অব্যক্ত প্রিয়তমা পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
324

#অব্যক্ত_প্রিয়তমা
#ফাতেমা_তুজ
#part_13+14+15

হঠাৎ করেই ঝড়ো হাওয়ার উৎপত্তি ঘটে। নির্ভীকের ঘোর ভাঙে মেঘের গর্জনে। অনিন্দিতা এখনো জড়িয়ে আছে তাকে। নির্ভীকের অন্তকর্নে ব্যথা অনুভব হয়। গুটিয়ে রাখা হাত টা সন্তর্পণে অনিন্দিতার বাহু তে স্পর্শ করে। অনিন্দিতার চোখের পানি তে শার্টের এক অংশ ভিজে গেছে। পাতলা শার্ট ভেদ করে সে অশ্রু কনা নির্ভীকের বুকে এসে লাগছে। শীতলায় নেমে আসে সে স্থান। নির্ভীকের শরীর কেমন কাঁপছে। অনিন্দিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
” এভাবে আর কতোক্ষন থাকবেন অনিন্দিতা ? এটা ঠিক হচ্ছে না। এবার ছাড়ুন বাসায় ফিরতে হবে। ”

” সারা জীবন থাকতে দিবেন নির্ভীক ভাই ? কেন এতো ভালোবাসি আপনাকে। আমি কেন এমন অগোছালো হয়ে গেলাম। আমি কি এমন ছিলাম ?”

” সেটাই তো আপনি তো এমন ছিলেন না। ফুটফুটে বাচ্চা একটা মেয়ে সে প্রেমের সংলাপ আওড়াচ্ছে। পাগল পাগল মনোভাবে জীবন রাঙাচ্ছে। আপনাকে এগিয়ে যেতে হবে অনিন্দিতা। এভাবে পিছিয়ে কেন যাচ্ছেন? ”

” জানি না আমি। তবে আজকের মতো সুখ আমি কখনো অনুভব করি নি। এই বুকে মাথা রাখার লোভ আমি কি করে সামলাই বলুন তো। পারবো না আমি , বড্ড কঠিন কাজ। ”

” অনিন্দিতা ঝড় হতে পারে। দ্রুত আসুন, আমার অস্বস্তি হচ্ছে। ”

কথা টা বলেই নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় নির্ভীক ।অনিন্দিতার দু চোখে পানি চিক চিক করছে। অধর কোনে হাসি ফুঁটিয়ে অশ্রু মুছে দিয়ে নির্ভীক বলে
” হাসি খুশি থাকবেন। আপনার স্বপ্ন ছিলো আমার বুকে মাথা রাখা। পূরন করে দিয়েছি আর এমন অনৈতিক কাজ কখনো করবেন না। ”

অনিন্দিতা উত্তর দেয় না। নির্ভীকের সাথে গাড়ি তে উঠে বসে। নির্ভীক মানুষটার মাঝে আলাদা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে কি নির্ভীক তাঁর অনুভূতি কে উপলব্ধি করছে। চোখ চক চক করে তাঁর।এক পলক তাকায় সে। নির্ভীকের চোখে মুখে প্রশান্তির রেখা। এ যেন ভিন্ন এক ব্যক্তি। অনিন্দিতা আবার জড়িয়ে ধরে নির্ভীক কে। নির্ভীক বলে
” ভালোবেসে পাগল হয়ে গেলেন অনিন্দিতা ? পাগলামোর নাম ই বুঝি ভালোবাসা । ”

মেয়েটার দু চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে। অনিন্দিতার উত্তর না পেয়ে থম মেরে যায় নির্ভীক। পিঠময় ছড়িয়ে রাখা চুল গুলো আলতো উড়ছে। কিছু টা চুল নির্ভীকের চোখে মুখে এসে লাগে। যার ফলে বিরক্ত হয় নির্ভীক। অনিন্দিতার অবাধ্য চুল গুলো সন্তপর্নে ছড়িয়ে দেয়। হালকা হাতে অনিন্দিতার বাহু জড়িয়ে ধরে। পর পর কয়েকটা শ্বাস ফেলে আদুরে গলায় উচ্চারন করে
” অনিন্দিতা। এই অনিন্দিতা, কেন পাগলামি করছেন বলুন তো। কেন এ অন্যায় কার্যে আমি সায় দিচ্ছি। আপনাকে সরাতে পারছি না কেন ? ”

” এটা কি স্বপ্ন নির্ভীক ভাই ? আমি সত্যি আপনাকে স্পর্শ করেছি। যদি স্বপ্ন হয় তাহলে আমি বলবো এই স্বপ্ন থমকে যাক।”

” থমকে গেলে নির্ভীক মাহতাব আপনার হয়ে যাবে ? ”

” চাই না আমি নির্ভীক কে। আমি জানি না কে নির্ভীক। আমি শুধু আপনাকে চিনি, আপনাকেই ভালোবাসি। আমার বেদনা কেন আপনাকে কাঁদায় না নির্ভীক ভাই ? কেন ভালোবাসেন না আমায় । ”

” ভালোবাসা ! আমি তো বুঝি না ভালোবাসা কি। আমি জানি না সে অনুভূতির রেখা। আপনি আমাকে কাছাকাছি টেনে উচিত করলেন না অনিন্দিতা। আমি অন্যায় করে বসলে সৃষ্টিকর্তা আমায় ক্ষমা করবেন না। এমনি তেই পাপ হয়ে গেছে। ছাড়ুন অনিন্দিতা, ভুলে যান এই যন্ত্র মানব কে। নির্ভীক কে ভালোবেসে শুধুই কষ্ট পাবেন। আমাকে দোষী বানাবেন না । ”

