#অবশেষে তুমি
#লেখিকা-Nazia Shifa
#পর্ব-২১ ও ২২
—————————-
গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে সামিরা।কাব্যর ফুপাতো বোন সে।তখন
(কাব্য নিচে নামতেই সামিরা কোথা থেকে যেন হুড়মুড় করে এসে জরিয়ে ধরলো কাব্য কে।আচমকা এমনটা হওয়াতে কাব্য ও হকচকিয়ে এক কদম পিছিয়ে যায়।তাকে জরিয়ে ধরা অবস্থাতেই বলতে লাগলো-
-উফফ কাব্য জানো কত মিস করেছি তোমায়।তুমি অনেক পচা একটু খবর ও নাও না আমার।এমন কেন তুমি?
নিজের বড় ভাইদের সামনে এই অবস্থায় মেয়ের মুখে এসব কথা শুনে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে মিসেস নিয়তির।এত করে বোঝানোর পরও সে আবারো এমনই করছে।সামিরা বাড়িতে ছিলোনা।মিসেস নিয়তি ইচ্ছে করেই তাকে তার ফ্রেন্ডের বাসায় পাঠিয়েছিলেন।কারণ উনি জানতেন যে ও এমন কিছুই করবে।কাব্যদের আসার ব্যপারটাও তাকে বলেনি।কিন্তু হঠাৎ সকাল সকাল তাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন তিনি।মনে মনে এসব ভাবছিলেন মিসেস নিয়তি।কিচেন থেকে ড্রয়িংরুমে এসে সামিরার সামনে দাড়ালেন।কাব্য সামিরার দুই বাহু শক্ত করে চেপে নিজের থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।আর সাথে সাথে ই গালে চড় পরলো তার।মিসেস নিয়তি ই মেরেছেন।
বর্তমান –
-তোমাকে কত বার বলেছি সামিরা এসব কাহিনি আর করবেনা।নিজের মা,মামা-মামীর সামনে কাব্যকে জরিয়ে ধরতে তোমার একটু ও লজ্জা লাগলোনা।আর কাব্য তোমার বড় ভাই ওকে নাম ধরে কেন ডাকলে তুমি।ঈশা তিশার মতো ও তোমার ও নিজের বড় ভাই।ভুলে যাও কেন বারবার।
মিসেস নিয়তি যখন খুব বেশি রেগে থাকেন তখনই তাকে সামিরা আর তুমি বলে সম্বোধন করেন।তাই এখন ও সামিরার বুঝতে বাকি রইলো না যে সে প্রচুর রেগে আছে।’এমনটা না করলেও পারতি সামু পরেই তার সাথে দেখা করে নিতি।কন্ট্রোল করতে পারলি না নিজেকে।এখন তো মাম্মা পুরো রেগে আছে।কি করবি এখন?মনে মনে ভাবছিলো সামিরা।তারপর কাব্যর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে মিনমিনিয়ে বললো-
-সরি কাব্য ভাই আর এমন হবে না।আমি আসলে বুঝতে পারিনি।সরি।
অন্যদিকে তাকিয়ে কাব্য বললো-
-ঠিক আছে। তারপর নূরের উদ্দেশ্যে বললো-
-চা টা রুমে দিয়ে যাও নূর।এতক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে সবটা দেখছিলো নূর।মনে মনে রাগ ও উঠছিলো সামিরার ওপর।সে কেন তার বরকে জরিয়ে ধরবে।তাও এতোগুলা মানুষের সামনে লাজ সরম কিছু নেই নাকি তেল বেচতে গিয়েছে।হুহ
-নূর?
