাঝে টানা-হেঁচড়ার আওয়াজ মিশে একটা অসুস্থ পরিবেশ তৈরি হলো। মুরসালীন তবু অনড় বসে রইল দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে। সে শুধু আন্দাজ করার চেষ্টা করল–আজ আনসারীর কথায় সেও যদি যেত ওদের সঙ্গে, জয় ঠিক খুঁজে বের করতো ওদেরকে, তাহলে জয়ের ব্যবহার কেমন হতো?

একসময় ওপাশের ঘরের আওয়াজ কমে এলো। জয় আর দেখলও না কুকুরগুলো তৃপ্তি পেয়েছে কিনা, তাদের ক্ষুধা মিটেছে কিনা অথবা শিকারগুলোর শরীরে আর কী পরিমাণ মাংস অবশিষ্ট আছে, আর কয় বেলা তারা নিজেদের ক্ষুধা নিবারণ করতে পারবে দেহগুলো থেকে।

সে আরাম করে বসে আরও খানিকটা মদ পান করল।
এরপর মুরসালীনকে জিজ্ঞেস করল, “মরার আগে একটা প্রশ্নের জবাব দে, জিন্নাহর সাথে কী হয়েছিল? হামজা ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞেস করার সুযোগ এখনও হয়নি, তুই বল।ʼʼ

মুরসালীন কাশল বেশ কয়েকবার। হাতদুটো মাথার নিচে দিয়ে আস্তে কোরে শুয়ে পড়ল মেঝের ওপর কাত হয়ে। নাক দিয়ে রক্ত আসছে। শরীরটা, বিশেষত হাতদুটো থরথর করে কাঁপছে তার। সেই হাতে সে নিঃশব্দে জয়ের দিকে এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল, “আম্মাকে দিবি এটা।ʼʼ

জয় উত্তর পেল না। মুরসালীন আরাম করে পড়ে রইল নিজের বিদ্ধস্ত দেহখানা নিয়ে। চোখ বুজলে একটা সুন্দর মৃত্যু তাকে ডাকছে। সেখানে হাহাকার নেই, বন্দিত্ব নেই, নেই রক্ত, শরীরের চিৎকার, নেই নিপীড়ন, ক্ষমতার তুলনা…
মুরসালীনের কানে এখন আর এমদাদ, তৌফিক, নাঈমদের আর্তনাদ ও কুকুরদের ভোজের আওয়াজ বাজছে না। ওরা এখন মুরসালীনের চেয়ে সুখী। মুরসালীনের দুর্ভাগ্যের ওপর নিশ্চয়ই হাসছে!

কেননা মুরসালীন এখন চোখের সামনে তিন কিশোরের মৃত্যু দেখার সম্ভাবনা নিয়ে বসে। এই ভার থেকে তারা মুক্ত হয়েছে। তওফীক, আব্দুল আহাদ ও হাবিবুল্লাহ্কে কোনোক্রমেই নিয়ে যাওয়া যায়নি। তারা মুরসালীন ভাইকে রেখে যাবে না। ওদের বোকামির ওপর মুরসালীন হাসল। ওরা কি জানে না মুরসালীন ভাইয়ের সাধ্যি নেই ওদেরকে রক্ষা করার! মুরসালীন একটা পাপ করল। সে নিজের মৃত্যু আগে চাইল। এটা মহাপাপ কিনা জানে না মুরসালীন। কিন্তু চোখের সামনে ছোট ছোট কিশোর প্রাণগুলোর ঝরে যাওয়া দেখার সাহস মুরসালীনের নেই। কিন্তু দেখতে হলো।

জয় চারটে গুলি খরচা করল তওফিক ও হাবিবুল্লাহর খাতিরে। আব্দুল আহাদের চোখদুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল তখনও। কিন্তু কখন যে তা জলে টসটসে হয়ে উঠল। তার আব্বা নেই। মায়ের আরেক ঘরে বিয়ে হয়েছে। নানীর বড় সাধ ছিল আব্দুল আহাদ হাফেজ হবে। বিশাল বড় ধার্মিক হবে। নানীর হাঁপানি আছে। সে শেষবার নানীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাদ্রাসায় আসার পথে নানীকে বলেছিল, ‘এবার আসার রমজানের ছুটিতে বাড়ি আসার সময় মুরসালীন ভাইয়ের কাছ থেকে শ’তিনেক টাকা নিয়ে তোর জন্য একখানা নতুন ইনহেলার কিনে আনব। সারাদিন হুক্কুর হুক্কুর করে কাশিস।ʼ

কেনা হলো না। নানীকে তার দেখা হয় না কতগুলো মাস। আচ্ছা, নানী কি আর তাকে… মরা আহাদকেই, দেখতে পাবে কী? সে মুরসালীনের সামনে গিয়ে বসে বুক পেতে দেবার মতো করে তাকিয়ে রইল। তার একবার ওই আপাটির কথা মনে পড়ল। তার মনে হলো ওই আপাটি এখন থাকলে নিশ্চয়ই এই জয়কেই গুলি করে মেরে ফেলতো, তবু আব্দুল আহাদ আর মুরসালীন ভাইয়ের কিছু হতে দিতো না।

জয় খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে হেসে আব্দুল আহাদকে টেনে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। তার লম্বা দেহের তুলনায় আব্দুল আহাদ জয়ের বুক পর্যন্ত লেপ্টে রইল। এক হাত দিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখে পিঠের ঠিক বামভাগে, যেখানটায় সামনের দিকে হৃদযন্ত্র থাকে সেইখানে মুজেল ঠেকিয়ে ট্রিগার চাপল।

