#অমৃতে_অরুচি
#কলমে_গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৩
“কী হলো ওঠো। মৃত্যুর পর মৃতদেহ বেশিক্ষণ ফেলে রাখতে নেই, আত্মা কষ্ট পায়। তোমার বাবার মৃতদেহ এখনও গ্রামের হসপিটালেই, তাকেও বাড়ি নেওয়ার ব্যাবস্থা করতে হবে। দু’জনের আত্মাই কষ্ট পাচ্ছে। তাদের সৎকারের ব্যাবস্থা করবে, চলো।”
দ্যুতি নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল, “আমি পারবো?”
অনিন্দ্যর মনের বোঝা কমলো। মেয়েটা তাহলে প্রভাবিত হয়েছে তার কথায়। আত্মহত্যার চিন্তা সরেছে মাথা থেকে। কিন্তু নিজের প্রতি সামান্য আত্মবিশ্বাস নেই।
“কেন পারবে না? গায়ে শক্তি নেই? না মনে জোর নেই? মরার মতো মনের জোর যখন আছে, বাবা-মায়ের শেষকৃত্য করার মনের জোরও পাবে আশা করি। চলো, ওঠো।”
অনিন্দ্যর মন বিষিয়ে আছে। মুখে ভালো কথা আসছে না। তবুও এভাবে কথাটা বলে মনে অনুশোচনা হলো। ভাবলো তার আরেকটু ভালোভাবে কথা বলা উচিত। সহানুভূতি দেখানো উচিত। কিন্তু পরমুহুর্তেই ভাবলো, মেয়েটা শাষণ বোঝে ভালো, শাষনের সুরে বলা কথা শোনেও মন দিয়ে। আর বেশি সহানুভূতি দেখাতে গেলে যদি আবার ভাবে সে যুযোগ নিতে চাইছে, তাহলে? তার চেয়ে এই আপাতত ভালো।
ভালো কথা বললে আবেগ পেয়ে বসবে ওকে। হয়তো আবার দৌড় দেবে মরবে বলে। আপাতত ভালমন্দ আর কোন কথা না বলাই ভালো। তবে সরি বলবে যাওয়ার আগে। গায়ে হাত তোলাটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।
দ্যুতির মা-বাবাকে এম্বুলেন্সে করে গ্রামে নিয়ে এলো অনিন্দ্য। তবে সাথে আসেনি। আলাদা এসেছে। আসার পর আর দ্যুতির সামনে গেল না। গ্রামের অনেকেই দ্যুতির পাশে আছে এখন, তাই তার না থাকলেও চলবে। এলাকার সাবেক চেয়ারম্যানও এসেছে। সঙ্গে এসেছে এলাকার কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি। যেহেতু ঘটনা এখন সকলেরই জানা, তাই মানুষের অভাব নেই।
কেউ এসেছে তামাশা দেখতে, কেউ এসেছে ক্ষমতা প্রদর্শন করতে, কেউ বা খুঁজছে সমালোচনার প্রসঙ্গ,
কেউ এসেছে জানার কৌতুহলে যে শেষমেশ কী আছে দ্যুতির কপালে। আর আরেক শ্রেণীর মানুষ এসেছে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে।
দ্যুতি একা নেই, অনিন্দ্য তবু চলে যেতে পারলো না। দূরে থাকলো, তবু থাকলো। অদ্ভুৎ এক দুশ্চিন্তা তাকে যেতে দিলো না। শেষটা দেখেই যাবে।
দ্যুতির বাবা-মায়ের সৎকার সম্পন্ন হতে হতে রাত তখন শেষ। ভোরের আলোয় পরিষ্কার গ্রামের পথঘাট। শশ্মান থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর থেকে বারান্দায় বসে আছে। কষ্ট না কমলেও চোখের জল কমে এসেছে। বেঁচে থাকার ইচ্ছে না থাকলেও মরে যাওয়ার ইচ্ছে আর হচ্ছে না।
এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান এখনও আছেন। তিনি বলেছেন, অভিভাবকহীন দ্যুতির একটা ব্যাবস্থা না করে তিনি যাবেন না। এই এলাকার ভালমন্দ তিনিই দেখেন। বৈঠক বসানো হলো। চেয়ারম্যান পাড়া প্রতিবেশির কথা শুনবেন, দ্যুতির কথাও শুনবেন। তারপর সিদ্ধান্ত জানাবেন দ্যুতিকে নিয়ে। শোনা হবে ঋণদাতাদের কথাও। বাড়ির নতুন মালিকেরও নাকি কী কথা আছে।
বৈঠক শুরু হলো পাড়া-প্রতিবেশির কথা দিয়ে। প্রতিবেশিদের মধ্যে কথাবার্তা নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে সবার হয়ে একজনকে কথা বলতে দেওয়া হলো।
