#অবাধ্য_প্রেম
#পর্ব_৪৪
#নন্দিনী_নীলা
নিবিড় আমার দিকে ফিরতেই আমার হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠে আমি ভয়ে দুপা পিছিয়ে যায়।
নিবিড় খুব কোমল গলায় আমার দিকে তাকিয়ে বলে,, ‘এক গ্লাস পানি দাও তো।’
আমি চকিতে মাথা তুলে তাকায়। নিবিড় আমাকে নড়াচড়া করতে দেখল না উল্টা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘কিছু বলছি কানে যাচ্ছেনা?’
আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছি। নিবিড়ের পানি আমি কিভাবে এনে দেবো? আমি তো নড়তেই পারছি না। আমার হাত পা চলছে না নিবিড় কে দেখলে আমার কেমন ভয় করছে। লোকটা মাঝে মাঝেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। চেনার উপায় থাকে না তখন।
নিবিড় আরেকবার চাইলো কিন্তু আমি নড়লাম না। আমি জানি এবার নিবিড় আবার রেগে যাবে হয়তো আমাকে ধমক দিবে। দিক ধমক। আমি ধমক শোনার জন্য মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। তবু আমি নড়তে পারবো না।
নিবিড় বিরক্ত নাক মুখ কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজে ই আমার ছোট কিচেন রুম টাই চলে গেল। ফিরে এলো পানির বোতল ও গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে। ফ্লোরে রেখে আমার কাছে এল আমি ভয়ার্ত মুখ করে নিবিড়ের দিকে তাকালাম।
নিবিড় বলল, ‘ এখানে বসো।’
নিবিড় আমাকে আমার পাতা বিছানা দেখিয়ে বলল আমি নড়লাম না শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তার কথায় কোনো ভাবান্তর না করায় নিবিড় কিছুটা রেগে আমাকে টেনে জোর করে বসিয়ে দিল।
শুধু বসেই কি খান্তো। এতক্ষণ গলা টিপে মারছে তে চেয়েছিল। আর এখন আহ্লাদ ভালোবাসা দেখিয়ে আমার সেবা করা হচ্ছে। আমাকে জোর করে পানি খাওয়ালো। আমিতো খাবোই না সামনে থেকে বারবার গ্লাস সরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু নিবিড় আমার গাল চেপে পানি খাইয়েছে।
আমি আগুন চোখে নিবিড়ের এদিকে দৃষ্টি ফেলেছি। নিবিড় আমার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে টেনে আমার গলা চেক করেছে।
আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, ‘ জুতা মেরে গরু দান করতে হবে না।’
নিবিড় আমার পানে চেয়ে বলল, ‘আমি তোমায় জুতা মারলাম কখন? আর গরুইবা কোথায় আনলাম!’
আমি দাঁত কিড়মিড় করে অন্যদিকে চেয়ে আছি। অজান্তে আমার চোখ দিয়ে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। নিবিড় আমার চোখে পানি দেখে নরম হয়ে গেল।
ওর সমস্ত রাগ উবে গেল।
আমাকে নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘: ব্যথা কি বেশি পেয়েছ?’
আমি ক্ষ্যাপা বাহিনীর মতো নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনি মানুষ মেরে ফেলে বলবেন মরতে কি বেশি কষ্ট হয়েছে?’
নিবিড় বলল, ‘ আমার রাগ করাটা কি স্বাভাবিক না? তুমি যা করেছো সেটার পরে কি আমি রাগ করতে পারি না?’