আব্দুল আহাদের হৃদপিন্ড ফুঁড়ে এসে সবটুকু রক্তই জয়ের বুক, লুঙ্গি, মুখ, হাতে ভরে গেল। জয় চোখদুটো বুজে তার অটোসেমি বেরেট-92FS পিস্তলের আরও চারখানা গুলি বড় তৃপ্তির সাথে আব্দুল আহাদের দেহকে সামান্য আলগা করে বুকে বিঁধাল। তার ঘরওয়ালি তার সাথে যে বিরোধিতার আয়োজন করেছে, তাতে আব্দুল আহাদের ওপর ঘরওয়ালির স্নেহের ভাগ অনেকটা। এদেরকে মুক্ত করার জন্যই এত আয়োজন। তাই জয় সেই আব্দুল আহাদের দেহটাকে তৃপ্তিমতো ঝাঝরা করল।

অন্তূ জানলে নিশ্চয়ই বলতো, জয় আমির মানসিক ভাবে অসুস্থ। পলাশকে পাগল বলা জয় আমির নিজেও স্যাডিস্ট।

চলবে…

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৭৯.

আব্দুল আহাদের দেহটাকে জয় ছেড়ে দেবার পরেও পড়ল কয়েক মুহূর্ত বাদে। কে জানে মৃত্যুর আগে কেন আব্দুল আহাদ আরমিণের ওড়নাখানা মুঠোয় চেপে ধরেছিল। হয়ত সব নারীতে মা লুকিয়ে থাকে তাই, আর তাদের আবরণের আঁচলে মমতার গন্ধ! এতিম আব্দুল আহাদ শেষবার সেই মমতাটুকুই অন্তূর ওড়নার প্রান্তে খুঁজেছিল, যে ওড়না জয় আমির বুক ছুঁয়ে ঝুলছিল তখন।

জয় মুরসালীনকে মারল না। মুরসালীনকে অতগুলো ছোট ছোট প্রাণহারা দেহের মাঝে নরকের মেঝেতে শুইয়ে রেখে লুঙ্গির নিচ পৃষ্ঠে হাতের রক্ত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো বড়ঘর ছেড়ে। আরমিণকে নিয়ে তাকে দেশ ছাড়তে হবে আজ রাতেই। তার কাছে এমপির কাজ ছিল বড়ঘরে লাশ বিছানো। তা সম্পন্ন হবার পর এমপি আর কেন ছাড় দেবে তাকে অথবা আরমিণকে?

হঠাৎ জয় ফিরে এলো। এক হাঁটু গেঁড়ে বসে দায়সারা হাতে মুরসালীনের মাথাখানা উরুতে ঠেকিয়ে ঠোঁটের কাছে পানির গ্লাস ধরে বলল, “হা কর।ʼʼ

তিনদিন পর সামান্য একটু পানি খাদ্যনালি পেরোতেই গলগল করে রক্তবমি উঠে এলো। জয়ের লুঙ্গিতেও লাগল। তাতে একটুও হেলদোল হলো না জয়ের। সে আরও খানিকটা পানি মুরসালীনকে পান করালো। উঠে যাবার সময় বিরবির করে বলল, “আত্মত্যাগের কুড়কুড়ানি যাদের থাকে, তাদের তোর মতো দড়ি ছিঁড়ে গোয়ামারা খাওয়া ছাড়া আর কী? কাল পালাসনি কেন? আমি কি মহান? এখন তোকে নিজ হাতে ছেড়ে দেব?ʼʼ

মুরসালীন বুঝল, সে খুব শীঘ্রই চেতনা হারাবে। তার মস্তিষ্কে অতিরিক্ত চাপ ও যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। দম আঁটকে আসছে। তবু সান্ত্বণা পায়–বাকি শিশুরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে মায়ের আঁচল ছুঁয়েছে! বন্দি মুরসালীনকে সত্যি জানাবে কে?

গতরাতটা শেষ সুযোগ ছিল আনসারী সাহেবের জন্য। হামজা হাসপাতালে, জয়কে অ্যারেস্ট করবে রউফ কায়সার, সেই ফাঁকে কিছু না করতে পারলে জান যাবে সবার। বাড়ি পাহারায় তখনও বেশ কয়েকটা ছেলে থাকার পরেও এলেন তিনি। হাতাহাতি হলো, ধাতব-অস্ত্র চলল টুকটাক। বিশাল প্রাচীর ঘেরা হামজার নগরী ওটা। তার একপাশে সচ্ছ পুকুর, ওপরপাশে বাসভবন, সামনে ওয়ার্কশপ, পেছনে পঁচা পুকুর, যেখানে হামজার মেশিনের বর্জ্য পদার্থ যায়। আশপাশে কেউ নেই ভেতরের আওয়াজ শোনার। রাত দশটা বাজতেই হামজার বাড়ির কয়েক গজ দূরত্বে লোক চলাচল কমে আসে। এসব বাড়ির শব্দরাও জানের শিকারী। এসব বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটতে হয় বোবা ও কালাদের। যে লোক কানে শোনে ও কথা বলতে পারে তার উচিত না রাতে বাড়ির আশেপাশে ঘেষা। কতরকমের শব্দ হতে পারে, সেসব শুনে ফেলার পর আর কোনোদিন দুনিয়ার কোনো আওয়াজ না শুনতে পাবার সম্ভাবনা সিংহভাগ। কারণ প্রাণ না থাকলে কান আর জবান কাজ করে না।

