গল্প: #অমানিশার_মধ্যরাত
লেখিকা: #আতিয়া_আদিবা
#পর্ব_২ (১৮+)
অমানিশার জীবনে আহনাফের অপর নাম বিশ্বাস। মা-বাবার পরেই আস্থার জায়গাটা বেশ পাকাপোক্ত করে নিয়েছে তেইশ বছর বয়সী টগবগে যুবক। মায়ের রূপের আদল খুঁজে পাওয়া যায় তার নিখুঁত চেহারায়।
ফর্সা, সুঠাম দেহ। গালভর্তি দাড়ি। এলোমেলো চুল। আহনাফ যেনো উপন্যাসের কোনো নায়কের বাস্তব শিলারূপ। যে অষ্টপ্রহর নিশ্বাস ফেলছে অমানিশার হৃদয়ে। ভুলিয়ে দিচ্ছে জগৎ-সংসার। জমিয়ে দিচ্ছে মস্তিষ্ক। কেড়ে নিচ্ছে ঠিক বেঠিক অনুধাবনের নিপুণতা। এ বয়সে আবেগের সাথে লড়াই করে বিবেকের হার – সে তো সর্বজনীন সত্য! এই সর্বজনীন সত্য হতে অমানিশা কিভাবে ছুটে পালাবে?
আহনাফ অমানিশার হাতজোড়া ধরে তার ঠোঁটে ঘষতে ঘষতে বলল,
হাতে মেহেদী দিও।
কেন?
আহনাফ ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে বলল,
সেকি! মেহেদী ছাড়া বিয়ে হয় নাকি?
অমানিশা লজ্জা পেয়ে পুনরায় আহনাফের লোমশ বুকে মুখ লুকালো। আহনাফ দুষ্টুমির ছলে বলল,
এখনো এত লজ্জা?
অমানিশা কোনো উত্তর দিল না। আহনাফ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
আবারো লজ্জা ভাঙ্গিয়ে দেই?
এই মোটেও না। আজ না, প্লিজ! শরীরটা ভালো লাগছে না।
অমানিশার এই তুচ্ছ আপত্তি আহনাফের উদ্দেশ্যে
কোনো প্রভাব ফেলল না। বরং সে উন্মাদের মত আচরণ করতে লাগল। অমানিশার মুখ চেপে ধরল। এই উন্মাদ আহনাফকে সে ভয় পায়। তার শরীরের পুরাতন ক্ষতগুলো আজও শুকায় নি। আহনাফের ঠোঁটে ভালোবাসার চিহ্ন আঁকা তার কাছে যতটা সুখকর, ঠিক ততটাই যন্ত্রণার শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে তাকে অনুভব করা। অমানিশার মনে প্রশ্ন জাগে – এভাবেই বুঝি সকল পুরুষ তার প্রেমিকাকে আদর করে? তবে এই আদরে আনন্দ কোথায়? সুখ কোথায়?
অমানিশার শরীরে নতুন ক্ষত সৃষ্টি হল। গালে আহনাফের পাঁচ আঙ্গুলের দাগ। গলায় পুরাতন কালসিটে দাগের পাশে নতুন দাগ সুস্পষ্ট!
অমানিশা জানে না, আদরের নাম করে এই বিকৃত মস্তিষ্কের খেলায় তার দেহখানি মুখ্য। এলোমেলো চুলগুলো মুঠোয় ভরে আঘাত করা অসভ্য ফিল্ম গুলোতেই মানায়। সভ্য সমাজে, প্রেমিকার চুলগুলো আলগোছে সরিয়ে সেখানে চুমু খাওয়ার নাম ভালোবাসা। প্রেমিকার দেহ পবিত্র মন্দিরের সমতূল্য। তাকে ছুঁতে শত বছরের সাধনাও যেন অনর্থক।
সে শরীরে আঘাত করা কোন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ?
অমানিশা গায়ে চাদর টেনে শুয়ে আছে। তার চোখের কোণায় পানি জমে আছে। আহনাফের দৃষ্টি এড়িয়ে চোখের পানি মুছে ফেলল সে।
আহনাফ ঢকঢক করে বোতলের অবশিষ্ট পানি শেষ করে ফেলল। এরপর অমানিশাকে জিজ্ঞেস করল,
তোমার স্কুল যেন কয়টায় ছুটি হয়?
