#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৩০
শ্রাবণের চোখদুটো তূবাকে দেখার জন্য ছটফট করছে। গত পনেরো দিন যাবত তূবার ছাঁয়াটা পর্যন্ত দেখেনি। শোনেনি ওর কণ্ঠস্বর। শ্রাবণ এখন আর থাকতে পারছে না। রুমে বসে বারবার তূবার ফোনে কল করছে কিন্তু ফোন নাম্বার বন্ধ। শ্রাবণ শ’খানিক মেসেজও করল। কিন্তু যেখানে ফোন বন্ধ সেখানে মেসেজ কীভাবে সিন হবে।
ঘরে একা বসে বসে শ্রাবণের বোর লাগছে। ভাবল বন্ধুদের সাথে গিয়ে আড্ডা দিবে। তখন কলিং বেল বাজল। শ্রাবণ দরজা খুলতেই মনে হলো একআকাশ সুখ এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। দরজার সামনে তূবা দাঁড়িয়ে। পরনে সাদা এমব্রয়ডারি করা সুতির থ্রি পিচ। ওড়নাটাও সুতির, ওড়নাটা দিয়ে মাথা আবৃত করা। চুলগুলো বেনী করে কাঁধের উপর থেকে সামনে ফেলা। গালের দুই সাইডে কিছু চুল বের হয়ে আছে। যার কারণে ওকে দেখতে মিষ্টি লাগছে।
চেহারায় প্রসাধনীর ছোঁয়া তো দূরে থাক দেখে মনে হচ্ছে কেবল চোখ মুখে পানি দিয়ে এসেছে। চোখের নিচটা বেশ কালো দেখাচ্ছে। ঠোঁট দুটো শুষ্ক। অনেক বেশি কাঁদলে চেহারা দেখতে যেমন অসহায়ের মতো লাগে ঠিক তেমন লাগছে। শ্রাবণের বুকটা হু হু করে কেঁপে উঠল। শ্রাবণের মনে চাইল ভালোবাসার অমৃত সুধা দিয়ে তূবার শুষ্ক ঠোঁট দুটোকে ভিজিয়ে দিক। কিন্তু সাহস হলো না।
শ্রাবণ, তূবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেমন আছো?’
‘হুম ভালো। তুই?’
‘ভালো নেই। কতদিন যাবত তোমার সাথে যোগাযোগ নেই, তোমার ছাঁয়াটা পর্যন্ত দেখি না, তোমার কণ্ঠস্বর শুনি না, ভালো থাকি কী করে বলো?’
তূবা শুষ্ক কণ্ঠে বলল, ‘চাচি কোথায়?’
‘মা-বাবা তো কথা আপুর বাসায় গেছেন।’
‘বর্ষণ ভাই?’
‘তিনি অফিসে। রাতের আগে তো ফিরে না।’
‘আমি ভিতরে আসব?’
‘আরে জিজ্ঞেস করার কী আছে আসো।’
শ্রাবণ দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। তূবা ভিতরে গিয়ে সোফায় বসল। তূবা জানত এ সময় বাসায় শ্রাবণ ছাড়া কেউ নেই। কথার সাথে কথা হয়েছে। ও-ঐ বলেছে, বাবা-মা আজ বিকালে ওর সাথে দেখা করতে যাবে। তূবা, শ্রাবণকে নিজের কথা বলার জন্য এমনই একটা সুযোগ খুঁজছিল। তাই যখন দেখল শ্রাবণী আর কথার বাবা সোহেল বেড়িয়ে গেছে, তার কিছুক্ষণ পরই ও চলে এসেছে। তূবা সোফায় বসে সাহস সঞ্চায় করছে। মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে কীভাবে কী বলবে!’
শ্রাবণ ওর পাশের অন্য সোফাটায় বসে বলল, ‘কী মহারানি রাগ কমেছে?’
‘তোকে কিছু বলার ছিল।’
‘বলো।’
তূবা বলতে নিয়ে ঢোক গিলল। বলল, ‘আমাকে এক গ্লাস পানি দে।’
শ্রাবণ পানি আনতে গেল। তূবা চট করে চোখের কোণে জমা অশ্রুগুলো ওড়না মুছে মনে মনে বলল, ‘আমি জানি, শ্রাবণ আজকের পর আর তুই আমার সাথে যোগাযোগ করবি না। আমাকে ভালোও বাসবি না। আমার প্রতি হওয়া তোর ক্ষনিকের মোহ কেটে যাবে আজ থেকে।’
শ্রাবণ পানি নিয়ে আসল। তূবা এক নিঃশ্বাসে পানিটা খেয়ে গ্লাসটা টেবিলে রাখল। তারপর মাথা নিচু করেই রইল। তূবার মৌনতা দেখে শ্রাবণ বলল, ‘কিছু বলবে বলছিলে?’
তূবা চট করে প্রশ্ন করল, ‘শ্রাবণ, তোর বাচ্চাদের কেমন লাগে?’
‘ভীষণ ভালো। আর বাচ্চাদের কার না ভালো লাগে?’
‘হুম তা ঠিক।’
‘তুই যাকে বিয়ে করবি নিশ্চয়ই চাইবি তোর কয়েকটা ফুটফুটে সন্তান হোক।’
‘সেটা তো বিয়ের পর ডিসাইড করব। অন্যের বাচ্চা ভালো লাগা এক কথা, আর নিজের বাচ্চা হওয়া, তার রেসপন্সসিবিলিটি নেওয়া আরেক কথা।’
‘তবুও তুই চাইবি না। তোর বউয়ের বাচ্চা হোক?’