ছেলেরা কয়েকজন ধরাশায়ী ও আহত হলো। কোনোরকমে বাচ্চাগুলোকে বের করে এনে ছোট্ট একখানা মালগাড়িতে তোলা হলো। তখন আনসারীর হৃদযন্ত্রে কেউ হাতুর ঠুকছে। আনসারী সাহেব অতি দুঃখে বোকা বনেছেন কিনা জানা নেই। কিন্তু তিনি ভাবলেন মালগাড়িতে যখন তোলা হয়ে গেছে, ওরা ওদের বাড়ি বোধহয় এবার পৌঁছাবে।

কিন্তু মুরসালীন যাবে না। তিনি কেঁদে ফেললেন। দাড়ি ভিজে উঠল। মুরসালীন উনার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে কপাল ঠেকায়, “চাচা, আজ আমি ওদের সাথে গেলে ওরা বাড়ি ফিরেও স্থায়ী হবে না। আমার খোঁজে খোঁজে ঠিক আবার ওদের জায়গা এরকম কোনো কালকুঠুরী হবে। হামজারা আমাকে বন্দি অথবা মৃত না দেখা অবধি সামান্য শান্তও হবে না। আপনি ওদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলবেন না আমায় বাঁচাতে চেয়ে। এই তো বেঁচে আছি আমি। এই চিঠিটা নিয়ে গিয়ে বড় হুজুরসাহেবের কাছে দেবেন, উনি যেন মাদ্রাসাসহ সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। আর একটা প্রাণের ভারও বইবার সাধ্যি আমার এই ভঙ্গুর কাধে নেই। আমি আমার রবের কাছে কী জবাব দেব? ওরা অনেক কোরআন শিখেছে। এবার বেঁচে থাকুক। নারায়ে তকবীর।ʼʼ

বাকিরা উচ্চস্বরে বলে উঠল, “আল্লাহু আকবর!ʼʼ

সবাই উঠল আনসারী সাহেবের সাথে। কেবল গেল না চার আধমরা যুবক ও তিন পাগল কিশোর। মুরসালীন ভাইয়ের সাথে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে তবু ভাইকে না নিয়ে ফিরে যাবে না।

আনসারী সাহেব চোখ মুছে বেরিয়ে গেলেন। তাঁর সেদিন রাতের সরলতার ওপর ধিক্কার দেয়াই যায়–তাঁর মালগাড়ি আটক হলো এমপির কাছে চারমাথার মোড়ের অদূরে। সকাল সকাল পুলিশ এসে তাঁকে এমপির ডেরা থেকে দেশোদ্রোহী হিসেবে ও তাঁর সাথে আসা জোয়ানদেরকে লাল-কমলা ইয়াবা বড়ি পাচারকারী হিসেবে ধরে নিয়ে গেল। মালগাড়ি থেকে বাচ্চাগুলোকে নামিয়ে নতুন নরক এমপির বাড়ির বেসমেন্টে জায়গা দেয়া হলো। মালগাড়িটা থানার হেফাজতে গেল স্মাগলিং-ভেহিকলস হিসেবে। সেদিন রাতের গল্প শেষ।

পরদিন রাতে এমপির সাহেবের মনমতো ঘটনা ঘটতে গিয়েও ঘটেনি। রোজ পরিকল্পনা একমতো কাজ দেয় না, এ এক সমস্যা বটে। আগের রাতে যেভাবে চমৎকারভাবে কতকগুলো জঙ্গি উনি শিকার করেছেন, পরদিন রাতে সেরকম নিখুঁতাভাবে তার লোক জয় আমিরকে আজরাইলের হাতে তুলে দিতে পারেনি। জারজটা এখনও হাসপাতালে পড়ে আছে। সমস্যা হলো, ছোকরারা ঘিরে আছে কেবিন। নয়ত ওখানে গিয়েই শেষ আশাটুকু রদ করে আসলে নিশ্চিন্ত হতে পারতেন তিনি। এখন জয়ের মরা-বাঁচা গলার কাঁটার মতোন বিঁধে আছে গলায়। এমপি সাহেব তাই খুবই খুশি হতে চেয়েও পারছেন না।


সমস্যাটা হলো–কবীর যখন কলে রিমিকে বলছে, “বড়ভাবী সর্বনাশ হয়ে গেছে, ভাবী। জয় ভাইয়ের গুলি লাগছে।ʼʼ

কবীরের ভেজা কণ্ঠ ও খবরখানা রিমির তরল মনকে ছলকে দিলো। সে ভুলে গেল সে বসে আছে হামজার চোখের সামনে। তার ওপর তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, “জয়ের…ʼʼ

ব্যাস! ছোঁ মেরে ফোনটা কেঁড়ে নিয়ে হাতের সেন্সর ক্লিপ খুলে উঠে বসে পড়ল হামজা, “কী হইছে রে, কবীর? জয় কই? কই ও? কী বলছিলি তুই? বল বল!ʼʼ

ওপাশে কবীরের দম আঁটকে গেল। হামজা গর্জে উঠল, “বল হারামজাদা! নয়ত একদম সামনে পেলে জিহ্বাটা একটান মেরে ছিঁড়ে আনব।ʼʼ

কথাটা সত্য। হামজা সত্যিই তা-ই করবে। থরথর করে কাঁপা গলায়, “জয় ভাইরে কারা জানি গুলি করছে ভাই। কিছু হয় নাই তেমন…ʼʼ