-জ্ব,,জ্বি (হকচকিয়ে)
-চা দাও এক কাপ।বলেই হনহন করে রুমে চলে আসলো সেখান থেকে। সাত সকালে মেজাজের একেবারে তেরোটা বাজিয়ে দিয়েছে।
তন্নী, ঈশা আর তিশা তিনজনই সিঁড়িতে দাড়িয়ে দেখছিলো সব।এদিকে কাব্যর মুখে নূর নাম টা শুনে কিচেনের দিকে তাকালো সামিরা।নতুন একজনকে দেখে কপাল কুচকালো সে।ভ্রু কুচকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-ও কে?
তার প্রশ্ন শুনে মিসেস নিয়তি বললেন –
-ও নূর।কাব্যর স্ত্রী আর আমাদের চৌধুরী বাড়ির একমাত্র ছেলের বউ।মানে তোমার ভাবি।তাই ও, সে না বলে ভাবি বলে সম্বোধন করো।আশা করি এই ব্যপারে আর কিছু বলতে হবেনা।কথাগুলো বলে কিচেনে চলে গেলেন তিনি।
উনি চলে যেতেই তন্নী,ঈশা আর তিশা সামিরাকে পাশ কাটিয়ে কিচেনে চলে গেলো।যাওয়ার আগে ঈশা তার দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কেটে বললো –
-আমাদের কাব্য ভাইয়ের বউ।কিউট ভাবিআপু।হুহ।
কিচেনে গিয়ে নূরের পাশে যেয়ে দাড়ালো তিনজন।
-গুড মর্নিং।
-গুড মর্নিং।ফ্রেশ হয়েছো?চা দিবো?
-হ্যা।ভাইয়ারটা দিয়ে আসো তারপর চারজন একসাথে খাবো।
-আচ্ছা।
.
.
চা নিয়ে রুমে আসলো নূর।পা ঝুলিয়ে বেডে বসে আছে কাব্য।নূর সামনে যেয়ে বললো-
-আপনার চা।
হাতে নিতে নিতে কাব্য বললো-
-থ্যাঙ্কিউ।নূর চলে আসতে নিবে তখনই শাড়ির আঁচলে টান পড়লো।থমকে দাঁড়ালো সে।পেছনে ঘুরে দেখলো কাব্যর এক হাতে চায়ের কাপ আর অন্য হাতে তার শাড়ির আঁচল মুঠ করে ধরে রাখা।
-কই যাও?
-নিচে,কেন আর কিছু লাগবে?
-হ্যা।
-কি?
-তোমাকে
কাব্যর জবাবে খানিক হকচকিয়ে গেলো নূর।
-মানে?
-বাংলা তেই তো বললাম বুঝোনি?না বুঝলে বলছি আমার খাওয়া শেষ হওয়া অব্দি এখানেই থাকবে।
-কেন?
-বলেছি তাই এখন বসো
-এত আস্তে খাচ্ছেন কেন?
-ইচ্ছা তাই
-হুহ,,সব তো আপনার ই ইচ্ছা।
-হ্যা।এদিক আসো।
সামনে এসে দাড়ালো নূর।তারপর বললো-
-কি হ,,
নূরের কথা শেষ হওয়ার আগে ই টুপ করে তার দুই গালে চুমু খেলো কাব্য।আকস্মিক ঘটনায় তব্দা মেরে গেলো নূর। চায়ের কাপ টা নূরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো-সকালে মিস হয়ে গিয়েছিলো এখন নিয়ে নিলাম।যাও।
নূর নড়লো না।লজ্জা ও পেলোনা।ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো।
তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাব্য বললো-
-কি হলো।এমন ভাবে দাড়িয়ে আছো যেন কি যেন করে ফেলেছি।
নূর কিছু বললো না। কাব্য কে অবাক করে দিয়ে টুশ করে তার গালে চুমু খেলো নূর।তারপর বললো –
-আপনাকে রোজ রোজ ফ্রী তে দিবো কেন।আমারো লাগবে আমিও দিবো। বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো নূর।
এদিকে গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে কাব্য।অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে বেচারা।গালে হাত রেখেই শব্দ করে হেসে দিল কাব্য। মেয়েটা আজকাল বড্ড পাগলামি করছে।তাকে যে বোঝাতে চাইছে কৌশলে সে সম্পর্কে ও অবগত সে।তবে এত সহজে মানবে না সে।তাকে নিজে থেকে প্রকাশ করতে হবে।তারপর সবকিছু হবে।
.
