গল্প: অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_২২
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
পৃথা পিছন ঘুরে তাকালো তুর্যের পানে। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
-“আপনি আমাকে ছেড়ে গিয়ে বুঝলেন আমাকে ভালোবাসে ফেলেছেন। আমার বাবা মা বুঝলো তারা ভুল করেছেন। আফসোস শুধুমাত্র আমিই বুঝলাম না আমার অগোচরে আমার কাছের মানুষগুলোর নিকট তাদের সম্পর্ক রক্ষায়, স্বার্থ রক্ষায় আমি ভীষন বাজেভাবে ঠকে গেছি।”
তুর্য এগিয়ে এসে দাঁড়ালো পৃথার সম্মুখে। কিছুটা অস্থির কন্ঠে বলল,
-“আমি ভুল করেছি এর জন্য তুমি আমাকে অবশ্যই দোষী সাব্যস্ত করতে পারো। কিন্তু তাই বলে ঠকবাজ উপাধি দিতে পারো না। আমি তোমাকে ঠকাইনি। তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো তোমার আর আমার বিয়ের সময়ে আমার বয়স ছিল ২০ বছর আর তোমার মাত্র ১০। একজন ২০ বছরের তরতাজা যুবকের সাথে যদি জোর জবরদস্তি করে, তেজ্য পুত্র করার হুমকি দিয়ে মাত্র ১০ বছর বয়সী এক শিশু কন্যার বিয়ে দেওয়া হয় তবে ঐ যুবকের এমন প্রতিক্রিয়া কিংবা রাগ করাটা কি অস্বাভাবিক কিছু? আমার স্থানে তুমি থাকলে কি করতে? প্রশ্নটা না হয় নিজেকেই করো।”
পৃথার দৃষ্টি শীতল হলো। বুঝলো সে ঐ বয়সে তুর্যের তাকে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তুর্যের স্থানে সে থাকলে হয়তো সেও মেনে নিতে পারতো না। কিন্তু পরের সাত বছর! ভালোবাসলে সেই সাত বছরে কেন ফিরে এলো না? কেন একটা বার খোঁজ নিল না? এত বছর পর এসেছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে। হতে পারতো এত বছরে পৃথা অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে অন্য কারো মায়ায় আবদ্ধ হয়েছে। যদিও ভাগ্যগুনে এসবের কিছুই হয়নি কিন্তু হতে তো পারতো। আচ্ছা এত বছর পর তুর্য কি সত্যিই ভালোবাসে তার কাছে ফিরে এসেছে নাকি এর পিছনেও কোনো স্বার্থ আছে? হতেই পারে স্বার্থ আছে। এই মুহূর্তে কাউকে আর বিশ্বাস হচ্ছে না পৃথার। মেয়েটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। ঠান্ডা কন্ঠেই বলল,
-“আমাদের সংসার হয়নি, একসাথে থাকা হয়নি, গভীর প্রণয়ে নিজেদের সিক্ত করা হয়নি। আর এত বছরে আমাদের মাঝের সেই বয়সের পার্থক্যটাও কিন্তু ঘুচে যায়নি। সেদিন যেহেতু আমাদের বয়সের পার্থক্যের কারনে আপনি আমাকে মেনে নিতে পারেননি, বিয়ের আসরেই ত্যাগ করেছিলেন সেহেতু আজও মেনে নিতে পারার কথা নয়। তার চেয়ে বরং তালাক দিয়ে দিন আমাকে। মুক্ত হয়ে যান এমন অনিশ্চিত তেতো একটি সম্পর্ক থেকে।”
তুর্য অস্থির হলো। ঠিক এই ভয়টাই সে পেয়েছিল এতদিন। যার দরুন একটু সময় নিয়ে আগে পৃথার মনে নিজের জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল তারপরে ধীরে ধীরে সবটা বুঝিয়ে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু রা’জা’কা’র শ্বশুরটা আর তা হতে দিল কই? মাঝ খান থেকে একটা শিয়াল জোগাড় করে তার কাছে বেঁচে দিতে চাইলো তার মুরগির বাচ্চার মতো ছোট খাটো বউটাকে। তুর্য আর একটু এগিয়ে গেল পৃথার পানে। মেয়েটার এক হাত টেনে পুরে নিল নিজের দুই হাতের ভাঁজে। ব্যাকুল কন্ঠে বলল,
-“এমন কথা বলো না পৃথা। আমি তোমাকে কখনও তালাক দেব না, ম’রে গেলেও না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভীষন ভালোবাসি।”
পৃথা তুর্যের হাতের ভাঁজ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
-“তা এই সাত বছর আপনার ভালোবাসা কোথায় ছিল? বিয়ের আসরে আমাকে ত্যাগ করার কথা না হয় বাদই দিলাম। ধরে নিলাম আপনি পরিস্থিতির স্বীকার। কিন্তু পরের সাত বছর! আমি না হয় বিয়ের সময়ে ছোট ছিলাম আপনার সাথে সংসার করার বয়স হয়নি তাই বলে কি একটু খোঁজ নিতে পারেন সেটুকু বয়সও আমার ছিল না?”
