অভিলাষী পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
2

#অভিলাষী (৬ষ্ঠ পর্ব)

#আরশিয়া_জান্নাত

মানুষ জীবনে যা পায়না তা নিয়ে তার যতো অনুযোগ অভিযোগ মনের মাঝে পুষে রাখে, তার বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা পাওয়া জিনিসগুলো নিয়ে যদি করতো হয়তো কুলিয়ে উঠতে পারতোনা। সেই সুবাদে আজকাল নিজেকে অকৃতজ্ঞ ই মনে হয়। আমার শ্বশুর আমাকে অনেক স্নেহ করেন, দাদীজান তো আছেন ই। আর বাকি সদস্যরাও খারাপ না। শাশুড়ি সমাজ তথা মা, চাচী, ফুফু,খালা এনারা আজীবন ই একটু বাঁকা কথার মানুষ হয়ে থাকেন। উনাদের নিয়ে মন খারাপ করলে জীবনে আর সুখী হবার সময় হবেনা।
আমি ও তাই তাদের কথা বা কাজের উপর ভিত্তি করে আমার জীবনের সুখ মাপি না।

ছোট ভাইয়ার বিয়ে উপলক্ষে বাসায় যেতে হবে। শুনেছি খুব ভালো ঘরেই সমন্ধ হয়েছে। এই প্রপোজাল টা ডালি আপার শ্বশুর পক্ষের হওয়ায় মাও ভীষণ আনন্দিত। ওমন বনেদি বাড়ির মেয়ে তার ছেলের বৌ হয়ে আসবে এতে তিনি ভীষণ খুশি। ফোনে কথা শুনে তেমনটাই মনে হয়েছে। ওখানে যাওয়ার কথা তুলতেই তৈমুরের চেহারা বদলে গেল। সে গম্ভীর গলায় বললো, “বিয়ে উপলক্ষে এমনিতেই ঘরভর্তি গেস্ট হবে, সেখানে থাকার চিন্তা নিয়ে না গেলে হয়না? দূরত্ব তো বেশি না, এতে বাড়তি চাপ ও কমবে…”
আমি বুঝলাম উনি সেখানে থাকতে ইচ্ছুক না। সম্পর্কের খাতিরে আতিথেয়তা রক্ষা করেই চলে আসতে চাইছেন। আমি এটা ওটা বলে কনভিন্স করার চেষ্টা করেছি। উনি শর্ত জুড়ে দিলেন যদি সেখানে তার মনে হয় থাকা উচিৎ হবেনা তবে আমি যেন দ্বিমত না করে তার সিদ্ধান্ত মেনে নেই। আমি ও কম নই, পাল্টা শর্ত দিয়ে বললাম, “ধৈর্য ধারণ করা আবশ্যক। অল্পতেই রাগ করা যাবেনা।”

নিসা ঘুরে ঘুরে শুধু ছড়া কাটছে,

“তাই তাই তাই ,মামা বাড়ি যাই
মামাবাড়ি ভারী মজা , কিল চড় নাই
মামী দিলো দুধভাত ,দুয়ারে বসে খাই”

আমি ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৈমুরের অপেক্ষা করছিলাম তখন মা এসে বললেন,”বিয়ে বাড়িতে গিয়ে হাসি ঠাট্টায় মশগুল হয়ে বাচ্চার কথা ভুলে যেওনা। ওখানে অনেক রকম মানুষ আসবে, বাচ্চারা আসবে। আমার নাতনিকে চোখে চোখে রাখবা।”

বলেই উনি নিসার কোমরে একটা কালো সুতো বেঁধে দিলেন। মায়ের বাসায় যাওয়ার আগে এই কাজটা উনি সবসময় করেন। শুরু তে কারণটা বুঝতাম না, পরে বুঝলাম এটা দ্বারা তিনি নিসার শারীরিক গঠনের পার্থক্য মাপেন। সোজা কথায় ওখানে গিয়ে নিসা শুকিয়েছে নাকি মোটা হয়েছে তা আন্দাজ করার একটা কৌশল!
মানুষের কত আজগুবি কর্মকাণ্ড!

আম্মু যদিও বলেছিল আমার শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে যেতে। কিন্তু বাবা রাজি হলেন না। বললেন সরাসরি বিয়েতে উপস্থিত থাকবেন।

বাসায় গিয়ে দেখি এলাহি অবস্থা। ঘরভর্তি আত্মীয়স্বজনের ভীড়। ইতোমধ্যেই সবাই উপস্থিত হয়ে গেছেন। আমাকে দেখে টুম্পা ভাবী বললেন,”এজন্যই বলে মক্কার মানুষ হজ্জের টিকিট পায়না। আমরা দূর দূরান্ত থেকে আগে আগে চলে এসেছি আর তুমি কাছে থেকে আজ এলে!”

