#অভিলাষী (৩য় পর্ব)
#আরশিয়া_জান্নাত
অনেকে বলে গর্ভাবস্থায় জীবন অনেক কঠিন হয়। আমার যে সহজ ছিল তা বলবো না। তবে আমার কাছে বাচ্চা হবার পরের স্টেজটা আরো বেশি কঠিন মনে হয়েছে। এতো ছোট্ট তুলতুলে একটা বাচ্চা কে কীভাবে ধরবো, কেমন করে ধরলে ওর ক্ষতি হবেনা, বা ওকে কিভাবে যত্ন নিবো পরিচর্যা করবো প্রভৃতি চিন্তায় আমার মাথা একদম নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। যদিও আমার পাশে মুরুব্বি অনেক আছেন তবুও মা হিসেবে নার্ভাসনেস ঘায়েল করছিল আমাকে। আমি ভয় পাচ্ছিলাম ওকে কোলে নিতে, সত্যি বলতে ওকে ফিড করাতেও কেমন সংকোচ লাগছিল, অদ্ভুত লাগছিল! আর সবচেয়ে বড় ভয় যেটা পাচ্ছিলাম তা হলো আমার শারীরিক পরিবর্তন। আমি অনেক ডকুমেন্ট পড়েছি অনেক মেয়ের জীবনের গল্পও পড়েছি। যেখানে একটা সমস্যা খুব প্রখর ছিল, তা হচ্ছে প্রেগন্যান্সির পরবর্তী স্টেজে হাজবেন্ড রা বেশিরভাগ ডেসপারেট হয়ে যান। সময় দিতে চান না এডজাস্ট হবার। অনেকে নাকি এই টার্মেই পরকীয়ায় ও জড়িয়ে যায়। সত্যি বলতে আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন এই ঘটনাগুলো খুবই অহরহ ঘটছে। আগে ঘটতো কী না জানি না তবে এখন যোগাযোগ মাধ্যম খুবই সহজ হওয়ায় এসব ঘটনা আমাদের সামনে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। তাই আমি ভীষণ ইনসিকিউর ফিল করছিলাম। তৈমুরের চরিত্র কেমন আমি ঠিক বুঝি না, ওর সাথে আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং ও তেমন হয়নি। আমাদের কথাই হয় খুব কম। তাই সময়ের তুলনায় আমি মানুষ টাকে খুব কম চিনি। আগেই বলেছি সে অযত্ন করেনা আমার। তবে আমার প্রতি তার টান কতোখানি বা সে আমাকে কতটুকু ভালোবাসেন আমার আইডিয়া নেই। মাঝেমধ্যে মনে হয় সে আমাকে ভালোবাসে, আবার মাঝেমধ্যে মনে হয় এ নিছকই দায়িত্ব পালন। এই যেমন হসপিটালের কান্ডে আমার মনে হয়েছিল মানুষ টার মনে আমাকে হারানোর ভয় তীব্র ছিল। এটা অবশ্যই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু আসার পর থেকেই মেয়েকে নিয়ে ই সে মহাব্যস্ত, আমার কথা যেন ভুলে ই গেছে দেখে মনে হচ্ছে সব দুশ্চিন্তা তার সন্তান কে ঘিরেই ছিল। আমাকে নিয়ে না! হুহ…
গতকাল আমার বাসা থেকে বাবা-মা আর ভাইয়ারা এসেছিলেন। মা বেশিক্ষণ বসেননি, বাসায় ডালি আপা একা তাই টেনশনে তিনি অস্থির ছিলেন। তার অস্থিরতা দেখে মনে হচ্ছিল শুধু দায়িত্ব থেকে ই মান রাখতে এসেছেন। আমার সবচেয়ে বেশি দুঃখ লাগলো উনি একটাবার আমার মাথায় হাত রেখে আদর করে জিজ্ঞেস করলেন না আমার কোনো অসুবিধা হয়েছে কি না, বা কোনো সাহায্য লাগবে কি না। আব্বু অবশ্য নাতনি কে কোলে নিয়ে সোনার হার পড়িয়ে দিয়েছেন। আর ভাইয়ারা পাশ থেকে চোখের দেখা দেখেছেন। কেউ আদিখ্যেতা করে ছবি তোলেনি, কোলেও নেয়নি। মেহমানের মতো এসে মেহমানের মতোই দ্রুত চলে গেলেন। অবশ্য এ বাড়িতে মেহমানরা আরো বেশি সময় থাকে। সে যাই হোক তারা রাজ্যের কাজ ফেলে হাজিরা দিয়ে গেছেন ওতেই আমার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আমার প্রতি তাদের এই অবহেলা এতোদিনে এই বাড়ির সবার চোখেই পড়েছে। মা যতবার ডালি আপা ও তার ছেলের কথা বলছিলেন কারো বুঝতেই বাকি ছিল না উনি তার বড় মেয়েকে একটু বেশিই ভালোবাসেন। আমার চাচী শাশুড়ি টিপ্পনী কেটে বলেই ফেলেছেন, “বড়টাকে ৬মাসের বেলাই নিয়ে রেখেছেন বাচ্চার বয়স ৪মাস হয়ে গেছে এখনো আপনাদের কাছেই রাখছেন। এদিকে ছোট মেয়ের বেলা হসপিটালে পর্যন্ত কেউ আসলেন না;এ কেমন বিচার? নাকি ভেবেছেন এলে খরচ বহন করতে হবে?”
