অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব-৮৫ (বর্ধিতাংশ)

0
34

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৮৫. (বর্ধিতাংশ)

দেখেই বোঝা যায় বহুদিন পর এই বাংলা লেখাটুকুর জন্য কলম ধরা হয়েছিল। তবু গোটা গোটা হাতের লেখা। অল্প যত্ন, কিছুটা দায়সারাপনা। জয় আমিরের হাতে লেখা উইল-পত্রটি পড়তে শুরু করে মাহেজাবিণ—


আমি জয় আমির। জাভেদ আমিরের একমাত্র পুত্র। জন্ম: ঘোড়াহাট, দক্ষিণ দিনাজপুর। স্থায়ী বসবাসযোগ্য কোনো বাসগৃহ আমার নাই। ধর্ম: অধর্ম। আজ সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে, সদিচ্ছায় এই হাতে লেখা উইলটি লিখতে বসেছি।

এই উইলে আমি বলে যাচ্ছি, আমি মরার পর আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বাড়ি, নগদ অর্থ ও সমস্ত নিজস্বতা নিম্নলিখিতভাবে মালিকানাধীন ও পরিচালিত হবে—

আমার স্ত্রী মাহেজাবিণ আরমিণ অন্তূ, পিতা: জনাব আমজাদ আলী প্রামাণিক, জন্ম: বাঁশেরহাট, দিনাজপুর সদর। আমার মৃত্যুর পর আমির পরিবারের সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেকটার উত্তরাধিকারী হবে সে। আমার বাপের প্রধান বাসভবন আমির নিবাস, যেটা ঘোড়াহাটে অবস্থিত। তা আমার স্ত্রী আরমিণ অর্ধেকটা পাবে এবং সেটুকুর সম্পূর্ণ মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ তার হাতে থাকবে। বাকিটা পাবে আমার একমাত্র চাচাতো ভাই জিন্নাহ আমির, পিতা: জনাব জয়নাল আমির। আমার মৃত্যুর পর আমার পৈতৃক সম্পদ সংরক্ষিত থাকবে তাদের দুজনের উদ্দেশ্যে। তা সমান দুইভাগে তাদের দুজনের মাঝে বণ্টিত হবে। এবং আমার ব্যক্তিগত অর্থের মালিকানা পাবে শুধু আমার স্ত্রী। আমি নিশ্চিত করতে চাই, আমার মৃত্যুর পর আর্থিকভাবে কোনোরূপ সমস্যার সম্মুখীন তাকে হতে হবে না। আমির বাড়ির বউ আর্থিক সংকটে ভুগলে বিষয়টা ভালো দেখাবে না।

আমার ব্যাংক একাউন্ট নম্বর–***** (সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ) এবং আমার অন্যান্য সকল অর্থের হকদার আমার স্ত্রী আরমিণ হবে।
আপাতত সে একজন শিক্ষার্থী। এই উইলও চেইকবই তার কাছে হস্তান্তরের পর থেকে প্রতিমাসে সে আমার ব্যাংক একাউন্ট থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ তার শিক্ষা ও যাবতীয় খরচ বাবদ পাবে। এছাড়া সে চাইলেই যেকোনো সময় সেই অর্থ থেকে ইচ্ছেমতো অর্থ উত্তোলন ও খরচ করতে পারবে।

আমি আমার পরিচিত এক সম্ভাব্য শুভাকাঙ্ক্ষী ও আইনজীবী দোলন স্যারকে উইলের এক্সেকিউটর হিসেবে নিযুক্ত করছি। তিনি আমার স্ত্রীর কাছে উইলপত্র ও সমস্ত দলিল-দস্তাবেজ পৌঁছে দেবেন। নিশ্চিত করবেন আমার ইচ্ছানুযায়ী আমার স্ত্রী ও ভাইয়ের কাছে আনুষঙ্গিক কাগজ ও মালিকানা পৌঁছেছে।

২৩/০৪/২০১৫
জয় আমির

নিচে দুজন সাক্ষীর সাক্ষর। দোলন সাহেব ও দ্বিতীয়টি কবীর।

মাহেজাবিণ চুপচাপ অনেকক্ষণ উইল-পত্রটির দিকে তাকিয়ে রইল। যে সময়ে উইলপত্রটি লিখেছে জয় আমির, তখন তাদের সম্পর্ক ছিল চূড়ান্ত বিরোধের। এছাড়া নিজের মৃত্যুর এত নিশ্চয়তা রেখে কেউ দিব্যি পাপের জীবনটা সাবলীলভাবে বয়ে যেতে পারে, না থেমেছিল হাসি, না কদম!

দোলন সাহেব দলিলের কাগজপত্র মাহেজাবিণের দিকে এগিয়ে দিলেন। পুরোনো হলদেটে কাগজ, তবু কচমচে, তা থেকেও একপাঁজা বিশাল ধন-ঐশ্বর্যের ধোঁয়া ঠিকরে বেরোচ্ছে। মাহেজাবিণ নির্লিপ্ত চোখে সেই দলিলখানা একনজর চোখে দেখল কেবল, হাতে ছুঁলো না।

দোলন সাহেব বললেন, “দরকার ছিল না। ওর এ কূলে-ও কূলে কেউ নেই। ওই যাযাবর মরলে স্ত্রী হিসেবে এমনিই ওর সব তুমি পেতে। তবে মজার ব্যাপার হলো ক্ষ্যাপা আমির তখন জানতো, খুব অল্প দিনের মধ্যে মুরসালীনকে অত্যাচার করে সে জিন্নাহ আমিরকে খুঁজে বের করে ফেলবে। তখন তোমরা দুজনই হবে আমিরদের সম্পত্তির দুই ভাগীদার। জিন্নাহ্ আর নেই। এখন আর এই উইল না থাকলেও সমস্ত সম্পত্তি একমাত্র তোমার! বিশাল ধনী মহিলা হলে আজ থেকে। আগেও ছিলে অবশ্য, আমির বাড়ির ব্যাটার বউ!ʼʼ

দলিল ও চেইকবই এগিয়ে দিলেন দোলন সাহেব, “নাও, দেখে বুঝে নাও সব ঠিক আছে কিনা! আমার কাধ পাতলা হোক। এই দায় মিটিয়ে কাধ ঝেরে আমি দুই ভাইয়ের পেছনে লাগব কাল হয়ে। দেখলে না। এজন্য আমাকে উল্লেখ করেছে সম্ভাব্য শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে। জোচ্চর আমিরের ব্যাটা!ʼʼ

অন্তূ দলিল ও চেইকবইটা মৃদু হাতে ছুঁড়ে ফেলে দিলো টেবিলের ওপর। ক্লান্ত চিত্তে হেলান দিয়ে বসে বলল, “উইল লেখার কথা মাথায় কেন এসেছিল তার?ʼʼ

-“অকাম করে বেড়াতো, আর এটা জানতো না যে দিন ঘনিয়ে আসছে?ʼʼ

-“শুধুই তাই?ʼʼ

-“ছোটচাচা ক্রসে যাবার পর ওর একটা বদ্ধ ধারণা হয়ে গেছিল ও-ও ক্রসে মরবে, পুলিশের গুলিতে…ʼʼ

মাহেজাবিণ কপাল চেপে ধরে। কী আশ্চর্য এক মানুষের ঘর করেছে সে! কোন পরিবারের উত্তরাধিকারী আজ সে? ওটা পরিবার? না, একঝাঁক নরকের অতিথি! সেই অতিথিদের কাতারে কীভাবে কীভাবে যেন তার নাম লিখিত হয়ে গেছে। কথাটা অদ্ভুত শোনায়– আমিরদের ব্যাটার বউ!