.
বারান্দায় চা নিয়ে বসেছে তন্নী, নূর,ঈশা আর তিশা।
-সামিরা টার স্বভাব আর বদলালো না।(ঈশা)
-হ্যা তা যা বলেছিস।(তিশা)
-তবে ফুপ্পির চড় মাড়াটা বোধহয় ঠিক হয় নি।(তন্নী)
-ঠিক ই করেছে আপি। (ঈশা)
-আচ্ছা,,কাহিনি কি?ক্লিয়ার করো (নূর)
বাধ্য হয়ে বললো নূর কারণ তারা তিনজন যা বলছে সবকিছু ই তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
-আসলে ভাবিআপু সামিরা কাব্য ভাইকে পছন্দ করে।ও কেমন জানি একটু গায়ে পড়া স্বভাবের আর কাব্য ভাইয়ার সাথে তো আরও বেশি।শুরুতে ভাইয়া এত বার বুঝিয়েছে কিন্তু ভালো কথায় কি আর কাজ হয়।ফুপ্পি ও জেনে গিয়েছিলো।ফুপ্পিও বুঝিয়েছে বাট তার একটাই কথা সে কাব্য ভাইকে ভালোবাসে,তাকে বিয়ে করবে হেনতেন।ইভেন ও যে কলেজে পড়তো সে কলেজে অলমোস্ট সবাইকে বলেছে কাব্য ভাই তার বয়ফ্রেন্ড।একদিন তো ভাইয়া চড় ই মেরে দিয়েছিলো তাকে। (তিশা)
-কেন?(নূর)
-সেবার ভাইয়া দের বাসায় গিয়েছিলাম আমরা তিনজন। আমরা দুইজন তন্নীর সাথে কথা বলছিলাম যেয়ে।এদিকে ও ভাইয়ার রুমে চলে যায় কাউকে না বলে।ভাইয়াতো এমনিতেই নিজের রুমে অন্য কারো আসা পছন্দ করে না।তার ওপর ও তাও আবার নক ও করেনি।ভাইয়া তখন সবে মাত্র শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে ছিলো। আর ও ওই অবস্থাতেই জড়িয়ে ধরেছিলো।সেদিন ঠাটিয়ে চড় পড়েছে বেচারি গালটা দেখার মতো ছিলো।হি হি হি।(তিশা)
প্রথম কথা শুনে যতটা রাগ হয়েছে চড় মারার কথা শুনে মনে মনে খুশি হলো নূর।খুশির ঠেলায় প্রকাশ্যেই বলে ফেললো –
-একবারে ঠিক করেছে আমি থাকলে আরও দুইটা দিতাম।হুহ।
নূরের কথা শুনে তিনজনই তার দিকে কেমন করে যেন তাকালো।তাদের তাকানো দেখে থতমত খেয়ে গেলো নূর। কি বলে ফেলেছে সে।মিনমিন গলায় বলল –
-আব,,আসলে,,
তার অবস্থা দেখে তিনজন ই হো হো করে হেসে দিলো।তাদের হাসতে দেখে নূর ও হেসে দিলো।
-এত খুশি কেন আমার মেয়ে গুলা?
মিসেস রাহেলার কথায় চারজন ই হাসি থামিয়ে তার দিকে তাকালো।
তাদের তাকাতেই উনি তাড়া দিয়ে বললেন –
-নাস্তা করতে আয় চারটা। কয়টা বাজে সে খেয়াল নেই এখন চা খাচ্ছে। তাড়াতাড়ি আয়।
.
.
