#অমৃতে_অরুচি
#কলমে_গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৫
ওপাশে কিছুক্ষণ নিরবতা। অনিন্দ্য আবারও বলল, “ক্যাশ। ঠিকানা টেক্সট করে দিচ্ছি। বাকি কথা সামনাসামনি হবে।”
কথা শেষ হতে না হতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো অনিন্দ্য। দরজা খুলতেই ঋণদাতারা অনিন্দ্যকে পাশ কাটিয়ে হুরমুর করে ঢুকে গেল ভেতরে। এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে বলল, ”দশ লাখ টেকা দিয়া কিা করবা?”
অনিন্দ্য বলল, “এই বয়সে আড়ি পেতে কথা শোনার স্বভাব! খুব খারাপ কিন্তু।”
“রাহো তোমার স্বভাব। তোমার সাতে আনোয়ার বাইয়ের কী কতা অইছে হেইডা কও? তহন অমনে তরতরি হাটা দিলো ক্যা? তলে তলে কী চলতাছে?”
“বলেছি, আপনারা যে এক লাখ চাচাকে দিবেন বলেছেন, আমি সেই এক লাখের জায়গায় দশ লাখ দেবো।”
“ক কয় লাখ?”
“দশ।”
“আমগো যে আনোয়ার বাইরে এক লাখ দেওয়ার কতা হেইডা তুমি কেমনে জানলা? আনোয়ার বাই কইছে?”
“না বললে জানলাম কীভাবে? আপনারা ছাড়া কথাটা জানে কে? চাচাই তো?”
“হ, আর কেউ তো জানে না। কী কইছে বাইয়ে?”
“বলল, আপনারা তিনজন নাকি এই বৈঠক বসানোর জন্য তার হাতে পায়ে ধরেছেন সে টাকা নিতে রাজি হয়নি বলে।”
“কী কইলা? এতো বড় কতা! এই এক লাখ টেকা বাড়াইয়া চাইর লাখ টেকা তুলনের কতা আনোয়ার বাই কইছে। হেই কইছে, হেরে এক লাখ দিলে যেমনেই অইক টেকা তুইলা দিবো, আমরা জানি কাউরে না কই যে দুলাল দায় এক লাখ ফিরত দিছিলো।”
“কী বলছেন! চাচা তো বলল দ্যুতির বাবার এক লাখ টাকা পরিশোধ করার কথা কেউ জানে না বলে আপনারা ষড়যন্ত্র করেছেন। সেই ষড়যন্ত্রে তাকে টাকার লোভ দেখিয়ে সামিল করতে পারেননি বলে হাতে পায়ে ধরেছেন। গেল তো আপনাদের সত্যিটা সবার সামনে বলতে। আমি টাকার অফার দিয়ে বলেছি, দ্যুতির বাড়িতে এখনও ভীড় কমেনি। সবার সামনে যদি সত্যিটা বলে দেয় আর আমাকে সসম্মানে যেতে দেয় তাহলে আমি তাকে এক লাখ না দশ লাখ টাকা দেবো।”
“এর লাইগা ওমনে দৌড়াইয়া গেল?”
“হ্যাঁ, দেরি করলে যদি ভীড় কমে যায়! আবার মানুষ ডাকাডাকি ভেজাল না?”
“হায় হায় রে! এহন কী করমু? আমরা যদি কই চেয়ারম্যানেই আমগো দিয়া এক লাখ বাড়াইয়া কওয়াইছে, আমগো কতাতো কেউ-ই বিশ্বাস করবো না। এহন তো আমও গেল ছালাও গেল! টেকা তো পামুই না, এলাকায় মুকও থাকপো না।”
“আহারে! সহজ সরল মানুষ পেয়ে ঠকিয়ে দিল। মায়া লাগছে। আপনারা চাইলে কিন্তু আমি হেল্প করতে পারি।”
“কেমনে?”
