অবাধ্য পিছুটান পর্ব-৪৮

0
174

গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
লেখনীতে : সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_৪৮

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

থামলো পৃথা আবার বলল,

-“মানছি আমার স্বামী আমার থেকে নিজের পেশা লুকিয়েছে। এর মানে এই নয় যে সে অন্য নারীর সান্নিধ্যে চলে গিয়েছে। আমি আমার স্বামীকে যথেষ্ট বিশ্বাস করি এবং ভরসা করি সেখানে এই অনলাইনের তুচ্ছ একটা ঘটনা ধরে বাপের বাড়ি যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমি আমার স্বামীর কাছেই থাকবো, কোথাও যাব না।”

কথাগুলো বলেই আর কারো পানে তাকানোর প্রয়োজনবোধ করলো না পৃথা। গটগট করে নিজের কক্ষের দিকে হেঁটে গেল সে। তুর্যের ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠলো সাথে সাথে। প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল বক্ষস্থল। পৃথা তাকে বিশ্বাস করেছে এরপর আর কি চাই তার? এখন যদি পুরো পৃথিবীও তার বিরুদ্ধে চলে যায় তাতে তো কিছু আসে যায় না। তুর্য সবার পানে তাকালো একবার। ইচ্ছে তো করছে বউয়ের কথা শুনে এখনই বাড়ির সকলের সম্মুখে একটা ঝাকানাকা নাচ দিতে। শুধুমাত্র মান ইজ্জতের ভয়ে নাচটা সে দিল না। সময় ব্যয় না করে ছুটলো পৃথার পিছু পিছু। কক্ষে ঢুকে দরজাটা কোনোমতে আটকে দিয়ে এগিয়ে গেল স্ত্রীর পানে। দুই হাত বাড়িয়ে যত্ন করে জড়িয়ে নিতে চাইলো নিজের সাথে। পৃথা ছিটকে দূরে সরে গেল তৎক্ষণাৎ। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

-“একদম ছোঁবেন না আমাকে। আমার কাছ থেকে দূরে সরুন ব্রিটিশ পুরুষ।”

তুর্য ওষ্ঠ কামড়ে হাসলো। বুঝলো বউটা তার সাথে অভিমান করে রয়েছে। নিচে পৃথা তার স্ত্রী হওয়ার দায়িত্ব পালন করে এসেছে এবার তুর্যকে তার স্ত্রীর অভিমান ভাঙিয়ে একজন স্বামী হওয়ার দায়িত্ব পালন করতে হবে। তুর্য পৃথার ঝাঁঝালো বানীকে উপেক্ষা করেই শক্ত করে সে জড়িয়ে ধরলো। টুপ করে বউয়ের গালে এক খানা চু’মু খেয়ে বলল,

-“ভালোবাসি বউ।”

পৃথা তেতে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“একদম ন্যাকামো করবেন না। সরুন আমার কাছ থেকে।”

তুর্যের বন্ধন আরও গাঢ় হলো। অপরাধীর কন্ঠে বলল,

-“স্যরি বউ আমার ভুল হয়েছে। আমার আগেই আমার পেশা সম্পর্কে বলে দেওয়া উচিৎ ছিল।”

থামলো তুর্য। আবার বলল,

-“আসলে হয়েছে কি আমরা একটা সিক্রেট মিশনে ছিলাম বউ। আর পুলিশ সদস্যদের সিক্রেট মিশন বলতে তো বোঝোই এর প্রতিটি পদে পদে বিপদ লেগে থাকে। শত্রুরা আমাদের ধ্বংসের জন্য ওত পেতে থাকে সর্বক্ষন। কখন কার কি হয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমন অবস্থায় আমি যদি তোমাকে সবটা জানাতাম তুমি হয়তো মেনে নিতে পারতে না। আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে, ভয় পেতে। হয়তো ভয়ে আমার পেশার প্রতিও আস্থা হারাতে। তাই আগে থেকে তোমাকে কিছু বলিনি, ভেবেছিলাম একদম মিশন শেষ হলে বলবো কিন্তু তার আগেই তো এতসব ঘটে গেল।”

কথাটা বলে পরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুর্য। কন্ঠ কিছুটা স্বাভাবিক করে বলল,

-“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ছবিগুলো দেখেছো ওগুলো আমাদের মিশনেরই একটা অংশ ছিল। একজন দাগী আ’সা’মি’কে গ্রেফতার করতে গিয়ে এই নাউজুবিল্লাহ মার্কা মেয়েটাকে পেয়েছিলাম আমরা হোটেল কক্ষে। আরুশও ছিল আমার সাথে যদিও শুধুমাত্র আমাকে ফাঁসানোর জন্য তাকে কাটছাঁট করে ছবি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।”

পৃথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো তুর্যের সব কথা। ভেংচি কেটে বলল,