-“আমি মানছি আমি ভুল করেছি। আমি নিজের অনুভূতি বুঝতে দেরী করেছি আর তারপর….”
এইটুকু বলেই থামতে হলো তুর্যকে। পিয়াল তেড়ে এসে সম্মুখে দাঁড়ালো তার। ক্রোধিত কন্ঠে বলল,
-“আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না এটাকে এখনও এখানে কেন সহ্য করা হচ্ছে? এটাকে আমাদের বাড়ি থেকেই বের করে দেওয়া উচিৎ।”
তুর্যের দৃষ্টি কঠিন হলো। আগের কথা ভুলে শক্ত কন্ঠে সে বলল,
-“তোদের বাড়িতে আমি থাকতেও আসিনি। রা’জা’কা’র, আল’বদর, আল শা’মসদের সাথে ভালো মানুষেরা একসাথে এক ছাদের তলায় থাকে বলে শুনেছিস কখনও? আমি এসেছি আমার বউ নিতে। আমার বউকে আমাকে দিয়ে দে আমি চলে যাই।”
পিয়াসও তেড়ে এলো। দুই হাতে তুর্যের শার্টের কলার চেপে ধরে বলল,
-“কিসের বউ? সাত বছর আগে ছেড়ে যাওয়ার সময় বউয়ের কথা স্মরণে ছিল না তোর? তারপর এত বছরেও তো বউয়ের কথা স্মরণে আসেনি। এখন এসেছিস নাটক করতে? বের হ আমাদের বাড়ি থেকে।”
তুর্যের চোখ মুখ শক্ত হলো। শক্ত হাতে সে নিজের কলার থেকে হাত ছাড়িয়ে দিল পিয়াসের। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“আমার বউকে ছাড়া আমি কোথাও যাচ্ছি না। অনেক সময় ব্যয় করেছি আর নয়। প্রয়োজনে যুদ্ধ করবো, পুলিশ ডাকবো তারপর বউকে সাথে নেব। তবুও বউ ছাড়া এক পাও নড়বো না আমি।”
এতক্ষনে মুখ খুললেন পলাশ শিকদার। থমথমে কন্ঠে বললেন,
-“তোমাদের বিয়েটা আইনত বৈধ নয়। বিয়ের সময়ে তোমার বয়স ২০ হলেও পৃথা ছিল নাবালিকা এক শিশু কন্যা। আর বিয়ের তেমন ডকুমেন্টও নেই। পুলিশের নিকট গেলে তোমাকেই ঝামেলায় পড়তে হবে, হয়তো পৃথাকে ছেড়েও দিতে হতে পারে।”
তুর্য বাঁকা হাসলো। পলাশ শিকদারের পানে তাকিয়ে বলল,
-“তুর্য আর তুর্যের ভাইয়েরা কখনও কাঁচা করে না। আমি সেদিন ক্রোধের বশে বিয়েতে কোনো উৎসাহ না দেখালেও আমার ভাইয়েরা বিয়ের প্রতিটি মুহূর্তের ভিডিও রেকর্ড করে রেখেছিল। পুলিশের কাছে আমার বিয়ের প্রমান দিতে একটা মুহুর্তও সময় লাগবে না। আর বাকি রইলো ঝামেলায় পড়া তা আমি ঝামেলায় পড়লে আপনারাও পড়বেন। একটা নাবালিকা মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার অপরাধে এই বুড়ো বয়সে জেলের ঘানি টানতে হবে।”
পিয়াল তেতে উঠলো। গলা বাড়িয়ে বলল,
-“ভয় দেখাচ্ছিস? দেখা তবুও আমার বোনকে তোর সাথে যেতে দেব না।”
তুর্য বলতে চাইলো কিছু। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই পৃথা বেশ ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
-“কিন্তু আমি যাব।”
উপস্থিত সবাই অবাক হলো পৃথার কথায়। পিয়াস চকিত কন্ঠে বলল,