পাঁচ টায়।
সাড়ে চাড়টা অলরেডি বেজে গেছে। জামা কাপড় পরে নাও তাহলে। নাকি?
অমানিশা ফ্লোর বেডে উঠে বসল। অলস ভঙ্গিতে স্কুল ইউনিফর্ম পরে নিল। আহনাফ ইতোমধ্যে আরো একটি সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে।
অমানিশা বিরক্তির সুরে বলল,
এত সিগারেট খেলে চলবে?
আহনাফ বিরস মুখে বলল,
এখন তো আগের মত খাই না। আগে সারাদিনে তিন প্যাকেট সিগারেট শেষ করে ফেলতাম। আর এখন দিনে এক প্যাকেট শেষ করি। কার জন্য এতকিছু মেনে চলছি? শুধুমাত্র তোমার জন্য। এরপরেও তোমার যত সন্দেহ!
আমি মোটেও তোমাকে সন্দেহ করছি না। – অমানিশা এগিয়ে গিয়ে আহনাফের গাল ধরল। বলল, আমার তোমাকে নিয়ে অনেক বেশি চিন্তা হয়। এত সিগারেট খেলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। তোমার কিছু হলে আমার কি হবে?
কি আর হবে? আরেকটা বিয়ে করবে!
অমানিশার চোখদুটো মুহুর্তেই ভিজে উঠল। আহনাফকে ছাড়া তার জীবন দুঃস্বপ্নের মত। এই যে মাঝেমধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে যায় ছেলেটা! ফোন ধরে না, ম্যাসেজ করে না। প্রথম দিকে দুশ্চিন্তা হত। এখন অমানিশা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আহনাফ উদাস প্রকৃতির। হয়তো একটু দায়িত্বহীনও বটে! তবে অমানিশার বিশ্বাস, তার প্রতি আহনাফের ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই।
অমানিশা আহনাফের গালে আদুরে চড় মারল। বলল,
ভুলেও আর কখনো এমন কথা বলবে না। আমি হয় তোমার বউ হব, নয়তো লাশ হব।
তার কথা শুনে আহনাফ হো হো করে হেসে ফেলল। বলল,
আজকাল প্রচুর বাংলা সিনেমা দেখা হচ্ছে মনে হয়?
অমানিশা গাল ফুলিয়ে উত্তর দিল, মোটেও না। আচ্ছা শোনো, আমি উঠি এখন। স্কুল ছুটি হওয়ার সাথে সাথে বাসায় উপস্তিত হতে হবে। তোমার হবু শাশুড়ীর কড়া হুকুম।
ঠিকাছে। – অমানিশার ঠোঁটে আবারো ছোট্ট করে চুমু খেলো আহনাফ। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে অমানিশা আহনাফের কাছ থেকে বিদায় নিল। সদর দরজা লাগানোর আগে আরোও একবার আহনাফকে শক্ত করে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করতে ভুলল না।
অমানিশা চলে যেতেই আহনাফ ফ্লোর বেডে আয়েশ করে বসল। ম্যাসেঞ্জারে ঢুকে দিশা নামের একটি মেয়েকে নক করল।
‘বাসা খালি। আমার কাছে ই*য়া*বা আছে চার পিস। হবে নাকি আজ রাতে?’
ক্ষণিককাল পর দিশা নামের মেয়েটি রিপ্লাই করল।
‘কে কে?’
‘তুমি যদি চাও আবিরকে ডাকতে পারি। তুমি ইলিনাকে সাথে আনতে পারো। বা শুধুমাত্র আমরা দুজনই ইঞ্জয় করতে পারি, সারা রাত!’