-আমি আপনাকে ভালোবাসি রিদ ভাই।আর কতবার ফিরিয়ে দিবেন আমায়।এক বুক আশা নিয়ে বারংবার আপনার সামনে দাড়িয়েছি একটু ভালোবাসার আবদার নিয়ে আর আপনি প্রতিবার ই ফিরিয়ে দিয়েছেন।প্রতিবার ই এক বুক কষ্ট নিয়ে ফিরে গিয়েছি।গুটিয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে। ভেবেছিলাম আর আসবোনা আপনার কাছে।ভুলে যাবো।কিন্তু পারিনি।পারবোনা আমি।আমার আপনাকে ই চাই।প্লিজ ফিরিয়ে দিয়েন না।(কাঁদতে কাঁদতে বললো তন্নী)
তন্নীর রুমের বারান্দায় তার দিকে পিঠ দিয়ে দাড়িয়ে আছে রিদ।আর দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে তন্নী।চোখ দিয়ে তার অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আজ বড্ড কান্না পাচ্ছে তার।বারবার নিজের ভালোবাসার মানুষটার প্রত্যাখান আর অবহেলা মানতে পারছে না সে।উপরোক্ত কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে চুপ করলো তন্নী।রিদের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো সে।আজও ফিরিয়ে দিবে তাকে।আজও তার প্রশ্নের জবাব পাবে না সে।চোখের পানিটুকু মুছে আবার বললো-
-আজকেও চুপ করে থাকবেন?জবাব দিবেন না?আমি কি এতই খারাপ যে একটু ভালোবাসতে পারেন না।এতটাই নিকৃষ্ট মনে হয় আমাকে যে আমার দিকে তাকিয়ে দু-টো কথাও বলা যায় না?কেন এমন করেন আপ,,,
পুরো কথা শেষ করার আগে ই রিদ তন্নীর দিকে ঘুরে ডান হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো।তারপর শক্ত কণ্ঠে বললো-
-খবরদার এসব কথা বলেছো তো।তুমি মোটেও খারাপ না।আর ওই শব্দ টা ভুলেও মুখে আনবে না।মুখ থেকে হাত সরিয়ে তন্নীর মুখটা নিজের দু’হাতের আজলে নিয়ে বললো-
-আমার দেখা দ্বিতীয় পবিত্র আর সুন্দরী নারী তুমি।আর প্রথম হচ্ছে আমার মা।আমার প্রেয়সীর ব্যপারে এসব বলার সাহস কোথা থেকে পেলে।কখনোই এসব বলবে না।
রিদের মুখে কথাগুলো শুনে তন্নীর চোখ দুটো পানিতে টইটম্বুর একবারে।এতক্ষণ কষ্টে জল বিসর্জন দিলেও এখন খুশি।কারণ রিদের চোখ স্পষ্ট জানান দিচ্ছে যে সে তাকে ভালোবাসে। শুধু মুখে স্বীকার করা বাকি।
-আপনি আমাকে ভালোবাসেন রিদ ভাই?
