অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_১৮
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
সোফার উপরে বসতে বসতে বললেন,
-“আজ সন্ধ্যায় ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে পৃথাকে। সব ঠিকঠাক থাকলে কাল আকদ।”
সুফিয়া বেগম, পিয়াস, পিয়ালের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। কি বলছে পলাশ শিকদার এসব? পৃথার আবার বিয়ে দিবে? পিয়াস হতবুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে পড়লো। বাবাকে এতদিন সে বেশ বিচক্ষণ মানব বলেই জানতো। কিন্তু আজ সে এ কেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে? পিয়াস হতবাক স্বরে বলল,
-“এসব কি বলছো বাবা? পৃথার আবার বিয়ে? আজই পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?”
পলাশ শিকদার তাকালেন ছেলের পানে। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
-“আমার মাথা ঠিকই আছে পিয়াস। এ ছাড়া আর উপায় নেই কোনো। তুর্য চৌধুরী ইতমধ্যে পৃথার সম্মুখে চলে এসেছে। এখন যদি মেয়েটাকে সে সবকিছু বলে দেয় তখন কি হবে ভেবেছো?”
বাবার সব কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো পিয়াস এবং পিয়াল। কেন যেন সে পলাশ শিকদারের সিদ্ধান্তের সাথে একমত হতে পারছে না তারা। অতীতে তার পিতা মাতার একটা ভুলের কারনে পৃথার জীবনটা আজ এই মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মাত্র দশ বছর বয়স ছিল মেয়েটার। কোনো বাবা সেই বয়সে কিভাবে একটা মেয়ের বিয়ে ঠিক করে? তাও বিশ বছরের এক যুবকের সাথে? সে তো তুর্য বিয়ে না মেনে চলে গিয়েছিল বলে পৃথা বেঁচে গিয়েছিল। আর যদি তুর্য তখন বিয়েটা মেনে নিতো তখন কি হতো পৃথার? দশ বছর বয়সে একটা মানুষের না আসে শারীরিক পরিপক্কতা আর না আসে মানসিক পরিপক্কতা সেখানে তাদের বোন এমন এক বৈবাহিক সম্পর্ককে কিভাবে টেনে নিয়ে যেত সারাজীবন? বাবা মায়ের এমন কর্মে মাঝে মাঝে রাগ হয় পিয়াস এবং পিয়ালের। শুধুমাত্র তাদের সম্মান করে বিধায় মানুষ দুটোর মুখের উপর বলতে পারে না কিছু। আর তাছাড়া তারা এই সাত বছরে নিজের বাবা মায়ের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ততা দেখেছে। যারা নিজেরাই অনুতপ্ত হয়ে গুমড়ে গুমড়ে ম’রে প্রতিনিয়ত তাদের আর কি বলা যায়? কিন্তু এখন আবার কি শুরু করেছে পলাশ শিকদার? বহুদিন আগে নিজেদের কর্মকে ধুলিসাৎ করার জন্য আবার একই খেলায় মেতে উঠতে চাইছে। পিয়াল কিছুটা ক্ষেপে গেল বাবার উপর। সদ্য একুশ বছরে পদার্পণ করা যুবক পিয়াল। বয়সের ভারে শরীরের রক্ত টগবগে তার। পিয়াল কিছুটা ক্ষীপ্ত কন্ঠেই বাবার উদ্দেশ্য বলল,
-“মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার বাবা? কিসের বিয়ে? একবার বিয়ে বিয়ে খেলায় মেতে আমার বোনটার জীবন নষ্ট করেছো এখন আবার কি চাইছো তুমি? তাছাড়া তালাক…”
এই টুকু বলতেই হাত উঠিয়ে তাকে থামিয়ে দিল পিয়াস। বয়সের ভাড়ে সে বেশ বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ বটে। তাছাড়া বাবা মা ভক্তও বেশ। পিয়াস বেশ ঠান্ডা কন্ঠেই বলল,
