অর‌ণ্যে রোদন পর্ব-২৭+২৮+২৯

0
256

#অর‌ণ্যে_রোদন
‌লেখা: শার‌মিন আক্ত‌ার সাথী
পর্ব: ২৭

‘হ্যাঁ আমি প্রেগ‌নেন্ট। তু‌মি বাবা হ‌তে, কিন্তু এখন হতে পার‌বে না।’
‌নিহাদ, কথার প‌রের কথাটা খেয়াল করল ন‌া। ও শুধু শুনলো কথা প্রে‌গনেন্ট। কথার গ‌র্ভে ওর সন্তান। ‌নিহাদ বিছানা থে‌কে নি‌মে কথার সাম‌নে ফ্লো‌রে বসল। কথার হাতদু‌টো নি‌জের হা‌তের মু‌ঠোয় নি‌য়ে ওর কো‌লে মাথা রে‌খে অনেকক্ষণ চুপ ক‌রে রইল।

তারপর ওর পে‌টের কাছ থে‌কে শা‌ড়িটা স‌রি‌য়ে পে‌টে আলত চুমু খে‌য়ে বলল, ‘আমার বাবা।’
কথার দিকে তা‌কি‌য়ে বলল, ‘ধন্যবাদ, কথা। অনেক ধন্যবাদ। তু‌মি আমা‌কে পৃ‌থিবীর বেস্ট‌ অনুভূ‌তির সা‌থে প‌রি‌চিত কর‌লে। বেস্ট‌ উপহারটা দি‌লে। এ খুশির কো‌নো ভাগ হয় না। কত সপ্তাহ?’
‘এগারো সপ্ত‌াহ।’
‘খুব ছোট্ট তাই না?
‘হ্যাঁ খুব।’

‌নিহাদ আবার কথা পে‌টে মুখ গুজল। পে‌টে ছো‌টো ছোটা চু‌মু খে‌তে খে‌তে বলল, ‘কথা, এ অনুভূ‌তির কো‌নো নাম হয় না। বাবা হওয়ার এ অনুভূ‌তি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বর্ণনাতীত আনন্দময় এ অনুভূ‌তি।’

কথা কিছুক্ষণ চুপ ক‌রে নিহা‌দের কান্ড কারখানা দেখল। তারপর বলল, ‘স‌রি নিহাদ!’
‘‌কেন?’
‘আ‌মি তোমা‌কে এ অনুভূতি অন‌ুভব কর‌তে দিব না।’
‌নিহাদ বেশ জিজ্ঞাসু দৃ‌ষ্টি‌তে কথার দি‌কে তাকাল। কথা বলল,
‘বুঝ‌লে না?’
‌নিহাদ মাথা নে‌ড়ে বলল,
‘না।’
‘তোমার শা‌স্তি এটাই।’
‘বুঝলাম না।’

কথা শীতল চো‌খে নিহা‌দের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল, ‘তু‌মি জান‌লে তু‌মি বাবা হবে। খু‌শি হ‌লে এ অনুভূ‌তিটা‌কে অনুভবও কর‌লে কিন্তু এই অনুভূাতটাই তোমা‌কে অনুভূ‌তিশূণ্য কর‌বে।’

‌নিহাদ আবারও অবাক দৃষ্টিতে কথার পা‌নে তাকাল। কথা বলল, ‘‌তোমার শা‌স্তি এটাই।’
‘মা‌নে?’
‘তু‌মি জ‌ানবে তোমার সন্ত‌ান পৃ‌থিবী‌তে আসত কিন্তু তু‌মিই তার মৃত্যুর কারণ হ‌বে।’

চম‌কে উঠল নিহাদ। চোখ বড় বড় ক‌রে কথার দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল, ‘কী বল‌ছো এসব?’
‘হ্যাঁ এ সন্তান‌কে আমি পৃ‌থিবী‌তে আস‌তে দিব না। এই নিষ্ঠুর পৃ‌থিবীতে ও আসার আগেই ওকে আমি বিদায় দিব। আজ‌কে আর কাল‌কে যত পা‌রো নিজ সন্তান‌কে আদর করে নাও। পরশু ওর শেষ দিন। আমি পরশু ডাক্তা‌রের এ্যাপ‌য়েন্ট‌মেন্ট নি‌য়ে‌ছি বাচ্চা এবরশন কর‌ার জন্য।’

‌নিহাদ ভয়াবহ চম‌কে উঠে দাঁ‌ড়ি‌য়ে গেল। তারপর বলল,
‘কী বল‌লে তু‌মি?’
‘তু‌মি যা শুনলে। আমি বাচ্চা এবরশন করাব।’
‘অসম্ভব। আমি আমার সন্তান‌কে কিছু‌তেই হারা‌তে পারব না।’
‘আ‌মি আমার সন্তান‌কে কোনো চ‌রিত্রহীন ব‌াবার নাম দিতে চাই না। কো‌নো চ‌রিত্রহীন লো‌কের বাবা হওয়ার কো‌নো অধিকার নেই।’

‌নিহাদ করুণ চো‌খে কথার দি‌কে তা‌কি‌য়ে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আর কতবার ক্ষমা চাই‌বো ব‌লে? আমার একটা ভুল, একটা বোকা‌মির জন্য তু‌মি যা ইচ্ছা শা‌স্তি দাও কিন্তু এই ভুলটা ক‌রো না। দে‌খো ওর কি দোষ? ও তো নিষ্পাপ।’
কথা বেশ ক‌ঠিন ক‌ণ্ঠে বলল, ‘ওর দোষ একটাই ও তোমার সন্তান।’
‘ও তো আমার একার নয় তোমারও সন্তান।’

কথা নি‌জের চো‌খের জল আট‌কে ক‌ঠিন গলায়ই বলল, ‘হ্যাঁ আমারও সন্তান ওর কপাল খারাপ যে ও তোমারও সন্তান। সে কার‌ণে ও পৃ‌থিবী‌তে আস‌বে না।’
‘কথা ও আমা‌দের ভা‌লোবাসার অংশ।’
‘‌তো? তোমার ধোকাটাও তো আমি পে‌য়ে‌ছি। তু‌মিই ব‌লে‌ছি‌লে যা শা‌স্তি দিব মাথা পে‌তে নি‌বে। তাহ‌লে খবরদার আমা‌কে বাঁধা দি‌বে না।’

‌নিহাদ বেশ রাগী ক‌ণ্ঠে বলল, ‘তু‌মি আমা‌কে শাস্তি দি‌বে তাই তো? ওয়েট!’
‌নিহাদ টে‌বি‌লে ব‌সে কিছু একটা লিখল তারপর বাই‌রে গি‌য়ে একটা ছু‌ড়ি এনে কথার হা‌তে দি‌য়ে বলল,
‘এই নাও ছু‌ড়ি আমা‌কে কে‌টে টুক‌রো টুক‌রো টুক‌রো ক‌রো। নয়‌তো আমার গলা কে‌টে ফেলো। আমি চি‌ঠি‌তে লি‌খে দি‌য়েছি আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না। আমি দায়ী। তু‌মি খুন ক‌রো আমা‌কে, নি‌জের রাগ ঠান্ডা ক‌রো, আমা‌কে শা‌স্তি দাও, তা-ও আমার সন্তান‌কে মারার কথা ব‌লো না।’

কথা ছু‌ড়িটা ফে‌লে দি‌য়ে বলল, ‘তোমা‌কে মার‌লে তুমি ‌তো ম‌রে যা‌বে, তোম‌ার মৃত্যু যন্ত্রণা আমি ভোগ করব, ত‌বে তু‌মি কী কর‌বে? আমি বেঁ‌চে থে‌কেও তোমা‌কে মৃত্যু যন্ত্রণা দি‌তে চাই। আর তার জন্যই আমি বাচ্চাটা‌কে পৃ‌থিবী‌তে আনব না। তোমার রক্ত তে‌া। ওর মৃত্যু‌তে তু‌মিই সব‌চে‌য়ে বে‌শি কষ্ট পা‌বে।’
‘তু‌মি পা‌বে না, কথা? ওর মৃত্যু‌তে তু‌মি তো আমার চে‌য়েও বে‌শি কষ্ট পা‌বে। তু‌মি ওর মা। তোমার ভিতর ও বড় হ‌চ্ছে। আর মা‌য়ের চে‌য়ে সন্তান‌কে কে বে‌শি ভ‌া‌লোবা‌সে? ব‌লে‌া?’

