অমৃতে অরুচি পর্ব-০৪

0
1

#অমৃতে_অরুচি
#কলমে_গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৪

অনিন্দ্য ভীড় ঠেলে চেয়ারম্যনের সামনে যেতেই সকলের নজর কাড়লো। কেউ চেয়ে রইলো সুদর্শন বলে, কেউ চেয়ে রইলো নতুন কোন তামাশা দেখার আশায়। শুধু চোখ তুলে চাইলো না দ্যুতি। তার চারপাশে কে আছে, কে নেই, কী হচ্ছে, কী হতে চলেছে তা নিয়ে মোটেও কৌতুহলী নয় সে। এক ধ্যানে মাটির দিকে চেয়ে আছে। চোখের কোনায় অশ্রু। কল্পনায় বাবা-মায়ের হাসিমুখ।

অনিন্দ্য আনোয়ার আলীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল, “জীবন টা দ্যুতির, সিদ্ধান্তও দ্যুতিই নিক। বিয়ে নিয়ে ওর মতামত জানতে চাইলেন কিন্তু মতামত দেওয়ার সুযোগ দেননি। ওকে সুযোগ দিন কথা বলার। বিয়ে ভাঙা থেকে বাবা-মায়ের মৃত্যু তারপর মুখাগ্নি করে ফিরেছে। এখনও এক গ্লাস জল খেয়েছে কিনা সন্দেহ। আপনারা প্রশ্ন করে সাথে সাথেই উত্তর পেয়ে যাবেন সেই মানসিক অবস্থায় আছে মেয়েটা?”

দ্যুতি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো অনিন্দ্যকে। চোখে ভাসলো গতরাতের মুহুর্ত। রাগী লোকটা চলে যায়নি! এখনও রয়ে গেছে, তার হয়ে কথা বলছে!

“তুমি কেরা? দ্যুতি কিছু লাগে তোমার?”

আনোয়ার আলীর প্রশ্নে অনিন্দ্যর জবাব, “না, কিছু লাগে না।”

“তাইলে চুপ থাকো। দ্যুতির ভালো-মন্দ আমি দেহুম, গ্রামের মানুষ দেখপো, তুমি এরমধ্যে ঢুইকো না।”

“এটাকে ভাল-মন্দ দেখা বলে না, চাচা। বলে জোরজবরদস্তি। দ্যুতির ওপর বিয়েটাকে চাপিয়ে দিচ্ছেন আপনারা। এইযে বিয়ের প্রস্তাব আনা ছেলেগুলো, একটাও জাতের? আমি স্থানীয় না হয়ে জেনে গেলাম একেকজন কত বড় মাপের সুপাত্র আর আপনি স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান হয়ে জানেন না তাতো হতে পারে না। আজ দ্যুতির বাবা-মা বেঁচে থাকলে এদের সাহস হতো দ্যুতির সাথে নিজেদের ছেলের বিয়ের কথা বলার? বাবা-মা নেই বলে যা খুশি করবেন একটা মেয়ের জীবন নিয়ে?”

আনোয়ার আলীর সাঙ্গপাঙ্গরা উত্তেজিত হয়ে উঠলো।

“এই এই, কার সামনে কী কও বুইঝা কইয়ো। সামনে সুন্দরী মাইয়া দেইখা মাথা নষ্ট হইয়া গেছে?”

সবাইকে চুপ করিয়ে আনোয়ার আলী রুক্ষ গলায় বললেন, “কী কইতে চাও?”

অনিন্দ্য কঠোর গলায় বলল, “আমি বলতে চাই আপনারা যেটা করছেন সেটা অন্যায়। দ্যুতির বাবা-মা দুনিয়া ছেড়েছে চব্বিশ ঘন্টাও হয়নি, এই মুহুর্তে গ্রামের লোকজন নিয়ে বসেছেন মেয়েটার বিয়ের আলাপ করতে, কী অমানবিক! দ্যুতিকে জিজ্ঞেস করুন সে কী চায়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় দিন, সাহস দিন।”

“এতো কতা কওয়ার তুই কেরা? দ্যুতি তর কী লাগে?”