অনিন্দিতা চোখ মুছে। নির্ভীক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। সোডিয়ামের মৃদু আলো তে বিন্দু বিন্দু জমে থাকা অশ্রু কনা যেন এক টুকরো মুক্তোর মালা। ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি ফুটে। অনিন্দিতার মায়াবী মুখের দিকে পলক হীন তাকায় নির্ভীক। অনিন্দিতার সাথে চোখাচোখি হয় তবে চোখ সরায় না। আবারো ডুকরে কেঁদে উঠে মেয়েটা। নাক টেনে বলে
” আমি অনেক দূরে কেন চলে যাচ্ছি না ? বলুন না। আমি দূরে কেন চলে যাচ্ছি না। দূরে চলে গেলে আমাকে মনে পরবে তো নির্ভীক ভাই ? ”

” পরবে না। আপনাকে মনে কেন পরবে বলুন তো ? এই যে পাঁচ টে বছর ধরে দহন দিয়ে যাচ্ছেন। এর জন্য আপনাকে মনে পরবে না আমার। আজকের কথা ভুলে যাবেন অনিন্দিতা। এ প্রহর বিষাক্তময় কিছু স্মৃতি। না আপনি না আমি কেউ ই উচিত করি নি। এ পাপের শাস্তি স্বরূপ সারা জীবন অনুশোচনা না করতে হয়।অনুশোচনা ভালো নয়।কারন
” মানসিক অশান্তির থেকে বড় শাস্তি বোধহয় কিছু নেই”

.

হলুদের অনুষ্ঠানে যায় নি অনিন্দিতা। শরীর খারাপের অজুহাত দিয়েছে। আসিম বুঝতে পেরেছে বিষয় টা। তবে বার বার করে বলেছে যাতে বিয়ে তে আসে। উপায় না পেয়ে অনিন্দিতা আসবে বলেছে। আর
বিয়ের দিন সকালেই নির্ভীকের সাথে চলে এসেছে। রাস্তায় একটা কথা ও হয় নি দুজনের। তবে একটু আগে নির্ভীক বলে গেছে যাতে গেট ধরতে যায় অনিন্দিতা। প্রচন্ড অবাক হয়েছে অনিন্দিতা। নির্ভীকের কিছু আচারন তাঁকে অবাক করে। মানুষ কতোটা রহস্যময় হতে পারে তা নির্ভীক কে না দেখলে বুঝতেই পারতো না। নিজের ভাবনার ছেদ কাঁটে আসিমের ডাকে। প্রচন্ড ব্যস্ত সময় পার করছে আসিম। এক মাত্র বোনের বিয়ে ব্যস্ত তো হতেই হবে। অনিন্দিতার উত্তর না পেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পরে আসিম। অনিন্দিতা প্রশ্ন নিয়ে তাকাতেই আসিম বলে
” তোমার মন খারাপ হওয়া টা স্বাভাবিক। তবে সকলের মন খারাপ করে দেওয়া টা ভীষন অস্বাভাবিক। ”

” মানে ? ”

” তুমি না গেলে আমি ও যাবো না। তোমাকে এভাবে মন খারাপ হয়ে বসে থাকতে দেখে আমি কি মজা করতে পারবো ? ”

আসিমের দিকে তাকায় অনিন্দিতা। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটিয়ে বলে
” আচ্ছা আসো। ”

আসিমের সাথে গেটে চলে আসে অনিন্দিতা। একটু দূরে কারো সাথে কথা বলছে নির্ভীক। মানুষটা কে নীল ব্লেজারে খুব সুন্দর লাগছে। নিষ্পলক তাকায় অনিন্দিতা। কালো চোখের মনি তে নীল রঙ যেন গেঁথে গেছে। নির্ভীকের মায়া ভরা দৃষ্টি আর আত্মা কাঁপানো হাসি যে মাতোয়ারা সে। কখন যে বর এসে পরেছে তাঁর খেয়াল ই নেই। খ্যাক করে কাশে নির্ভীক। হতচকিয়ে যায় অনিন্দিতা । তুতলিয়ে বলে
” জি ”

” সামনের দিকে আসুন। এভাবে তাকিয়ে থাকলে অন্যরা বাজে ভাববে। ”

মাথা ঝাঁকায় অনিন্দিতা। নির্ভীক তাঁর হাত চেপে ধরে। অবাক চোখে তাকায় মেয়েটা। ভীর ঠেলে অনিন্দিতা কে নিয়ে একদম কাছে চলে আসে। অনিন্দিতার দৃষ্টি নির্ভীকের দিকে। নির্ভীক আবারো কাশে , তবু ও চোখ সরায় না অনিন্দিতা। উপায় না পেয়ে বাহু তে হাত রাখে নির্ভীক। আশে পাশে ছেলে মানুষের অভাব নেই। একটু ঝুঁকে বলে
” অনিন্দিতা নিজেকে অন্তত সামলান। আশে পাশে পুরুষ মানুষের সমাগম।”

” আপনি আছেন তো ? ”

” আমি থাকলেই বা কি বলুন তো ! ”

” পুরো পৃথিবী থমকে যায়। ”

কথা বাড়ায় না নির্ভীক। মেয়েটা কে হাসি খুশি রাখার জন্য সামনের দিকে নিয়ে আসলো আর হচ্ছে উল্টো। অতিরিক্ত নির্ভর হয়ে গেছে সে। নির্ভীকের অন্তকর্নে দীর্ঘশ্বাস জমে। এক পলক তাকায় অনিন্দিতার দিকে। প্রচুর হৈ হুল্লর হতে থাকে। ভীরের মাঝে নির্ভীক কে খিচে ধরে রাখে অনিন্দিতা । যেন ছেড়ে দিলেই পাখির মতো উড়ে যাবে। না হয় চাঁদের মতো দিনের আশো তে মিলিয়ে যাবে।
.