‘হ্যাঁ আমি কষ্ট পা‌বো, সব‌চে‌য়ে বে‌শি কষ্ট পা‌বো কিন্তু তোমা‌কেও কষ্ট দিব। তু‌মি আমা‌কে যে কষ্ট দি‌য়ে‌ছ তার শা‌স্তি তোমায় দিব। তু‌মি কী ভে‌বে‌ছি‌লে? আমি তোমা‌কে ছে‌ড়ে দিব? তারপর তোমা‌কে শা‌স্তি দিব? নো! নেভার! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি তোমা‌কে শা‌স্তি দিব। তু‌মি এতগু‌লো বছর আমার ভা‌লোবা‌সা‌কে দে‌খো‌ছো, এবার রাগ আর ঘৃণা‌কে দেখ‌বে। তোমা‌কে এক দন্ড আমি শা‌ন্তি পে‌তে দিব না। তোমা‌কে সব‌চে‌য়ে বে‌শি ভা‌লোবাসি তে‌া, সে জন্য কষ্টও তত‌বে‌শি দিব। আর তোমার শা‌স্তি এটাই, তু‌মি নিজ সন্তা‌নের মৃত্যুর জন্য দায়ী থাক‌বে।’

নিহাদ নি‌চে ব‌সে কথার পা দু‌টো জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল,
‘দাও শাস্তি আমা‌কে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শা‌স্তি দাও তা-ও আমা‌দের সন্তান‌কে মারার কথা ব‌লো না। ও নিষ্পাপ। ও জান্না‌তের ফুল। ওকে মে‌রে তুমি আমা‌কে তো শা‌স্তি দি‌বে, সাথে ‌নি‌জেও মস্ত বড় পাপি হ‌বে।’
‘হ‌বো পা‌পি, একশবার হ‌বো। আমার সরলতা তু‌মি দে‌খেছো কিন্তু ক‌ঠিন আমা‌কে দে‌খোনি। আমি আমার সিদ্ধা‌ন্তে অটল। এ সন্তান‌কে আমি পৃ‌থিবীর আলো দেখ‌তে দিব না। না মা‌নে না। তা‌তে তু‌মি য‌দি বাঁধা দাও তাহ‌লে আমি সু**ইসা***ইড করব। তখন বাচ্চা আর আমি দুজন‌কে হারা‌বে।’

‌নিহাদ অসহায় চো‌খে কথার দি‌কে তা‌কি‌য়ে রইল। নি‌জে‌কে ওর পৃ‌থিবীর সব‌চে‌য়ে অসহায় মানুষ‌টির ম‌তো লাগ‌ছে। এতক্ষণ যে কথার বু‌দ্ধিমত্তায় ও বিম‌ো‌হিত হ‌য়ে‌ছিল এখন সেই কথার ক‌ঠোরতায়, নিষ্ঠুরতায় ওর প্রচন্ড রাগ হ‌চ্ছে, কিন্তু তা-ও কথা‌কে কিছু বল‌বে না ভে‌বে সিদ্ধান্ত নি‌য়ে‌ছে।

কথা রা‌গের মাথ‌ায় বুঝ‌তে পার‌ছে না ও কত বড় অন্যায় কর‌তে যা‌চ্ছে। নিহাদ, কথা‌কে, কথার স্টাই‌লেই বুঝা‌বে যে ও যেটা কর‌তে যাচ্ছে সেটা কত বড় ভুল, কত বড় অন্যায়অ শাস্তি দেওয়ার অনেক রকম পথ আছে। এ শাস্তি কথা শুধু নিহাদ‌কে নয় বরং নি‌জে‌কে নি‌জে দি‌চ্ছে।

নিহাদ ম‌নে ম‌নে বলল, ‘‌তোমা‌কে তো আমি এতব‌ড়ো অন্যায় কর‌তে দিব না কথা। অা‌মি তোমাকে প্রচন্ড ভা‌লোবা‌সি কথা। আমি নি‌জে ভুল ক‌রে‌ছি, অন্যায় করে‌ছি কিন্তু তোমা‌কে কো‌নো ভুল কিংবা অন্যায় কর‌তে দিব না। তুমি এখন হয়‌তো বুঝ‌তে পার‌ছো না, আমা‌দের সন্তা‌নের মৃত্যু‌তে যতটা কষ্ট আমি পা‌বো, তার চে‌য়ে অধিক কষ্ট তু‌মি পা‌বে। তু‌মি মা। তু‌মি নিজ সন্তান‌কে মে‌রে‌ ফেলবে, এ অপরাধ‌বোধ তোমা‌কে সারাজীবন তা‌ড়ি‌য়ে বেড়া‌বে। আমি তা হ‌তে দিব না। তোমা‌কে আমি তোমার বুদ্ধি‌তেই বুঝাব। একব‌ার গাধা‌মি ক‌রে‌ছি ব‌লে কি বারবার করব?’

‌নিহাদ, কথার দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল,
‘‌ঠিক আছে। তু‌মি যেটা ঠিক ম‌নে কর‌বে সেটা কর‌বে। আর আমি যেটা ঠিক ম‌নে করব সেটা করব। আম‌দের সন্তা‌নের উপর আমি একটা টোকাও লাগ‌তে দিব না, কসম আল্লাহর।’

কথা অনেকটা বিস্ম‌য়ে নিহা‌দের দি‌কে তা‌কি‌য়ে রইল। ম‌নে ম‌নে বলল, ‘কী কর‌তে চাই‌ছে নিহাদ? ও কীভা‌বে আটকা‌বে আমায়? য‌দি বু‌দ্ধি ক‌রে আটকা‌তে পা‌রো তাহলে প্লিজ আট‌কে ফে‌লো আমা‌কে নিহাদ। আমিও খু‌নী হ‌তে চাই না। নি‌জের সন্তান‌কে হত্যা কর‌তে চাই না। ও তো আমার ভিতর বড় হ‌চ্ছে। প্র‌তি মুহূ‌র্তে ওর অস্তিত্ব আমি টের পাই। ওকে আমি প্রচন্ড ভা‌লোবা‌সি, কিন্তু তোমা‌কেও ক্ষমা কর‌তে পার‌ছি না, নি‌জের জে‌দের উপর, রা‌গের উপর কো‌নো কাবু কর‌তে পার‌ছি না।

বিশ্বাস করো নিহাদ আমি রাগ‌কে নয় বরং ক‌দিন যাবত, আমার রাগ জেদ আমা‌কে নিয়ন্ত্রণ কর‌ছে। আমার রাগ আমা‌কে তার ম‌তো প‌রিচালনা কর‌ছে। আমা‌কে দি‌য়ে যা তা করা‌তে চাই‌ছে। নি‌জে‌কে কিছু‌তেই নিয়ন্ত্রণ কর‌তে পার‌ছি না আমি। তু‌মি আমা‌কে ঘরবন্দী ক‌রে রা‌খো তা-ও এই পাপ করা থে‌কে আটকাও। মা হ‌য়ে নিজ সন্তান‌কে কীভা‌বে হত্যা ক‌রি? নিহাদ তু‌মি প্লিজ এমন কো‌নো বুদ্ধি বের ক‌রো, যা‌তে আমার রাগ, জেদটা ক‌মে যায়, আমার সন্ত‌ানটা বেঁ‌চে থা‌কে, ওর যাতে কো‌নো ক্ষ‌তি ন‌া হয়। হে আল্লাহ আমার মন ম‌স্তিষ্ক থে‌কে রাগ, জেদ নামক শয়তান‌টা‌কে তাড়ি‌য়ে দাও। আমা‌কে নি‌জের রাগ নিয়ন্ত্রণ কর‌ার শ‌ক্তি দাও।

‌নিহাদ, কথা‌কে ধ‌রে বিছানায় শু‌য়ে দি‌য়ে ওর পে‌টে মাথা দি‌য়ে বলল,
‘তু‌মি, যখন তোমার জেদ পূরন কর‌বে সিদ্ধান্ত নি‌য়েই ফেলছ, তখন আমা‌কে আমার সন্তা‌নের সা‌থে কিছুটা সময় কাটাতে দাও। ওর সা‌থে প্রাণখুলে কথা বলতে দাও।’