‘না পারেন না। আমি যা করেছি একদম ঠিক করেছি। আর আপনি আমার উপর এইভাবে রাগ দেখাতে পারেন না। আপনি বাসায় ঢুকেছেন কিভাবে সেটা আমাকে আগে বলেন।’
‘তোমার বাসায় ঢোকা আর কি ব্যাপার। কিন্তু আজকে তো মিথ্যা কথা বলে বাসায় ঢুকতে হয়েছে। বাসাটা নিচ তলায় নিয়ে ভালো করেছো আমি যখন খুশি তখন চাইলেই চলে আসতে পারবো সবার অগোচরে প্রেম করতে। কিন্তু আজকে এসেছি আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে ওর খালার বাড়ি চার তলায়।ও না থাকলে হয়তো আমি বাসার ভেতরে ঢুকতে পারতাম না খুব ঝামেলা করতে হতো।’
‘আমার সবাইকে বলে আসা উচিত হয়নি আমি বাসায় কোথায় নিয়েছি।’
‘কাউকে না বলে আসলেও তোমাকে খুঁজে বের করা আমার ব্যাপার ছিল না। আর একটা কথা শোনো। মাইশা তোমাকে কি কি বলেছে আমি সব জেনে গেছি।’
‘ কিভাবে জানলেন?’ বিস্মিত কন্ঠে বললাম।
নিবিড় বলল, ‘ পরে বলি। আমি একটু আসতেছি দরজা খুলিও।’
বলেই নিবিড় দরজা খোলে চলে যায়। আমি হাঁ করে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। একটু বাদে ব্যথার মলম নিয়ে ফিরে আসে। আমার হাতে মলম দিয়ে বলে এটা লাগিয়ে নিও। আমি রাগে ফুঁসছি।
‘আপনার মলম আপনি লাগান আমার লাগবে না। সস্তা আদিখ্যেতা আমার সহ্য হয় না।’
‘আদিখ্যেতা না এটা ভালোবাসা!’
আমি কিছু বলতে গিয়েও আমার মাইশার ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করলাম। নিবিড় বলল না। এই লোকটা এমনই আমি জানতাম বলবে না। শুধু বলল, ‘বাসা ছেড়েছো ভালোই হয়েছে এখন প্রেম করার জন্য তোমার বাসায় আমার যাতায়াত চলবে। আমার নাম্বার হয়তো ব্লকলিস্টে করেছো। আমি লিস্ট থেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছি। আর ব্লক করার চেষ্টাও করবে না। আর ফোন দিলেই ফোন রিসিভ করবে। কথাটা যেন মাথায় থাকে।
আমি অবাক গলায় বলল, ‘ মগের মুল্লুক পেয়েছেন? আপনি বলবেন আর আমি আপনার ফোন রিসিভ করতে যাব! আবার ব্লক করে দিব।’
‘শোন, যদি আমার ভালোবাসা একসেপ্ট না কর। আমাকে যদি অসহ্য মনে করে এড়িয়ে চলো। তাহলে কিন্তু তোমাকে ফাঁসানোর অস্ত্র আমার হাতে আছে।’
‘শুনুন আমাকে আজাইরা ডায়লগ দিতে আসবেন না। আমাকে ফাঁসানোর কিছু আপনার কাছে নাই। অনেক ব্ল্যাকমেল করেছেন। আপনার কোন কথা আমি কানে নেব না। আপনি এবার বের হন আমার বাসা থেকে। একজন অবিবাহিতা মেয়ে রুমে এসে আপনি যা করছেন এসব বাইরের লোকে জানলে আর মুখ দেখানোর জো থাকবে না। আপনি তো এটাই চান আমি সবার সামনে খারাপ হই। এর জন্যই তো এসব শুরু করেছেন আলগা পিরিত দেখাচ্ছেন।’
আমার কথা শুনে নিবিড়ের মেজাজ গরম হয়ে গেল। কিন্তু তবুও শান্ত থাকার চেষ্টা করল আমার ওপর আর রাগ দেখালো না। শুধু কঠিন স্বরে বলুন, ‘আমি ঠান্ডা আছি ঠান্ডা থাকতে দাও আমার মুডটা ঘুরিয়ে দিও না।’
‘নিজের রাগ, ঠান্ডা, নিজের ভালোবাসা সবকিছু অন্য কোথাও দেখান।এখানে প্রয়োগ করতে আসবেন না।’
‘অপাত্রে দান করবো নাকি যেখানে আমার যা সেখানেই তো প্রয়োগ করতে হবে। আর তুমি যদি আমার কথা না শোনো এবার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল নয় এবার হুমকি দিচ্ছি। তোমার মামী কার সাথে যেন তোমার বিয়ে ঠিক করছিল ছেলেটা শুনছিলাম বখাটে গুন্ডা, মনে আছে সেই সুপুরুষের কথা। ওর সাথে কিন্তু আমার কন্টাক্ট আছে। ওকে তোমার ঠিকানা দিতে আমি দুইবার ভাববো না। আমাকে মেনে না নিলে। ওই বকাটে গুন্ডা টার বউ হওয়ার স্বপ্ন তোমার সত্যি করে দেব আমি।’
আমি ভয়াত কন্ঠে বললাম, ‘ওই শয়তান টার সাথে আপনি আমার বিয়ে দিতে চান?’