আমি হেসে কথাটা উড়িয়ে দিলাম। আমার মেয়ে কে দেখে আমার মামাতো ভাই শামীম কোলে তুলে বললো, “মৃত্তিকা তোর মেয়ে তো মাশাআল্লাহ অনেক কিউট হয়েছে পুরাই পুতুল।”

টুম্পা ভাবি,”মায়ের কপি হয়েছে বলে কথা!”

শামীম নিসাকে মামা মামা বলে জান দিয়ে ফেললো। নিসাও আদর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই শামীমের সাথে বেশ মিশে গেল। আমার মেয়ে কে নিয়ে আমার পরিবারের বিশেষ আগ্রহ না থাকলেও অন্যদের খুব সহজেই আগ্রহ জন্মে যায়। ডালি আপার ছেলে খুব রগচটা স্বভাবের হয়েছে। যেখানেই যাচ্ছে তান্ডব চালাচ্ছে। ওর চিৎকার চেঁচামেচিতে পুরো ঘর মাথায় উঠার উপক্রম। ছেলেটাকে কেউ একটু ডাক ও দেয়না। ওর দস্যিপনা দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। এইটুকু বয়সে এতো রাগ ওর! ছেলেদের রাগ বেশি হয় দুষ্টু ও তুলনামূলক বেশি হয়‌ তাই বলে এতো আমি ভাবিনি। রাতুলকে দেখে আমার এটাই মনে হলো ভাগ্যিস আমার ছেলে হয়নি!
ডালি আপা আমাকে দেখে বললেন, “খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে ডায়েট করছিস নাকি? ওজন কত এখন?”

“আমার হাইট অনুযায়ী পারফেক্ট ই আছে। শুনলাম তোর নাকি কোলেস্টেরল বেড়ে গেছে? প্রি-ডাইবেটিস টার্মে আছিস!”

“এসব এখন খুব কমন রোগ। তাছাড়া আব্বুর ডায়বেটিস ছিল, আবার মামাদের ও আছে। বংশানুক্রমে এটা হবেই স্বাভাবিক।”

“হুম তাও ঠিক। দুলাভাই আসেনাই?”

“আমরা আসছি ১০/১৫দিন হবে। ও এখান‌ থেকেই অফিস করে তো, তাই অফিসে গেছে।”

“ওহ।”

“বিয়ের শপিং করা কি যে কঠিন কাজ! রাকিবের(ছোট ভাইয়া) একটাই কথা আমার পছন্দের বাইরে কোনোকিছু কেনা যাবেনা। তাই আমাকেই রোজ শপিং এ গিয়ে সব সিলেক্ট করা লাগছে। বুঝতেই পারছিস কত চাপে ছিলাম‌”

“হুম অনেক কষ্ট গেল!”

ডালি আপা নিজের কথা বলা শেষ করে চলে গেলেন। আমি রুমে বসে দম নিলাম। নাহ কোনোকিছু কে তোয়াক্কা করা যাবেনা। আমি দু’টো দিনের অতিথি হয়ে এসেছি এই দু’টো দিন স্বাভাবিক ভাবে কাটাবো। কে কি করছে কাকে গুরুত্ব দিচ্ছে ওসবে তাকানোর ও দরকার নেই।

নিসা দু হাত ভর্তি চিপস চকোলেট নিয়ে এসে বললো, “আম্মু মামা অনেক ভালো। দেখো আমাকে কতকিছু কিনে দিয়েছে।”

“তুমি একা একা এগুলো খাবে?”

“আপু ভাইয়াদের জন্য রেখে দাও। বাসায় ফিরলে ওদের দিবো।”

“তা দিবে, তবে এখানে ও যে তোমার অনেক আপু ভাইয়া আছে ওদের না দিলে কান্না করবে না?”

নিসা গালে হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ার ভাভ নিয়ে বললো, “আম্মু এখানে তো অনেক বেবি। সবাইকে দিলে ওদের জন্য থাকবে?”

“ওদের জন্য আম্মু কিনে‌ নিবো, তুমি এখন এখানের সবাইকে দিয়ে খাও কেমন?”

