অমৃতে অরুচি পর্ব-০১

0
1

(সূচনা পর্ব)
#অমৃতে_অরুচি
#কলমে_গুঞ্জন_চৈতি

বিয়ে বাড়িতে মাংস কম পড়ায় বাকবিতন্ডা থেকে মারামারি, অতঃপর পাত্রপক্ষ বিয়ে ভেঙে দিয়ে ফিরে গেল। লগ্নভ্রষ্টা হলো দ্যুতি। কিছুক্ষণ পর খবর এলো, দ্যুতির বাবা-মা দু’জন একসাথে বাড়ির পিছনের স্কুলের ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে, অবস্থা ভালো নয়। বাঁচার আশা ক্ষীণ।
মেয়ের বিয়ের খরচ উঠাতে নিজের একমাত্র সম্বল বসত-বাড়িটা বন্ধক রেখেছিলো দ্যুতির বাবা। তাতে শুধু গয়নার টাকাও জোগার না হলে বাড়িটা অবশেষে বিক্রিই করে দেন। বিয়ে সম্পন্ন হলে কনে বিদায়ের পরেই মালপত্র নিয়ে ভাড়া বাড়িতে ওঠার কথা ছিল তাদের।

পাত্রপক্ষ পণ চায়নি। না টাকা পয়সা, না ঘর সাজানোর আসবাবপত্র, আর না একটা গাড়ি। ছেলে পোস্ট অফিসে চাকরি করে, সরকারী চাকরি! ভাগ্য করে নাকি এমন ঘরে বিয়ে ঠিক হয়েছিল দ্যুতির।

সকলের ভাষ্যমতে পাত্রপক্ষের দাবী ছিল খুবই সামান্য। মেয়েকে হাতে, কানে, গলায় সোনা দিয়ে সাজিয়ে দিতে হবে। আর পাত্রের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা একটু বেশি, তাই বরযাত্রীর সংখ্যাও একটু বেশি হবে। মাত্র দেড়শো। কোনভাবেই আপ্যায়নে ত্রুটি রাখা যাবে না। ব্যাস, এটুকুই। গয়না আর খাবার। সরকারী চাকুরী করা বর এটুকুও কী আশা করবে না?

খাবারের তালিকা দেওয়া হয়েছিল দ্যুতির বাবাকে। খাসির মাংস সবাই খায় না, আবার মুরগীও সবাই খায় না। তাই আয়োজনে খাসি আর মুরগী দু’টোই রাখতে বলা হয়েছিল। মাছের মধ্যে কোরাল মাছ, ইলিশ, চিংড়ি আর বড় রুই। আর ডাল, ডিম সাথে দই, মিষ্টি তো আছেই।

বাড়ি বিক্রির টাকায় দ্যুতির হাত, কান আর গলা ভরলেও জোগার হলো না খেতে না পেয়ে শুকিয়ে যাওয়া বরপক্ষের খাওয়ার খরচ৷ সঞ্চয় যা ছিল, তাতে এই রাজকীয় খাবারের আয়োজন করতে গেলে বিশ জনের আয়োজনও হবে না।

শেষমেশ আরও চার লাখ টাকা ঋণ করে জমজমাট আতিথিয়েতার আয়োজন করে দ্যুতির বাবা।

একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। কিন্তু দেড়শো বরযাত্রী আসার কথা থাকলেও বরযাত্রী আসে প্রায় দুইশোর কাছাকাছি। যার ফলে খাবার কম পড়ে এবং ঘটে এমন লজ্জাজনক দুর্ঘটনা।

বিয়ে ভাঙার অপমানে দ্যুতির বুক কাঁপলেও সে কাঁদেনি একটুও। এমন একটা পরিবার, যারা দেড়শো বরযাত্রী আসার কথা বলে দুইশো বরযাত্রী নিয়ে চলে আসে আবার খাবার কম পড়লে নির্লজ্জের মতো মাংস চেয়ে করে মারামারি, সে পরিবারের হাত থেকে যে বেঁচে গেছে এই অনেক।

এমন মেরুদন্ডহীন, আত্মসম্মানহীন ও ছোটলোক পরিবারের বউ হলে তো আজীবন নরক যন্ত্রনা পোহাতে হতো।

এই ভেবে তো বেশ শক্ত ছিল। কিন্ত তার বাবা-মা তাকে গলায় দড়ি দিতে বলে নিজেরাও আত্মহত্যা করলো। এই দুঃখ সে রাখবে কোথায়? আর ঋণের বোঝা? সে কী করে শোধ করবে এতো টাকার ঋণ?