-“কি বলছিস এসব তুই? মাথা ঠিক আছে তো? এই ছেলেটার সাথে তুই যেতে রাজি হচ্ছিস? যে কিনা সাত বছর আগে বিয়ের আসরে তোকে ত্যাগ করেছিল।”
পিয়াসের কথার মধ্যেই পিয়াল বলল,
-“যে পুরুষ তোর কথা একটা বারের জন্যও ভাবেনি। বিয়ের আসরে তোকে ছেড়ে গিয়েছিল তার সাথে যাবি তুই?”
পৃথা বাবা মায়ের পানে তাকালো একবার। চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-“তা তো আমার পরিবারও আমার কথা ভাবেনি। ভাবলে কি আর নিজেদের সম্পর্ক গাঢ় করার উদ্দেশ্যে মাত্র ১০ বছরের এক নাবালিকা কন্যাকে বিয়ে দিতে পারতো।”
থামলো পৃথা। আবার বলল,
-“বাবা মা ১০ বছর বয়সে বিয়ে তো আমাকে সংসার করার উদ্দেশ্যেই দিয়েছিলেন। সে তো আমার কপাল ভালো ছিল বলে ঐ বয়সে সংসারের ঘানি টানতে হয়নি। এখন যখন সুযোগ পেয়েছি তখন না হয় বাবা মায়ের ইচ্ছাকেই প্রধান্য দেই, সংসার করি।”
সুফিয়া বেগম এবং পলাশ শিকদার বেশ ভালোভাবেই বুঝলেন মেয়ের তাদের উপর অভিমান জমেছে বেশ। আর সেই অভিমান থেকেই এসব কথা বলছে মেয়েটা। সুফিয়া বেগম এগিয়ে এলেন মেয়ের পানে। মেয়েকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে বললেন,
-“তুই আমাদের ভুল বুঝছিস মা। হ্যা আমরা তুর্যের পরিবারের সাথে সম্পর্ক গাঢ় করার জন্য তোকে তুর্যের সাথে বিয়ে দিয়েছিলাম ঠিক কিন্তু তখনই তোর সংসার করার কথা ছিল না। আমাদের দুই পক্ষের মধ্যে কথা হয়েছিল বিয়ে হলেও তখনই ও বাড়িতে যাবি না তুই। তোর ১৮ বছর পূর্ণ হলে ধুমধাম করে তুলে নিবেন তারা।”
পৃথা কন্ঠের জোর বাড়ালো। শক্ত কন্ঠে বলল,
-“তাহলে বিয়েটাও না হয় ১৮ বছর হলেই দিতে। অল্প বয়সে ঐ সময় বিয়েটা না দিলে তো আর আমার জীবনে এতসব ঘটনা ঘটতো না।”
-“আমরা ভয় পেয়েছিলাম বড় হয়ে তোরা যদি দুজন দুজনকে যদি না মানতে চাস। তাছাড়া তুর্যও বখে যাচ্ছিলো তাই তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা দিয়েছিলাম।”
পৃথা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মায়ের পানে। মলিন হেসে বলল,
-“তোমরা তোমাদের সম্পর্ক গাঢ় করতে এতটাই তৎপর হলে যে বখে যাওয়া একটা ছেলের সাথে নিজের ১০ বছরের শিশু কন্যার বিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করলে না। আমি জানতাম মেয়ের বাবা মা মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে বখে যাওয়া ছেলেদের এড়িয়ে চলে আর আমার বাবা মা উল্টো সম্পর্ক গাঢ় করার উদ্দেশ্যে বখে যাওয়া ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।আচ্ছা মা আমার থেকে তোমাদের সম্পর্ক গাঢ় করার নিশ্চয়তাটা বেশি হয়ে গিয়েছিল তখন?”