-“হয়েছে এত কইফিয়ত দিতে হবে না আমাকে। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।”

তুর্য হাসলো। একটু ঝুঁকে পৃথার কপালে এক খানা চুমু খেয়ে বলল,

-“এর জন্যই তো আমি আমার বউটাকে এতটা ভালোবাসি।”

পৃথা ভেংচি কাটলো আবারও। একটু সময় নিয়ে প্রশ্ন বলল,

-“একটা কথা বলুন তো, আপনি তো বিদেশে ছিলেন। এলেন কিছুদিন আগে তাহলে আপনি এই চাকরি কখন পেলেন? তারপর আবার মিশন।”

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো তুর্য। কন্ঠ স্বাভাবিক রেখেই বলল,

-“পড়াশোনা শেষ করে আমি প্রায় তিন বছর আগেই সকলের অগোচরে দেশে ফিরেছিলাম। এ চাকরি তখনকার। এবং এর পরে এই মিশনের কাজেই আবার দেশের বাহিরে গিয়েছিলাম, ফিরেছি কিছু সময় পূর্বে। আমার এই কিছু সময় পূর্বে ফেরাটাই সকলে জানে বা আমি জানিয়েছি তার আগেটা কেউ জানে না।”

পৃথার হৃদয়ে ঘনিভূত অভিমানেরা আরও গাঢ়রূপ ধারন করলো তুর্যের কথা শ্রবণে। অভিমানী কন্ঠে সে বলল,

-“তিন বছর আগে দেশে ফিরেছিলেন কিন্তু একটা বারও খোঁজ নিলেন না আমার। আবার দাবি করছেন আমাকে নাকি ভালোবাসেন। এই আপনার ভালোবাসা?”

-“এটা সত্যিই আমার ভুল ছিল। আমি ভেবেছিলাম তোমার সাথে আমার বিয়েটা যেহেতু হয়ে গেছে তখন তুমি সারাজীবনের জন্য আমারই আছো। আমার থেকে আর কোথায় পালাবে। তাছাড়া আমার পরিবারের প্রতিও আমার একটা ভরসা ছিল। যতদূর দেখেছিলাম তোমার প্রতি তারা যথেষ্ট আবেগী ছিল তাই ভেবেছিলাম তারা তোমাকে ধরে বেঁধে হলেও আমার জন্য রেখে দিবে কিন্তু তারা তা করেনি।”

তুর্যের মলিন কন্ঠস্বর। পৃথার অভিমান গুলো একটু। কিছুটা কৌতুহলী কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

-“আপনি তো বিবাহিত ছিলেন। বিবাহিত হয়ে কিভাবে পুলিশে চাকরি পেলেন?”

-“প্রথমত তেমন কেউ জানতো না আমি বিবাহিত। আর দ্বিতীয়ত পুলিশের সকল পোস্টর জন্য বিবাহিত অবিবাহিত দেখা হয় না। কিছু কিছু পোস্টে যোগ্যতার ভিত্তিতে বিবাহিতরাও গ্রহনযোগ্য। তাছাড়া আমি বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগের মাধ্যমে এই পোস্টে এসেছি।”

পৃথা চুপ রইলো কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে। অতঃপর হুট করেই বলল,

-“ছাড়ুন আমাকে।”

তুর্য ছাড়তে চাইলো না। মেয়েটার কাঁধে মাথা রেখে বলল,

-“না, ছাড়বো না।”

পৃথা তুর্যকে ঠেলে নিজের থেকে সরিয়ে দিতে চাইলো। নাকমুখ কুঁচকে বলল,

-“ছাড়বেন তো। আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”

তুর্য এ পর্যায়ে ছেড়ে দিল পৃথাকে। বেশ উৎসুক হয়ে শুধালো,

-“কি সারপ্রাইজ?”

পৃথা উত্তর দিল না কোনো। একটু এগিয়ে টেবিল থেকে একটা ডাক্তারি রিপোর্ট তুলে নিল হাতে। তুর্যের পানে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-“পড়ে দেখুন।”

তুর্য কিছুটা ঘাবড়ে গেল। কি আছে এই রিপোর্টে? আর পৃথাই বা এত আয়োজন করে এই রিপোর্ট তাকে পড়তে কেন দিল? কোনো বড় অসুখ টসুখ করেছে নাকি মেয়েটার? তুর্যের হৃদয় ব্যাকুলতা ছেয়ে গেল। সময় নষ্ট না করে সে পড়তে শুরু করলো রিপোর্টটা। হুট করেই রিপোর্টের একটা স্থানে চোখ আটকে গেল। চমকে উঠলো তাকালো পৃথার পানে। পৃথা বুঝলো এই তাকানোর মানে। ভেংচি কেটে সে বলল,

-“এখনই বলতে চাইছিলাম না, লুকিয়ে রাখতে চাইছিলাম সবটা। কিন্তু আমি তো আর আপনার মতো ব্রিটিশ নই তাই আর লুকিয়ে রাখতে পারলাম না।”

