অবশেষে তুমি পর্ব-৩৬+৩৭

0
764

#অবশেষে_তুমি
#লেখিক_Nazia_Shifa
#পর্ব_৩৬
_______________________
অন্ধকারাচ্ছন্ন রুম।মাথার ওপরে শুধু একটা ছোট বাল্ব মতো জ্বলছে।চেয়ারের সাথে হাত বাধা অবস্থায় নূর।মুখেও লাগানো সক্চটেপ।হলদেটে আলোয় ঘর্মাক্ত মুখশ্রী টা স্পষ্ট তার।থেমে থেমে শ্বাস নিচ্ছে সে।তখন গাড়িতে ওঠার সময় পেছন থেকে কেউ মুখ চেপে ধরেছিল।ছোটাছুটি করেও পেরে উঠেনি সে।তারপর,,তারপর কি হয়েছে মনে নেই তার।কোথায় আছে তা ঠাওর করতে পারছেনা।নিভু নিভু চোখ তাকালো আশেপাশে। খুব একটা বড় না ছোট কামরা মতো।ঘরের মধ্যিখানে অবস্থান তার।একটু দূরেই পুরোনো ছোট একটা টেবিল সাথে একটা চেয়ার। সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকাতেই চমকালো নুর।দরজার সামনে দাড়িয়ে আছেন এক জন মানবি। অস্পষ্ট তার চেহারা।আস্তে আস্তে তার দিকেই এগোচ্ছে।মধ্য বয়স্ক একজন মহিলা।ঠিক মধ্য বয়স্ক কিনা বোঝা মুশকিল।পরিমান থেকে অনেক বেশি সাজসজ্জা তার,দামি শাড়ি,মুখে ভারি মেকআপ।এক কথায় স্টাইলিশ বলা যায়।সামনে এসে পাশ থেকে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন নূরের মুখোমুখি হয়ে।গলা ঝেরে পরিষ্কার করে নিলেন তিনি।টান দিয়ে খুলে দিলেন নূরের মুখের সক্চটেপ।ঠোটঁ চেপে সহ্য করলো নূর।তার গালে এক হাত বুলাতে বুলাতে বললেন-

-‘দেখতে তো ভালোই সুন্দর এজন্যই বুঝি এত আদর আর সোহা/গ করে কাব্য।’

মুখ সরিয়ে একটু পিছিয়ে গেল নূর।তার ছোয়ায় গা ঘিনঘিন করছে। নারী হয়েও অন্য নারীর প্রতি এমন বিচ্ছি/রি মানসিকতা রাখে। ছিহ/হ।

সে আবার বললো-

”তোকে কিডন্যাপ করেছি সেই খবর তোর জা/মাই কে এখনো দেই নি।সে তো জানেওনা। ঝগড়া করেছিস না দুইজন,করার ই কথা।সে তো খু/নি একটা।”

নূরের থুতনিতে চাপ দিয়ে মুখ উঁচু করে বললেন-

-‘ইশশ,,এত ভালোবাসা আর এত বিশ্বাস এক ভিডিও তে সব ফুশশশ।’
বলেই কর্কশ আওয়াজ তুলে হাসতে লাগলেন।

তার কথা শুনে মুচকি হাসি দিল নূর। আর বললো –

-‘বিশ্বাস আর ভালোবাসার মর্যাদা বা ডেফিনিশন আপনি কি জানেন মিসেস শায়রা।জীবনে বিশ্বাস ভাঙা আর ভালোবাসার অপমান ছাড়া আপনি আর কি ই বা করেছেন।

নূরের কথা শুনে কিঞ্চিৎ অবাক হলেন তিনি।’কি বলছে সে?তার নামই বা জানে কিভাবে?তার তো চেনার কথা না।তাহলে?আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন –

-‘কি বলতে চাইছো তুমি?বা/জে কথা বলবেনা একদম।

আবারো হাসলো নূর।হাসি বজায় রেখে ই বললো-

-‘আমি না হয় বা/জে বক/ছি কিন্তু আপনি ঘামছেন কেন?আর আমতা আমতা করছেন ই বা কেন?

একটু কাছে এসে হিসহিসিয়ে বললো-

-‘ভয় পাচ্ছেন?এত বছরের সত্যি টা বেড়িয়ে আসবে বলে?

নূরের কথায় আরও ভয় পেয়ে গেলেন মিসেস শায়রা।তাড়াহুড়ো করে মুখে আবার স্কচটেপ লাগিয়ে দিলেন।

উদিগ্ন হয়ে ভাবতে লাগলেন –

-‘রিয়াদ কোথায় ম/রেছে?কখন গিয়েছে এখনো আসেনি।

নূর শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।মুখে স্কচটেপ থাকা স্বত্বেও স্পষ্ট ই বোঝা যাচ্ছে তার মুখে এখনো বিদ্যমান সেই মুচকি হাসি।রাগে গজগজ করতে করতে আবারও সামনে আসলেন নূরের।বাম হাত দিয়ে চুলের মুঠি ধরে ডান হাত দিয়ে থুতনি চেপে ধরলেন।মুখে হাসি থাকলেও ব্যথায় চোখ ভিজে গেল তার।মিসেস শায়রা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন-

-‘তোকে কিডন্যাপ করেছি কেন জানিস?তোর কাব্য কে আনার জন্য।তোর দ্বারা কাব্যে কে আনবো আমার কাছে।তারপর,, তারপর মে/রে ফেলবো।কেউ ঘুনাক্ষরে ও টের পাবেনা যেমনটা আপা আর সাদমান সাহেবেরটা পায়নি।সাত বছর হয়ে গেছে মে/রে ফেলেছি অথচ সবাই জানে সাদমান সাহেবের বিজন্যাস এ অতিরিক্ত উন্নতির কারণেই তারই পার্টনাররা তাকে মে/রে ফেলেছে।

বিস্ফরিত নয়নে তাকালো নূর। কি বলছে সে?নিজের বোন আর বোন জামাইকে মে/রে ফেলেছে?