বাবা-মা আত্মহত্যার চেষ্টা করার আগ পর্যন্ত এতো টাকা ঋনের কথা সে জানতো না। এমনকি বাড়িটাও যে বিক্রি করে দিয়েছে, তাও জানতো না। সে জানতো বাড়ি বন্ধক রেখেছে বাবা, বন্ধকের টাকায় বিয়ের আয়োজন হয়েছে।

বাবা-মায়ের আত্মহত্যার খবর পাড়ায় জানাজানি হতেই বাড়ি এসে উপস্থিত হলো ঋণদাতারা। তখনই সব জানলো দ্যুতি।

সে ঘরকুনো মেয়ে। বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে ধারণা প্রায় নেই বললেই চলে। গ্রামের ভেতর এমন একটা ছোট্ট বাড়ির দাম কত হতে পারে আর বিয়ের মতো এতো বড় আয়োজনের খরচই বা কেমন, তার ধারণা দ্যুতির একদমই নেই। বাবা-মা তো বুঝতেও দেয়নি, তাদের সর্বস্ব এই বিয়ের যজ্ঞে আহুতি দিয়ে মেয়ের বরপক্ষের খিদে মেটানোর আয়োজন করেছে। জানলে বিয়ের জন্য রাজি হতো না।

দ্যুতি বিয়ের সাজেই হাসপাতালে ছুটলো। যাওয়ার পর জানতে পারলো, বাবা-মা দু’জনের অবস্থাই খুব খারাপ। গ্রামের হাসপাতালে তাদের রাখা হলো না। নিতে বলা হলো সদরে। দ্যুতির একমাত্র সম্বল তখন গায়ের গয়নাগুলো। এম্বুলেন্সের ভাড়া এবং চিকিৎসা খরচের জন্য গয়না বিক্রি করবে ভাবলো।

যাওয়ার আগে মায়ের সাথে কথা বলতে গেল দ্যুতি। শুনতে পেল মা বিরবির করে বলছে, “মইরা যা দ্যুতি, গলায় দড়ি দে। সব শ্যাষ…”

দ্যুতি ভেঙে পড়লো খুব। কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতাল থেকে দৌড়ে বের হতে গিয়ে একটা ছেলের সাথে ধাক্কা লাগলো। ছেলেটা ওষুধ হাতে নিয়ে ঢুকছিলো হাসপাতালে, পড়ে ভাঙলো কিছু ওষুধের বোতল। ছেলেটা রেগেমেগে বলল,
“সিনেমার শ্যুটিং চলছে? নিজেকে নায়িকা মনে হয়? এভাবে দৌড়ানোর মানে কী?”

দ্যুতির হিচকি উঠে গিয়েছে কাঁদতে কাঁদতে। কোনমতে “মাফ করবেন” বলতে গিয়েও থমকে গেল।

পিছন থেকে পাড়ার জগলু কাকার আহাজারি শোনা যাচ্ছে। তাকেই রেখে এসেছিলো বাবা-মায়ের কাছে। পিছু ডেকে বলছে, “তর বাপে আর নাই রে দ্যুতি, যাইস না। দাদায় আর নাই।”

এবার পরিস্থিতি বুঝতে পারলো অনিন্দ্য। দ্যুতির বিয়ের সাজ দেখে আরও বেশি মায়া হলো। আহারে! বিয়ের মণ্ডপ থেকে উঠে এসেছে নিশ্চয়ই। হাতে শাখা থাকলেও সিঁথিতে সিঁদুর নেই, তারমানে বিয়ে সম্পন্ন হয়নি। তারমধ্যেই হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে করতে বাবাকে হারালো।

অপরাধবোধে সরি বলবে, এরমধ্যেই দ্যুতি জ্ঞান হারালো। লুটিয়ে পড়লো হাসপাতালের মেঝেতে। অনিন্দ্য দ্যুতিকে নিয়ে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকলো। দ্যুতিকে জরুরি বিভাগে রেখে ওষুধগুলো আবার কিনে নিয়ে এলো।

এরমধ্যে দ্যুতির জ্ঞান ফিরতে খুব বেশি সময় লাগলো না। চোখ খুলেই চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল বাবার কাছে।

এতোকিছুর মাঝে দ্যুতি খেয়ালই করলো না, সেই অচেনা ছেলে তার সাথে সাথে দৌড়াচ্ছে আর বলছে, “শান্ত হোন, আপনি দুর্বল, আবার সেন্সলেস হয়ে যাবেন। আপনার মায়ের জন্য আপনাকে সুস্থ থাকতে হবে।”

দ্যুতি বাবার কাছে গিয়ে দেখলো রক্তাক্ত নিথর শরীরটা হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে। পায়ের কাছে বসে খুব কাঁদলো। অনিন্দ্য পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। না মেয়েটাকে একলা ফেলে চলে যেতে পারছে, আর না ভরসা দিয়ে বলতে পারছে, কেঁদো না মেয়ে।

