অব্যক্ত প্রিয়তমা পর্ব-২৬

0
370

#অব্যক্ত_প্রিয়তমা
#ফাতেমা_তুজ
#part_26

এক মুঠো বিকেল কে স্বাক্ষী রেখে আলাদা হয় দুটি হৃদয়। বড্ড আফসোস হচ্ছে। নিজের ভালোবাসা কে আগলে না রাখতে পারার যন্ত্রণা যেন আকাশচুম্বি বেদনা। একটি মাত্র ভাবনা ভাইয়ের মন কে কি করে ভেঙে দিবো ?
মানুষ অদ্ভুত প্রানী। সবাই স্বার্থপর। কেউ নিজের জন্য কেউ বা অন্যের জন্য। তবে স্বার্থের দেয়ালে পিঠ ঠেকে কিছু মানুষ মরন যন্ত্রনা অনুভব করে।সেই ইচ্ছাকৃত মরন যন্ত্রনার থেকে রেহাই পেলো না কঠিন মন ধারী নির্ভীক ওহ। সবাই অনেক বুঝিয়ে ও পারলো না পাথরের মনে ফুল ফোটাতে। দিগন্ত পথ মারিয়ে নির্ভীক আটকে আছে একটা প্রসঙ্গে। ‘ পারবো না আমি আমার ভাইয়ের হৃদয় কে বেদনা দিতে। ওর মনে বেদনা দিয়ে আমি সুখী হবো না। তাঁর থেকে ভালো দুটো বিক্ষিপ্ত হৃদয় আরো বিক্ষিপ্ত হোক। ভালোবাসার শাস্তি গ্রহন করে দুটো পরিবার কে খুশি করার চেষ্টায় বিলীন হোক। ‘

ক্লান্ত অনিন্দিতা। অক্ষম সে প্রিয়তম কে বোঝাতে। বরাবর ই বুকে পাথর চাঁপা ছেলে নির্ভীক। তাঁর মস্তিষ্ক পরিবার কে সুখের সায়রে ভাসাতে চায়। কিন্তু বুঝতে পারে না এভাবে সুখ নয় বরং হবে দুঃখ।নেত্র পল্লব মেলে দিয়ে ঘোলাটে মনি তে শেষ বারের মতো প্রিয়তম কে মুগ্ধ দৃষ্টি তে দেখে। বলে
” আপনার দেওয়া শাস্তি গ্রহন করে নিলাম। অভিনয়ের সাথেই পথ চলবো। কখনো বুঝতে দিবো না কাউ কে ভালোবেসে আমি ও মরেছি। যে মরন যন্ত্রনার স্বাক্ষী স্বয়ং প্রকৃতি। ”

” ভালো থাকুন অনিন্দিতা। পারলে ক্ষমা করে দিবেন। আপনার জীবন থেকে সুখ কেড়ে নিলাম আমি। ”

অস্পষ্ট ভাবে নির্ভীক কে দেখতে পায় মেয়েটা। উত্তর করার মতো শব্দ ডিকশনারি তে নেই। থাকবেই বা কি করে ?
মানুষ প্রেমের জন্য দুনিয়া ছাড়ে। এক সাথে থাকার প্রতিশ্রুতি গড়ে। আর ওদের প্রেম গড়েছে আলাদা হওয়ার প্রতিশ্রুতি। রঙিন জীবন কে কালো করার প্রতিশ্রুতি। যেখানে হাত বুলিয়ে শুধু কান্না করা যায়। পাওয়া যায় বেদনা। আবার সেই বেদনা কে সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখতে হবে পুরো পৃথিবীর থেকে। প্রেম সুন্দর , সত্যি প্রেম সুন্দর। তিক্ততার মাঝে ও পূর্নতা দেয়। কিছু ব্যথার মাঝে ও সুখ দেয়। নিজেকে নয় বরং অন্য কে।
.

বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। পুরো বাড়ি গমগম করছে। দুটো পরিবারের মাঝে কদাচিত পরিমান কোনো দুঃখ নেই। নিজের মন ভেঙে ও তৃপ্ত নির্ভীক। পরিবারের সুখ টুকু বিসর্জন দেয় নি সে। বরং প্রিয়তমা কে দিয়েছে শাস্তি গ্রহন করেছে বেদনা। তাঁতে ও যেন সুখ। উহহু ঠিক সুখ নয় বরং অভিনয়ের রূপ। যে রূপে গুটি গুটি আয়োজনে সাজে পুরো বাড়ি। বসন্ত পেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস আর গ্লানি। হলুদ শাড়ি তে কি সুন্দর লাগছে মেয়েটা কে। এতো সুখের মাঝে ও বুঝি দুঃখ এসে ভর করে ?
বুকে হাত গুঁজে নির্লিপ্ত তাকিয়ে থাকে প্রিয়তমার দিকে। দুটো দিন , বা কিছু ঘন্টা পর প্রিয়তমা কে প্রিয়তমা বলে ডাকা যাবে না। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সম্পর্ক বদলে হবে শক্ত পোক্ত দেয়াল। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নির্ভীক। অতি দ্রুত চলে যাবে সে। দূরত্ব বজায় রেখে দুজনেই লড়াই করবে। কারো বিরুদ্ধে নয় , নিজের সাথে নিজের লড়াই। অভিনয়ের জগতে পা রাখার লড়াই।

” কি রে নির্ভীক। আজকে ও দাঁড়িয়ে থাকবি ? যা হলুদ লাগা অনি কে। ”

” না আব্বু আমার এসব ভালো লাগে না। ”

” সেকি কথা। ভাইয়ের বিয়ে তে ও ভালো লাগে না। এটা বললে তো চলবে না। যাহ হলুদ লাগাবি। আচ্ছা আয় সবার আগে হলুদ লাগিয়ে না হয় রেস্ট করবি। ”

” আব্বু আমি যাবো না। ”

নির্ভীকের কথায় পাত্তা দেন না আজমাল। এক প্রকার টেনে নিয়ে যান স্ট্রেজে। কোনো মতে হলুদ লাগিয়ে চলে আসে নির্ভীক। অনিন্দিতার কোনো অনুভূতি নেই। তবে সুখ একটাই বিচ্ছেদের হলুদ এর ছোঁয়া তো প্রিয়তমর থেকেই পেলো। জীবনে চরম সত্যের মুখোমুখি না হলেই হয়তো ভালো হতো। নির্ভীকের প্রেম ওকে একটু একটু করে পোরাচ্ছে। মানিয়ে নিয়েছিলো ওহ , তবে এই সত্য ওকে কয়েক গুন পিছিয়ে দিয়েছে। হৈ হুল্লরে মেতে উঠে সকলে। অনিন্দিতার হাত টা শক্ত করে জড়িয়ে আছে ইনতেহা। চোখ দুটো বার বার ভিজে যাচ্ছে। কাতর কন্ঠে বলে
” দোস্ত আমি সবাই কে বলে দেই। ওনারা নিশ্চয়ই সব মেনে নিবে। ”

” সেটা আমি ও জানি। আমি বললেই সবাই মেনে নিবে। কারো কোনো সমস্যা থাকবে না। তবে ভেতর থেকে সবাই কষ্ট পাবে। নির্ভীক ভাইয়ের সামনেই প্রতিশ্রুতি হয়েছিলো। সেদিন ওনি বারন করতে পারে নি। কেন পারে নি এই প্রশ্ন উঠবে। ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর ও কেন ভালোবাসা কে জীবন্ত করেছে সেই প্রশ্ন উঠবে। অপমান হবে আমাদের ভালোবাসার। কিছু মানুষ কলঙ্ক লাগাবে। নির্ভীক ভাই স্বচ্ছ, শুভ্র, তাঁর গাঁয়ে কলঙ্ক লাগলে আমি নিজেকে কি করে ক্ষমা করবো বলতে পারিস ? তাছাড়া ইতিহাসে বহু প্রেম আছে যেখানে প্রেমের পরিনতি নিষ্ঠুর হয়। আমাদের প্রেম টা ও না হয় নিষ্ঠুর হোক। ”