দিশা নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করল একটি উইংক ইমোজির মাধ্যমে। আহনাফ হেসে ফোন রেখে দিল। সে উত্তর পেয়ে গেছে।
অমানিশার পুরো শরীর প্রচন্ড ব্যাথা করছে। সে কোনোভাবে নিজেকে সামলে একটি রিক্সা ডাক দিল। এরপর বাসার উদ্দেশে রওনা হল। আহনাফদের বাসার সাথে তাদের বাসার দূরত্ব খুব বেশি নয়। মিনিট পাঁচেকের মাঝেই সে পৌঁছে গেল।
সদর দরজায় বেল বাজার বিচ্ছিরি ক্রিং শব্দ হল। রাহেলা আক্তার খুশিমনে দরজা খুলতে গেলেন। অবশ্যই তার মেয়ে এসেছে। এসময় স্কুল ছুটি হয়। সারাটাদিন বাসা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মেয়ে ঘরে ঢুকলেই বাড়িটা যেন প্রাণ ফিরে পায়।
দরজার অপাশে অতিরিক্ত ক্লান্ত অবস্থায় মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে যান রাহেলা। শঙ্কিত গলায় প্রশ্ন করেন,
কি হয়েছে তোর?
কিছু হয়নি। সারাদিন ক্লাস করে অনেক টায়ার্ড।
দে, স্কুল ব্যাগটা আমার কাছে দে।
অমানিশা স্কুল ব্যাগ মায়ের দিকে এগিয়ে দিল। রাহেলা এক হাতে ব্যাগ নিয়ে অন্য হাত দিয়ে মেয়ের হাত ধরলেন। কি ব্যাপার? শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি লাগছে! রাহেলার সন্দেহ সঠিক হল যখন তিনি মেয়ের কপালে হাত রাখলেন। আগুন গরম হয়ে আছে পুরো শরীর।
তোর গা তো জ্বরে পুরে যাচ্ছে রে, মা! তাড়াতাড়ি ঘরে আয়।
রাহেলা অমানিশাকে তার ঘরে নিয়ে গেল। বিছানায় শুইয়ে দিল। বলল,
তুই শুয়ে থাক। আমি একটু পানি গরম করে নিয়ে আসছি। গা মুছে দেই। জামা পাল্টিয়ে দেই।
অমানিশা মায়ের এই যত্নটুকু লুফে নিতে চাইছিল। পরক্ষণেই তার মনে হল শরীরের কালসিটে দাগের কথা। সে তড়িঘড়ি করে উত্তর দিল,
না মা। লাগবে না। আমি নিজেই জামা কাপড় পাল্টে নিচ্ছি। তুমি আমাকে একটা নাপা দাও।
রাহেলা অস্থির হয়ে বললেন,
না, আমি গা মুছিয়ে দিচ্ছি। শুধু ওষুধ খেলে হবে না। বেশি বুঝিস না।
অমানিশা চিৎকার করে উঠল,
বললাম তো গা মুছিয়ে দিতে হবে না। আমাকে ওষুধ দাও তাতেই হবে। সব সময় যন্ত্রণা করো না তো, মা। ভালো লাগছে না। তুমি ঘর থেকে বের হয়ে যাও।
মেয়ের এহেন ব্যবহারে রাহেলার চোখদুটো পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। কোথায় যেন সে শুনেছিল, সন্তানের দুর্ব্যবহারে যদি মায়ের চোখে জল আসে, সেই জল বয়ে আনে অভিশাপ। রাহেলা দ্রুত চোখের পানি মুছে ফেলল। মনে মনে বলল, হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে তুমি পৃথিবীর সমস্ত সুখ দান করো।
অমানিশাও অশ্রুসিক্ত চোখে ঘর থেকে মায়ের প্রস্থান দেখল। সে মায়ের সঙ্গ চাইছে। মায়ের উষ্ণ বুকে একটুখানি জায়গা চাইছে। অথচ পরিস্থিতি তাকে দিন দিন মায়ের থেকে কত দূরে সরিয়ে ফেলছে!
আগামীকাল সকালে সে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করবে। যদিও এর পরিণতি নিয়ে অমানিশা এখনো অবগত নয়। তবুও হঠাৎ করে অজানা এক ভয় তাকে ঘিরে ধরল। দম বন্ধ হয়ে আসছে অমানিশার।
আচমকা তার মনে হল, সে বিশাল গভীর সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে। এ গভীরতা থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।
[সত্য ঘটনা অবলম্বনে ]
চলবে।