জগলু কাকার থেকে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনেছে অনিন্দ্য। হাসপাতালের মোটামুটি সবাই এখন জানে পুরো ঘটনা। বিয়েতে মাংস কম পড়ায় একটা পরিবার কীভাবে শেষ হতে পারে, সে গল্প এখন সবার মুখে মুখে।

দ্যুতি মায়ের কাছে গেল এবার। মায়ের হাত ধরে বলল, “তোমাকে সদরে নিয়ে যাবো মা। তোমার কিছু হবে না। আমি এখনি টাকা নিয়ে আসছি।”

দ্যুতির মা কথা বলতে পারছে না। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। মাস্ক সরিয়ে খুব কষ্ট নিয়ে বলল, “মরস নাই এহনো? গলায় দড়ি দে। আমার… চিন্তা করিস না। আমার সময় শ্যাষ। মইরা যা মা। নইলে… সবাই তরে ছিঁড়া খাবো। একলা বাঁচা পারবি না। মইরা যা… নিজেরে বাঁচা। মরলেই বাঁচপি।”

দ্যুতি আরও ভেঙে পড়লো। একদিকে বাবার মৃত্যু, আরেকদিকে মৃত্যু পথযাত্রী মা বলছে মরে যেতে। সে তো এতো শক্ত মনের মেয়ে কখনোই ছিলো না, কী করে সামলে উঠবে সব?

এদিকে অনিন্দ্যও শুনলো সবটা। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশংকায় জগলু কাকাকে ডেকে দ্যুতিকে মায়ের থেকে সরিয়ে নিতে বললো।

দ্যুতিকে গয়না বিক্রি করতে হলো না। অনিন্দ্য এম্বুলেন্সের ব্যাবস্থা করে দিলো তৎক্ষনাৎ। দ্যুতি জগলু কাকাকে নিয়ে রওয়ানা করলো সদর হাসপাতালের উদ্যেশে।

অনিন্দ্যর যেতে ইচ্ছে করলো দ্যুতির সাথে। কিন্তু বন্ধু এক্সিডেন্ট করে একই হাসপাতালে ভর্তি থাকায় যেতে পারলো না। বন্ধুও একা আছে, পরিবারের কেউ এখনও আসেনি।

ভাবলো, বন্ধুর পরিবারের কেউ এলে তারপর নাহয় যাবে একবার। গেছে তো সদর হাসপাতালেই। জগলু কাকার ফোন নাম্বারও রেখে দিয়েছে। আপাতত ফোনে যোগাযোগ রাখবে না-হয়।

ঘন্টা দুয়েক পর বন্ধুর পরিবার হাসপাতালে চলে এলে তাদের কাছে রোগীর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে অনিন্দ্য বেরিয়ে এলো। সবার আগে কল করলো জগলু কাকাকে। তিনি প্রথমবারে কল ধরলেন না। আধ ঘন্টা আগেও তো কথা হলো, এখন কল রিসিভ না করায় চিন্তা হলো অনিন্দ্যর। আবারও কল করলো।

এবার জগলু কাকা কল রিসিভ করেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। অনিন্দ্য চিন্তিত স্বরে বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলো কী হয়েছে। জগলু কাকা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “বউদি আর নাই। দ্যুতি মায় কেমন জানি পাথর অইয়া বইয়া রইছে। কতা কইতাছে না।”

অনিন্দ্যর সর্বপ্রথম মনে পড়লো দ্যুতিকে তার মায়ের বলা শেষ কথাগুলো। বুক কেঁপে উঠলো কথাটা ভেবে। জগলু কাকাকে বলল, “আমি আসছি। আমি না আসা পর্যন্ত দ্যুতিকে চোখে চোখে রাখুন। চোখের আড়াল করবেন না।”

অনিন্দ্য বাইক নিয়ে রওয়ানা হলো। গন্তব্য সদর হাসপাতাল। সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটা মেয়ের চিন্তায় সে ঘামছে। রাস্তা ফুরাতে চাইছে না৷ পুরো রাস্তা প্রার্থনা করতে করতে গেল, মেয়েটা কোন ভুল পদক্ষেপ না নিয়ে বসে!

হাসপাতালে পৌছানোর আগেই জানতে পারলো দ্যুতিকে পাওয়া যাচ্ছে না। জগলু কাকা কল করে জানালো। অনিন্দ্য ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দশ মিনিটের পথ পাঁচ মিনিটে শেষ করে হাসপাতালে পৌঁছালো। হাসপাতালের বিল্ডিংয়ের সামনে যেতেই চোখে পড়লো ছাদের দিকে। দ্যুতি ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় মনে হচ্ছে, লাল টুকটুকে বেনারসী পড়া লক্ষ্মী প্রতিমা যেন। যে নিজেকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ]