অমানিশার মধ্যরাত পর্ব-১০

0
2781

অমানিশার_মধ্যরাত
লেখিকা: আতিয়া আদিবা
#পর্ব_১০

আরো বেশ কয়েকবার ধরণী তার অংশুমালীকে প্রদক্ষিণ করে ফেলল। অথচ আহনাফ তার স্বভাবমতো নিখোঁজ রইল। পাগলপ্রায় অমানিশা স্বস্তিতে নিশ্বাস ফেলার জন্য আকুপাকু করছে। তার মনে চুল পরিমাণ শান্তি নেই।
মানসিক শান্তির তৃষ্ণা মিটাতে মানুষ খুনের মত বড় অপরাধকেও তুচ্ছ করে দেখে। অমানিশার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছুর দেখা মিলল না।

তার গর্ভের সন্তান একটু একটু করে বাড়ছে। আর কদিন পরেই ছোট্ট ভ্রুণটি মানুষের আকৃতি ধারণ করতে শুরু করবে। টকটকে লাল রঙের অতি ক্ষুদ্র দুটি হাত, দুটি পা, ছোট একটি মাথা, বিন্দু বিন্দু দুটি চোখ। বড় হবে ভ্রুণটি। ছোট প্রাণটির হৃদপিণ্ডের ধক ধক শব্দ কি তখন অমানিশার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাবে? যদি সেই ধকধকানি আলগোছে কড়া নাড়ে বিবেকের দরজায়। তখনও কি ভ্রুণহত্যা নিতান্তই তুচ্ছ বলে মনে হবে অমানিশার কাছে?

৪৫৪ কোটি বছর বয়সী পৃথিবী এর উত্তর জানে না। ৪৫৭ কোটি বছর বয়সী সূর্যও এর উত্তর জানে না। মাটিতে হেঁটে চলা, পানিতে ডুবে চলা বা বাতাসে ভেসে চলা প্রতিটি নিশ্বাসের গল্প এখানে ভিন্ন। বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কে সত্যের পথে এগোবে আর কে বেছে নিবে মিথ্যার পথ তা শুধুমাত্র সেই জানে।

শেষবার তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাওয়ার পরেও আহনাফের প্রতি অমানিশার বিশ্বাস ছিল অটুট। তবে, সেদিন মধ্যরাতে কি মনে করে যেন তাহাজ্জুদ আদায় করল সে! পাক পবিত্র হয়ে সিজদায় ঝুঁকে নীরবে চোখের পানি ফেলল ফজর পর্যন্ত। রাতের নিস্তব্ধতায় অনিশ্চয়তার ভয় আঁকড়ে ধরেছিল তাকে। বিরতি দিয়ে দিয়ে শরীর কেঁপে উঠেছিল তার।

কিন্তু, এক অন্য ভোরের আলো ফুটেছিল সেদিন। পূর্ব দিকের লাল আকাশ, মৃদুমন্দ বাতাস আর সেই ছন্দে দুলে ওঠা গাছের পাতাগুলো অমানিশার বুকে যেন অবিশ্বাসের বীজ রোপণ করতে ব্যস্ত ছিল। কমলা রোদের স্নিগ্ধ আলোর ছোঁয়ায় সেই অবিশ্বাস তরতর করে বাড়তে লাগল। যৌক্তিক প্রশ্নেরা মাথায় ছোটাছুটি করতে লাগল।
আহনাফ তাকে ভালোবাসে। তবে কেন এত অবহেলা?ভালোবাসায় তো অবহেলার কোনো স্থান নেই!
তাদের সম্পর্কটা কি টাকা কেন্দ্রিক নয়? রেস্টুরেন্টের সামান্য কফির বিলও অমানিশাকে দিতে হয়েছে।
এছাড়া আহনাফের যত বিলাসী আবদার, সব ছিল অমানিশার কাছে। নেশা ছাড়ানোর জন্য প্রতি সপ্তাহে সাত হাজার টাকা করে দিতেও পিছুপা হয়নি সে। বিনিময়ে কি পেয়েছে?
কখনো বেশ্যার ট্যাগ। কখনো বা খাংকি, নটি এজাতীয় গালি। সত্য মিথ্যার লড়াই এর মাঝে অমানিশা নিজেকে আর জড়াতে চায় না। সে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চায়!