তন্নীর কথায় হুঁশ ফিরলো রিদের। একপ্রকার ছিটকে সরে গেলো তার কাছ থেকে।আবারো তন্নীর দিকে পিঠ দিয়ে দাড়ালো।নিজের অনুভূতি আর চোখের পানি লুকাবার প্রয়াস মাত্র।কারণ তার মনের আকাশেও যে তন্নীর জন্য অনুভূতিরা ডানা ঝাপটায়।কিন্তু তাদেরকে মুক্ত হয়ে উড়তে দেয়ার মতো সাহস যে নেই।তবে আজ যে বড্ড ইচ্ছে করছে নিজের প্রেয়সী কে বুকে নিয়ে বলতে -আমিও তোমাকে ভালোবাসি। খুব বেশি ই ভালোবাসি।নিজেকে স্বাভাবিক করে শক্ত কণ্ঠে বললো রিদ-
-এগুলো বলার জন্য ডেকেছো আমাকে।কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা হয়ে যাবে আসি আমি।
রিদ চলে যেতে নিলেই তার হাত ধরে ফেললো তন্নী।টান দিয়ে নিজের ওপর ফেলে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে।কানের সামনে ফিসফিসিয়ে বললো-
-আমি জানি আপনি আমাকে ভালোবাসেন। মুখে না বললেও সমস্যা নেই আপনার চোখ স্পষ্ট বলছে আপনিও আমাকে ভালোবাসেন তাই এসব নাটক করবেন না।প্লিজ এবার অন্তত ফিরিয়ে দিয়েন না।
তন্নীর কথায় দমে গেলো রিদ।এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলেও এবার আর পারলো না।শক্ত করে জরিয়ে ধরলো তাকে।রিদের স্পর্শ পেয়ে তন্নী যেন আরও গলে গেলো।কান্নার পরিমাণ দ্বিগুণ হলো।তার চোখের আর নাকের পানিতে রিদের শার্ট ভিজে একাকার অবস্থা।
-কাঁদছ কেন?
তন্নী বুক থেকে মাথা উঠিয়ে জবাব দিলো-
-এমনি।
-এমনি বুঝি কেউ কাঁদে
-হ্যা কাঁদে আমি কাদি।আপনার জন্য অনেক কেঁদেছি।(নাক টানতে টানতে)
হাসলো রিদ। মেয়েটা তাকে বড্ড বেশি ই ভালোবাসে।তাকেই এতদিন ধরে কাদিয়ে আসছে সে নিষ্ঠুরের মতো।কিন্তু তারও যে কিছু করার নেই।যে পরিবার তাকে এত বছর ধরে আগলে রেখেছে,ভালোবেসেছে তাদের মেয়েকেই প্রকাশ্যে ভালোবাসার মতো স্পর্ধা দেখাতে সাহস হয় নি তার।তার ওপর এত বড় ঘরের মেয়ে তন্নী আর সে তো কিছুই না তার জন্য।তাই দূরে থেকেছে।নিজের অনুভূতি গুলো প্রকাশ করেনি কোনোদিন তবে আজকে পারলোনা লুকাতে।প্রকাশ হয়ে ই গেলো।
-এসব চলছে তাহলে তোমাদের মাঝে
আচমকা কারো কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো দু জন ই।ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে সামনে তাকালো রিদ।সামনে তাকাতেই,,
#চলবে
_______________________________________
পর্ব -২২
—————
-এসব চলছে তাহলে তোমাদের মাঝে
আচমকা কারো কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো দু জন ই।ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে তন্নীকে ছেড়ে দিয়ে সামনে তাকালো রিদ।সামনেই তাকাতেই নূরের গম্ভীর প্রশ্নসূচক মুখশ্রী দেখে ঘাবড়ে গেলো রিদ।প্রথম দিনেই কি ঝামেলা হয়ে যাবে?তাও এখানে?ভুল বুঝবে তাকে?রিদের মস্তিষ্কে যখন এই প্রশ্ন গুলো কড়া নাড়ছিলো তখন ই তাকে অবাক করে দিয়ে ফিক করে হেসে দিল নূর।তার সাথে সাথে তন্নী ও শব্দ করে হেসে দিল।গোল গোল চোখ করে অবাক চিত্তে তাকালো রিদ।একবার নূরের দিকে তো আর একবার তন্নীর দিকে।মুখ দিয়ো ‘চ’ সূচক শব্দ করে জিজ্ঞেস করলো-
-কি হয়েছে পাগলের মতো হাসছিস কেন?