দাদীজান তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে প্রসঙ্গ এড়ালেন যদিও। কিন্তু জবাব দেওয়ার মুখ যে আমার পরিবারের ছিল না আমি তো জানি।
আমার শাশুড়ি গলার চেইনটা খুলে বাবার হাতে দিয়ে বললেন, “আমার নাতনির গলায় চেইন পড়ার বয়স হলে আমরাই ওকে দিবো। আপনারা ওকে দোয়া করে দিলেই হবে।”
আব্বু ব্যতিব্যস্ত হয়ে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু আমার শাশুড়ি নাছোড়বান্দা, তিনি কিছুতেই ঐ চেইন রাখলেন না। আমি তখন টের পেলাম আমার বাবা-মায়ের প্রতি তাদের মনেও অভিমান আছে। হয়তো উনারা কেউ চাননি সোনার চেইন দিয়ে আম্মু আব্বু দায়সারা হোক। তাই বলতে গেলে একটা নিরব স্নায়ুযুদ্ধের মাধ্যমেই তাদের বিদায় পর্ব কেটেছে।
তৈমুর এ ব্যাপারে কিছু না বললেও সবাই যাওয়ার পর বলল, “মৃত্তিকা তুমি হয়তো মায়ের আচারণে ব্যথিত হয়েছ, কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করতে পারছিনা সামাজিকতা রক্ষা করতে উনারা ব্যর্থ হয়েছেন। আমাদেরকে অনেকের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের অনুপস্থিতিতে। তাই হয়তো মা ক্ষোভ থেকে এমন করেছেন। তুমি মনে কষ্ট নিও না।”
আমি কোনোকিছু ই অনুভব করি না, না লজ্জা না অপমান। আমার ভরা সংসার, তাই এখানে মানুষের পরিমাণ বেশি। আত্মীয় স্বজনের আনোগোনাও বেশি। এই জনসমাগমে বৌয়ের বাড়ির কেউ উপস্থিত ছিল না টের পাওয়া কঠিন কিছু নয়। তাই ব্যাপারটা স্বভাবতই দৃষ্টি কটু ঠেকেছে বলা বাহুল্য। শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের মান রাখতে বাবা মাকে কত কী করতে হয়, তবুও মেয়ে মান পাবে সেই নিশ্চয়তা থাকেনা। সেখানে আমার পরিবার তো কিছুই করছেনা। তাই আমি এখানে মন খারাপ করার কারণ পাই না, কেউ কিছু বললেও হাসিমুখে এড়িয়ে যাই।
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম বাবুনীর নাম কী রাখা যায়। কত কী ভাবছি কোনোটাই মনমতো হচ্ছে না। অবশেষে বিরক্ত হয়ে বললাম, “এই ঘুমিয়ে পড়েছেন?”
“নাহ, বলো কী বলবে?”
“ওর নাম কী রাখবেন ভেবেছেন?”
“হুম।”
“কী শুনি?”
“তোমার কোনো নাম পছন্দ করা আছে?”
“নাহ, সেটাই ভাবছিলাম এতোক্ষণ। আপনি বলেন দেখি।”
“মায়সারা তেহরিম নিসা। পছন্দ হয়?”