‘সেসব পরের কথা। যখন বিয়ে করব তখন তুমি আমি মিলে সিদ্ধান্ত নিব।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তূবা বলল, ‘তুই কি শিওর আমাদের বিয়ে হবে?’
‘১০০% শিওর।’
তূবা তাচ্ছিল্য হেসে বলল, ‘যদি বলি আমার সিক্রেট জানার পর তুই আর আমাকে বিয়ে করতে চাইবি না?’
শ্রাবণ খানিকটা ভ্রু কুচকে বলল, ‘কী সিক্রেট?’
শ্রাবণ মনে মনে বলল,
‘প্লিজ তূবা, চুপ করো। কিছু বলো না। আমি কিছু শুনতে চাই না। আমি সব জানি। আমি তোমার কোনো কিছু শুনতে চাই না। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি, অন্য কিছু না।’
কিন্তু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তূবা বলল, ‘শ্রাবণ আমি কখনও মা হতে পারব না। আমার কিছু সমস্যার কারণে ডাক্তার বলেছেন, আমার মা হবার চান্স মাত্র ৫%। এখন তুই ডিসাইড কর, এমন একটা মেয়ের সাথে রিলেশন করবি যার মা হবার চান্স নেই বললেই চলে। আর বয়সের বড়, পারিবারিক প্রোবলেম সেগুলো নাহয় বাদই দিলাম।’
শ্রাবণ গম্ভীর মুখে তূবার দিকে তাকিয়ে রইল। ওর চাহনী দেখে তূবা বলল, ‘তোর চাহনী আমাকে সব বলে দিয়েছে। এরপর আর আমার পিছনে নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করিস না। নিজের জীবন নিজের মতো গুছিয়ে ফেল। পড়ালেখায় মন দে।’
শ্রাবণ চুপ করে বসে রইল। তূবা প্রাণপনে চেষ্টা করছে নিজের চোখের জল আটকানোর। বসা থেকে দাঁড়িয়ে তূবা ধরা গলায় বলল, ‘চললাম। ভালো থাকিস।’
তূবা উঠে মেইন দরজা পর্যন্ত গেল। দরজার সিটকিনি খুলতে নিবে তখন পিছন থেকে একজোড়া হাত আষ্টে পিষ্টে ওকে জড়িয়ে ধরল। ওর কাঁধে থুতুনি রেখে বলল, ‘তুমি কেন বললে এ কথাটা? আমি কখনও চাইনি তুমি এ কথাটা আমাকে বলো। কখনও চাইনি তুমি আমাকে জানাও। কারণ এ কথাটা আমি বহু আগে থেকেই জানি।’
তূবা চমকে শ্রাবণের দিকে তাকাল। শ্রাবণ বলল, ‘এভাবে কেন তাকাচ্ছো? তোমার কোনো কিছু আমার কাছে গোপন নেই। তোমার এ কথা আমি তোমাকে ভালোবাসার পর পরই জেনেছি। কিন্তু তাতে কিন্তু আমার ভালোবাসা কমেনি। মোটেও কমেনি।’
তূবা হতভম্ব হয়ে শ্রাবণের কথা শুনতে লাগল। শ্রাবণ বলল, ‘আমি কখনো চাইনি, তুমি জানো যে, আমি জানি তোমার এই বিষয়টা। হয়তো তুমি ভাবতে পারো আমি করুণা করছি। কিন্তু বিশ্বাস করো তোমাকে আমি কীভাবে করুণা করব বরং তোমার মতো চমৎকার একজন মেয়ে আমাকে ভালোবেসে করুণা করেছে। তোমাকে ততটা সম্মান করি, যতটা আমি আমার মা আর কথা আপুকে করি। আমার জীবনে সবচেয়ে প্রিয় তিনজন নারী। আমার মা, বোন আর তুমি। তো তোমার কোনো ত্রুটিই আমার কাছে, তোমার চেয়ে বড় নয়।’
তূবা ধরা কণ্ঠে বলল, ‘তুই এসব কী করে জানলি?’
‘কথা আপু আমাকে আগেই সব বলেছিল।’
তূবা অবাক হয়ে বলল,
‘কথা?’
‘হ্যাঁ। আপু তোমাকে নিয়ে খুব টেনশনে থাকতেন। আমার মনে হয় পৃথিবীতে কথা আপুর চেয়ে তোমাকে কেউ ভালোবাসে না। কোনো মেয়ে তার বান্ধবীকে এত ভালোবাসতে পারে আমি জানতাম না। সেটা তুমিও জানো। সে কথা পরে বলি।
আমি যখন থেকে তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করলাম। তখন আপু বিভিন্নভাবে আমাকে পরীক্ষা করা শুরু করলেন আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি কি না? যখন দেখলেন তার সব পরীক্ষায় আমি পাশ করেছি, তখন তোমার সিক্রেটটা বলল, কিন্তু এটা বলার পর আমি দুই মিনিটও ভাবিনি। সাথে সাথেই বলেছিলাম এই সামান্য কারণে আমার ভালোবাসা কমবে না। এটা মোটেও তোমার ত্রুটি না। একটা মেয়ের জীবনে মা হওয়াই সব না। মানুষের জন্ম শুধু বাচ্চা উৎপাদন করার জন্য না। জীবনে বাচ্চা প্রয়োজন তবে এতটাও প্রয়োজন না যে, তার জন্য নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ছাড়তে হবে। আমি অন্তত এই তুচ্ছ কারণে তোমাকে ছাড়তে পারব না।’
তূবা কঠিন কণ্ঠে বলল, ‘তুই যেটা তুচ্ছ কারণ বলছিস, অন্যদের কাছে তা বিশাল বড় কারণ।’
‘অন্যদের দিয়ে আমার কী কাজ? সংসার তো আমি তোমার সাথে করব।’
‘তোর পরিবার?’