নিহাদ ম‌নে ম‌নে সব ছক কে‌টে ফেলল, কীভা‌বে কথা‌কে আটকা‌বে। কীভা‌বে কথার রাগ, জেদ কম‌বে আর ওদের সন্তানেরও কো‌নো ক্ষ‌তি হ‌বে না।

‌বির‌তি,
শীঘ্রই কিন্তু আমার নতুন বই “‌রৌ‌দ্রোজ্জ্বল দি‌নে একটু মে‌ঘের ছায়া” উপন্যা‌সের প্রি অর্ড‌ার আস‌ছে।

৩০!!
শ্রাবণ, তূবা‌কে মে‌সেজ ক‌রেই যা‌চ্ছে আর তূবা মে‌সেজ দে‌খে কো‌নো উত্তর না দি‌য়ে রে‌খে দি‌চ্ছে।

৫ তা‌রিখ থে‌কে নতুন বই‌য়ের প্রি অর্ডার আস‌বে ইনশাআল্লাহ্। পা‌শে থাক‌বেন।

চল‌বে…

#অর‌ণ্যে_রোদন
‌লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ২৮

৩০!!
শ্রাবণ, তূবা‌কে মে‌সেজ ক‌রেই যা‌চ্ছে আর তূবা মে‌সেজ দে‌খে কো‌নো উত্তর না দি‌য়ে রে‌খে দি‌চ্ছে। শ্রাবণ দুষ্টু‌মি ক‌রে মে‌সেজ ক‌রল,
“মুখ‌টি তোমার ফু‌লের ম‌তো,
চাঁ‌দের ম‌তো হা‌সি
‌সেই কার‌ণে ওগো প্রিয়া
‌তোমায় ভা‌লোবা‌সি।”

‌ছন্দটা প‌ড়ে তূবা ‌নি‌জে নি‌জে বলল, ‘গাধাটা আবার গাধা‌মি শুরু কর‌ছে।’

শ্রাবণ আব‌ার মে‌সেজ করল,
“কাঁচা ম‌রিচ ঝাল
ট‌মে‌টো লাল
আমার কা‌ছে ভা‌লো লা‌গে
‌তোমার দু‌টি গাল।”

ছন্দটা প‌ড়ে তূবার ঠোঁ‌টের কোণ হা‌সি ফুটল। কিন্তু তূবা এবারও শ্রাবণ‌কে কো‌নো উত্তর দি‌লো না। শ্রাবণ আবার মে‌সেজ করল,
“‌তোমার মু‌খের হা‌সিটুকু,
লা‌গে আমার ভা‌লো।
তু‌মি আমার ভা‌লোবাসা,
‌বেঁ‌চে থাকার আলো
রাজার যেমন রাজ্য আছে,
আমার আছো তু‌মি।
তু‌মি ছাড়া আমার জীবন,
শুধু মরুভূমি”

তূবা এবার রাগ ক‌রে মে‌সেজ করল,
“এরপর য‌দি আর একটা চু‌রি করা ছন্দ পাঠাস তোর খবর আছে। থাপড়াই দাঁত ফেলে দিব।”

শ্রাবণ মে‌সেজ করল,
“আমার দাঁত অত নড়ব‌ড়ে না যে এক থাপ্পড়ে প‌ড়ে যা‌বে। তোমার দাঁ‌তের ম‌তো না। তোম‌ার তো দু‌টো দাঁত ফি‌লিং করা। তোমা‌কে বি‌য়ের পর তো তু‌মি মাং‌সের হা‌ড্ডি তো দূ‌রে থাক গরুর মাংস চি‌বি‌য়ে খে‌তে পার‌বে না, আমার চি‌বি‌য়ে খাওয়া‌তে হ‌বে। নয়‌তো মাংস ব্লেন্ডার ক‌রে জুস ক‌রে দি‌তে হ‌বে।”

তূবা আর রিপলাই করল না। মে‌সেজ সিনও করল না। শ্রাবণ দুষ্টু‌মি ক‌রে ক্লান্ত হয় না কিন্তু তূবার ইদা‌নিং সকল কা‌জে খুব ক্লা‌ন্তি পায়। তূবা ভাবল, ‘ওর সা‌থে কো‌নো কথাই বল‌বে না। কথা বল‌লেই আবার গাধাটা উল্টা পাল্টা কথা ব‌লে মেজাজ খারাপ ক‌রে দি‌বে।’

শ্রাবণ এবার অধৈর্য্য হ‌য়ে মেসেজ করল,
“একবার কথা ব‌লো, তাহ‌লে আজ আর বিরক্ত করব না।”

তূবা সা‌থে সাথে কল করল। শ্রাবণ রি‌সিভ করার পর বলল,
‘‌কেমন আছো?’
‘তূবা নিশ্চুপ।’
‘কথা ব‌লো?’
‘‌কী বলবো?’
তূবার কণ্ঠ শু‌নে শ্রাবণ চম‌কে উঠে বলল,
‘এ‌ কি তোমার কণ্ঠ এমন লাগ‌ছে কেন? গলা ব‌সে গে‌ছে কেন?’

তূবা বলতে ইচ্ছা করল, ‘হারা‌মি তোর কথা ভে‌বে কাঁদ‌তে ক‌াঁদতে আমার গলা ব‌সে গে‌ছে, কিন্তু বল‌তে পারল না। ম‌নের কথা ম‌নে লু‌কি‌য়ে বলল, ‘বরফকু‌চি দি‌য়ে ঠান্ডা পা‌নি খে‌য়ে‌ছিলাম তিন গ্লাস। সে কার‌ণে গলা ব‌সে গে‌ছে।’

শ্রাবণ বেশ রাগ ক‌রে বলল, ‘তোমার টন‌সে‌লের সমস্যা আছে জে‌নেও কেন বরফকু‌চি দেওয়া পা‌নি খে‌লে?’
‘মন চাইল খেলাম। তো‌কে জি‌জ্ঞেস ক‌রে খে‌তে হ‌বে?’
‘না, তা কেমন খা‌বে। ত‌বে নি‌জের ভা‌লোটা তো বুঝ‌বে।’
‘‌সে আমি বুঝব। তোর বুঝ‌তে হ‌বে না।’
‘এত রুড‌লি ব্যবহার কর‌ছো কেন?’
‘মন চাই‌ছে তাই।’

দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে শ্রাবণ বলল, ‘বুঝ‌তে পার‌ছি রে‌গে আছো। স‌রিও ব‌লে‌ছি কতবার। তা-ও রাগ ক‌রে আছো। কী কর‌লে তোমার রাগ ভাঙ‌বে ব‌লো?’
‘বল‌লে শুন‌বি?’
‘হ্যাঁ।’
‘প্র‌মিজ।’
‘প্র‌মিজ।’
‘তাহ‌লে অা‌মি যত‌দিন না নি‌জে তোর সা‌থে কথা বলবো, তত‌দিন তুই আমার সা‌থে কথা বল‌বি না, যোগা‌যোগ কর‌বি না, ‌মেসেজও দি‌বি না। তা‌মিম‌কে পড়া‌তে আস‌লেও আমার খোঁজ কর‌বি না।’

শ্রাবণ গম্ভীর ক‌ণ্ঠে বলল, ‘তু‌মি আমা‌কে রাগ ভাঙা‌নোর উপায় বল‌ছো না‌কি, শা‌স্তি দিচ্ছ?’
‘তুই যা ভা‌বিস।’
‘এসব কর‌লে তু‌মি আমা‌কে ভা‌লোবাস‌বে?’
‘আ‌মি ভা‌লোবাস‌বো ব‌লি‌নি। আজ‌কের করা তোর অন্যায়টা ক্ষমা করব।’
‘ক্ষমা কর‌বে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কষ্ট হ‌বে মান‌তে ত‌বে তোমা‌কে যে‌হেতু প্র‌মিজ ক‌রে‌ছি তখন প্র‌মিজ রাখ‌বো। এত‌দিন যে‌হেতু কথা বল‌তে পারব না আজ একটু দেখা ক‌রি।’

