#অবেলায়_এলে_তুমি🍁
#পর্ব:১৪
#লেখনীতে: তামান্না_ইসলাম_কথা
হসপিটাল থেকে বের হয়ে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একের পর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছে নিহান। মাথায় হাজার প্রশ্নের ছড়াছড়ি। কিন্তু উত্তর কোথাও নেই। মেয়েটাকে হুট করে এভাবে বাড়িতে নিয়ে আসাও উচিত হয়নি। কিন্তু নিহান যে অপরিচিত একটা মেয়েকে খুব সহজেই বাড়িতে নিয়ে নিবে না। নিজের কাজ কি ভাবে করতে হয় সেটা নিহান জানে। কিন্তু কোথা থেকে সব কিছু শুরু করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিছু একটা মনে হতেই আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে বাম হাতে দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোন দিলো। কয়েক বার রিং হয়ে ফোন কেটে গেলো। অপর পাশের মানুষের কোনো খবর নেই। আবারো ফোন দিতেই দুবার রিং হতেই ফোন রিসিভ করে।
” স্টুপিড কোথায় থাকো তুমি? আর ফোন রেখে কোথায় থাকে? ফোন করছি কানে শুনতে পারো না? তোমাকে আমি কখনো ঠিক করে ফোন করলে পাওয়া যায় না।”
অপর পাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই বিরক্ত হয়ে কথাটা বললো নিহান। অপর পাশের লোকটিও নিহানের এমন কথায় বিরক্ত হলো। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে আবারো কথা বলতে লাগলো।
“স্যরি স্যার আমি আসলে! ঐ একটু!”
” এমন আমতা আমতা না করে ঠিক করে কথা বল রিশাদ। তুই কিন্তু খুব ভালো করে জানিস আমি এমন করে কথা বলা পছন্দ করি না।”
” চুপ কর শালা! তোর জন্য কি এখন আমি এখন ওয়াশরুমে ফোন নিয়ে যাবো?”
দিগুন বিরক্ত হয়ে কথা গুলো বললো রিশাদ। এতে নিহানের কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। সে এখনো হাতের সিগারেটে ফুঁক দিয়ে সে-ই নিকোটিনের ধোঁয়া আকাশের দিকে দিচ্ছে।
” দরকার হলে তাই করবি। এখন আমাকে বল কাজ কত দূর পর্যন্ত এগিয়েছে? কিছু কি জানতে পেরেছিস?”
” তুই তো বলেছিলি মেয়েটা অন্যের বাড়িতে কাজ করে কিন্তু তার পোশাক দেখে তো আমার সেটা মনে হলো না।”
“এইসব কথা না বলে মেইন কথা বল। মেয়েটার কথা শুনে আমার প্রথমেই খটকা লেগেছিল। কোনো অশিক্ষিত, বস্তির মেয়ে এতো শুদ্ধ করে কথা বলতে পারে না। বস্তি এবং অশিক্ষিত মানুষের কথার ধরণ অন্য রকম হয়ে যায়। তারা যতই শুদ্ধ ভাবে কথা বলার চেষ্টা করুক না কেনো কোনো না কোনো ভাবে তাদের কথার মাঝে অশিক্ষিত হওয়ার প্রমাণ থাকে।”
” তোর বাড়ি থেকে বের হয়ে মেয়েটা অনেক সময় বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু যখন পর পর দুই বাস যখন চলে যাওয়ার পরেও মেয়েটা বাসে না উঠে দাঁড়িয়ে ছিলো তখন সন্দেহ হয়। আর তার ঠিক কিছু সময় পর মেয়েটার পাশে একটা গাড়ি এসে থামতেই সেটাই উঠে পড়ে। আর মোস্ট ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে গাড়িতে কোনো নাম্বার ছিল না।”
রিশাদের কথা শেষ হতেই নিহান ভাবনায় পড়ে গেলো। যেই বা যারা এই গেইম খেলছে সে খুব চতুর এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই মেয়েটার সম্পর্কে আগে সব কিছু জানা প্রয়োজন।
