অবেলায় এলে তুমি পর্ব-০৫

0
183

#অবেলায়_এলে_তুমি
#পর্ব:৫
#লেখনীতে: তামান্না_ইসলাম_কথা

দেখতে দেখতে বিয়ের এক সপ্তাহ হয়ে গেলো। কিন্তু এখনো সম্পর্ক সেই আগের মতই রয়ে গেছে। ঘরের বাইরে পারফেক্ট বিবাহিত দম্পতি কিন্তু ঘরের ভিতরে সেই আগের মতই সম্পর্ক বিঃদ্রঃ মান। না তো সে স্বামীর অধিকার নিয়ে আমার কাছে আসে আর না তো আমি স্ত্রীর অধিকার নিয়ে তার কাছে যায়। ভদ্রলোককে কিছু বললে শুধু হুঁ, হাঁ, বলেই কথা শেষ। ভদ্রলোক নিজে বলে না সে বিয়ে মানে কি মানে না। শুধু তার একটাই কথা “আমার মেয়ে এবং মায়ের জন্য তোমাকে প্রয়োজন।” তার এই প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে আর কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। সেই দিন সব সত্যি জানার পর থেকেই যেনো ভদ্রলোক আগের থেকে বেশি গম্ভীর হয়ে গেছে। শাশুড়ি মা নিজেও ছেলেকে বুঝিয়েছে। এতে তাদের কোনো দোষ নেই তারা তো সব সত্যি বলেই ছিল কিন্তু আমার পরিবার মিথ্যে কথা বলেছে। কিন্তু আমার সেই সবে কোনো মাথাব্যথা নেই এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলো কিন্তু আমাকে কেউ এখনো অরিত্রির সম্পর্কে কিছু সঠিক করে বললো না আর না তো কোনো ছবি দেখতে পেলাম। মনে মনে ঠিক করলাম বাসায় গিয়েই আজকে ছবি খোঁজার মিশন শুরু করবো।

“আরে এই তরী!”

ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরছিলাম রাস্তার কিনারে দিয়ে। আজকে তিথি, দিয়া, রিমু,তায়াস, তন্ময় কেউ আসেনি। গত এক সপ্তাহ ধরে কারো সাথে যোগাযোগ নেই। সেই যে ফোন অফ করে রেখেছি। আসার আগে একবার ফোন করে আসলে ভালো হতো। কিন্তু ফোন করে না আসায় এখন মন মরা হয়ে রাস্তার কিনারে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজ গন্তব্যে ফিরছিলাম। কিন্তু কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকতেই সেখানে থেমে গেলাম। আশেপাশে দেখতে লাগলাম কে ডাকছে। কিন্তু রোদের এতো তেজ যে ঠিক ভাবে তাকানো যাচ্ছে না।

” কেমন আছো?”

লোকটা সামনে আসতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। প্রায় পাঁচ বছর পর আবার আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যখন আমি মাত্র দশম শ্রেণীতে উঠি তখন কোনো এক কারণে লোকটা কাউকে কিছু না বলেই নানু বাড়ি থেকেই লন্ডন পাড়ি জমিয়েছে বলে সবাইকে জানানো হয়। মামা মামী কেউ জানতো না তার এমন সিদ্ধান্তের কথা।
সোহেল ভাইয়ার যখন পনেরো বছর বয়স তখন মামী ভাইয়াকে তার নানু বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। মামা যদিও দিতে রাজি ছিলেন না কিন্তু স্ত্রীর জেদের কাছে হার মেনে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল। এরপর কয়েক বার এসেছিল কিন্তু শেষ বার এসেছিল যখন আমি দশম শ্রেণীতে ছিলাম। আর তখন সে লন্ডন চলে যায়। এরপর আর তাকে দেখিনি যদিও মামা মামীর সাথে কথা বলার সময় ফোনে আমার সাথেও কথা হয়েছে কয়েক বার। কিন্তু মামা আর মামী ভাইয়া এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মামী দুই মাস কথা বলেননি অভিমান করে মামাও ছেলের প্রতি রাগ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে ঠিক কথা বলেছে। ছেলের উপর আর কতদিন অভিমান করে থাকা যায়?

“ভাইয়া আপনি?”

সোহেল ভাইয়া আমার সামনে এসে দাঁড়াতেই তাকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।

“হ্যাঁ! আমি। এতো অবাক হয়ে যাচ্ছো কেন?”

“না মানে! আসলে এতো গুলো বছর পর দেখছি তো তাও আবার এখানে তাই অবাক হয়ে গেলাম।”

সৌজনের খাতিরে ভাইয়ার কথার উত্তর হাসি মুখে দিলাম। ভাইয়ার কেমন করে জানি তাকিয়ে আছে যা আমাকে অস্তিত্বে ফেলে দিচ্ছে। মানুষ নিজ দেশে রেখে অন্য দেশে গেলেই কি তাদের দেখার ধরণ পরিবর্তন হয়ে যায় না কি?

“হ্যাঁ! প্রায় পাঁচ বছর পর দেখা হচ্ছে। তা এই রোদের মধ্যে রিকশায় না গিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছো কেন? চলো রিকশায় উঠে বসো। এক সাথে বাসায় ফেরা যাবে।”

” ভাইয়া আমি ওবাড়ি যাচ্ছি না। আমি আমার শশুর বাড়ি যাচ্ছি। আপনি বরং একাই চলে যান।”

ভাইয়ার কথায় তাড়াতাড়ি করে উত্তর দিলাম। মামীকে মামা আর বাপের বাড়ি পাঠায়নি। আমিই না করেছিলাম। মামী চলে গেলে মামা বাসায় একা পড়ে যাবে যার জন্য মামাকে বুঝিয়ে মামীর যাওয়া বন্ধ করা হয়।
আমার কথা শুনে এবার ভাইয়া আমাকে ভালো করে লক্ষ্য করলেন। যেনো এতো সময় আমাকে দেখেনি।

” মানে? তোমার বিয়ে হলো আর আমি কিছু জানলাম না? সেই ছোট তরীর না কি বিয়ে হয়ে গেছে? আর এই শাড়ি পড়ার কারণ বুঝি বিয়ের জন্য?”