‘সেটা আমার দেখার বিষয়, তোমার না। মা, কথা আপু, বর্ষণ ভাইয়াকে তুড়ি মেরে রাজি করাতে পারব। বাকি রইল বাবা, তার জন্য মা-ই যথেষ্ট।’
‘আর আমার পরিবার?’
‘সেটাও আমি দেখব। তোমার কিছু করতে হবে না। তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসো, শুধু ভালোবাসো। যদি ভালোবাসতে না পারো তবে, আমাকে ভালোবাসতে দাও। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসতে চাই, ভালোবেসে যেতে চাই। বিনিময়ে কিছুই চাই না।’
তূবা, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আজ থেকে কিছু বছর পর এই দিনটার জন্য আফসোস করবে। তখন সন্তানের জন্য তোমার বুকটা হাসফাস করবে।’
‘করবে না। কারণ তখন আমাদের বাচ্চা থাকবে।’
তূবা অবাক চোখে শ্রাবণের দিকে তাকাল। শ্রাবণ বলল, ‘মানুষ ১% ভরসায় পুরো পৃথিবী জয় করে, আর সৃষ্টিকর্তা আমাদের একটা সন্তান দিবেন না? তা-ও ৫% এর ভরসায়!’
‘ওটা হয়তো ডাক্তার শান্তনা দিতে বলেছিলেন।’
‘বলুক। না হোক সন্তান। তবুও আমার তোমাকে চাই।’
‘এটা তোর কম বয়সের আবেগ মাত্র।’
‘আমার বয়স অলরেডি ২০ বছর হয়ে গেছে।’
‘তুই কী ভাবিস খুব বেশি?’
‘এতটা কমও না যে বুঝব না। তুমি এই তুচ্ছ কারণে আমাকে দূরে ঠেলছিলে?’
‘এটা মোটেও তুচ্ছ কারণ নয় শ্রাবণ।’
‘হাজারবার তুচ্ছ কারণ। চলো তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।’
শ্রাবণ, তূবাকে ওর রুমে লাগানো ছয় ফুট আয়নাটার সামনে নিয়ে গেল। তূবাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে, পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, ওর কাঁধে থুতুনি রেখে বলল,
‘আয়নায় দেখো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটা। প্রকৃতির সকল সৌন্দর্য যেন মেয়েটার কাছে এসে খুব বিনয়ে মাথা নত করে আছে। বলছে তোমার কাছে আমারা হেরে গেছি। আর তোমার পাশের ছেলেটিকে দেখো কেবন ভ্যাবলার মতো চেহারা। ভেড়ার মতো দেখতে। পিছনে খেয়াল করে দেখলে লেজও দেখতে পাবে।’
তূবা হালকা হেসে বলল, ‘তুই কোনো রাজপুত্রের চেয়ে কম না, শ্রাবণ।’
‘তোমার তুলনায় অত সুন্দরও তো না।’
‘বাহ্যিক সৌন্দর্যই কী সব?’
‘তোমার ভিতরটা তোমার বাহিরের চেয়েও সুন্দর। তুমি ভিতর বাহির মিলিয়ে সুন্দর একটা পরী। পুরো একটা সুন্দরের রাজ্য তুমি। এক সুন্দর রাজ্যের পরীদের পরীরানি তুমি। শুধু পাখাটা অদৃশ্য।’
‘তবুও শ্রাবণ আমার থেকে দূরে থাক।’
‘তুমি কি ভালোবাসো না আমাকে?’
তূবা মাথা নিচু করে ফেলল। শ্রাবণ, তূবার কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি তোমার না বলা সব কথা বুঝি।’
তূবা, শ্রাবণের বুকে মুখ লুকিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল। শ্রাবণ ওর মুখটা তুলে চোখে চুমু খেলো। তারপর বলল, ‘তুমি বড্ড চিন্তা করো। যতটা চিন্তা করছো ততটা খারাপ হওয়ার মতো কিছুই হবে না।’
‘যদি হয়?’
‘আমি আছি তো। সব ঠিক করে দিব।’
শ্রাবণে চোখের প্রবল আত্মবিশ্বাস দেখে তূবার কেন জানি মনে হলো, সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হবে। শ্রাবণ সব ঠিক করে দিবে। এই প্রথম তূবা নিজের সবটা দিয়ে শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরল। বিড়বিড় করে বলল, ‘ভালোবাসি।’
শ্রাবণ আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘জোরে বলো, শুনিনি।’
তূবা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘পারব না।’
‘পারতে হবে না। আমি বুঝি।’
তূবা, শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে হাসল। ইশ! এ হাসিতে শ্রাবণ হাজারবার মুগ্ধ হয়ে মরে যায়। শ্রাবণ বলল, ‘উফ তূবা, তোমার হাসিটা সোজা হৃদয়ের মাঝ বরাবর গিয়ে লাগল।’
তূবা আবার হাসল। শ্রাবণ গভীর আবেগে ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। তারপর বলল,
‘ফাইনাললি অফিসিয়ালী তোমাকে পেলাম।’
‘অফিসিয়ালী পেতে গেলে তো রেজিট্রি করতে হবে।’
‘তাহলে চলো আজই করে ফেলি।’
তূবা হাসল। শ্রাবণ হেসে ওর দুই গালে হাত দিয়ে বলল, ‘সব কিছু আমাদের পরিকল্পনা মতো হবে। কিছু গড়বড় হবে না। তুমি শুধু হাসতে থাকো। আর কখনো আমার সামনে কাঁদবে না। দেখবে সব ঠিক হবে।’
‘সত্যি তো?’