হাসি থামিয়ে নূর বললো-
-তুমি এত বোকা কেন রিদ ভাই।এখনো বুঝলেনা এটা আমাদের প্ল্যান করা ছিলো।তন্নীকে আমিই বলেছিলাম এগুলা করতে।কালকে ছাদে বারবার তন্নীকে দেখছিলাম তোমার দিকে তাকাতে।সন্দেহ জাগছিলো তাই আজকে সকালে জিজ্ঞেস করলাম আর সে গড়গড় করে সব উগলে দিয়েছে।আর তারপর আমিই বলেছিলাম তোমাকে আজকে আবার বলতে।
নূরের কথা শুনে বিস্ময়ে রিদের চোখ জোড়া কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম।দুই পুচকি মিলে এভাবে বোকা বানালো তাকে আর সে টের ও পেল না।হায় ইজ্জতের পাভ-ভাজি হয়ে গেছে একেবারে।
-তোমার কেন মনে হলো যে কাব্য ভাই বা মামনি কেউ রাজি হবেনা। বেশি বুঝ তুমি।নিজে নিজে উল্পাপাল্টা ভেবে আমার নন্দীনি টাকে কষ্ট দিয়েছো যার শাস্তি স্বরূপ তিন বক্স চকলেট কিনে দিবে আমায়।
মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো রিদ।
-এত হাসিয়ো না এটা তো আমার তরফের শাস্তি বাকিটা তো বিয়ের পর তন্নী দিবে। আমি তো বোন দেখে চকলেট দিয়ে চালিয়ে দিলাম ও কি করবে কে জানে।(চোখ মেরে)
-বড্ড পেকে গেছিস দেখা যায়।কান মুলে দেব একবারে।
-হ্যা বড় হয়ে গিয়েছি তো। হি হি হি
এদিকে বিয়ের কথা শুনে তন্নীর মুখখানা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।তা দেখে নূর বললো-
-আয় -হায় বিয়ের কথা বলেছি আর লাল হয়ে গেছে এখনো বিয়ে হয় নি।এত লজ্জা পাওয়া লাগবে না এখন।অনেক সময় বাকি।
-আমি গেলাম(রিদ)
-আচ্ছা। আমার চকলেট
-আনবো
-ওকে।
.
.
.
বিকেল চারটা প্রায়।গাড়িতে সামনে দাঁড়িয়ে আছে কাব্য।দাড়িয়ে আছে বললে ভুল অপেক্ষা করছে নূরের জন্য।মিসেস রাহেলার কড়া আদেশে নূরকে নিয়ে বেরোচ্ছে কাব্য।তন্নী,তিশাদের সাথে নিতে চাইলেও পারে নি।মিসেস রাহেলার সাফ বলেছেন -তোরা একা ই যাবি ওরা না হয় রিদ আর ইরামের সাথে যাবে।মূলত ইচ্ছে করেই করেছেন এমনটা যাতে কাব্য আর নূর একসঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে পারে।বিয়ে কেমন পরিস্থিতিতে হয়েছে সেটা সবাই জানে।আর কাব্য যে সারাদিন অফিস নিয়ে ই পড়ে থাকে তাই এখন সময় পেয়েছে যেহেতু এখন একটু একা থাকুক।দু’জন দু’জনকে সময় দেক।
হঠাৎ সামনে চোখ পড়তেই কয়েকটা হার্ট-বিট মিস হলো কাব্যর।লাল আর গোল্ডেন পাড়ের শাড়ি পরিহিতা একজন রমনী এগিয়ে আসছে তার দিকে।যাকে দেখে এই মূহুর্তে তার মুখে একটা কথাই আসছে-অসম্ভব রকমের সুন্দর।কাব্যর কাছে এখন নূর যেন সদ্য ফোটা কোনো লাল গোলাপযা গুটিগুটি পায়ে হেটে আসছে তার দিকে।হলদেটে ফর্সা সে।গোলগাল চেহারা,পিঠ থেকে একটু নিচ পর্যন্ত তার চুল আর নেশা ধরানো এক জোড়া মায়াবী চোখ যাতে খুব যত্ন সহকারে কাজল লাগানো।মাশা -আল্লাহ নজর যাতে না লাগে আমর বউয়ের।কাব্য যখন মনে মনে তার প্রেয়সীর সৌন্দর্যের বর্ননা দিচ্ছিলো নিজেকে তখনই তার হাত ধরে ঝাকুনি দিলো নূর। সম্বিত ফিরল কাব্যর।শার্টের ফোল্ড করা হাতাটার দিকে ঠিক করার মতো করে বললো-
-এসেছো অবশেষে। বসো
-হুম।
গাড়ি চলছে নিজ গন্তব্যে তবে নূর জানে না তাদের গন্তব্য কোথায়।শো শো বাতাস বইছে চারিদিকে।দু’জন ই নিরব।আশেপাশের মানুষগুলো যে যার মতো ছুটে চলেছে।কারো দিকে কারো তাকাবার সময় নেই যেন।নূর গাড়ির জানালার কাচ ভেদ করে সেগুলোই দেখছে।নিরবতা ভেঙে নূর জিজ্ঞেস করলো-
-আমরা কোথায় যাচ্ছি?
