অবেলায় এলে তুমি পর্ব-০৩

0
234

#অবেলায়_এলে_তুমি🍁
#পর্ব:৩
#লেখনীতে: তামান্না_ইসলাম_কথা

পশ্চিমা আকাশে লাল কৃষ্ণচূড়ার মতো করে লালাভ ছড়িয়ে হারিয়ে যাচ্ছে সূর্যমামা। পাখিরা নিজ নীড়ে ফিরে চলেছে ডানা ঝাপটে। কর্মস্থল থেকে নিজ বাসভবনের দিকে যাচ্ছে শত শত মানুষজন। গাড়িতে উঠতে না উঠতেই নিরাত্রি ঘুমিয়ে পড়েছে। একবার ড্রাভিং সিটের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোককে দেখে নিলাম। ভদ্রলোকের চোখে মুখে এখনো রাগের ছাপ স্পষ্ট। আগুনে ঘি ঢালার মতো কোনো কিছু না করে চুপচাপ সূর্য অস্ত যাওয়া দেখতে লাগলাম। কিন্তু চুপচাপ থাকা যেনো ভদ্রলোকের সহ্য হলো না।

“এমনিতে মুখ ঠিক চলে কিন্তু যখন মুখ চলার কথা তখনই যেনো মুখে তালা মেরে বসে থাকে। কাজের থেকে অকাজের সময় মুখ ছুটে।”

“কেউ যদি বলতো তার ফুপি চুগলিখোড় তাহলে কি মুখে তালা দিয়ে বসে থাকতাম না কি? এখন যত দোষ নন্দ ঘোষ।”

“বুদ্ধিমানের জন্য ইশারায় যথেষ্ঠ। কিন্তু যারা বুদ্ধি হাঁটুতে নিয়ে চলাফেরা করে তাদের বুঝিয়ে দিলেও কিছু হবে না।”

লোকটার কথা শুনে ইচ্ছে করছে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দিই। আমাকে বলে আমি নাকি হাঁটুতে বুদ্ধি নিয়ে চলাফেরা করি। ভদ্রলোকের কথার বিপরীতে আর কিছু না বলেই চুপচাপ বসে রইলাম। একবার ঠিক মতো বাসায় গিয়ে পৌঁছায় তারপর মজা দেখাবো।

🍁🍁🍁🍁

ভাগ্নি আর ভাগ্নি জামাই আসবে বলে সেই কখন থেকে সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন নৌশাদ সাহেব। ভাগ্নি যে তার বোনের রেখে যাওয়া আমানত। খুব করে চেয়েছিলেন সারাজীবনের জন্য ভাগ্নিকে নিজের কাছেই রেখে দিতে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার হয়তো অন্য কিছুই ইচ্ছে ছিলো। ছেলেটা সেই সুদূর দেশে পড়ে আছে। দেশে আসার কথা বললেও নানান বাহানা দিয়ে কথা পাল্টে ফেলে।

“তুমি সেই কখন থেকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছো। এখানে এসে চুপ করে বসো এবার। সময় হলে তারা আপনাআপনিই চলে আসবে।”

“তুমি একটু চুপ করবে? নিজের কাজ করো গিয়ে। বাসায় নতুন জামাই আসতে চলেছে। আমি যেনো কোনো কিছুর কমতি না দেখি। আর বিয়ের পর এই প্রথম আমার ভাগ্নি আর ভাগ্নি জামাই আসছে বাড়িতে। আমি সব কিছু একদম পারফেক্ট ভাবে দেখতে চাই। আর হ্যাঁ একটা কথা শুনে রাখো, নতুন জামাইয়ের সামনে যদি তুমি তরীকে কোনো অপমান করেছো তাহলে তোমার জন্য ভালো হবে না।”

স্ত্রীর কথায় বিরক্ত হয়ে কথা গুলো বললেন নৌশাদ সাহেব। কিন্তু সালমা বেগম যেনো স্বামীর কথাকে গুরুত্ব দিলেন না। উল্টো মুখ ভেংচে দিলেন।

“দুনিয়াতে মনে হয় উনারই একমাত্র ভাগ্নি আছে। পারবো না আমি কিছু করতে। যতটা করার করে দিয়েছি আমি আর যা করার তোমার ঐ ভাগ্নিকে করে নিতে বলিও।”

“তোমার মতো..! ঐ তো এসে গেছে তরীরা।”

স্ত্রীকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন নৌশাদ সাহেব। কিন্তু সে কথা শেষ করার আগেই গাড়ির শব্দ শুনে বাহিরে চলে গেলেন।

🍁🍁🍁🍁

“মামা!”