সুফিয়া বেগম চুপ হয়ে গেলেন। এ পর্যায়ে মেয়ের কথার কোনো উত্তর দিতে পারলেন না তিনি। কি উত্তরই বা দিবেন? সত্যিই তো ভুল করেছেন তারা, মেয়েটার সাথে অন্যায় করেছেন যার জন্য মেয়ের জীবনে আজ এত জটিলতা। পৃথা মায়ের চুপ হয়ে যাওয়া মুখ পানে তাকিয়ে মলিন হাসলো। চোখ দুটো ভিজে উঠেছে তার। ভেজা চোখেই সে এগিয়ে গেল তুর্যের পানে। নিজেকে শক্ত করে বলল,
-“আমাকে নিয়ে চলুন আপনার সাথে।”
তুর্য এতক্ষন চুপচাপ দেখছিলো সবটা। পৃথা যে এত তাড়াতাড়ি তার সাথে যেতে রাজি হবে কল্পনাও করতে পারেনি। সে ভেবেছিল পৃথা তাকে ভুল বুঝবে, তাড়িয়ে দিবে। তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বউকে নিজের কাছে নিতে হবে। অথচ এত তাড়াতাড়ি রাজী হয়ে গেল? তাই তো সবটা শুনে একটু থম মে’রে গিয়েছিল আর কি। তবে পৃথার কথায় এবার ঘোর কাটলো তুর্যের। আনন্দের সহীত নিজের হাত বাড়িয়ে ধরলো পৃথার এক হাত। সম্মুখ পানে যেতে যেতে বলল,
-“চলো।”
পিয়াস এবং পিয়াল উদ্যত হলো তুর্যকে আটকাতে। তারা জানে তাদের অভিমানী বোন পরিবারের উপরে অভিমান করে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই বলে তারা তো বোনকে এভাবে চলে দিতে পারে না। পিয়াস এবং পিয়াল তুর্য, পৃথাকে আটকতে যেতে নিলেই তাদের থামিয়ে দিলেন পলাশ শিকদার। থমথমে কন্ঠে বললেন,
-“ওদের যেতে দাও।”
পিয়াস এবং পিয়াল অবাক হলো। পিয়াস অবাক কন্ঠেই বলল,
-“তুর্য তো পৃথাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে বাবা আর তুমি ওদের আটকাতে বারন করছো?”
পলাশ শিকদার কোনো উত্তর দিলেন না ছেলের প্রশ্নের। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন তার আনা পাত্র পক্ষের পানে। যারা এতক্ষন খুব নিগুঢ়ভাবে দর্শকের ন্যায় দেখছিলো সবটা। পলাশ শিকদার ঠান্তা কন্ঠেই তাদের বললেন,
-“আপনাদের কাজ শেষ নজরুল ভাই। আপনাদের ধন্যবাদ এখানে আসার জন্য।”
পাত্রপক্ষ নামধারী আসা জনমানবের মধ্যে একজন বলল,
-“আরে ঠিক আছে। আচ্ছা আমরা এখন আসছি। আপনারা পারিবারিক ভাবে মিটিয়ে নিন সবটা।”
কথাটা বলেই চলে গেলেন তারা। পিয়াস, পিয়াল এবং সুফিয়া বেগম অবাক হলেন। সুফিয়া বেগম অবাক কন্ঠেই শুধালেন,
-“এসবের মানে কি?”
পলাশ শিকদার একবার তাকালেন স্বামী সন্তানদের পানে। অতঃপর থমথমে কন্ঠে বললেন,
-“আমি এতটাও নির্বোধ নই যে আমি আমার তালাকহীনা মেয়ের বিয়ে দেব অন্যত্র….