‘অবশ্যই না তোমাকে তো আমি আমার বউ করতে চাই। কিন্তু যদি আমাকে মেনে না নাও তাহলে ওর বউ করে দেবো। একজনের ভালোবাসা তো সফল করতে হবে তাই না। ও বখাটে গুন্ডা হলেও কিন্তু তোমাকে রিয়েল লাভ করে। আহারে বেচারা ছেলেটার জন্য আমার মায়া হয়। তোমাকে যদি নিজের জন্য সিলেক্ট করতাম তাহলে ওর সাথেই বিয়ে দিতাম। কিন্তু তুমি তো আমায় নিজের প্রেমে পাগল করে দিয়েছো তাই এটা করতে পারছি না।’
‘ আমি আপনাকে পাগল করলাম কীভাবে?’
‘ সে তুমি বুঝবে না বাচ্চা মেয়ে।’
‘ আমি কোন বাচ্চা না যে বুঝব না। আসলে আপনি বলতে চান না। ‘
‘ ছোঁয়া জান এখন আমি আসি। আর যা বললাম মনে রেখো কিন্তু এদিক ওদিক করলেই তোমার দেওয়ানা জসিমের কাছে খবরটা চলে যাবে। তারপর জসিমের মিসেস হয়ে যাবে।’
জসিমের ভয়ে আমি নিবিড়ের কথা শুনতে বাধ্য হলাম। নিবিড়ের সাথে কথা বলতে যে একটা খারাপ লাগছে তা কিন্তু না ওটা ভালই লাগে কিন্তু আমি চায় না নিবিড় কে প্রশ্রয় দিতে।
নিবিড় দশবার কল দিলে আমি একবার রিসিভ করি। আর কলেজে তো প্রতিদিন দেখা হয়। ওদের কলেজ অফ কিন্তু নিবিড় তার গ্যাঙ নিয়ে কলেজেই থাকে আমার জন্য সেটাও আমি বুঝি। নিবিড়ের পরিক্ষার ফরম ফিলাপ হয়ে গেছে রুটিন দিয়ে দিছে এখন শুধু পরীক্ষার দিন আসার অপেক্ষা। সবাই বাসায় বসে পরে আর ও কলেজে ঘোরাফেরা করে। এজন্য আমি একদিন কলেজে জিজ্ঞেস করি আপনি পড়াশোনা না করে কলেজে ঘুরাফেরা করেন কেন? আপনার তো পরীক্ষা দুইদিন পরিক্ষা।
নিবিড় বলে তাহলে তুমি আমার কল ধরবা আমি যতবার দেবো বলো। তাহলে আমি আর কলেজে আসব না। ঠিকমতো পড়ালেখা করবো একেবারে পরীক্ষার পরে তোমার সাথে দেখা করতে আসব।
আমি ইতস্ত বোধ করে রাজি হয়ে যায়। এদিকে লেখাপড়া হবে আর আমাকে জালানোটা বন্ধ হবে। কল দিলে না হয় দুই তিন মিনিট কথা বলে নেব এই হলো। পরীক্ষার শুরু হওয়ার আগে একটু বেশি ফোন দিত পরীক্ষার দিন থেকে আমি আবার নতুন শর্ত জারি করেছি।
আমি বলেছি, ‘আজকে থেকে যেহেতু আপনার পরীক্ষা এখন থেকে শুধুমাত্র পরীক্ষার দিন আমাকে দিনে একবার করে ফোন দিতে পারবেন।’
নিবিড় বলে, ‘আচ্ছা দিনে একবার রাতে যতবার খুশি।’
‘না দিনরাত মিলে একবার ফোন দিবেন।’
‘আচ্ছা তোমার কথা শুনলাম পরীক্ষা যে কয়দিন থাকবো এই কয়দিন শুধু এক বার করে দিব আর মাঝখানে যে বন্ধ থাকে তখন ইচ্ছা মতো দেব।’
আমি রেগে আর কিছু না বলে ফোন কেটে দেয়।
এদিকে আমি কল্পনা জল্পনা করছিলাম আপনাদের সাথে আর এদিকে আমার মনোযোগ না পেয়ে লিলি নিজের বাসায় চলে গেছে মন খারাপ করে।
তখন আর আমি লিলি সাথে কথা বলতে বা দেখা করার জন্য নিচে আসলাম না কারণ এখন আমার কিছু রান্না করে খেতে হবে। আমি উপরে আস্তে আস্তে ১১ টা বাজল।