নূরের চাহনির মানে বুঝে আরও উচ্চ স্বরে হাসলেন মিসেস শায়রা।হাসি থামিয়ে বললেন –

-নিজের বোন আর তার জামাইকে মারতেই কলি’জা কা*পেনি তো তোদের বেলায় তো কিছুই হবে না।
আবারো স্কচটেপ খুলে দিল নূরের তারপর বললো-

-‘তোকে মা/রা যাবেনা।তোকে দিয়ে টাকা কামাবো আমি।বিদেশি কাস্টমারের কাছে, চওড়া দাম পাবো।

হতভম্ব হয়ে গেলো নূর।সে কি মেয়ে পা/চারকারী চক্রের সাথে জড়িত?

নিজেকে ধাতস্থ করলো নূর।সত্যি জানতে হবে তাকে।বিস্ময়াভাব ঠেলে সরিয়ে চেহারায় কঠিনতা আনলো।কাঠ কাঠ গলায় জিজ্ঞেস করলো-

-কাব্যর সাথে কিসের শ/ত্রুতা আপনার?কি চান আপনি?

-সুন্দর প্রশ্ন করেছিস।কাব্য ই তো সব।ও ম/রলে পুরো পরিবারে শোকের ছায়া নামবে।ভেঙে পড়বে সে আর মজা নিব আমি।

-ক,,,কে ভেঙে পড়বে?

নূরের প্রশ্নের মাঝেই দরজা খুলে ভেতরে আসলো একজন মানব।তাকে দেখে বিরক্তি মাখা মুখশ্রীতে মিসেস শায়রা জিজ্ঞেস করলেন-

-রিয়াদ এতক্ষণে এসেছিস?কই ম*রে*ছিলি?

-‘স,,সরি ম্যাম,,আস,,আসলে

মিসেস শায়রা ভ্রুকুটি কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।জিজ্ঞেস করলেন-

-‘কি হয়েছে?তোতলাচ্ছি,,,পুরো কথা শেষ করার আগেই চুপ হয়ে গেলেন তিনি। বিস্ফোরিত নয়নে তাকালেন রিয়াদের পাশে থাকা দু’জন মানবের দিকে। তারপর রিয়াদের পানে তাকালেন।যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন উনি।দাঁত কিড়মিড় করতে করতে তড়িৎ গতিতে এগোতে নিলেই টান পড়লো হাতে।থমকে গেলেন তিনি।দুই হাত পেছনে মুড়ে তার গলায় ছুড়ি ধরে আছে নূর।তার টপসের ছোট্ট পকেটে ছিল ছুড়িটা।যার সাহায্যে অনেক আগেই হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছিলো।সামনের দুইজনকে দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো নূর।সেই দু’জন আর কেউ না কাব্য আর রিদ ই।মিসেস শায়রা নূরের হেন কান্ডে ঘাবড়ে গেলেন তবুও দমে না গিয়ে বাঁকা হেসে বললেন-

-‘ছুড়ি গলায় ঠিকই ধরেছিস কিন্তু চালানোর মতো সাহস যে নেই সেটা ভালো করেই জানি আমি।

তার কথা শুনে তাকে আরও চেপে ধরলো নূর।গলায় ধরে রাখা ছুড়িটাতেও জোড় দিলো যার দরুন গলার মাঝ বরাবর কেটে গেল কিছুটা।রক্তের জোগান হলো সেখানটায়।আকস্মিক আক্রমণে হতভম্ব মিসেস শায়রা।তার নিজের কথাই যে নিজের ওপর ভারি পড়বে বুঝতে পারেন নি উনি।
.
.
চেয়ারে হাত -পা অবস্থায় মিসেস শায়রা।কাব্য, নূর,রিদ আর রিয়াদ চারজনই তাকে ঘিরে ধরে আছে।ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছেন উনি।চেহারার ভাব দেখে বোঝা দায় তাতে অনুতপ্ততা নাকি হিংস্রতা।নীরবতা ভেঙে কাব্য ই জিজ্ঞেস করলো-

-‘তা মিসেস শায়রা রাধসান কোথায় এখন?

কাব্যর প্রশ্ন কর্ণধার হতেই চকিতে তাকালেন মিসেস শায়রা।কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন-

-আ,,আমি জানিনা।

-‘এখনো সত্যি বলবেন না?

নিরুত্তর মিসেস শায়রা।

-‘সমস্যা নেই আমি ই বলছি।রাধসান আবরার সাদমান আঙ্কেল আর শায়লা আন্টির একমাত্র ছেলে।সাত বছর আগে আঙ্কেল আন্টি কার এক্সিডেন্টে মা*রা যান।যদিও এক্সিডেন্ট ছিলনা সবাই ভেবেছিলো ওনার বিজনেস পার্টানার রাই এক্সিডেন্ট করিয়েছে কিন্তু আসল কালপ্রিট তো আপনি।আপনি মেরে*ছেন তাদের।বাবা আর সাদমান আঙ্কেল বন্ধু ছিলেন।শায়লা আন্টির ছোট বোন আপনি।বাবা-মা ছিলনা আপনাদের। তাই বিয়ের পর আপনাকে নিজের কাছে ই রেখেছিলেন আন্টি। আঙ্কেল আন্টির লাভ ম্যারেজ ছিল।সব কিছু ঠিকঠাক ই তো ছিলো তাহলে কেন করতে গেলেন এমনটা?

এবার মুখ খুললেন মিসেস শায়রা। চিৎকার করে বললেন –

-সহ্য হয়নি শায়লার সুখ।আমাকে কষ্টে রেখে ও সুখে থাকতে পারেনা।তাই মে/রে দিয়েছি ওকে।

একটু থামলেন উনি তারপর কোমল গলায় বললেন-

-‘ভালোবেসেছিলাম একজনকে কিন্তু পাইনি তাই তাকেও থাকতে দেইনি তার ভালোবাসার মানুষের সাথে।

-‘শুধুই কি এটা কারণ ছিল?সম্পত্তির কথা কে বলবে?

