অমৃতে অরুচি পর্ব-০২

0
1

#অমৃতে_অরুচি
#কলমে_গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২

পাঁচ তলা বিল্ডিং, ছাদ থেকে লাফ দিলে নির্ঘাত মৃত্যু। অনিন্দ্য বিহ্বল হয়ে পড়লো। চোখের সামনে একটা মানুষকে মরতে দেখবে! সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে উঠতে যদি ঝাঁপ দেয়? নিচে দাঁড়িয়েও বা কী করতে পারবে?

অনিন্দ্য নাস্তিক না হলেও ধার্মিক কোনকালেই ছিল না। তবুও বিপদের সময় ঈশ্বরকেই স্বরণ করলো। প্রার্থনা করলো মেয়েটার জন্য। ঈশ্বরকে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো বুলেটের গতিতে। কিন্তু ছাদে উঠে কোথাও দ্যুতিকে দেখতে পেল না। তাহলে কি সে দেরি করে ফেলল?

হঠাৎ ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেল অনিন্দ্য। আয়াজটা দেয়ালের ওপাশ থেকে আসছে। এগিয়ে দেখলো, হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে মেয়েটা। তাহলে ঝাঁপ দেয়নি।

অনিন্দ্য বড় করে শ্বাস টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়লো। কয়েক মুহুর্তের জন্য দম বন্ধ লাগছিলো। নিজেকে শান্ত করে হাঁটু গেড়ে বসলো দ্যুতির সামনে। মনের চলছে কথা গোছানোর চেষ্টা। এমন পরিস্থিতিতে একজন অচেনা অজানা মানুষ হয়ে কী বলা উচিত তার? উপদেশ না সান্তনা? নাকি পাশে থাকার আশ্বাস? কথা খুঁজে না পেয়ে নাম ধরে ডাকলো, “দ্যুতি।”

দ্যুতি মাথা উঁচু করে দেখলো অনিন্দ্যকে। অনিন্দ্যও দেখলো দ্যুতিকে। বাল্বের লাল আলোয় লাল বেনারসির সাথে প্রায় মিলে গেছে দ্যুতির মুখটা। কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে উঠেছে ফর্সা নাক। কপালের চন্দন ঘেটে একাকার। ঠোঁটে লিপস্টিক প্রায় নেই বললেই চলে। চোখের কাজল ছড়িয়ে বাড়িয়েছে শোকের ছাপ।

অনিন্দ্যকে দেখে দ্যুতি হাওমাও করে কেঁদে উঠলো বুকে হাত চেপে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি লাফ দেওয়ার সাহস যোগাতে পারছি না। নিচে তাকালেই দম ফুরিয়ে আসে। কী করবো আমি? মা-বাবা কীভাবে লাফ দিলো অতো উঁচু থেকে? ওদের ভয় করলো না? আমি এখন কী করবো? কী করবো আমি? আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই। আমাকে একটু ধাক্কা দেবেন? বেঁচে থাকার সাহস নেই, মরে যাওয়ারও সাহস নেই। আমাকে একটু ধাক্কা দিন…”

অনিন্দ্যর ভীষণ অসহায় লাগছে। পরিচিত কিংবা কাছের কেউ বিপদে পড়লে যেভাবে পাশে থাকা যায়, সান্তনা দেওয়া যায়, একজন অপরিচিত একটা মেয়ের পাশে থাকা, ভরসা দেওয়া তত সহজ নয়। কী বলে সান্তনা দেবে?

“আমাকে একটু ধাক্কা দিন না। নয়তো ঘুমের ওষুধ কিংবা বিষ এনে দিন। মা আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। দিবেন না? থাক দিতে হবে না। আমি পারবো। বাবা-মা পেরেছে, আমি পারবো না কেন? আমি পারবো।”

দ্যুতি এবার অস্বাভাবিক আচরণ করছে। অনিন্দ্য বুঝিয়ে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলো। কিন্তু দ্যুতি ক্রমশঃ উত্তেজিত হয়ে উঠছে। অনিন্দ্য সাহস পাচ্ছে না দ্যুতিকে ছোঁয়ার। জোর করে হলেও ধরে নিচে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু গায়ে হাত দিলে যদি হিতে বিপরীত হয়! পরিস্থিতির যে অবনতি দেখতে পাচ্ছে সে একা সামলাতে পারবে না।

এরমধ্যেই দ্যুতি নিজেকে দোষারোপ করতে করতে ছাদের কিনারে এগোতে লাগলে অনিন্দ্য হাত টেনে ধরলো। আর তাতে ভীষণ রেগে গেল দ্যুতি। তার মা তো তাকে বলেছিল, পুরুষ মানুষ তাকে ছিঁড়ে খাবে, বাঁচতে দেবে না। এই সেই পুরুষ? তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে এসেছে?