‘হ্যাঁ।’
আমার নতুন বই “রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া” এর প্রি অর্ডার চলছে। প্রি অর্ডার লিংক সবার শেষে দেওয়া। পাশে থাকবেন।
শ্রাবণ মাথা নিচু করে গাল বাড়িয়ে বলল,
‘এখন টুপ করে আমার গালে একটা চুমু খাও তো।’
‘মাইর চিনিস? খবরদার বড়োদের সাথে একদম বেয়াদবি করবি না।’
‘আমার দিকে তাকাও আর নিজের দিকে দেখো তারপর বলো কে বড়ো?’
‘হাইট নিয়ে খোঁটা দিচ্ছিস? জানি তুই ৫.১০´´ আর আমি ৫.১´´। তোর চেয়ে আমি অনেক খাঁটো।’
‘সে জন্যই বলি বয়সে তুমি যতটানা বড় তার চেয়ে তিনগুন হাইটে ছোটো, এ কারণে বয়স নিয়ে কথা বলা বন্ধ করো। আর তোমাকে দেখলে কেউ বলবে না তুমি আমার বড়ো। কথা আপুও তো তোমার চেয়ে লম্বা, তা-ও ওকে সবাই আমার ছোটো বোন ভাবে সেখানে তুমি তো এইটুকু একটা মেয়ে। শ্রাবণ আঙুল দিয়ে দেখাল এইটুকু।’
তূবা কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, ‘এইটুকু মেয়েকে ভালোবাসছিস কেন?’
‘কী করবে বলো ছোটো বেলা থেকে শখ ছিল পুতুলের মতো বউ এর। আর তুমি আমার সেই পুতুলের মতো বউ।’
ইশ! বউ কথাটা শুনতেই তূবা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। গালের গোলাপি আভা আরও গোলাপি হলো। শ্রাবণ ওর লজ্জা আর একটু বাড়াতে নিচু হয়ে তূবার গালে আলত চুমু আঁকল। তূবা লজ্জায় এবার জমে গেল। নিজের এক আকাশ সমান লজ্জা কমাতে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, ‘অসভ্যতা করছিস কেন?’
শ্রাবণ মিটমিট হাসতে লাগল। তূবা বলল,
‘আমি যাই।’
শ্রাবণ মুখ ভার করে বলল, ‘রাগ করলে? আচ্ছা সরি এরপর আর এমন করব না।’
তূবা ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘মনে থাকে যেন। আমি এখন যাই। সন্ধ্যা হয়েছে।’
‘আরেকটু থাকো। কেবলই তোমায় নিজের করে পেলাম। আর একটু সময় দাও আমাকে।’
‘না। কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আযান দিবে।’
‘প্লিজ।’
তূবা কঠিন গলায় বলল, ‘না।’
শ্রাবণ মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইল। তূবা দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে আসল। শ্রাবণের বুকে মাথা রাখল। শ্রাবণও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তূবাকে। তূবা বলল,
‘তুই যে পিচ্চি তার প্রমাণ পেলি? একটুতেই মুখ ফুলিয়ে ঢোল হয়ে যাস।’
শ্রাবণ হাসল। আরও গভীরভাবে তূবাকে জড়িয়ে ধরল। এবার তূবা সত্যি চলে যাচ্ছিল। শ্রাবণ বলল, ‘কিছুক্ষণ পর তামিমকে পড়াতে আসছি, তখন যেন আবার লুকিয়ে থেক না।’
তূবা হাসল। ঘায়েল করা সে হাসি। আজ এ হাসিতে কষ্টের মাত্র খুব ক্ষুদ্র। পুরোটাই সুখের হাসি। সুখের রেশে তূবার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে বারবার। তূবা দরজা খুলে চলে গেল। শ্রাবণ ফোন হাতে নিয়ে কথাকে কল করল।
কথা রিসিভ করার সাথে সাথে,’আপু আমাকে অামাকে কনগ্রেচুলেট কর।’
‘কেন?’
‘তোর বান্ধবীকে আমি পুরোপুরি পেয়ে গেছি। সে নিজে আজ আমার ভালোবাসার কাছে আত্মসমার্পন করেছে।’
‘জানতাম এমনটা হবে।’
‘তূবা তোকে আগে বলেছিল?’