“মাইয়া ডাঙ্গর, যুবতী, তারওপর খুবই সুন্দরী। এই মাইয়ারে গেরামের মধ্যে একলা থাকপার দেওন যাইবো না কোনমতেই। অনেক আগে থিকাই দ্যুতিরে নিয়া ওর বাপ-মায় মেলা জ্বালা পহাইছে। কত ছেরারা জ্বালাইছে, চিঠি দিছে, বিয়ার পস্তাব দিছে, পেমের পস্তাব দিছে, রাস্তাঘাটে তো একলা চলবারই পারে নাই। তুইলা নেওয়ার হুমকি দিছে। তাই তো তরতরি বিয়া ঠিক করছিলো। বাপমায় থাকতেই যে মাইয়া নিরাপদ আছিলো না, হেই মাইয়া এহন বাপমাও ছাড়া কোনভাবেই থাকপার দেওন যাইবো না। চেয়ারম্যান চাচা, বিয়ার ব্যাবস্থা করেন। আপনিসহ আমরা সবাই থাইকা বিয়ার কামডা সাইরা হালাই, মাইয়া সেফ থাকুক। পাত্র ঠিক করেন।”
“হ হ, সমাধান একটাই, বিয়া। বিয়া দিলে অভিভাবকও অইলো, থাকার জায়গাও অইলো আর আকাম কুকামের ডরও রইলো না। আমগো ঘরে আবিয়াত্তা পোলারা আছে, ঘরের লগে এমনে আবিয়াত্তা মাইয়ারে একলা রাহন যায়?”
একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবার মুখে মুখে। আলোচনা চলল কিছুক্ষণ। দ্যুতিকে ঘরের বউ করার প্রস্তাব রাখলো অনেকেই। কারও ছেলে বেকার ভবঘুরে, সারাদিন নেশা করে বেড়ায়। কারও ছেলের বয়স বেশি, মেয়ে পায় না মনমতো। কারও ছেলের মাথায় একটু সমস্যা আছে, কেউ বা প্রতিবন্ধী। এমন অনেক ছেলের জন্যই প্রস্তাব এলো।
দ্যুতি নিস্তেজ হয়ে শুনতে লাগলো সব। তার বাবা-মা তাকে ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়ার জন্য, তাকে সুখে দেখার জন্য সর্বহারা হয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে নিল, অথচ তার কপালে কোন বয়ষ্ক, নেশাখোর, প্রতিবন্ধী, অথবা আধপাগলই লেখা ছিল। আগে জানলে ভাগ্য মেনে নিয়ে এদের থেকেই কাউকে বিয়ে করে নিতো। এতো আয়েজন করে বাবা-মায়ের মৃত্যু উদযাপন করতো না।
সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ার আলী কয়েকজনের সাথে আলোচনা করার পর দ্যুতির মতামত জানতে চাইলো। দ্যুতি কোন কথা বলল না। এমনকি প্রতিবেশিরা কথা বলার সুযোগও দিলো না। দ্যুতির মৌনতা হয়ে গেল সম্মতির লক্ষ্মন।
তাতে আনোয়ার আলীর বৈঠক হয়ে গেল মাছের বাজার। আলাদা আলাদা বৈঠক বসতে লাগলো একই উঠোনে। আনোয়ার আলীকে হাত করার প্রচেষ্টা চলতে লাগলো প্রস্তাব রাখা ছেলের পরিবারের তরফ থেকে।
এবার ঋণদাতারারা ঝামেলা দেখে আগেভাগে নিজেদের কথা শেষ করতে চাইলো। চেয়ারম্যান বলল, “যে ঋণ নিছে হে বাঁইচা নাই। পোলা থাকলে বাপের অইয়া টেকা শুধাইতো। কিন্তু আছে একখান মাইয়া, যে নিজেই অসহায়। টেকা চাইবা কার কাছে? দাবী ছাইড়া মন থিকা মাফ কইরা দেও। উপরওয়ালা খুশি অইবো।”
“চাচা, আমরাও গরীব মানুষ, কোটিপতি না। দাবী কেমনে ছাড়ি, কন? পরিস্থিতি বুইঝা আমগো চাইরজনের তরফ থিকা একখান পস্তাব আছিলো। মাইয়ার বিয়ার কতা অইতাছে, বিয়া ছাড়া কেউ থাকপার দিবো না। তাইলে বিয়া যে করবো হে দিক টেকা। মাইয়ারে বিয়া করতে অইলে হশুরের ঋণ শুধাইয়া তারপর বউ নিয়া যাইক। চাইলে সময়ও নিবার পারে। কিন্তু দাবী ছাড়ুম না চাচা। আমাগোও রক্ত জল করা টেকা।”
এবার পরিস্থিতি পাল্টে গেল। বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে অসন্তুষ্টতার ছাপ। কেউ কেউ রণে ভঙ্গ দিলো, কেউ তুলল আওয়াজ। এ দাবী তারা মানবে না। যেন দ্যুতি তাদের বাপদাদার রেখে যাওয়া সম্পত্তি। যা শুধুমাত্র তাদের মধ্যেই ভাগবাটোয়ারা হবে।