নির্ভীকের কেয়ার পেয়ে অনিন্দিতার মনে ফুল ফুটে। নির্ভীক এই প্রথম তার প্রতি এতো টা যত্ন শীল হয়েছে। না হয় সব সময় তুচ্ছ করেই গিয়েছে। মেহেরিমার পাশে বসে আছে অনিন্দিতা। বিয়ের লেখালেখি চলছে। বউ সাজে অপরূপ লাগছে মেহেরিমা কে। কথায় আছে বিয়ের কোনে সব সময় ই সুন্দর। তাই হয়তো অনিন্দিতার থেকেও মেহেরিমা কে বেশি সুন্দর লাগছে। আসিম নিজের পার্সোনাল ক্যামেরা দিয়ে ফটো শুট করছে। সবার সাথে ছবি তুললে ও অনিন্দিতার সাথে ছবি তোলা হয় নি। মেহেরিমা বলে
” এদিকে আসো অনিন্দিতা। তোমার সাথে একটা ও ছবি তোলা হয় নি। ”

” না ম্যাম আমি ঠিক আছি। ”

” এদিকে আসো বলছি। ”

কথাটা রাগি দৃষ্টি তেই বলে মেহেরিমা।মাথা টা নিচু করে মেহেরিমার কাছে আসে অনিন্দিতা। আসিম বলে
” অনি কে বউ সাজালে কেমন হয় বলো তো ? ”

” কেন তোর বউ বানাবি নাকি ? ”

মেহেরিমার কথাতে সকলে হেসে উঠে লজ্জায় পরে অনিন্দিতা। আসিমের মুখে মেকি হাসি। অনিন্দিতা কে ইশারায় কাছে ডাকে। অনিন্দিতা কাছে আসতেই বলে
” নির্ভীক স্যারের বউ বানাবো। আর আমি হবো দুশমন। ”

” আজব কথা বললে তুমি। দুটোর কোনো টাই হবে না। ”

” হাল ছেড়ো না অনি। তোমার বিধ্বস্ত হওয়া মুখ আমার সহ্য হয় না। ”

কথা টা বলেই ফোঁস করে দম ফেলে আসিম। অশ্রু তে ভরে উঠেছে অনিন্দিতার মুখ। আসিমের মায়া হয়।এতো ভালোবাসার পর ও অনিন্দিতা অসহায় । এমন একজন কে ভালোবাসে যে তাকে সহ্য করতেই পারে না।

কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করে। একটু দূরে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে নির্ভীক। অনিন্দিতার দৃষ্টি মৃত। নির্ভীকের নিষ্পলক চাহনি দেখে আসিম অবাক হয়। এ দৃষ্টি তে কিছু একটা লুকিয়ে আছে। সে এগিয়ে যায় , নির্ভীকের কাছে এসে বলে
” ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা হয় স্যার ? ”

” উহুহ হয় না, আবার হয় ওহ। আমরা মানুষ রাই সব দিক লক্ষ্য করি। তাই তো অনেকেই খুব সুন্দর করে ভালোবাসার সংজ্ঞা দিতে পারে। ”

” আর আপনি ? ”

আসিমের কথায় মুচকি হাসে নির্ভীক। চেয়ার টেনে বসে পরে। আসিমের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে
” অব্যক্ত কথার কোনো সংজ্ঞা হয় না আসিম। আমার কাছে ভালোবাসার একটাই সংজ্ঞা। সেটা হলো অব্যক্ত কথন। অর্থাৎ যতো ই আগাই না কেন এক ধাপ পিছিয়ে যেতেই হবে। ভাগ্য বিশ্বাসী যে আমি। তাই সেই দিকেই তাকিয়ে আছি। ”

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন ।

চলবে

#অব্যক্ত_প্রিয়তমা
#ফাতেমা_তুজ
#part_14

সেকেন্ড সেমিস্টারের পরীক্ষা চলছে। প্রচন্ড মনোযোগী হয়েছে অনিন্দিতা। আসিমের সাথে বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়েছে। নির্ভীকের রহস্য উন্মোচনে ব্যর্থ সে। তবু ও নানা ভাবে অনিন্দিতা কে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে আসিম। নির্ভীক মাহতাব , সে তো নিজের নামের মতোই দূর্লভ। অনিন্দিতার মন আজকাল কোনো কিছু তেই টানে না। নির্ভীকের প্রতি ভালোবাসা টা যেন তাঁকে একটু একটু করে শেষ করছে। এই এতো গুলো মাসে স্বল্প পরিমানে কথা হয়েছে। কখনো বা মিনিট দুয়েক কখনো বা কয়েক সেকেন্ড। অনিন্দিতা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মানুষ অভ্যাসের দাস কথা টা চিরন্তন সত্য। চলছে এভাবেই দিন। ভারসিটি তে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে মেয়েটা। তখনি খবর আসে হীর অন্তঃসত্ত্ব। কথা টা শুনেই এক চিলতে হাসি ফুটে অনিন্দিতার। দেড় বছর আগে হীরের সাথে পৃথিবীর বিয়ে টা হয়ে যায়। অবশ্য অনিন্দিতার জোড়াজোড়ির কারনেই সব সম্ভব হয়েছে। আরশাদের দিকে দৃষ্টি পাত করতেই মুখ কালো করে নেয় মেয়েটা। শক্ত হয়ে বলে
_ আমি যাবো না আব্বু। তোমরা যাও , আমার পরীক্ষা রয়েছে।

_ তাঁতে কি হয়েছে অনি। আজ কেই তো তোমার শেষ এক্সাম। হীর অন্তঃসত্ত্বা শুনে ও তুমি যাবে না, কথাটা শুনলে মেয়েটা কতো টা কষ্ট পাবে ভেবেছো ?