-‘হ্যা সম্পত্তির লো/ভেও করেছি।আমার বোন হয়ে ও এত সম্পত্তির মালিক হবে,এত বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে মেনে নিতে পারিনি।হিংসে হয়েছে খুব।তাই মে’রে ফেলেছি।সব সম্পত্তি আমার।

-আর রাধসান?ওকে এখনো বাচিয়ে রেখেছেন কেন?

-নিজের জন্য। ওর মাথায় শুধু একটা জিনিস ই আছে। আয়মান চৌধুরী তার বাবা-মায়ের খু/নি।তাকে আর তার পরিবার কে শাস্তি দিতে হবে।

-মেডিসিন খাওয়াতে খাওয়াতে ওর পুরোনো স্মৃতি সব ভুলিয়ে রেখেছেন। ব্রেনওয়াশ করে দিয়েছেন পুরো।ফা/কা মস্তিষ্কে শুধু অতটুকু কথা ছাড়া আর কিছুই নেই।যাতে ভবিষ্যতে আপনি কিছু করার পর সন্দেহের তীর আপনার ওপর আসলে আপনি সহজেই রাধসানকে ফাঁসিয়ে দিতে পারেন।তাইতো?

-হ্যা।

-রাধসান কোথায়?

-বাসায়।রুমে বন্দি করে রাখি।

কাব্য বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করলো-

-শিওর?সেখানে আছে?

কাব্যর কথায় সন্দেহ হলো মিসেস শায়রার।রিয়াদের দিকে তাকাতেই দেখলো সে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে।বুঝে গেলেন তিনি নিজের হার এবার নির্ধারিতই।

কাব্য আবার জিজ্ঞেস করলো-

-আঙ্কেল আন্টি কে তো মে/রেছেনই। আমার ফ্যামিলির পেছনে কেন লেগেছেন?

মিসেস রেহানা বিমূর্ষ গলায় বললেন –

-আয়মান চৌধুরী সেই তো সব। তার জন্য ই নিজের ভালোবাসা পাইনি আমি।

মিসেস শায়রার উক্ত বাক্যে কপাল কুচকে এলো সবার।

-মানে?(কাব্য)

-‘আমির’ যাকে ভালোবেসে ছিলাম আমি।তখন ছোট খাটো একটা চাকুরি করতো।বলেছিল ভালোমতো সেটেল হয়ে তারপর আসবে আমার হাত চাইতে।ভালোই চলছিল সব।প্রথমবারের মতো দেখা করতে গিয়েছিলাম আমরা।মোটরসাইকেলে ঘুরেছিলাম সেদিন তার সাথে।সারাদিন ভালোয় ভালোয় ই কেটেছে। বিকেলের একটু পরেই বাসায় আসলাম।বাসায় আসতেই চ*ড় পড়লো গালে।জানতে পারলাম আমিরের সাথে ঘোরার সময় দেখে ফেলেছিল সাদমান সাহেবের বন্ধু আয়মান চৌধুরী। উনিই বলেছেন সাদমান সাহেবকে।অক*থ্য ভাষায় ব*কা দিলেন আপা।সাদমান সাহেবও মুখ ফিরিয়ে নিলেন।শেষবার যখন বলতে গেলাম তখন আপা রুমে আটকে দিলো।টানা ১৫দিন আটকে ছিলাম চার দেয়ালের মাঝে।একদিন আপা এসে বললো-‘তাদের ভুল হয়েছে। এভাবে আটকে রাখা ঠিক হয়নি।আমি যাকে চাই তার সাথেই বিয়ে দিবেন।’আমিও বিশ্বাস করে ছিলাম তার কথা।টানা ১৫দিন পর বের হলাম রুম থেকে।কিন্তু সেটাই ছিলো বড় ভুল।সব প্রলয়ের শুরু সেখান থেকেই। সেদিন সন্ধ্যায়ই কাজি ডেকে অচেনা, অপরিচিত এক লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন আমার।খ্যা/ত মতো ছেলে ছিল।আমার সাথে মোটেও যায়না।আর সেই ছেলের খোজ আয়মান চৌধুরী ই দিয়েছিলেন।বিশ্বাস করতে পারিনি নিজের বোন ই এত বড় বে/ইমানী করবে।রাগে,ক্ষোভে ফুসে উঠে ছিলাম ভেতরে ভেতরে।তখন মা*রার চিন্তা ভাবনা আসেনি।সাদমান সাহেবের সম্পত্তি আর খ্যাতি দিনকে দিন বেড়েই চলেছিল। সূযোগ খুজছিলাম সেই সম্পত্তি তে ভাগ বসানোর।হুট করে মাথায়,আসলো একেবারে সরিয়ে দিলে কেমন হয়?’দিলাম সরিয়ে। বেশি কষ্ট করতে হয়নি।শুধু একজনকে ভাড়া করেছিলাম ট্রাক/চাপা দিতে। ব্যস কাজ হয়ে গেছে।রাধসান ১৪ কি ১৫বছরের ছিল।বাবা-মায়ের মৃত্যু তে ভেঙে পড়েছিল একদম।তার বাহানা তেই আবারো রাধসান মেনশনে পা রাখি।রাধসানকে তখন থেকেই মেডিসিন দিতাম খাবারের সাথে।একদিন খাবারের সাথো মেশাতে গিয়ে দরজার আড়াল থেকে দেখে ফেলেছিল রিয়াদ।সেও তখন ১৪-১৫ বছরেরই ছিল।ছুড়ি দিয়ে ভয় দেখিয়ে ছিলাম মুখ খুলেনি আর।রিয়াদ ড্রাইভার চাচার ছেলে। নিজের কাছে ই রেখে দিয়েছিলাম।মূলত রাধসানের ওপর নজরদারি করতে।মেডিসিনের এফেক্টে রাধসানের মস্তিষ্ক এখন স্মৃতি শূন্য। আগের কিছুই মনে নেই।তার শূন্য, ফাঁকা মস্তিষ্ক শুধু এতটুকুই জানে আমি তার আন্টি যে তাকে আদর যত্নে বড় করেছে, রিয়াদ তার বন্ধু, তার বিশ্বস্ত সঙ্গী।আর আয়মান চৌধুরী তার বাবা মায়ের খু/নী।রিয়াদ আমারো বিশ্বস্ত ছিলি তুই কিন্তু এভাবে পিঠে ছুরিকাঘাত করবি কল্পনাতেও ছিলনা।

-আপনার স্বামীর কি হলো?উনি কোথায়?