“আচ্ছা।”

নিসা খুব আগ্রহ নিয়ে ওর‌ নতুন ভাইবোনের সাথে খাবার ভাগাভাগি করতে গেলো। সেই সুযোগে আমি ওকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম।

“মৃত্তিকা শুনে যা।”

মায়ের ডাকে আমি উনার ঘরে গিয়ে বসলাম। উনি নিজের হাঁটু ঘষতে ঘষতে বললেন, “তোকে বলেছিলাম সবাইকে নিয়ে আসতে, এলিনা কেন?”

“এমনিতেই এখানে এতো মানুষ, উনারা এসে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে চায়নি তাই আসেনি।”

“বাড়তি চাপের কী আছে তোর শ্বশুরবাড়ি দূরে হলেও কী সবাইকে নিয়ে আসতি না ভাইয়ের বিয়েতে?”

“যেটা হয়নি সেটা কল্পনা করে লাভ কি?”

“তোর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমাদেরকে পছন্দ করেনা এটা না বোঝার মতো কিছু না। তোর বাবা মারা যাওয়ার পর সেই গেছিস এসেছিস আজকে। একই শহরে থেকে ও তুই আসিস না। এই যে দূরত্ব সৃষ্টি করলি কী ভাবিস এতে তুই লাভবান হচ্ছিস? মোটেই না। শ্বশুরবাড়িতে বাপের বাড়ির নাম ছোট করে কেউ কোনোদিন সুখ পায়না। বরং খোঁটা খেয়ে খেয়ে সবসময় পায়ের তলানিতে পড়ে থাকতে হয়। ”

আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। হাসিমুখে ই বললাম, “পথটা তো তোমরাই চেনালে! আমি আসিনি তোমরাও তো আনতে যাওনি‌। বিয়ের পর কয়বার সেখানে চৌকাঠ মারিয়েছ এক আঙ্গুলের কড়াতেই গোনা যাবে। অথচ ডালি আপা….”

“তোর এই তুলনার স্বভাব গেলো না! ডালি কী তোর মতো অতিথি হয়ে আসে? এই বিয়ের সব যোগাড় যন্ত্র ও একা করেছে, মেয়ে দেখা থেকে শুরু করে সবকিছু তো ও ই করলো। তারপরও তোর মনে হচ্ছে ওর সঙ্গে তোর তুলনা খাটে? তুই কী করেছিস এই পর্যন্ত?”

আমি ড্রয়ার থেকে মুভ ক্রিম বের করে মায়ের হাঁটু তে মালিশ করতে করতে বললাম, “আমার সংসারে গিয়ে একটা দিন থেকো। জাস্ট একটা দিন, তারপর নাহয় দোষ দিও!”

আম্মু মুখ ভার করে অন্যদিকে তাকালেন। আমি পরম যত্নে উনার পা মালিশ করছি আর চোখের পানি আটকানোর কঠিন প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।

“মৃত্তিকা ঘুমিয়ে পড়েছ?”

“এখানে ঘুমাতে অসুবিধা হচ্ছে?”

“নাহ ঠিকাছে”

“কিছু বলবেন?”

“তুমি ঠিক আছ?”

“হ্যাঁ, ঠিক না থাকার কী আছে!”

তৈমুর কি ভেবে নিরব হয়ে গেল। আমার চুলে বিলি কেটে নরম গলায় বলল, “রাগ করেছ প্রশ্ন টা করায়?”

“নাহ।”

“এরকম মন‌ভার করে আছ যে? শরীর ঠিকাছে?”

আমি উনার দিকে ফিরে বললাম,”মানুষ বিরিয়ানি না, সে চাইলেই সবাইকে তৃপ্ত করতে পারেনা। এই চরম সত্যি টা যে যত দ্রুত মেনে নিবে সে ততোই দ্রুত সুখে থাকা শিখবে!”

“হঠাৎ ফিলোসফি ঝাড়ছো যে! সক্রেটিস ভর করলো নাকি?”

“নাহ আত্মোপলব্ধি করার চেষ্টা করছি। আচ্ছা একটা কথা বলবেন?”

“কি কথা?”

“বলুন তো আমি দেখতে সুন্দর নাকি কুৎসিত?”

“কুৎসিত না। আল্লাহর বানানো কোনো মানুষ ই দেখতে কুৎসিত নয়। কেউ কিছু বলেছে?”