-“বাবা পৃথার বিয়ে দেওয়া ছাড়া কি আর ওকে তুর্যের থেকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই? ওকে তো আমরা অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে পারি।”
পলাশ শিকদারের থমথমে মুখশ্রী। গম্ভীর কন্ঠে তিনি বললেন,
-“তোমার কি মনে হয় ওকে কোথাও পাঠিয়ে দিলেও সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? তুর্য পৃথার আর খোঁজ করবে না? ছেলেটা যদি ঢাকা থেকে রাজশাহী চলে আসতে পারে পৃথার খোঁজে তবে অন্য কোথাও কি যেতে পারবে। মনে রাখবে লোহা লোহা কাটে। তেমনি পৃথাকে একবার বিয়েটা দিয়ে দিলে তুর্য আর কিছুই করতে পারবে না।”
সুফিয়া বেগম এতক্ষন বসে বসে শুনছিলেন স্বামী সন্তানের কথা। তার ভীষন বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো,
-“তাহলে পৃথাকে ওর কাছে দিয়ে দাও। তুর্য যখন ওকে ফিরিয়ে নিতে চাইছে, মেয়েটাকে খুঁজতে খুঁজতে এতটা দূরে চলে এসেছে তখন আমাদেরও উচিৎ ওদের এক করে দেওয়া।”
হাজার হলেও মা তো। কোনো মা ই চায় না তার মেয়ের সংসার ভাঙুক। মনে মনে এত কথা বললেও সাহস করে স্বামীকে বলতে পারলেন না কিছুই। কারন মেয়ের জীবনের এই অবস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী তিনিই। বহুদিন আগে নিজের বান্ধবীর সাথে সম্পর্কটা গাঢ় করার জন্য বান্ধবীর ছেলের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ের আবদারটা সুফিয়া বেগমই করেছিলেন। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন মহিলা। একটু সাহস জুগিয়ে স্বামীকে বললেন,
-“ওদের তো তালাক হয়নি এখনও। এর মধ্যে মেয়ের অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবাটাও কি অন্যায় নয়?”
পলাশ শিকদার তাকালেন স্ত্রীর পানে। থমথমে কন্ঠে বললেন,
-“অন্যায়! কিসের অন্যায়? অন্যায় তো করেছিল ঐ তুর্য আমার মেয়েকে বিয়ের আসরে ফেলে গিয়ে। বিয়ের দিনই সে নিজের স্ত্রীকে ত্যাগ করেছিল। সাত সাতটা বছর আমার মেয়েটার কোনো খোঁজ খবর রাখেনি। একটা বারের জন্যও জানতে চায়নি আমার মেয়েটা বেঁচে আছে নাকি ম’রে গেছে। এতগুলো বছর পরে আজ এসেছে আমার মেয়েকে বউ বলে দাবি করতে, বউকে নিতে।
থামলেন পলাশ শিকদার। আবার বললেন,
-“আমি মানলাম ভুলটা আমাদের ছিল। বিশ বছরের এক তরতাজা পুরুষের সাথে দশ বছরের এক কন্যার বিয়ে দেওয়া ছিল আমাদের চড়ম ভুল। তাই বলে ও আমার মেয়েকে ফেলে যাবে? আমার মেয়েটা তো কোনো দোষ করেনি। এমনকি ও তখন ভালোভাবে বিয়ের মানেটাও বুঝতে শিখেনি। ওর জন্য, শুধুমাত্র ওর জন্য আমার মেয়েটাকে কত কি না সহ্য করতে হয়েছে, এলাকা পর্যন্ত ছাড়তে হয়েছে আমাদের। তারপরেও সবটা মেনে নিয়েছিলাম। পৃথার জীবনের অতীতের কিছুই সামনে আনিনি ওর। কিন্তু এখন তুর্য এসে কোথা থেকে জুটলো? আবার বউ বলে দাবি করছে আমার মেয়েকে। এতদিন কোথায় ছিল সে? কই আমার মেয়ের খারাপ সময়ে তো তাকে দেখিনি মেয়ের পাশে। যাক ধরে নিলাম বিয়ের দিনের ঘটনায় রেগে চলে গিয়েছিল। নিজের পাশে একজন নাবালিকা মেয়েকে মানতে পারেনি কিন্তু তারপর! তারপর কেন ও এই সাতটা বছর আমার মেয়ের খোঁজ খবর নিল না? ও অন্তত একটা কল করে মাফ চাইতে পারতো সবার থেকে। একবার বলতে পারতো ও বিয়েটা মেনে নিয়েছে তাহলে তো আর আমার মেয়েটাকে সমাজের চোখে ছোট হতে হতো না, সমাজ পরিবার বাজে মন্তব্য করার সুযোগ পেত না।