‘এখন রাত একটা বা‌জে। আব‌ার দৌড়া‌নি খে‌য়ে ভা‌লো পা’ট‌াও নষ্ট কর‌তে চাস?’
শ্রাবণ বেশ ভ‌য়ে পে‌য়ে বলল, ‘‌তোমা‌কে দেখ‌তে ইচ্ছা কর‌ছে।’

দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে তূবা হেড‌ফোন কা‌নে দি‌য়ে, ভি‌ডিও কল করল। শ্রাবণ আল্হা‌দে আটখানা হ‌য়ে কল রি‌সিভ ক‌রে তূবা‌কে দে‌খে বেশ অব‌াক হ‌লো। তূবার চোখ মুখ ফু‌লে লাল হ‌য়ে আছে। অতি‌রিক্ত কাঁদার ফ‌লে ফর্সা মে‌য়েটা টকট‌কে গোলা‌পি র‌ঙের হ‌য়ে আছে। চোখ ফু‌লে আছে।

শ্রাবণ বলল, ‘তু‌মি কাঁদ‌ছিলে কেন?’
‘‌তো‌কে ‌কে বল‌ছে কাঁদ‌ছিলাম?’
‘বলতে হ‌বে না। তোমা‌কে দেখ‌লে আমি বু‌ঝি।’
‘এত বুঝ‌তে হ‌বে না। দেখা হ‌য়ে‌ছে এখন রাখ‌ছি।’
‘আর দুই মি‌নিট।’
‘না।’
‘‌প্লিজ। জাস্ট টু মি‌নিট। কো‌নো কথা বলব না শুধু দেখব।’
‘আচ্ছা।’

শ্রাবণ অপলক চো‌খে তা‌কি‌য়ে রইল নি‌জের প্রিয়তমর স্বর্গীয় মুখপা‌নে। তূবার এমন বিধস্ত চেহারা দে‌খে শ্রাব‌ণের খুব খারাপ লাগল। শ্রাবণ এক ধ্যা‌নে তূবার দি‌কে তা‌কি‌য়ে আছে দে‌খে, তূবার বেশ অস্ব‌স্তি হ‌চ্ছে। তূবা বলল, ‘আচ্ছা শ্রাবণ রাখ‌ছি। আমার ভা‌লো লাগ‌ছে না।’
শ্রাবণ আর কথা বাড়া‌লো না। বুঝল তূবার স‌ত্যি খারাপ লাগ‌ছে। তাই বলল, ‘আচ্ছা।’

কল কাটার পর তূবা নি‌জে‌ নি‌জে বলল,
‘শ্রাবণ জা‌নিস, বিকালে ছো‌টো ফু‌পি এসেছিলেন আরেকটা সম্বন্ধ নি‌য়ে। ছে‌লের বয়স আট‌ত্রিশ। স্ত্রী মারা গে‌ছেন। এক বাচ্চার বাবা। বাচ্চা পালার জন্য বি‌য়ে কর‌বে। আমার অক্ষমতার কারণে আমার নি‌জের লো‌কেরাই আমা‌কে নি‌য়ে তেমন আশা ক‌রে না। তারা আশা ক‌রে না, আমি ভা‌লো কাউ‌কে ডিজার্ভ ক‌রি। সেখা‌নে তুই তো পার‌ফেক্ট এর উপরে পার‌ফেক্ট। দেখ‌তে ঠিক প্রি‌ন্সের ম‌তো। পড়ালেখায় এত ভা‌লো। তোর ভ‌বিষ্যৎ উজ্জ্বল। সেখা‌নে তোকে আমি কীভা‌বে ডিজার্ভ ক‌রি?

আর আমার তো কো‌নো ভ‌বিষ্যতই আমি দেখি না। পড়া‌লেখা শেষ ক‌রে নি‌জের পা‌য়ে দাঁড়া‌তে পার‌লে হয়তো সবার বোঝাটা একটু কম‌বে। কিন্তু আমা‌কে কো‌নো সম্পূর্ণ ছে‌লে বি‌য়ে কর‌তে চাই‌বে না। আর আমি জে‌নেশু‌নে তো‌কে একটা অসম্পূর্ণ জীবন কী ক‌রে দি বল? আমা‌কে ভা‌লো‌বে‌সে বি‌য়ে কর‌লে কখনো বাবা হ‌তে পা‌রবি না। সবসময় অসম্পূর্ণ থাক‌বি। তো‌কে কীভা‌বে অসম্পূর্ণ থাক‌তে দি বল? ভা‌লো‌বে‌সে ফেলে‌ছি যে তো‌কে। আর যা‌কে ভা‌লোবা‌সি সে মান‌ুষটার ভ‌বিষ্যৎ আ‌মি নষ্ট কর‌তে পারব না। কখনও না। তো‌কে স‌ত্যিটা ব‌লে দিব। তারপর তুই এম‌নিই আমার থে‌কে দূ‌রে থাক‌বি। তখন ভা‌লো-ও থাক‌বি।

‌বির‌তি,
শীঘ্রই কিন্তু আমার নতুন বই “‌রৌ‌দ্রোজ্জ্বল দি‌নে একটু মে‌ঘের ছায়া” উপন্যা‌সের প্রি অর্ড‌ার আস‌ছে।

৩১!!
সকাল এগা‌রোটা,
কথা হস‌পিটা‌লের ওয়ে‌টিং রু‌মে ব‌সে আ‌ছে। একটু পর ওর সি‌রিয়াল। বাচ্চাটা‌কে একটু পরই খুন কর‌বে ও। তারপর ও হ‌য়ে যা‌বে খুনী। কথা নি‌জের পে‌টে হাত রে‌খে কাঁদ‌তে লাগল। কাল রা‌তে কথা একটা স্বপ্ন দেখে‌ছে, পরীর মতো দেখ‌তে একটা মে‌য়ে ওকে মা মা ব‌লে ডাক‌ছে। কথা, নিহাদ মে‌য়েটা‌কে আদর কর‌ছে, তার সা‌থে খেল‌ছে। একটা সুখী প‌রিপূর্ণ প‌রিবা‌রের প্র‌তিচ্ছ‌বি দে‌খে‌ছিল কথা। রাত থে‌কে স্বপ্নটা মাথার ম‌ধ্যে ঘুর‌ছে। কথা কিছু‌তেই নি‌জে‌কে স্থির রাখ‌তে পার‌ছে না।

পে‌টে হাত বু‌লি‌য়ে বিড়‌বিড় ক‌রে বল‌তে লাগল, ‘আমা‌কে মাফ ক‌রার কো‌নো প্র‌য়োজন নেই বাবা। তোর মা‌কে মাফ ক‌খনও মাফ কর‌বি না। আল্লাহর কা‌ছে গি‌য়ে আমার না‌মে না‌লিশ কর‌বি, আমা‌কে যেন ক‌ঠিন শা‌স্তি দেয়।
আমি যে নিরুপায় তা বল‌বো না। আমি যে রা‌গে কো‌নো কিছু না ভেবে সিদ্ধান্ত নি‌চ্ছি তা-ও বল‌বো না। কিন্তু আমি নি‌জেও জা‌নি না আমি কী কর‌ছি? কেন কর‌ছি? কিন্তু আমি এতটুকু বুঝ‌তে পার‌ছি আমি মস্তবড় অন্যায় কর‌ছি। যে অন্যা‌য়ের কো‌নো ক্ষমা হয় না। যে পা‌পের কো‌নো প্রা‌শ্চিত্য হয় না।

নিহাদ ঠিক ব‌লে‌ছে ওকে শা‌স্তি তো দি‌ব সা‌থে নি‌জেও নি‌জে‌কে সারা জীব‌নের জন্য শা‌স্তি দিব। তোর বাবার কা‌ছে আমি আর কো‌নো দিন যাব না। ও য‌দি আমা‌কে ত্যাগ ক‌রে সেটা আলাদা কথা কিন্তু ও য‌দি এত কিছুর পর আমার সা‌থে থা‌কে তবুও ওকে আমি আর কো‌নো‌দিন স্ব‌ামীর অধিকার দিব না। কখনো না। ও আর আমি একই ঘ‌রে থে‌কে সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ হ‌য়ে কাটাবো বা‌কি জীবনটা।