“চেয়ারম্যান এখনো কিছু বলেনি। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি বলেছি ফোন করে টাকাটা ম্যানেজ করে তারপর আসছি। আমি গেলে আমাকে সামনে রেখেই কথা শুরু করবে। এখন আমার সাথে চলুন। চেয়ারম্যান কিছু বলার আগে সবার সামনে বলে দিন, চেয়ারম্যান আপনাদের দিয়ে এই ঘৃণ্য কাজটা করিয়েছে। একজন মৃত মানুষের নামে মিথ্যে ঋণের বোঝা চাপিয়েছে।”
“যদি কেউ বিশ্বাস না করে? আমগো চেইয়া আনোয়ার বাইরে মানুষ বেশি মানে, বেশি বিশ্বাস করে। হের কতার দাম আছে।”
“আপনাদের কথাটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য একটা কাজ করতে হবে। বলবেন, আপনারা অসহায় বাপ-মা মরা একটা মেয়ের কাছ থেকে এভাবে টাকা আদায় করে শান্তি পাচ্ছেন না। তাই সব টাকার দাবী ছেড়ে দিচ্ছেন। দ্যুতির কাছে আপনাদের আর কোন দাবী নেই, দ্যুতি মুক্ত। তাহলে চেয়ারম্যান উল্টো দোষারোপ করার আগেই গ্রামবাসীর কাছে মহান হয়ে যাবেন। তারপর চেয়ারম্যান যাই বলুক কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। সবাই ভাববে, যারা তিন লাখ টাকার দাবী ছেড়ে দিতে পারে তারা নিশ্চয়ই মিথ্যে বলবে না?”
“তা ঠিক আছে। কিন্তু এতো টেকা ছাইড়া দি…”
“সত্যি সত্যি ছাড়তে হবে না। তিন লাখ তো! আমি দিয়ে দিবো। ঘণ্টা খানিকের মধ্যে টাকা নিয়ে আমার ড্রাইভার চলে আসবে। আসলে আপনার টাকা আমি দিয়ে দেবো। দ্যুতি যদি আপনাদের উপর খুশি হয় তাহলে এক লাখ টাকা বাড়িয়েও দিতে পারি।”
“কিন্তু যদি না দেও?”
“বিশ্বাস না হলে থাক। আমার লাভ তো দু’দিকেই। তবে… আপনাদের দিলে আমার চার লাখ যাবে, খুব বেশি হলে পাঁচ লাখ। আর চেয়ারম্যানকে দিলে দশ লাখ। তাই চাচ্ছিলাম আপনাদের সাথেই ফাইনাল ডিল করি।”
একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো তারা। তারপর সম্মতি জানালো। অনিন্দ্য আবারও ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। দরজা খুলে হাঁটলো দ্যুতির বাড়ির দিকে। যেতে যেতে ঋণদাতাদের বোঝালো, ওখানে গিয়ে সময় নষ্ট না করে সাথে সাথে যেন বোম টা ফাটায়। নয়তো চেয়ারম্যানের সন্দেহ হলে সে যদি আগে আগে কথাটা বলে ফেলে তাহলে তাদের কথা গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করবে না।
অনিন্দ্যর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার অঙ্গীকার নিয়ে ও বাড়ি ঢুকলো সবাই। অনিন্দ্যর চোখ সবার আগে খুঁজলো দ্যুতিকে। দেখল এখনও উঠোনেই বসা। আনোয়ার আলী চেয়ার পেতে বসা দ্যুতির ঠিক সামনেই। কী যেন বলছে আর মাথা ঝাঁকাচ্ছে। অনিন্দ্য ঋণদাতাদের ইশারা করে সরে দাঁড়ালো তাদের থেকে।
তারা সবার মনেযোগ আকর্ষণ করলো আগে। সবাইকে ডেকে জড়ো করে বলল, “সবার সামনে আমগো কিছু কতা আছে, স্বীকারোক্তি কইতে পারেন। এদিক আহেন সবাই। আমি মন্টু আর মানিক তিনজনে যে চাইর লাখ টেকার দাবী জানাইছি হেইডা মিছা কতা। আমরা চাইর লাখ না তিন লাখ টেকা পাই। দুলাল দায় বিয়ার আগের দিন রাইতে এক লাখ টেকা আমগো ভাগ কইরা দিয়া দিছিলো। আমরা আর তিন লাখ পাইতাম।”
গ্রামবাসীর বিস্মিত প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকা দ্যুতিও নড়েচড়ে বসলো। আর আনোয়ার আলীর দম আটকে গেল গলার কাছে। ঘাম মুছে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল ঋণদাতাদের কাছে। উদ্দ্যেশ্য, তাদের মুখ বন্ধ করা।
তার পথ আঁটকে দাঁড়ালো অনিন্দ্য। ফিসফিসিয়ে বলল, “চুপচাপ দাঁড়া হারামজাদা। সামনে ইলেকশন। ইমেজ আর থোবড়া দুটো একসাথে খারাপ করতে না চাইলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। নয়তো ব্যানারে ছবি ভালো আসবে না।”
আনেয়ার আলী স্তব্ধ হয়ে গেল অনিন্দ্যর আচরণে। একটু আগের অনিন্দ্য তো তার দলে ছিল, মুখে ছিল মিষ্টি মিষ্টি কথা আর দ্যুতির গয়না হাতানোর প্ল্যান। রাগে গা কাঁপতে লাগলো তার। তাকে ধোঁকা দিলো এই চ্যাংড়া ছেলে!