দোলন সাহেব মনোযোগী হলেন, “এবার বর্তমানের জরুরী খবরে আসি।ʼʼ

-“বলুন।ʼʼ

-“সামনের সপ্তাহে কোর্ট।ʼʼ

-“শুনলাম।ʼʼ

-“সাক্ষীর সাথে কথা বলা প্রয়োজন। তুলি কোথায়? তো তোমার সেই পরিকল্পনামতো–আর সব অপরাধ তো আছেই, সাথে তুলির স্বামী এমপির আত্মীয়, তার মৃত্যু যোগ করলে একটা ভয়াবহ কেইস পেশ করা যাবে আদালতে। কোথায় তুলি?ʼʼ

-“শ্বশুরবাড়ি।ʼʼ

-“ভালো কাজ করেছ। মাতব্বরদের যোগ্য বধূ। এভাবে পরিচালনা করার দক্ষতা দেখেই বউ ঘরে তোলা উচিত। আমিররা না চাইতেও পেয়েছে।ʼʼ

-“ব্যাঙ্গ করছেন, স্যার!ʼʼ

গম্ভীর হয়ে বললেন দোলন সাহেব, “না। মাতব্বরদের যোগ্য বউ হও বা না, বাপের যোগ্য মেয়ে তুমি।ʼʼ

-“এটাও ব্যাঙ্গই ছিল, স্যার।ʼʼ

দোলন সাহেব চুপচাপ কিছুক্ষণ মাহেজাবিণকে দেখে বললেন, “তোমাকে জুনিয়র হিসেবে পেতে আগ্রহী আমি। যদি তুমি আমার আন্ডারে প্রাকটিস করতে চাও তো, আমি খুশিই হবো।ʼʼ

মাহেজাবিণ সামান্য হাসল, “সবে থার্ড ইয়ার শেষ হচ্ছে স্যার। এখনও অন্তত বছর দুয়েক!ʼʼ

-“চলে যাবে দিন।ʼʼ

মাহেজাবিণ গভীর শ্বাস টানে। সব হারিয়ে কিছু পাওয়াটাকে প্রাপ্তি হিসেবে ধরাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত? সব হারানোর পর সে স্বপ্নের পথে পা বাড়াতে চলেছে। মাঝখানে জীবন তার সঙ্গে এক অনন্য আদিম খেলা খেলে নিলো!

-“তুলিকে হাজির করতে হবে কোর্টে। এখন কথা হলো, সে কি উইটনেস হবে তার ভাইয়ের বিপক্ষে?ʼʼ

-“স্যার, ছেড়ে দিলে হয় না?ʼʼ

-“কাকে? হামজাকে? তুমি বলছো? তুমি?ʼʼ

-“শাস্তি কি শুধু আইন দিতে পারে, স্যার? আইনের ওপর যে মহান আইন রয়েছে, তার মতোন শাস্তি আইনের দেবার সাধ্যি কোথায়? তথাকথিত আইনের আনুষ্ঠানিক নাটকীয়তা থেকে বাঁচিয়ে দিন।ʼʼ

-“তুমি আসলে কী চাও?ʼʼ

-“মৃত্যুদণ্ড না হোক! জীবিত থাকুক।ʼʼ

দোলন সাহেব মাথা নাড়লেন, “তুমি তাহলে আসল শাস্তির কথা বলছো। হামজা বাঁচতে চায় না, আমি ওকে জানি।ʼʼ

মাহেজাবিণ বিরবির করে বলে, “কাপুরুষ একেকটা। পাপ করবে দাপটের সাথে কিন্তু শাস্তি ভোগ করার সময়ে লেজ গুটিয়ে পালাবে কুকুর অথবা মাছ-চোর বিড়ালের মতো।ʼʼ

দোলন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি রিমির কথা ভেবে হামজার মুক্তির আশা রাখছো?ʼʼ

মাহেজাবিণ চুপ থাকে। কারও সামনে আবেগ প্রকাশে অক্ষম সে। সে বলতে পারে না রিমির কান্না ও নির্লিপ্ত-মৃত চেহারা তার বুকে কতটা ব্যথার উদ্রেক করে। এছাড়া দিন যত যাচ্ছে, তার ধৈর্য বাড়ছে, মনোভাব বদলাচ্ছে। সে বড় হচ্ছে। আজকাল মস্তিষ্কটা ঠান্ডা হয়েছে, আগের মতো টগবগ করে না। শান্ত-শীতল ভাবনারা খুব ভাবায় তাকে। সে বুঝতে শিখেছে যে পথে ক্ষমা নেই, ধৈর্য ও খোদায় ভরসা নেই, সেই পথেই হিংসাপরায়ন জয় আমিরদের জন্ম। সে হিংসাপরায়ন নয়। কেবল অন্যায়কে থামাতে সঠিক আইন প্রয়োগে বিশ্বাসী।

মাহেজাবিণ শুধায়, “এত কঠিন অসুস্থতার মাঝে কী শাস্তি হতে পারে হামজার?ʼʼ

-“দুইরকম কাণ্ড ঘটতে পারে। রাজনৈতিকভাবে ধরলে সে যত সুস্থ হবে উপরমহলের কাঠি নাড়ানাড়িতে তার শাস্তি তত কমে আসবে। আর যদি আইনতভাবে ধরো তো সে যত অসুস্থ হবে তাতে তার শাস্তি কমবে। এখন যেহেতু সুস্থ হবার চান্স দেখা যাচ্ছে না, তাই আইনতভাবে বিবেচনার বিষয় হতে পারে।ʼʼ

-“আপনি কোন উদ্দেশ্যে কেইস লড়বেন, স্যার?ʼʼ

দোলন সাহেব একটু রহস্য করে হাসলেন।

-“স্যার, আপনি মুরসালীন মহানের ওপর প্রবল স্নেহ রাখেন, তাই না? আমি আপনাকে খুব একটা বুঝতে পারি না। খুব জটিল মানুষ আপনি। আপনি মুরসালীন মহানকে মারার অপরাধে হামজার ওপর ক্ষুদ্ধ, এও কিন্তু জানি আমি।ʼʼ

-“আর কী কী জানো?ʼʼ

-“জানার কথা ছাড়ুন। আপনি এলেন বিরোধী দলীয় আইনজীবী ও সমন্বয়কারী হয়ে, অথচ বনে গেলেন সেই বন্দি-বিপ্লবীর শুভাকাঙ্ক্ষী, এর ব্যাখ্যা কী, স্যার?ʼʼ

-“আমি মুরসালীনের শুভাকাঙ্ক্ষী, কে বলল?ʼʼ

-“বাতাসে খবর পেয়েছি।ʼʼ

-“বাতাস ভুল খবর দিয়েছে।ʼʼ

মাহেজাবিণ অল্প হাসল। তারপর আনমনা হলো। অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। দোলন সাহেব অপেক্ষায় রইলেন তার দ্বিধা ভেঙে কিছু ভয়ানক বলার।

-“স্যার!ʼʼ

-“হু হু!ʼʼ

-“আপনাকে বললে আপনিও কি ঠেকাবেন আমায় সারেন্ডার করা থেকে?ʼʼ

-“আবার সেই একই কথা? বিষয়টা মাথা থেকে বের করতে পারছো না কেন?ʼʼ

-“স্যার, আমি খুনী।ʼʼ

-“আমার সামনেই হয়েছিল খুনটা। তুমি কি আমার চেয়ে বড় আইনজীবী হয়ে গেছ?ʼʼ

-“স্যার, আপনি দুনিয়ার আদালতের আইনজীবী। আমাকে দাঁড়াতে হবে সেই আদালতে, যেখানকার বিচারক আমার মহান রব। আমি মানুষের চক্ষুলজ্জার ভয় পাই না।ʼʼ

দোলন সাহেব বিরক্ত মুখে খিটখিট করতে করতে বললেন, “এসব নীতিবোধ ছাড়ো। আর ভাবো তুমি জেলে গেলে একগাদা জীবন রাস্তায় নেমে আসবে। তাই চুপচাপ মানবধর্ম পালন করো। এটাকেই তুমি ওই খুনের সাজা হিসেবে নাও না, দেখবে মনে হবে অপরাধের চেয়ে শাস্তি বড় হয়ে গেছে। আর বাদীপক্ষ যখন অভিযোগ আনেনি পুলিশের কাছে, ব্যক্তিগতভাবে তোমার ক্ষতি করার জন্য লেগে আছে, তারপর কীসের অনুতাপ? আইনের ভাষায় একজন সম্ভাব্য খুনীকে মেরেছ তুমি। এ নিয়ে আর কথা না বলো!ʼʼ

মাহেজাবিণ বুঝল না এই অদ্ভুত মানুষটির ওপর তার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত কিনা। সে অনুতাপ ও দ্বিধায় একাকার হয়ে আস্তে কোরে বলল, “আমার হামজার সাথে কথা বলার আছে। আপনি কোর্টের প্রস্তুতি নিন।ʼʼ