_ আমার যেতে ইচ্ছে করছে না আব্বু।

_ একটা কথা বলবে আমায় তুমি কেন এতো পরিবর্তন হয়ে গেলে । হাসি খুশি মুখে সব সময় বিষন্নতা কেন ?

মাথা নিচু করে অনিন্দিতা । উত্তর দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পায় না। চোখ দিয়ে অশ্রু নেমে যায়। কতোটা পরিবর্তন হয়েছে সে ? মেয়ের উত্তর না পেয়ে চলে যায় আরশাদ। আরশির সামনে দাড়িয়ে নিজেকে পরখ করে অনিন্দিতা। চেহারায় মলিনতা এসেছে। রঙ টা ও কিছু টা উজ্জ্বল হয়েছে শুধু চঞ্চলতা থমকে গেছে। একটা মানুষের জন্য আর কতো দগ্ধ হবে জানা নেই। ঘড়ির কাঁটা ঢং ঢং শব্দ তুলে। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসে অনিন্দিতা। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পিছু ডাকে নির্ভীক। অবাক হয়ে যায় অনিন্দিতা। নির্ভীকের মুখে মৃদু হাসি, অনিন্দিতা বলে
_ কিছু বলবেন ?

_ পরীক্ষা কেমন হয়েছে ?

_ ভালো।

_ আচ্ছা যান।

অনিন্দিতা পথ বাড়ায়। নির্ভীকের চাহনি মৃত। নিলিপ্ত দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার যাওয়ার পানে। প্রতি টা কদম যেন চূর্নবিচূর্ন করে দিচ্ছে। ভারসিটি তে যায় না সে। চলে আসে গ্রাম অঞ্চলের দিকে। নদীর ধারে বসে থাকে বেশ অনেকক্ষণ। পকেট থেকে একটা রেকর্ডার বের করে সে। সুইচ অন করতেই মিষ্টি এক বাচ্চা মেয়ের কন্ঠ ভেসে আসে। গড় গড় করে ইংরেজি তে সংলাপ বলছে। প্রতি টা কথা অতি মনোযোগ দিয়ে শুনে নির্ভীক। চোখ দুটো ছলছল রেখে বলে
” অব্যক্ত প্রিয়তমা।”

.

” যদি জীবন থমকে দাঁড়ায় তাহলে ঘুরে দাঁড়াও। যদি পেছন থেকে আঘাত পাও তবে সামনে তাকাও। কেউ পা টেনে রাখলে হাত দিয়ে আগাও। শুধু থমকে থেকো না। অনুভব করো নিজেকে, অনুভবেই যে শক্তি। সব সময় মনে রাখবে পিছনে ফিরে তাকানো টা বোকামি নয়। বরং বেঁচে থাকার এক একটা চেষ্টা। শুধু থমকে থেকো না। ”

” যদি পথ হারিয়ে ফেলি তাহলে কি করবো স্যার ? ”

” পথ খুঁজবে , দাঁত কামড়ে পিছু লেগে থাকবে। তবু ও থমকে থাকবে না। এই যে তোমাকে দিয়ে আমরা আশা রেখেছি রিতি মতো দাঁত কামড়ে পরে আছি। ঠিক তেমনি তোমাকে ও দাঁত কামড়ে পরে থাকতে হবে। ”

অনিন্দিতা মাথা ঝাঁকায়। পরীক্ষা শেষে একজন প্রফেসর তাকে নানান প্রশ্ন করছিলেন। কথার প্রসঙ্গে কথা গুলো বলে সে। অনিন্দিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
_ এগিয়ে যাও।

প্রফেসর চলে যান। অনিন্দিতা ক্লান্তি হটিয়ে হাঁটা লাগায়। পথে দেখা হয় আসিমের সাথে। বিচলিত সে , আসিম বলে
_ নির্ভীক স্যারের সাথে যে মেয়েটা কে দেখেছিলে না ঐ যে রোজ ওনি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে।

_ আমার সাথে কেন দেখা করতে এসেছে ?

_ আমি ঠিক জানি না অনি। তুমি ক্যাম্পাসের দিকে যাও।

_ আচ্ছা।

আসিমের আচারন টা কেমন লাগছে। এদিকে রোজ দেখা করতে এসেছে। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পাসে পৌছাতেই চোখে পরে রোজ কে। অনিন্দিতা এগিয়ে যায়। রোজের মুখে হাসি খুশির ছাঁপ। রোজ বলে
_ কেমন আছো অনিন্দিতা?

_ জি ভালো। আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন ?

_ হ্যাঁ। একটা কথা জানাতে এসেছিলাম। তাঁর আগে একটা কথা বলো তো নির্ভীককে ভালোবাসো তুমি ?

_ সমস্ত টা জেনেই তো এসেছেন।

_ বাহ ইনটেলিজেন্ট মেয়ে। নির্ভীক তোমাকে ভালোবাসে না সেটা জানো তো ?

_ জি।

_ তাহলে কেন পরে আছো। এভাবে ওর জীবন টা নষ্ট কেন করছো ? একটু শান্তি তে বাঁচতে দাও ওকে।

_ নির্ভীক ভাইয়া আপনাকে পাঠিয়েছে ?

_ না আমি ই এসেছি। সত্যি টা জানাতে এসেছি।

_ কোন সত্যি জানাতে এসেছেন আপনি?

ব্যাগ থেকে ফাইল বের করে রোজ। ফাইল টা অনিন্দিতার হাতে দিয়ে বলে
_ তুমি সহজে বিশ্বাস করবে না তাই পেপার নিয়ে এসেছি। আমি আর নির্ভীক অফিসিয়ালি হাসবেন্ড ওয়াইফ গত ছয় বছর ধরে।

ভ্রু কুঁচকে নেয় অনিন্দিতা। কথা টা যেন তাঁর মাথার উপর দিয়ে গেল। ফাইল টা খুলে দেখে সে। কোনো অনুভূতি নেই তাঁর মাঝে। রোজ কে এক পলক দেখে বলে
_ অভিনয় টা ঠিক ঠাক হলো না। আরেকটু ভালো করে চেষ্টা করবেন। আপনার মতো বিদেশে পড়াশোনা না করলে ও আমি পড়াশোনা করেছি। নকল আর আসল এর পার্থক্য বুঝি। আর যে সাইন টা সেটা ও নির্ভীক স্যারের না।

_ অনিন্দিতা।

_ গলা নামিয়ে কথা বলুন। নির্ভীক ভাইয়ার সাথে আপনার কি সম্পর্ক আমার জানা নেই। তবে যে মিথ্যে অভিনয় করলেন এটা ভালো হয় নি। একদম ই অনুচিত হয়েছে।

_ অনিন্দিতা আমার কথা শোনো।

হাজারো ডাকে ও অনিন্দিতা কথা শুনে না। এক পা দু পা করে এগিয়ে যায়। রোজের চোখ ভিজে যায়। যন্ত্রনা যেন বুকে আগুন হয়ে ঝরছে।

.

বাসায় ফিরে না অনিন্দিতা। কয়েক বার ফোন দিতে গিয়ে ও দেয় না। অশ্রু তে পুরো মুখে আঠালো রূপ ধারন করেছে। সময় তিনটের কাছাকাছি। বা হাতের তর্জনি দিয়ে চোখ মুছে সে। নির্ভীকের নাম্বার ডায়াল করে ফোন লাগায়। আশ্চর্য এক বার রিং হতেই ফোন রিসিভ করে সে। অনিন্দিতা কিছু বলার সুযোগ পায় না। ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন ক্লান্ত কন্ঠে ভেসে আসে
” অনিন্দিতা, ফোন সুইচ অফ কেন ? কোথায় আপনি। বাসায় আসেন নি কেন ?”

” কারন টা কি জানা নেই নির্ভীক মাহতাব ? নাকি সব জেনে বুঝে ও না বোঝার ভান করছেন। ”

” কি সব বলে যাচ্ছেন আপনি। আমার কথা শুনুন বাসায় ফিরে আসুন। ”

” লোকেশন দিয়ে দিচ্ছি চলে আসুন। ”

” অনিন্দিতা, অনিন্দিতা, ”

অনিন্দিতা উত্তর দেয় না। লোকেশন ম্যাসেজ করে দিয়ে আবারো ফোন সুইচ অফ করে দেয়। ব্যাগ থেকে ডায়েরী বের করে লেখালেখি করে। নির্ভীক তাঁকে ভালোবাসে না , গত দেড় বছর নির্ভীককে বিরক্ত ওহ করে নি। তবে কেন করলো এমন ? মেঘের ঘনঘটার মতো রূপ পরিবর্তন হয় অনিন্দিতার । তাচ্ছিল্য ফুঁটিয়ে বলে
” দূর থেকে ভালোবাসা টা ও যদি অন্যায় হয় , তাহলে আমার মৃত্যু যেন হয় ”

মিনিট পনেরো যেতেই নির্ভীক চলে আসে। চোখে মুখে কাঠিন্য ফুঁটিয়ে নেয়। অনিন্দিতার হাসে , খলবিলিয়ে হাসে সে। অবাক হয়ে নির্ভীক বলে
” অনিন্দিতা , এটা কি ধরনের অসভ্যতামু। ”

” কেন নির্ভীক মাহতাব ? কেন ভালো লাগছে না। বিবাহিত হয়ে ও কেন লুকিয়ে রেখেছেন বিয়ের কথা ? ”

” আমার কথা টা শুনুন। ”

” হুসস একদম নয়। আজ আমি বলবো। অনেক তো বলেছেন আপনি। আমাকে কয়েক টা প্রশ্নের উত্তর দিন তো , আমি কি গত দেড় বছরে আপনাকে একবার ও বলেছি ভালোবাসি কিংবা আপনাকে স্পর্শ করেছি ? ”

” প্লিজ অনিন্দিতা আমার কথা টা শুনুন। ”

” উত্তর দিন নির্ভীক মাহতাব। ”