পলাশ শিকদার থেমে গেলেন আবারও। একটু সময় নিয়ে বললেন,
-“আমি সেই ছেলের হাতে আমার মেয়েকে কখনওই তুলে দেব না যে ছেলে আমার মেয়েকেই বিয়ের আসরেই ত্যাগ করেছিল।”
পলাশ শিকদারের প্রতিটি কথা সত্যি। এরপরে আর কিছু বলার থাকে না কারোরই। তবুও পিয়াস বলল,
-“তাই বলে তালাকহীন একটা মেয়েকে তুমি অন্যত্র বিয়ে দিতে পারো না বাবা।”
-“এমনিও ওদের বিয়ের রেজিস্টি হয়নি। তখন পৃথার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। এত অল্প বয়সে বিয়ে আইন বহির্ভূত।”
সুফিয়া বেগম ইতস্তত করলেন। আমতা আমতা করে বললেন,
-“তবুও তালাকের একটা ব্যাপার আছে। শরিয়ত মোতাবেক তো বিয়ে হয়েছিল ওদের।”
পলাশ শিকদার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন স্ত্রীর পানে। তীক্ষ্ম কন্ঠে বললেন,
-“তা আমি বুঝে নেব। তালাক দিইয়ে আমি বিয়ে দেব আমার মেয়ের। তবে পাত্রপক্ষ আজ সন্ধ্যায় পৃথাকে দেখতে আসবে তা জেনে রেখো।”
২২.
পৃথা দাঁড়িয়ে আছে তুর্যের ফ্ল্যাটের দরজার সম্মুখে। ভিতরে ঢুকবে নাকি ঢুকবে না দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে মেয়েটা। পৃথার দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যেই খুলে গেল দরজাটা। মেয়েটা প্রথমে ভরকে গেলেও পরক্ষনে সামলে নিল নিজেকে। চোখ তুলে সম্মুখ পানে তাকিয়ে দেখলো তুর্য হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথা আমতা আমতা শুরু করলো। তবে সে কিছু বলার আগেই তুর্য বলল,
-“এত দেরী করলে কেন? সেই কখন থেকে তোমার অপেক্ষা করছি।”
পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
-“আপনার সাথে কথা বলার বড়জোর পনেরো মিনিটের মধ্যে এসেছি আমি। এটা দেরী?”
তুর্য মৃদু হাসলো। অতঃপর বলল,
-“তোমার অপেক্ষার কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত যে কতটা ব্যথাদায়ক তা যদি তুমি একটা বার বুঝতে তবে আর আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে না।”
কথার ইতিতে গিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো ছেলেটা। দরজা থেকে সরে গিয়ে আবার বলল,
-“এসো ভিতরে এসো।”
পৃথা ভিতরে গেল। কাঁধ ব্যাগটা বসার কক্ষের সোফায় রাখতেই তাকে তাড়া দিল তুর্য। ছটফটে কন্ঠে বলল,
-“বসবে পরে, আগে রান্নাঘরে চলো।”
পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিহান কন্ঠে বলল,
-“রান্নাঘরে কেন যাব? আমি কিন্তু রান্না টান্না একদম পারি না। আপনি যদি আমাকে এখানে রান্না করার উদ্দেশ্যে এনে থাকেন তবে বলে রাখি আপনি ভুল স্থানে ভুল কার্যক্রম চালাতে চাইছেন।”
পৃথার কথায় তুর্য শরীর দুলিয়ে হাসলো। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,
-“তোমাকে রান্না করতে হবে না। আমি রান্না করবো তুমি চেয়ে চেয়ে শুধু দেখবে। এসো তাড়াতাড়ি।”
পৃথা অবাক হলো। অবাক সুরেই প্রশ্ন করলো,
-“আপনি রান্না করতেও পারেন?”