আজ কোনো এক বিশেষ কারণে স্কুল বন্ধ। অমানিশা ল্যাপটপের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অন্য কোনোভাবে টাকার ব্যবস্থা করতে পারে নি সে। ল্যাপটপ বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
ল্যাপটপটা সে আহনাফের হাতে দিবে না। টাকা জোগাড় হয়েছে কিনা এবিষয়ে কোনো তথ্য তাকে জানাবে না। তবে একা কিভাবে ল্যাপটপ বিক্রি করবে সে?
শিরিন আজ মিথ্যা বলে বাসা থেকে বের হতে পারবে না। আরবীর ক্ষেত্রেও অভিন্ন বিষয়। তার বাসাও বেশ দূরে। একমাত্র মুনার পক্ষে কিছু একটা ব্যবস্থা করা সম্ভব। কেননা তার বাসা স্কুলের সন্নিকটে।
যদিও মুনার সাথে সম্পর্ক এখন আর আগের মত নেই। সেদিন স্কুলের ওই আলাপচারিতা মুনা বেশ ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছে। তার ভাষ্যমতে, এত বড় অপবাদ যে বন্ধু দিতে পারে, তার সাথে সম্পর্কে রাখা আর দুধ দিয়ে কেউটে পুষা একই।

খানিকটা ইতস্তত করেও নিরূপায় অমানিশা মুনার সাহায্যের শরনাপন্ন হল। ফোন করে বলল,
দোস্ত, আমি খুব বিপদে আছি তোর সাহায্যের প্রয়োজন।

মুনা সহজ গলায় জবাব দিল,
কি সাহায্য?

আমার দ্রুত টাকার প্রয়োজন। ল্যাপটপটা বিক্রি করতে হবে। – তড়িঘড়ি করে বলল অমানিশা।

আমি কিভাবে ল্যাপটপ বিক্রি করতে সাহায্য করব? আমি নিজেই জানি না, কোথায় এসব বিক্রি করতে হয়। – বিরক্তির সুরে বলল মুনা।

তোর বয়ফ্রেন্ডকে বললে সাহায্য করবে না? – আগ্রহভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল অমানিশা।

ক্ষিপ্রগতিতে জবাব ধেয়ে আসল মুনার পক্ষ থেকে,
না। জোভান তোকে দেখতে পারে না। ও আমাকে তোর সাথে মিশতেও মানা করে দিয়েছে। তাছাড়া কি হিসেবে আমি তোকে সাহায্য করব বল? আজকে সাহায্য চাইছিস আগামীকাল আবার আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিবি। আমি এসব সহ্য করতে পারব না। তুই ফোন রাখ।

অমানিশা কান্না চেপে অনুনয় করে বলল,
দোস্ত, আই এম সরি। আমি কি একটা মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তোকে বলে বোঝাতে পারব না। হুট করে শুনেছিলাম প্রেগনেন্সির খবর ছড়িয়ে গেছে। তখন আমার মাথা কাজ করছিল না। কারণ তুই ছাড়া আর কেউ এই বিষয়ে কিছু জানতো না। দোস্ত, আমার দ্রুত এবোরশনের টাকা জোগাড় করতে হবে। প্লিজ আমাকে শেষবারের মত সাহায্য কর। তোর পায়ে পড়ি দোস্ত। প্লিজ?

অমানিশার কথা শুনে বোধহয় মুনার মায়া হল। সে সাহায্য করতে রাজি হল। জিজ্ঞেস করল,
আমার কি করতে হবে বল?

তুই স্কুল টাইমে বাসা থেকে বের হতে পারবি?

স্কুল টাইম তো অলমোস্ট হয়েই গেছে। যাইহোক, পারব। কিন্তু এরপর কি হবে?

তুই আগে বের হ। এরপর বলছি। আধা ঘন্টার মধ্যে স্কুলের পেছনে ভাঙ্গা বাড়ির ওইদিকে দাঁড়িয়ে থাকিস। কেমন?

তুই কি স্কুল ড্রেস পরে বের হবি?