“বাহ সুন্দর তো…”
“যাক তোমার পছন্দ হলেই হলো। তুমি চাইলে নিকনেইম বদলাতে পারো। ”
“নাহ এটাই সুন্দর। আপনি এই নাম কী এখন ঠিক করেছেন?”
“নাহ, আরো আগে গুগল ঘেঁটে ঠিক করেছি।”
“আরো আগে? আপনি কী মেয়ের আশা করেছিলেন?”
“যে ই আসতো আমার অসুবিধা ছিল না, তবে মেয়ে হওয়ায় আমি বেশি খুশি হয়েছি। ১ম সন্তান মেয়ে হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার…”
“দেখছি তো,,ও আসার পর থেকে আপনি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। এখনি এই অবস্থা ক’দিন পর তো আমি যে আছি এটাই ভুলে বসবেন!”
উনি আমার কথা শুনে উঠে বসলেন আমার চোখের দিকে চেয়ে বললেন, “স্ত্রী আর সন্তান কী এক মৃত্তিকা? আমার জীবনে তোমার গুরুত্ব কতখানি তা কী আমায় মুখে বলতে হবে? আমার চোখ দেখে কী কিছুই বুঝতে পারোনা?”
আমি উনার গলা জড়িয়ে কাছে টেনে বললাম, “অনুভূতি প্রকাশ করলে কী বেশি ক্ষতি হয়? কানের ও তো অধিকার আছে মনের খবর শোনার!”
উনি আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, “আমি কথায় না কাজে বিশ্বাসী। আমি চাই আপনার সকল ইন্দ্রিয় টের পাক আমার মনের খবর। আমি মুখে কিছু বলবোনা…”
“এ আপনার ভারী অন্যায়।”
“এখানে অন্যায়ের কী হলো?”
“কিছু হয়নি বলছেন? আপনি ইচ্ছে করে একটা সাসপেন্স ধরে রাখবেন আর আমি দোটানায় ভুগবো তাতো হবেনা। সবকিছু স্ট্রেইট কাট হতে হবে।”
উনি কিছু বললেন না। চুপচাপ আমার দিকে চেয়ে রইলেন। তার নিঃশ্বাসের গরম স্পর্শ আমার নাকে মুখে পড়ছে। আমি অন্য দিকে চেয়ে বললাম, “এমনভাবে তাকিয়ে আছেন যে? কথার জবাব দিন?”
“মৃত্তিকা….”
“হুম?”
উনি আমার কপালে গাঢ় চুমু এঁকে বললেন, “ঘুমিয়ে পড়ো, অনেক রাত হয়েছে।”
বলেই উনি সরে গেলেন। অথচ তার গলা শুনে মনে হয়েছিল………….
আমি মুগ্ধ হয়ে মানুষটার সংযমী রূপ টা পরোখ করলাম।
।
নিসার আকিকার অনুষ্ঠানের দিন সকালে তৈমুর আমার জন্য একটা সি গ্রীন কালারের শাড়ি এনে বলল, “আজকের প্রোগ্রামে এটা পড়বে।”
আমি শাড়িটা উল্টেপাল্টে দেখে বললাম, “এই কালারটা আমি কখনোই পড়িনি, আমাকে মানাবে কি না কে জানে!”
“পছন্দ না হলে বাদ দাও পড়তে হবেনা। তুমি তোমার ইচ্ছে মতো যেকোনো শাড়ি পড়ে নাও।”
“আপনি কী রাগ করলেন? আমি পড়বোনা বলিনি তো।”
তৈমুর আমার চিবুক তুলে ঠান্ডা গলায় বললেন, “সবকিছুতে এডজাস্ট করা কে শিখিয়েছে তোমাকে? নিজের পছন্দ অপছন্দ বলতে সাহস হয়না কেন? আমি কী তোমার দূরের কেউ? এতো মাসে কেন একটাবার দেখলাম না আমার হ্যাঁ এর অপজিটে না বলতে? আমি এমন স্বৈরশাসন তো চাইনি মৃত্তিকা!”