বাঁকা হাসি টেনে বললেন-

-‘সে তো বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায়ই আত্ম/হত্যা করে মা/রা গেছে।

-আত্ম/হত্যা করেছেন নাকি আপনি?

কাব্যর কথা শুনে বাকা হাসিটা দীর্ঘ করলেন আরও।বুঝতে বাকি রইলোনা তাকেও খু/ন করেছেন তিনি।

আঁতকে উঠল নূর।কীভাবে পারলো সে? কাঠ কাঠ গলায় বললো –

-‘মিসেস শায়লাও তো কল্পনা করেন নি যে তার আপন বোনের হাতেই তাকে খু/ন হতে হবে।কিভাবে খু/ন করলেন আপনি তিন তিনটা মানুষকে?কলি/জা কাপে/নি?

মিসেস শায়রা হাসি বজায় রেখে ই বললেন-

-আমি না হয় তিনটা খু/ন করেছি।তোমার স্বামী সেও তো ধোঁয়া তুলসি পাতা না।সেও তো রিয়াকে মে/রে ফেলেছে।ভুলে গেছ?রাগ করে যে চলে আসলে?

হাসলো নূর। মুখ বাকিয়ে বললো –

-আপনি এতটাও বো/কা নন।কিন্তু এখনো বুঝেননি?কিসের রাগ?কিসের খু/ন?জীবিত মানুষকে মৃ/ত বলছেন?

মিসেস শায়রা শেষোক্ত উক্তিটুকু শুনে হকচকিয়ে উঠে বললেন –

-মানে?

-মানে যাকে মৃত বলছেন সে এখনো বেঁচে আছে, ক’দিন পরে মর/বে।

কারো স্বর পেয়ে সামনে তাকালো সবাই।সবার ভাব ভঙ্গি স্বাভাবিক হলেও মিসেস শায়রা সামনে তাকাতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলেন।এ তো রিয়া। কিন্তু,, কিন্তু রিয়াকে তো রিয়াদ তার সামনেই সেই ইনজেকশন পুশ করেছিল আর,,আর কিছু ভাবতে পারলেন না তিনি।চকিতে তাকালেন রিয়াদের দিকে।তার তাকানো দেখে রিদ বলে উঠলো-

-রিয়াকে যেই ইনজেকশন দেয়া হয়ে ছিল সেটা নরমাল ড্রা/গ ছিল মাত্র। যার দরুন সেন্সলেস হয়ে পড়েছিল সে।শ্বাস আটকে ছিল কিছুক্ষণের জন্য।

এতটুকু বলে রিদ রিয়াদের দিকে তাকালো।তারপর রিয়াদ বললো-

-হ্যা।আপনাকে বলেছিলাম ইনজেকশন এর কাজ শুরু হয়ে যাবে।আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবে সে। আপনি রাধসান স্যারের কাছে যান। এখানে বাকি কাজ আমি দেখছি।রিয়ার বাকি যা করার কাব্য আর রিদ করবে।আপনি বিশ্বাস করেন আমায়।করারই কথা এতটা বছর আপনার ছোট বড় সব অপরাধে বিনাবাক্যে সঙ্গ দিয়েছি।আপনার সেই বিশ্বাস কেই কাজে লাগিয়েছি।চলে গেলেন আপনি। সেন্সলেস অবস্থায় রিদ রিয়াকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তটা সাথে পাশে দাঁড়ানো কাব্য স্যারকে ভিডিও বন্দী করলাম। দেখালাম আপনাকে,বিনাবাক্যে বিশ্বাস করে নিলেন আপনি।আপনার নাম্বার থেকেই সেন্ড করলেন নূরের ফোনে।তারাও ঝগ/ড়া করে আলাদা থাকার নাটক করলেন।প্ল্যান অনুযায়ী নূর ম্যামকে কিড/ন্যাপ করা হলো আজকে।নিয়ে আসা হলো এখানে,আপনাকে সম্মুখে আনার জন্য।

একটু থেমে আবার বললো-

-আপনার অপরাধের ভাগ আর নিতে পারছিলাম না।রাধসান স্যারের সাথে যা করছিলেন সহ্য হচ্ছিল না আর।সব কিছু জানার পরেও কিছু বলতে পারিনি এত বছর। বাবাকে বার কয়েক বলেছিলাম ‘আমি এখানে কাজ করবোনা।থাকবোনা এখানে’।কিন্তু বাবা সবসময়ই এক কথাই বলতেন-‘শুধু তার সাথেই থাকতে হয় সারাক্ষণ। এতটুকু তেই এত মোটা অঙ্কের টাকা পাস।কে দিবে এখন?হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।প্রতি বারই বুঝেছি,টাকার কাছে বি/কে গিয়েছে।কিন্তু কাব্য স্যার প্রায় মাসখানেক আগে হুট করেই আমার খোজ করে নিলেন।জোড় করে কিছু লোক ধরে নিয়ে আসলো।আসার পর জানতে পারলাম আমার পুরো পরিবার সম্পর্কে জানেন উনি।একটু পরই বাড়ি থেকে ছোট বোনের কল আসলো।বললো-

-কিছু অপরিচিত লোক নাকি বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। তাদের হাতে অস্ত্র ও আছে কেমন।

আগে জানতেন না উনি আপনি,বা রাধসান স্যারের কথা।সেদিন আমার থেকেই জেনেছিলেন।ওনার মাধ্যমে আশার আলো দেখেছিলাম আমি।এই সু-দীর্ঘ প্রলয়ের খেলার বুঝি অবসান ঘটবে। রাজি হয়ে যাই চোখ বন্ধ করে। অনুতপ্ততা যে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরে ছিল। আপনার কথায় রিয়া ম্যামকে দিয়ে তাদের এক্সিডেন্ট করিয়েছি।আপনার কথায়ই সেদিন ভার্সিটিতে তন্নী আর নূর ম্যামকে কিডন্যাপ করতে গিয়েছিলাম। আপনার কথাতেই কাব্য স্যারের অফিসের ম্যানেজারকে দিয়ে অফিসের একাউন্টে ঝামেলা পাকাতে গিয়েছিলাম।ক্ষতি করতে চেয়েছিলাম।দেউলিয়া বানাতে চেয়েছিলেন আপনি তাই আজকে আপনার অবস্থাই এমন হয়েছে।না আছে আপন মানুষ,না আছে টাকা-পয়সা আর সম্পত্তি আর না আছে আত্মসম্মান।সব দিক থেকে দেউলিয়া আপনি।আপনার কৃত-কর্মের কথা সব বলেছি ওনাকে।এতদিনে গুমরে গুমরে ম/রে যাওয়ার কথা কিন্তু আজকের জন্য ই বোধহয় বে/চে ছিলাম।সেই হসপিটাল থেকে ওই ডক্টর সম্পর্কে সব জেনেছেন উনি।তার কাছ থেকে যা যা মেডিসিন নিয়েছেন সেগুলোর প্রেসক্রিপশন ও ম্যানেজ করে নিয়েছেন।সে ডাক্তার এখন কোথায় জানেন?

মিসেস শায়রা প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকালেন।

অবিলম্বে জবাব দিলো রিয়াদ-

-‘হসপিটালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে। রাধসান স্যারও তো এমন ছটফট করতেন যন্ত্রণায় কাতরাতেন তার দেয়া সেই মেডিসিনের প্রভাবে।তার শাস্তি সে পাচ্ছে আপনারটাও পেতে হবে। সাথে আমিও তো পাবো আমারটা।আপনার অন্যায়,অপরাধ কে দিনের পর দিন প্রশ্রয় দিয়েছি আপনার ভয়ে সেটাও তো বড় অপরাধ।রাধসান স্যারকে এতক্ষণে হসপিটালে নেয়া হয়ে গেছে তাই না স্যার?

-হ্যা।(কাব্য)

রিয়াদ কিছু বলবে তার আগেই কাব্য রিয়াদ আর রিদকে উদ্দেশ্য করে বললো-

-তোমরা দুইজন নূর আর রিয়াকে নিয়ে ফার্ম হাউজে যাও আমি আসছি।

কাব্যর কথা শুনে নূর নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো-

-কোথায় যাবেন আপনি?

-কাজ আছে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও রিদ।

-জ্বি স্যার।কাব্যর আদেশ পাওয়া মাত্র ই চারজন বেড়িয়ে এলো গোডাউন থেকে।রওনা হলো ফার্মহাউজের উদ্দেশ্যে।কাব্য সাথে না আসায় মন খারাপ হয়েছে নূরের।হৃদ কুটিরে মেঘ জমেছে রাশি রাশি।ঘন ঘন পলক ফেলে ঠোটে ঠোঁট চেপে কান্না নিবারনের চেষ্টা করছে।সাথে চিন্তা ও হচ্ছে আবার কি করবে কাব্য? কোনো বিপদ হবে না তো?

#চলবে

#অবশেষে_তুমি
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_৩৭
__________________________
শরৎ এর আকাশে তুলোর ন্যায় উড়ো উড়ি করছে মেঘ।গতিবেগ তাদের অতিব দ্রুত যেন ছুটছে কোনো কিছুর পেছনে।কিন্তু কোথায়?কোন প্রান্তে যেয়ে থামবে?সেটা তো অজানা।গন্তব্যহীন তারা,গন্তব্যহীন তাদের যাত্রা। তবুও থামার নাম নেই,না আছে কোনো পিছুটান। বারান্দার এক কোণে ফ্লোরে বসে এমনই আকাশকুসুম ভাবনায় ব্যস্ত নূর।মৃদু বাতাসে উড়ছে এলোমেলো চুল গুলো।বাঁধতে যেয়েও বাঁধেনি। ফার্মহাউজে পৌঁছেই কোনোরকম শাওয়ার নিয়ে সোজা এসে বসেছে বারান্দায়।এক রুমে রিয়াদ আর রিদ, এক রুমে রিয়া আর এক রুমে আছে সে।কাব্য আসেনি এখনো।ফোন করেছিল কিন্তু রিসিভ করেনি।আর ট্রাই করেনি।একবার যেহেতু রিসিভ করে নি এখন শখানেক বার দিলেও করবেনা।নূর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশ পানে।চোখেমুখে প্রশান্তির সাথে বিষাদের ছাপ। তবে প্রশান্তি ছাপিয়ে বিষাদ ই জায়গা করে নিল মন – মস্তিষ্ক জুড়ে।মন আর মস্তিষ্ক দু’টোতেই কড়া আঘাত করছে কাব্যর বলা উক্তিটুকু ‘রিয়ার ক্যান্সার হয়েছে,লাস্ট স্টেজ,যেকোনো সময় ফুরিয়ে যাবে শ্বাস, নিথর হয়ে পড়বে তার দেহ।’ভাবতেই বুকটা ধক করে উঠলো তার।চোখ ফেটে কান্না আসছে।আর যাই হোক বন্ধু তাদের।এতটা বছরের বন্ধুত্ব সে যাই করুক তার প্রতি তাদের আচরণ কোনোটাই মিথ্যা বা নাটক ছিলোনা।আপন ভেবেছিলো তাকে।একসাথে কাটানো কত মধুর স্মৃতি আছে তাদের।কিভাবে ভুলবে সেগুলো?কিভাবে বিশ্বাস করবে যে এই মানুষটা তাদের কাছে অল্প দিনের জন্য ই আছে।আঙ্কেল আর ওর ভাই,তন্নী আর রিতু ওরা কিভাবে বিশ্বাস করবে?আর রাজ?সে তো ভালোবাসে রিয়াকে ওনার কি হবে?আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে নূর বললো-

-‘এমন না হলে কি হতো?সে নিজের সব ভুল বুঝতে পেরেছে তাহলে এত বড় শাস্তি কেন?মৃত্যু তো কেউ কামনা করে নি।আপনার তরফ থেকে দেয়া এটা?

-হ্যা। ওনার তরফ থেকেই দেয়া।

আচমকা কারো কণ্ঠ পেয়ে খানিক চমকে গেলো নূর। দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো দাড়িয়ে আছে রিয়া।তার তাকানো দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো রিয়া।নূরের পাশে এসে বসলো নত মস্তকে শব্দহীন ভাবে।নূর অপলক তাকিয়ে রইলো রিয়ার দিকে।তাকে দেখে যেন কান্নার পরিমান বেড়ে গেলো আর কিন্তু কাঁদ/ লোনা নূর।চোখের কোণে জমা পানিটুকু ও মুছে নিলো। কিছু বলার জন্য ধাতস্থ করলো নিজেকে।তার আগেই মুখ খুললো রিয়া।নিচু স্বরে বললো-

-‘তোর সাথে কোনো ঝামেলা ছিলনা আমার।অনেক বেশি ভালোবাসতাম তোকে।অনেক কাছের ছিলি।চারজনের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বন্ডিং ছিল তোর আর আমার।ভাসিটির সবারই জানা ছিল এটা।কিন্তু হুট করেই কেন জানি তোকে অসহ্য লাগা শুরু হলো।সব টিচার্সদের পছন্দের স্টুডেন্ট হয়ে গেলি তুই।সবসময় ভালো রেজাল্ট করতি।ভালো ব্যবহার, ভালো রেজাল্ট এর কারণে সবার প্রিয় ছিলি।জেদ চেপে বসেছিল।তোর থেকেও ভালো রেজাল্ট করার চেষ্টা করলাম।সবার চোখে প্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু তোর জায়গায় যেতে পারিনি।যখন জানলাম রাজের সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে তখন তোকে অপমান করার জন্য রাজের সাথে ভালোবাসার নাটক করি।সে সত্যি সত্যি ই ভালোবেসেছিল আমায় কিন্তু আমি শুধু আমার উদ্দেশ্যর জন্য ব্যবহার করেছিলাম।কিন্তু যখন জানলাম তোর বিয়ে ভাঙার পরেও কাব্য ভাইয়া তোকে বিয়ে করে নিয়েছে তখন রাগ উঠেছিল খুব।কাব্য ভাইয়া সিয়াম ভাইয়ার ফ্রেন্ড। আমার বার্থডে তে ওনাকে দেখেই চোখে লেগেছিল খুব।তাই হিংসে হয়েছিল।বার্থডে তে তার সাথে গায়ে পড়ে ডান্স করার ছবি গুলো জোগাড় করে দেখালাম তোকে যেন ঝগড়া হয় তোদের।হয়নি কিছুই সবটা সামলে নিয়েছেন উনি। তোকে ভয় দেখানোর জন্য লাইব্রেরীর পাশের রুমটায় আটকে রেখেছিলাম।সেইদিন ই রিয়াদ তার লোকদের সাথে ভার্সিটি এসেছিল তোকে আর তন্নী কে কিড/ন্যাপ করতে।করিডোরে দাড়িয়ে যখন লিসার সাথে তোকে আটকে রাখার প্ল্যান করছিলাম তখন সেটা দেখে ফেলেছিল রিয়াদ।ভিডিও করে নে সেটা আর তার জোরেই ব্ল্যাক/মেইল করছিলো আমাকে।সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে ক্যারিয়ার শুরু হওয়ার আগে ই শেষ হয়ে যেতো।ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।বাবা আর ভাইয়া জানলে আস্ত রাখবেননা।অতঃপর বিবোধ-বিবেক/হীনের মতো ছোট অপরাধ কে ঢাকতে বড় এক পাপ করে বসলাম।তার একদিন পরই অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য সামনে আসলো।কাশতে কাশতে নাক -মুখ দিয়ে ব্লাড বেড় হওয়া দেখেই মনের ভিতর ‘কু’ ডাকছিলো।ডক্টর দেখালাম।রিপোর্ট আসলো হাতে।আমার ভাবনাকে সত্যি প্রমান করে জানান দিলো ‘আমার মাথায় টিউমার হয়েছে তিনটা।ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত।ক্যান্সার পর্যায়ে চলে গিয়েছে আর এখন লাস্ট স্টেজে আছি।মেডিসিন নিলে যে কয়দিন বাঁচবো একটু ভালো থাকব হয়তো।কিন্তু বাঁচার কোনো আশা নেই।মুচকি হাসি দিয়ে বিদায় নিয়েছিলাম ডক্টরের কাছ থেকে।মেডিসিন নেই নি আর।কাউকে বলিনি।তারপর দিনই কাব্য ভাই ধরে ফেললেন তার আর তার প্রাণপাখির এক্সিডেন্ট করানোর অপরাধে।ঠিকঠাক ই ছিলাম।কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় হুট করে ই আবারো ব্লিডিং। শ্বাস আটকে যাচ্ছিলো।হসপিটালে নিয়ে গেলেন রিদ কাব্য ভাইয়া ও আসলেন।রিপোর্ট হাতে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়েছিলেন আমার দিকে।বিনিময়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিলাম- ‘ জীবনের শেষ সময়ে এসে আপনাকে সাহায্য করতে চাই।সেই সুযোগ টা দিবেন?
তারপর,,