-“পারি তো। ইংল্যান্ডে যখন ছিলাম তখন তো একা একা রান্না করেই খেয়েছি।”
পৃথা হাসলো তৎক্ষণাৎ। মুখে হাত দিয়ে বলল,
-“আপনি ইংল্যান্ডে থাকতেন? তবে আপনাকে ব্রিটিশদের বংশধর বলে ভুল করিনি তো।”
তুর্য শীতল দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। মৃদু হেসে বলল,
-“তুমি কখনও ভুল করোনি। যা ভুল ছিল আমার ছিল আর তার শাস্তিও ভোগ করছি ভীষণ বাজে ভাবে।”
পৃথার ওষ্ঠের হাসি উবে গেল। নরম দৃষ্টিতে সে তাকালো তুর্যের পানে। কোমল কন্ঠে শুধালো,
-“কি ভুল করেছিলেন আপনি?”
তুর্য হাসলো আবারও। ভীষন সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যেতে চাইলো পৃথার প্রশ্নটা। একটা ঝুড়িতে কিছু চাল নিয়ে সে হাতে ধরিয়ে দিল মেয়েটার। মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-“আমি রান্না করবো আর তুমি শুধুমাত্র বসে বসে খাবে তা তো চলবে না। চালটা ধুয়ে নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি।”
পৃথা কথা বাড়ালো না। বাধ্য মেয়ের মতো চাল ধুতে শুরু করলো। ক্ষানিক সময়ের ব্যবধানে চাল ধোয়া শেষ করে মেয়েটা খেয়াল করলো তুর্য একটা ছু’রি দিয়ে সবজি কাটছে। পৃথা এগিয়ে গেল সেদিকে। তুর্যকে বলল,
-“দিন আমি করছি। আপনি বরং রান্না চাপান।”
তুর্য সাথে সাথে নাকোচ করে দিল পৃথার এ প্রস্তাব। সবজি কাটতে কাটতে বলল,
-“তার কোনো প্রয়োজন নেই। পরে দেখা যাবে সবজির বদলে ছু’রি নিজের হাতে চালিয়ে দিয়েছো।”
পৃথার দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। সে মানলো না তুর্যের কথা। বরং ছেলেটার হাত থেকে ছু’রি’টা কেড়ে নিয়ে বলল,
-“সরুন আমি কাটছি।”
তুর্যও এবার আর কিছু বলল না। সবজি কাটার দায়িত্ব সে পৃথাকে দিয়ে গেল রান্নার দিকে। মেয়েটা সবজি কাটছিল আর আড়চোখে দেখছিলো তুর্যকে। চুলার আঁচে ছেলেটার ফর্সা মুখটা কেমন রক্তিম বর্ণ ধারন করেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের উৎপাত দেখা যাচ্ছে, আবার মাঝে মাঝে ঠোঁট কামড়ে রান্নার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। পৃথা যেন তুর্যের এই রূপেই হারিয়ে গেল মুহুর্তেই, মুগ্ধ হলো তার দৃষ্টি। এতদিন ঝগড়ায় ঝগড়ায় নিজের ক্রাশ খাওয়াকে দমিয়ে রাখলেও আজ আর পারলো না। ছোট খাটো একটা ক্রাশ খেয়ে বসলো তুর্যের উপরে। আর সাথে বেখেয়ালিতে নিজের হাতটাও কেটে বসলো অবশেষে। সে সত্যিই তুর্যকে দেখতে গিয়ে সবজির বদলে হাতেই ছু’রি চালিয়ে দিয়েছে। তবে খুব বেশি কাটার আগেই লাফিয়ে দূরে সরে গেল মেয়েটা। কন্ঠে তুললো “আহহহ” মূলক ব্যথাতুর ধ্বনি। হকচকালো তুর্য। চুলার দিক থেকে পাশ ফিরে তাকিয়েই দেখলো পৃথার বাম হাত কেটে লাল রক্তের আভাস দেখা দিয়েছে। অস্থির হয়ে উঠলো ছেলেটা। দ্রুত এলো পৃথার নিকট। মেয়েটার কাটা হাত খানা ধরে বিচলিত কন্ঠে বলল,
-“কি হয়েছে দেখি।”
চলবে…..
অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_১৯
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
মেয়েটার কাটা হাত খানা ধরে বিচলিত কন্ঠে বলল,
-“কি হয়েছে দেখি।”
তুর্যের আকস্মিক স্পর্শে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো পৃথা। সে নিজের হাতটা সরিয়ে নিতে চাইলো ছেলেটার হাত থেকে। আমতা আমতা করে বলল,
-“কিছু হয়নি।”
হাত নিয়ে পৃথার মোড়ামোড়িতে বিরক্ত হলো তুর্য। চোখ গরম করে সে তাকালো মেয়েটার পানে। চুপসে গেল পৃথা, আর নিজের হাত টানাটানি করলো না। তুর্য কিছুটা সময় নিয়ে বিচলিত ভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণ করলো পৃথার হাতের আঙ্গুলটা। অতঃপর হুট করেই কিছু না বলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
ক্ষানিক সময় অতিবাহিত হতেই আবার হন্তদন্ত হয়ে ফিরলো হাতে প্রাথমিক চিকিৎসার একটি বাক্স নিয়ে। পৃথার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
-“হাতটা দাও তাড়াতাড়ি। ঔষধ লাগাতে হবে।”
পৃথা অবাক হলো। সামান্য একটুই তো কেটেছে। বেশি কাটার আগেই হাতটা সরিয়ে ফেলেছিল মেয়েটা। এই টুকু কাটায় আবার কি ঔষধ লাগাবে? তাছাড়া এসব ঔষধ পথ্যের পুরো বিপরীতে চলাচল পৃথার। এই ঔষধ নামক পদার্থটা দুই চোক্ষে সহ্য করতে পারে না। তার উপর এই ঔষধ কাটা স্থানে লাগলে জ্বলবে। পৃথা নিজের হাতটা দিলো না বরং আরও গুটিয়ে নিল। ঢোক গিলে বলল,
-“এসবের আবার কি প্রয়োজন? একটুই তো কেটেছে।”
তুর্য তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে অতঃপর নিজে থেকেই মেয়েটার হাতটা টেনে নিল নিজের দিকে। বাক্স থেকে ঔষধ বের করতে করতে বলল,
-“তা আমি বুঝে নেব। ছোট মানুষ তুমি, এত বুঝতে হবে না তোমাকে।”
তুর্য নিজ দায়িত্বে পৃথার হাতে ঔষধ লাগাতে শুরু করলো। সাথে সাথেই হাত জ্বলে উঠলো মেয়েটার। হাতটা একটু টেনে কন্ঠে ব্যথাতুর ধ্বনি তুলে বলল,
-“আহহহ লাগছে।”
তুর্য নিজের হাত থামিয়ে দিল। ঔষধ লাগানো বন্ধ চোখ তুলে তাকালো পৃথার পানে। মেয়েটা কেমন চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে, গোলাপীরাঙা নরম কোমল ওষ্ঠজোড়া কাঁপছে তিরতিরিয়ে। পৃথার ব্যথায় যেন ব্যথা পাচ্ছে তুর্যের হৃদয়। কষ্ট হচ্ছে ছেলেটার, বুকের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে চলছে ক্রমশ। তুর্য আর ভাবলো না। নিজের ব্যগ্রতা নিয়ে ওষ্ঠ গোল করে ফু দিতে শুরু করলো পৃথার হাতে। পিটপিট করে আঁখিদ্বয় মেলে তাকালো পৃথা। নিজের সম্মুখের পরিস্থিতি অবলোকনে আশ্চর্য হলো ভীষণ। গোল গোল চোখে সে তাকালো তুর্যের পানে। তুর্য আলতোভাবে পৃথার হাতে ফু দিচ্ছে আর ঔষধ লাগাচ্ছে। তুর্যের মুখ থেকে নিঃসৃত বায়ুর স্পর্শে যেন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মেয়েটার শরীরের প্রতিটি লোমকূপ। শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে শুরু করেছে শীতল রক্তস্রোত। এ কেমন অনুভূতি? এ কেমন ভালো লাগা? হৃদয়টা যেন প্রশান্তিতে ছেয়ে যাচ্ছে পৃথার। সকল ব্যথা যেন সুখে পরিনত হচ্ছে এই মুহূর্তে। এমন কেন হচ্ছে? তবে তাদের এই সুখকর মুহূর্তটা বোধহয় সহ্য হলো না কারো। আরুশ এসে উঁকি দিল রান্নাঘরের দরজায়। মিহি কন্ঠে ডাকলো,
-“স্যার।”
আরুশের ডাকে ধ্যান ভাঙলো পৃথা এবং তুর্য উভয়েরই। হঠাৎ তুর্যের হাতে নিজের হাত থাকা অবস্থায় আরুশকে এভাবে দেখে অপ্রস্তুত হলো পৃথা। ছিটকে দূরে সরে গেল সে। তুর্য বিরক্ত হলো। দাঁতে দাঁত চেপে তাকালো আরুশের পানে। কটমট করে বলল,
-“আসার আর সময় পেলি না বেয়াদব?”