দোলন সাহেব চলে গেলেন। মাহেজাবিণ বসে রইল কতক্ষণ ওভাবেই। দলিল ও চেইকবই দুটো দেখল। উইলপত্রের সাথে আরও একটি পৃষ্ঠা। ওটা পড়ল না। এইসব দলিলপত্র, সম্পত্তি এসব তার কোনো কাজের নয়। দলিলটা নিজের কাছে রাখাও ভার মনে হচ্ছে। এসব দিয়ে সে কী করবে? ওভাবেই পড়ে রইল ওগুলো।

তার খিদে পায় না আজকাল। রাবেয়া এসে বসলেন পাশে। মাহেজাবিণ কারও সাথে আলাপে থাকলে কেউ আসে না সোফার ঘরে।

-“খাবি না?ʼʼ

মাহেজাবিণ চকিতে তাকাল। রাবেয়ার হাতদুটো ধরে সোফায় বসিয়ে সে মেঝেতে বসে রাবেয়ার কোলে মাথা রাখল। আব্বুর সাথে চা-মুড়ি খাওয়ার সময় এটা। সেই সোফা, আম্মু, বিকেল সব আছে। নেই শুধু আমজাদ সাহেব আর অন্তূ।

-“কী দিয়ে গেল রে? নেড়ে দেখেন রাবেয়া কাগজগুলো। পড়তে জানেন না খুব একটা তিনি। তবু কী বুঝে বললেন, জয় কিছু রেখে গেছে নাকি রে তোর জন্যে?ʼʼ

-“হ্যাঁ, আম্মু। একটা পোড়া-কয়লার জীবন।ʼʼ

রাবেয়া আগাগোড়াই ভয় পান মেয়েকে। আজও মেয়ের মাথায় হাত হাত বুলাতে বুলাতে ভাঙা স্বরে বললেন, “একদিন নিয়ে চল না জয়ের কবরের কাছে। আমি দেখ…ʼʼ

মাহেজাবিণ তাকালে তিনি থেমে গেলেন।

-“তোমাকে কতবার বলেছি এই আবদার বাদে যেকোনো কিছু চাও।ʼʼ

-“আর কী চাই বল তো তোর কাছে? বাপের কাজ করতেছিস যে তুই আমার। কিন্তু এইটাই চাই এখন।ʼʼ

-“কেন?ʼʼ

-“এতিম ছেলে…ʼʼ

-“আমিও আম্মা। তুমিও…ওই লোকটার কারণে।ʼʼ

-“ভুলে যা, অন্তূ। মরা মাইনষের ওপর অভিযোগ রাখতে নাই। শিখাই নাই আমি তোরে? এত নিষ্ঠুর হইতে নেই, কত বোঝাইছি তোরে! চল না যাই!ʼʼ

মাহেজাবিণ কথা বলে না। মায়ের ভিজে ওঠা চোখে তাকিয়ে থাকে।

-“জানিস ও একদিন গেছিল কুষ্টিয়া! আমারে কী বলে আসছিল জানিস? ও মরলে আমি কাঁদব কিনা!ʼʼ

বলেই আশ্চর্যজনকভাবে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন রাবেয়া। মাহেজাবিণের চোখ ভিজে ওঠে আজ মায়ের কান্নায়। কী আশ্চর্য হয় এই মায়েরা! অন্তূ অবাক হয়। আজ তিনমাস ধরে অন্তূকে একা পেলেই ভীতু স্বরে আবদার করে বসেন জয় আমিরকে দেখতে যাবার।

-“ও আমার ব্যাটার দরদ বোঝে নাই। ওর তো ব্যাটা ছিল না। কিন্তু আমি তো মা রে অন্তূ। ওর মতোন এক জোয়ান ছেলেরে নয়মাস পেটে ধরা মা আমি। জানিস ও যেইদিন প্রথম আমার বাড়ি আসে আমি ওরে বলছিলাম, আমারে মা ডাকতে। সেদিন ও আমার ব্যাটার জান নেয় নাই। সেইদিন তো কথা দিয়ে দিছি রে আমি। মা-ই হলাম নাহয় আমার ব্যাটার খুনীর। একবার নিয়ে যা আমারে ওর কবরে। অন্তিকের কবরে গেছি আমি দোয়া করতে। ওর কবরটা দেখলাম না যে… আমার মেয়ের ইজ্জত, ছেলের জান নেয়া লোকের কবরটা দেখায়ে আনবি আমায়।ʼʼ

মাহেজাবিণ রাবেয়ার হাঁটু জড়িয়ে ধরে মাথায় ঠেকায় কোলের ওপর। টুপ টুপ করে কয়েক ফোঁটা পানি রাবেয়ার মলিন শাড়িতে পড়ে, সুতির শাড়ি তা আলগোছে শুষে নেয়। তখন রাবেয়ার মৃদু কান্নায় কাঁপছে। মাহেজাবিণের চোখের সামনে নিজের সন্তানের রক্তাক্ত পিণ্ড ভেসে ওঠে। সে আচমকা বাঁধ ভাঙা নদীর মতো হু হু করে কেঁদে ওঠে। সে নিজেও মা। এক অকালমৃত রক্তপিণ্ডের গর্ভধারিনী মা, আরেক এমন মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদে যে মা তার নিজের সন্তানের খুনীর জন্য চোখের পানি ফেলতে নিংসংকোচ! আচ্ছা সে কি পারবে তার সন্তানের খুনীকে ক্ষমা করতে? হামজার মুখটা মনে আসতেই আতঙ্ক ও ঘেন্নায় দম আটকে এলো তার।

মাহেজাবিণ অপ্রকৃতস্থের মতো মাথা নাড়ে, “কিন্তু আমি পারব না। আমি পারব না, নাহ্, না না না না না…. আমার সন্তানের খুনীকে আমি ক্ষমা করব না, আম্মু। কোনোদিন না। ওর বাপও ক্ষমা করে যায়নি। তুমি জানো, তুমি জানো আম্মু, ওই খুনী পায়ে পা তুলে বসে অর্ডার দিলো আমার সন্তান আমার নাড়ি থেকে ছিঁড়ে আনার। তুমি জানো আম্মু, কীভাবে আমার গর্ভফুল থেকে ছিঁড়ে আনা হলো ওকে? তারপর মেঝের ওপর ফেলে রাখলো। আমি দেখলাম ওকে। আমার থেকে বিচ্ছিন্ন রক্তে মাখা একটা ছোট্ট মাংসের দলা….আজও আমার তলপেটে অসহ্য ব্যথা হয়, আমার নারীদ্বার চিড়ে আসে, শুধু কোলে আমার বাচ্চা নেই, আমাকে মা বলে ডাকার কেউ নেই। আমার নারীজনম ব্যর্থ গেল…আমি ক্ষমা করব না, করতেই পারব না আমি ক্ষমা। তুমি পারো, মরিয়ম চাচি পারে, আমি পারি না।ʼʼ

রাবেয়া অস্থির হয়ে দুহাতে মেয়েকে সামলান। অন্তূ উন্মাদের মতো বুকে হাত ঘষতে লাগল। এই চারমাসে অসংখ্যবার অন্তূর এই গোপন পাগলামির সাক্ষী রাবেয়া। দুনিয়া দেখে না এসব, এই পাগলামি শুধু তার সামনে দৃশ্যমান। কেউ কেউ বলে, মায়ের ভাগ্য মেয়ে পায়। কথাটা সত্য হবার সম্ভাবনা প্রবল।


কবীরদের বাড়ির মেঝে পাকা, ইটের গাঁথুনির দেয়াল, তার ওপরে টিনের ছাদ। কবীর আগে পেশা হিসেবে রাজনীতির পাশাপাশি হামজার ওয়ার্কশপের দেখাশোনার কাজ করেছে। ওয়ার্কশপ বন্ধ হয়েছে। সে এখন বড়বাজারে এক মুদি দোকানের কর্মচারী। মাসিক বেতন খুব বেশি নয়। তাই দিয়ে যা হয়।

তুলিকে বিয়ে করা নিয়ে মায়ের সাথে মতবিরোধ জন্মেছিল খুব। বিবাহিতা, মেয়েসহ এক মহিলাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে অবিবাহিত ছেলে, এটা কোনো মা মেনে নেন না। কবীর মাকে বোঝালো, ওটা কোনো বিবাহিতা, অন্যের মেয়ে কোলে মহিলা না। ওটা জয় আমিরের ফেলে যাওয়া জিম্মেদারী। তা কাধে তুলে নিতে না পারলে কবীর দম আটকেই মরে যাবে। কোয়েলের দিকে তাকালে তার ভেতরে যে স্নেহ জেগে ওঠে তা মা বুঝবে না।