‘না। তূবা বলেনি। তবে আমি তূবা আর শ্রাবণ দুজনকেই জন্মের পর থেকে চিনি। তাদের চিন্তাধারার সাথে আমি পরিচিত। আমি জানতাম আমার ভাইয়ের পাগল করা ভালোবাসা তূবা আগ্রহ্য করতে পারবে না। তবে ভাই তূবা কিন্তু জীবনে খুব কষ্ট পেয়েছে। ওকে আগলে রাখিস। তোর কারণে যদি ও সামন্যতম কষ্ট পায় তবে তোর সামনে সবার আগে আমি দাঁড়াবো। তূবার সামান্যতম কষ্ট আমি নিতে পারব না।’
‘জানি জানি। তুই তো নিজের ভাইর চেয়ে বান্ধবীকে বেশি ভালোবাসিস।’
‘হ্যাঁ, সেটাই মনে থাকে যেন।’
‘হুম থাকবে।’
সন্ধ্যার পর,
শ্রাবণ, তামিমকে পড়াতে গেল। তামিকে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তূবার রুমে উঁকি ঝুঁকি মারছিল, কিন্তু তূবার দেখা পাচ্ছিল না। আড়াল থেকে শ্রাবণের অবস্থা দেখে তূবা মিট মিট হাসল। কিছুক্ষণ পর তূবা নাস্তা নিয়ে শ্রাবণের সামনে আসল। তূবাকে দেখে শ্রাবণ হা হয়ে তাকিয়েই রইল। মনে মনে বলল, ‘করেছে কী মেয়েটা? শাড়ি পরছে। উফ! আমার তো মাথা খারাপ করে ছাড়বে।’
তূবা আর নীল রঙের জংলী ছাপার সুতির শাড়ি পরছে। শ্রাবণের জন্যই পরেছে। শ্রাবণদের বাড়ি থেকে ফিরে দেখল তামিমা নতুন কয়েকটা জংলী ছাপার সুতির কাপড় এনেছে। নতুন কাপড় দেখলেই তূবা পরার বায়না ধরে। আজ তো ওর মনটাও খুব ভালো। সে কারণে দ্বিগুন উৎসাহে শাড়ি পরল। বেনী করা চুলগুলোকে সুন্দর করে চিরুনী করে মেলে দিয়েছে। মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু ক্রিম লাগিয়েছে। আর চোখে চিকন করে কাজল টেনেছে। সুন্দরী মেয়েদের হালকা সাজ আরও সুন্দরী করে তোলে।
তূবাকে দেখে শ্রাবণের মাথা খারাপ হবার জোগার। তূবা, শ্রাবণের সামনে দাঁড়িয়ে পুরি চটপটি দিয়ে বলল, ‘পুরি আমি বানিয়েছি। চটপটি চাচি। খেয়ে বলতো কেমন হয়েছে?’
শ্রাবণ মনে মনে বলল, ‘মাথা খারাপ করে এখন ফুড রিভিউ চাচ্ছে। বজ্জাত মেয়ে।’
তামিমের পড়ানো শেষে শ্রাবণ ভাবল আরেকবার তূবাকে দেখে যাবে। কিন্তু মেয়েটা সেই যে রুমে ঢুকছে আর বের হয়নি। শ্রাবণ বারবার উঁকি দিয়েছে কিন্তু মহারানির দর্শন পাননি। শেষে বাধ্য হয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলো।
তামিমাকে বলল, ‘চাচি, তূবা আপু কোথায়? কথা আপু দুটো নোট নাকি তার কাছে। আমি তো আপুর বাসায় যাবো। আপু নিয়ে যেতে বলছে।’
তামিমা বলল,
‘তো তূবার রুমে গিয়ে নিয়ে নে। এটা তো তোরও ঘর। অনুমতি নেওয়ার কী আছে?’
‘আচ্ছা চাচি।’
শ্রাবণ তূবার দরজার কাছে গিয়ে দরজায় নক করল। তূবা দরজা খুলতেই শ্রাবণ ভিতরে ঢুকে দরজা লক করে দিলে তূবাকে জাপটে ধরল। তূবা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘করছিস কি? কেউ এসে পড়বে।’
‘আমার মাথা খারাপ করে এখন নিজে ভয় পাচ্ছো?’
‘আমি কী করেছি?’
‘নীল রঙের শাড়ি, খোলা চুল, চোখে কাজল। আমার মাথা খারাপ করতে আরও কিছু লাগবে?’
তূবা ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘কেমন লাগছে?’
‘ব্লু বেরীর মতো টসটসে রসালো, খেয়া ফেলা যায় এমন।’
‘ছি! প্রশংসা করার কি ধরণ। সুন্দর করে বল।’
শ্রাবণ হাসল। তূবার শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল,
‘মাশাআল্লাহ। তুমি নীল কলমি দেখেছো? ঠিক তেমন স্নিগ্ধ লাগছে। আমার তো এক্ষুনি তোমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছা করছে। চলো বিয়ে করে ফেলি। বাকি পরিবারেরটা দেখা যাবে।’
তূবা হাসল। শ্রাবণ আবার তূবার হাসির প্রেমে পড়ল। বলল, ‘এমন করে হেসো না তো। পাগল হয়ে যাব।’
তূবা, শ্রাবণের বুকে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলল,
‘তোর অবস্থা অলরেডি পাগলের মতোই।’
শ্রাবণও ফিসফিস করে বলল, ‘তোমার জন্যই তো।’
শ্রাবণ বাড়ির দিকে যাচ্ছে। তামিম দৌড়ে এসে বলল, ‘শ্রাবণ ভাই, দাঁড়ান।’
শ্রাবণ পিছু ফিরে বলল,
‘কিরে কিছু বলবি?’
‘তূবা আপু টিফিন বক্সটা আপনাকে দিতে বলল। আপনি নাকি কথা আপুর বাসায় যাবেন? এতে আপুর জন্য আচার আছে।’
‘আচ্ছা।’
‘শ্রাবণ ভাই, একটা কথা বলি?’
