অবাধ্য পিছুটান পর্ব-৩০+৩১

0
165

গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_৩০

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

অতঃপর কোলবালিশটার পানে তাকিয়ে মনে মনে বলল,

-“ব্যাটা বদমাইশ। আমার আর আমার বউয়ের মাঝখানে এসেছিলি? দেখ এখন আমরা আমে দুধে মিলে গেছি আর তুই আটি হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছিস।”

তুর্য আর একটু এগিয়ে গেল পৃথার পানে। মেয়েটার গা ঘেঁষে বসলো। চুল ছাড়ানোর বাহনা দিয়ে নিজের হাত দ্বারা একটু স্পর্শ করলো বউয়ের এক হস্ত। পৃথা শিউরে উঠলো। তৎক্ষণাৎ তুর্যের থেকে একটু দূরে সরে গেল। মুখ খুলে কিছু বলার আগেই তুর্য থামিয়ে দিল তাকে। তড়িঘড়ি করে বলল,

-“স্যরি, স্যরি একটু তাড়াহুড়ো করে তোমার চুল ছাড়াতে গিয়ে হাতে হাত লেগে গেছে।”

পৃথাও আর বিষয়টা নিয়ে ভাবলো না ততটা। তার স্বামী যে সত্যি সত্যিই মাথার ভিতরে সব ব্রিটিশ বুদ্ধি নিয়ে ঘোরাফেরা করছে বুঝলো না ছোট মেয়েটা। তুর্য আর একটু এগুলো পৃথার পানে। মেয়েটা প্রথম স্পর্শে যতটুকু সরে গিয়েছিল ততটুকু দূরত্ব কমালো।

পৃথার ওপাশে আর জায়গা নেই। এরপর আর সরতে গেলেই মেয়েটা খাট থেকে পড়ে যাবে মেয়েটা। তুর্য উঁকি দিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো বিষয়টা অতঃপর পরিকল্পনা করলো এবার হুট করেই বউয়ের নরম গালে হাত রাখবে। তারপর বউ শিউরে উঠে দূরে সরে যেতে নিলেই খাট থেকে পড়ে যাবে। তৎক্ষণাৎ তুর্যও নিজের হাত বাড়িয়ে কোমড় চেপে ধরবে পৃথার। একটু অনুভূতি নিয়ে রোমান্টিক কায়দায় নিজের দিকে টেনে নিবে বউয়ের ছোট খাটো দেহ খানা । বুকের সাথে মিশিয়ে ঐ নাটক সিনেমার মতো একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকবে বেশ সময় নিয়ে। আহা কি রোমান্টিক দৃশ্য। নিজের করা পরিকল্পনাকে নিজেই বাহবা জানালো তুর্য। এত সুন্দর বুদ্ধি যে তার মাথায় আছে বউ না আসলে তো জানতেই পারতো না। তুর্যের এখন খুব করে মনে হচ্ছে সে এখানে কি করছে? তার তো বাংলাদেশের একজন বুদ্ধিজীবী হওয়ার কথা ছিল। তার নিজেরই ভুল। এতদিন বিদেশে গিয়ে না থেকে বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ঢুকে পড়লেই আজ নাম জশ খ্যাতি এমনকি বউটাও তার থাকতো। ইসসস কি ভুলটাই সে করে ফেলেছে। মনে মনে কতক্ষন তুর্য নিজের করা ভুলের জন্য আফসোস করলো অতঃপর পরিকল্পনা অনুযায়ী সুকৌশলে নিজের এক হাত চুলের উপরে রেখেই বাড়িয়ে দিল পৃথার পানে। কিঞ্চিৎ সময়ের মধ্যেই পৃথার গালও ছুঁয়ে দিল তার শক্তপোক্ত পুরুষালী হাত দ্বারা। সত্যিই হঠাৎ তুর্যের এমন স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো পৃথা। পিছনের অবস্থা যাচাই বাছাই না করেই দ্রুততার সাথে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইলো পিছনের দিকে। তুর্যের পরিকল্পনা মাফিক মেয়েটা পড়ে যেতেও নিল খাট থেকে। তুর্য ভীষন আবেগ নিয়ে নিজের এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে ধরতে চাইলো বউয়ের নরম কোমড় খানা। কিন্তু ধরতে আর পারলো না। ঠিক তখনই তাদের বন্ধ দরজায় টোকা পড়লো। না চাইতেও তুর্যের কান সেদিকে চলে গেল। আর এই টুকোতেই ঘটে গেল মহা বিপত্তি। পৃথা ধপাস করে পড়লো ইট কংক্রিটে গড়া পাকা মেঝেতে। চিৎ হয়ে পড়তেই মাথায় আঘাত পেল মেয়েটা, সাথে সাথে তুর্যের টিশার্টে পেঁচিয়ে থাকা চুলগুলোও ছিঁড়ে গেল চড়চড় ধ্বনি তুলে। পৃথা তীব্র বেগে চেঁচিয়ে উঠলো,

