অমানিশার মধ্যরাত পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0
5257

#অমানিশার_মধ্যরাত (শেষ পর্ব)
ক্লিনিকের সাদা-নির্মম দেয়ালগুলো যেন আরও সাদা, আরও শীতল হয়ে উঠেছে অমানিশার জন্য। ফিনাইলের গন্ধও তার অসহ্য লাগছে। সে যে খাটে শুয়ে আছে তার চারপাশে সস্তা সাদা পর্দা টানানো। অমানিশার শরীর নিস্তেজ, যন্ত্রণায় জর্জরিত। এবরশনের মত ঘৃণ্য অপরাধ তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়া করিয়েছে আজ। তাই হয়ত শরীরের চেয়েও বেশি ভারী হয়ে আছে তার মন।
ক্লিনিকের নার্সরা অমানিশার পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, মুখে এক ধরনের অবজ্ঞার ছাপ নিয়ে। তাদের চোখের একরাশ জাজমেন্টাল দৃষ্টিও বেশ পরিলক্ষিত। যেন তারা বলছে, “এই মেয়ে! তুমি ভয়ঙ্কর অপরাধ করেছো। তুমি এমন নষ্ট কাজ করেছো, যার জন্য সারাজীবন তোমার লজ্জিত হওয়া উচিত। মাথা নত করে থাকা উচিত চিরকাল। কি নোংরা মেয়েছেলে তুমি। ছিঃ! ”

ডাক্তারের কণ্ঠেও ছিল সেই একই মনোভাব। রাউন্ডে যে কয়বার এসেছেন, অমানিশার দিকে এমন ঘৃণ্য দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়েছেন। যেন অমানিশার মতো মেয়েরা তার দুচোখের বিষ। ইঁচড়েপাকা মেয়েগুলোর একই গল্প, একই পরিণতি দেখতে দেখতে তারা বিরক্ত। ব্যাকস্টোরি নিয়ে তাদের তেমন কোনো উৎসাহ নেই।

অমানিশার বুকের ভেতরে একরাশ ক্রোধ, হতাশা আর অবর্ণনীয় শূন্যতা জমাট বেঁধে আছে।

খাটের পাশেই বসে আছে রাহেলা। তার মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এই মানুষটার ভিতরে কী ভয়ানক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তিনি অমানিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর অঝোরে কাঁদছেন। কান্নায় ভিজে গেছে তার ওড়নার একাংশ। চোখের কোণ শুকানোর কোনো ফুরসতই যেন নেই। তার প্রতিটি ভারী নিশ্বাসে মিশে আছে অসহায়ত্ব।
মনে মনে সৃষ্টিকর্তার সাথে এক তরফা তর্কে মেতে উঠেছেন তিনি।
“কী দোষ ছিল আমার মেয়েটার? হে আল্লাহ, তুমি কেন আমার পরিবারের উপর এই বিপদ দিলে? আমার মেয়েটাকে তুমি আগের মত করে ফিরিয়ে দাও। ফিরিয়ে দাও সেই ছোট্ট অমানিশাকে।”

রাহেলার মনে ভেসে আসছে অমানিশার শৈশবের স্মৃতি স্কুলের ইউনিফর্মে পরিপাটি করে গোঁজা দুটি বিনুনি। বিনুনির নিচে আবার সাদা ফিতের ফুলের কারুকাজ। হাসিখুশি চেহারার চঞ্চল তার মেয়ে। অমানিশা! সেই মেয়েটা কীভাবে এমন এক বিপদে জড়িয়ে পড়ল? রাহেলার বুকের মাঝে বিস্ময়, শঙ্কা, ভয় আর ক্ষোভের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বারবার।

অমানিশার চোখে তখন ভেসে আসে দিনকয়েক আগের দৃশ্য। আহনাফের মুখটা তার স্পষ্ট মনে পড়ছে। যার জন্য সে নিজের সবটুকু বিসর্জন দিল। বাড়িতে মিথ্যে বলে স্কুলের নাম করে মুনাকে সাথে নিয়ে সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিল কেবলমাত্র তার জন্য। সেদিন ল্যাপটপটা বিক্রি হয়েছিল। তবে ল্যাপটপ বিক্রির টাকাগুলো আহনাফের হাতে তুলে দেওয়ার পর সে আর একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি। ফোন করেনি। এমনকি একবার খোঁজও নেয়নি তার। অমানিশার বাচ্চার বাবা তো সেই ছিল! সে কিভাবে পারল অমানিশাকে, তার বাচ্চাকে, এভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিতে? আহনাফের ব্যবহার আজ অমানিশার মনের ভেতরে বিষের মতো ছড়িয়ে গেছে। নিজেকে তার তুচ্ছ মনে হচ্ছে। আহনাফের কাছে সে শুধুমাত্র একটি সেক্স টয় ছিল! যাকে যখন খুশি শরীরের ক্ষুধা মেটানোর জন্য ব্যবহার করা যায়। নেশার টাকা ফুরিয়ে গেলে এটিএম মেশিন হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