মাহেজাবিণ তুলিকে ডেকে বসিয়ে বসেছিল, “আপু, আমি ছোট মানুষ। আপনার ভারী জীবনটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার মতো শক্ত মেরুদণ্ড আমার নেই। তবু একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আপনি শুধু একবার না বললে না।ʼʼ

-“এভাবে বলছো কেন? তুমি তো আমার বাপ, আরমিণ। যে দায়িত্ব তুমি পালন করলে এতগুলো দিন, আমার বাপও করেনি কোনোদিন।ʼʼ

-“আমি আপনার বিয়ের প্রস্তাব এনেছি।ʼʼ

তুলি নির্বাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শুধায়, “আমার বিয়ে?ʼʼ

-“কবীর ভাইয়ের সাথে।ʼʼ

তুলি ওভাবেই তাকিয়ে থাকে।

-“সে ভালো-খারাপ সেই প্রশ্নে না যাই। কোয়েলকে ভীষণ ভালোবাসে লোকটা। জয় আমিরের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তার যেকোনো আত্মীয় ও জিম্মেদারীর ওপর জান কোরবান তার। আমার মনেহয় আপনি অন্তত সম্মান আর বেঁচে থাকার খোড়াকটুকু পাবেন। এর বেশি আমার সাধ্যি নেই, আপু। আমার পায়ের নিচে শক্ত মাটি থাকলে আমি… আমায় ক্ষমা করতে পারলে করবেন..ʼʼ

তুলি মাহেজাবিণের হাতটা ধরে থামায় ওকে। কিন্তু হ্যাঁ বা না কিছু বলেনি মুখে। অন্তূ নিরবতাকে সম্মতি ধরে নিয়েছিল।

কবীর তাকে ঘরে এনে এখনও এমন আচরণ করে যেন সে জয় আর হামজার বাড়ির সম্মান, তার ছোট্ট ঘরে অতিথি হয়ে এসেছে। কোথায় রাখবে, কোথায় বসাবে, কী খাওয়াবে, কীভাবে ভালো রাখবে— ব্যস্ততা অশেষ।

বিয়ের চারদিন পর দুপুরে খুব ঘেমে বাড়ি ফিরল। তুলি গামছাটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “দ্রুত গোসল করে আসুন। খেতে দিই। আমারও খুব খিদে পেয়েছে।ʼʼ

কবীর ব্যাতিব্যস্ত হলো, “আপনে খান নাই এখনও? ক্যান? শরীর খারাপ? কী হইছে? বেলা তো ম্যালা হইলো, খান নাই ক্যান?ʼʼ

-“আরে! আগে ‘আপনি আপনিʼ করে কথা বলা বন্ধ করুন। এত জোরে জোরে ‘আপনি আপনিʼ করছেন, লোক শুনলে কী মনে করবে? আর আমি কি বয়সে বড় আপনার?ʼʼ

কবীর লজ্জা পেয়ে গেল। তার তো মুখেই আসবে না বোধহয়। সারাজীবন আপামণি বলে ডেকে অভ্যস্ত সে। কতবার হামজার হুকুমে তুলির শ্বশুরবাড়ি থেকে তুলিকে আনা-নেয়া করেছে সে! আজ তার ঘরের বউ সেই নারী।

তুলি বলল, “আপনার সাথে খাব বলে খাইনি। কোয়েলও খাবে। ওকে ঝাল খাওয়া শিখতে হবে এখন। তরকারী দিয়ে ভাত চটকে খাওয়ার অভ্যাস করাতে হবে।ʼʼ

কবীর সঙ্গে সঙ্গে মুখ গোমরা করে, “ক্যান? আমার সাধ্যি নাই ওরে দুধ-মিষ্টি খাওয়ানোর এই জন্যে? ঝাল খাওয়া শিখার কোনো দরকার নাই। আমি এত অধম না।ʼʼ

তুলি এবার ধমকে উঠল মৃদু, “কী আশ্চর্য! একবারও বলেছি তা? ও কি এখনও দুধের বাচ্চা আছে? বয়স পাঁচ হবে। সামনের বছর স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। এখনও ভাত না শিখলে কী খাবে?ʼʼ

কবীর মিইয়ে গেল ধমক খেয়ে। তুলি টের পেয়ে একটু স্বর নরম করে বলে, “যান, ওকেও গোসল করিয়ে আনুন। এ বাড়িতে এসে সারাদিন মাটিতে খেলার অভ্যাস হয়েছে।ʼʼ

পরক্ষণেই তার মনে পড়ল, সে কথা বলছে ইমোশোনাল বয় মোহাম্মদ কবীর আবেগী সাহেবের সাথে। আবার মাটিতে খেলাকেও নিজের গরীবী ধরে নিয়ে মুখ কালো করে তার আগেই সে বলল, “ভালোই হয়েছে। খেলার সাথী পেয়েছে। খেলাধূলায় মন ভালো থাকছে। যান, গোসল সেরে আসুন। আমি ভাত বাড়ি।ʼʼ

কবীরের মা তুলিকে কোনোভাবেই পছন্দ করতে পারেন না। তবু বিয়ের এই দুটো মাস পার করে তার মনে হলো–সে এই প্রথম সংসার করছে। আগে কখনও করার ভাগ্য হয়নি তার। মাটির চুলায় রান্না, একটা বখাটে অল্প কামানো নিজের ভাইয়ের চ্যালা তার খুব যত্নশীল স্বামী, অসুস্থ শ্বশুর, একটু খিটখিটে শাশুড়ি, টিনের ঘরে দিনের বেলার গমগমে গরম সব মিলিয়ে তুলির মনে হলো এতদিনে সে নারী হয়েছে, এতদিনে সেই নারীর একখানা টানপোড়েনের সংসার হয়েছে, যে সংসার অধিকাংশ বাঙালি মেয়ের নারীগত অধিকার।

এখানে এসি চলা রুম, মূল্যবান আসবাব যেমন নেই তেমন নেই রাতভর মদ পান করে এসে চুল ধরে আঁছড়ে মারা স্বামী নামক আসামী, নেই মাতাল এক কাপুরুষ, যার সম্মুখে স্ত্রী ধর্ষিতা হলেও তা স্বাভাবিক ঘটনা…

কোয়েল নিজের ঔরসগত বাপ হারালেও পেয়ছে একটা কবীর মামাকে। তুলি কোয়েলকে অন্য ডাক শেখায়নি। কোয়েল তার তোতলা মুখে ‘কবীল মামাʼ ডেকে যে আরাম ও স্নেহবোধ করে তা তুলি দেখেছে ওটা হুট করে কবীর মামা থেকে অন্যকিছু ডেকে সে পাবে না, মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব পড়বে। কবীল মামা কোয়েলের ভেতরে জয়ের স্মৃতি দমিয়ে রাখতে সচেষ্ট। কোয়েল দিনে কমপক্ষে চার-পাঁচবার জয়ের খোঁজ চালায়। তার অভ্যাস এবং বিশ্বাস কবীল মামার কাছে জয়ের খোঁজ থাকে, কবীল মামাকে পাওয়া মানে জয়কে খুঁজে পাওয়া। কিন্তু আজকাল কবীল মামা প্রতারণা করছে বারবার।

তুলি চোখ বুজে গভীর এক দম ফেলে জীবনের সমস্ত অন্ধকারটুকু এক ঢোকে গিলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তা ও আরমিণের ওপর কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তার চোখ ভরে ওঠে, বুকে ব্যথা হয়! আজ তরুটা বেঁচে থাকলে জয়ের বউ তারও একটা ব্যবস্থা ঠিক করতো। পাকা এক সিনা চওড়া, কাধ শক্ত কর্ত্রী ঘরে তুলে এনেছিল পাপী জয় আমির। তরু যে পুরুষকে ভালোবেসে গেছে আমরণ, তার তুলে আনা কর্ত্রী একহাতে গোটা একটি জিন্দা-লাশের মিছিল সামলে নিতে পটু, তরুটাকেও ঠিক একটা জীবন দিতো সেই নারী! তার আগেই তরুনিধী পালিয়েছে। বোকা তরু, ধিক্কার তার নারীত্বকে।

তুলির ঘরের কবীরটা একটু পাগল। কোয়েলকে ঘাঁড়ে চড়িয়ে প্রায় রোজ একবার যায় ঘোড়াহাঁটের কবরস্থানে। কীসের টানে যায় কে জানে!