-“চুপ, খানকির বাচ্চা।ʼʼ

কবীর থরথরিয়ে উঠল।

-“একদম সত্যিটা বল। যেন ধর আমি এখানে বসে লাইভ দেখতেছি। তোর কি মনেহয় হামজা পুঁটিমাছের জান নিয়ে দুনিয়ায় এসেছিল? একটু হাওয়া দিলেই মরমর কোরে ওঠা ছনের ঘরের মতো ভিতরে আমার কইলজার?ʼʼ

কবীরের কিন্তু এবার একটুও ভয় লাগল না। হামজার এই কথা শুনে যে কেউ ভাববে এ তো বড় শক্ত কথা, কবীর জানে হামজার কলিজা এখন ইতোমধ্যে গুড়িয়ে পড়া ছনের ঘরের মতো অবস্থা। জয় যে খুঁটি সেই ঘরের।

কবীর কেঁদে ফেলল, “ভাই, জয় ভাইয়ের রক্ত লাগবে। রক্ত নাই কুত্থাও। কোনোহানে পাই নাই। আর্জেন্ট রক্ত দরকার।ʼʼ

হামজা কল কাটার আগে শুধু বলল, “যদি আমাকে দেরিতে জানানোর কারণে জয়ের অসুস্থতার এক ফোঁটাও বাড়ে রে কবীর, তোর বংশ আমি দুনিয়া থেকে মুছে তুলব– বলে দিলাম। আর কেউ জন্মাবে না সেইখানে, যারা জন্মেছিল থাকবে না। বাস্টার্ড!ʼʼ

ততক্ষণে সে ক্যানোলা টান মেরে খুলে ফেলায় হাতের পিঠে এক পাঁজা রক্ত, হাতের শিরা ফুলে টসটসে হয়ে উঠেছে। রিমি জাপটে ধরল, “শুনুন আমার কথা, এই!ʼʼ

-“জীবনে আমার হাতে মার খাওনি, রিমি,না? আজ প্রথমদিন হতে পারে। আমার ফতোয়া-পাঞ্জাবী অর এনি আউটফিট কিছু এনেছ?ʼʼ

রিমি ছলছল চোখে হামজার বুকের সামনে পথ আগলে কাছে এসে দাঁড়ায়, “মারুন। তাই মারুন। তবু এই শরীরে ছুটতে ছুটতে যেতে পারবেন না। আমরাও যাব। কাল সকালে রওনা দেব। আপনার ইঞ্জেকশন চলছে। আমি থেরাপির এপয়েনমেন্ট নিয়েছি। অন্তত আর একটা সপ্তাহ থাকতেই হবে এখানে। আপনি বুঝতে পারছেন না।

-“এক সপ্তায় ওদিকে আমার দাফন হয়ে যাবে। তুমি কি মনে করো আমি আমার এই এক দেহের মধ্যে বেঁচে আছি? আমার কর্ষিকাগুলো দিনাজপুর পড়ে আছে, রিমি।ʼʼ

হামজার ইশারায় এগিয়ে এসে দুটো ছেলে হামজাকে শার্ট পরিয়ে দিলো। হামজা রিমিকে থুতনি ধরে চুষে একখানা শক্ত চুমু খেলো ঠোঁটে। এরপর আচমকা তার মনে হলো সে যেন হাজার বছর দাঁড়িয়ে। মেরুদণ্ড অবশ তার, ধুপ করে কোমড় ভেঙে বসে পড়ল বেডের ওপর। নিচু হয়ে হেসে মাথা তুলে বলল, “আমার কী হয়েছে, রিমি? ডাক্তার কিছু বলেছে তোমায়? আমায় তো বলবে না শালারা। কী হয়ে গেছে আমার?ʼʼ

রিমির সবচেয়ে প্রচলিত ভাষা কান্না। বিশেষ কোরে এই পুরুষটির সম্মুখে। কয়েকটা টিস্যু ছিঁড়ে হাতে চেপে ধরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে যায় হামজা। পিছু নেয় রিমি। তুলি গিয়ে হামজার আরেক বাহু চেপে ধরল। কোয়েল সবার আগে হাঁটছে। হামজা বোন ও স্ত্রীর কাঁধের ওপর বিশাল শরীরের প্রায় সম্পূর্ণটুকু ভর ছেড়ে দিলো। উপায় নেই। তার শরীরে স্নায়ু অকার্যকর লাগছে। পেছনে হামজার ছেলেরা, দুজন ওয়ার্ডবয়। তারা হুইল চেয়াল এনেছিল। হামজা বসল না। ওটা অসম্মানজনক, তার আগে হামজা মরে যাবে তবু পঙ্গুত্ব বরণ তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে মেরুদণ্ড ভেঙে বসে থাকবে পঙ্গুর মতো আর আরেকজন মেরুদণ্ড সোজা কোরে তাকে নিজ শক্তিতে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাবে, এর আগে হামজা মরে যাবে। তবু এই ধরণের সেবা গ্রহণ করা সম্ভব নয় তার দ্বারা। একজন প্রাইভেট ডাক্তার সাথে চলল ভ্রাম্যমান অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য।

নিজস্ব গাড়ির অবস্থা বেহাল। ভাড়া গাড়িতে রিমির কাধ ও বুকের মাঝ বরাবর মাথা রেখে চোখ বুজে পড়ে রইল হামজা। রিমি কিন্তু টের পাচ্ছে হামজার বুকের ধুকপুকানি। সে অবাক হয় সাথে ঈর্ষান্বিত–জয়ের জন্য এই লোকের বুকে এত তোলপাড় চলবে কেন? বাইরে থেকে মুখটা দেখলে মনে হবে দুনিয়ার সকল নিষ্ঠুরতা ওখানে আশ্রয় পেয়ে খুব আরামে আছে। কিন্তু অসুস্থ হামজার বুকের কাঁপুনি রিমিকে অবধি কাঁপিয়ে তুলল।

এখন কি রিমির বলা উচিত লোকটার নিজের শরীরের অবস্থা কী? যে অবস্থা রিমির ঘেন্নায় ভাঙন ধরিয়ে দেবার জোগাড় কোরেছে!