চমকে যায় নির্ভীক। অনিন্দিতার দুই চোখ থেকে যেন আগুন ঝরে। হঠাৎ করেই ঝাঁপিয়ে পরে নির্ভীকের গাঁয়ে। শার্টের কলার চেপে বলে
” কেন এই নাটক ? আমি তো শেষ হয়েই গেছি তাহলে কেন আবার নাটক ? আমি তো আমার ভাগ্য কেই মেনে নিয়েছি। তবে কেন করলেন এমন ? আমি তো মিথ্যে জানতে চাই নি। আমি শুধু আপনাকেই ভালোবাসি , গুটিয়ে নিয়েছি নিজেকে। পাগলামি নেই আমার মাঝে। ”

” মিথ্যে বলছেন অনিন্দিতা। ”

” কোনো মিথ্যে নয় সব সত্যি। আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি এটাই সত্যি। ”

নির্ভীকের চোখ মৃত দৃষ্টি দিয়ে আছে। অনিন্দিতা একি কথা বলে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই অনিন্দিতা কে হেঁচকা টান মারে নির্ভীক। একদম কাছে নিয়ে আসে। এক হাতে চেপে ধরে চোখে চোখ রাখে। বিষয় গুলো এতো টাই দ্রুত ঘটেছে যে থতমত খায় অনিন্দিতা। নির্ভীকের চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে সাথে রয়েছে দৃশ্যমান পানি কনা। হঠাৎ করেই অনিন্দিতা ঘাড়ের জামা টা একটু নিচু করে। চমকে যায় অনিন্দিতা। ছুটোছুটির চেষ্টা করে তবে পারে না। নির্ভীকের ঠান্ডা হাত অনিন্দিতার ঘাড়ে স্পর্শ করে। পরক্ষনেই রক্ত লাল চোখে বলে
” কেন লিখেছেন আমার নাম ? ”

” ভালোবাসি তাই লিখেছি। ”

” কেন নিজেকে আঘাত করেছেন বারংবার?”

” ভালোবাসি তাই আঘাত করেছি। ”

” কেন ভালোবাসেন আমায় ? ”

” জানি না , জানি না আমি। আমাকে এভাবে না মেরে মৃত্যু দিন আমায়। আমি আর পারছি না। ”

অনিন্দিতার হাত ছেড়ে দেয় নির্ভীক। দু হাতে খামচে ধরে নিজের চুল। হুট করেই অনিন্দিতার কাছে চলে আসে। দু হাত এক সঙ্গে চেপে ধরে বলে
” আর একটা আঘাত পরলে খুন করবো আমি। অনেক সহ্য করেছি। রক্তাক্ত হতে ভালো লাগে তাই না ? ”

” হ্যাঁ ভালো লাগে রক্তাক্ত হতে। যত বার আপনি আঘাত পাবেন অনিন্দিতা ততো বার নিজেকে আঘাত করবে। আমার চাঁদ আপনি , আমার একান্ত চাঁদ। ”

আগুনে পানি ঢালার মতো দমে যায় নির্ভীক। কয়েক পা পিছিয়ে যায় সে। অনিন্দিতার চোখে মুখে উৎকন্ঠা ছড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই কেঁদে উঠে মেয়েটা। মাটি তে বসে পরে পা ছড়িয়ে। নির্ভীক কোনো কথাই বলে না। অনিন্দিতার চিৎকার কানে আসতেই থমকে চায়।অনিন্দিতা বলে
” আমাকে ভালোবাসেন না যখন ,তখন মায়া কেন দেখাচ্ছেন ? যান আপনি , চলে যান আমার থেকে, বহু দূরে চলে যান। চাই না আপনাকে, আমি এভাবেই ভালো আছি। মৃত লাশ হয়ে আছি , আমার মৃত্যু হলে ও আপনি আমার কাছে আসবেন না। কখনো আসবেন না, চলে যান। খুব ভালোবাসি আপনাকে ভালোবাসি”

মিনিট দুয়েক পর চোখ খুলে অনিন্দিতা। আশে পাশে কেউ নেই। চলে গেছে নির্ভীক। নিজের গাঁয়ে আঘাত করে অনিন্দিতা। নির্ভীক কে ছাড়া নিশ্বাস ওহ যেন বিষ হয়ে যায়।

চলবে

#অব্যক্ত_প্রিয়তমা
#ফাতেমা_তুজ
#part_15

কেঁটে যায় কয়েক মাস। নির্ভীকের সাথে দেখা হয় না অনিন্দিতার। কারন নির্ভীক তৃতীয় বর্ষের ক বিভাগের কোনো ক্লাস নেয় নি। যথাসম্ভব দূরে দূরেই থাকে। তিক্ত অনিন্দিতা ও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ভালোবাসার লড়াই টা নিজের মাঝেই রেখেছে। প্রেমের অনুভূতি যখন একান্ত তখন কষ্ট গুলো ও একান্ত। এই কয়েক মাসে কয়েক টা ডায়েরী পূর্ন করেছে সে। যাঁর প্রতি টা অক্ষর নির্ভীকের নামে। প্রিয় মানুষ টির রক্তে লাল হওয়া ডায়েরী বুকে জড়িয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়। যে মরন যন্ত্রনা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় সেই মরন যন্ত্রণা কেই আঁকড়ে ধরেছে। রিতি মতো বুক ফাঁটা আর্তনাদ গুলোই হয়েছে আপন। সারাদিন নিজের ঘরেই বসে থাকে। কখনো বা হাসে কখনো বা কাঁদে। প্রেমে ব্যর্থ রাজকন্যার মতোই সকলের চোখে সুখী সে। সব সুখ তাঁর হাতের মুঠোয় । কিন্তু শুধু সে ই জানে ব্যর্থ জীবন কে রাঙানোর চেষ্টায় আছে। এক মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়েছে সে। আজ তিন দিন ধরে নির্ভীকের ছবি আঁকার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছু তেই হয়ে উঠছে না। অনিন্দিতার রাগ উঠে। কাগজ গুলো কয়েক টুকরো করে জানালা দিয়ে ফেলে দিতে গেলেই চোখ পরে নির্ভীকের দিকে। আজ কয়েক মাস পর নির্ভীক কে দেখতে পেলো সে। অজান্তেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে। শাহানার ডাক পরতেই হতচকিয়ে উঠে অনিন্দিতা। গলা উঁচিয়ে বলে
” আসছি আম্মু । ”