” রিশাদ তুই মেয়েটার খুঁজ খবর কালেক্ট কর। দুদিনের ভিতরে আমার মেয়েটার সম্পর্কে সব কিছু জানা চাই। বাকিটা আমি সামলে নিবো।”
কথাটা বলেই ফোন কেটে দিল নিহান। মেয়েটা আরো কিছু করার আগে সব কিছু জানা প্রয়োজন। কিন্তু কোনো ক্লো পাওয়া যাচ্ছে না। যাও একটা পাওয়া যাচ্ছে সব কিছু মিলিয়ে নিতে গেলে শেষ পর্যন্ত সে-ই একই জায়গায় ফিরে আসতে হচ্ছে। সিগারেট খাওয়া শেষ মুখে একটা চুইংগাম দিয়ে চিবুতে চিবুতে হসপিটালের ভিতরে চলে গেল।
🍁🍁🍁🍁
সকাল আটটা। “সুখবিন্দর নিবাস” এর সামনে হলুদ রঙের শাড়ি দিয়ে মুখ খানিকটা ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। সেই চিরচেনা বাড়ির সামনে আবারো এসে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির প্রতিটি মানুষের সাথে তার গভীর সম্পর্ক। নিজের হাতে সাজিয়ে তুলেছিল ঘরের প্রতিটি কোণায়। নিহান যাকে চোখে হারাত। আর রৌশানা বেগম নিজের ছেলের থেকেও বেশি আদর করতো, ভালোবাসতো। সব কিছু মনে হতেই মেয়েটির চোখে মুখে খেলা করছে হাজার খুশির ঝলক। কিন্তু কিছু একটা মনে হতেই মূহুর্তে সেই হাসি মুখে কঠিনতার ছাপ ছেয়ে গেলে। চোখ মুখ হয়ে উঠে হিংস্র।
” আমার সুখ, আমার পরিবার, আমার ভালোবাসা সব কিছু কেড়ে নিয়েছিল তুমি নিহান। আমার কানে বাজে কী ভাবে আমার বোনকে তুমি তিলে তিলে শেষ করেছো। তোমার জন্য আমার বাবা রাস্তায় বসে গিয়েছিল। শুধু মাত্র তোমার জন্য নিজের পরিবার থেকেও আমি তাদের থেকে দূরে ছিলাম। তোমার উল্টো দিন গুনা শুরু করে দাও। তোমার জীবনকে আমি নরক করে তুলবো। তোমার জন্য আমি সব হারিয়েছি। এবার তোমার হারানোর পালা।”
কথা গুলো বলে আরেকবার বাড়িটার দিকে তাকিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়িটা দেখতে লাগলো।
” এই মাইয়া তুমি এইহানে খাড়িয়া, খাড়িয়া (দাঁড়িয়ে) কি করতেছো? যাও এহান থ্যেইক্কা। মেলাক্ষণ(অনেক সময়) ধইরা দেখতেছি তুমি এই বাড়ির দিকে চাইয়া (তাকিয়ে) রইছো। যাও এহান থ্যেইক্কা কইতাছি।যাও!”
অনেক সময় ধরে মেয়েটাকে এক জায়গায় লক্ষ্য করছিল দারোয়ান খালেক মিয়া। বারবার বাড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে বিরবির করতে দেখে গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে কথা গুলো বললেন তিনি। মেয়েটা কিছু না বলে দারোয়ানের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে সেখান থেকে চলে যায়।
মেয়েটা চলে যাওয়ার পনেরো বিশ মিনিট পর নিহান বাড়ি ফিরে সবাইকে নিয়ে। নিরাত্রির বাকি চিকিৎসা বাড়ি থেকেই করাবে নিহান। নিহানের এমন হুটহাট সিদ্ধান্ত আমাকে বরাবর অবাক করলেও কিছু বলার অবকাশ নেই। তাই চুপ থাকাই শ্রেয়।
” খালা ঐশী কোথায়? তাকে বলো নিরাত্রির জন্য পানি গরম করতে। আর তুমি একটু সবজি গুলো কেটে রাখো আমি ফ্রেশ হয়ে এসে রান্না করবো।”
” ঐ মাইয়া তো বাড়িতে নাই। রাইতে যে বাড়ি থেকে বাইরে গেছে এখনো আহে (আসে) নাই।”
বাড়ি ফিরে নিরাত্রিকে শুয়ে দিয়ে কাজের খালাকে কথা গুলো বলে আবারও রুমের দিকে যেতেই খালার কথা গুলো শুনে থেমে গেলাম। গতকাল রাত থেকে বাড়িতে নেই মানে কি? এতো বড় কাহিনী হয়ে যাওয়ার পর মেয়েটা বাড়িতে নেই? ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলো?