‘হুঁ বল।’
‘এরপর যখন তূবা আপুর রুমে বসে তাকে জড়িয়ে ধরবেন কিংবা তার সাথে প্রেমালাপ করবেন তখন পশ্চিম দিকের জানালাটা বন্ধ করে নিবেন। সেখান থেকে কিন্তু যে কেউ আপনাদের দেখতে পারে।’
শ্রাবণ চমকে তামিমের দিকে তাকাল। তামিম বলল, ‘ভয় পাবার কিছু নেই। আমি কাউকেই কিছু বলব না। তবে আপনি যে রোজ এত এত হোম ওয়ার্ক দেন সেটা কম করেন। আর দুলাভাই হতে চাইলে আমাকে শালার মতো ট্রিট করেন।’
শ্রাবণ হেসে বলল, ‘দেখা যাক শালাবাবু। তবে বিষয়টা আপনার পেটেই রাইখেন। বাইরে যেন চালান না হয়।’
‘ভরসা রাখতে পারেন। বোম মেরেও কেউ কথা বের করতে পারবে না।’
শ্রাবণ হেসে বাড়ির দিকে চলে গেল।
আমার নতুন বই “রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া” এর প্রি অর্ডার চলছে। প্রি অর্ডার লিংক সবার শেষে দেওয়া। পাশে থাকবেন।
৩৩!!
তূবার পাঠানো আচার পেয়ে কথার কষ্ট যেন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। মনে হলো কাটা ঘায়ে লবন মরিচের ছিটা পড়ল। তূবা তো জানে না কথা কী করেছে? ও তো কথার অনাগত সন্তানের জন্য কত কী ভেবে ফেলেছে। তূবাতো বাচ্চার নাম পর্যন্ত ঠিক করে ফেলেছে। তূবা, কথার জন্য অনেক রকমরে আচার বানিয়েছে। তূবা শুনেছে এ সময় মেয়েদের আচার খেতে ভালো লাগে।
তূবা ঘরে ফুচকার পুরি বানিয়ে শুকিয়েছে, যাতে কথাকে বাইরের অস্বাস্থ্যকর ফুচকা না খেতে হয়। কয়েক রকেমের শুকনা আচার করেছে। বাবুর জন্য কাঁথা সেলাই করতে নিয়েছে। কথাকে বলেছিল, ‘তুই চাপ নিস না। তোর বাচ্চার যত কাঁথা লাগবে সব ওর খালা দিবে। শোন বাচ্চা হওয়ার পর আমি কিন্তু তোর কাছে এসে থাকব। সে তুই যে বাসায় থাকিস। বাবুর দেখাশোনা আমি করব।’
কথা হেসে বলেছিল, ‘বাবুর হাগু মুতু পরিষ্কার করতে পারবি?’
তূবা বেশ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলেছিল, ‘কেন পারব না? তোর সন্তান কি আমার সন্তান না? আমি নিজে মা হতে পারি বা না পারি তোর সন্তান হবে আমার সন্তান। তারা কিন্তু আমাকে খালামনি না ছোটো মা ডাকবে।’
তূবা ফুলের নকশা করে কয়েকটা কাঁথায় সেলাই শুরু করে দিয়েছে। কথাকে কিছুক্ষণ আগে ছবি পাঠিয়েছে। অথচ কথা কী করল? যে মেয়েটা নিজে মা হতে পারবে না ভেবে বান্ধবীর বাচ্চাকে নিজের বাচ্চার মতো আপন করতে চেয়েছিল কথা তার স্বপ্নও ভেঙে দিলো। অথচ তূবা কিছুই জানে না।
কথা মনে মনে বলল, ‘তূবাকে এসব পাগলামি করা বন্ধ করতে বলতে হবে। সত্যিটা বলে দিতে হবে। নয়তো যত দিন যাবে মেয়েটা তত স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। ওর স্বপ্ন ভাঙার কষ্টটা নিতে পারব না। এমনিতেই মেয়েটা সবসময় নিজের ত্রুটি নিয়ে কষ্টে থাকে। হে আল্লাহ শ্রাবণ যেন ওর জীবনে নতুনভাবে রঙীন করতে পারে। ওকে যেন কোনো কষ্ট না দেয়। ও যেন কষ্ট না পায়। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে প্রাপ্ত কষ্ট সহ্য করা অসম্ভব। আমি খুব ভালো করে বুঝি। সে কারণে চাই না ঐ দুঃখী মেয়েটা আরও দুঃখ পাক।’
কথা, শ্রাবণকে বলল, ‘আমার রুমে আয় কথা আছে তোর সাথে।’
‘হুম চল।’
রুমে যাবার পর কথা, শ্রাবণের পাশে বসে বলল,
‘আজ তুই আমাকে একটা কথা দিবি। একটা ওয়াদা করবি।’
‘বল।’
‘জীবনে যেমন পরিস্থিতিই আসুক না কেন তুই তূবার হাত ছাড়বি না। ওকে খুব যত্নে আগলে রাখবি। আমি তোর কাছে জীবনে কিছু চাইব না, এটাই আমার তোর কাছে একমাত্র চাওয়া। ওয়াদা কর।’
শ্রাবণ, কথার হাতে হাত রেখে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, ‘ছাড়ব না হাত। ওয়াদা করলাম।’
রাত তিনটা,
কথা, নিহাদ ঘুমে বিভোর। কথা স্বপ্নে দেখছে। দুটো মেয়ে বাচ্চা হাসছে, খেলছে, দৌড়াচ্ছে। কথাকে মা মা বলে ডাকছে। কথা যেই ওদের ধরতে যাচ্ছে বাচ্চাদুটো দূরে বহুদূরে চলে যাচ্ছে। কথা হাত বাড়িয়ে শুধু ডাকছে বাচ্চাদের। বাচ্চারা মাথা নেড়ে বলল, ‘না। আসব না তোমার কাছে। তুমি খুনী আমাদের। আমাদের মেরে ফেলেছো।’
কথা আৎকে উঠে বলল, ‘না আমি তোদের মা।’
বাচ্চাদুটো হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তুমি মা না। তুমি খুনী। কেন মারলে আমাদের মা?’