তোর বাবা‌কে বড্ড ভা‌লোবা‌সি ব‌লে, ওকে ছে‌ড়ে থাকা সম্ভব না। কিন্তু ওর অন্যায়টা‌কে ক্ষমা কর‌তে পারছি না ব‌লে ওর কা‌ছে থাকাও সম্ভব না। আমি আছি মহা দ্বিধায়। যেখান থে‌কে কো‌নো স‌ঠিক সিদ্ধান্ত নি‌তে পার‌ছি না। কোনটা স‌ঠিক কোনটা ভুল তা বিচার বি‌বেচনা কর‌তে পার‌ছি না। হয়‌তো আমি পশু হ‌য়ে গে‌ছি। হয়‌তো আমার বি‌বেকবোধ ম‌রে গে‌ছে। হয়তো আমি রাক্ষসী হ‌য়ে গে‌ছি। রাক্ষস যেমন নি‌জের সন্তান‌কে খে‌য়ে ফে‌লে, আ‌মিও তেমন নিজ সন্তান‌কে হত্যা কর‌তে যা‌চ্ছি।’

কথা একটু চালা‌কি করছে। নিহাদকে ব‌লে‌ছে ডাক্তা‌রের ডাক্তা‌রের এ্যাপ‌য়েন্ট‌মেন্ট বিকা‌লে কিন্তু এ্যাপ‌য়েন্ট‌মেন্ট সকা‌লে। ও কাউ‌কে না জা‌নি‌য়ে সকা‌লে হস‌পিটা‌লে চ‌লে এসে‌ছে নিজ সন্তান‌কে হত্যা কর‌তে। নিহাদ, তূবা ছাড়া, কেউ তো জা‌নেও না কথা প্রেগ‌নেন্ট। কথা জানা‌বেও না আর কাউ‌কে।

একটু পরই কথার সি‌রিয়াল আসল। কথার নাম ধ‌রে ডাকল একজন লোক। কথা রুমটার ম‌ধ্যে যাবার সাহস পা‌চ্ছে না। একটু পর পর ঐ রুম থে‌কে মে‌য়েরা বিধস্ত চেহারায় বের হয়। প্রায় প্র‌তিটা মে‌য়েই কান্না কর‌তে কর‌তে বের হয়। ঐটা পৃ‌থিবীর সব‌চে‌য়ে জঘণ্য র‌ুম। কারণ ওখা‌নে নিঃষ্পাপ কিছু জীবন‌কে র্নিদয়ভা‌বে হত্যা করা হয়। কথার পা যেন চল‌ছে না। ম‌নে হ‌চ্ছে, পাদু‌টো জ‌মে গে‌ছে। কথা চো‌খের সাম‌নে সব অন্ধাকার দেখ‌তে লাগল। তবুও কাঁপা কাঁপা হা‌তে ফোনটা হা‌তে নি‌য়ে নিহাদ‌কে কল করল।

নিহাদ কল রি‌সিভ করে বলল, ‘ব‌লো?’
‘আ‌মি হস‌পিটা‌লে।’
‌নিহা‌দের বুকটা ধক ক‌রে উঠল। কথা বলল,’এখন যা‌চ্ছি আমি আমার হৃদ‌য়ের অংশটা‌কে হৃদয় থে‌কে আলাদা কর‌তে। তু‌মি হয়‌তো রাগ কর‌বে, হয়তো কখনো ক্ষমা কর‌বে না। কারণ তু‌মি যে অন্যায় ক‌রে‌ছো, আমিও ততটাই ঘৃণ্য অপরাধ কর‌তে যা‌চ্ছি। আমি যেমন তোমা‌কে ক্ষমা কর‌তে পার‌ছি না, তু‌মিও তেমন আমা‌কে ক্ষমা ক‌রো না। সারাজীবন আমা‌কে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় ক‌রি‌য়ে রে‌খো।’
‘কথা, আমার কথা শো‌নো।’

কথা ফোনটা কে‌টে বন্ধ ক‌রে দি‌লো। কথা এবরশন করা‌নোর রুমটায় প্র‌বেশ করল। বে‌ডে শু‌য়ে চো‌খের কো‌ণ বে‌য়ে পড়া অশ্রু ম‌ুছল। তারা কথা‌কে একটা ইন‌জেকশন পুশ করল। ধী‌রে ধী‌রে কথা জ্ঞান হারা‌লো। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন নিহাদ ওর পা‌শে বসা। নিহা‌দের চো‌খ বে‌য়ে অনর্গল অশ্রু ঝরছে। নিহাদ কথার দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল,
‘তু‌মি পার‌লে এভা‌বে আমার সন্তান‌টা‌কে মে‌রে ফেল‌তে?

নতুন বই‌য়ের প্রি অর্ডার ইনশাআল্লাহ ৫ তা‌রিখ থে‌কে শুরু হ‌বে।

চল‌বে…

#অর‌ণ্যে_রোদন
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ২৯

জ্ঞান হারা‌নোর সময় কথা অস্পষ্ট স্ব‌রে বিড়‌বিড় ক‌রে বল‌ছিল,
‘আমার বাচ্চা‌কে মেরো না। ওকে আস‌তে দাও সুন্দর এ পৃ‌থিবীতে। আমি মার‌তে চাই না ওকে। ওকে মার‌তে পারব না। ও আমার জান। আমার নিহা‌দের অংশ।’

কথার ম‌নে হ‌লো নিহাদ ওর সাম‌নে দাঁ‌ড়ি‌য়ে হাস‌ছে। হয়‌তো বিদ্রুপ হা‌সি হাস‌ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আস‌ছে। ঝাপসা চো‌খে যেন নিহা‌দের মুখটা দেখল। কিন্তু এটা ওর ম‌স্তি‌ষ্কের কল্পনা মাত্র। নিহাদ কীভ‌া‌বে আস‌বে? এই মাত্র তো কথা বলল নিহা‌দের সা‌থে। নিহাদ ভা‌র্সিটি‌তে ক্লাস নি‌চ্ছে। কথা হাত বাড়া‌লো। ওর ম‌নে হ‌লো নিহাদ‌কে ছুঁ‌য়ে দি‌লো যেন। অন্য হাত পে‌টে রে‌খে বিড়‌বিড় ক‌রে বল‌তে লাগল, ‘আমার সন্তান। আমার প্রাণ।’
ওর চো‌খের সাম‌নে কা‌লো কা‌লো বিন্দু ঘুর‌ছে। চো‌খের সাম‌নে ঘুটঘু‌টে অন্ধকার ছে‌য়ে যা‌চ্ছে। সব‌কিছু ধী‌রে ধী‌রে অন্ধকার, গভীর নিকষ কা‌লো আধা‌রে প‌রিণত হ‌লো। কথা ধী‌রে ধী‌রে জ্ঞান হারা‌লো।

কথার যখন জ্ঞান ফিরল তখন ঘ‌ড়ি‌তে একটা বা‌জে।
জ্ঞান ফেরার পর কথা রু‌মের চার‌দি‌কে তাকাল। এখনও মাথাটা ঝিম ঝিম কর‌ছে। চো‌খে সব‌কিছু ঝাপসা দেখ‌ছে। কা‌নে আস‌লো ঘ‌ড়ির টিক টিক শব্দ। ডান দি‌কের দেয়া‌লের দি‌কে তাকা‌তেই দেখল, ধবধ‌বে সাদা দেয়া‌লে টানা‌নো কা‌লো ঘ‌ড়িটা টিক‌ টিক শব্দ ক‌রে এগি‌য়ে চল‌ছে সম‌য়ের সা‌থে সা‌থে।

ঝাপসা চো‌খে কথা রুমটা‌কে ভা‌লো করে পর্য‌বেক্ষণ করল। হস‌পিটা‌লের ছোটো একটা কে‌বিন। হস‌পিটা‌লের কে‌বি‌নে যা যা থাকা দরকার সবই আছে। ত‌বে ধবধ‌বে সাদা দেয়া‌লে টানা‌নো দু‌টো বাচ্চার র‌ঙিন ছ‌বি। কি সুন্দর ক‌রে হাস‌ছে বাবু দু‌টো! একটা মে‌য়ে বাবু একটা ছে‌লে বাবু। বাবু‌দের ছ‌বি দেখ‌তেই কথার নি‌জের বাচ্চার কথা ম‌নে পড়ল। নি‌জের অজা‌ন্তেই হাত চ‌লে গেল পে‌টে। পে‌টে হাত দি‌তেই কেঁপে উঠল কথা। ম‌নে ম‌নে বলল, ‘আমার বাচ্চাটা কি ত‌বে…!’
পা‌শে তা‌কি‌য়ে ‌দেখল নিহাদ ব‌সে আছে। ওর চোখ থে‌কে অনর্গল অশ্রু ঝর‌ছে।

নিহাদ কথার দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল,
‘কথা, স‌ত্যি তু‌মি পার‌লে এভা‌বে আমাদের সন্তান‌ দু‌টো‌কে মে‌রে ফেল‌তে?’
কথা চম‌কে উঠল। বলল,
‘দু‌টো?’
‘হ্যাঁ। টুইন’স ছিল। আর তু‌মি দু‌টো প্রাণ‌কে পৃ‌থিবী‌তে আসার পূ‌র্বেই…!’