কোর্টের তারিখের চারদিন আগে মাহেজাবিণ ঘোড়াহাট যায় রাবেয়াকে নিয়ে। সঙ্গে কবীর। নারীদের অনুমতি নেই কবরস্থানের সীমানায় প্রবেশে। ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে মাহেজাবিণ সালাম জানায়, ‘আসসালামুআলাইকুম, ইয়া’আহলাল, কুবর।ʼ

রাবেয়া ফটক ধরে মতো চেয়ে থাকেন ভেতরে, সন্তানের খুনীর শেষ ঠিকানা খোঁজেন ঝপসা চোখে। কবীর ভেতরে ঢুকে জয় আমিরের কবরের পাশটায় দাঁড়ায়। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে।

উঁচু ঢিবির মতো মাটি, লম্বায় ছাড়ে ছয় হাত মতো কবরখানা, তার নিচে জয় আমিরের লম্বা দেহটা শায়িত। এতদিনে কি সেই শক্ত-পোক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ অক্ষত আছে? মিশে যায়নি মাটির সাথে? দাপুটে জীবন, ব্যথাহীন শরীর, পাপী পৌরুষ, সাথে বুকের সমস্ত হাহাকার.. সব গিলে খেয়েছে মাটি আজ। মাটি এমনই। কত সভ্যতা, কত পাপ অথবা পূণ্য, কত বাহাদুরী সব প্রোগ্রাসে গিলে যায়।

আজ কবীর দাঁড়িয়ে আছে এত কাছে, জয় আমির আজ হেসে উঠল না। মিশ্র আঞ্চলিক ভাষায় দুটো গালিসমেত কিছু রসিক কথাবার্তা বলল না। মাহেজাবিণ দূর থেকে দেখে ছোট্ট একটি লাঠির আগায় বোর্ড টাঙানো কবরের পাশে। কবরের মাটি কেনা। আবছা দেখা যায়, তাতে লেখা–

মৃত: জয় আমির
পিতা: জাভেদ আমির
ঠিকানা: ঘোড়ার হাট, দক্ষিণ দিনাজপুর

মাহেজাবিণ শুধুই চাতকের মতো চেয়ে দেখল নিষ্পলক। জয় আমিরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ থেকে শেষ বিদায় অবধি সবটা চোখের পর্দায় ভেসে উঠে আবার নিভে গেল। বুকে চাপ ধরা এক বদ্ধ দমে হাঁপিয়ে উঠল সে। একটি পর্বতের অতখানি ভার তার শরীরটা শিথিল করে তুলল। তখনই আচমকা রাবেয়া হু হু করে কেঁদে উঠলেন। মাহেজাবিণ ঝাপটে ধরে মাকে।

-“কাঁদছো কেন, আম্মু? মানা করেছিলাম আসতে। জরুরী নয় তুমি যাকে আপন ভাববে, সেও তোমাকে তোমারই মতো আপন করবে। জরুরী নয় তুমি যাকে ভরসা করবে সে ভরসার যোগ্য হবে, যাকে স্নেহ করবে সে স্নেহের মর্যাদা বুঝবে। জয় আমিরেরা কারও আপন হয় না। চলো এখান থেকে। নয়ত কাঁদবে না, খবরদার। কান্না করাতে আনিনি তোমায় এখানে আমি।ʼʼ

রাবেয়া ধুলোর ওপর বসে পড়লেন। কবীর এলো, “কী হইছে চাচীর? কী সমস্যা? অসুস্থ লাগতেছে নাকি? কাঁদতেছে ক্যান?ʼʼ

মাহেজাবিণ রাবেয়াকে ধরে তুলে বলল, “এমনিই কাঁদছে। কাঁদার কোনো কারণ তার জীবনে নেই, তবু কাঁদছে। চলুন, আমরা যাই। বেলা পড়ে গেল।ʼʼ

অন্তূ বেশ কিছুদূর এগিয়ে ঘাঁড় ফিরিয়ে দেখে একবার বিরোধীর কবরটা। এখন আর বোর্ডে লেখা জয় আমিরের পরিচিতি দেখা যাচ্ছে না। অনেকগুলো কবরের মাঝে জয় আমিরের কবরখানা মিশে গেছে, চোখে ধাঁধা তৈরি হলো, সঠিক অবস্থান বোঝা যায় না তখন আর।

পথে মাহেজাবিণ রাবেয়াকে নিয়েই ঢুকেছিল মরিয়ম বেগমের কাছে সেদিন আর খালিহাত ফেরেনি সে। রাবেয়া প্রচণ্ড পরিমাণে বন্ধুসুলভ, সরলা নারী। বোন পাতানো হয়ে গেল তার। তিনি মরিয়ম বেগমকে বললেন, “শোনো বোন, আমার কেউ নাই। স্বামী নাই, ছেলে নাই। কিন্তু আমার মা আছে। তুমারও কেউ নাই। চলো আমার সাথে। আমার মা তোমারও মা। আইজ থেকে দুই বোন আমার মা’র জিম্মেদারীতে বাস করব।ʼʼ

এই আবদার ফেলা বড় দায়। মরিয়ম বেগম দুটো মলিন শাড়ি, একটা নিজের হিজাব ও ছোটখাটো একটি পুটলি বাঁধলেন মাহেজাবিণের দায়িত্বে গা ছাড়ার জন্য। শেষে তিনি আরেকটি ছোট হিজাব পুটলিতে রাখলেন। ওটা মুমতাহিণার। গোলাপী রঙা প্রিন্টের কাপড়ে তৈরি। ওতে এখনও মুমতাহিণার গন্ধ লেগে আছে। ওটা ফেলে যেতে পারেন না মরিয়ম।

আমজাদ সাহেবের চার কক্ষের ছোট্ট ইটের গাঁথুনির বাড়িটা অনেকগুলো জীবন্মৃতর আবাস হলো। রিমির জায়গা হলো মাহেজাবিণ এর কক্ষে।

আদালতে নেবার দু’দিন আগে সরকারী হাসপাতাল থেক হামজাকে পুলিশফাঁড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ডিটেনশন সেলের ভেতরে হুইল চেয়ারে অনড় হামজাকে দেখে মাহেজাবিণের মনে পড়ল তার গর্ভপাতের নির্দেশ দিয়ে আমির নিবাসের কেন্দ্রীয় চেয়ারখানায় হামজার বসে থাকার দৃশ্যটা। দোলন সাহেব সেলের বাইরে একটি মরিচা ধরা লোহার চেয়ারে বসলেন। মাহেজাবিণ সেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মুখের নিকাবটা খুলে ফেলল।

-“আপনার ওপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক, হামজা সাহেব।ʼʼ

সে নেকাব খুলতেই চোখ থামল হামজার। নিষ্পলক দেখল নারীটিকে। কঠোর সৌন্দর্য আজও চেহারায় লুটোপুটি খায়। চোখের নিচে কালি, তবু চোখজোড়ার সৌন্দর্য একরত্তি ম্লান হয়নি, আর না আগুন নিভেছে। ঠোঁট, নাকসহ ত্বকের রঙ সবটা প্রতিক্ষণে অ-মৃত সৌন্দর্যের ঘোষণা দিচ্ছে। এবং তা ভয়াবহ। সেই সুশ্রী চেহারায় নজর বুলিয়ে হামজার পৌরুষ চোখে সামান্য অনুরাগ আসে না, বরং দমে থাকা আক্রোশ পর্বত ফুঁড়ে বেরোনো ম্যাগমার মতো দগদগ করে ওঠে।

সে বহুদিন পর এক টুকরো বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে হাসে, “ভাবিনি শেষ জীবনে এক চার আনার মেয়েলোকের সঙ্গে বিরোধ লড়তে হবে।ʼʼ

মাহেজাবিণও হাসে একটু, “কেন ভাবেননি? ভাবেননি কেন, হামজা সাহেব! ধ্বংসের খেলা তো খেলেছেন এক মেয়েলোকের জীবনের সাথেই, তাহলে এটা কেন ভাবেননি যে খেলার বাজি পাল্টাতে পারে? আপনারা কেন এত নিশ্চয়তা রাখেন সব নারী রিমি হয়।ʼʼ

-“রিমিকে আর রিমি রাখোনি।ʼʼ

-“বিশ্বাস করুন সামান্য প্রচেষ্টাও ছিল না আমার, তাকে পরিবর্তনে।ʼʼ

হামজার চেয়ার বয়ে নিয়ে এগিয়ে এসে কম্পিত বাম হাত দ্বারা সেলের শিক চেপে ধরে, “চুপ, কুচক্রী মেয়েলোক!ʼʼ

-“কুচক্রী বলতে কী বোঝেন? নাকি আপনারা দুই ভাই শুধু শব্দ জানেন, অর্থ ছাড়া। যার তার জন্য যা তা! এক কাপুরুষ মূর্খ আমাকে বলে গেছে ছলনাময়ী, আবার আপনার কাছে কুচক্রী। আপনারা কি নিজেদেরকে জমিনের ওপর সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত শান্তির দূত মনে করেন নাকি?ʼʼ

হামজারর শ্বাস-প্রশ্বাস গভীর হয়, সে ঠান্ডা বিস্ময়ে বলে, “আজও সেই দুঃসাহস!