শাহানা তত্ত্ব সাজাচ্ছেন। মেয়ের শশুর বাড়িতে যাবেন সকলে। কয়েক দিন পর ই হীরের ডেলিভারি । অনিন্দিতার দিকে করুন চোখে তাকায় শাহানা। মায়ের দৃষ্টি বুঝতে পারে অনিন্দিতা । হাসি মুখেই বলে
” আমি যাবো আম্মু ”

” সত্যি বলছিস অনি ? ”

” হ্যাঁ আম্মু ”

পর পর কয়েক বার মেয়ের মুখে চুমু খায় শাহানা। অনিন্দিতার অধর কোনে হাসি ফুটে। পরিবারের সুখেই না হয় নিজের দুঃখ বিসর্জন দিবে।

পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে আসেন আরশাদ। অনিন্দিতা কে দেখে হাসেন। বলেন
” তাহলে আমার মেয়ের মাথায় সুবুদ্ধি হয়েছে ? ”

” আগে থেকেই ছিলো আব্বু ”

” আহা সেটা বলি নি মা। শুধু বললাম নিজেকে ঘর বন্দী রাখার চিন্তা টা বদলে নিয়েছিস। ”

অনিন্দিতা উত্তর করে না। কিচেন থেকে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে আসে আসিম। প্রচন্ড অবাক হয়ে অনিন্দিতা বলে
” তুমি কখন এলে ? ”

” ভোর পাঁচ টায়। ”

” হোয়াট ”

” তুমি ইনভাইট নাই করতে পারো আন্টি আর আঙ্কেল আমার কথা ভুলে নি। এখন তো মনে হচ্ছে ওনারাই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ”

অনিন্দিতা কিছু বলবে তাঁর আগেই ইনতেহার কন্ঠ আসে। শাড়ির প্যাকেট হাতে এসে বলে
” আমি ও কিন্তু আছি। তুই ভুলে গেলে ও আন্টি ভুলে নি। ”

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় অনিন্দিতা। সবাই অট্টহাসি তে ফেঁটে পরে। নিজ রুমের দিকে এগিয়ে যায় অনিন্দিতা।ডোর লাগানোর আগে বলে
” সবাই চিটিং করেছো। ”
.

রেডি হয়ে বসে আছে অনিন্দিতা। মুখ গম্ভীর তাঁর। নির্ভীক বার বার যাবে না বলেছে। চারুলতা অবশ্য লেগে আছেন ছেলের পেছনে কেন যাবে না সে। নির্ভীকের একটাই উত্তর এতো মানুষজন ভালো লাগে না তাঁর। এই কথা শুনেই চারুলতা রেগে গিয়েছেন। নিহালের ওহ একি কথা। সাথে ব্যবসার কাজ ও নাকি রয়েছে। এখন যদি নির্ভীক ওহ একি কথা বলে তাহলে কি করে হয় ? চারুলতার রাগে দমে যায় নির্ভীক। মায়ের নাছোড়বান্দা দৃষ্টি থেকে রেহাই নেই।

প্রায় দুই বছর পর মামা বাড়িতে এসেছে অনিন্দিতা । হীরের বিয়ের মাস দুয়েক পর এসেছিলো আর আসা হয় নি। মামা , মামি আর ভাই বোন দের যত্নে একেবারে যা তা অবস্থা। তাই তো বলে মামার বাড়ি রসের হাঁড়ি। অনিন্দিতার প্লেটে খাবার দিতে দিতে উঁচু করে ফেলেছে। না পেরে অনিন্দিতা চিৎকার করে বলল
” আমি কি রাক্ষস নাকি ? ”

” সেকি কথা অনি। রাক্ষস হতে যাবি কেন? আরেকটু খাবার দিবো? ”

” মামুনি প্লিজ এবার তোমরা থামো এতো খাবার আমি সপ্তাহে ও খাই না। ”

আপেলে কাঁমড় বসিয়ে হীর বলে
” সমস্ত খাবার শশুর বাড়িতে গিয়েই খাবে। এটা অবশ্য ভালো। বাবার সম্পদ রক্ষা করে চলেছে। ”

” মার খাবি হীর। ”