চলবে…..
গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_২৩
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
পলাশ শিকদার একবার তাকালেন স্বামী সন্তানদের পানে। অতঃপর থমথমে কন্ঠে বললেন,
-“আমি এতটাও নির্বোধ নই যে আমি আমার তালাকহীনা মেয়ের বিয়ে দেব অন্যত্র। আমি শুধুমাত্র দেখতে চেয়েছিলাম তুর্য আমার মেয়ের জন্য কি কি করতে পারে। আমি জানতাম তুর্য এখানে আসবে। পৃথার বিয়ের খবরটা ওর নিকট সুকৌশলে আমি নিজেই পাঠিয়ে ছিলাম নয়তো ওর সাধ্য ছিল না কিছুই জানার যেখানে তোমরাই সবটা জেনেছিলে দুপুরে।”
-“কিন্তু বাবা…”
এইটুকু বলতেই পিয়ালকে থামিয়ে দিলেন পলাশ শিকদার। আবার বললেন,
-“হ্যা আমি আগে বলেছিলাম পৃথার সাথে তুর্যের তালাকটা গোপনে করিয়ে দেব, পৃথাকে না জানিয়ে। কারন আমি এই সম্পূর্ণ বিয়ের বিষয়টাই পৃথার থেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি চাইলেই কি ওদের গোপনে তালাক হয়ে যেতো? স্ত্রীর অনুপস্থিতে তালাক দেওয়া বা স্ত্রীকে জানানো না হলে তালাক হয় না। তালাক দেওয়ার জন্য স্বামীকে অবশ্যই স্ত্রীর উপস্থিতে স্পষ্টভাবে তিনবার তালাক বলতে হবে। বিষয়টা নিয়ে এমনিই সর্বদা চিন্তিত ছিলাম আমি। তার উপর তুর্য ফিরে এলো। সেদিন তুর্যকে তালাকের কথা বললেও তুর্য শক্ত কন্ঠে নাকোচ করে দিল। ওর কন্ঠে আমি দৃঢ়তা অনুভব করেছিলাম। তোমরা বসে থাকলেও আমি বসে থাকিনি। ওর বিষয়ে সম্পূর্ণ খোঁজ খবর নিয়ে আমার মনে হয়েছিল ওকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিৎ। সাত বছর আগে ও আমার মেয়েকে ত্যাগ করে ভুল করেছে ঠিক আমরাও তো কম ভুল করিনি। তাছাড়া বিচ্ছেদ কোনো সমাধান হতে পারে না। ভুল তো আমাদেরও ছিল। অন্তত নিজেদের ভুলটা শুধরে নিয়ে ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ সুন্দর করার জন্য হলেও তুর্যকে একবার সুযোগ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। সেই সুযোগটাই আমি তাকে দিয়েছি।”
থামলেন পলাশ শিকদার। শক্ত কন্ঠে বললেন,
-“তবে ভেবো না ঐ তুর্য চৌধুরীকে আমি এত সহজে ছেড়ে দেব। সাত বছর আমার মেয়েকে অনিশ্চিতার মধ্যে রেখেছে, বিয়ের আসরে আমার মেয়েকে ত্যাগ করেছে। সাত বছর পরে এত সহজে অবশ্যই ওর পরীক্ষা শেষ হবে না। আমি আমার মেয়েকে আবার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো ওর থেকে, ও যদি ভালোবেসে থাকে তবে ভালোবাসার নারীকে ধরে রাখার দায়িত্ব ওর।”
কথাটা বলে কাউকে আর কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রস্থান করলেন পলাশ শিকদার। পিছনে ফেলে রেখে গেলেন তিন জোড়া বিস্ময় পরিপূর্ণ চোখ।
২৫.