ঢোক গিললো আরুশ। আমতা আমতা করে বলল,
-“আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি স্যার। কিন্তু জরুরী একটা কথা ছিল তাই না এসেও পারলাম না।”
তুর্যের কপালে ভাঁজ পড়লো। হতে পারে আরুশ সত্যিই কোনো জরুরী কথা বলতে এসেছে। কালই তো গো’লা’গু’লি লাগলো। কিন্তু সেসব কথা তো আর পৃথার সামনে বলা যাবে না। তুর্য নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বলল,
-“আমার রুমে অপেক্ষা কর। আসছি আমি।”
-“রুমে যেতে হবে না স্যার। এখানেই বলছি।”
তুর্যের কপালের ভাঁজ গাঢ় হলো। এখানে বলার মতো জরুরী কথা? তবে কি হতে পারে? থমথমে কন্ঠে তুর্য প্রশ্ন করলো,
-“কি কথা?”
এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো আরুশ। আগ্রহী কন্ঠে বলল,
-“স্যার আমার খাবারটাও কি আপনি রান্না করবেন? নাকি আমি বাইরে খেয়ে নেব?”
তুর্যের মেজাজ বিগড়ালো ভীষণভাবে। এটা আরুশের জরুরী কথা? বউয়ের সাথে কত সুন্দর একটা সময় অতিবাহিত করছিলো, তার মধ্যে এই উদ্ভট জরুরী কথা বলতে এসেছে বেয়াদবটা? তুর্য ব্যস্ত হয়ে আশেপাশে তাকালো। হাতের কাছে একটা কাঠের খুন্তি পেয়ে তা তুলে নিল অতি দ্রুত। গভীর ক্রোধে সে খুন্তিটা ছুঁড়ে মারলো আরুশের পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“তোর তিন দিনের খাবার বন্ধ। ব্যাটা মীর জাফরের বংশধর।”
আরুশ দ্রুততার সাথে খুন্তিটা ক্যাচ ধরলো। বোকা বোকা কন্ঠে বলল,
-“তিন দিন আমি না খেয়ে কিভাবে থাকবো স্যার? শুকিয়ে শুঁটকি হয়ে যাবো।”
তুর্যের ক্রোধ এবার আকাশ ছোঁয়া। এই ছেলেটা যে বোকা নয় তা সে জানে। বোকা হলে তো আর তার সাথে কাজ করার সুযোগ পেত না। কিন্তু ছেলেটা তার সম্মুখে এলেই কেমন বোকা বোকা কথা বলে। তুর্য চেঁচিয়ে উঠলো। ধমকের সুরে বলল,
-“আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ আহাম্মক। তোকে যেন আমি আমার চোখের সামনে না দেখি।”
তুর্যের ধমকে কেঁপে উঠলো আরুশ। দেরী না করে চট জলদি সে বেরিয়ে এলো তুর্যের ফ্ল্যাট থেকে। তুর্য এই মুহূর্তে যে পরিমাণ রেগে আছে তাতে তাকে কাঁচা চিবিয়েও খেয়ে ফেলতে পারে। জান বাঁচানো ফরজ। আগে নিজের প্রাণ বাঁচানো তারপর অন্য কিছু। অবশ্য আজকের মতো যতটুকু প্রতিশোধ নিয়েছে এতটুকুই যথেষ্ট। সব সময় তাকে শুধু মীর জাফরের বংশধর, মীর জাফরের বংশধর বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। এবার সেও মীর জাফরের বংশধরের মতোই তুর্যের প্রেমে ব্যাগড়া দিয়ে এসেছে। আহহ এতদিন পর একটু শান্তি লাগছে আরুশের প্রাণে।
আরুশ চলে যেতেই তুর্য আবার আগের রূপে ফিরে এলো। তবে এবার সে ঐ সবজি টবজি বাদ দিয়ে নামলো বিরিয়ানি রান্নার কর্মে। যে সবজির জন্য তার বউয়ের হাত কাটলো আজ সে সবজি সে খাবেই না। পৃথাকে আর কোনো কাজে হাত লাগাতে দিল না তুর্য। মেয়েটা আগ বাড়িয়ে কোনো কাজে হাত লাগাতে গেলেও ধমকে থামিয়ে দিল। হুংকার তুলে বলল,
-“হাত কেটে শান্তি হয়নি? এবার গলা কা’ট’তে চাইছো নাকি?”