হুঁ। এছাড়া কিছু করার নেই আমার। – দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল অমানিশা।

আচ্ছা।

গার্লস স্কুল আজ একদম নিশ্চুপ। কোনো হইচই নেই। হট্টগোল নেই। স্কুলের সামনের দোকানগুলোর বেচাকেনা নেই বললেই চলে। সবাই জানে, স্কুল বন্ধ। কোন এক এন-জি-ও এর ম্যানেজমেন্ট পদের পরীক্ষার সীট পড়েছে এখানে। পরীক্ষা হয়েছে আজ সকালে।
স্কুল ড্রেস পড়া অমানিশাকে রাস্তার সবাই কৌতূহলী চোখে দেখছে। সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে ভাঙ্গা বাড়ির সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল অমানিশা। একজন পথচারী ভ্রুঁ কুঁচকে তাকে জিজ্ঞেস করল,
মামণি, দাঁড়িয়ে আছো কেন? আজকে স্কুল বন্ধ না?

অমানিশা হেসে জবাব দিল,
জি আংকেল। আসলে আমি জানতাম না।

ওহ! – পথচারীও মিষ্টি করে হেসে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল।

ক্ষণিককাল পর দেখা মিলল মুনার। আপাদমস্তক কালো বোরখায় ঢাকা। ধীরগতিতে হেঁটে সে অমানিশার কাছে এসে বলল,
এখন কি করবি?

জোভানকে একটু ফোন দিয়ে বল ল্যাপটপটা নিয়ে যেতে। – করুন স্বরে বলল অমানিশা।

মুনা গর্বিত ভঙ্গিতে বলল,
দেখেছিস তুই জোভানকে এক সময় পছন্দ করতি না। আজ ওই তোর কাজে আসছে।

অমানিশা হাসার চেষ্টা করে বলল,
ওকে আমি কেন পছন্দ করতাম না সেটা তুই ভালোভাবেই জানিস। ও ই*য়া*বার ব্যবসা করে। আমি কখনোও চাইনি তুই ই*য়া*বা ব্যবসায়ী কারো সাথে প্রেম কর।

মুনা হো হো করে হেসে ফেলল। বলল,
অথচ নিজে ই*য়া*বাখোরের সাথে প্রেম করছিস!

অমানিশা স্বাভাবিকভাবে বলল,
আহনাফের নেশা সংক্রান্ত বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না, মুনা। কিন্তু তুই প্রেম করার আগেও জোভানের ব্যাপারে সব জানতি।

মুনা খানিকটা আক্রমণাত্মক ভাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। আচমকা অমানিশা রাস্তার পাশে হড়হড় করে বমি করতে শুরু করল। মুনা লক্ষ্য করল অমানিশার চোখের চারিপাশে কালো দাগ পড়েছে। মুখে এতটুকুন জ্যোতিও নেই।

ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিল অমানিশা। ম্লান হেসে বলল,
সকালে কিছু খেতে পারিনি। বমি হয়েছে। এখন আবার বমি হল।

মুনা উতলা হয়ে বলল,
তুই আগে কিছু খেয়ে নে। – এরপর চারিপাশে চোখ বুলিয়ে মুদির দোকান খুঁজতে লাগল সে। একটি ছোট দোকানের দেখাও মিলল। মুনা পুনরায় বলল,
তুই দাঁড়া। আমি সামনের দোকান থেকে কেক কিনে আনি।

অমানিশা বলল,
কোনো প্রয়োজন নেই।

মুনা অমানিশার কথা অগ্রাহ্য করে মুদির দোকান থেকে কেক কিনে নিয়ে এলো। বলল,
তুই এটা খেতে থাক। আমি জোভানকে ফোন করছি।

মুনা একটু দূরে সরে গিয়ে জোভানকে ফোন করল। ঠিক এমন সময়, অমানিশার ফোনও ভাইব্রেট করে উঠল। জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে ফোন হাতে নিয়ে দেখল স্ক্রিনে ‘আহনাফ’ নামটি উঠে আছে।
[চলবে…]

#অমানিশার_মধ্যরাত
লেখিকা: আতিয়া আদিবা