“আইছে হিরো সাজতে, বুঝস না? সুন্দর মাইয়া দেইখা মাথা ঠিক নাই।”

গ্রামের লোকজনদের মধ্যে হইহই লেগে গেল। একেকজনের মুখে মনগড়া কথা ও কাহিনী। বিয়ের প্রস্তাব আনা ছেলের পরিবার নিজেদের অপমান সহ্য করতে না পেরে চড়াচ্ছে গলা।

দ্যুতি এবার কথা বলতে বাধ্য হলো। ভীত গলায় বলল, “আপনি যাননি কেন?”

অনিন্দ্যর মেজাজ চটে গেল। সে এখানে এসেছে কেন সেটা মুখ ফুটে বলতে পারলে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে মুখে কেন বলতে পারছে না? অন্যদের সেই অধিকার বা সুযোগ কেন দিচ্ছে?

রাগ দেখিয়ে রুক্ষ গলায় বলল, “এসেছি বিয়ে খেতে। শুনলাম এলাকার নেশাখোর থেকে শুরু করে পাগল ছাগল সবাই তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে আছে!”

অনিন্দ্য অল্পতে রেগে যাওয়া মানুষ। অন্যায় সহ্য করতে পারে না, তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করে বসে। পরবর্তী ফলাফলের চিন্তা করে না। আর রেগে গেলে মুখে ভালো কথা তার কোনকালেই আসে না। তবু দ্যুতির চুপ করে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকা দেখে গভীর শ্বাস নিয়ে মাথা ঠান্ডা করে বলল, “লিসেন, তোমার লাইফ তোমার ডিসিশন। তুমি যে বিয়েতে রাজি নও, সেটা সাফ সাফ জানিয়ে দাও। কারও বাবারও ক্ষমতা নেই তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাকে বিয়ে দেয়ার। দেশে কী আইন নেই নাকি? জাস্ট নিজের মুখে বলো তুমি কী চাও।”

“ওই পোলা ওই, তুমি এতো কতা কও কোন অধিকারে? দ্যুতি তোমারে কইছে ওয় রাজি না? ভংচং কী বুঝাও?”

“রাজি সেটাও তো বলেনি।”

“কওয়ার মুখ আছে? দ্যুতির আর দুনিয়ায় আছে কেরা? বিয়া করলে অভিভাবক অইবো, মাতার ছাদ অইবো, পায়ের নিচে মাটি অইবো আর তিনবেলার খাওনও অইবো। বিয়া ছাড়া কেরা দিবো সব? পালবো কেরা আর দেখবো কেরা? মাইয়া মাইনষের সেফটি বলতেও তো একটা কতা আছে।”

“ও সাহায্য চেয়েছে আপনাদের কাছে? বলেছে আমাকে অভিবাবক দিন, ছাদ দিন, মাটি দিন, বিয়ে দিন?”

“তুমি এতো কতা কওয়ার কেরা? দ্যুতি তোমার কী লাগে?”

“আপনার কী লাগে? আপনি তো কম কথা বলেননি।”

“দ্যুতি আমার গেরামের মাইয়া।”

“দ্যুতি আমার দেশের মেয়ে।”

“ওই পোলা চ্যাংরামি করস? দ্যুতির সাতে তর কী সম্পর্ক ক। নাগর লাগস? তাইলে তুই বিয়া কর। চাইর লাখ টেকা দিয়া নিয়া যা দ্যুতিরে। তারপর করিস মাতব্বরি, জিগাইস দ্যুতি কী চায়।”

টনক নড়লো ঋণদাতাদের। গ্রামবাসীর রাগের মাথায় বলা আচমকা এক উড়ো কথায় যেন টাকা আদায় করার অসীম সম্ভাবনা দেখতে পেলো তারা। সত্যি তো, এই ছেলের গলায় যদি ঝুলিয়ে দেওয়া যায় দ্যুতিকে তাহলে টাকা হাতানো সহজ হয়ে যাবে।

লোভে ঋণদাতারা চড়াও হলো অনিন্দ্যর ওপর। গ্রামবাসীর চেয়েও বেশি উগ্র হয়ে উঠলো। তারা জানে, দ্যুতিকে বিয়ে করতে যতোই পাত্র দাঁড়াক, টাকা দিয়ে কেউই বিয়ে করবে না। তাই তাঁদের টাকা উসুল করার একমাত্র উসিলা এখন অনিন্দ্য। দেখে বড়লোকের ছেলে মনে হয়েছে, তারওপর শহুরে। চাপ দিলেই টাকা আদায় করা যাবে।