তুর্যের এমন তর্জন গর্জনে আর কোনো কাজে হাত লাগালো না পৃথা। শুধুমাত্র উঁকিঝুঁকি মেরে বার কয়েক তাকালো বিরিয়ানি রান্নার পানে। তুর্য রান্নার কাজ সামলাতে সামলাতেই পৃথাকে বলল,
-“খিচুড়ি, বিরিয়ানি, গরুর মাংস, পায়েস এগুলো শিখে রেখো। আমার প্রিয় খাবার এগুলো।”
পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে শুধালো,
-“আপনার প্রিয় খাবারের রান্না শিখে আমার কাজ কি?”
তুর্য ঠোঁট কামড়ে হাসলো। পৃথার পানে একটু ঝুঁকে বলল,
-“ভবিষ্যতে আমাকে রেঁধে খাওয়াবে। তোমার হাতের রান্না খাওয়ার জন্য জ্বীহ্বা আমার উতলা হয়ে পড়েছে।”
পৃথা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-“ঐ উতলাই হবে শুধু খেতে আর পারবেন না।”
তুর্য হাসলো একটু খানি। পৃথার কথার জবাব দিন না আর। কিছুটা সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে রান্না শেষ করলো সে। অতঃপর একটা প্লেটে নিয়ে রান্নাঘরেই পৃথাকে বিরিয়ানি ধরিয়ে দিল। উদগ্রীব কন্ঠে বলল,
-“ঝটপট খেয়ে বলো তো কেমন হয়েছে।”
পৃথা নিজেও ভীষন উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল তুর্যের রান্নার স্বাদ নেওয়ার জন্য। সে মেয়ে হয়ে এখনও রান্না জানে না অথচ একটা ছেলে হয়ে তুর্য রান্নাতে পটু। ছেলেটা কেমন রান্না করে সে বিষয় আগ্রহ তো জাগবেই। পৃথা দেরী করলো না। ঝটপট হাত ধুয়ে হাত লাগালো বিরিয়ানিতে। এক লোকমা মুখে দিতেই চমকে গেল মেয়েটা। বাহ! দারুন স্বাদ তো। একদম রেস্টুরেন্টের মতো। পৃথা লাফিয়ে উঠলো। তুর্যকে বাহবা দিয়ে বলল,
-“আপনি এত ভালো রান্না করতে পারেন জানা ছিল না। আপনার ভবিষ্যৎ স্ত্রী নিশ্চই অনেক ভাগ্যবতী।”
তুর্য হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো। বিরিবিরিয়ে বলল,
-“কিন্তু সেই ভাগ্যবতী নারীই তো আমার কাছে ধরাই দিতে চাইছে না।”
পৃথা শুনলো না তুর্যের বলা কথাগুলো। সে মনোযোগ দিল বিরিয়ানিতে। খেতে খেতে হঠাৎ মেয়েটার মনে পড়লো সময়ের কথা। সেই কখন সে এ বাড়িতে এসেছে। নিশ্চই বাড়ির মানুষ চিন্তা করছে। কিন্তু কল তো দিল না কেউ। নাকি দিয়েছে কিন্তু সে টের পায়নি। পৃথার চিন্তা হলো। এতক্ষন সে বাড়ির বাহিরে। বাবা, ভাইরা যদি আবার বকাবকি করে। মেয়েটা কোনো রকমে নাকে মুখে বিরিয়ানি শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। হাত ধুয়ে তড়িঘড়ি করে তুর্যকে বলল,
-“আমি এখন আসি। অনেকক্ষণ বাসা থেকে এসেছি বাবা বকবেন।”
কথাটা বলেই ব্যস্ত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করলো পৃথা। তুর্যও এলো পিছু পিছু। মেয়েটা ততক্ষণে বসার কক্ষের সোফায় সোফা থেকে কাঁধ ব্যাগটা তুলে কাঁধে ঝুলিয়েছে। তুর্য ওষ্ঠ ফাঁকা করলো কিছু বলার জন্য। তবে তাকে থামিয়ে দিল পৃথা। “আসছি” বলে তড়িঘড়ি করে হাঁটা ধরলো দরজার দিকে। তবে দরজা পর্যন্ত যেতেই কি মনে করে থমকে দাঁড়ালো। পিছু ফিরে আমতা আমতা করে বলল,
-“তাড়াতাড়ি খেয়ে নিবেন।”
কন্ঠে তোলা বাক্যের সমাপ্তি ঘটিয়ে আর এক সেকেন্ডের জন্যও দাঁড়ালো না পৃথা। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল। তুর্যের ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠলো। যাক তার বউ অন্তত তার খবর রেখেছে। মনে রেখেছে তার খাওয়ার কথা। এই মুহূর্তে এর থেকে বেশি আর কি চাই?