-জানি না।
-জানিনা কেমন কথা?কোথায় যাচ্ছি বলুন না।
জবাব দিলো না কাব্য। নূরও আর জিজ্ঞেস করলোনা।খানিক বাদে নূর বললো-
-আচ্ছা জানালাটা খুলে দিন না।বাইরে কি সুন্দর বাতাস বইছে।
-কোনো দরকার নেই।এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিচ্ছি গরম লাগলে।
-এসিতে হবে না বাইরেরটা লাগবে।প্রকৃতির হাওয়া ওইটা এসিতে কি মিটবে।
-না মিটলে কিছু করার নেই।বাইরে ধুলোবালি আর তোমার যে ডাস্ট এলার্জি আছে ভুলে গেছো।
-আপনি কিভাবে জানলেন? আমি তো বলিনি
-এমনি।
আর কিছু বললো না নূর। কাব্য ও কিছু বললো না। আবারো নিরবতায় ছেয়ে গেলো কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।হুট করেই নূর চেচিয়ে বলল-
-গাড়ি থামান গাড়ি থামান কাব্য।
আচমকা নূরের চেঁচানো তে হকচকিয়ে গেলো কাব্য। গাড়ি ব্রেক করলো কোনোরকম।তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে ততক্ষণে নূর গাড়ির দরজা খুলে দৌড়।কাব্য ও পেছন পেছন গেলো।নূরকে হাওয়াই মিঠাইর দোকানের সামনে দাড়াতে দেখে কপলা কুচকালো কাব্য। ভ্রু কুটি কুচকে নূরের দিকে তাকালো সে।
-তিন তিনটা কালারের হাওয়াই মিঠাই একসাথে। মামা দুই টা দিন।
-কিসের দুই টা দিবে।মামা লাগবে না আমি কিনবো না।
-কেন কিনবেন না মামা আপনি দিন তো।
-দিবেন না বললাম তো।
-কেন কি সমস্যা? না করছেন কেন
-এগুলো আনহাইজেনিক নূর।আর ওই দিকে দেখো( হাত দিয়ে তাদের থেকে এক হাত দূরে অবস্থান রত বাচ্চা মেয়েটিকে ইশারা করে)
হাওয়াই মিঠাই খাচ্ছে সে।ঠোট জিহ্বা একেবারেই কালার প্লেটের মতো হয়ে গেছে।
দেখেছো।ভালো জিনিস না এগুলা মানুষ যে কেন খায়।
-একদিন খেলে কিছু হবে না একটা খাবো।
-বাসায় লিপ্সটিকের অভাব পড়েছে যে এগুলো দিয়ে কালার করতে চাইছো
-হ্যা পড়েছে
-তাহলে আসো লিপস্টিক কিনে দেই।
-লাগবে না আপনার লিপস্টিক। লিপস্টিক কিনে চাঁদে পাঠান।হুহ
রাগে দুঃখে হনহনিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো নূর। ‘সবকিছু তেই তার ইচ্ছা।আমার ইচ্ছের কি কোনো দাম নেই।লাগবেনা খাবো না আমি আর বলবো ও না আপনাকে। ‘
কাব্য এসে আবার ড্রাইভ করা শুরু করলো।আঁড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে নূরের দিকে। রাগ একেবারে চরম পর্যায়ে ঢেড় বুঝতে পারছে সে। কিন্তু কিছু বললো না সে।নূরও চুপ মেরে বসে আছে।