“হ হ, টেকা দিয়া বিয়া কইরা তারপর বড় বড় কতা কইক। আইছে হিরো সাজতে। চাচা, এই পোলার সাতে নিশ্চিত এই মাইয়ার সম্পর্ক আছে। কয় চিনে না অথচ জানে সব। এনে আইহা বাধা দিতাছে যাতে টেকাপয়সা ছাড়া দ্যুতিরে ভাগাইয়া নিয়া যাইতে পারে। পোলারে আঁটকাইয়া রাইখা গার্জেন ডাকাইয়া আনেন। তারপর টেকা আদায় কইরা বিয়া করাইয়া দেন।”

দ্যুতি এবার কথা বলল, অনেক কথা। কিন্তু কেউ আর শুনলো না। কথা বলারও সঠিক সময় থাকে। সময় গেলে সাধন হয় না!

গণ্ডগোলে সামিল হলো গ্রামের কিছু উগ্র মস্তিস্কের মানুষ। সঙ্গ দিলো আনোয়ার আলীর সাঙ্গপাঙ্গরা এবং প্রশ্রয় দিলো আনোয়ার আলী।

এক কথায় দুই কথায় শুরু হলো তর্কাতর্কি। দ্যুতি আর অনিন্দ্যকে নিয়ে বাজে কথা বলায় অনিন্দ্য গায়ে হাত তুললো একটা ছেলের। ব্যাস, বেঁধে গেল আরও বিপত্তি।

আটক করা হলো অনিন্দ্যকে। ঋণদাতারা খুশি, নতুন বাড়ির মালিকও খুশি। অখুশি শুধু ছেলের পরিবারেরা, যারা দ্যুতিকে ঘরের বউ করার পায়তারা করছিল। আফসোস কমাতে দ্যুতির চরিত্র নিয়ে শুরু করলো তারা মিথ্যাচার। কিছু একটা করে সন্তুষ্ট তো হতে হবে।

আনোয়ার আলী গ্রামের মুরুব্বীদের কাছে বিয়ের নিয়মকানুন জানতে চাইলেন। জানা গেল, দ্যুতি যেহেতু মুখাগ্নি করেছে সেহেতু একমাস অশৌচ পালন করতে হবে। মুখাগ্নি না করলে তিনদিন অশৌচ পালন করলেই হতো। পরিবারের কারও মৃত্যুর পর বিয়ের মতো যেকোন শুভকাজ ছেলে সন্তানের জন্য হলে এক বছর অপেক্ষা করতে হয়, মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে শ্রাদ্ধ পালনের পর অশৌচ কেটে গেলেই শুভকাজ সম্পন্ন করা যায়।

এমন পরিস্থিতিতে এক মাস অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই সহজ কিংবা বিকল্প উপায় জানতে চাইলেন আনোয়ার আলী। ঋনদাতাদের মধ্যে একজন বলল, “এহন এইসব কেউ মানে নাকি? তিনদিনই যথেষ্ট। তিনদিনের দিন নিয়ম কাম সাইরা চাইর দিনের দিন বিয়া করাইয়া দিলেই অইবো।”

অন্য সময় হলে বেশিরভাগ মানুষ এমন কথা মেনে নিতো না, এখন নিলো। কারণ নিজ স্বার্থে তো আঘাত লাগেনি।

কথা হলো আগামীকাল নিয়মকাজ সেরে আগামী পরশু বিয়ে।

এবার অনিন্দ্যকে বলা হলো বাড়িতে কল করে টাকার কথা জানাতে। অনিন্দ্য অনেক্ক্ষণ যাবত শান্ত হয়ে বসে দেখছিলো সব। রাগ কমেছে, বেড়েছে চিন্তা। এই পরিস্থিতিতে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভেবেচিন্তে বলল, “আমি চাচার সাথে আলাদা কথা বলতে চাই।”

চারজন পাহারায় ছিল। তাদের মধ্যে একজন বলল, “চাচায় কইছে আগে গার্জেন কল তারপর হরি বল, মানে বিয়া। তাছাড়া কোন কতা অইবো না। খুব হিরো সাজতে আইছিলি, এহন বুঝ ঠেলা।”

অনিন্দ্য দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “আচ্ছা হাত খোল, দিচ্ছি কল।”

“কতা কইতে হাত খুলা লাগে? আত খুলার পর পলাইনার ধান্দা থাকলে বাদ দে। আমগো চেহারা দেখছস? চাইরজন আমরা। আত খুললেই করবি কী?”