আজ দুপুরের পর ডাক্তার আলাদাভাবে রিমিকে ডেকে নিয়ে বললেন, হামজা মেরুদন্ডে ভয়ানক আঘাত পেয়েছে সেদিন। অর্থাৎ স্পায়নাল কর্ড, যা সরাসরি প্রধান স্নায়ুর সাথে যুক্ত। এবং আঘাতের ফলে মেরুদন্ডে ব্লাড-সার্কুলেশন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এতে ধীরে ধীরে মেরুদন্ডের কোষগুলো মরে যাবে। ইমফ্লেমেশন তৈরি হবে। ইমফ্লেমেশনের ভয়াবহতাই হলো–প্রথমদিকে সাধারণ মনে হয়, ধীরে ধীরে…. অনলি অ্যা হিউম্যান হ্যাজ টু বিকাম সেন্সরিয়ালি-ডেড!

প্রথমবার চেতনা ফিরে পাবার পর থেকেই হামজা পিঠে অনুভূতি টের পাচ্ছিল না ও মেরুদন্ডের আশেপাশের দৈহিক অংশ অবশ অনুভূত হচ্ছিল। এটা কয়েক সপ্তাহ বা কয়েকদিনের ব্যবধানে পারমানেন্ট-প্যারালাইজেশনে রূপ নিতে পারে। হামজার কন্ডিশন সেদিকেই এগোচ্ছে। তারওপর সে সবসময় ভীষণ মানসিক চাপে থাকে, চিকিৎসা নিতেও খুব অনাগ্রহী। এই অসময়ে চিকিৎসা ছেড়ে যাওয়াটা তার জন্য অপূরণীয় ক্ষতিকর হতে পারে।

শেষে ডাক্তার সাহেব ব্যক্তিগতভাবে বড় আফসোসের সঙ্গে মাথা নেড়ে বললেন, মেরুদণ্ড (স্পায়নাল কর্ড) মানুষের দ্বিতীয় প্রধান স্নায়ুতন্ত্র। যেকোনো ধরণের নিউরোলজিক্যাল, সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম অর প্যারালাইজেশনে স্থায়ীভাবে ভুগতে হতে পারে। খুব তাড়াতাড়ি বড় একটা সার্জারি অথবা থেরাপির ডোজ শুরু না করলে পরে চেয়েও আর কিছু করার থাকবে না।

কিন্তু হামজা যেন পারলে যখন-তখন পালাবে হাসপাতাল ছেড়ে। সে জানে তার অনুপস্থিতিতে সব ভেসে যাচ্ছে ওদিকে। অথচ সে বুঝল না–ধ্বংস ও মৃত্যু অনিবার্য সত্য। এ দুটো থেকে পালিয়ে উল্টোপথে ভাগার পথেই এ দুটোর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে যায়। এটা প্রকৃতি।


জয় নিঃশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হলো সন্ধ্যার দিকে। চোখ খুলল না। তবে ডাক্তার বললেন, সে ঘুমন্ত, চেতনা আসছে। হামজার পৌঁছাতে মাঝরাত হবে কমপক্ষে। কবীরের যে আরও একখানা গুরুদায়িত্ব আছে।

সে বেরিয়ে গেল ঘোড়াহাঁটের উদ্দেশ্যে। আমির নিবাসে ঢুকতে গিয়ে গা ছমছম করে উঠল। তখন বেশ রাত অনেক হয়ে গেছে। পা দুটো কেউ পেছন থেকে টানছে যেন ফিরে যাবার তরে। জয়ের পাঠানো দুজনকে কোথাও দেখল না। তাহলে কি অন্ধকারে আরমিণ এত দীর্ঘসময় পার করেছে! আৎকে উঠে জোরে ধাক্কা ও লাত্থি মারতে লাগল সদর দরজায়।

অনেকক্ষণ পর ক্ষীণ স্বর ভেসে এলো, “কে? জয় আমির?ʼʼ

কবীর হাসে, “ভাবী, আমি। আমি কবীর। একটু বিশ্বাস কোরে দরজা খোলেন তো। আমি আইছি।ʼʼ

দশ মিনিট পেরিয়ে গেলেও দরজা খুলল না। কবীর ধাক্কায় আবার। ভেতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এসে শাল কাঠের ভারী দরজার লোহার বিশাল হুড়কোটা খুলতে আরমিণের শরীরের শেষ শক্তিটুকুও যেন নিঃশেষ হলো। হুড়মুড় কোরে পড়ে যাচ্ছিল মেঝেতে। কবীর জাপটে ধরল, পরক্ষণে দ্রুত ছেড়ে দিয়ে ক্ষমা চাইবার মতো কোরে মাথা নত করল।

টর্চের আলোয় অন্তূকে দেখে বুক কেঁপে উঠল কবীরের। মনে হচ্ছে যেন কোনো দীর্ঘদিনের সাজাপ্রাপ্তা রাজবন্দিনী। মেঝের ওপর থোকা থোকা বমি শুকিয়ে লেপ্টে আছে। দু এক ফোটা রক্তও ভেসে আছে তাতে। কবীরের গা কেপে উঠল ভেতরের নির্জন ও অন্ধকারচ্ছন্নতা দেখে। কীভাবে সম্ভব একলা দিন-রাত কাটানো এই মৃত্যুপুরীতে?