তুর্যের কর্ণে যেন পৌঁছালো না পৃথার বলা একটা কথাও। সে ভ্যাবলার মতো বসে রইলো ওভাবেই। নিজ চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না এই মুহুর্তে।বেচারা আরেকবার পড়লো রিপোর্টটা অতঃপর হুট করেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো পৃথাকে। আবেগী কন্ঠে বলল,

-“আমি যা দেখছি তা কি সত্যি বউ? নাকি সবটা স্বপ্ন।”

পৃথা ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাসলো। দুই হাত বাড়িয়ে নিজের সাথে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরলো তুর্যকে। মৃদু কন্ঠে বলল,

-“একদম সত্যি দেখছেন মিস্টার তুর্য চৌধুরী, আপনি অতি শীঘ্রই বাবা হতে চলেছেন। এবার অন্তত নিজের পাগলামী ছাড়ুন মশাই।”

তুর্য সাথে সাথে প্রতিবাদ করলো পৃথার কথার। উৎফুল্ল চিত্তে সে বলল,

-“উহু এখন আরও বেশি পাগলামী করবো। আগে পাগলামী করেছি একা এখন পাগলামী করবো আমার ছাও পোনাদের নিয়ে। কেউ আটকাতে পারবে না আমাদের।”

৫৩.
লাল নীল সবুজ বাতির আলোয় ঝলমল করছে আজ চৌধুরী বাড়ি। পুরো বাড়ি কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে অতিথিদের আগমনে। হবেই বা না কেন? আজ যে ইরা এবং আরুশের বিয়ে। ইতমধ্যে আরুশের বাড়ির লোকেরা বরযাত্রীসহ চলে এসেছে এ বাড়িতে। আরুশকে বসতে দেওয়া হয়েছে স্টেজে সুসজ্জিত এক রাজকীয় চেয়ারে, আর ইরার অবস্থান তার পাশেই। মেয়েটাকে আজ পার্লার থেকে ভারী মেকআপের আবরণে সাজিয়ে আনা হয়েছে, আর সাথে শরীরে তো ভারী ল্যাহেঙ্গা আছেই। আরুশ একটু পর পর আড় চোখে দেখছে নিজের প্রেয়সিকে। মেয়েটাকে কি সুন্দর লাগছে আজ। বিয়ের সাজে সম্ভবত সব নারীকেই আলাদাভাবে সুন্দর লাগে। আরুশ নিজ চেয়ারে একটু চেপে বসলো। সকলের অগোচরে কথা বলতে চাইলো ইরার সাথে। কিন্তু এখানেও তার শত্রুর আগমন। কোথা থেকে হুট করেই আগমন ঘটলো পৃথার আর তার পিছু পিছু তুর্যের। তুর্য পৃথার পিছু পিছু হাঁটছে আর সেকেন্ডে সেকেন্ডে সাবধানী বানী হাঁকছে,

-“আস্তে হাঁটো বউ। এই সময়ে এত জোরে হাঁটতে হয় না। আমার টিয়া পাখির ছানাদের কষ্ট হবে যে।”

পৃথার এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে নিজের কপাল নিজে চাপড়ে ফাটিয়ে ফেলতে। কোন দুঃখে সে এই পাগল লোককে বলতে গিয়েছিল যে সে প্রেগন্যান্ট। যখন থেকে এই লোক জেনেছে পৃথা প্রেগন্যান্ট আর সে বাবা হতে চলেছে তখন থেকে না পৃথার পাশ থেকে একটা সেকেন্ড নড়েছে আর না মেয়েটাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিয়েছে। না খাওয়াতে শান্তি দিয়েছে, না বসাতে, না শোয়াতে, না ঘুমাতে। তার উপর আবার ইরার বিয়ে উপলক্ষ্যে অফিস থেকেও লম্বা ছুটি নিয়েছে। এখন তো আর চেঁচিয়েও লাভ নেই এর উপর। বো*ম মেরেও কেউ একে সরাতে পারবে না বউয়ের নিকট থেকে। পৃথা মাঝে মাঝে আশ্চর্য বনে যায়। একটা লোক কিভাবে এতটা নির্লজ্জ ধাঁচের হতে পারে?তারপর সৃষ্টিকর্তার কৃপায় হয়েছেও না হয় তাই বলে সেই নির্লজ্জ লোকটাকে পৃথার কপালেই পড়তে হলো? পৃথা হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো। এমনিই তো এই লোকের পাল্লায় পড়ে জীবনে শান্তি নেই কোনো এখন আবার এই লোকের উপাধি দেওয়া টিয়া পাখির ছানা যতক্ষণ তার পেটে থাকবে ততক্ষণ অত্যাচারেরও শেষ থাকবে না।

চলবে…..