বাচ্চাদের কথা শুনে, কথা চিৎকার করে কাঁদে, বাচ্চাদের কাছে ডাকে। কিন্তু বাচ্চারা আসে না। তারা চলে যায় দূরে বহু দূরে।
চিৎকার দিয়ে কথার ঘুম ভাঙে। সারা শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। অসহ্য কষ্টে শরীর থরথর করে কাঁপছে। নিহাদ দ্রুত টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বলল,
‘কী হয়েছে কথা?’
কথা, নিহাদকে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কাঁদে। অনেকটা সময় কোনো কথা বলল না। শুধু কাঁদল। কান্নার দরুন সারা শরীর কাঁপছে। কান্না করতে করতে কথা বলল, ‘নিহাদ আমার বাচ্চাদের এনে দাও। আমার ওদের চাই।’
নিহাদ কঠিন গলায় বলল,
‘কথা মানুষ একবার চলে গেলে তারা ফিরে আসে না। ওরা কোনো পুতুল ছিল না যে, তুমি ভেঙে ফেলে আবার কান্না করে চাইলে আর আমি তোমায় কিনে এনে দিলাম। যার প্রাণ আছে, সে একবার প্রাণহীন হলে তার ভিতর আর প্রাণের সঞ্চার করা যায় না।’
কথা, নিহাদকে জড়িয়ে ধরে হেঁচকি দিয়ে কাঁদে আর বলে,
‘আমি কী করলাম? নিজের জেদের কাছে হেরে গিয়ে নিজের সন্তানদের হত্যা করলাম।’
কথার কষ্টে কাঁদে নিহাদও। সবকিছু তো ওর গাধামির কারণেই হলো। না ও গাধামি করত, না ওর উপর রাগ করে কথা গাধামি করত। দুই গাধা মিলে গাধাদের কারখানা বানাবে। স্টুুপিড।
চলবে।
#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৩১
কথার কষ্টে কাঁদে নিহাদও। সবকিছু তো ওর গাধামির কারণেই হলো। না ও গাধামি করত, না ওর উপর রাগ করে কথা গাধামি করত। তবুও নিহাদ নিজেকে সামলে বলল,
‘এখন কাঁদলে কী হবে? যা সর্বনাশ করার তা তো করেই ফেলেছো।’
কথার কষ্টটা তখন আরও বেড়ে গেল। কষ্টটা রাগে রূপান্তরীত হলো। রাগে নিজের মাথার চুল ধরে কতক্ষণ টানল। রাগে যেন ও হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। নিহাদের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, ‘সব কিছু তোর জন্য হয়েছে। না তুই সিন্থিয়ার সাথে নোংরামি করতি না আমার মাথা খারাপ হতো, না আমি এত বড়ো ভুল করতাম। সব কিছুর জন্য তুই দায়ী, শুধু তুই। তুই আমার বাচ্চাদের মেরেছিস। এখন তুই তাদের এনে দিবি। কোথা দিয়ে আনবি আমি জানি না। আমার শুধু আমার বাচ্চাদের চাই।’
নিহাদ ধমক দিয়ে বলল, ‘কথাবার্তা ভেবে বলছো তো, কথা? এগুলা কেমন ভাষা? তুই তুকারি করছো কেন?’
‘সন্তান হারা মায়ের মুখে ভালো ভাষা আসে না। আমার বাচ্চাদের এনে দে। আমি তোর সাথে ভালো করে কথা বলবো। নয়তো এমন তুই তুকারি করে কথা বলবো। কেন গেছিলি সিন্থিয়ার সাথে মারাতে। তুই…!’
নিহাদ, কথার মুখ চেপে ধরে বলল, ‘এগুলা কেমন নিচু ভাষা কথা?’
কথা, নিহাদের হাত মুখ থেকে সরিয়ে বলল, ‘আমি এর থেকেও নিচু ভাষা বলতে পারি। শুনবি? ভালোয় ভালোয় আমার বাচ্চাদের এনে দে নয়তো তোকে খুন করে ফেলব। সেদিন তো খুব বলছিলি বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য তুই তোর মতো বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করবি। তাহলে কোন বা*ল ফা*লাই*ছিস বল? কোথায় আমার বাচ্চারা? কেন তারা আমার কাছে নেই?’
বাচ্চাদের শোকে কথার মানসিক অবস্থা দিনকে দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। নিহাদ কথাকে বুকের মাঝে টেনে নিলো। কথা এবার শব্দ করে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘নিহাদ, প্লিজ আমার বাচ্চাদের এনে দাও। তোমার সব অন্যায় আমি ক্ষমা করে দিব। তুমি যা বলবে তাই করব। প্লিজ আমার বাচ্চাদের এনে দাও। আমি ভুল করেছি। মস্তবড়ো ভুল করেছি। যে ভুলের কোনো ক্ষমা হয় না। যে ভুল শুধরানো যায় না। তবুও আমার মন বলছে আমার বাচ্চারা বেঁচে আছে। আমার মন এমন কেন বলছে? আমার শরীরের অনুভূতিও বলছে বাচ্চারা বেঁচে আছে। নিহাদ তুমি বলো যে আমার বাচ্চারা বেঁচে আছে। প্লিজ নিহাদ। তুমি বলো যে, তুমি কিছু একটা করে বাঁচিয়ে নিয়েছো তাদের। প্লিজ নিহাদ বলো।’
নিহাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথাকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরল। কোনো কথা বলল না। কথা নিহাদের বুকে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগল। নিহাদ নিজের চোখের কোণে জমা অশ্রু মুছে বিড়বিড় করে বলল,
‘সরি কথা।’
আমার নতুন বই “রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া” এর প্রি অর্ডার চলছে। প্রি অর্ডার লিংক সবার শেষে দেওয়া। পাশে থাকবেন।
৩৪!!