-“ও মাগো।”

তুর্য আহাম্মক বনে গেল আকস্মিক ঘটে যাওয়া ঘটনায়। বোকা বোকা চোখে তাকালো পৃথার পানে। মেয়েটা এখনও চিৎ হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। মাথা চেপে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। তুর্য অস্থির হলো। নিজের ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে নেমে পড়লো বিছানা থেকে। তড়িঘড়ি করে পৃথাকে ধরে উঠে বসালো। ব্যাকুল কন্ঠে বলল,

-“ব্যথা পেয়েছো? কোথায় ব্যথা পেয়েছো? নিশ্চই মাথায়।”

পৃথা কোনো জবাব দিল না। লজ্জায় ম’রি ম’রি অবস্থা তার। ইসস কিভাবে বিছানা থেকে চিৎ হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। ছেলেটা নিশ্চই মনে মনে হেসেছে পৃথার উপর। ভেবেছে মেয়েটা বোকা, ন্যাকা। নয়তো পিছনে জায়গা না দেখেও সরতে কেন গেল। তুর্য পৃথার জবাবের অপেক্ষা করলো না। নিজ উদ্যেগেই দেখতে শুরু করলো মেয়েটার মাথা খানা। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে বউয়ের চুলের ভাঁজগুলো দেখতে দেখতে ফুঁসে উঠলো তুর্য। কোন বজ্জাত এসে দরজায় টোকা দিল। না দিল তার পরিকল্পনা স্বার্থক হতে আর বউটাকেও ব্যথা দিল। তুর্য ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করতে করতে এগিয়ে গেল দরজার পানে। শক্ত হাতে দরজাটা খুলেই দেখা মিললো আরুশের। বেচারা দরজার বাইরে কোমড় চেপে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরুশকে দেখে তুর্যের ক্রোধ বাড়লো আরও। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“তোকে আমি এমনি এমনি মীর জাফরের বংশধর বলি বেয়াদব? কেবল একটু বউয়ের কাছাকাছি গিয়েছিলাম। যেতে দিলি না আমাকে, টেনে হিচরে বউয়ের থেকে দূরে সরালি সাথে সাথে বউটাকেও একটা আছাড় মারলি।”

আরুশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল তুর্যের কথায়। সে আবার কি করলো? প্রথমত এই বিকালের সময়ে যে তুর্য নামক প্রাণী তার বউয়ের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে এটা পৃথিবীর কে বুঝবে? দ্বিতীয়ত সে কখন পৃথাকে আছাড় মা’র’লো? সে তো দরজার সম্মুখে দাঁড়ানো। ভিতরে গেলে না তুর্যের বউকে আছাড় মা’র’বে। আরুশ তাকালো তুর্যের পানে। বোকা বোকা কন্ঠে বলল,

-“আমি কখন ম্যামকে আছাড় মারলাম স্যার?”

তুর্য বিরক্তি নিয়ে তাকালো আরুশের পানে। তীক্ষ্ম কন্ঠে বলল,

-“তুই শুধু আমার বউকে আছাড় মা’রি’স’নি আহাম্মক। সাথে আমার আবেগটাকেও আছাড় মে’রে আহত করে দিয়েছিস। আর একটু হলেই বউটাকে বুকে নিতাম। নিতে দিলি না। ”

থামলো তুর্য আবার বলল,

-“তোর কলিজা আমি ভাজা ভাজা করবো বেয়াদব। তোর সাথে আমি এক জ’ঙ্গী নারীর বিয়ের দেব। তারপর তোর বউসহ তোর পেটে বো’ম বেঁধে ছা’দে ঝুলিয়ে রাখবো।”

বরাবরের মতোই তুর্যের কথার কোনো তাল ঠিক পেল না আরুশ। শুধুমাত্র মস্তিষ্কে হানা দিল দুটো কথা। প্রথমত জ’ঙ্গী নারীর সাথে বিয়ে, আর দ্বিতীয়ত বউসহ পেটে বো’ম বেঁধে ছাদে ঝুলিয়ে রাখার বিষয়টা। এই তুর্য নামক ভয়ানক প্রাণীর দ্বারা সব সম্ভব। পেটে বো’ম বেঁধে রাখা কেন বো’ম পেট কে’টে’ও ঢুকিয়ে দিতে পারবে এ। আরুশের মুখশ্রী চুপসে গেল। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,

-“স্যার আমি আর কখনও আপনার কলিজা আছাড় মারবো না। তবুও আমাকে ঐ জ’ঙ্গী ফ’ঙ্গি’র সাথে বিয়ে দিবেন না। ওরা খুব ভ’য়া’ন’ক হয়।”

তুর্য এবার একটু দমলো। তবে ভারী কন্ঠে বলল,

-“তা আমি পরে দেখে নেব তবে আমার বউয়ের থেকে আলাদা করার জন্য তোকে যে আমি ছাড়া দেব না সে বিষয়ে নিশ্চিত থাক। যাই হোক এই অসময়ে এসে আমার কলিজাসহ বউটাকে আছড়া আছড়ি কেন করলি বল।”

আরুশ একটু হলেও স্বস্থির নিঃস্বাশ ফেললো। যাক তুর্য একটু তো স্বাভাবিক পর্যায়ে এসেছে নয়তো ভেবেছিল আজ এই মুহূর্তেই না এই লোক ওকে মাটির মধ্যে গেড়ে টেড়ে দেয়। আরুশ একটু কেশে গলা পরিষ্কার করলো। কন্ঠ কিছুটা স্বাভাবিক করে বলল,

-“স্যার শাহীন মির্জার লোকেরা ঝামেলা করছে আবার। আমরা রাজশাহী থেকে ঢাকায় ফিরেছি শুনেই আবার ঢাকায় চলে এসেছে।”

তুর্য মুখ বাঁকালো। কটমট করে বলল,

-“তা তো আসবেই। ও ব্যাটা শাহীন মির্জা তো আগেই নিজের বউকে মে’রে’ছে। এখন নিজের বউয়ের কাছে যেতে পারছে না, বউয়ের থেকে আদর সোহাগ কিছু পাচ্ছে না তাই আমাকেও পেতে দিতে চাইছে না।”

থামলো তুর্য। হতাশ কন্ঠে বলল,

-“সবই হিংসে আরুশ, সবই হিংসে।”

আরুশ মনে মনে বিরক্ত হলো ভীষন। এমন এক জটিল বিষয় নিয়ে তুর্যের এত হেঁয়ালি আসছে কোথা থেকে? লোকটা কি জানে না সে আগুন নিয়ে খেলছে? একটু পান থেকে চুন খসলেই বিপদ। নিজের মনের বিরক্তি মনে চেপেই আরুশ বলল,

-“কিন্তু আমরা এখন কি করবো স্যার?”

তুর্য তেমন ভাবলো না বিষয়টা নিয়ে। গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,

-“সবগুলোকে তুলে আমার আস্তানায় বেঁধে রাখ। আমি রাতে বউকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে চলে আসবো।”

আরুশ মনে মনে মনে ভেংচি কাটলো তুর্যের কথায়। বিরবিরিয়ে বলল,

-“বউ দেয় না পাত্তা তাকে আবার ঘুম পাড়িয়ে আসবে।”

তুর্য ঠিক শুনলো না আরুশের নিচু কন্ঠে বলা কথাগুলো। তাই আবার সে জিজ্ঞেস করলো,

-“কি বললি তুই?”

আরুশ থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,

-“ককই কিছু না তো। এখন আসছি আমি।”

কথাটা বলেই তড়িৎ বেগে প্রস্থান করলো আরুশ। সে কি বলেছে একবার যদি এই লোক শোনে তাহলে কিসের জ’ঙ্গী বউ আর বো’মা হা’ম’লা এর থেকেও ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে। তার থেকে জান নিয়ে পালানো শ্রেয়।

৩২.
রাত গভীর। চারদিকটা নীরব নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে। বাহিরে শুধু শোনা যাচ্ছে নিশাচর প্রাণীদের হাঁক ডাক। তুর্য কেবলই বাড়ি ফিরেছে নিজের কাজ শেষে। বউকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে কাজে যাওয়ার কথা থাকলেও যেতে হয়েছিল তাকে তাড়াতাড়ি। ওদিকে একটু বেশিই গোলমাল বেঁধে গিয়েছিল। আরুশরা শাহীন মির্জার লোকদের তুলতে গিয়ে মা’রা’মা’রি’তে আবদ্ধ হয়েছিল। সেই মা’রা’মা’রি থামাতেই আবার তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল তাকে।

তুর্য নিজের কাছে থাকা অতিরিক্ত চাবি দিয়ে ঢুকলো বাড়িতে। চারদিকে তাকিয়ে দেখলো পুরো বাড়ি নীরবতায় ছেয়ে রয়েছে। বাড়ির কোনো ঘরেও আলো জ্বলছে না তেমন। শুধুমাত্র বসার কক্ষে টিমটিমে ড্রীম লাইটের অস্তিত্ব রয়েছে। হয়তো ইতমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। তাহলে পৃথাও কি ঘুমিয়ে পড়েছে? ভাবতে ভাবতেই নিজেদের কক্ষের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো তুর্য। বিছানার পানে তাকিয়ে দেখলো পৃথা গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে রয়েছে। তুর্য ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাসলো। এগিয়ে গিয়ে বসলো পৃথার পাশে। হাত তুলে আলতোভাবে ছুঁয়ে দিল পৃথার গাল। অতঃপর একটু ঝুঁকে বউয়ের ললাটে চুম্বন করে আবারও উঠে দাঁড়ালো। পাশ ফিরে ওয়াশ রুমের দিকে যেতে গিয়েই চোখ পড়লো বিছানার পাশের টেবিলে রাখা ঢাকা দেওয়া খাবারের উপরে। তুর্য এগিয়ে গেল সেদিকে, খাবারের উপর থেকে ঢাকনাটা তুললো দেখলো দুটো প্লেটে খাবার রাখা পরিপাটিভাবে। এর মানে পৃথা খায়নি রাতে। তুর্য তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না। এক সাথে ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বসলো বিছানায়। আদুরে কন্ঠে পৃথাকে ডাকলো,

-“বউ, ও বউ!”

পৃথার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। মেয়েটা গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে তার। এ পর্যায়ে তুর্য একটু গলার স্বর বাড়ালো। জোরে বেঁকে বলল,

-“ওঠো তাড়াতাড়ি, খেয়ে নিবে।”

পৃথা নড়েচড়ে উঠলো একটু। ঘুমের মধ্যেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,

-“খাবো না আমি। আপনি খেয়ে নিন।”

তুর্যের হৃদয় কম্পিত হলো মেয়েটার কন্ঠস্বরে। এ ঘুম জড়ানো কন্ঠ নাকি নেশার বান। হৃদস্পন্দন বাড়লো তুর্যের তবুও নিজেকে সামলে নিল সে। আলতোভাবে পৃথার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

-“না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে তোমার। ওঠো তাড়াতাড়ি।”

চলবে…..

গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_৩১

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

[ প্রাপ্তবয়স্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

আলতোভাবে পৃথার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

-“না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে তোমার। ওঠো তাড়াতাড়ি।”

পৃথা উঠলো না। একটু নড়েচড়ে উঠে পাশ ফিরে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো তুর্য। টেবিল থেকে প্লেট হাতে নিয়া ভাত মাখাতে মাখতে ডাকলো পৃথাকে। কিঞ্চিৎ শক্ত কন্ঠে বলল,

-“তুমি উঠবে নাকি আমি জোর করে উঠিয়ে বসিয়ে দেব?”

পৃথা বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকালো আবার। ঘুমের ঘোরেই উঠে বসালো বিছানায়। চোখ বন্ধ রেখে বলল,

-“সমস্যা কি এত ডাকছেন কেন? বলছি তো আমি খাবো না। আপনি খান, খেয়ে ঘুমান।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই আবার মেয়েটা শুয়ে পড়তে নিল বিছানায়। তুর্য এক হাত বাড়িয়ে আঁটকে দিল পৃথাকে। শাসনের সুরে বলল,

-“না খেয়ে একদম শুবে না তুমি।”

পৃথাও আর বলল না কিছু। এতক্ষনে এটুকু সে বেশ ভালোভাবেই বুঝেছে যে সে না খেলে তুর্য ঘুমাতে দিবে না। তার থেকে বরং খেয়ে ঘুমানোই ভালো। ঝামেলা থাকবে না কোনো। তুর্য ততক্ষণে ভাত মেখে হাতে লোকমা নিয়ে ধরলো পৃথার মুখের সম্মুখে। মেয়েটাও কোনো দ্বিরুক্তি না করে খেয়ে নিল কয়েক লোকমা। অতঃপর ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল,

-“ব্যস আর খাবো না। এখন আমাকে ঘুমাতে দিন।”

তুর্যও খাওয়া নিয়ে আর জোরাজুরি করলো না। অল্প খেলেও খেয়েছে তো। টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি তুলে সে আবার ডাকলো পৃথাকে। বলল,

-“পানি খেয়ে ঘুমাও বউ।”

পৃথা অর্ধশোয়া হয়ে বসলো। স্বামীর হাত থেকেই একটু পানি পান করে আবারও শুয়ে পড়লো। তুর্য হাসলো ওষ্ঠ প্রসারিত করে। বউটা তার ভীষন ঘুম কাতুরে। এতক্ষন যদি তাকে নিয়ে কেউ এভাবে টানাটানি করতো ঘুম সেই প্রথম দিকেই উবে যেত। তুর্য আবারও হাসলো, হাত বাড়িয়ে মুছিয়ে দিল পৃথার মুখ অতঃপর নিজেও খেতে শুরু করলো ঐ প্লেট থেকেই।

ক্ষানিক সময় নিয়ে নিজের খাওয়া শেষ করলো তুর্য। খাবার প্লেট গুলো গুছিয়ে লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লো বিছানায় পৃথার পাশেই। আজ তাদের মধ্যে কোলবালিশ নেই কোনো। থাকবে কোথা থেকে? সে কোলবালিশ তো তুর্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই সকলের অগোচরে বাইরে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন যেন কেন তার মনে হচ্ছে কোলবালিশটা থাকলেই ভালো হতো। তুর্য ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। ভিতরে ভিতরে তার পুরুষালী সত্ত্বা নড়েচড়ে উঠছে একটু একটু করে। একজন বিবাহিত পুরুষ মানুষ বউকে নিয়ে এক বিছানায় খুব কাছাকাছি শুয়ে আছে এমন পরিস্থিতিতেও কি তার পুরুষালী অনুভূতিগুলো হানা দিবে না? অবশ্যই দিবে। তুর্যেরও দিয়েছে। যদিও একটা সামান্য কোলবালিশ কখনও তার পুরুষালি সত্ত্বাকে বেঁধে রাখতে পারতো না কিন্তু মনকে তো বুঝ দিতে পারতো এটা বলে যে বউ তাদের মধ্যে প্রাচীর তুলে দিয়েছে, এই প্রাচীরের ওপাশে যাওয়া তার বারন। তুর্যের ভাবনা চিন্তার মধ্যেই পৃথা ঘুমের ঘোরে এগিয়ে এলো তার পানে। নিজের এক হাত দ্বারা জড়িয়ে ধরলো তুর্যের বেকাবু শরীর খানা। শিউরে উঠলো ছেলেটা, সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল মুহুর্তেই। এমনিই এতক্ষন নিজের ভিতরকার পুরুষালী সত্ত্বার অনুভূতিতে অসহায় ছিল সে এর মধ্যে আবার বউয়ের স্পর্শ। পৃথার শরীরটা একদম লেগে আছে তুর্যের শরীরের সাথে। মেয়েটার প্রতিটি ভারী নিঃশ্বাস জাগিয়ে তুলছে তুর্যের শরীরের লোমকূপগুলো। কি একটা অবস্থা! তুর্যের দম যেন বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। ঝাপটে ধরতে ইচ্ছে করছে পৃথার নরম দেহটা। মেয়েটার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে নিজের স্পর্শ এঁকে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। তুর্য যেন একটু বেশিই বেকাবু হয়ে পড়লো আজ। নিজেকে আর সংযত রাখতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। কিন্তু করার যে কিছুই নেই। তাকে নিজেকে সংযত রাখতে হবে। এই মুহূর্তে অনুভূতির জোয়ারে ভেসে গিয়ে পৃথার সাথে জোর জবরদস্তি করলে তাদের সম্পর্কের অবনতি বই উন্নতি হবে না। মেয়েটার মনে তুর্য সম্পর্কে বাজে ধারনা সৃষ্টি হবে। আজকে এক রাতের জন্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে হয়তো পরে দেখা যাবে কখনও তাকে মেনেই নিতে পারলো না পৃথা। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো তুর্য। নিজের শরীর থেকে পৃথার হাতটা সরিয়ে দিয়ে খুব সাবধানে নেমে পড়লো বিছানা থেকে। নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ালো বারান্দায়। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা চালালো। কিন্তু পৃথাকে ছেড়ে এখানেও ভালো লাগছে না। মানসিক শান্তি পাচ্ছে না। নিজেকে অসহায় লাগছে। এত বছর এত অপেক্ষার পর পৃথাকে কাছে পেয়েও দূরে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কি এক যন্ত্রনার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে তুর্য। না পারছে সইতে আর না পারছে মুখ ফুটে বলতে। তুর্য বারান্দায়ও থাকতে পারলো না। অল্প সময়ের মধ্যেই আবারও বিছানায় চলে এলো। শুয়ে পড়লো পৃথার পাশে মেয়েটার পানে মুখ ফিরিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,

-“এত কেন পোড়াচ্ছো আমাকে বউ? ঐ সাত বছরের জন্য? যে সাতটা বছরে তোমার কোনো অনুভূতিই ছিল না, ঐ সাত বছর তো তোমার কোনো কষ্টও হয়নি কারন তুমি জানতেই না আমাদের বিয়ের কথা। জেনেছো মাত্র কয়েকদিন আগে। সেই কয়েকদিন আগে জেনেই দীর্ঘ সাত বছরের জন্য অভিমান করে বসলে অথচ আমি তো পুরো সাতটা বছরই তোমার জন্য ছটফটিয়ে কাটিয়েছি, নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করেছি, তোমাকে পাওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনেছি। কিন্তু শেষ অব্দি কেউ আমাকে বুঝলো না এমনকি তুমিও বুঝলে না। আমাকে তোমরা কেন বুঝলে না বউ?

ওপাশ থেকে উত্তর এলো না কোনো। আসবে কিভাবে? পৃথা তো ঘুমাচ্ছে, গভীর ঘুমে নিমজ্জিত সে। তুর্যের বলা কোনো কথাই তো কর্ণে পৌঁছায়নি তার। আচ্ছা মেয়েটা যদি এই মধ্য রাতে তুর্যের এই কাতর কন্ঠের বাক্যগুলো শুনতো তারপরেও কি অভিমান নিয়ে বসে থাকতে পারতো? হয়তো পারতো আবার হয়তো পারতো না। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো তুর্য। একটু এগিয়ে পৃথাকে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। হৃদয়ে স্থান পাওয়া অনুভূতিদের সাথে হাজারটা যু’দ্ধে লড়াই করতে করতেই দুই চোখ বন্ধ করলো ছেলেটা।

৩৩.
সকালের আলো ফুটেছে চারদিকে। সূর্যটা ধীরে ধীরে নিজের উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে। রাতের নিস্তব্ধতায় ঘেরা শহরটাও ধীরে ধীরে তার ব্যস্তময় পরিচিত রূপে ফিরে এসেছে। চারদিকের কোলাহল ধ্বনিতেই ঘুমটা ভেঙে গেল পৃথার। একটু নড়েচড়ে উঠতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো কারো শক্তপোক্ত পুরুষালী বাহুবন্ধনে। পিটপিট করে চোখ খুললো পৃথা। চোখের সম্মুখে দেখতে পেল তুর্যের ঘুমন্ত মুখশ্রী। ছেলেটা কেমন আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে রয়েছে তাকে। মুহুর্তেই দু চোখ থেকে পুরোপুরিভাবে ঘুম উধাও হয়ে গেল মেয়েটার। ছিটকে দূরে সরে গেল পৃথা। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

-“আপনি আমার এত কাছে কেন? আর কোন সাহসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন ব্রিটিশ অ’স’ভ্য পুরুষ?”