ফিচেল হাসে হীর। অনিন্দিতা দম ফেলে খাবার খেতে বসে। এক মনে খাচ্ছে নির্ভীক। যেন কোনো যন্ত্র মানব। চোখের নিচে কালি জমেছে। শুকিয়ে গেছে অনেক টা। অনিন্দিতার বুক ধুক করে উঠলো। এ কি হাল হয়েছে ছেলেটার ?
অনিন্দিতার মনে প্রশ্ন জাগে। বিরক্ত করা ছেড়ে দিয়েছে সে তারপর ও এই অবস্থা কেন !গলা দিয়ে খাবার নামে না। একটু খেয়েই উঠে যায় অনিন্দিতা। বিকেলে সবাই বাগানে ঘুরতে যায়। অনিন্দিতা মাথা ব্যথার অজুহাতে যায় না। সে জানে নির্ভীক বের হবে না আজ। তাই ঘাপটি মেরে বসে থাকে। কিচেন থেকে দু কাপ কফি বানিয়ে গেস্ট রুমের দিকে রওনা হয়। গেস্ট রুমে নির্ভীক কে না পেয়ে ট্রেরেস এ চলে আসে। ট্রেরেস এ নির্ভীক কে সিগারেট খেতে দেখেই হৃদয়ে আঘাত লাগে। টেবিলে কফি রেখে ছুটে যায় নির্ভীকের কাছে। নির্ভীকের হাত থেকে ছো মেরে ফেলে দেয় সিগারেট। গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখ দুটো মেলে তাকায় নির্ভীক। স্তব্ধ হয়ে যায় দুটি আত্মা। নির্ভীকের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে আর অনিন্দিতার চোখে ভাসে অশ্রু। আবছা হাতে নির্ভীকের বুকে স্পর্শ করে সে। কোনো রকম প্রতিক্রিয়া করে না নির্ভীক। অনিন্দিতা তাঁর কাঁপা কন্ঠে বলে
” একি হাল হয়েছে আপনার ? আমি তো বিরক্ত করি না আপনাকে। তাহলে এমন কেন করছেন ! ”

” কেন বিরক্ত করেন না অনিন্দিতা? ”

” আপনিই তো বারন করেছেন। ”

” তাহলে এখন কেন এসেছেন ? ”

অনিন্দিতা উত্তর দেয় না। নির্ভীকের মেরুন ঠোঁটে কালচে দাগ পরেছে। যার অর্থ দীর্ঘদিন সিগারেট খেয়েছে। ছলছল নয়নে তাকায় অনিন্দিতা। নির্ভীকের ঠোঁটে স্মিত হাসি সে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা নন্দিনীর ( মেয়ে ) দিকে। এই সেই নন্দিনী যে তাঁর জন্য দুনিয়া ছাড়তে রাজি। অথচ সে নির্বিকার পুরুষ মানুষ। মিনিট কয়েক এভাবেই চলে যায়। কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হয় নির্ভীকের। হাতের আঙুলের সাহায্য অনিন্দিতার বেবি হেয়ার গুলো গুছিয়ে দেয়। এই স্পর্শে যেন মাদকতা আছে। অনিন্দিতার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম । কিছু টা দূরে সরে যায় নির্ভীক। অনিন্দিতা বলে
” আমাকে সত্যি ই ভালোবাসলেন না ? ”

” হ্যাঁ বাসলাম না। ”

” শুধু মাত্র আমার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য রোজ আপুর সাথে বিয়ের নাটক ও করেছিলেন ! ”

” হ্যাঁ করেছিলাম। আপনাকে দূরে সরানোর কোনো পথ ছিলো না। যদি ও ব্যর্থ ছিলো সেই প্রচেষ্টা তবে আপনি ঠিক ই দূরে সরে গেছেন। ”

” তাহলে এই অবস্থা কেন আপনার? ”

” উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করি না। ”

মুখে হাত চেপে কাঁদে অনিন্দিতা। সে কান্নার শব্দ শুনতে পারে না ছেলেটা। ধমকে উঠে সে। অনিন্দিতার বাহু চেপে বলে
” একদম কাঁদবেন না। এ চোখের পানি অনেক মূল্যবান। এই ব্যর্থ প্রেমের জন্য কেন অশ্রু ফেলেন ? আপনাকে দিয়ে এমন টা আশা করি না আমি। চলে যান অনিন্দিতা, বহু দূরে চলে যান। যেখানে নির্ভীকের কোনো অস্তিত্ব নেই। আপনার জীবন হবে সুখময়। ”

” তাহলে মৃত্যু দিন আমায়। যেখানে আপনি নেই সেখানে থাকতে চাই না আমি। যেখানে আপনি নেই সেই সুখ আমার জন্য বিলাসিতা মাত্র। আপনি শুধু আপনি নির্ভীক মাহতাব শুধুই আপনি। এই আপনি তেই আমি মরন দেখেছি। ”

অনিন্দিতার চিৎকার করা হা হা কার বেদনা নির্ভীকের টনক নাড়িয়ে দেয়। অনিন্দিতার দিকে এক হাত বাড়িয়ে আবার গুটিয়ে নেয়। দেয়ালে লাথি মেরে বলে
” পারছি না আমি। আপনাকে সঙ্গী করা সম্ভব নয়। চলে যান অনিন্দিতা চলে যান।”

কথা টা বলেই নিজের বুকে শুট করে নির্ভীক। গুলি লেগে খলবিলিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। লাল রক্তে রঙিন হয় মেঝে। অনিন্দিতার মুখ থেকে কথা বের হয় না। কেউ যেন মুখে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। কয়েক দফা পিছিয়ে যায় নির্ভীক। হাতের বন্দুক টা ছিটকে পরে যায় অনেক দূরে। অশ্রু শিক্ত নয়নে ডুবে থাকা অনিন্দিতা দেখতে পায় মেঝে তে পরে যাচ্ছে তাঁর প্রান প্রিয় প্রিয়তম। এই বুঝি ভালোবাসার সমাপ্তি হলো ।

চলবে