রাতের খাবার শেষ করে নিজ রুমে বসে বসে “সোনার তরী” বই পড়ছিলেন নৌশাদ সাহেব। চাকরি থেকে রিটায়ার্ড হওয়ার পর থেকেই রাতের বেলা বই নিয়ে বসে যান। সালমা বেগমের এই নিয়ে অনেক বিরক্ত। সালমা বেগমের ভাষ্যমতে বই পড়ার জন্য সে খিটখিটে হয়ে গেছেন এবং তার দিকে ঠিক ভাবে তাকায় না।

“আরে তরী! আয় ভিতরে আয়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

আমাকে দেখেই মামার হাতে থাকা বইটা এক পাশে রেখে কথা গুলো বললেন। মামার কথা শুনে গুটি গুটি পায়ে ভেতরে গেলাম। । মামার থেকে একটু দূরে বসে আছে মামী। আমাকে দেখেই কেমন জানি তাড়াহুড়ো করে উঠে যেতে লাগলেন। সেটা দেখে আমি মামার পাশে না বসে মামীর পাশে গিয়ে বসলাম।

” মামা তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো।”

“তুই এখানে বস আমি চা করে নিয়ে আসছি। জামাইকে ও দিয়ে আসবো।”

মামীর এহন ব্যবহারে মামা বেশ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর কতটা অবাক হয়েছে সেটা তাঁর চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যেই মামী আমাকে সহ্য করতে পারে না আবার আমার নতুন স্বামী নিয়ে এবাড়িতে আসায় ঠিক করে রান্না পর্যন্ত করেননি সে যাচ্ছে আমাদের জন্য চা করতে? মামীর এমন ভয় পেয়ে যাওয়া দেখে মনে মনে এক পৌচাশিক আনন্দ পাচ্ছিলাম। কিন্তু তার থেকেও বেশি রাগ হচ্ছিল।

“মামী তোমাকে কিছু করতে হবে না। উনি এই সময় চা খাবে না কফি খাবে আর আমি তাকে কফি দিয়ে আসছি। তুমি বসো তোমাদের সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।”

এবার মামীর মুখে ভয়ের ছাপ আগের থেকেও বেড়ে গেলো। আমি একবার মামীর দিকে তাকিয়ে মামার মুখোমুখি হয়ে বসলাম।

“মামা আমি তোমাদের বাড়ি থাকি বলে কি অনেক বড় বোঝা হয়ে যাচ্ছিলাম? তার জন্য তোমরা আমার সাথে এমন প্রতারণা করবে?”

আমার কথা গুলো যেনো মামা বুঝতে পারলো না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।

” জন্মের সময় বাবাকে হারিয়ে মা আমাকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে এসেছিল। কিন্তু মা তোমাদের বাড়িতে থাকলেও আমার আর মায়ের খরচ মা নিজে চালিয়েছে। তোমাদের থেকে কখনো একটা টাকাও নেয়নি। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর থেকে তোমরা আমাকে লালন পালন করে বড় করেছো। কিন্তু আমি একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর থেকে এই বাড়ির সম্পূর্ণ কাজ করে দিয়েছি। মামী কখনো একটা কাজ করেনি। আমার যেই বয়সে ঘুরে ফিরে চলার কথা আমি সেই বয়সে এই বাড়ির প্রতিটি মানুষের জন্য রান্না করে গেছি। তুমি যখন বাসায় না থাকতে একটু কোনো কিছু হলেই মামী আমার গায়ে হাত তুলতে ভুল তো না। মাঝে মাঝে তো মা’কে নিয়েও অনেক কথা বলতো। কখনো সোহেল ভাইয়ার মতো করে একটু আদর করেনি। তবুও আমি চুপ করে ছিলাম কারণ তোমরা ছাড়া আমার আর কেউ নেই।যখন আরেকটু বড় হলাম তখন নিজেরটাও নিজে করতে লাগলাম।
মামা আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। কিন্তু তার মানে এই কি যে, তোমরা আমাকে একটা বিবাহিতা ছেলের সাথে বিয়ে দিবে তাও একটা বারের জন্য আমাকে না জানিয়ে? শুধু বিবাহিত না বরং এক বাচ্চা বাবা সেই কথাও আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না একটা বারের জন্য? আমার জীবনের এতো বড় সিদ্ধান্ত আমি তোমার উপর বিশ্বাস রেখে মেনে নিয়েছিলাম বলেই কি এমন করলে? আমার ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলে? আমি তো সব কিছু জানার অধিকার রাখি তাই না মামা? আমার থেকে এতো বড় সত্যি কেনো লুকিয়ে রাখলে তুমি মামা?”

আমার কথা শুনে মামা একবার মামীর দিকে তো একবার আমার দিকে তাকাতে লাগলো। মামী কোনো কথা না বলে তড়িঘড়ি করতে লাগলো কি ভাবে এখান থেকে বের হওয়া যায়। কিন্তু সে আর কোনো কোল পাচ্ছে না।

“সালমা?”