উপরে এসে আয়োজন দেখে মনে হল যেন আজকেই বিয়ে আজকে মেয়ে নিয়ে চলে যাবে। আমাকে দেখেই আন্টি এক গাল হেসে বলল, ‘ ছোয়া যাও তোমার বান্ধবীর কাছে যাও কেমন পাগলামি করছে বলতো। আমি কি ওর ভালো চাই না বলো তো মা। ওর ভালোর জন্য তো বিয়ে ঠিক করেছি। আমি নিজে গিয়ে দেখেছি খুব ভালো ফ্যামিলি, আর ছেলের কথা কি বলবো এত ভালো এমন ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এখানে বিয়ে হলে তোমার বান্ধবীর রাজ কপাল হবে। কিন্তু সে তো রাগ করে বসে আছে তাকে আগে জানায়নি বলে। কিভাবে জানাতাম বল ছেলে তো পই পই করে না করে দিয়েছিল। সে নাকি এখনই কিছু জানাতে চায় না। এতে নাকি লিলি লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। এখন ছেলে যেখানে না করছে সেখানে কি জানানো যায়। আর তোমার বান্ধবী তো আর নিজে পছন্দ করে বয়ফ্রেন্ড করে নি কাউকে। যে আমার পছন্দের উপর কথা বলতে আসবে। সোনা মুখ করে রাজি হয়ে যাবে তা না। এখন রাগারাগি করছে আমার উপর।’
আমি কি বলবো আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে স্বীকার করে যাচ্ছি। আন্টি নিজের মত বকরবকর করে চলে গেল। আমি লিলি রুমের দিকে যাচ্ছি ছিলাম তখনই দেখা হয়ে গেল লিলির ভাইয়ের সাথে আমি তাকে দেখেছি চমকে উঠলাম। এই মানুষটাকে আমার একটু পছন্দ না। কেমন যেন একটা টাইপের এই যে এখন আমার সামনে এসে দাঁত কেলিয়ে বলল, ‘ ভালো হয়েছে চলে আসছো আজকে আর নিচে যাওয়ার দরকার নাই। আমাদের এখানে থেকে যেও খাওয়া দাওয়া এখানেই করো। তোমার বান্ধবী তো আজকে বিয়ে।’
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, ‘কি আজকে না এনগেজমেন্ট ছিল শুধু। এখন আবার বিয়ে বলছেন কেন?’
‘কাবিনটা মনে হয় আজকেই হবে।’
আমি এবার কপরটা রাগ দেখিয়ে বললাম, ‘এটা কোন কাজ করলেন ভাই আপনারা? লিলি কে কিছুই না জানিয়ে একদম বিয়ে পর্যন্ত চলে গেছেন। ছেলেটাকে লিলি চেনে না। এখন পর্যন্ত দেখেনি। বিয়ের আগে কি একটু দরকার না, ওদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হবে। নিজের একটা পছন্দ অপছন্দ আছে। এভাবে একদম বিয়ের আয়োজন করে ফেলছেন। লিলির দিকটা একটু ভাববেন না?’
‘আরে তুমিও দেখি তোমার বান্ধবীর মত রাগ করছো। আমরা কি আমার বোনের ক্ষতি চাইবো? আমরা ভালো বুঝি তো ঠিক করেছি এখানে আবার ওর কি কথা? আর ওর পছন্দ করতে হবে কেন? আমরা খারাপ পাত্র ঠিক করেছি নাকি। ও দেখলেই পছন্দ হয়ে যাবে। আর আজকে শুধু বিয়েটা হবে আজকে তারা ওকে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাচ্ছে না। বিয়ের পর না হয় জানাশোনা ভালো করে হবে।’
প্রচুর বিরক্ত লাগছে আমি এমনিতেই মানুষটাকে পছন্দ করি না। আবার তার এমন অযৌক্তিক কথাবার্তা আমার আরো পছন্দ হলো না। আমি তার সাথে আর কথা না বাড়িয়ে লিলির রুমে চলে এলাম।
.