অনিন্দ্য মন্টুকে ইশারায় বলল জলদি কথা শেষ করতে। এবার মন্টু বলতে শুরু করলো,
“আনোয়ার বাইয়ের কাছে কাইল রাইতে আমরা গেছিলাম দুলাল দায় মরছে হুইনা। তহন হে পুরা কতা হুনার পর কইছিলো দুলাল দায় যে এক লাখ ফিরত দিছে তা জানি আমরা কাউরে না কই। হে চাইর লাখ উঠাইয়া এক লাখ নিজে নিবো আর তিন লাখ আমগো দিবো। আমরা প্রথমে মানতে চাই নাই। হে আমগো হুমকি দিছে, হের কতা না হুনলে আমগো টেকা জীবনেও উঠাইতে দিবো না। আর আমগো ব্যাপসাও ডুবাই দিবো।”
“হ৷ আমরা ভয় পাইয়া রাজি অই। কিন্তু মনে মনে অনুতাপ অইতাছিলো। শান্তি পাইতাছিলাম না কেউ। বাপ-মা মরা অসহায় মাইয়াডারে বিপদে ফালাইয়া টেকা নিয়া আমরা শান্তিতে বাঁচপারও পারুম না, মরবারও পারুম না। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, সবার সামনে আমগো ভুল স্বীকার কইরা মাফ চাইয়া নিমু আর আমরা আমগো টেকার দাবী ছাইড়া দিমু। সবাইরে সাক্ষী রাইখা আমরা কই, দ্যুতির কাছে আমগো কোন দাবী নাই, দ্যুতি ঋণমুক্ত। ওর বিয়া কইরা আমগো টেকা দিতে অইবো না।”
গ্রামবাসীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। একেকজনের একেক রকম মন্তব্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলো দ্যুতিদের বাড়ির ছোট্ট উঠান। কেউ খুশি হলো, কেউ অবাক, কেউ অখুশি, আবার কেউ করছে উপভোগ। যেন তামাশা চলছে।
আনোয়ার আলী নিজেকে সাধু প্রমাণ করতে নানান যুক্তি নিয়ে উঠেপড়ে লাগলেও তা ধোপে টিকলো না। শেষমেশ চেলাপেলাদের নির্দেশ দিলো ঋণদাতাদের হাত-পা ভেঙে দিতে। কিন্তু তারা সংখ্যায় মাত্র আটজন। আর গ্রামের প্রায় অর্ধেক মানুষ তাদের চারপাশে। জনগন ক্ষেপলে রক্ষা নেই ভেবে এক প্রকার পালিয়ে গেল সবাই। আনোয়ার আলী হয়ে গেল একা। তার হম্বিতম্বি এবার ভয়ে পরিণত হলো।
দ্যুতি নিরবে সব দেখছে। তার কী যেন বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কী বলবে আর কাকে বলবে বুঝতে পারছে না। মনের উপর থেকে ভারী এক বোঝা নেমেছে। ভীষণ হালকা লাগছে তার। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দেওয়ার সময় চোখে ভাসলো অনিন্দ্যর মুখটা। তার মা তো বলতো, ইশ্বর কখনো নিজে আসেন না আমাদের সাহায্য করতে। কাউকে না কাউকে আমাদের কাছে পাঠান। যে আমাদের সবরকমের বিপদ থেকে কোন না কোনভাবে উদ্ধার করে ফেলে। অনিন্দ্যই সেই মানুষটা। যাকে তার কাছে সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছেন। তাকে পুরোপুরি একা করে দেননি।
এবার অনিন্দ্য এগিয়ে দাঁড়ালো আনোয়ার আলীর মুখোমুখি। হাত উঁচু করে ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, “সময় একটু আছে হাতে। কিছু বলবেন?”
আনোয়ার আলী রাগী চোখে তাকালো। কিছুক্ষণ আগে তুইতোকারি করে এখন আপনি!