তুর্য পৃথাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পৃথাকে নিয়ে সোজা চলে এসেছে কাছে পিঠে এক উকিলের অফিসের সম্মুখে। আইনিভাবে এবার তার বিয়েটা করে নেওয়া প্রয়োজন নয়তো বলা যায় না কখন আবার তার রা’জা’কা’র শ্বশুরটা মুরগির বাচ্চার মতো বউয়ের উপরে খাবলা বসায়। পৃথা, আরুশ এবং গার্ডসদের নিয়ে অফিস বিল্ডিং এ ঢুকলো তুর্য। পৃথা ক্ষানিকটা অবাক হলো। বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় এ অফিস চিনতো সে আগে থেকেই। মেয়েটা কপাল কুঁচকে তুর্যকে শুধালো,
-“আমরা এখানে কেন এসেছি?”
তুর্য সম্মুখ পানে পা দিতে দিতে জবাব দিল,
-“বিয়ে করতে।”
পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিহান কন্ঠে বলল,
-“আমাদের বিয়ে না হয়ে গেছে?”
-“আইনিভাবে হয়নি এখনও।”
-“কিন্তু আইনিভাবে বিয়ের করার বয়স তো আমার হয়নি এখনও।”
তুর্য ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো পৃথার পানে। বাঁকা হেসে বলল,
-“তুমি শুধু বিয়ের জন্য প্রস্তুত হও বউ তারপর তোমার বয়স বাড়ানোর দায়িত্ব আমার।”
পৃথা ওষ্ঠ ফাঁক করলো কিছু বলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে তুর্য বলল,
-“দেখো আমি এই মুহূর্তে কোনো জটিলতা চাইছি না। তোমার আর আমার বিয়ে সাত বছর আগেই হয়ে গেছে। এখন তুমি মানলেও আমার বউ না মানলেও আমার বউ। আইনি বিয়ে না হলেও রেকর্ডের ভিত্তিতে আমাদের বিয়েকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবুও আমি চাইছি এবার আমাদের আইনি বিয়েটাও হয়ে যাক। ধর্ম এবং সমাজ দুটো মেনেই আমি তোমাকে নিজের করে চাইছি। সুতরাং কন্ঠে কোনো না না ধ্বনি তুলে ঝামেলা বারিও না।”
পৃথাও আর কিছু বলল না। সত্যি বলতে বিয়ে তো সেই কবেই হয়ে গেছে। এখন সারাদিন না না করলেও কাজ হবে না কোনো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো পৃথা। তুর্যকে অনুসরণ করে ঢুকলো এক কক্ষের ভিতরে। সেখানে চেয়ারে আগে থেকেই বসা ছিলেন কোর্ট প্যান্ট পড়া একজন ভদ্রলোক। সম্ভবত উকিল হবেন ইনি। তুর্যকে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। হাসিমুখে বললেন,
-“এসেছেন আপনারা! আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম আমি।”
তুর্যও হাসলো। ভদ্রলোকের সাথে কুশলাদি বিনিময়ে করে পৃথাকে নিয়ে বসলো ঐ দুটি কাঠের তৈরি চেয়ার দখল করে। নিজের হাতটা তুলে হাতঘড়ির পানে তাকালো একবার। উকিলকে তাড়া দিয়ে বলল,
-“কি কি করতে হবে তাড়াতাড়ি করুন। আমাদের আবার ঢাকায় ফিরতে হবে।”
উকিল সাহেবও বসলেন। আগে থেকেই প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র গুছিয়ে রেখেছিলেন। তুর্য তাড়া দিতেই তিনি প্রয়োজনীয় কাগজ এবং কলম এগিয়ে দিলেন তুর্য ও পৃথার পানে। আঙ্গুল তুলে কাগজের দিকে ইশারা করে বললেন,
-“এখানে সই করে দিন।”