লিলিকে আর আমি কি বোঝাবো শান্তনা দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নাই। ওকে আমি বলছি তোর যদি খুব খারাপ লেগে থাকে তুই পালিয়ে যা। আমার মতো। মতে বিরোধী বিয়ে করিস না। আমি শুনে নিয়েছি তোর ভাইয়ের থেকে। আজকে তোর বিয়ে।
‘আমি এটা পারবো না রে। মা বাবা যার সাথে বিয়ে দেবে আমি তাকেই বিয়ে করবো। কিন্তু এরকম হুট করে বলে আমার খারাপ লাগছে।’
‘বাবা মায়ের আদরের বাধ্য মেয়ে। আচ্ছা লিলি আমার যদি বাবা মা থাকত তাহলে কি আমি তাদের বাধ্য হয়ে থাকতাম তোর মত?’
‘থাকতি তুই আমার থেকেও আদরের মেয়ে। বাধ্য মেয়ে, ভালো মেয়ে থাকতি।’
বাবা মায়ের কথা মনে পরতেই চোখে জল চিকচিক করে উঠল আমার।
বিকেলে বরপক্ষ আসতেই আমি দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম। বরের দিকে তাকাতেই আমি চমকে উঠলাম।
#চলবে….
#অবাধ্য_প্রেম
#অতিরিক্ত_পর্ব
#নন্দিনী_নীলা
বরপক্ষ রা বসে আছে তাদের পেছনে একজন দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শ্যামলা করে হ্যাংলা পাতলা ছেলেটা। সেই চেনা মুখ সেই চেনা বিশ্রী হাসি। ইয়ার কেউ না জসিম। জসিমকে দেখে ভয়ে আমার জান বের হওয়ার উপক্রম। আমি ঠাস করে দরজা শব্দ করে লাগিয়ে ভেতরে গিয়ে কাঁপতে লাগলাম। আমাকে হঠাৎ ভয় পেতে দেখে লিলি চমকে উঠলো।
বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরল অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ছোঁয়া কি হয়েছে তোর!এমন করছিস কেন?’
আমি কাঁপা কাঁপা পায়ে বিছানায় বসে বললাম,, ‘জসিমের বাচ্চা এখানে কি করছে? তোর ওই হবু শ্বশুর বাড়ির লোকের সাথে ওর আবার কি সম্পর্ক? কেন আসতে গেলাম এখানে আমি! একবার জসিম আমাকে দেখে নিলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’
লিলি জসিম নামটা শুনে চিনতে পেরে গেছে। কারণ ছোঁয়ার থেকে জসিম কে কেন জসিমকে এত ভয় পাচ্ছো তার সবই জানে ও। ও নিজে অবাক হল সেই শয়তান ছেলেটা ওদের বাসায় কি করছে?
ছোঁয়া কি ঠিক বলছে? নাকি ও ভুল দেখল!
ও ছোঁয়া কে আবার জিজ্ঞেস করল,, ‘ ছোঁয়া তোর কথাও ভুল হচ্ছে না তো? ওই বদমাইশ ছেলেটা এখানে কিভাবে আসবে?’
লিলির কথা শুনে আমি বিরক্তিকর চাহনী দিলাম ওর দিকে।
বিরক্ত আর ভয় মাখা গলায় বললাম, ‘ওই হারামিটা কে চিন্তে আমার একটু ভুল হবেনা। জসিমার মত ছেলের সাথে যে ফ্যামিলির সম্পর্ক সেই ফ্যামিলি যে কতটা ভালো হবে সেটা আমি ভাবছি। এরকম একটা ফ্যামিলির সাথে তোর বিয়ে ঠিক হলো। তুই যেভাবে পারিস দোস্ত বিয়ে ভেঙে দে। আর আমাকে একটা লুকিয়ে থাকা জায়গা দে। ওই জসিমের সামনে যেন আমি না পড়ি। ও যেন জানতে না পারে আমি এখানে আছি।’
লিলি আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘যদি জসিমের সাথে ওই পরিবারে কোন সম্পর্ক থেকে থাকে রে বাবা মার বিরুদ্ধে আমি এই প্রথম কথা বলব। এই বিয়ে আমি করবো না। আর একটা কথা তুই নিশ্চিন্তে এখানে থাক। আমি আছি তো এই রুমে কেউ আসতে পারবে না। মা এমনিতেই তো তোকে বলেছিল তুই যেন পাত্র-পক্ষের সামনে না যাস। ভালোই হয়েছে তুই এবার ভালো মতো লুকিয়ে থাকতে পারবি। আমি বলব এরুমে তুই আছিস কেউ না আসে যেন।’
সেই মুহূর্তের দরজা ধাক্কা দিয়ে আন্টি এলো লিলির মা। এসে লিলিকে নিয়ে গেল আর আমাকে বলল রুমে থাকতে।
আমি বললাম, আন্টি আমি তাহলে ভেতর থেকে দরজা আটকে দেই!’