দ্যুতি মনের সমস্ত আক্রোশ নিয়ে অনিন্দ্যর উপর আক্রমণ করলো। ধাক্কাতে ধাক্কাতে খামচে, কামড়ে রক্তাক্ত করে দিলো। মায়ের বলা সেই তথাকথিত পুরুষ সমাজের উপর সমস্ত রাগ উগড়ে দেওয়ার এক বৃথা চেষ্টা যেন।

অনিন্দ্য আর না পেরে দ্যুতির হাত ধরলো শক্ত করে। দ্যুতি ভয়কাতর হয়ে ক্রমাগত চিৎকার করতে লাগলো। তার চোখে অনিন্দ্য এখন সেই পুরুষ, যার কথা তার মা বলে গেছে।

অনিন্দ্য আর উপায় না পেয়ে হাত ছেড়ে দিলো। বলল শান্ত হতে। বোঝানোর চেষ্টা করলো অনিন্দ্য ওর কোন ক্ষতি করবে না বরং সাহায্য করতে চায়।

কিন্তু দ্যুতির মনোভাব ভিন্ন। মায়ের বলা সেই পুরুষই যেন তার সামনে। যে তাকে ছিঁড়ে খেতে প্রস্তুত। এবার মায়ের দেখানো সমাধান ছাড়া আর উপায় নেই। মৃত্যুই একমাত্র সমাধান। আর ভয় পেলে চলবে না। সে মরেই যাবে। তাই হাত ছাড়া পেতেই রেলিংয়ের দিকে দৌড়ে গেল। ঝাপ এবার দেবেই। চোখ বন্ধ করে ঝাঁপ দেবে।

অনিন্দ্যও পিছু দৌড়ালো। একেবারে ছাদের কিনার থেকে হাত ধরে হিঁচকে টান মেরে সরিয়ে নিয়ে এলো। একটুর জন্য সে নিজে পড়ে যায়নি নিচে।

এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে ঠাস করে একটা চড় মারলো দ্যুতির বাম গালে। হাত ধরে রেখেই উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলল, “আমি তোমার কোন ক্ষতি করবো না। তোমার ক্ষতি যা করার তোমার বাবা-মা অলরেডি করে রেখে গেছে। কিছুই বাকি রাখেনি। নিজেরাও মরেছে, তোমার মাথায়ও মরার ভূত চাপিয়ে দিয়ে গেছে। মৃত্যু সব সমস্যার সমাধান হলে পৃথিবী হতো মানবশূন্য। প্রতিটা মানুষ আত্মহত্যা করতো। কারণ, সুখে তো কেউই নেই।”

একটু থামলো অনিন্দ্য। দ্যুতির চোখেমুখে রাগের ছাপ দেখে তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বলল, “মৃত বাবা-মায়ের নামে এসব শুনতে খারাপ লাগছে? লাগুক। তবু শুনতে হবে। তারা মরে গিয়েছে বলে তাদের ভুল সব ফুল হয়ে ঝরে যাবে না। তারা শোনার জন্য বেঁচে থাকলে তাদের শোনাতাম, যেহেতু নেই তাই তুমি শোনো।”