কাগজটা হাতে পেয়েই দ্রুততার সাথে সই করলো তুর্য অতঃপর পৃথার পানে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“তাড়াতাড়ি সই করে দেও।”
পৃথা তাকালো কাগজটার দিকে। হৃদয় ভারী হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। একবার না জানিয়ে অগোচরে অল্প বয়সে পরিবারের লোকেরা তাকে বিয়ে দিলেও আজকের বিয়েতে সেই পরিবারই নেই। যতই পরিবারের উপর অভিমান করুক মেয়েটা তবুও তার পরিবার তো। ঐ বাবা মা ই তাকে জন্ম দিয়েছেন। এত বছর আদর যত্ম দিয়ে বড় করেছেন। জীবনের এই মুহুর্তে এসে পৃথার ভীষন মনে পড়ছে বাবা মাকে। হয়তো তুর্যের সাথে তার বিয়েটা আগেই হয়েছে। কিন্তু তখন কোনো অনুভূতির উপস্থিতি ছিল না। বিয়ের মানেই তো তখন পৃথা বুঝে উঠতে পারেনি ভালোভাবে। তার জন্য আজ অনুভুতিটা প্রথম আর সেই অনুভূতিতে বাবা মা ভাই কেউ পাশে নেই।
বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলো। পৃথা এখনও কলমই তুললো না সই করবে কি? তুর্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো মেয়েটার পানে। দেখলো মেয়েটা টলমল চোখ নিয়ে কিছু ভাবছে আবার মাঝে মাঝে নিচু হয়ে পা চুলকাচ্ছে। তুর্য সজাগ দৃষ্টিতে তাকালো আশেপাশে। কান খাঁড়া করে শুনলো কিছু মশার গান। ইসস তার ছোট বউটাকে নিশ্চই মশায় কামড়ে রক্ত চু’সে নিচ্ছে। তুর্য আশেপাশে তাকালো। উকিলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“আপনার এখানে কি মাশারি আছে?”
উপস্থিত সবাই ভরকালো তুর্যের কথায়। উকিলও চকিত দৃষ্টিতে তাকালো ছেলেটার পানে। এই প্রথম কিনা কেউ বিয়ে করতে এসে মশারি খুঁজছে। বিয়ে করতে এসে মশারি দিয়েই বা কাজ কি! উকিল কৌতুহল অনুভব করলেন। আগ্রহ নিয়ে বললেন,
-“না তো। মশারী দিয়ে কি করবেন?”
তুর্য হাত উঠিয়ে দুই হাত দ্বারা ঠাস করে শব্দ করে মশা মা’রা’র চেষ্টা করলো। নাক মুখ কুঁচকে বলল,
-“আমার বউকে মশায় কামড়াচ্ছে।”
উকিল সহ সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। পৃথাও নিজের চিন্তা ভুলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তুর্যের পানে। বিয়ে করতে এসে কিনা এই লোক মশারী খুঁজছে তাও কিসের জন্য তার বউকে দুই একটা মশায় কামড়াচ্ছে বলে। তুর্যের এ ধরনের কথা বার্তার সাথে আর কেউ পরিচিত না থাকলেও আরুশ ঠিক পরিচিত। ছেলেটা এগিয়ে এলো তুর্যের পানে। মাথা চুলকে বলল,
-“অফিস কক্ষে মশারি কোথা থেকে আসবে স্যার? কয়েল থাকলেও থাকতে পারে।”
আরুশের কথা শুনে চকচক করে উঠলো তুর্যের চোখ দু খানা। গদগদ হয়ে বলল,
-“সাব্বাস ব্যাটা কে বলেছে তুই আকার রশিকার ছাড়া বলদ। এই তো তোর মাথায় বুদ্ধি আছে। ঐ রাজাকার জনগোষ্ঠীর সাথে বাক বিতণ্ডায় জড়িয়ে আমি তো কয়েলের কথা ভুলেই বসেছিলাম।”
কথাটা শেষ করেই তুর্য ফিরে তাকালো উকিলের পানে। ভীষন আশা নিয়ে শুধালো,
-“আপনার অফিসে কয়েল আছে?”