আমি তার কথায় বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। আমি সবসময় ভেবেছি আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যম হলো যা বলবে তা মেনে নেওয়া, তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। আমার ব্যক্তিগত পছন্দ বা মতামত বলেও যে কিছু আছে তা তো আমি ভুলে গেছি বহু আগে। আমাকে সবসময় বলা হয়েছে পরের ঘর করতে গেলে নিজের শখ আহ্লাদ বলে কিছু থাকেনা। তাই মেয়েদের বাপের বাড়ি থেকেই প্রশিক্ষণ নিতে হয়। আমি ভেবেছিলাম আমি তৈমুরের চোখে একজন আদর্শ স্ত্রীর নমুনা হয়ে আছি। কিন্তু সে যে এই আদর্শে খুশি নয় তা আমি সত্যিই বুঝি নি। তৈমুর আমার কাঁধ ঝাঁকিয়ে ধ্যান ভাঙিয়ে বললো, “কেউ যখন একতরফা বারবার স্যাক্রিফাইস করে তখন একটা পর্যায়ে সে ক্লান্ত হয়ে যায়, সম্পর্কের নাম যাই হোক সে ওটাতে আর আনন্দের উৎস খুঁজে পায়না। বরং একটা চাপিয়ে দেওয়া মস্ত বড় বোঝা মনে করে। আমাদের সম্পর্কের জার্নি তো স্বল্পকালীন নয়। তবে তুমি কেন এটায় নিজের মাঝে তিক্ততা আনতে চাচ্ছো?”
“আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন, আমার উদ্দেশ্য আপনাকে হার্ট করা ছিল না।”
“তুমি আমার কথা উপলব্ধি করতে পারছোনা, তোমার মাথায় এখনো ঘুরছে আমি কোনোভাবে হার্ট হলাম কি না!”
আমি খুব নার্ভাস হয়ে পড়লাম, তার কথার পিঠে কী বলবো মাথায় আসছিল না। তৈমুর আমাকে আলমিরার সামনে নিয়ে দরজা খুলে বলল, “এখানে তোমার পছন্দের শাড়ি কোনটা বলো। যদি একটাও পছন্দের না থাকে সেটাও বলবা। দ্রুত…”
আমি ভয়ের চোটে আন্দাজে একটা শাড়ি নিয়ে বললাম, “এটা আমার পছন্দের।”
সে আমার কথা বিশ্বাস করলো বলে মনে হয়নি। নেহাতই বাবুনী অনেক ছোট আর আমি শারীরিক ভাবে স্ট্যাবল নই বলে সে আমায় শপিং এ নিয়ে যায়নি। তবে শপিং এ গিয়ে ভিডিও কল করে সব শাড়ির কালেকশন দেখিয়ে বলেছে কোনটা পছন্দ হয় বলতে। আমি ফোনের এপাশে বসে ব্যাক ক্যামেরা অন করে অঝোরে কাঁদছিলাম। আমি জানি না আমার কেন এতো কান্না আসছিল। এই কান্নার কারণ সুখ নাকি দুঃখ তাও জানি না। আমার শুধু মনে হচ্ছিল এই ২১ বছরের জীবনে আমাকে কেউ এভাবে জিজ্ঞেস করেনি কোনটা পছন্দ! না আমার সামনে অপশন রাখা হয়েছিল যেকোনো একটা মনমতো চুজ করার। আজ তৈমুর এটা করেছে.. সে হয়তো জানে কিংবা জানেনা। তবে তার এই কর্মকাণ্ড আমার মনের কতটা গভীরে গিয়ে স্পর্শ করেছে তা দেখানোর সাধ্য আমার নেই। এই জীবনে প্রথমবার আমি নিজের মেয়ের আকিকাতে নিজের পছন্দের শাড়ি গায়ে জড়িয়েছি। তৈমুর আমার জীবনের এই অসাধ্য সাধন করেছে।
।
রান্নার পাট চুকিয়ে গোসলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন কল আসে আব্বু স্ট্রোক করেছেন। কন্ডিশন বেশি ভালো না দ্রুত যেন হাসপাতালে যাই। আমি সেই অবস্থাতেই আমার শ্বশুরের সঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে হসপিটালে পৌঁছাই। ওখানে গিয়ে শুনি আব্বুর এক হাত প্যারালাইজড হবার সম্ভাবনা আছে। উনার বাম পাশ রেসপন্স করছেনা। আমি করিডরে বসে কাঁদছিলাম তখন ডালি আপা এসে আমার পাশে বসলেন। তার গায়ের থেকে দামি পারফিউম এর ঘ্রাণ আসছিল, আপার সৌন্দর্য আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়ে গেছে। আমি কান্না ভুলে ফ্যালফ্যাল করে আপার দিকে চেয়ে রইলাম। আপা আমার দিকে এক নজর পরোখ করে বললেন, “তোর অবস্থা এতো জঘন্য হয়ে আছে কেন? কয়দিন গোসল করিস না? পুরাই রহিমা খালা বনে গেছিস দেখছি! বাইরে আসার আগে একটু আয়না দেখবি না?”