-“ওরা আইছিল, দরজা খোলেন নাই?ʼʼ

অন্তূ জবাব দিতে পারল না। কিন্তু বোঝা গেল সে খোলেনি। দরজা খোলাটা অন্তূর জীবনে সুখকর ঘটনা নয়, এছাড়াও এই নির্জন শিকারী বাড়ি, অপরিচিত নোংরা চরিত্রের পুরুষ ও অন্তূর সচেতন নারীচিন্তা…ওরা বোধহয় ডেকে ডেকে গলা ব্যথা কোরে ফিরে গেছে।

হঠাৎ-ই কবীরের কী হলো কে জানে, সে একটু ভাবনায় পড়ল। অন্তূকে পর্যবেক্ষক নজরে দেখতে দেখতে বুক নিংরে আসা এক চিলতে ছলকানো হাসি তার মুখে ফুটে উঠল। তার আন্দাজ; না না আন্দাজ নয়, সে নিশ্চিত যেন!

সে সদরঘরের বিভিন্ন কোণে দশটা-বারোটা মোমবাতি জ্বালালো। দ্বিধা, লজ্জা, ভয়ের কাঁপা হাতে খাবার তুলে অন্তূর সামনে তুলে বলল, “আমারে ক্ষমা করতে পারেন, আপা?ʼʼ

অন্তূ নিভু নিভু চোখে চায়। কবীর বুঝি কেঁদে ফেলবে। সে আবার বলে, “আমার বোন নাই। আমার মতোন পাপীরা আপনাগো মতোন মেয়েলোকের মর্যাদা কী বুঝবো? শিখি নাই তো কুনুদিন। আইজ মাপ করবেন?ʼʼ

অন্তূ হাসে, “আমি কারও কোনো অপরাধ রাখিনি, ভাই। এভাবে বলবেন না। মাফ করার মালিক আমার খোদা তায়ালা। আমি এক নগন্য বান্দি।ʼʼ

-“আমি শুনছি যার সাথে অন্যায় হয়, ওয় মাপ না করলে খুদাও মাপ করে না। আজ আপনে আমার হাতে একটু খাবার খাইলে আমি ধরে নেব আপনে আমারে মাপ করছেন।ʼʼ

অন্তূ খাবার নিলো। দু-একবার। আবার বমি আসছিল। কবীর নিজ হাতে পানি পান করায় অন্তূকে। তাকে ফিরতে হবে। অন্তূ এই বাড়ির সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে উঠবে না, সেই শক্তি নেই তার শরীরে। কবীরেরও সাহস নেই তাকে পাটোয়ারী বাড়িতে নিয়ে আয়। ওদিকে মরণ।

সে বেরিয়ে যাবার আগে অদ্ভুতভাবে হেসে জানায়, -“আপনের দুশমন কইলাম হাসপাতালে, ভাবী। তাই আমি আইছি।ʼʼ

অন্তূ চোখের পাতা কাঁপল।

-“গুলি লাগছে কাল শেষ রাইতে। আমি যাই। সে না আইলে দরজা খুইলেন না। এমপির লোক আপনারে খুঁজতেছে। আমি আবার আসব।ʼʼ

অন্তূর শরীরে কাঁপুনি উঠল। এটা হতে পারে না। জয় আমির এভাবে মরতে পারে না। এটা সময় নয়। অন্তূর থুতনি ভেঙে এলো, থরথর কোরে কাঁপল। আচ্ছা, বড়ঘরেরই বা কী অবস্থা? কেমন আছে ওরা? আছে তো? জয় আমির কী করেছে ওদের সঙ্গে? অন্তূর মনে হলো, সে এখানেই মরে যাবে। বাকি থাকা দায়ভার ও জীবনের পিছুটান তাকে বাঁধতে পারবে না। এত কঠিন হতে নেই জীবন।

হামজা পৌঁছাল শেষরাতে। কেবিনে ঢুকে হুড়মুড় কোরে ঝুঁকে পড়ল জয়ের বুকের ওপর। জয় শুয়ে আছে। বাহুতে ব্যান্ডেজ, উরুতে ব্যান্ডেজ। শরীরের ওপর পাতলা চাদর। অনেকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল চেহারার দিকে। এই মুখটা তার জয়ের। জয় তার ভাই কম, সন্তান। সে জয়ের বাপ, পয়দাকর্তা। কয়দিন পর জয়কে দেখে তার মনে হলো সে বুঝি কতকাল এই মুখখানায় নিজের নাম শোনে না। হাসির ঝংকার শোনে না।

-“জয়! ও জয়! তাকা, তাকা। …….তাকা জয়। আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে। জয় রে?ʼʼ

