অমানিশার মধ্যরাত পর্ব-০১

0
2058

#অমানিশার_মধ্যরাত (১)
লিখা: আতিয়া আদিবা
#পর্ব_১ (১৮+)

সদ্য ক্লাস নাইনে উত্তীর্ণ একটি মেয়ে প্রেগনেন্সি কীট কিনতে ফার্মেসিতে এসেছে। বিষয়টি অবিশ্বাস্য। কিন্তু এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটি এখন ঘটছে মকবুলের ফার্মেসিতে। মকবুল কটুক্তির চোখে মেয়েটিকে দেখছে। মুখ ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে_ ছি:! এই বয়সে এসব? নষ্টা মাগী জানি কোথাকার।
এই নষ্টা মাগীদের জন্যই সমাজটা দিন দিন নর্দমায় পরিণত হচ্ছে। বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায় না। চারিদিকে দুর্গন্ধ! ছি:

অমানিশার পুরো শরীর এখনো কাঁপছে। সন্তপর্ণে চতুর্দিকে চোখ বোলাচ্ছে বারবার। গায়ে স্কুলের ইউনিফর্ম। কেউ তাকে দেখছে না তো? কাঁপা গলায় সে পুনরায় প্রশ্ন করল,
ভাইয়া, প্রেগনেন্সি কীট আছে কি?
মকবুল বিষদৃষ্টিতে অমানিশার দিকে তাঁকিয়ে উত্তর দিল, আছে।

ভাইয়া একটু তাড়াতাড়ি দিন। কাগজে মুড়িয়ে দিয়েন ভালো করে।

মকবুল প্রেগনেন্সি কীট কাগজে মোড়াতে মোড়াতে দাঁতের ফাঁক দিয়ে নিচু স্বরে গালি দিল, বেশ্যার ঘরের বেশ্যা!

কত টাকা ভাইয়া?

সত্তর টাকা।

থ্যাংক ইউ।

অমানিশা আরোও একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। এরপর যত দ্রুত সম্ভব ব্যাগে কীটটি ঢুকিয়ে ফেলল। ফার্মেসি থেকে বের হয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগল। আজকাল হাঁটতে বড় কষ্ট হয় তার। কয়েক কদম ফেললেই বুকটা ধরফর ধরফর করে। গত কয়েকদিন ধরে একদম খেতে পারছে না সে। শরীর জুড়ে অবসাদ। বড় ক্লান্ত লাগে। হাত পা অবশ হয়ে আসে।
অমানিশা ভ্রুঁ কুঁচকে আকাশের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল। সূর্য একদম মাথার ওপর। সমস্ত তাপ ঢেলে দিচ্ছে প্রকৃতিতে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। নাক ঘেমে উঠেছে। শ্যামবর্ণের মেয়ে বলে গালের লাল টুকটুকে আভা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে নি বরং তার মুখ আরোও কালো দেখাছে।

হঠাৎ অমানিশার মনে হল, লোকে বলে_ নাক ঘামলে নাকি জামাই আদর করে! তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসির দেখা মিলল।
কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে সে রিক্সা ডাকল। গন্তব্যস্থল ঠিক করে রিক্সায় জড়োসড়ো হয়ে বসল। ভালোমতো স্কার্ফ দিয়ে মুখ ঢেকে নিল। এক্ষুনি স্কুলের সামনে দিয়ে রিক্সা যাবে। টিফিন পিরিয়ডে কোনোভাবে গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাইরে এসেছে। ইউনিফর্ম পরিহিতা কাউকে দেখলে অবশ্যই গার্ড আটকাবে। জিজ্ঞাসাবাদ করবে।
– তুমি কোন শিফট এর? বাসা কোথায়? ইউনিফর্ম পরে বাইরে কেনো ঘুরছো? ইত্যাদি।
উত্তর মন:পুত না হলে সোজা হেডমাস্টারের ঘরে! অমানিশা এজাতীয় ঝক্কিঝামেলায় জড়াতে চাইছে না।

অবশ্য, এজাতীয় ঝক্কিঝামেলা তাকে পোহাতেও হল না।

স্কুলের সীমানা অতিক্রম করার সাথে সাথেই অমানিশা ব্যাগ থেকে একটি ছোট্ট বাটন ফোন বের করল। এই ফোনটি সে লুকিয়ে ব্যবহার করে শুধুমাত্র আহনাফের সাথে কথা বলার জন্য। অমানিশা আহনাফের নাম্বার ডায়াল করল। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে ভরাট কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

হ্যালো।

অমানিশার পুরো শরীরে যেন দ্রুতবেগে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হল। এই অনুভূতি তার কাছে নতুন নয়। যতবার সে আহনাফের কণ্ঠস্বর শুনে ঠিক ততবার তাকে এই অনুভূতি কাবু করে ফেলে। তার মুখের সমস্ত শব্দ কেড়ে নেয়। তাকে বোবা করে দেয়।

আহনাফ চিন্তিত স্বরে আবারও বলল,
হ্যালো নিশা, শুনতে পাচ্ছো?