-“এটা আমার অলংকার।ʼʼ

-“সব হারিয়েছ এর দায়ে। জিততে পারোনি।ʼʼ

-“আপনি পারলেই হতো! আমি তো অবলা, শক্তিহীন, নির্বোধ মেয়েলোক। অজায়গায় দুঃসাহস দেখিয়েছি। আপনি হারলেন কীসের দায়ে?ʼʼ

মাহেজাবিণের জিতে যাওয়া চোখে চোখ রেখে লাল হয়ে ওঠে হামজার চোখজোড়া। চোয়াল ও পক্ষাঘাতগ্রস্থ হাতদুটো অবধি থরথর করে কাঁপে। ভেতরের যন্ত্রণা ও দহন লুকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা ব্যর্থ যেতে থাকে।

-“পিঠপিছে ছুরি গেঁথে বাহাদুরী দেখাইও না, নাদান মেয়েলোক। জয়কে টার্গেট না করে আমার অন্য যেকোনো কিছুতে হাত রাখতে…. তুমি জানো, আমি খুব ভালোভাবে জানি তোমার নরম-কোমল, চুড়ি পরা হাত কীভাবে মটমট করে ভাঙতে হয়। পুরুষ নাচাতে ভালোই জানো, জানা ছিল না। জয়কে কব্জা করে খুব খেললে।ʼʼ

-“বুঝলাম, পাগল হয়ে গেছেন আপনি। খারাপ না, এ আর এমন কী! কতলোক এমন হয়েছে আপনার খাতিরে! আমি ও আমার ভাতিজি হয়েছি বাপ হারিয়ে, আমার মা ও ভাবী স্বামী হারিয়ে, কত মেয়ে হয়েছে ইজ্জত হারিয়ে, অসংখ্য মা হয়েছে তাদের সন্তান হারিয়ে। সব চলে, হামজা সাহেব। টেইক ইট ইজি। আপনি আর কত বড় খেলোয়ার! আসমানের উপরে যে মালিক বসে আছে, তার খেলা খেলার ঊর্ধ্বে।ʼʼ

হামজা কিছুক্ষণ চোয়াল এঁটে ঠান্ডা নজরে দেখে মাহেজাবিণকে। এরপর শুধায়, “কেন এসেছ?ʼʼ

-“দেখা করতে এলাম। কত পুরোনো আর গভীর সম্পর্ক আমাদের!ʼʼ

হামজা হাসে, “আসলেই। উদ্দেশ্য বলো।ʼʼ

-“আপনি আর সেই যোগ্য আছেন যে আপনাকে কোনো গুরুতর উদ্দেশ্য বলতে এতদূর বয়ে আসব?ʼʼ

-“আমার পঙ্গুত্বকে তাচ্ছিল্য কোরো না। তোমার তো আমার পঙ্গুত্বকে পুঁজো করা উচিত। তুমি জানো, এটাই তোমাকে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছে।ʼʼ

মাহেজাবিণ খানিকটা ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে, “জানি। তবে আপনি কি জানেন আপনাকে পঙ্গু হয়ে বাঁচার সুযোগ আমি দিয়েছি?ʼʼ

-“বেশিদিন টিকতে পারবে না, আমি না চাইলে।

-“আজ তিন মাস আছি।ʼʼ

-“তিন যুগ নয়।ʼʼ

-“আপনি নিজেকে দেখুন। আপনার-আমার দ্বৈরথ কাউকেই টিকতে দেয়নি, হামজা সাহেব। দুজন দাঁড়িয়ে জলসিঁড়ির দুই ধাপে। যখন-তখন তলিয়ে যাব।ʼʼ

এই পথের শুরু ভার্সিটির এক টিচাররুমে। যেদিন হামজা তার এক মামুলি শিকারকে চোখ তুলে দেখার প্রয়োজন অবধি বোধ করেনি। আজ তারা প্রতিদ্বন্দীরূপে কারাগারের এপার-ওপার। অনেকক্ষণ সময় দুজন দুজনের চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। নিঃশব্দ এক দামামা বেজে উঠল দুজনের বুকের ভেতরে। যে যুদ্ধে কেউ জেতেনি, হেরেছে দুজন, হারিয়েছে দুজন। দুজনের চোয়াল শিথিল হয়ে এলো। সিক্ত হলো চিত্ত। তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত দুই বিরোধী আজ খালিহাত।

সেল খুলে আইনজীবী ও মাহেজাবিণকে ভেতরে যেতে দেয়া হয়। হামজা শান্ত-পরিশ্রান্ত গলায় বলে, “তুমি বয়সে অনেক ছোট আমার।ʼʼ

-“তা ভেবে জীবন ভিক্ষা দিতে পারতেন।ʼʼ

হামজা মাথা দোলায়, “অনেক ছাড় দিয়েছি।ʼʼ

-“ছাড়ই এমন!?ʼʼ

-“তুমি কোনো ক্ষতি করোনি আমার?ʼʼ

-“আপনার ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আজ অবধি কিছু করিনি আমি। কেবল আপনার কালো হাতদুটোকে ঠিক এরকমই পঙ্গু অবস্থায় দেখতে চেয়েছি।ʼʼ

-“তাতে আমরা শেষ হয়ে যাব?ʼʼ

-“দশজন যদি বিশটা অপরাধ করতে পারে, আটজন ষোলো। মাইনাস ফোর। অল্প থেকে শুরু হোক। এবার বলুন, হাত তো খালি, কী পেলেন এই অসুস্থ পথচলায়?ʼʼ

-“তুমি কী পেলে? আমার কাছ থেকে জয়কে সরিয়ে তুমি..ʼʼ

-“কূটনি মহিলাদের মতো অপবাদ রটানো ছাড়ুন। জয় আমির আত্মহত্যা করেছে। তাকে কেউ মারেনি। সে ছিল এক কাপুরুষ, পাপ করেছে বুক ফুলিয়ে, শাস্তির পালা এলে পিঠ এগিয়ে দিয়েছে ঝাঝরা হতে।ʼʼ

হামজার চোখে এক পৃথিবী ভঙ্গুরতা এসে ভর করে। দাঁতের মাড়ি চেপে ধরে। তারপর আচমকা বাম হাতে মাহেজাবিণের গলা চিপে ধরে। হাত শিথিল, অসাড় প্রায়, তবু পৌরুষ থাবা।

-“তুমি থামাওনি। সে তোমার জন্যই…ʼʼ

মাহেজাবিণ সামান্য বিচলিত হয় না, গলা মুক্ত করার চেষ্টা না করে বলে, “সেদিনের সতর্কবাণী মেনে নিলে আজ আপনি অন্য অবস্থায় থাকতে পারতেন। বলুন তো জয় আমির আত্মহত্যা কেন করল?ʼʼ

হামজার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। আবার একলেমসিয়ার মতো এক প্রকার খিঁচুনির উদ্রেক হতে লাগল। মাহেজাবিণকে ছেঁড়ে দিয়ে থরথরিয়ে কাঁপা হাতের দুই তালুর দিকে তাকিয়ে থাকে হামজা।

-“তুমি জানো? এই দুই হাতে আমি কতবার ওর কপালে জলপট্টি দিয়েছি। তখন আমার কাছে জ্বরের সিরাপ কেনার পয়সা থাকতো না। কত দুপুর পুকুরে ঝাপ পেড়ে সাতার শিখিয়েছি। তুমি তখন ছিল? নাহ্! কেউ ছিল না। শুধু আমি ছিলাম। আজও ও পারতো একসাথে সাতার কেটে বর্ডার পার হয়ে পালাতে আমার সাথে। আমাকে রেখে চলে গেছে, নিমোকহারাম।ʼʼ