কথা হতভম্ব হ‌য়ে নিহা‌দের দি‌কে তা‌কি‌য়ে রইল। ওর এখন হাসফাস লাগ‌ছে। কী ক‌রেছে তা ভে‌বে ছটফট কর‌তে লাগল। ওর ম‌নে আছে, ও শেষ মুহূর্তে চায়‌নি বাচ্চা‌কে মার‌তে। জ্ঞান হারাবার পূ‌র্বে ব‌লে‌ছিল বাচ্চা‌কে না মার‌তে। তবে কি কথাগু‌লো কেবল ম‌নে ম‌নে ব‌লে‌ছিল? ডাক্তাররা শো‌নে‌নি ওর কথা? প্রচন্ড ক‌ষ্টে চোখের কোণ বে‌ঁয়ে অশ্রু নদী বই‌তে লাগল।

নিহাদ বলল, ‘কথা, এতদিন আ‌মি ভাবতাম আমার প্র‌তি তোমার, রাগ,‌ জেদ, অভিমান জ‌মে আছে, কিন্তু তোমার ম‌নে যে আমার জন্য ঘৃণা জ‌মে গে‌ছে সেটা আজ জান‌তে পারলাম। আমি এত‌দিন এটা ভে‌বে তোমার সব‌কিছু মুখ বু‌ঝে সহ্য করেছিলাম যে তু‌মি রে‌গে আছো। আর রাগ এক‌দিন না এক‌দিন ক‌মে যাবে। সম‌য়ের সা‌থে সা‌থে সকল রাগ ক‌মে যায়। কিন্তু আজ তোমার করা কা‌জে বুঝ‌তে পারলাম তু‌মি আমা‌কে প্রচন্ড ঘৃণা ক‌রো। এতটাই ঘৃণা করো যে আমার সন্তাদের পর্যন্ত হত্যা কর‌তে তোমার বুক কাঁপল না।

কথা, সন্তান‌ তো আমার একার ছিল না? তোমারও ততটাই যতটা আমার অংশ। তোমার মা‌ঝেই জী‌বিত ছিল। তাহ‌লে কীভা‌বে পারলে তা‌দের…! আমা‌দের সন্তান তো অবৈধ‌ ছিল না যে, তু‌মি তা‌দের নোংরার ম‌তো ফে‌লে দি‌লে? সন্তান তো আমা‌দের শুদ্ধতম ভা‌লোবাসার প্র‌তিক ছি‌ল। আমা‌দের মা‌ঝে তৈরি হওয়া প‌বিত্র কিছু অনুভূতি যা প্রা‌ণে রূপ নি‌চ্ছিল। কিন্তু তু‌মি সে প্রাণ দু‌টো‌কে…!

আমার করা অন্যায়ের পূ‌র্বে থে‌কে তু‌মি জান‌তে তু‌মি প্রেগ‌নেন্ট, আমা‌কে হয়‌তো জানাও‌নি। ভুলটা আমার ছিল, অন্যায়টা আমার ছিল তাহ‌লে শা‌স্তি আমার সন্ত‌ানরা কেন পেল? তোমার বি‌বেক কী ব‌লে, কথা? একজনার ভু‌লের শা‌স্তি অন্য‌কে দেওয়া কি ঠিক? তা-ও নিষ্পাপ দু‌টো বাচ্চা‌কে! যারা কি না পৃ‌থিবীর মুখও দে‌খে‌নি? পরম মমতায় মা‌য়ের গ‌র্ভে থে‌কে পৃ‌থিবী‌তে‌ আসার অপেক্ষা কর‌ছিল।

এই কাজটা করার পূ‌র্বে তোমার অন্তর একবারও কাঁ‌পল না? একবারও ম‌নে হয়‌নি যা‌দের মার‌ছো তারা তোমার নাড়ির সা‌থে সংযুক্ত! যা‌দের মারছো সে কেবল তোমার স্বামীর দুই ফোটা বীর্য থে‌কে তৈরী হয়‌নি ব‌রং তোমার শরী‌রের রক্ত মাংস তার ভিতর মি‌শে আছে? ম‌নে হয়‌নি সে তোমার অস্তি‌ত্বের অংশ? এই কাজটা করার পূ‌র্বে একবারও কী নি‌জের মন‌কে জি‌জ্ঞেস ক‌রে‌ছি‌লে তু‌মি কী কর‌ছো? কেন কর‌ছো? ঠিক কর‌ছো না‌কি ভুল?

মানলাম আমি অপরাধী, পৃ‌থিবীর সব‌চে‌য়ে ঘৃণ্য কীট, জা‌নোয়ার, নরপশু আমি। কারণ নি‌জের স্ত্রীর সাথে প্রতরণা ক‌রে‌ছি। আমার বেঁ‌চে থাকার, সু‌খে থাকার কো‌নো অধিকার নেই। কিন্তু তু‌মি কী জান‌তে না কেন ক‌রে‌ছিলাম? আদৌ সেটা প্রতারনা ছিল কি না? তবুও ম‌ানলাম দোষ আমার ছিল, তো শা‌স্তি তো আমার প্রাপ্য ছিল। আমি তোমা‌কে এটা পর্যন্ত ব‌লে‌ছিলাম আমা‌কে মে‌রে ফেলো, কিন্তু তু‌মি কী কর‌লে আমার আত্মাটা‌কে মে‌রে ফেল‌লে। আমার অনাগত দু‌টো সন্তান‌কেই মে‌রে ফেল‌লে।

আমি যে অন্যায় ক‌রে‌ছি তু‌মিও তারচে‌য়ে কম কিছু করো‌নি। আজ‌কের পর তু‌মি আ‌মি একই প‌থের প‌থিক। এরপর তু‌মি আমা‌কে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করা‌তে পার‌বে না। পার‌বে না আমার থে‌কে মুখ ঘু‌রি‌য়ে নি‌তে। আমি নি‌জেই তোমার থে‌কে ম‌ুখ ঘু‌রি‌য়ে নিব। ভেব না তোমা‌কে ছে‌ড়ে দিব কিংবা পরনারী‌তে আক‌র্ষিত হ‌বো। নিহা‌দের জীব‌নে নারী আকর্ষণ কেবল কথার জন্যই ছিল। আজ‌কের পর কারও জন্য থাক‌বে না। আজ‌কের পর পু‌রো সমা‌জের চো‌খে আমরা কেবল স্বামী-স্ত্রী থাকব কিন্তু আদ‌তে আমা‌দের মাঝে কো‌নো সম্পর্ক থাক‌বে না। তু‌মি ঠিক কর‌লে না কথা। কাজটা ঠিক কর‌লে না। আমি তো তোমার ম‌তো তোমা‌কে ঘৃণা কর‌তে পারব না, কিন্তু কা‌ছে টান‌তেও হয়‌তো পারব না।’

কথা নিঃশ‌ব্দে নিহা‌দের কথাগু‌লো শুনলো। চোখ বে‌য়ে বই‌ছে নোনা নদীর ধারা। ইতিম‌ধ্যেই ও বুঝ‌তে পে‌রে‌ছে ও কতবড় ভুল ক‌রে‌ছে। কিন্তু এখন বুঝে কী হ‌বে? অনু‌শোচনা ছাড়া করার ম‌তো কিছুই নেই এখন। যা করার তা তো ক‌রেই ফে‌লে‌ছে।