“আমি বলবো বলবো করেও ভুলে গেয়েছিলাম। আমি ভেবেছি তুমি হয়তো বলেছো। কিন্তু আমি তো জানিনা তুমি বলো নি। আর তরী নিজেও তো কিছু বলেনি। তাই ভেবেছি হয়তো তরীর মত আছে।”

মামা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মামী নিজের সমস্ত দোষ আমার দিকে দিয়ে দিলো। কিন্তু মামা সেই দিকে কান দিলো না।

“একদম মিথ্যে কথা বলবে না তুমি সালমা। আমি তোমাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছি তরী সব কিছু জানে? তরীকে তুমি সব কিছু বলেছো? তরী সব কিছু জেনে বিয়েতে রাজী কি-না? কিন্তু তুমি প্রতিবার উত্তরে কি বলেছিলে? তুমি প্রতিবার আমাকে বলেছিলে তরী সব কিছু জানে। সব কিছু জেনে এই বিয়েতে রাজী হয়েছে। তুমি বলো নি আমাকে এইসব?”

মামী নিজেই যে আমাদের দুজনকে মিথ্যে বলেছে সেটা আমার বা মামার বুঝতে বাকি নেই। ‌

“আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি।”

মামী মামার পাশে গিয়ে হাত ধরে ন্যাকা কান্না করে দিয়ে কথা গুলো বলতে লাগলো।

“তোমার ভুলের জন্য একজন মেয়ের জীবনে কতটা প্রভাব পড়বে সেটা তুমি ভাবলে না? আজকে তোমার জন্য আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। তুমি কী কখনো তরীকে নিজের মেয়ে বলে ভাবতে পারোনি? আজকে তোমার জন্য তরীর জীবনে এতোটা ক্ষতি হলো। আগামীকাল তরীরা চলে যাওয়ার পর তুমি নিজেও এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে। এই বাড়িতে তোমার কোনো জায়গা নেই। তরী মা আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি যদি জানতাম তোকে কিছু জানানো হয়নি তাহলে আমি তোকে সব কিছু আগেই বলে দিতাম। আমার ভুল হয়েছে সালমাকে বিশ্বাস করা। আমার ভুল তো আমি আর এখন শুদ্ররে নিতে পারবো না শুধু বলবো আমাকে ক্ষমা করে দিস।”

প্রথম কথা গুলো মামীর উদ্দেশ্যে বলে শেষ কথা গুলো বলে চোখের পানি মুছে নিলেন। মামার কথার প্রেক্ষিতে আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করলো না না। আর মামীর হয়েও কথা বলতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করলো না।

🍁🍁🍁🍁

“তোমাকে মিথ্যে কথা বলে হয়েছিল? তুমি সব সত্যি জানতে না তরী?”

মামার রুমে থেকে নিজ রুমে আসতেই ভদ্রলোক প্রশ্ন গুলো করলেন। লোকটার কথা শুনে ভাবতাম লাগলাম উনি সব কথা শুনলেন কখন? আমি তো রুম থেকে বের হয়ে কাউকে দেখিনি। তাহলে সে কখন গেলো আর রুমে আসলো কখন?

“নিরাত্রি উঠে গেছে আমাকে একবার ডাকলেন না কেনো? আমাকে ডেকে দিলেই তো চলে আসতাম।”

ভদ্রলোকের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের মতো করে কথা গুলো বলে নিরাত্রিকে কোলে তুলে নিলাম।

“তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দেও তরী। তুমি জানতে না আমার মেয়ে আছে? নিরাত্রির জন্মের সময় অরিত্রি মারা যায় এইসব তুমি কিছু জানতে না?”

“সব কিছু যখন শুনতে পেরেছেন তাহলে আমাকে আবার জিজ্ঞেস করছেন কেনো? ন্যাকা সষ্টি।”

লোকটা কথার প্রতিউত্তরে সহজ ভাবে কেনো জানি উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। সব সময় ত্যাড়া ভাবে কথা বলতে ভালো লাগে।

“একদম আমার সাথে ত্যাড়া ভাবে কথা বলবে না তুমি। স্বামীর সাথে কী ভাবে কথা বলতে হয় জানো না? আর একটা কথা পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি, তুমি যাই সত্যি জানো বা না জানো তোমাকে সারাজীবন আমাদের সাথে থাকতে হবে। আমি নাটকের নায়কদের মত বলতে পারবো না, তুমি যদি বিয়ে যত দিন মন থেকে না মানবে ততদিন তুমি এই বাড়িতে থাকবে। আমি এইসব বলতে পারবো না। আমার মা আর মেয়ের তোমাকে প্রয়োজন। তাই তুমি মানো আর না মানো তোমাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।”

নিজের মতো করে কথা বলে আমার থেকে নিরাত্রিকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।‌ একটা বার আমার কথা শোনার প্রয়োজন মনে করলো না? আর কি বললো আমাকে প্রয়োজন?

“তোমাকে আমাদের সাথে যেতে হবে। মগের মুল্লুক নাকি? যাবো না আমি।”

#চলবে