ক্লিনিকের সাদা দেয়ালে ঝুলতে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অমানিশা অনুভব করল, তার ভিতরটা ফাঁকা। একেবারে শূন্য। সে জানেনা তার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য কি? তবে অমানিশা এটা জানে তার ভুলটা কোথায় হয়েছে। আহনাফের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসে নিজেকে সে হারিয়ে ফেলেছিল গোলকধাঁধায়।
পুরুষ মানুষের কাছে তার প্রেমিকার দেহ হল মন্দির। সেই মন্দিরকে অপবিত্র যে করে, সে আর যাইহোক সম্মানের সহিত কখনো ভালোবাসতে পারে না!

অমানিশা ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল। তার মনে হলো, এই জীবনের শূন্যতার মধ্যেও এক ধরনের পুনর্জন্ম সম্ভব। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সে আর ভাঙবে না। বরং নিজেকে আবার গড়ে তুলবে আরোও পোক্তভাবে। জীবনের কোনো ভুলের বোঝা তাকে আর দমিয়ে রাখতে পারবে না। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সে নতুন যাত্রা শুরু করবে।

পরবর্তী দিনগুলোতে অমানিশা নিজেকে গুটিয়ে নিল। পুরোনো বন্ধুদের এড়িয়ে চলতে শুরু করল। কারও সাথে আগের মতো প্রাণ খুলে কথা বলত না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দূরে সরে গেল, নিজের ভেতরে একটি ছোট্ট জগৎ তৈরি করে নিল। সেই জগতে তার পুরনো ভুলের কোনো স্থান নেই। সেখানে জায়গা করে নিল তার নতুন জীবনের সূচনার শক্তি আর স্বপ্ন।

সময় তার নিজের গতিতে এগিয়ে যায়। অমানিশার জীবনও থেমে রইল না।

কয়েক বছর পর।

এক শীতের সকাল। সূর্যের নরম আলো বারান্দায় ছড়িয়ে পড়েছে। অমানিশা বারান্দার এক কোণে বসে আছে, হাতে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা। তার পাশে বসে আছে তার স্বামী, সাদমান। সাদমান তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। অমানিশা তার স্বামীর হাসিতে খুঁজে পায় এক ধরনের স্থির শান্তি।
বারান্দা থেকে দূরের কুয়াশাঘেরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই অমানিশার মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলোর কথা—ক্লিনিকের সাদা দেয়াল, মায়ের কান্না, আহনাফের উদাসীন মুখ। মনে পড়তেই তার ভেতরে এক ধরনের শিউরে ওঠা অনুভূতি জাগে।

সাদমান তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখে। জিজ্ঞেস করে,
“তুমি এখনো তোমার অতীত ভুলতে পারো নি, তাই না?”

অমানিশা প্রত্যুত্তরে বলল,
“অতীত ভুলবার জিনিস নয়। তবে জীবন অনেক সহজভাবে বদলে যায়। পুরোনো জিনিস ফিকে হয়ে যায়। তুমি আমার জীবনে না আসলে কখনো বুঝতামই না ভালোবাসার গভীরতা কেমন হয়।”

সাদমান উদাস কণ্ঠে বলল,
“জানো? আমার অফিসের এইচ আর এর মেয়েরও ঘটনা অনেকটা তোমার জীবনের সাথে মিলে যায়। মেয়েটা সুইসাইড করার চেষ্টাও করেছে। ভাগ্য ভালো সঠিক সময়ে দরজা ভেঙ্গে তাকে উদ্ধার করা হয়।”

অমানিশা মৃদু হাসল। বলল, “জানো? আমার এই গল্প পুরো পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার ইচ্ছা আছে। যদি আমার গল্প কোনো মেয়ের জন্য শিক্ষা হয়, তাহলে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি আর হবে না। আমি এই পৃথিবীতে কোনো দ্বিতীয় অমানিশা চাই না।”

সাদমান শক্ত করে অমানিশাকে জড়িয়ে ধরল। অমানিশার চোখের কোণে জল জমেছে। হয়ত তার জীবনের চড়াই উতরাই এর মিশ্র অনুভূতিতেই এই অশ্রুজলের সূচনা।

সমাপ্ত।

অমানিশা, একদিনের সেই ভাঙা মেয়ে এখন জানে, আলোর জন্য শুধু অপেক্ষা করলেই চলে না, আলোকবর্তিকা নিজেকেই হতে হয়।
আমি অত্যন্ত খুশি আমি কারো জীবনী ছোট্ট পরিসরে লিখতে পেরেছি।
অমানিশার মত আমিও চাই না কেউ এরকম মেন্টাল ট্রমার মাঝ দিয়ে যাক। গল্পটি থেকে আশা করি সবাই এই শিক্ষাটুকু গ্রহণ করবেন। ভালোবাসা রইল ❤️