পৃথার আকস্মিক ধাক্কায় হকচকিয়ে উঠলো তুর্য। হুড়মুড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলো সে। কিন্তু পরক্ষনেই সকাল সকাল নিজের বউয়ের মুখ থেকে এমন ঝাঁঝালো বাক্য কর্ণে পৌঁছাতে বিরক্ত হলো। সারারাত কতটা যন্ত্রনায় সে কাটিয়েছে তবুও কোনো প্রকার জোর করেনি বউকে উল্টো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। অথচ সকাল সকাল কিনা সেই বউ একটু জড়িয়ে ধরার জন্য চোটপাট দেখাচ্ছে। বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকালো তুর্য অতঃপর বলল,

-“আমি জড়িয়ে ধরি নি বরং তুমি জড়িয়ে ধরেছো। তাকিয়ে দেখো আমি আমার স্থানেই আছি, উল্টো তুমি তোমার স্থান থেকে সরে এসেছো।”

সেই গাড়ির মতো যুক্তি। পৃথার এবার সন্দেহ হলো। বারবারই কি সে নিজের স্থান ছেড়ে তুর্যের নিকটে যায়? পৃথা সন্দিহান সুরে প্রশ্ন করলো,

-“প্রতিবার আমিই আমার নিজের স্থান থেকে সরে আপনার কাছে যাই নাকি এর মধ্যে অন্য কোনো কারন আছে?”

তুর্য অপ্রস্তুত হলো পৃথার কথায়। মেয়েটা কোনোভাবে ধরে ফেললো না তো তার কারসাজি? এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো তুর্য। আমতা আমতা করে বলল,

-“এর মধ্যে আবার অন্য কি কারন থাকবে?”

থামলো তুর্য। বিছানা থেকে চট করে উঠে দাঁড়ালো সে। তাড়াহুড়ো করে বলল,

-“আমার পেটে চাপ দিয়েছে ভীষণ। ওয়াশ রুমে যেতে হবে।”

কথাটা বলেই এক প্রকাশ দৌড়ে ওয়াশ রুমে ঢুকলো তুর্য। পৃথার দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। ধারালো দৃষ্টিতে সে চেয়ে রইলো তুর্যের চলে যাওয়ার পানে।

৩৪.
পৃথা ফ্রেশ হয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়েছে অনেক আগেই। ইতমধ্যে সকলের সাথে খাবার টেবিলেও বসে পড়েছে সে। তুর্যও কিছু সময়ের মধ্যেই একদম স্যূট বুট পড়ে বেড়িয়ে এলো কক্ষ থেকে। গলা বাড়িয়ে বলল,

-“আমি বাইরে যাচ্ছি, কাজ আছে অনেক।”

তহমিনা বেগম সাথে সাথেই কপালে ভাঁজ ফেললেন। তিনিও গলা বাড়িয়ে বললেন,

-“খেয়ে তারপর যেদিকে খুশি যা।”

তুর্য হন্তদন্ত হয়ে খাবার টেবিলের কাছে এলো। পৃথার প্লেট থেকে একটা শুকনো পাউরুটি তুলে মুখে পুড়লো। চিবুতে চিবুতে বলল,

-“এখন আসছি।”

তাহমিনা বেগম আর কিছু বলবেন তার আগেই তুর্য পা বাড়ালো সম্মুখ পানে। দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার কি মনে করে তাড়াহুড়ো করে ফিরে এলো খাবার টেবিলের নিকট। একবার সবার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে একটু ঝুঁকে গেল পৃথার পানে। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,

-“ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করবে বউ, নিজের যত্ম নিবে। আমার আজ ফিরতে একটু দেরী হবে।”

কথাটা শেষ করে পরপরই আবার তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল তুর্য। পৃথা অবাক চোখে চেয়ে রইলো স্বামীর চলে যাওয়ার পানে। তুর্যের একটু আগের বলা কথাগুলো কেমন যেন এক রাশ ভালো লাগার সৃষ্টি করলো তার হৃদয়ে। তাদের বৈবাহিক জীবনে একসাথে থাকা কেবল মাত্র দুই দিন, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কও গড়ে ওঠেনি এখনও, সে ভালো কোনো ব্যবহারও করেনি তুর্যের সাথে অথচ ছেলেটা তার কতটা যত্ম নিচ্ছে। গতকাল রাতে তুলে খাইয়ে দেওয়া এখন আবার এতটা আদুরে ভঙ্গিতে তার থেকে বিদায় নেওয়া। একটা মানুষকে ঠিক কতটা গুরুত্ব দিলে তার থেকে অবহেলা পেয়েও তার যত্ম নেওয়া যায় ভাবছে পৃথা।

চলবে…..