অনিন্দ্যর মনে হলো কোন শেয়াল তাকিয়ে আছে তার দিকে। যে নিজেকে ভীষণ ধূর্ত মনে করে, কিন্তু আসলো বোকা।
“ওগোরে আত করলি কেমনে? ওগো দিয়া এইসব তুই কওয়াইছস তাই না? আমারে দ্যুতির সোনার গয়নার কতা কইয়া পাঠাইলি। গয়না চুরি অইয়া যাইবো, রাকপো কোনে, আমি জানি আমার হেফাজতে রাখি। তারপর একলা পাইয়া ওগো আত করছস। ভালো বুদ্ধি। কিন্তু এতে আমার বা * ল ছেঁড়া গেছে বা * ল! এনে কারও সাহস আছে আমার সামনে খাড়াইয়া প্রশ্ন করার? দেখ, নিজেরা নিজেরা আলোচনা করতাছে সবাই। কেউ আইগাইয়া আহে নাই আমারে দুইডা কতা জিগাইতে। ভোটাভুটি আইতে আইতে সবাই সব ভুইলা যাইবো। নোট পাইলে কেউ এইসব মনে রাহে না। দ্যুতির মিছা নাগর বানাইছিলাম তরে। কিন্তু তুই তো সত্যিকারের নাগর বাইর অইলি। ভালো কতা। আমিও দেহি, এই গ্রামে দ্যুতি কেমনে থাকে।”
দুজনের কথা শেষ হতে না হতেই পুলিশ চলে এলো। আনোয়ার আলী একা ভয় পেল না। ভয় পেল ঋণদাতারাও। তারা অনিন্দ্যর পাশ ঘেঁষে বলল, “পুলিশ ক্যা?”
“চোর ধরতে এসেছে।”
“আইচ্ছা ধরুক। তুমি আমগো টেকা দিয়া দেও আমরা যাইগা।”
“কীসের টাকা?”
“এই, এমন কতা কইয়ো না বাপ, তোমার ভরসায় এতো বড় কাম করলাম আমরা। আইচ্ছা, আমগো বাড়তি টেকা লাগবো না, তিন লাখ পাই তিন লাখই দেও।”
“আমাকে কোটিপতি মনে হয়? এতো টাকা পাবো কোথায় আমি! টাকার দুঃখে বিষ কিনে ঘরের ইঁদুর মারতে পারি না, এসেছে তিন লাখ চাই!”
হতবাক তিনজন। প্রকাশ্যে না পারলেও মনে মনে মাথায় হাত রাখলো হয়তো। একদিকে পুলিশের ভয়, আরেকদিকে টাকার চিন্তা। তিনজনেই ঘামতে লাগলো দরদর করে।
অনিন্দ্য পুলিশের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হাত মিলিয়ে বলল, “হ্যালো অফিসার। আমি অনিন্দ্য চ্যাটার্জি।”
“হ্যালো অনিন্দ্য। চ্যাটার্জি বাবুর কল পেয়েছি আমি। কোন চিন্তা কোরো না, ভিক্টিমের সাথে কথা বলে যত দ্রুত সম্ভব যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমার উপর ভরসা রাখতে পারো।”
অনিন্দ্য মাথা ঝাঁকিয়ে সৌজন্যমূলক হেসে কিছুক্ষণ কথা বলে দ্যুতির কাছে এলো। কালক্ষেপণ না করে সরাসরি বলল, “আমি ঢাকা চলে যাচ্ছি। আমার সাথে যাবে?”
অপার সংকোচ আর অস্বস্তিতে হাত-পা জমাট বেঁধে গেল দ্যুতির। এটা ঠিক কেমন প্রস্তাব ছিল!
অনিন্দ্য বলল, “দেখো, এ বাড়িটা তুমি ফেরত পেতে পারো। গয়না যা আছে বিক্রি করলে বাড়ি বিক্রির টাকাটা প্রায় উঠে যাবে। কিন্তু এখানে তুমি একলা বাঁচতে পারবে না। ওরা কেউ তোমাকে বাঁচতে দেবে না। তুমি চাইলে আমার সাথে ঢাকা আসতে পারো। ঢাকায় আমার দাদুর আশ্রম আছে সেখানে থাকতে পারো যতদিন তোমার ইচ্ছা। তোমার কোন কিছুর অভাব হবে না, সেখানে থেকে তুমি পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে পারবে। আমি সব ব্যাবস্থা করে দেবো। যাবে আমার সাথে?”
চলবে…