“না।”

উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনার স্বরে বললেন,”নিজেকে কখনো অন্য কারো সঙ্গে তুলনা করবেনা। প্রতিটি মানুষ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কেউ ই কারো মতো নয়, সবার মাঝেই বৈচিত্র্যতা আছে।”

“আচ্ছা।”

বিয়ের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমি নিরবেই ফিরে আসি। আমি পারফেক্ট মেয়ে হতে পারবোনা কোনোদিন। না পারবো নিজের সংসার ফেলে অন্য কারো সংসারের খড়ি নাচাতে। এসব কাজ তারাই করতে পারে যাদের হাতে অফুরন্ত সময়। আমার যেটা নেই সেটা নিয়ে আফসোস করে লাভ কি! আমি এই পর্যন্ত কোনোদিন তাদের নিয়ে এই বাড়িতে কাউকে কিছু বলিনি, এমনকি তৈমুর কেও না। অথচ আমার মা কী অনায়াসে বলে ফেলেছে আমি তাদের ছোট করেছি। উনি যেন একদম ভুলেই গেছেন তাদের কৃতকর্মের ফলেই এই বিরূপ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। নিজের ভুল ঢেকে অন্যকে দোষারোপ করে আত্মতৃপ্তি পাওয়া বোধহয় মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। বিয়েতে আমার উপস্থিতি মিস্টার ইন্ডিয়ার মতোই ছিল। আমি থাকা না থাকা প্রায় সমান। আমি ও বাড়িতে যেতে চাই না, ওখানে গেলে আমার মন খারাপ হয়। যার রেশ কাটতে বহুদিন লাগে। অথচ আমি এই সময়টায় সবসময় মুখোশ পড়ে রাখি। কেউ যেন বুঝতে না পারে আমার মন খারাপ। ইচ্ছে করে রোজ কানে ফোন তুলে অভিনয় করি যেন মা ফোন করেছেন, ভাইয়েরা খবর নিচ্ছেন। অথচ ওরা কেউ ই ফোন করেনা। আমি করলে নানান অজুহাতে শর্টকাটে রেখে দেয়। আমার জায়ের মা প্রায়দিন ভিডিও কল করে নাতনিকে দেখে, কথা বলে। আমার নিসাকে তো কেউ কোনোদিন ভিডিও কলে দেখতে চায়নি। ঐ অভিনয়টুকু আমি কী করে করি? আমি একা যতটা পারি করে যাই, তোমরা কেউ তো সিকিভাগ ও করছোনা। তবে আমাকে নিয়ে এতো জঘন্য ভাবনা পুষে কি মজা পাও!
আমার মনে হয় একশহরে বিয়ে হয়ে ক্ষতি হয়েছে। আমার এমন শহরে বিয়ে হওয়া উচিৎ ছিল যেখান থেকে আসবো বললেও ২/৩দিনের সফর করা লাগবে। অথবা যেখানে নেটওয়ার্ক খুব লো।

আকাশে ঘনঘটা করে আঁধার নেমেছে, ঠিক যেন আমার মনের বহিঃপ্রকাশ। আমি ছাদের কাপড়গুলো চিলেকোঠায় রেখে ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। ঝুমবৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন গায়ে কাঁটার মতো ফুটছে। আমি আগেপরের ভাবনা ভুলে মোহগ্রস্তের মতো বৃষ্টিতে ভিজতে থাকি। বৃষ্টিতে ভিজলে আমার মাথায় নানারকম বুদ্ধির উদয় হয়। একটা সুপ্ত ইচ্ছা খুব নড়েচড়ে জেগে উঠে। আমি সেই ইচ্ছা পূরণের চেষ্টা করেছিলাম ও বহুবার। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর পূরণ করা হয়নি কোনোভাবেই। আজ বহুবছর পর সেটা আবার জেগে উঠেছে। আকাশে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আরো জোরে বৃষ্টি নামছে। দুপুরের এই অলস সময়টায় বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে ই থাকে। নিসাও তার দাদীর সাথে ঘুমাচ্ছে। আমার ই শুধু দুপুরে ঘুম আসেনা। এই সময়টা আমার অসহনীয় অবসরে কাটে।
বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে যা দোয়া করা হয় তাই নাকি কবুল হয়। আমি দুহাত উঁচু করে বললাম,

“আমার মেয়েটাকে তুমি অনেক সুখে রেখো। সবার মধ্যমণি করে রেখো। ওকে যেন কেউ কোনোদিন কষ্ট না দেয়…”

পানির স্রোতে উঠোনটা ভেসে যাচ্ছে। জমাটবাঁধা পানিতেই উপুড় হয়ে পড়ে আছে মৃত্তিকা। তাকে দেখে যে কারো মনে হবে সে খুব আরামে ঘুমাচ্ছে। হয়তো হাতে পায়ে আলতা মেখে রাখায় বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে রাঙা হয়েছে চারপাশ। বৃষ্টির শব্দে কেউ টের পেলোনা তাদের আরামের ঘুমের মাঝে এই বাড়ির বড় বৌটাও নিশ্চিন্তে ঘুমের দেশে হারিয়েছে…..