“ভাইয়া আপনার মতো তো আমি বিদেশে বড় হয়নি তাই আপনার মতো এমন পোশাক পড়ে বাসা থেকে বের হয় না। আমরা বাঙালী। পুরুষরা লুঙ্গি আর নারীরা শাড়িতেই পরিচয়। একটা কথা আছে জানে? শাড়িতেই নারী। আপনার মতো বিদেশি কালচারে অভ্যস্ত এখনো হতে পারিনি। আর হতে পারলেও আমি শাড়িতেই পারফেক্ট আছি। বিদেশি পোশাক পড়ার প্রয়োজন নেই।”

“তুমি আমাকে অপমান করছো তরী। আর আমি বিদেশে বড় হয়েছি সেখানে এইসব পোশাক নরমাল। আর কি গরম দেখেছো তুমি?”

“মূর্খের সাথে কথা বলে মূর্খতার পরিচয় দিতে চাচ্ছি না। ভালো থাকবেন।”

ভাইয়াকে কথা গুলোই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশায় উঠে বসলাম। আর এক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো আমি আরো কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিয়ে আসতাম। কিন্তু তার চাহনি বারবার আমাকে অস্তিত্বে ফেলে দিচ্ছিল। কেমন কামুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।

🍁🍁🍁🍁

ধরুণীর বুকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কিন্তু এখনো আলো বিদ্যমান। আকাশটা দেখতে বড্ড বেশি সুন্দর লাগছে। ভদ্রলোক বাসায় ফিরেছেন ঘন্টা খানেক আগে। তবে কিছু একটা নিয়ে হয়তো রেগেও আছেন। তাই কিছু না বলে নিরাত্রিকে আম্মার কাছে দিয়ে আমি ছাদে চলে আসি।

“গাছে পানি দিচ্ছো না কি এবার ঘরে পানি যাওয়ার ব্যবস্থা করছো?”

ফুল গাছ গুলো রোদে কেমন নেতিয়ে গেছে। সেই গাছ গুলোতেই পানি দিচ্ছিলাম । কিন্তু আনমনা হয়ে আকাশ দেখছিলাম আর পানির পাইপ যে কখন ছাদের দরজার কাছে চলে গেছে জানা ছিল না আর ভদ্রলোক নিজেই কখন এসেছে তাও খেয়াল নেই।। ভদ্রলোকের কথাতে ভাবনার ছেদ ঘটে। তাড়াতাড়ি করে দরজার সামনে থেকে পাইপ সরাতে গিয়ে সেটা গিয়ে পড়লো ভদ্রলোকের উপর।

“তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে তরী? এই ভরসন্ধেয় তুমি এইটা কি করলে? দেখে শুনে কাজ করতে পারো না? যত সব বাচ্চামু। এইটা কি বাচ্চামু করার বয়স? কাজ করার সময় মন কোথায় থাকে? বাহিরের মানুষের সামনে কথা বলার সময় তো ঠিক হেসে খেলে দুলতে দুলতে কথা বলতে পারো। আর কাজের সময় মন থাকে না? যতসব আজাইরা।”

সামান্য একটু পানি যাওয়ায় নিজের মতো করে আমাকে কথা শুনিয়ে ভদ্রলোক নিচে চলে গেলেন। একটা বার আমাকে কথা বলতে দিলো না। কিন্তু আজকে ভদ্রলোকের ব্যবহার, কথা বলার ধরণ অন্য রকম ছিল। মানছি ভুল করেছি তাই বলে এমন ব্যবহার করবে? মন খারাপ নিয়েই পাইপ রেখে নিচে নেমে গেলাম।
মেয়েরা কোথাও আসলে নিজের সঠিক সম্মান পাই না। যদি বলা হয় বাপের বাড়ি পাওয়া যায় তবুও ভুল। কোনো না কোনো ভাবে তাদের কাছেও একসময় বোঝা হয়ে উঠে। আর স্বামীর বাড়ি তৌ ও সম্পূর্ণ আলাদা। সামান্য একটু ভুল হলেই শুনতে হয় হাজার কথা। শুধু কী নিজেকে শুনতে হয়? উঁহু! মা-বাবাকেও শুনতে হয় হাজার কথা। অবহেলিত হতে হয় সবসময়।

“আম্মা!”

“আরে ওখানে দাঁড়িয়ে কেনো ভিতরে আসো।”

নিরাত্রিকে নিয়ে গল্প করছিলেন তিনি। আমার ডাকে হাসি মুখে ভিতরে প্রবেশ করতে বললেন তিনি।

“আম্মা আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।”

আমার কথা শুনে ব্রু জোগলের মাঝে কিংচিত ভাঁজ ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

“কি হয়েছে তরী? তোমার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে কেনো?”

“কিছু না আম্মা। আপনি আমার কথাটা শুনোন একটু। খুব ইম্পর্ট্যান্টে কথা আম্মা।”

কথাটা বলেই আম্মাকে সব কিছু বলে নিয়ে নিরাত্রিকে কোলে তুলে নিলাম।

🍁🍁🍁🍁

“তরী কে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না নিহান।”

#চলবে