উকিল তুর্যকে হতাশ করে জবাব দিলেন,
-“না, আমার অফিসে কয়েলও নেই।”
তুর্যের মেজাজ খারাপ হলো কিছুটা। কি একটা অফিস যেখানে কিছু রাখে না। তার বউকে মাশায় কামড়াচ্ছে অথচ একটা কয়েল পর্যন্ত নেই? এক মিনিট, এক মিনিট মশায় কামড়াচ্ছে নাকি চু’মু খাচ্ছে? তুর্যের হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো। মস্তিষ্ক বলে উঠলো,
-“এত বছর বিয়ে করে বউকে এখনও চু’মু খেতে পারলি না। অথচ দেখ মশাগুলো এসে কি সুন্দর তোর বউকে চু’মু খেয়ে যাচ্ছে। ছিঃ তুর্য ছিঃ।”
তুর্য হাঁসফাঁস করে উঠলো। বিরবিরিয়ে বলল,
-“এই রাজশাহীর মশাগুলোই বেয়াদব, অ’স’ভ্য মার্কা। কত বড় সাহস এদের আমার বউকে চু’মু খায়। আমার অধিকারে ভাগ বসায়।”
কথাগুলো বলেই তুর্য পাশ ফিরে তাকালো পৃথার পানে। মেয়েটা এখনও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে তার পানেই। তুর্য ধমকে উঠলো পৃথাকে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-“তাড়াতাড়ি কাগজে সইটা করে আমাকে উদ্ধার করো। আমার এই মামলাগুলোকে সহ্য হচ্ছে না।”
আকস্মিক ধমকে পৃথা কেঁপে উঠলো। তুর্যের বলা শেষ কথাটা বোধগম্য না হলেও মুখ খুলে কিছু জিজ্ঞেস করলো না আর। সামনে রাখা কলমটা হাতে নিয়ে কাগজে খসখসে ধ্বনি তুলে সই করে দিল দ্রুত। ব্যস তুর্য এবং পৃথার আইনি বিয়েও শেষ এবার। তুর্যের চিন্তা অনেকটাই কমলো এবার। নিশ্চিন্ত মনে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে। উকিলের সাথে শেষ একবার হাত মিলিয়ে এবং তার পাওনা পরিশোধ করে বেরিয়ে এলো অফিসের বাইরে।
২৬.
রাত বেড়েছে কিছুটা। চারদিকটা নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। অন্ধকারেরা গ্রাস করে নিয়েছে পরিবেশ। এই নিস্তব্ধ অন্ধকারের বুক চিড়েই হাইওয়ে ধরে সাঁই সাঁই করে গন্তব্যের পানে ছুটে চলছে তুর্যদের গাড়িটা। সামনের ড্রাইভিং সিটে বসে আরুশ গাড়ি চালাচ্ছে আর পিছনের সিটে রয়েছে তুর্য আর পৃথা। তখন উকিলের অফিস থেকে বেরিয়েই গাড়িতে চেপে বসেছিল তারা তিনজন আর গার্ডসরা চেপেছে তাদের নির্ধারিত অন্য গাড়িতে। তুর্য আর পৃথা পাশাপাশি বসলেও দুজনের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে বেশ। অবশ্য এই দূরত্বটা রেখেছে পৃথা নিজেই। তুর্যও আর আগ বাড়িয়ে বলেনি কিছু। এমনিই মেয়েটার উপর থেকে কম ধকল আজ যায়নি। তাই নিশ্চুপভাবেই সবটা মেনে নিয়েছে সে। মেয়েটাকে একটু একা থাকতে দিয়ে নিজে মনোনিবেশ করলো মোবাইলে।
ক্ষানিক সময় গড়ালো। তুর্য মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়েই তাকালো পৃথার পানে। মেয়েটা গাড়ির সিটের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সি স্নিগ্ধ লাগছে প্রিয়তমার ঘুমন্ত মুখশ্রী। তুর্যের দৃষ্টি মুগ্ধ হলো, হৃদস্পন্দন বাড়লো তরতর করে। হৃদয়ে নিষিদ্ধ অনুভূতিরা চনমনে হয়ে উঠলো। ইসসস এসব কি ভাবছে সে? একটা মেয়ের ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিবে? পরক্ষনেই তুর্যের হৃদয় হানা দিল মেয়েটা তার স্ত্রী। আর স্ত্রীকে ভালোবাসা নিশ্চই সুযোগ নেওয়া নয়। তুর্য ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকালো আরুশের পানে। ছেলেটাকে সজাগ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে একটু চেপে বসলো পৃথার পানে।
চলবে…..