” অসহ্য , এমন প্রেম যেন কারো জীবনে না আসে। ”

” তোর হাসবেন্ড আসলো না ? ”

” এসে কি করবে ? শোক পালন করা বিয়ে দেখবে। ধ্যাত আমি ও আর আসবো না। ”

রেগে চলে যায় ইনতেহা। অনিন্দিতা হাসে, জীবন টাই হাস্যরসত্মাকে পরিনত হয়েছে।

মিনিট দশেক পর নিহাল কে টেনে নিয়ে আসে হীর। বেচারা নিহাল এর অবস্থা নাজেহাল। সে কিছু তেই হীর কে বোঝাতে পারলো না। রসিকতার স্বরে হীর বলে
” সেকি ভাইয়া এতো লজ্জা কিসের। ”

” আমার ফোন বাজছে হীর। ”

” উফফ রাখুন তো ফোন। সারা জীবন ফোনে মুখ গুঁজে রাখা যাবে। এই সময় টা কি আসবে আর ? ”

বিপাকে পরে নিহাল। অদ্ভুত হলে ও সত্যি নিহালের কোনো ফ্রেন্ড ই আসে নি। সেই নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নেই। অতো দিকে খেয়াল রাখার সময় কোথায়। বন্ধু মহলের সাথে আড্ডায় মজেছে নির্ভীক। আড়চোখে অনিন্দিতা কে দেখে যাচ্ছে। ভারী সুন্দর অভিনয় করে মেয়েটা। হাসি মুখে সবার সাথে প্রহর গুনে চলেছে। এমনকি নিহালের সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলছে যেন এই বিয়ের জন্য বহু দিন ধরে অপেক্ষা করে ছিলো সে । নির্ভীকের সাথে চোখাচোখি হতেই হাসে অনিন্দিতা। ইশারায় বলে হাসি ফোঁটাতে। সন্তপর্নে হাসি ফোঁটায় নির্ভীক। অনিন্দিতা ও হাসে। ফটো সেশন শুরু হয় , একে একে সবাই ফটো তুলে। নির্ভীক কে পাশে বসিয়ে দেয় রোজ। নির্ভীক সামান্য বিব্রত হয়। অনিন্দিতা বলে
” পাঞ্জাবি তে সব সময় ই আপনাকে সুন্দর লাগে। আজ ও প্রেমে পরতে বাধ্য হলাম। ”

” কষ্ট বাড়াচ্ছেন অনিন্দিতা। নাকি বিদ্রুপ করছেন। ”

” সে সাধ্য কি আছে আমার ? শাস্তি দিয়েছেন মাথা পেতে গ্রহন ও করেছি। তারপর কষ্ট বিদ্রুপ সব বিলাসিতা। আমি কাঙালি ব্রাহ্মন। চাঁদ কে দেখার সৌভাগ্য মিলেছে যে এটাই বেশি। ”

চলে যেতে চায় নির্ভীক। সকলের আড়ালে নির্ভীকের হাত টেনে ধরে অনিন্দিতা। উপায় না পেয়ে আবারো পাশে বসে পরে নির্ভীক। ফিস ফিস করে বলে
” কি হচ্ছে কি অনিন্দিতা । ”

” আর কয়েক ঘন্টা পর এই হাত ধরতে পারবো আমি ? প্রেমের চোখে দেখতে পারবো আমি। এই সামান্য সময় টুকু আমি হারাতে চাই না। ”

” আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম আমি। প্রেমিক হিসেবে ব্যর্থ আমি। ”

” ভাই হিসেবে তো গর্বিত আপনি। এটাই অনেক কিছু। আমার প্রিয় মানুষ টার জন্য এই টুকু করতে পারবো না আমি ? ”