মাহেজাবিণ ম্লান হাসে, “কেন চলে গেছে, তা ভাবছেন না কি ভয়ে? কোথাও কারণটা আপনি না হোন!ʼʼ

হামজার চোখে কাতরতা দেখা যায়। মাহেজাবিণ উদাস স্বরে জানায়—

“একজন ভরসাহীন মানুষ নিজের জীবনের সবটুকু ভরসা ও ভালোবাসা দিয়ে দেয়া মানুষটির কাছে হেরে যায়, মানুষ আর একটুও বাঁচার স্পৃহা কোথাও খুঁজে পায় না। বোঝেন এসব কথা? কখনও ভেবেছেন, আপনি জয়কে কতবড় জখম দিয়ে দুনিয়াছাড়া করেছেন? যার চেয়ে বড় জখম আর দেয়া সম্ভব নয় কোনো মানুষকে, ঠিক ততখানি আঘাত আপনি করেছেন জয় আমিরকে। সেই জয় আমিরকে, যে আপনার নামে নিজের সবকিছু বকসে দিয়েছিল, আপনার পালিত পশু হয়ে বেঁচে ছিল, নিজের পরিচয় ও গর্ব বিসর্জন দিয়ে। এবার ভাবুন, যখন সে জানতে পারল তার জীবনে সে সব হারানোর পর নিজের বেঁচে থাকা রুহ্টা অবধি যাকে সঁপেছিল, সেই বড়সাহেবই তাকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতটা করেছে, তার কেমন লেগেছিল? আমি আপনাকে সময় দিলাম দুই মিনিট। ভাবুন।ʼʼ

হামজার হৃদস্পন্দনের গতি অসুস্থ পর্যায়ে বেড়ে গেল। হতবিহ্বল হয়ে পড়ল সে। ইশারায় মাহেজাবিণকে থামাতে চাইল।

-“আপনি আমার সন্তান ছিঁড়ে নিয়েছেন, শুধুই আমার ভেবে। ভুলে গিয়েছেন পরের জন্য কাটা খালে নিজে পড়া দুনিয়ার পুরোনো নিয়ম। বাচ্চাটা আপনার জয়ের ছিল, জয়ের জয়ের। সেই জয়, যে আপনার খাতিরে পাপ আর পূণ্যকে এক পাত্রে গুলিয়ে জীবনের বিষ-পানীয় তৈরি করেছিল।
একটা তেতো সত্যি বলি? আমি যে মুহুর্তে আপনাকে দুশমন হিসেবে সচেতন করেছিলাম, ওই মুহুর্তে আমি মূলত আপনাকে জয় আমিরের মৃত্যুর খবরটা শুনিয়েছিলাম। শুধু খুলে বলিনি বাক্যটা।ʼʼ

-“তুমি জানতে? কী জানতে?ʼʼ

-“আপনি কেন জানতেন না, এটাই বিস্ময়কর প্রশ্ন। যে মানুষ বেঁচে থাকতেই নারাজ, মরণে তার চরম আগ্রহ, যে লোকটা নিজের পরিচয়ের পেছনে উন্মাদের মতোন ছুটেছে বছরের পর বছর। তার কাছ থেকে একে একে সমস্ত পরিচয় কেঁড়ে নেয়া হলে তার বাঁচার প্রশ্ন আসে কোত্থেকে? আপনি দেখেননি জয় আমিরের মৃত্যুকে আলিঙ্গনের তোড়জোর।আমি দেখেছি আপনার কাছ থেকে ফেরার পর তার মৃত্যুতৃষ্ণা….
সে মৃত্যুর আগেও শুধু একটাবার আমার কাছে স্বীকৃতি পেতে চেয়েছিল সে বেঁচে থাকলে অন্তত কেউ তার সঙ্গী হতো। অথচ আমি দেখছিলাম সে পালাবে, এই অল্প সময়ে সে শুধু বিশ্বস্ত কাউকে নিজের রেখে মরতে চায়।ʼʼ

হামজা বিদ্রুপের হাসি হাসে, “তুমি জয়ের বিশ্বস্ত কেউ হতে?

মাহেজাবিণ আর জবাব দেয় না। চুপচাপ চেয়ে থাকে হামজার দিকে। তাকে কখনোই কোনো অসুস্থ মানুষকে ব্যাঙ্গাত্বক চোখে দেখার শিক্ষা দেয়া হয়নি। হামজাকে দেখে তার খারাপ লাগছে না ভেবে খারাপ লাগে তার।

বিশ্বাসঘাতকতা তার ধর্ম নয়। জয় আমির মানুষ চিনতো খুব। সেদিন আরমিণ রাজী হওয়া মানে জয় আমিরের পাপা মেনে নেয়া, আর পাপ মেনে নিলে আরমিণ হতো তার সবচেয়ে বিশ্বস্তজন, আমরণের সাথী, কারণ আরমিণ ঠিক সাদা পায়রার মতোই পবিত্র আত্মা– এটাই জয়ের ধারণা ছিল। কিন্তু মিথ্যে আশা আরমিণ দেয়নি সেদিন তাকে। কারণ জয়ের পাপ হাশরেও কবুল নয় তার। আর জয় আমির আর বাঁচতে চায়নি। কারণ তার সহ্যক্ষমতা বিদীর্ণ হয়ে গেছিল এবার।

হামজার শরীর ঘেমে টুপটুপ করে পানি পড়তে লাগল, যেমনটা সদ্য গোসল করা মানুষের শরীর বয়ে যায়। দোলন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, “শান্ত হও, হামজা।ʼʼ

-“স্যার ওই চতুর মেয়েলোক কী বলছে? ওকে থামতে বলুন।ʼʼ
-“ও থেমেছে। তুমি নিজেকে থামাও…ʼʼ

বদ্ধ সেলের কংক্রিটের চার দেয়াল হামজাকে একটা বার্তা দেয়—

‘এক বিরোধিনী তোমার জয়ের রক্ত গর্ভে ধারণ করে সে হলো জয়ের সর্বোচ্চ আস্থাভাজন, তুমি আপনজন সেই রক্ত ধ্বংস করে হলে একমাত্র দূর্জন।ʼ

দোলন সাহেবের সঙ্গে কেইসের ব্যাপারে কিছু কথা হবার পর হামজা শেষবার একবার রিমির সঙ্গে দেখা করতে চায়। তারপর মাহেজাবিণকে ডাকে–

“আরমিণ! তুমি আর মুরসালীন পথে অন্ধকারকে পেয়ে বাধ্য হয়ে তা গ্রহণ করেছ। আমি অন্ধকারে জন্মেছি, আমি অন্ধকারে গড়ে উঠেছি।ʼʼ

-“অথচ তা কখনোই হামজা এবং জয় আমির হয়ে ওঠার শর্ত হতে পারে না।ʼʼ

হামজা হাসল, “সাবধানে থেকো। তোমার পথ ঠিক ততটা কঠিন হবে, যতটা তোমার কল্পনার সীমানায় নেই।ʼʼ

-“ধন্যবাদ আপনার শুভাকাঙ্ক্ষার জন্য। দেখা হচ্ছে আপনাদের নিজস্ব আদালতে।ʼʼ


অক্টোবরের ২০ তারিখ, ২০১৫ তে আসামী হামজার বিচারকার্য হয়েছিল অদ্ভুত। যাকে বলে অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু রাজনীতি মাত্রই অনাকাঙ্ক্ষার সমন্বয়মাত্র।

প্রথম আধাঘণ্টা কেবল হামজার রাজনৈতিক জীবনের ফিরিস্তি ও তার শারীরিক অবস্থা বর্ণনায় কেটে গেল। হামজার পক্ষের উকিল হামজাকে কেবল একজন পক্ষাঘাতগ্রস্থ পঙ্গু রোগী হিসেবে যুক্তি-তর্ক স্থাপন করে সেটা আদালতে উপস্থিত জনতার ভেতরে ফিট করতে করতে তিনি ঘেমে উঠলেন। দোলন সাহেবের সঙ্গে ভালো রকমের তর্ক হলো। কিন্তু মানবিকতার কথা নেই কোনো। ডিফেন্স মহোদয় রজব আলমগীর মানবিকতার ওপর প্রশ্ন তুলে পুরো আদালতকে আবেগী করে তুলতে সফল হয়ে গেলেন।