ধীরে ধীরে এক বিশাল ঝামেলা সৃষ্টি হলো। শেষমেশ আনোয়ার আলী যখন ঋণদাতাদের সঙ্গে একমত হয়ে বললেন, দ্যুতিকে বিয়ে করতে হলে শোধ করতে হবে তার বাবার ঋণ করা চার লাখ টাকা, তখন আর কারও আওয়াজ পাওয়া গেল না।
বিয়ের আলাপ এখানেই সমাপ্ত হতে যাচ্ছিলো। কিন্তু রণে ভঙ্গ দেওয়া ছেলের পরিবারের লোকগুলো এবার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল, “এই বিয়া ভাঙ্গা মাইয়া চার লাখ টেকা খরচ কইরা কেরা বিয়া করবো? কেউ না। এমনে করলে এই মাইয়ার জীবনেও বিয়া অইবো না। আর বিয়া না করলে এই পাড়ায় ঠাঁই দিতে আমরা রাজি না। আমগো পাড়ার পরিবেশ নষ্ট অইবো।”
সামনেই ইলেকশন। এতো ক্যাচক্যাচ ভালো না লাগলেও জনগন চটিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে পারছেন না আনোয়ার আলী। জল যেদিক গড়াবে সেদিকেই যেতে হবে তাকে।
এরমধ্যে বাড়ি কিনে নেওয়া বাড়ির মালিক জানিয়ে দিয়েছে এই বাড়ি তার নিজের। টাকা দিয়ে কিনেছে, কাউকে থাকতে দিতে পারবে না। দ্যুতির বাবার সাথে কথা হয়েছিল বিয়ের এক সপ্তাহ পর বাড়ি ছেড়ে দিবে, তাই এক সপ্তাহের বেশি সময় সে কোনভাবেই দেবে না।
ঘুরেফিরে আবার সেই বিয়ের কথা। বিয়েই একমাত্র সমাধান হয়ে দাঁড়ালো। সব মিলিয়ে খুবই বাজে একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো। যা তৈরি করলো বিয়ের প্রস্তাব আনা ছেলের পরিবারগুলো। যেন এমন সুযোগ হাত ছাড়া করলে তাদের ছেলের জীবনই বৃথা হয়ে যাবে। তাদের অমন ছেলের জন্য এমন মেয়ে সাত জনমের ভাগ্যের জোরেই পাওয়া যায়। যা না পেলে আজ ছিনিয়ে নেবে।
যেমন রূপবতী, তেমন গুণবতী। সংসারের সব কাজ জানে। কোন চারিত্রিক বদনাম নেই। আজ পর্যন্ত রাস্তাঘাটে কোন ছেলের সাথে কথা বলতে দেখা যায়নি। অথচ কত ছেলেরা লাইন ধরে থাকতো। সবচেয়ে বড় কথা, এমন অসহায় মেয়ে বাড়ির বউ হয়ে এলে সাত চড়ে রা কাটবে না। আর কী চাই!
এসবের মাঝে দ্যুতি আর নিস্তেজ বসে থাকতে পারছে না৷ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তার সুখের কথা ভাবার মানুষগুলো এভাবে কেন চলে গেল? ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েও যদি বেঁচে থাকতো, অন্তত কেউ তার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি তো খেলতে পারতো না। ভাগাভাগি করতে পারতো না তাকে।
অনিন্দ্য এতোক্ষণ চুপচাপ ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলো। পরিস্থিতি সে বুঝে গেছে। উপায় একটাই, এটা সত্যি। কিন্তু সেটা বিয়ে নয়, দ্যুতি নিজে।
দ্যুতিকে নিজের হয়ে কথা বলতে হবে। আওয়াজ তুলতে হবে, অন্যায় আবদারের প্রতিবাদ করতে হবে। তার নিজস্ব ইচ্ছা অনিচ্ছা আর সিদ্ধান্ত জানানোর সাহস দেখাতে হবে। কিন্তু এই মেয়ে তো চুপ!
এদিকে একেকজন যা ফন্দি আঁটছে তা বুঝতে পেরে মাথা গরম হয়ে গেল অনিন্দ্যর। দ্যুতির চারিত্রিক দোষ নিয়ে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করবে বলে ফন্দি আঁটছে, যাতে বিয়ের ব্যাপার টা সহজ হয়। আর চুপ থাকতে না পেরে অনিন্দ্য ভীড়ের মধ্যে থেকে এগিয়ে গেল আনোয়ার আলীর সামনে।
চলবে…