২৩.
দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা প্রায়। আকাশের সূর্যটা হেলে পড়েছে এক কোনে। রক্তিম বর্ণ ধারন করে সে প্রায় ডুবু ডুবু। তুর্য ড্রইং রুমে বসে বসেই ল্যাপটপে কি যেন করছিলো। এর মধ্যেই কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলো আরুশ। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-“স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
তুর্য আরুশের পানে তাকালো না। ল্যাপটপের পানে দৃষ্টি রেখেই বলল,
-“দুপুরে তুই আমার যে সর্বনাশ করেছিস এর থেকে বেশি সর্বনাশ হয়েছে?”
আরুশ বিচক্ষণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। কন্ঠে জোর দিয়ে বলল,
-“আলবাত হয়েছে। সর্বনাশে সর্বনাশে বিধ্বংসী সর্বনাশ হয়ে গেছে স্যার।”
তুর্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরুশের পানে। থমথমে কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
-“কি হয়েছে?”
-“আপনার শ্বশুর কোনো এক শিয়ালের সাথে আপনার মুরগির বাচ্চার মতো বউয়ের বিয়ে ঠিক করেছে।”
তুর্য চমকালো, থমকালো। কি বলল আরূশ এটা! পৃথার অন্য কারো সাথে বিয়ে? যে মেয়েকে অন্যকারো সাথে সে কল্পনা পর্যন্ত করতে পারে না তার বিয়ে? তুর্যের বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো। সে ভেবেছিল পলাশ শিকদার বা পৃথার পরিবার তাকে মানবে না, ঝামেলা করবে কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত যাবে এ কথা সে কল্পনাও করেনি। তাছাড়া পৃথার সাথে তার তালাক হয়নি। তালাকহীনা একটা মেয়ের বিয়ে ঠিক কিভাবে হলো?তুর্যের চোয়াল শক্ত হলো। চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারন করলো মুহুর্তেই। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়ালো সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“কোন রাজাকারের এত সাহস আমার বউকে বিয়ে দিবে? আমি তুর্য চৌধুরী আজ এই মুহূর্তে আমার শ্বশুরের বিরুদ্ধে বউ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষনা দিলাম।”
থামলো তুর্য। আবার বলল,
-“বউকে তো আমি পেয়েই ছাড়বো।
বউ মুক্তির সংগ্রামেও নামবো।
বেহায়া যখন হশেছি বেহায়া আরও হবো। তুবও বউকে ঐ রাজাকারের হাত থেকে উদ্ধার করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। তোদের যার কাছে যা আছে তা নিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড় আরুশ।”
তুর্যের কথা শুনে আরুশ তড়িঘড়ি করে নিজের প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকালো। দুই পকেট তন্ন তন্ন করে খুঁজে পকেটের পাতলা কাপড় বাইরে বের করে রাখলো। অসহায় কন্ঠে বলল,
-“আমার কাছে আপাতত কিছুই নেই স্যার।”
চলবে…..