রিয়াকে ঝা/পটে ধরলো নূর। কথা বন্ধ হয়ে গেলো রিয়ার।নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো।মিনিট দুয়েক রিয়া নিজেই ছেড়ে দিল নূরকে।বসা থেকে দাড়িয়ে পড়লো সে। কিছু না বলে পেছনে ঘুরে হাটা ধরলো।নূরও কিছু বললো না।ঠায় বসে রইলো সেখানে।

মিনিট দশেক বাদ কাঁধে শীতল স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো নূর। পাশ ফিরে কাব্য কে দেখেই জা/প্টে ধরলো তাকে।ভড়কে গেল কাব্য।তার বুকে মাথা রেখে অশ্রু ঝরাতে ব্যস্ত নূর।মনে হচ্ছে কেউ যেন ছুড়ি দিয়ে সেখানটায় আঘাত করছে বারংবার।রক্তক্ষরণ হচ্ছে এই বুকে।শক্ত করে দু’হাতে জড়িয়ে রাখলো নূরকে। করার কিছু নেই।এই কান্নার পিঠে সান্তনা দেয়ার জন্য কী ই বা আছে।কাব্যর চোখেও চিকচিক করছে অশ্রু কণা,জানান দিচ্ছে নিজের অর্ধাঙ্গিনীর ব্যথায় সেও কাতর।

কী অদ্ভুত না?ব্যথায় জর্জরিত দু’জন মানব মানবি কিন্তু ব্যথার উপশম হচ্ছে দুজনের দু’জনের মধ্যেই।নিজের প্রিয়তমাকে বুকে নিয়ে তার ব্যথা নিরাময়ে ব্যস্ত এক বৈধ প্রেমিক আর তারই উষ্ণ আলিঙ্গনে নিজের কষ্ট ভুলে নিজেকে শীতল করতে ব্যস্ত এই বৈধ প্রেমিকা।
.
.
.
কথায় আছে সময় কারো জন্য থেমে থাকেনা।কারো জন্য থেমে থাকেনা মানুষের জীবনও।সেদিনের পর কেটে গেছে একমাস তিনদিন।এই দিনগুলো গুনে গুনে রেখেছে সবাই।রাত পেরিয়ে নতুন ভোরের সাথে সময় ফুরিয়ে আসছে রিয়ার।ইদানীং শরীর একেবারেই খারাপ তার।রাজ বাদে সবাই জানে তার ব্যাপারে এখন।কিন্তু তার এক্সিডেন্ট করানো বা অন্য কাহিনি গুলোর কথা কাউকে জানায়নি নূর,কাব্য বা রিদ কেউই।এমনকি তন্নী আর রিতু ও জানেনা।প্রতিদিন ভার্সিটি শেষে রিয়ার বাসায় যেয়ে তার সাথে সময় কাটানো,তাকে নিয়ে আশেপাশে ঘুরতে যাওয়া রুটিন হয়ে গেছে এই একমাসে নূর,তন্নী আর রিতুর জন্য। আজও ব্যতিক্রম হয়নি।ভার্সিটি শেষেই তিনজন রওনা হয়েছে রিয়ার বাসার উদ্দেশ্যে।

মেয়ের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিরবে কান্না করছিলেন মিলন সাহেব।বাবা হয়ে এই বয়সে সন্তানের মৃত্যু দেখবেন কল্পনা ও করেননি তিনি।কীভাবে সহ্য করবেন তিনি?মা মরা মেয়েটাকে এত আদর, যত্ন করে পেলেছেন বাবা ছেলে মিলে আর সেই
মেয়েই এতটুকু বয়সে তাদের শূন্য করে দিয়ে চলে যাবে।বু/ক ফে/টে যায় তার কিন্তু মেয়ের সামনে তাকে স্বাভাবিক থাকার না/টক করতে হয়।চোখ মুছে প্রবেশ করলেন মেয়ের রুমে।তার উপস্থিতি টের পেয়ে পাশ ফিরলো রিয়া।মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ধক করে উঠলো মিলন সাহেবের।চোখের নিচে কালো দাগ,মাথার চুলগুলো ঝরতে ঝরতে এখন ক্ষীণ পরিমানে বাকি আছে, ফর্সা রঙটা ফ্যাকাসে রঙ ধারন করেছে,মুখে মুচকি হাসি।

মেয়ের পাশে বসলেন তিনি। কিছু বলবেন তার আগে রিয়া কমজোর গলায় বললো –

-বাবা,,তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা।এত সুন্দর জীবন দিয়েছো আমায়।মা তো সেই ছোট বেলাতেই চলে গেছে তবুও তুমি আর ভাইয়া মিলে সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছো।আম্মুর অভাব বুঝতে দেওনি আমায়।তোমার মতো বাবা আর ভাই পাওয়া চারটে খানি কথা না।কিন্তু তোমাদের ছেড়েই চলে যেতে হবে আমার।আমি যাওয়ার পর তুমি কিন্তু একদম কাদবে না বাবা।ভাইয়াকেও কাঁদতে না করবে।আমি চাইনা আমার জন্য তোমরা কাঁদো।একটুও কাঁদবেনা।

মেয়ের কথা শুনে আর সামলাতে পারলেননা নিজেকে।হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন।রিয়াও কেঁদে দিলো সাথে সাথে। কাঁদতে কাঁদতে ই বললো-

-কাঁদছো কেন বাবা?বললামনা একদমই কাদবে না এখনও যাইনি আমি তার আগেই আমর কথা অমান্য করছো। তুমি কি চাও আমি সময়ের আগেই চলে যাই?