তিনি কি যেন ভেবে বলল,’ আচ্ছা!’
আমি দরজা আটকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই। আমার ফোনটা বেজে উঠলো। নিবিড় কল করেছে। আজকে নিবিড়ে পরীক্ষা ছিল। আমার শর্ত অনুযায়ী আজকে একবারের বেশি কল করতে পারবে না। আমার শর্ত ভাংলো! আমি কল কেটে দিলাম। কিন্তু তার কল করা থামছে না। কল করেই যাচ্ছে। ফোন বন্ধ করতে নেব তখনই নিবিড় মেসেজ পাঠাবো,
‘নিবিড়ের জানেমান। তোমার শর্ত ভাঙ্গার কারণ আছে। ফোনটা রিসিভ করো। জসিম এ ব্যাপারে তোমার সাথে কথা বলতে হবে। জসিম কিন্তু এই ফ্ল্যাটে ঢুকেছে।’
আমি চোখ বড় বড় করে মেসেজটার দিকে তাকিয়ে আছি। নিবিড় জানলে কি করে জসিম এই ফ্ল্যাটে ঢুকেছে?
এবার ফোন আসতে আমি ফোনটা রিসিভ করলাম।
ফোন রিসিভ করেই বললাম, ‘আপনি জানলেন কি করে জসিম এই ফ্ল্যাটে ঢুকছে?’
নিবিড় আমাকে বলল, ‘একটু বারান্দায় আসো তো।’
‘মানে? আমি যা বলছি তার আনসার দেন!’
‘আরে আসো তো। কিভাবে জানতে পারলাম দেখবে না? আমি বলার থেকে তুমি নিজ চোখে না হয় দেখো।’
বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে এল আমার। নিবিড়ের উপর মেজাজটা গরম হয়ে যাচ্ছে। লোকটা এত ভনিতা করতে পারে। জাস্ট বিরক্তিকর। জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষার জন্য আমি নিবিড়ের কথাটা ফেলতে পারলাম না। বেলকনিতে এলাম। আমি ভাবছি নিবিড় হয়তো ভাবছে আমি নিচ তলায় আছি। ও হয়তো নিচের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কিন্তু না এখানে সে আমাকে অবাক করল নিবিড় ও তিন তলার বেলকুনিতে চেয়ে আছে। আমি যে রুমের টাই আছি। আমি বেলকনিতে গিয়ে দাড়াতেই নিবিড় আমাকে হাত ইশারা করল। একটা ফ্লাইং কিস দিল আমি কটমট চোখে তাকিয়ে আছি।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,’আপনি এখানে কি করছেন? দেখে তো মনে হচ্ছে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে সোজা এই রাস্তা ধরেছেন।’
নিবিড় চটপটে উত্তর দিল, ‘তোমার ধারনা কিন্তু ভুল নয়। ১০০% রাইট তুমি যা বলছো সেটাই তো করেছি।
‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হবেন, খাবেন, রেস্ট নিবেন। তা না বৈরাগীর মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’
‘তোমার প্রেমেতে হয়েছি যে আমি পাগল পারা।’
‘অসহ্যকর!’
‘শোনো আমি এসেছিলাম তোমাকে এক নজর দেখতে। কিন্তু তোমার দেখা তো আজ পেলাম না পেলাম গিয়ে তোমার ওই জসিমের নজর। তাকে দেখতে পেলাম কয়জন মানুষের সাথে ভেতরে ঢুকতে। তোমার আবার বিপদ হলো নাকি। তাই জন্যই কল দিলাম না হলে আমি যে এখানে এসেছিলাম সেটা তোমাকে জানাতাম না। কিন্তু দুশ্চিন্তায় জানাতে বাধ্য হলাম এবার বল ওই জসিমের বাচ্চা কোথায় আছে? ও কি তোমাকে ডিস্টার্ব করছে ও বাসায় কোথায় গেছে কার বাসায় গেছে ?’
‘জসিম যে বাসায় এসেছে সেটা লিনিদের বাসা আর আমি এখন লিলিদের বাসায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি।’
‘সেটা আমি জানি। আচ্ছা তুমি এখানে আছো জসিম সেটা কিভাবে জানলো? আমার কি উপরে আসতে হবে? আমি কি আসবো?’