জয়ের মুখে হাত নেড়ে দেয়, মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলায়। রিমির অবাক লাগে। জয়ের সামনে যে হামজাকে দেখা যায়, ওই হামজা আরেকজন। তার হাতদুটো থরথর কোরে কাপছে, মস্তিষ্কের নির্দেশ যেন হাতের পেশিতে পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছে। হামজার সাথে কী হচ্ছে? জয়ের সুস্থ হতে হবে। দুই ভাইয়ের একবার খুব শীঘ্রই বিদেশ চলে যাওয়া জরুরী। চারদিকের অবস্থা ভালো না। এই সুযোগে দুজনের একচোট জম্পেশ চিকিৎসা সেরে নেয়া যাবে।

ডাক্তার ঢুকতেই থাবা মেরে ধরল, “রক্ত নিন। খবরদার যেন উচ্চারণ করবেন না, আমি অসুস্থ, এ অবস্থায় রক্ত দিতে পারা যাবে না। আমার রক্ত ও নেগেটিভ। নার্স? নার্স কই? ডাকেন!ʼʼ

তখনও শরীরের বিভিন্ন স্থানে দগদগে ঘা, ব্লাড-প্রেশার ও হার্টবিট হাই। কিন্তু হামজার কথার খেলাপি করতে নেই। ডাইরেক্ট ব্লাড ট্রান্সফিউশন ব্যবস্থা কোরে ফেলা হলো।
বারবার একজন আরেকজনের রক্ত ভাগাভাগি করতে করতে এখন দুজনের রক্ত গুলে গেছে। কতবার এরকম লক্ত দেয়াদেয়ী হয়েছে হিসেব নেই। হামজা কী করে নিজের রক্তকে অস্বীকার করতে পারে। জয় এখন তার রক্ত। সে-ই জয়ের পরিবার, বংশপরিচয়, আত্মীয়, মা-বাপ, ভাই, অভিভাবক। আর কারও স্থান নেই এখানে।

রক্ত দেবার পর জয় অবজার্ভেশনে রইল। দু-একদিনের মাঝে তার শরীর ঠিক হয়ে উঠবে। তার শরীরে এসব মশা কামড় মারা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। এসবে কাবু হবার মতো ক্যাপাসিটি শরীর বহুকাল আগেই হারিয়ে ফেলেছে। হামজাও বাকি রাতটাসহ গোটা দিনটা হাসপাতালেই আরেকটু চিকিৎসার অধীনে রইল। এ অবস্থায় রক্ত দেবার ফলে তার শরীর আরও ভেঙে এলো। দুজন পাশাপাশি বেডে পড়ে রইল।

কবীর খুশির সংবাদখানা কাকে দেবে কাকে দেবে কোরে উত্তেজনা সামলাতে পারছিল না। কিন্তু সে অন্তত জয়কে দিলো না। একজনকে দেবার সাথে সাথে হাসপাতাল ভেঙে দিনাজপুর এসেছে, এই খবর শুনলে জয় এই মুহুর্তে দুনিয়াদারী ভুলে ছুটতে চাইবে ঘোড়াহাঁট। উন্মাদ হয়ে যাবে। কিন্তু কবীরের ভেতরে চেপে রাখা কঠিন।

রিমি, তুমি ও কোয়েল জয় ও হামজার বেডের মাঝখানে বসা। হামজা-জয় দুজনেই ঘুমোচ্ছে তখন। রাত শেষ হবার পথে। ফজরের আজান হবে। চারদিকে নিশ্চল নীরবতা।
কবীর রিমির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “বড়ভাবী! জয় ভাই বাপ হইলে কেমন হবে, কন তো?ʼʼ

রিমি বিস্ময়ে তাকায়। চোখদুটো চিকিচিক করে উঠল, চোখে জিজ্ঞেস করে, “হবে নাকি?ʼʼ

কবীর ইঙ্গিতে যে ব্যাপারটা বোঝাতে পেরে খুবই গর্বিতবোধ করে নিজের ওপর। রিমির কি কান্না পাচ্ছে। একবার আরমিণকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। খুব।

হামজা পরদিন সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে আরেকটু রেস্ট কোরে রাতের ওষুধ খেয়ে কয়েকটা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বড়ঘরে গেল। জয় অনেকগুলো লাশ বিছিয়ে রেখে গেছে। শুধু একটা পতঙ্গের জান এখনও সামান্য ফরফর করছে। পতঙ্গটার নাম মুরসালীন। এটা বিরক্তিকর।

সে মুরসালীনের আধমরা দেহটাকে গলা চেপে ধরে বসিয়ে বলল, “তুমি আমার খুব বড় বড় ক্ষতি করেছ, মুরসালীন। তোমরা নীতির কথা বলে বেড়াও, আমার মতো পাপীর ক্ষতি করো। তোমাদের নীতি কী বলে? পাপীর ক্ষতি করা নীতিবিরুদ্ধ নয়?ʼʼ

দুটো ছেলে বড় চাপাতিখানা ও শাণ এনে রাখল হামজার কাছে। হামজার হাতের পেশি অবশ প্রায়। ওরাই শাণে চাপাতি ঘঁষতে লাগল। ধাতব শব্দ উঠল অবরুদ্ধ ঘরখানায়। আর তিনজন গিয়ে পাশের ঘর থেকে কুকুরের খেয়ে অবশিষ্ট রাখা হাড্ডিসার দেহ-কঙ্কালগুলো এনে ফেলল মেঝের ওপর।