দুজন অনেকক্ষণ চ‌ুপচাপ ব‌সে কাঁদল। কেউ কারও সা‌থে কো‌নো কথা বলল না। কিছুক্ষণ পর ‌নিহাদ, কথা‌কে বলল,
‘বাসায় চ‌লো। একা উঠ‌তে পার‌বে?’
কথার কান্নার দরুণ হেচ‌কি উঠে গে‌ছে। কোনম‌তে বলল,
‘পারব।’

কথা পারব বল‌লেও প্রচন্ড মাথা ঘুরা‌নোর দরুন উঠে দাঁড়‌া‌তে পার‌লেও নি‌জে‌কে স্থির রাখ‌তে পারল না। ‌প‌ড়ে যে‌তে নি‌লে নিহাদ কথা‌কে শক্ত ক‌রে ধ‌রে নি‌জের সাথে দাঁড় নিল। তারপর বলল,
‘‌তোমার অনেক ‌ব্লি‌ডিং হ‌য়ে‌ছে। হয়তো এ কার‌ণে শরীর দুর্বল। চ‌লো নি‌য়ে যা‌চ্ছি।’

‌নিহাদ, কথা‌কে কো‌লে তু‌লে নি‌লো। নি‌হা‌দের চোখ বে‌য়ে ক‌য়েক‌ ফোটা অশ্রু কথার গা‌লে পড়ল। কথার ম‌নে হ‌চ্ছে এগু‌লো অশ্রু নয় নিহা‌দের হৃদ‌য়ের অনু‌শোচনার তপ্ত অনুভূ‌তি। যা কথার ভিতরটা ছাড়খার ক‌রে দি‌চ্ছে।

কথা ম‌নে ম‌নে বলল, ‘‌নিহাদ কি স‌ত্যি অনুতপ্ত? য‌দি ও স‌ত্যি অনুতপ্ত হয়, ত‌বে আমি কী করলাম? অা‌মি নিহাদ‌কে ক্ষমা করব না ভে‌বে, ওকে কষ্ট দিব ভে‌বে যে পদ‌ক্ষেপ নিলাম, সে কষ্ট তো এখন আমা‌কে খে‌য়ে ফেলবে। দগ্ধ কর‌বে অনুশোচনার আগু‌নে। মে‌রে ফেল‌বে প্র‌তিটা মুহূ‌র্তে। আমার দু‌টো সন্তান‌কে আমি নিজ হা‌তে হত্যা করলাম। বেঁ‌চে থাকার কো‌নো অধিকার নেই আমার। শেষ করে দিব নি‌জে‌কে।’

কথা, নিহাদ‌কে বলল, ‘আমা‌কে ছা‌ড়ো নিহাদ।’
‘তু‌মি দাঁড়া‌তে প‌ারবে না।’
‘পারব। নি‌চে নামাও।’
নিহাদ, কথা‌কে ছাড়‌তেই কথা দৌ‌ড়ে হস‌পিটালের বারান্দায় চ‌লে গেল। ওরা তিন তলায় ছিল। নিহাদও, কথার পিছু পিছুই দৌড় দি‌লো। কথা, বারান্দা থে‌কে লাফ দি‌বে তার পূ‌র্বেই নিহাদ কথা‌কে ধ‌রে ফেলল।

কথা হাত, পা ছুড়‌তে ছুড়‌তে বলল, ‘ছা‌ড়ো নিহাদ। ম‌রে যেতে দাও আমা‌কে। আমার ম‌তো রাক্ষসীর বেঁ‌চে থাকার কো‌নো অধিকার নেই। ছা‌ড়ো বল‌ছি ছা‌ড়ো।’
নিহাদ, কথা‌কে শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধরে বলল, ‘আর একটু বাড়াবা‌ড়ি কর‌লে চড় মে‌রে দাঁত সব কয়টা ফে‌লে দিব। অসভ্য মে‌য়ে সবসময় নি‌জের মন ম‌র্জি কর‌বে।’
‘ছা‌ড়ো নিহাদ। আমি দু‌টো জীবন‌কে হত্যা করে‌ছি। জে‌দের ব‌শে সব‌চে‌য়ে ঘৃণ্য কাজ ক‌রে‌ছি। পৃ‌থিবীর সব‌চে‌য়ে ঘৃণ্য অপরাধ ক‌রে‌ছি। আমা‌কে ছা‌ড়ো। ম‌রে যে‌তে দাও।’

এবার নিহাদ স‌ত্যি স‌ত্যি ঠাস ক‌রে কথার গা‌লে একটা চড় ব‌সি‌য়ে দি‌লো। চড় খে‌য়ে কথা বেহুশ হ‌য়ে নিহা‌দের বু‌কেই প‌ড়ে গেল। অসুস্থ শরীরটা, ম‌নের আর শরী‌রের ধকল নি‌তে পারল না। জ্ঞান হা‌রি‌য়ে ফেলল। নিহাদ, কথা‌কে কো‌লে তু‌লে কে‌বি‌নে চ‌লে গেল। ওদের কান্ড দেখ‌তে ছো‌টো খা‌টো একটা জটলা পে‌কে গেল সেখা‌নে। নিহাদ সেসব ভ্রু‌ক্ষেপ না ক‌রে কথা‌কে সাম‌লে নি‌লো।

কথা‌কে স্যালাইন দেওয়া হ‌লো। ডাক্তার আজকের রাতটা কথা‌কে হস‌পিটা‌লে রাখ‌তে চাই‌লে নিহাদ বলল,
‘বা‌ড়ি‌তে ব‌সে ও দেখাশুনা কর‌বে।’
কথার বিষ‌য়ে নিহাদ কাউ‌কে কিছু ব‌লে‌নি। কথা যেমন ওর বিষ‌য়ে কিছু ব‌লে‌নি। নিহাদও তেমন কথার বিষয়ে কিছু বলে‌নি। বা‌ড়ি‌তে ফোন ক‌রে ব‌লে‌ছে, কথা‌কে নি‌য়ে এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খে‌তে গে‌ছে। ফির‌তে রাত হ‌বে।
নিহা‌দের বাবা-মা কখনোই ছে‌লে বউ‌য়ের বিষ‌য়ে নাক গলান না। ওদের কথা অকপ‌টে মে‌নে নেন,‌ বিশ্বাস ক‌রেন।

‌বির‌তি,
আমার নতুন বই “‌রৌ‌দ্রোজ্জ্বল দি‌নে একটু মে‌ঘের ছায়া” উপন্যা‌সের প্রি অর্ড‌ার কাল থে‌কে আস‌ছে ইনশাআল্লাহ।

রাত আটটা।
‌নিহাদ, কথা‌কে নি‌য়ে গা‌ড়ি‌তে উঠল। তখন কথা কিছুটা স্বাভা‌বিক। গা‌ড়ি স্ট্রার্ট দি‌তেই কথা বলল,
‘সকা‌লে তু‌মি তো ভা‌র্সি‌টি‌তে ছি‌লে, তাহ‌লে হস‌পিটা‌লে আস‌লে কী ক‌রে?’

‌নিহাদ, কথার প্র‌শ্নের কো‌নো জবাব দি‌লো না। একম‌নে গা‌ড়ি চালা‌তে লাগল। বা‌ড়ি পৌঁ‌ছে কথা‌কে ধ‌রে ভিত‌রে নি‌য়ে গেল। কথা‌কে ‌দেখে মো‌মেনা বলল,
‘এ কি কথা? তোর এ অবস্থা কেন? চেহারা এমন বিধ্বস্ত কেন? তোরা না বেড়া‌তে গি‌য়ে‌ছি‌লে? তাহ‌লে তো‌দের চেহারা এমন কেন?’