তুমি বাসায় আছো?

হুঁ। আজ সকালে এসেছি।

আমি তোমার বাসায় আসছি।

আহনাফ ফিঁক করে হেসে ফেলল।
আবার স্কুল পালিয়েছো?

অমানিশা প্রত্যুত্তরে হাসল। বলল,
তোমার সাথে দেখা করার জন্য – একবার নয়, দুবার নয়, তিনবার নয়, সহস্রবার স্কুল পালাতে রাজী আছি!

আহনাফ জিজ্ঞেস করল, শুধু দেখা করার জন্য? – তার কণ্ঠস্বরে ভরপুর দুষ্টুমি।

অমানিশা এপ্রশ্নের উত্তর দিল না। বলল,
আমার আসতে আর পাঁচ মিনিট লাগবে।

সাবধানে এসো।

অমানিশা ফোন কেটে দিল।

আহনাফদের পাঁচ তলা বাসাটি তার বাবা, চাচা ও ফুফুরা মিলে করেছে। প্রতি ফ্লোরে দুটো করে ইউনিট। দোতলার একটি ইউনিটে আহনাফ তার মা এবং প্যারালাইজড বাবাকে নিয়ে থাকে। অন্য ইউনিটে ভাড়াটিয়া ছিল তবে গতমাসেই তারা ছেড়ে দিয়েছে। নতুন করে ভাড়া দেওয়া হয় নি। এ সুযোগে আহনাফ গাট্টি বোচকা নিয়ে খালি ইউনিটে গিয়ে উঠেছে।

বলিউডের ‘আশিকী টু’ মুভি মাত্র রিলিজ পেয়েছে। কি চমৎকার এই মুভির গানগুলো! সাউন্ডবক্সে উচ্চশব্দে ‘তুম হি হো’ গানটি শুনছিল আহনাফ। ঘরের জানালা বন্ধ। ভারী পর্দা টেনে রাখা। এদিকে একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকছে সে। অতিরিক্ত ধোঁয়ায় ঘরটাকে ভুতুড়ে দেখাচ্ছে।

ঠক ঠক। দরজায় দুইবার টোকা পড়ল। আহনাফ নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, কে?
ওপাশ থেকে অমানিশার মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া গেল।
আমি, আহনাফ। দরজা খোলো।

আহনাফ সিগারেটে লম্বা করে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দরজা খুলে দিল। অমানিশা ঘরে ঢুকতেই তাড়াহুড়ো করে দরজা লাগিয়ে দিল।

আহনাফের লাল টুকটুকে চোখ দেখে অমানিশা কিছু একটা বলতে চাইছিল। তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হল না। দেয়ালে হাত দুটো চেপে ধরে গভীরভাবে চুমু খেতে লাগল তার ঠোঁটে। নিশ্বাস ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হতে লাগল অমানিশার। আহনাফের ঠোঁটের ঢেউয়ের কারুকাজের কাছে নিজের প্রচেষ্টা বরাবরই তুচ্ছ মনে হয় তার। তবুও ভালোবাসা প্রকাশ করার এই মাধ্যমে অমানিশা কখনো ছাড়তে চায় না। নিজের সবটুকু দিয়ে ঠোঁটের এই খেলায় অংশগ্রহণ করে। আজও করল।

কতক্ষণ দুজন এভাবে মিশে ছিল সময়ও হয়তো হিসেব রাখে নি। এক পর্যায়ে দুজন শান্ত হয়ে পাশাপাশি বসল। অমানিশা হাঁপাচ্ছে। আহনাফ হেসে জিজ্ঞেস করল,
পানি খাবে?