পরিশিষ্ট: নিসা হাসিমুখে দু’হাত মেলে বসে আছে। দুজন মেয়ে তার হাতে মেহেদি লাগাচ্ছে। পাশে অন্যরা গানের কলি খেলছে আর হাসি তামাশা করছে। আজ তার গায়ে হলুদ ছিল। আগামীকাল তার বিয়ে। বিয়েটা তার পছন্দসই পাত্রের সঙ্গে ই হচ্ছে বলে তার চোখেমুখে অন্যরকম আনন্দ। একটু পরপর কেউ না কেউ এসে তার খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছে। কিছু লাগবে কি না, কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না প্রভৃতি। তার মায়ের জীবনের একটাই অভিলাষ পূর্ণ হয়েছে। সে সবার মধ্যমণি হয়েই বেড়ে উঠেছে। খুব আদরের মৃত্তিকার মেয়ে হয়েই বেড়ে উঠেছে।

তৈমুরের মন একটুও ভালো নেই। মেয়ে বিয়ের দিনগুলো তে কোনো বাবার ই মন ভালো থাকেনা। তবু বুকে পাথর চেপে সে বসে আছে। নিসার মুখ দেখে তার ভালো লাগছে ওর মুখে মৃত্তিকার মুখের মতো অবসাদ নেই। বিয়ের দিন যখন ১ম বার মৃত্তিকা কে দেখেছিল মনে হয়েছিল রাজ্যের সব দুঃখ মেয়েটার চেহারায় ভিড় করেছে। তৈমুর ভেবেছিল বিয়ের দিন বলে হয়তো! আনুগত্য বান্দার মতো সব কাজ নিরবে সম্পাদন করা মেয়েটাকে ওর রোবট ই মনে হতো। এ কেমন মেয়ে যার কোনো শখ নেই, আহ্লাদ নেই। কোনো আবদার নেই কিছু নিয়ে। শুরুতে এতে স্বস্তি খুঁজে পেলেও পরে এটায় খুব জ্বলতো তৈমুরের। ও চাইতো মৃত্তিকা মুখ ফুটে বলুক, ওর কী লাগবে কী পছন্দ সব বলুক। তৈমুর সব হাজির করবে বৈকি!
অথচ মেয়েটাকে ও কোনোদিন বলতে পারেনি ওর বুকে কতটা ভালোবাসা জমেছিল। তৈমুর তো কোনোদিন ভাবেনি মৃত্তিকা তাকে এতো তাড়াতাড়ি একা রেখে চলে যাবে। আজকাল ওর এই ভেবেই বরং আফসোস হয় কেন সে একটাবারও বলেনি ও মৃত্তিকা কে কতটা ভালোবাসে। কিংবা সেই রাতে যখন ও জানতে চেয়েছিল ও সুন্দর না কুৎসিত, তখন কেন ওর প্রশংসা করে বলেনি ও এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রমণী!
মৃত্তিকা শুনতে চাইতো তৈমুর শোনায়নি, কেউই শোনায়নি। ওর প্রতি এ বাড়ির সবার মনে যে অপার মায়া তা প্রকাশ করা হয়নি। যদি জানতো ওর জীবনে সুন্দর মিষ্টি কথা শোনার অভাব, তবে হয়তো সবাই ওকে ভালো কথা শোনাতো। এই তৃষ্ণায় ওকে মরতে হতোনা।
মানুষের কতরকম তৃষ্ণা থাকে তাই না! কাউকে দেখার তৃষ্ণা, মনের কথা বলার তৃষ্ণা, ভালো কথা শোনার তৃষ্ণা। তৈমুরের নিজের প্রতি বিরক্ত লাগে এই ভেবেই সে জানতো এই তৃষ্ণা ওর ছিল তবুও কখনো মেটায়নি। ওকে মুখে বলেনি ভালোবাসি! আচ্ছা যদি সে একবারও বলতো তবে কী মৃত্তিকা আজ ওর পাশে থাকতো?

তৈমুরের চোখ ভিজে আসে। ওর মনে হয় ও খুব খারাপ মানুষ। নয়তো মৃত্তিকার শোকে ও মরলো না কেন? ও তো ভেবেছিল ওকে ছাড়া সে এক মুহুর্ত ও বাঁচবে না। অথচ কি নিষ্ঠুর ভাবেই সে বছরের পর বছর বেঁচে আছে… মানুষ আসলেই কঠিন ইস্পাতে গড়া, কারো বিচ্ছেদে কেউ মরে না।

~সমাপ্ত