হকচকিয়ে গেলেন মিলন সাহেব। কান্না থামিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন-

-না মা কি বলছিস এসব।কাঁদ বোনা আমি একটুও কাঁদবো না কথা দিলাম।

-গতরাতে ভাইয়াকেও বলেছিলাম।জানো ভাইয়া না খুব কাঁদ ছিলো।ওকেও বলেছি তুমিও ভাইয়াকে বলবে যেন একটুও না কাঁদে।

-ঠিক আছে বলবো।

হাসলো রিয়া। ফ্যাকাসে মুখশ্রীতে চোখে জল আর ঠোঁটে হাসি।বিষাদময় সেই মুখশ্রী,যেখানে তাকাতেই চোখ ভিজে গেলো দরজায় দাড়ানো তিন মানবীর।

-আরে তোরা কখন এসেছিস?

রিয়ার কথায় হুঁশ ফিরলো তন্নী, নূর আর রিতুর।রিয়ার অগোচরেই চোখ মুছে নিলো তিনজন।হাসি মাখা মুখে প্রবেশ করলো রুমে। তার প্রশ্নের উত্তরে তন্নী বললো-

-এই তো এখনই এসেছি।

-আচ্ছা। আয় বোস।

তাদের সাথে একটু কথা বলেই চলে গেলেন মিলন সাহেব।রিয়ার দুইপাশে বসলো তিনজন।তারা বসতেই রিয়া তিনজনের ই ডানহাত নিজের হাতে নিলো। নত মস্তকে বলা শুরু করলো-

-ভাইয়া আর বাবার পর তোরা তিনজনই আমার জীবনে এমন যাদের আপন মনে করি আমি।যারা এত যত্ন সহকারে আগলে রেখেছিস আমায়। পরিচয়টা খুব বেশিদিনের না আবার কম দিনের ও না।কিন্তু তোদের সাথে সম্পর্কটা আমার আত্মার ছিলো।কিন্তু মাঝে নূরের সাথে করা সবকিছুর জন্য তোরা আমাকে ঘৃণা করেছিস।দূরে সরে এসেছিলাম।কিন্তু এত কিছু হওয়ার পরেও শেষ সময়টায় তোরাই আগলে রাখলি আমায়।নূরের কাছে ক্ষমা চাওয়ার অধিকার বা মুখ নেই আমার কিন্তু পারলে তোরা ক্ষমা করে দিস।প্লিজ নাহয় আমি মরেও শান্তি পাবোনা।

রিয়ার কথা শোনা মাত্র ই হাত ঝারি দিয়ে সরিয়ে নিল নূর।দাঁতে দাঁত চেপে বললো-

-কতবার বলবো তুই আর এসব বলবিনা।কোনো রাগ নেই তোর ওপর না আমার না কাব্যর।আর না তন্নী আর রিতুর।তাহলে কেন বলিস বারবার।

রিয়া ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে নিচু স্বরে বললো-

-আর বলবোনা।

-হ্যা আর যেনো না শুনি।(রিতু)

-বাইরে যাবি রিয়া?একটু বাইরের হাওয়া বাতাস শরীরে লাগলে ভালো লাগবে দেখিস।(তন্নী)

-না রে ভালো লাগছে না।

-বেশি খারাপ লাগছে?(নূর)

-না অতটা না।

-তাহলে চল।(রিতু)

-ইচ্ছে করছেনা।

-ঠিক আছে তাহলে কালকে নিয়ে যাবো।কালকে না করবি না একদম।(তন্নী)

জবাবে কিছু বললো না রিয়া।মলিন হাসলো শুধু।

ঘন্টা দুয়েক থেকে চলে আসলো তিনজন।
.
.
.
দুপুর তিনটা কি সাড়ে তিনটা।বেডের ওপর চুপচাপ বসে আছে নূর।দুপুরে খাওয়াও হয়নি।কেমন যেনো অস্থির লাগছে তার।মনের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করছে অজানা আশঙ্কায়। এমন কেন হচ্ছে?উত্তর পায়নি।নূরের মলিন মুখশ্রীতে অপলক তাকিয়ে আছে কাব্য। আজ তাড়াতাড়ি ই ফিরেছে অফিস থেকে। তারও খাওয়া হয়নি দুপুরে।তার না খাওয়ার কারনটা অবশ্য নূর।জোড়াজুড়ি করেনি ভেবেছে একটু পর বুঝিয়ে সুঝিয়ে খাইয়ে দিবে।কিন্তু তার এমন চেহারা দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো কাব্যর।এই এক মাসে নূর যথেষ্ট চেষ্টা করেছে যেন রিয়ার ব্যপারটা তার ওপর অতিরিক্ত প্রভাব না ফেলে যার দরুন তাদের সম্পর্ক ও তার দ্বারা প্রভাবিত না হয়।কাব্য জানে সম্পূর্ণ টা।তার অভিযোগ নেই কোনো, করেওনি। তাহলে আজকে এমন দেখাচ্ছে কেন তাকে? কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার আগেই ফোনের টোন পেয়ে থেমে গেল।ফোন হাতে নিতেই দেখলো স্ক্রিনে ‘সিয়াম’ নামটা জ্বলজ্বল করছে।হঠাৎ সিয়ামের ফোন পেয়ে কেমন যেন লাগলো তার।তার ফোনের আওয়াজ পেয়ে নূরও তাকালো তার দিকে।ফোন রিসিভ করে সিয়ামের কান্নাভেজা কণ্ঠে বলা কথাটুকু শুনেই ফট করে নূরের দিকে তাকালো কাব্য। নূর প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ফোন কেটে সামনে আসলো নূরের।নূর উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলো-

-কি হয়েছে? কে ফোন দিয়েছে?

কাব্য শান্ত গলায় বললো –

-নূর,, রি,,রিয়া

এতটুকু শোনার পর আর বুঝতে বাকি রইলো না নূরের যে কাব্য কি বলতে চাইছে।টুপ করে চোখ থেকে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
আপন মনে আওড়ালো- মানুষ ঠিকই বলে ‘নিয়তি বড্ড সুন্দর।’

#চলবে