আজ আবার চুল্লি চলবে বড়ঘরে। ভালো আয়োজন হবে আজ। হামজা চাপাতি একহাতে তুলে ধরল, একটু জোর ও জেদ বেশি দিতে হলো শরীরের ওপর। মুরসালীনকে বলল, “আমি আগে আলাদাভাবে তুমি জীবিত থাকতেই তোমার হাত দু-খানা চাই, বুঝলে! তোমার এই হাতদুটো আমাদের বিরুদ্ধে খুব আপত্তিকর কথাবার্তা লিখেছে। আমার পালক বাপকে মেরেছে। আর অনেককিছু।ʼʼ

এক কোপে মুরসালীনের ডানহাতখানা কেটে ফেলল হামজা। চামড়ার সাথে ঝুলছিল হাতখানা, হামজা টান মেরে ছিঁড়ে নিলো। মুরসালীনের চিৎকার বড় শ্রুতিমধুর লাগছে, এটা শুনবে বলে সে মুখে কিছু গুঁজে দেয়নি। মুরসালীনের চোখে তখনও অভয়। একটুও আঁকুতি নেই। সে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া হাতখানার দিকে তাকিয়ে হাসল।

ওই হাতদুটো শেষবার তার মায়ের কাছে চিঠি লিখেছে। ওই হাতদুটো ধরে মা কতবার বলেছে, শোন মুরসালীন, ভার্সিটিতে পড়তে দিছি বলে জাহিল হবি, তা কিন্তু না। ইকদম ত্যায্য করব। তোর এই হাত যেন কারও কষ্টের কারণ না হয়। তোর হাতেখানা যেন কখনও মিথ্যা ও মজলুমের বিপক্ষে না লেখে। আল্লাহ পাক হাশরে প্রতিটা অঙ্গের হিসাব চাইবেন। অঙ্গরা নিজেরা নিজেদের কৃতকর্মের সাক্ষী দেবে।

বলতে বলতে মরিয়ম কেঁদে ফেলতেন। মুরসালীন হেসে জড়িয়ে ধরতো আম্মাকে ওই হাতখানা দিয়েই। আজ এই অবস্থায় তিনি দেখলে নিশ্চয়ই মুরসালীনের বুকে জায়গা নিতেন, কিন্তু মুরসালীনের হাতখানা নেই উনাকে জড়িয়ে নেবার জন্য। মুরসালীন তাই হাসল। তার খুব পিপাসা পাচ্ছে। এক গ্লাস ঠান্ডা পানির জন্য বুক চিড়ে আসার মতো অনুভূত হলো। সে অবাক হলো, মৃত্যু পূর্ববর্তী প্রভাব তাকেও ঘিরে ধরতে সক্ষম হয়েছে। মৃত্যুর তো আসলেই অনেক শক্তি। মানুষ কেবল সান্ত্বণা পেতে বলে মৃত্যুকে আমি ডরি না। মৃত্যুর আগ মুহুর্ত মৃত্যু মুহুর্তের চেয়ে কঠিন বুঝি!

বাম হাতখানাও কেটে নিলো হামজা। মুরসালীনকে দেখতে অদ্ভুত লাগল। জীর্ণ হয়ে আসা লম্বা শরীরে লম্বা লম্বা সাহসী হাত দু-খানা নেই আর। টপটপ করে রক্ত পড়ে যাচ্ছিল মেঝেতে। হামজা একটা ছেলের ওপর ভর দিয়ে অনেকটা সময় নিয়ে মেরুদন্ড সোজা কোরে উঠে দাঁড়ায়। উঠতে গিয়ে চারবার মতোন মেরুদণ্ড মুড়ে এলো, ঝুঁকে পড়ল অর্ধঙ্গ রোগীর মতো।

পিস্তলখানা বুক বরাবর তাক করল মুরসালীনের, “কোনো শেষ ইচ্ছা আছে তোমার, মুরসালীন? আছে? বলো।ʼʼ

মুরসালীন পাঠ করে—’আশশাহাদু আল্লাহ্ ইলাহা ইল্লাল্লাহ্, ওয়াশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসুলূহ্! আশশাহাদু আল্লাহ্ ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ ওয়া….ʼ

ভোঁতা চারটে আওয়াজ উঠল। পরপর চারটে গুলি মুরসালীনের বুকের প্রায় একই জায়গা ফুঁড়ে পেছনের দেয়ালে গেঁথে রইল। একটা গুলি বিঁধে রইল মুরসালীনের বিদ্রোহী বুকের হৃদযন্ত্রের পেশীতে।

চুল্লিতে কয়লা ও কোক অল্প ঢালা হলো। অনেকগুলো তাজা দেহ আছে আজ। কোক অত না হলেও চুল্লি জ্বলল। মুরসালীনের শরীরখানা গলে লাল টকটকে লাভা হয়ে উঠল। তার বিদ্রোহ, বিপ্লবের পিপাসা, টগবগে রক্তের স্ফূলিঙ্গ, এক অসহায় মায়ের শেষ প্রতীক্ষা এক মেটাল-মেল্টিং চুল্লিতে কিছু সময়ের কারবারে গলে গেল।
ফুরিয়ে গেল মুরসালীনও। মুরসালীনের মায়ের অপেক্ষা যদিও ফুরোয়নি। তিনি যে আনসারী মোল্লার কাছে কথা নিয়েছেন মুরসালীনকে নিয়ে আসবেন।

হামজার কাজ ফুরোলো বড়ঘরে। তাকে এখন একবার ঘোড়াহাঁটে যেতে হবে।

চলবে…

[ ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। রিচেইক করার সুযোগ পাইনি।]