অমানিশা মাথা ঝাঁকাল। আহনাফ তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিল। এক নিশ্বাসে প্রায় আধা বোতল পানি শেষ করল অমানিশা। আহনাফ ফ্লোর বেডে শুয়ে হাসিমুখে আরেকটি সিগারেট ধরালো। বিছানার একপাশে সাদা কাগজে গোলাপি রঙের তিনটি ট্যাবলেট রাখা। সেদিকে ঘৃণ্য চোখে ক্ষণিককাল তাকিয়ে রইল অমানিশা। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
আবার নেশা করেছো? তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে আর নেশা করবে না।

আহনাফ কোনো উত্তর দিল না। সিগারেট ফুঁকায় মন দিল।

অমানিশা অশ্রুসিক্ত চোখে বলল,
তুমি না বলেছিলে ডাক্তার দেখিয়েছো? নেশা ছাড়ার জন্য তোমাকে অনেক দামী দামী ওষুধ দিয়েছে? কোথায় সেগুলো? আমি কত কষ্ট করে অতগুলো টাকা এরেঞ্জ করেছি জানো? সোনার আংটিটা বিক্রি করতে হয়েছে!

আহা ওষুধগুলো আছে তো! মার ঘরে।

তোমার ওষুধ মার ঘরে কেনো?

মার ঘরে একটা বড় ঝুড়ি আছে। ওখানেই সব ওষুধগুলো রেখে দিয়েছি।

ওষুধও খাচ্ছো আবার নেশাও করছো?

একবারে কি ছাড়া যায়? আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, নিশা। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?

অবশ্যই, বিশ্বাস করি।

আহনাফ হেসে অমানিশাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলল। বলল,
তাহলে এত প্রশ্ন করছো কেন?

অমানিশা ছলছল চোখে বলল,
আমার অনেক ভয় করছে, আহনাফ।

কিসের ভয়?

অমানিশা ফুঁপিয়ে উঠল।

আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
বলো, কিসের ভয়?

আমার পিরিয়ড হচ্ছে না। অলরেডি পনেরো দিন লেট।

আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
এরপর জিজ্ঞেস করল, তোমার কি মনে হচ্ছে তুমি প্রেগন্যান্ট?

অমানিশা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

আহনাফ উল্লাসিত কণ্ঠে বলল,
আমি বাবা হব? তুমি মা হবে?

অমানিশা কঠিন গলায় বলল,
তোমার কি মনে হয় আমি মজা করছি?

আহনাফ অবাক হয়ে বলল,
আমিও তো মজা করছি না। প্রেগন্যান্সি কীট কিনেছো?

হুঁ।

তুমি কিনতে গেলে কেনো? আমাকে বললেই আমি কিনে দিতাম।

তোমাকে কল করলে তুমি ফোন ধরো? গত তিনদিন ধরে চেষ্টা করছি। রিং হয় অথচ তুমি ধরো না। আজকেও তুমি ফোন ধরবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ ছিল। আচ্ছা, তুমি ফোন কেনো ধরো না?

আহনাফ সহজ গলায় উত্তর দিল,
তুমি তো জানো আমি উদাস প্রকৃতির। আমি বাসায় ফোন ফেলেই আবিরদের গ্রামে চলে গিয়েছিলাম।

অমানিশা চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
আবির ভাইয়ার কাছে তো আমার নাম্বার আছে। উনাকেও আমি অনেকবার ফোন করেছি তোমার খোঁজ নিতে। উনিও ফোন ধরে নি। একটা ম্যাসেজ তো করতে পারো তুমি!

আহনাফ প্রসঙ্গ পালটে বলল,
আচ্ছা বাদ দাও না। এখন বলো তুমি প্রেগন্যান্ট হলে আমাদের কি করা উচিত?

অমানিশা লজ্জা পেয়ে বলল,
কি করা উচিত?

অবশ্যই বিয়ে করা উচিত। – একথা বলে অমানিশার কপাল থেকে চুল সরিয়ে ছোট্ট একটি চুমু খেলো আহনাফ। এরপর অমানিশার ঠোঁটের ওপর ঠোঁট চেপে ধরে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তুই কি আমায় শাসন করার ব্যক্তিগত রাণী হবি? আমার অগোছালো জীবন টা গুছিয়ে দিবি? আমার লক্ষ্মী বউ হবি, অমানিশা?

অমানিশা ছলছল চোখে আহনাফকে জিজ্ঞেস করল,
তুমি আমাকে সত্যিই বিয়ে করবে?

সত্যি, সত্যি, সত্যি! এইতো তিন সত্যি বলে দিলাম। টেস্ট করে রেজাল্ট কি আসে দেখো। এরপর আমরা যত দ্রুত সম্ভব সিদ্ধান্ত নেই। কেমন? আবির আর আমি একটা ব্যবসার পরিকল্পনা করছি। দোয়া করো আমাদের পরিকল্পনা যেন সফল হয়!

অমানিশা আহনাফের লোমশ বুকে মুখ ঘষে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

[গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে ]

চলবে।