এক মুহুর্তের জন্য থমকে যায় নির্ভীক। ইচ্ছে হয় অনিন্দিতা কে জড়িয়ে নিতে। চিৎকার করে বলতে আপনাকে ছাড়বো না আমি। কিছুতেই ছাড়বো না। তবে পরিস্থিতি এতো টাই আবেগ প্রবন যে নির্ভীকের হাতে সে ক্ষমতা নেই। ভাই কে কষ্ট দিতে পারবে না ওহ। প্রচন্ড ভালোবাসে পরিবার কে। কখনো তাঁদের এতো টা আঘাত করতে চায় না যাঁর ফলে আফসোস করতে হয়। অবশ্য জীবনে আফসোস টা কখনোই যাবে না। প্রিয়তমা কে না পাওয়ার বেদনা কখনোই স্তব্ধ হবে না। বরং দুজনে এক সাথে থাকার যে ইচ্ছে টা তা কিছু মুহুর্তেই শেষ হয়ে যাবে।

সারা রাত ঘুম হয় নি নির্ভীকের। বুকের ভেতর বেদনা যেন ওকে পাগল করে দিয়েছে। সিগারেটের ধোঁয়া তে পুরো ঘর কেমন গুমোট হয়ে আছে। আকাশের চাঁদ টা ও মেঘের আড়ালে লুকিয়ে। প্রেম কে হারিয়ে কাঁদছে অনিন্দিতা। ব্যলকনি তে দাঁড়িয়ে অনিন্দিতার ডায়েরীর শেষ পাতা টা অপূর্ন হতেই দেখছে নির্ভীক। একটা একটা করে ছিঁড়ে ফেলছে অনিন্দিতা। খুব যত্নে লেখা প্রতি টা অক্ষর আজ অযত্নে থমকে গেছে। যত্নে লেখা অক্ষর গুলো যেন চিৎকার করে বলে
‘ আমাকে পর করে দিও না। আমি তোমাতে হারিয়ে গেছি। ‘
সমস্ত বেদনা কে তুচ্ছ করেই ডায়েরী টা ছিন্ন ভিন্ন করে দেয় অনিন্দিতা।

বিয়ের দিন সকালে নির্ভীকের অবস্থা বদ্ধ পাগলের মতোই। সে যেন নিজের মধ্য নেই। সবাই কে লুকিয়ে এলোমেলো পায়ে অনিন্দিতার ঘরে প্রবেশ করে। নির্ভীকের ছবি বুকে জড়িয়ে জানালায় মাথা এলিয়ে আছে মেয়েটা। হঠাৎ শব্দ হওয়া তে কিছু টা হতচকিয়ে যায় ।নির্ভীক কে দেখে অবাক হয়। কিছু টা ভেঙে পরে ডুকরে কেঁদে উঠে। তৎক্ষনাৎ কাছে এসে দাঁড়ায় নির্ভীক। এলোমেলো দৃষ্টি আর উৎখুস চুলে ও যেন অজস্র সৌন্দর্য বিদ্যমান। অন্তত অনিন্দিতার কাছে তো তেমনি লাগে। প্রিয়তমার চোখে বিষন্নতা ওকে উম্মাদ করে দেয়। হুট করেই জড়িয়ে ধরে অনিন্দিতা কে। শিউরে উঠে মেয়েটা। নির্ভীক বলে
” আমি আপনাকে ছাড়তে পারবো না অনিন্দিতা। আমি পারবো না আপানকে ছাড়তে। ”

অনিন্দিতা যেন আকাশ থেকে পরে। অবিশ্বাস্য স্বরে বলে
” আপনি ভেবে বলছেন নির্ভীক ভাই ? ”

” হ্যাঁ আমি ভেবেই বলছি। চলুন পালিয়ে যাই অনিন্দিতা। যেখানে কেউ নেই , আমি আর আপনি , শুধু আমি আর আপনি। ”

অনিন্দিতা কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অনিন্দিতার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় নির্ভীক। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে অনিন্দিতা। নির্ভীকের চোখ দুটো ঘোলাটে। প্রিয়তমা কে নিয়ে ছুটতে থাকে সে। বহুদূর থেকে বহুদূর।
চলবে