‘একদমই না। চুপচাপ বাসায় ফিরে যান। আর শর্ত মোতাবেক আপনার এই কয়দিন আমার আশেপাশে আসা বারণ ছিল। আপনি তাও কেন এসেছেন?’
‘দেখো এখন আমি টেনশনে আছি। ওই জসিম কেন ওখানে গেছে। আমাকে সবটা খুলে বলো। না হলে আমি কল কেটে উপরে এসে নিজেই দেখছি বাই।’
‘আরে না না। আপনি উপরে আইসেন না। আপনি চলে যান জসিম আমার জন্য আসেনি। আর আমি যে এখানে আছি সেটাও জানে না।’
‘তুমি মিথ্যা বলছো!’
‘উফ মিথ্যা কেন বলতে যাবো? সত্যি, লিলি কে আজ দেখতে আসছে পাত্রপক্ষ। তার সাথে জসিম আসছে। আমি লিলি কাছে আসছিলাম সেই জন্য। এসে জসিমকে দেখে আমি লুকিয়ে আছি। আপনি এসে আর ঝামেলা বাড়াইয়েন না। নিজের শর্ত পালন করুন চলে যান। না হলে আমিও আপনার শর্ত মানবো না।’
‘ওকে চলে যাচ্ছি। কোনো গন্ডগোল হলে আমাকে কল করবে।’
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম নিবিড় গাড়ি নিয়ে চলে গেল। রুমে ভেতর আসতেই দরজা ধাক্কানোর শব্দ পেলাম আমার বুকটা ছ্যাদ করে উঠলো। দরজা ধাক্কাচ্ছে কে দরজা খুলতে আমার ভয় করছে। আমি দরজার কাছে এসে বললাম কে? তখন লিলির আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে দিলাম।
লিলি আমাকে বলল,, ‘দোস্ত সর্বনাশ হয়ে গেছে এটা তো রায়ান।’
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, ‘কি বলিস তোর সেই পুরনো প্রেমিক!’
লিলি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘আবার পুরনো প্রেমিক বলছিস। ও কবে আমার বয়ফ্রেন্ড ছিল?’
‘আমি কি জানি তুই তো আমাকে সম্পূর্ণ কাহিনী এখনো বলিস নি!’
‘আচ্ছা আজকে রাতে বলবনি তুই আজ আমার বাসায় থেকে যা।
‘আজ তোর বিয়া আজ তোর জামাই থাকবে এই রুমে। আমার জায়গা হবে না।’
‘ধ্যাত, দোস্ত ওই জসিমের খবরটাও নিয়ে আসছি।’
‘ বল বল…
‘দোস্ত জসিম হচ্ছে রায়ানের বোনের জামাই যে গাড়ি আছে সেই গাড়ির ড্রাইভার। রায়ানের যেহেতু গাড়ি নাই তো বোনের গাড়ি নিয়ে আসছে। তো সেই গাড়ির সাথে ড্রাইভার আসছে।’
‘ও আচ্ছা। তাহলে তো বিয়েটা করাই যায়। যেহেতু পুরনো প্রেমিক পেয়েছিস। আর ছেলে তো মাশাল্লাহ সুন্দর আছে। তুই তো রাজী মনে হয়। তোকে তো এখন আর রাগী মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে বিয়েতে তুই নিজেও রাজি হয়ে গেছিস।’
‘হ্যাঁ রায়ান কিন্তু ছেলে হিসেবে খুব ভালো। আর যেহেতু আমার দিক থেকে ওর প্রতি একটা ভালো লাগা আছে রাজি না হয়ে কোথায় যায়।’
‘আচ্ছা ভালো বিয়ে করে নে। শুধু ওই জসিম শয়তান টা কে আমার ধারে কাছে আনিস না। আজকে দিনটা পার করতে পারলে। তোর বিয়ের ধারের কাছে আর আসতাম না।’
লিলি বিস্মিত গলায় বলল, ‘আমার বিয়েতে থাকবি না?’
‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম। ওই জসিম আমার চির শত্রু ও তোর বিয়েতে থাকবে যেহেতু ড্রাইভার দেখতে আসতে যে থাকে সে তো বিয়ের সময় ও থাকবে। আমি এভাবে লুকিয়ে, পালিয়ে বিয়ে খেতে পারব না রে। তার থেকে বরচ আমি নিজের বাসায় দরজা বন্ধ করে বসে থাকব।’
‘বিয়েতে কোন সমস্যা হবে না অনুষ্ঠান যেহেতু হবে। এত মানুষের মধ্যে তোকে লক্ষ্যই করবে না। তুই একটু লুকিয়ে চুরিয়ে থাকলেই হবে।’
দুজনের আলোচনার মাঝে আবার কে যেন দরজা ধাক্কা দিল। আমি ভয় পেয়ে বাথরুমে ভেতরে চলে গেলাম। লিলি দরজা খুলে দেখলো ওর মা এসেছে। ওর মা এসে জানালো ছেলে নাকি মেয়ের সাথে আলাদা কথা বলতে চায়। লিলি কে একা রুমে থাকতে বলল আর ছোঁয়াকে একটু অন্য রুমে যেতে বলল। লিলি চোখটা বড় করে ভাবছে ছোঁয়া তো বের হবে না কিছুতে। এখন কি রুম থেকে বের হবে বের হলেই তো ড্রয়িং রুমে সবার চোখে পড়ে যাবে আর জসিম এদিক মুখ করে বসে আছে।
লিলির মা বলল, ‘কইরে ছোঁয়া কোথায়? আয় ছোঁয়া তুই পাশের রুমে বসবি।’
লিলি আমতা আমতা করে বলল, ‘মা ছোঁয়া না হয় বেলকুনিতে বসে থাকবে। এ রুম থেকে বের হলেই তো ড্রইং গ্রুপের সবার চোখে পড়ে যাবে। আমার রুম একদম ড্রয়িং রুমের কাছাকাছি। রুমটা একদম স্পষ্ট দেখা যায় ড্রয়িং রুম থেকে। ছোঁয়া বারান্দায় বসে থাকবে আর আমরা রুমে কথা বলব সমস্যা হবে না।’
লিলির মা আচ্ছা বলে চলে গেল।
.
লিলি মাথা নিচু করে বসে আছে ওর পাশে বসলো রায়ান।
খুবই কোমল গলায় লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,’কেমন আছো?’
লিলি জড়তা মেশানো গলায় বলল, ‘ জি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’
‘ খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে শাড়িতে।’
প্রশংসা শুনে লিলির মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল।
‘লজ্জা পেলে দেখি আরো সুন্দর লাগে।’
এবার লিলি উঠে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে ফিরে রইল।
রায়ান আর লজ্জা দেওয়ার মত কোন কথাই বলল না শুধু বলল, ‘তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছো?’
লিলি শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে প্যাচাচ্ছে মাথা নিচে করে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছে না যেন ওর। ও তো রাজি আছে কিন্তু সেটা বলতে পারছে না কেন?
‘কিছু তো বলো। হঠাৎ করে আমাকে দেখে নিশ্চয়ই চমকাইছো?’
এবারও লিলি কোন উত্তর দিল না। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। লিলি আরষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচুর অস্বস্তি লাগছে ওর । গলা যেন ভার হয়ে আছে। কোন কথাই বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে আজব। নিজের প্রতি নিজের রাগ হচ্ছে কিন্তু তবুও ফলাফল শূন্য।
এবার রায়ান উঠে দাঁড়িয়ে লিলি সামনে এসে দাঁড়ালো। লিলি মাথা নিচু করে রাখা লজ্জা রাঙা মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা তোমার নীরবতাকে আমি সম্মতি বলে মেনে নিলাম।
বলে রায়ান লিলির শাড়ী পেঁচানো একটা হাত টেনে নিজের হাতে নিল। লিলি আচমকা রায়ানের স্পর্শ পেয়ে থমকে গেল। ওর মনে হলো ওরে হৃদস্পন্দন থেমে গেছে। ও কাপাকাপা চোখে রায়ানের দিকে তাকাল। রায়ান একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিল। ও মুগ্ধ হলো হাসিটা দেখে। রায়ান ওর অনামিকা আঙ্গুলে একটা সুন্দর রিং পরিয়ে দিল। আর ফিসফিস করে বলল, ‘আজ থেকে আমার নামে করে দিলাম তোমাকে। বিয়েটা আজকে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি চাইছি না। আজ এনগেজমেন্ট টাই হোক। এক মাস পর একদম অনুষ্ঠান করে বউ বাসায় তুলবো।’
#চলবে……