গাড়ি এসে থামলো একটা লেকের সামনে। শুনশান জায়গাটা।মানুষের আনাগোনা নেই তেমন একটা। লেকের স্বচ্ছ পানি,শীতল হাওয়া,মনোমুগ্ধকর কৃত্রিম সৌন্দর্য আর পাশে প্রিয় মানুষ।আর কি চাই। স্মৃতির পাতায় এক প্রিয় প্রহর যে।আজ আকাশটাও বড্ড সুন্দর লাগছে।সবকিছুই পরিমান থেকে বেশি সুন্দর লাগছে নূরের কাছে।কেন?তার মনের আকাশে কি প্রেমের রঙধনু উঠলো তবে?যার জন্য সে এত খুশি আর সবকিছুর সৌন্দর্য কে এত কাছ থেকে অনুভব করতে পারছে। হ্যা উঠেছে তবে।উঠুক।তার মনের অনুভূতি গুলো প্রকাশ্যে আসুক।নূর যখন চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত তখন কাব্য তার সামনে থাকা রমনীকে দেখতে ব্যস্ত।চোখজোড়া তার সরছেই না।তার ই না নজর লেগে যায়।তাড়াতাড়ি করে নূরের চোখের নিচ থেকে কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে একটু কাজল ছুয়ে দিলো।আর মনে মনে বললো- মাশা আল্লাহ।
-কি করলেন?
-কই কি করলাম,কাজল লেপ্টে ছিলো তাই
-ওহ
-হুম।
-পা ভিজাতে পারো চাইলে।এত কম সময়ে তো আর কক্সবাজার যাওয়া সম্ভব না তাই এখানেই কাজ চালিয়ে নাও।
মনে মনে এটাই চাইছিলো নূর কিন্তু বলতে পারছিলোনা। কাব্যর বলতে দেরি নূরের পা পানিতে ফেলতে দেরি হয়ে নি।কাব্য স্বল্প পরিসরে হাসলো আর নূরের পাশে বসে পড়লো।দু’জন ই নিশ্চুপ আবার।খানিক বাদে কাব্যর এক হাত জড়িয়ে ধরে তার কাধে মাথা রাখলো নূর। কাব্য ও সন্তপর্ণে তাকে আবদ্ধ করলো তার বাহুডোরে।একটু বাদে নূরকে জিজ্ঞেস করলো-
-তোমার খিদে পেয়েছে নূর?
-উহুম।
-সত্যি ই পায় নি?
-উহুম।
মিনিট দশেক পর কাব্য বললো-
-এখন তবে উঠি এখান থেকে।
খানিক মন খারাপ করে নূর বললো-
-এখন ই চলে যাবো?আর একটু থাকি প্লিজ।
কিছু বললো না কাব্য।তার প্রেয়সীর ও বুঝি তার পছন্দের জায়গাটা পছন্দ হয়েছে। কাব্যর বলতে গেলে প্রিয় জায়গা এটা।এখানে আসলেই সে এখানটায় আসে।আজও এসেছে তবে একা নয়।নিজের পছন্দের জায়গায় নিজের পছন্দের মানুষটাকে নিয়ে এমন সুন্দর মুহূর্ত ক’জন কাটাতে পারে।যে কাটাতে পারে তারতো সৌভাগ্য।
কিছুক্ষণ সেখানটায় কাটিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলো তারা।
#চলবে