“বাড়িতে নেই মানে কী খালা? সে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় তোমাকে কিছু বলে যায়নি? আর গতকাল রাত থেকে বাড়িতে ফিরেনি এইটা কেমন কথা? কোনো বিপদ হলো না তো?”
” আমি জিগাইছিলাম ( জিজ্ঞেস করা) এতো রাইতে কনে যাইতেছো? কিন্তু হেই মাইয়া তো আমারে কিছু বলেই নাই-ই আবার আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছিলো। কেমন অসভ্য মাইয়া তুমি ভাবো। আমি ওর মায়ের বয়সী একজন মানুষ হইয়া কথাখান জিগাইছি আমারে উত্তর না দিয়া চোখ দিয়া শাসিয়া (চোখ রাঙানো) গেলো।”
খালাকে প্রশ্ন গুলো করতেই এতো গুলো কথা বলে দিলেন তিনি। এই মেয়েটা আমাকে আবার নতুন কোন চিন্তায় ফেলে দিয়ে চলে গেলো। এর কিছু হলে আমি এর পরিবারকে কি ভাবে উত্তর দিবো। সব কিছু ভাবতেই মাথা ঘুরাতে শুরু করে দিল। খালাকে কোনো রকম আজকে রান্না করে নিতে বলে আমি রুমের দিকে চলে গেলাম।
🍁🍁🍁🍁
আজ অনেক দিন পর মনে হলো আমি এখনো অরিত্রির কোনো ছবি দেখিনি নিহানের রুমে। শুধু নিহান না বরং এই বাড়ির কোথাও আমি দেখিনি। এর মাঝে যদিও ভুল ছিলো যে, আমি এই বাড়ির প্রতিটি রুম দেখিনি। তাই আজকে ঠিক করলাম অরিত্রির কথা জিজ্ঞেস করবো। কিন্তু বর মহাশয়কে জিজ্ঞেস করা যাবে না এখন। কিছু বললেই পুরানো ঘাতে আবারো আঁচড় কাটবে। তাই আর কিছু না ভেবে আমি শাশুড়ি আম্মার রুমের দিকে চলে গেলাম। শাশুড়ির রুমের সামনে যেতেই অবাক হয়ে গেলাম। রুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। আম্মা যে কখনো রুম ভেতর থেকে বন্ধ করে না এইটা আমি জানি। তাহলে আজকে হঠাৎ করে ভিতর থেকে বন্ধ করার কারণ দেখছি না। যার জন্য অবাক না হয়ে পারলাম না।
“তুমি এখানে কী করছো তরী?”
আম্মার রুমে নক করতে যেতেই নিহান পিছন থেকে এসে কথা গুলো বলতেই চমকে উঠলাম।
” না মানে আম্মার সাথে একটু কথা বলার ছিলো। কিন্তু আম্মার রুম ভিতর থেকে লক করা মনে হচ্ছে।”
কথাটা বলে আবারও রুমে নক করতে যাবো তার আগেই লোকটা পিছন থেকে আবারো আটকে দিলো।
“তোমাকে আমি নিরাত্রির কাছে থাকতে বলেছি তরী। তুমি ওর কাছে যাও। আমি আম্মাকে তোমার কাছে যেতে বলবোনি। আর শুনো আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি আগামীকাল ফিরে আসবো। তুমি নিজের আর বাকি সবার খেয়াল রেখো।’
গালে হাত রেখে কথা গুলো বলে কপালে চুমু দিয়ে একে দিলো। স্থানভেদ না দেখে লোকটার এমন স্বভাবের জন্য কবে জানি আমি লজ্জায় শেষ হয়ে যায়। লোকটার কথা মতো আর কিছু না বলে শাশুড়ি আম্মার রুমে না গিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলাম।
#চলবে