অবাককর ঘটনাটা খুব কম সময়ে ঘটে গেল। হামজা এমপির খুনই করেনি। সে করতেই পারে না। কারণ এমপির খুন তার এক্সিডেন্টের কমবেশি দুই-সপ্তাহ পরে সংঘটিত হয়েছে। হামজার চিকিৎসক এসে চমৎকার সাক্ষী দিয়ে গেলেন যে, সম্ভবই না। কড়কড়ে কাগজের রিপোর্ট পেশ করা হলো—হামজার মেরুদণ্ড(স্পায়নাল কর্ড) সড়ক দূর্ঘটনায় কী পরিমাণ ড্যামেজ, এই অবস্থায় রোগী নিজ শক্তিতে চলাচল করতে অবধি অক্ষম, সে কী করে এমপির খুন করতে পারে? তাকে এমপি মার্ডার কেইসে ফাঁসানো হয়েছে কেননা এমপি জীবিত অবস্থায় তাকে ভালো চোখে দেখতো না।

এছাড়া তার অপরাধ কেবল রাজনীতিতে একটু অনৈতিকতা আর কী! ওসব কোনো গোণায় ধরার মতো বিষয় নাকি? ১৬ই জুলাই দিবাগত রাতে পাটোয়ারী বাড়িতে যে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছিল, তা জয় ঘটিয়েছিল আদালতে প্রমাণ হয়ে গেল। হাতকাটা সেই ডাক্তার সাক্ষী দিলো।

মাহেজাবিণ পাথরের মতো বসে দেখল শুধু। শেষ সময়ে হুইল চেয়ার ঠেলে হামজাকে আদালতে আনা হয়েছিল। বিচারক মহোদয় নিজেই কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা হামজার অবস্থা দেখে। এরকম এক নিষ্পাপ, অসুস্থ যুবক এমন ধরণের অপরাধ করতে পারে?

হামজার নামে অভিযোগ হলো–সে নাকি এমপির ও এমপির স্ত্রীর ভাগিনা যে কিনা নিজের বোনের। স্বামী, তাকে খুন করেছে। এটা কখনও বিশ্বাসযোগ্য? নিজের বোনের স্বামীকে কেউ কেন খুন করতে যাবে? এছাড়া হামজার অবস্থা দেখার পর নতুন মোড় এলো, হামজার এই অবস্থা করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ও বিরোধী দলের কর্মীরা সম্মিলিতভাবে। অতিসত্বর তাদেরকে বিচারের আওতায় আনার হুকুম দিয়ে আদালত ফুরোলো।

দোলন সাহেব সব বুঝলেন, চুপচাপ গিললেন। হামজাকে আবার স্থানান্তর করা হলো পুলিশফাঁড়িতে। দোলন সাহেব গেছিলেন তার সঙ্গে সাক্ষাতে। হামজা হেসে ফেলল তাকে দেখে—

-“স্যার, আপনি আমার ওপর এত আক্রোশ কবে জমিয়েছেন?ʼʼ

-“কে বলে আক্রোশ?ʼʼ

হামজা হাসে, “অবাক হননি তো আবার আদালতে?ʼʼ

-“প্রশ্নই ওঠে না। আমি আনাড়ি বা অবুঝ-চোখকানা জনতা নই হামজা। আমার আন্দাজ ও জানা সম্বন্ধে তোমার ধারণা থাকা দরকার। শুধু বলো, তুমি কি এটাই চেয়েছিলে?ʼʼ

-“না। কয়েকদিন আগ অবধি চাইনি। তবে যেদিন আমার নারী-বিরোধী ও আপনি সাক্ষাতে এলেন, তারপর চাওয়াটায় বদল এলো। কী করব, স্যার? এক কোমড়ভাঙা মাগী মানুষ আর আপনার মতো হুট করে মানবিকতার গান গাওয়া উকিল মশার কাছে হারা তো আমার সাজে না!ʼʼ

আদালতের তারিখের দু’দিন আগে উপরমহলের সদস্য এলো হামজার কাছে। হামজার পরিকল্পনা তখনও— আদালতে উঠেই গড়গড় করে জীবনের সব সত্যি বলে দিয়ে ফাঁসির মালা গলায় চড়ানো।

এটা জেনে উপরমহল ক্ষেপে ক্ষেপণাস্ত্র। হামজা যে ভাঙা জাহাজের ছেঁড়া পাল হয়ে গেছে, যা দমকা হাওয়ায় দিগ্বিদিক হন্য হয়ে কেবল পতপত করে উড়ছে। তাতে উপরমহলের কোনো যায়-আসে না। তারা কেবল চান আদালতে সরাসরি হামজার কার্যক্রম সামনে না আসুক, কোনোভাবেই না। এটা হামজার নয়, দলের অস্তিত্ব ও নামের প্রশ্ন। এসব কাজ খোলা ময়দানে আসার মতো নাকি? আদালতে হামজা স্বীকার করবে যে সে একগাদা শিশু ও মুরসালীনের মতো যুবকদেরকে বড়ঘরের মতো কুঠুরিতে আঁটকে রেখে রক্তের খেলা খেলেছে, এটা হতে দেয়া যায় নাকি?

উপরমহল থেকে হামজাকে শাসিয়ে যাওয়া হলো যে— তার কিছুই সামনে আসবে না। সে প্রায় বেকসুরমতো খালাস পাবে, অথবা জনগণের মনের সান্ত্বণার জন্য তার ছোট-মোটো অভিযোগে দু-চার মাস কারাগারে কাটানো লাগতে পারে। এর জন্য যা যা দরকার, যা প্রমাণ, সাক্ষী, হাতে বানানো আদালত সব ব্যবস্থৃ উপর থেকে হয়ে যাবে, হামজা কেবল চুপ থাকবে, চুপ। এটুকুই তার কাজ। না হলে হামজার বউ, বোন, বোনের মেয়ের সাথে খুব একটা ভালো আচরণ করা হবে না। তার সাথে কী করা হবে, তা বলা যাচ্ছে না। আর তার বলা কথাগুলো ধামাচাপা দেয়া অসম্ভব কিছু না।

এসব কথা দোলন সাহেবকে হামজা বলল না। সে শুধু আরমিণের কাছে হারতে রাজী নয়।

এরপর উপরমহলের নজরদারীতে রইল সে। কিছুদিন পর পাটোয়ারী বাড়ির সিলগালা খুলে দেয়া হলো। রিমিকে সঙ্গে নিয়ে সেই মারণকুঠুরিতে বসবাস শুরু হলো। শরীরের অবনতি-উন্নতি কিছু নেই। বাম হাতটা কোনোমতো নড়াতে পারা যায়। চিকিৎসার জন্য পয়সা দরকার অগাধ, তবু নিশ্চয়তা নেই সামান্য কিছুটা উন্নতিও হবে কিনা! নিউরোলজিস্টরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। শরীর প্রায় সবটা অবশ। তার ভেতরের প্রতিক্ষণের অন্তরজ্বালা তাকে ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত মৃত্যুর দিকে নিয়ে চলল। দিনকে দিন সে হয়ে উঠল ঠিক তার হুইল চেয়ারটার মতোই জড়-অসাড় আসবাব।

আর রিমি তার জড় সেবিকা। যে সঙ্গ ছাড়েনি অথচ সঙ্গে নেই। হামজা রোজ প্রহর গোণে কবে জয় স্বপ্নে এসে একবার হেসে ভাই বলে ডেকে যাবে। হামজা শুনেছে মৃত মানুষ স্বপ্নে ডাকলে তারপর খুব শীঘ্রই মানুষ সেই মৃতর সঙ্গে চলে যায় জীবন ছেঁড়ে। সে রিমির কাছে রোজই অনুরোধ করে চলে যেতে। এক পঙ্গু, চলনশক্তিহীন মানুষের দেখভাল করে জীবন নষ্ট করার মানে নেই। তাকে ফেলে চলে গেলে কয়েকটা দিনই মাত্র হামজা বাঁচবে এই অরুচিকর দুনিয়ায়। এটা হামজার একমাত্র চাহিদা আজ। সে যেতে চায়, বহুদূর…যতদুর জয় পৌঁছে গেছে।

মাহেজাবিণ থামলে সিস্টার ক্যাথারিন সেদিন এ পর্যায়ে মিনিট দশেক চুপ থেকে আস্তে কোরে শুধু বলেছিলেন, “জয় আমিরের রেখে যাওয়া দ্বিতীয় কাগজটা কোথায়? দেখেছিলে সেটা?ʼʼ

(পরিশিষ্ট বাকি)