একটু থেমে পুনরায় বলল, “আমি বড় অসহায়, আমার তো কেউ নাই। বাবা-মায়ের শেখানো এই স্লোগান মাথা থেকে সরাও। তুমি অসহায় না। আর একটা বিয়ে ভেঙে গেলেই জীবন শেষ হয়ে যায় না। বরং বেঁচে গেছো এই বিয়ে ভাঙায়। তোমার বাবা-মা শুরু থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুল করে এসেছে। প্রথম ভুল, তোমাকে বেঁচে থাকা শেখায়নি। দ্বিতীয় ভুল, ওমন লোভী পরিবারের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে। সরকারী চাকরি! চাকরি ধুয়ে জল খাবে মেয়ে? ছেলে কী করে, পকেটের ওজন কত, সম্পদের পরিমাণ কতটুকু, ঘর পাকা না কাঁচা শুধু তাই দেখেছে। ছেলে মানুষ কিনা, একজন সত্যিকারের পুরুষ কিনা, মেরুদন্ড আছে না নেই, নৈতিক শিক্ষা, চরিত্র, ব্যাক্তিত্ব, মন-মানসিকতা কোন কিছুর খোঁজ নেয়নি। একটা ছেলের স্বভাব, চরিত্র, আচার-আচরণ কেমন তা জানতে রকেট সাইন্স জানা লাগে না। পাড়া-প্রতিবেশি কিংবা এলাকার চায়ের দোকানে খোঁজ নিলেই হয়। একইভাবে পরিবার সম্পর্কেও খোঁজ নেওয়া যায়। তাতো করেনি, দেখেছে শুধু ছেলের চাকরি। পরিবারের মুখ্য সদস্যরা কেমন, দুই পরিবারের বোঝাপড়া ঠিক আছে কিনা, তাদের মন-মানসিকতা স্বচ্ছ কিনা, লোভী কিনা, তুমি তাদের সাথে মানিয়ে চলতে পারবে কিনা তা খোঁজ নিয়েছে? জানার চেষ্টা করেছে? করেনি। শুধু ছেলের পরিবারের দোষ দেখলে হবে? ছেলে তার বাবার ডাকে মণ্ডপ ছেড়ে চলে গেছে আবার যাওয়ার আগে ধুতি চেপে মারামারি করতেও ছাড়েনি কারণ তার চৌদ্দ গুষ্ঠি কতবছর পর ভালমন্দ খেতে পেয়েছিল, তাতে কিনা আবার মাংস কম! ছোটলোক! এমন ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য তোমার বাবা একমাত্র সম্পদ বাড়িটা বিক্রি করেছে তো করেছেই, আবার ঋণ করেছে চার লাখ। খায় না গায় দেয়! লোভী শুধু ছেলে আর ছেলের পরিবারকে বললে হবে? তোমার বাবা লোভ করেনি? সরকারী চাকরির লোভ? এখন ঋণের ভয় আর বাড়ির শোকে আত্মহত্যা করে খালাস। আবার মেয়ের মাথায় ঢুকিয়ে গেছে, মরতেই হবে। বেঁচে থাকা যাবে না। বাঁচার ইচ্ছাই নষ্ট করে দিয়ে গেছে।”

এপর্যায়ে দ্যুতি বসে পড়লো ছাদের মেঝেতে। অনিন্দ্য থামতে পারছে না। আরও বলতে ইচ্ছে করছে। দ্যুতির বাবা-মা বেঁচে থাকলে তাদেরও শোনাতো। এমন মেয়ের বাবা-মা এই সমাজে আছে বলেই ওমন ছেলে আর ছেলের পরিবারও আছে। এমন মেয়ের পরিবার না থাকলে ওমন ছেলে ছেলের পরিবারের ভাত আছে নাকি? মেয়ের পরিবার যদি পাত্র বাছাই এর নিয়ম পাল্টাতো, তাহলে ওই মেরুদন্ডহীন ছেলেগুলোকে মেয়ে দিতো কোন বাবা?

অনিন্দ্য এবার গলার স্বর একটু নামিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল, “তোমার বাবা-মা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে, তুমি সন্তান হিসেবে নিজের দায়িত্ব অবহেলা কোরো না। নিচে চলো। আন্টিকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে। আঙ্কেল আন্টির শেষকৃত্য তোমাকেই করতে হবে। তারপর বাঁচতে হবে। ভালো থাকতে হবে। আন্টি যেন উপর থেকে দেখতে পায়, তার মেয়ে মরে না গিয়ে ভালো আছে, বেঁচে আছে। তারা বেঁচে থেকে তোমাকে যা শেখাতে পারেনি, তুমি বেঁচে থেকে তাদের তা শিখিয়ে দাও। বুঝিয়ে দাও, মৃত্যুই সব সমস্যার সমাধান হতে পারে না। কখনোই না।”

চলবে…