‌নিহাদ, শীতল ক‌ণ্ঠে বলল, ‘কথা একটু অসুস্থ হ‌য়ে প‌ড়ে‌ছিল। অনেক‌দিন পর লম্বা জা‌র্নি করলো তো তাই। আর আমারও মাথাটা যন্ত্রণা কর‌ছে। মা, খি‌দে পে‌য়ে‌ছে, খে‌তে দাও। ফ্রেশ হ‌য়ে আস‌ছি।’
‘আচ্ছা যা জল‌দি ফ্রেশ হ‌য়ে নে। আমি টে‌বি‌লে খাবার দি‌চ্ছি।’
রু‌মে ঢু‌কে নিহাদ কথা‌কে বলল,
‘ফ্রেশ হ‌য়ে নাও।’

বাথরু‌মে ঢু‌কে ঝরনা ছে‌ড়ে কথা ডুক‌রে কাঁদ‌তে লাগল। বারবার কা‌নে বাজ‌ছে আমা‌দের ট‌ুইন’স ছিল। দু‌টো জীবন‌কে কথা হত্যা ক‌রে‌ছে। ওর ম‌রে যেতে ইচ্ছা কর‌ছে কিন্তু ও তো মর‌তেও পার‌বে না। হস‌পিটা‌লে আ**ত্মহ**ত্যা করতে চাইবার ঘটনার পর নিহাদ ব‌লে‌ছিল,
‘এখন তু‌মি ম‌রে গে‌লে তো আর আমার সন্তানরা ফি‌রে আস‌বে না। তু‌মি যেমন আমা‌র সন্তা‌দের, আমার স্ত্রী‌কে আমার থে‌কে দূর ক‌রে, আমা‌কে শা‌স্তি দি‌লে। আমা‌কে বেঁ‌চে থাক‌তেও মৃত্যু যন্ত্রণা দি‌লে। সে যন্ত্রণা তোমা‌কেও পে‌তে হ‌বে। তোমা‌কেও বেঁচে থাক‌তে হ‌বে। সন্তান হারা মা হ‌য়ে, স্বামী থাক‌তেও স্বামী হারা স্ত্রী হ‌য়ে। য‌দি তু‌মি সু*সাই**ড করার চেষ্টা ক‌রো বা ক‌রো, অথবা নি‌জে‌কে কো‌নোভা‌বে আঘাত ক‌রো, তাহ‌লে আমিও নি‌জে‌কে শেষ ক‌রে দিব। আমার সন্তানরা তো চ‌লে গে‌ছেই তা‌দের পিছু পিছু তু‌মি গে‌লে আমি বেঁ‌চে থে‌কে কী করব? আমিও নি‌জে‌কে শেষ ক‌রে দিব। সিদ্ধান্ত তোমার। পার‌বে তো সৃ‌ষ্টিকর্তার কা‌ছে এতগু‌লো অন্যা‌য়ের জবাব‌দি‌হিতা কর‌তে?’

নিহা‌দের কথাগুলো ভে‌বে কথা আরও ক‌ষ্টে জর্জ‌রিত হ‌য়ে ভে‌ঙে পড়ল। বাথরু‌মে ব‌সে কাঁদ‌তে লাগল হাউমাউ ক‌রে। বাথরু‌মের দরজার অপরপা‌শে ব‌সে কাঁদ‌তে লাগল নিহাদ। অনেকক্ষণ হবার পর কথা বের না হলে, নিহাদ বেশ ক‌য়েকব‌ার কথা‌কে ডাকল। কো‌নো সারা না পে‌য়ে দরজায় ধাক্কা দি‌তে দেখল দরজার সিট‌কি‌নি দেওয়া না। নিহাদ ভিত‌রে ঢু‌কে গেল। কথা তখন ঝরনার নি‌চে ব‌সে ভিজ‌ছে আর কাঁদ‌ছে।

দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে নিহাদ ঝরনা বন্ধ ক‌রে দি‌লো। তারপর কথা‌কে বসা থেকে উঠি‌য়ে দাঁড় করা‌লো। তোয়া‌লে দি‌য়ে ওর মাথ‌া মুছ‌তে মুছ‌তে বলল,
‘কাঁদ‌লে আর নি‌জে‌কে শা‌স্তি দি‌লে আমার বাচ্চারা ফেরত আস‌বে না। নি‌জে‌কে সুস্থ রা‌খো। তোমার শা‌স্তি অন্যভা‌বে হ‌বে। অনু‌শোচনায় পু‌ড়ে যে দগ্ধ হ‌বে সেটাই তোমার শা‌স্তি।’

কথার আবার মাথা ঘোরা‌চ্ছে। সারা শরীর কাঁপ‌ছে। নিহাদ নি‌জেই ওর কাপড় পা‌ল্টে দি‌লো। কথা‌কে ধ‌রে বিছানায় ব‌সি‌য়ে ও বাথরু‌মে চ‌লে গেল ফ্রেশ হ‌তে। নিহাদ বের হ‌য়ে দেখল, কথা সেই একভা‌বেই বিছানায় ব‌সে আছে। চুলও মুছে‌নি। নিহাদ, কথার চুল মু‌ছে দি‌তে দি‌তে বলল,
‘জানো কথা, ক্ষমা মানু‌ষের মহৎ গুণ। জা‌নি সব ভুল, সব অন্যা‌য়ের ক্ষমা হয় না। কিন্তু কিছু ভুল, কিছু অন্যায় মানুষ ইচ্ছাকৃত ক‌রে না। হয়‌তো মন থে‌কে তা‌কে ক্ষমা ক‌রা যায় না কিন্তু তা‌কে ঘৃণাও করা যায় না। আমি যে অন্যায়টা অনি‌চ্ছাকৃত ক‌রে‌ছিলাম, তবুও সেটার ক্ষমা হয় না। কিন্তু কথা আমি কখনও ভা‌বি‌নি, আমার উপর রাগ ঘৃণা থে‌কে তু‌মি এমন কিছু কর‌বে।

কথা নিশ্চুপ ব‌সে রইল। নিহাদ, কথার চুল মু‌ছে, ওদের খাবার রু‌মে নি‌য়ে আসল। কথা‌র দি‌কে খাবার এগি‌য়ে বলল,
‘‌খে‌য়ে নাও প্লিজ।’

কথা খাবার না খে‌য়ে শু‌য়ে পড়ল। নিহাদ ওকে জোর ক‌রে তু‌লে বলল,
‘কথা আমা‌কে রা‌গিও না। চুপ ক‌রে খে‌য়ে নাও। আমি তোমাকে সেই শা‌স্তি দি‌তে পারব না, যেটা তু‌মি আমা‌কে দি‌য়ে‌ছো কিন্তু তোমা‌কে আমি অফূরন্ত ভা‌লো‌বে‌সে শা‌স্তি দিব। আমার ভা‌লোবাসায় তোমার দম বন্ধ হ‌য়ে আস‌তে চাই‌বে, কিন্তু আমি তোমার দম বন্ধ হ‌তে দিব না। ঘৃণার শা‌স্তির চে‌য়ে, ভা‌লোবাসার শা‌স্তি অনেক ক‌ঠিন। অনেক বে‌শি ক‌ঠিন।’

৩২!!
আজ দশ‌দিন হ‌য়ে গেল, তূবার সা‌থে কো‌নো যো‌গাযোগ নেই শ্রাব‌ণের। তূবার ফোন বন্ধ। শ্রাবণ অবশ্য রোজ একবার ক‌রে কল ক‌রে। কারণ, তূবা‌কে প্র‌মিজ ক‌রে‌ছে ও তূবা‌কে বিরক্ত কর‌বে না। যত‌দিন না তূবা নিজ থে‌কে যোগা‌যোগ কর‌বে তত‌দিন যোগা‌যোগ কর‌বে না। ক’‌দিন যাবত তা‌মিকে পড়া‌তে গি‌য়েও তূবার দেখা পায় না শ্রাবণ। হয় তূবা ঘ‌রে থা‌কে না, নাহয় রু‌মে দরজা বন্ধ ক‌রে থা‌কে। শ্রাব‌ণের সাম‌নেই আসে না। শ্রাব‌ণের চোখদু‌টো তূবা‌কে দেখার জন্য ছটফট কর‌ছে।

আমার নতুন বই “‌রৌ‌দ্রোজ্জ্বল দি‌নে একটু মে‌ঘের ছায়া” উপন্যা‌সের প্রি অর্ড‌ার কাল থে‌কে আস‌ছে ইনশাআল্লাহ।

চল‌বে…