“তাহলে খুলে দিলেই হয়।”

হাসতে হাসতেই হাত খুললো চারজন। হাত খুলতেই অনিন্দ্য একে একে চারজনকেই মেরে আধমরা বানালো। খুব বেশি হাত-পা ছোড়ার প্রয়োজন পড়লো না। জিম করা শরীর তার, গ্রামের ভুড়িওয়ালা চারজন পুরুষ মানুষ মেরে শুইয়িয়ে দিতে হাতেপায়ের বেশি কসরত করা লাগে না। চারজনেরই মেইন পায়েন্টে গণ্ডগোল ঘটানো হয়েছে। উঠে দাঁড়াতে সময় লাগবে।

শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বাইরে গেল। বাইরে থেকে দরজার সিটকিনি লাগিয়ে বেরিয়ে কিছুদূর এসে দেখল আনোয়ার আলী বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে যাওয়ার আগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঋণদাতাদের সাথে করছে গোপন আলাপ।

ঝোপের পিছনদিক থেকে আসায় তাদের কথোপকথন শুনতে পেল অনিন্দ্য। জানলো, ঋণদাতারা চার লাখ নয় তিন লাখ টাকা পায় দ্যুতির বাবার কাছে। দ্যুতির বাবা চার লাখ টাকা নিলেও এক লাখ টাকা ফিরত দিয়েছিলেন বিয়ের দিন।

এক লাখ টাকা বেশি নিয়ে তা আনোয়ার আলীকে দেওয়া হবে টাকা উঠিয়ে দেওয়ার জন্য। তাহলে এতোক্ষণ যা চলছিলো সবটাই নাটক!

অনিন্দ্যর আবার মাথা গরম হয়ে গেল। ইচ্ছে করলো আনোয়ার আলীর মেইন পয়েন্টেও গণ্ডগোল ঘটাতে। কিন্তু দ্যুতির কী হবে? আগে মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

চাইলে এক্ষুনি চলে যেতে পারে এখান থেকেই, কেউ ধরতে পারবে না। কিন্তু যাবে না। একটা মেয়েকে বিপদে ফেলে চলে যাওয়ার মতো ছেলে সে নয়। এভাবে অন্যের উপকার করতে গিয়ে কত বিপদে সে পড়েছে! সেসবের সামনে আজকের বিপদ তুচ্ছ! কিচ্ছু না।

এগিয়ে গেল আনোয়ার আলীর সামনে। তাকে দেখে আনোয়ার আলী বিস্মিত হলো। এদিক সেদিক চেয়ে সেই চারজনকে দেখতে না পেয়ে তাকিয়ে রইলো অনিন্দ্যর দিকে। অনিন্দ্য ঠান্ডা স্বরে বলল, “আমার কিছু কথা আছে আপনার সাথে, আলাদা।”

অনিন্দ্যর স্বাভাবিক মুখভঙ্গি আর ঠান্ডা গলা শুনে ভড়কে গেল আনোয়ার আলী। ঋণদাতাদের বলল একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াতে। তবে তাকে একলা রেখে চলে যেতে মানা করলো। ভয় ঢুকেছে মনে, আবারও কৌতুহলও ছাড়ছে না। সাহস করে আলাদা কথা বলল।

দু’জনের কথা হলো মিনিট দশেক, খুব বেশি না। তারপর যে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, সেই ঘরেই ফিরে গেল অনিন্দ্য। আর আনোয়ার আলী পাগলের মতো দৌড়ে গেল দ্যুতির কাছে। যেন এক মিনিট দেরি হলে তার জান খোয়া যাবে।

অনিন্দ্য ফোন বের করে কল করলো কাউকে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলে বলল, “আমার দশ লাখ টাকা লাগবে।”

ওপাশে কিছুক্ষণ নিরবতা। অনিন্দ্য আবারও বলল, “ক্যাশ। ঠিকানা টেক্সট করে দিচ্ছি। বাকি কথা সামনাসামনি হবে।”

চলবে…