আমি আপাকে কোনো জবাব দিলাম না শুধু হাসলাম। আব্বুর আমার প্রতি মায়া থাকুক কী না থাকুক আমার তো আছে। তাকে হাসপাতালে আনা হয়েছে এইটুকু শুনে আমার রূহ উড়ে গিয়েছিল, মনে সংশয় ছিল মৃতের খবর তো সরাসরি দেয়না কেউ। আমি তো নিশ্চিত ছিলাম না উনি আদৌ বেঁচে আছেন কি না। আমি জানিনা পৃথিবীর কোনো মেয়ে বাবার এমন খবর পেয়ে সেজেগুজে নিশ্চিন্তে আসতে পারে কি না। আমিতো পারিনি। আমি যে অবস্থায় ছিলাম সেই অবস্থাতেই দৌড়ে এসেছি। আমিতো ভাবিনি এই সিচুয়েশনে আমার গেটাপ জাজ করা হবে। আমি পাশ ফিরে দেখি তৈমুর দাঁড়িয়ে আছেন। তার চেহারায় অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়না, সে আপার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টিতে চেয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি উঠে উনার কাছে যেতেই বললেন, “এখানে সবকিছু এখন স্বাভাবিক আছে। বাসায় চলো।”
“আব্বু কে কেবিনে আনার পর যাই?”
“কাল সকালে এসে দেখো।”
আমি উনার কথার টোন শুনে দ্বিমত করার সাহস পেলাম না। চুপচাপ তার সাথে বেরিয়ে এলাম। পুরো রাস্তা সে কোনো কথাই বলেনি। একমনে ড্রাইভ করে গেছে। বাসায় ফেরার পর সবাই আমাকে ঘিরে আব্বুর খবর নিতে এসেছিলেন, তৈমুর আমাকে রুমে যেতে বলে উনি নিজেই যাবতীয় খোঁজ খবর জানালেন। আমি রুমে এসেই শাওয়ার নিলাম। সারা শরীর রগড়ে রগড়ে লাল করে ফেললাম, তবুও মনে হচ্ছিল গায়ের ময়লা যাচ্ছে না। আমার নিজেকে খুব নোংরা মানুষ মনে হচ্ছিল, যার আশপাশ থেকেও দূর্গন্ধ ছড়ায়। সারাদিন কান্না করতে করতে আমার চোখ ফুলে ঢোল হয়ে আছে, চোখে আর পানি নেই বের হবার মতো। কিন্তু বুকের ভেতর যে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে তা নিরাময় করবো কিভাবে কান্না ছাড়া? আমি তীব্র মাথা ব্যথা নিয়ে ও কেঁদে যাচ্ছিলাম। আমার ভীষণ মন খারাপ হচ্ছিলো, আমি কেন আজ ভালোভাবে যাই নি। কেন এত মাস পর আপার সামনে আমার এমন রূপে উপস্থিত হওয়া লাগলো!
দরজার টোকার শব্দ শুনে ট্যাপ বন্ধ করে শোনার চেষ্টা করি। তৈমুর দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “মৃত্তিকা দরজা খোলো…”
“আমার গোসল শেষ হয়নি, ৫মিনিট সময় দিন বের হচ্ছি।”
উনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “কান্না বন্ধ করে বেরিয়ে এসো। তোমার শাওয়ার নিতে কয় মিনিট লাগে আমার ভালো করেই জানা আছে।”
অগত্যা আমি দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। আচমকা উনি আমার মাথার পেছনে চেপে ধরে ঠোঁটে চুমু খেতে শুরু করলেন। আমি চোখ বড় বড় করে তার দিকে চেয়ে রইলাম। সে আমার চাহনির তোয়াক্কা না করে আরো গভীর করে আলিঙ্গন করলো। বিস্ময়ে আমি নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেলাম। এই লোকটা আমাকে দম আটকে মেরে ফেলার পায়তারা করছে নাকি!!
চলবে…..