‘কী করছো?’
‘শ্রাবণ রাত তিনটার সময় মানুষ কী করে আমিও তাই করছি?’
‘স্বামী স্ত্রী কিন্তু অন্য কিছু করে।’
শ্রাবণের কথা শুনে তূবার ঘুম উড়ে গেল, লজ্জায় গাল লাল হয়ে গেল আর কান গরম। কপোট রাগ দেখিয়ে বলল,
‘এরপর যদি আমার সাথে এমন উলটা পালটা কথা বলিস থাপড়ে তোর দাঁত আমি ফেলে দিব।’
মুখ ভার করে শ্রাবণ বলল,
‘সে না হয় দিও। কিন্তু তুমি আজ ঘুমাচ্ছো কী করে?’
‘কেন? আজ কি ঘুমানো নিষেধ?’
‘নাহ তা না। আজকে আমার এত খুশি লাগছে যে ঘুম আসছে না।’
‘এত খুশির কারণ?’
‘আজকে আমি আমার তূবাকে সম্পূর্ণ নিজের করে পেলাম।’
‘এখনও সম্পূর্ণ পাসনি। তার জন্য তোর আমাকে বিয়ে করতে হবে। আর বিয়ে করার জন্য আমার পুরো পরিবারকে রাজি করাতে হবে। বিশেষ করে আমার বাবাকে। জানিস তো তোর পরিবারে সবাই তোর মায়ের কথা মানলেও আমার পুরো বংশে আমার বাবার কথাই এক কথা।’
‘জানি তো। হিটলার শ্বশুর আমার। কী মাটি দিয়া বানাইছে কে জানে? সবসময় মুখ ফুলিয়ে রাখে।’
তূবা হেসে বলল,
‘কঠিন মাটি দিয়া। আসলে মা আর ভাই মারা যাবার পর বাবা কেমন যেন কঠিন হয়ে গেছেন। মায়ের মৃত্যুটা বাবা নিতে পারেননি।’
‘তবে যা-ই বলো না কেন, চাচা কিন্তু চাচিকে অনেক ভালোবাসতেন। নয়তো এত বছর বিয়ে না করে থাকতে পারতেন না।’
‘তা তো বটেই।’
‘সে দিক থেকেই আশার আলো দেখতে পারছি। যে নিজের স্ত্রীকে এতটা ভালোবাসে সে নিশ্চয়ই আমাদের ভালোবাসা বুঝবেন।’
‘হয়তো। দেখা যাক।’
‘কী করছো তুমি?’
‘শ্রাবণ, মা**ই**র খাবার শখ হইছে তোর? রাত তিনটার বেশি বাজে। এখন আমি কী করব? আমি তো ভূত পেত্নি না যে রাত তিনটার সময় গাছে উঠে নাচব।’
‘তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।’
‘খবরদার এত রাতে আসবি না।’
‘আমি আসব না। ভিডিও কল দি?’
‘শ্রাবণ, এত রাতে জ্বালাস না তো। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। তোর কারণে গত কদিন যাবত ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি।’
‘আমি কী করছি?’
‘টেনশনে রাখছিলি। আমি তো জানতাম না কথা তোকে আগেই সব জানিয়ে রেখেছে। জানলে টেনশন করতাম না।’
‘তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে এত টেনশনের কী আছে? আজব তো?’
‘তোর কাছে বিষয়টা তুচ্ছ, কারণ তুই মানুষ ভালো। সবার কাছে না।’
‘সবাইকে দিয়ে তোমার কী কাজ? তোমার কাজ তো আমার সাথে। আমি তো কখনো চাইতাম-ই না তুমি এ বিষয়টা আমাকে বলো।’
‘কেন?’
‘তাহলে তুমি আমাকে মহান ভাবতে আর নিজেকে আমার চেয়ে কম। আমি কখনো চাই না তুমি নিজের চোখে নিজে কম থাকো। আমি তোমাকে খুব রেসপেক্ট করি। সে কারণে সবসময় তোমায় নিজের বরাবর রাখতে চাই। দরকার হলে বেশি বাট কম না।’
তূবা মৃদু হেসে বলল,
‘শ্রাবণ!’
‘হুম।’
‘নাহ্! কিছু না।’
‘বলো ভালোবাসি।’
‘হুম।’
‘হুম না বলে প্লিজ বলো।’
স্মিত হেসে তূবা বলল, ‘ভালোবাসি।’
‘ইশ! তোমার মুখের ভালোবাসি শব্দটা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর শব্দ।’
তূবা হাসল। শ্রাবণ বলল, ‘আজকে একটা প্রমিজ করো।’
‘কী?’
‘আর কখনো তুমি আমার কাছে তোমার ত্রুটির কথাটা বলবে না। আজকেই প্রথম বলছো আজই শেষ। আর কখনো বলবে না।’
‘কেন?’
‘কেন টেন কিছু না। বলবে না মানে বলবে না। তোমার কোনো ত্রুটি নেই। তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি কিছু জানি না। তুমিও কিছু জানো না। আমরা আর পাঁচটা স্বাভাবিক কাপলের মতো সারাজীবন থাকব।’
তূবা মৃদু হেসে বলল, ‘শ্রাবণ!’
‘হ্যাঁ।’
‘এখন তুই কাছে থাকলে তোকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতাম।’
‘ইশ! কী বলছো? তুমি বললে এখনই চলে আসি?’
‘খবরদার! একদম না।’
‘তাহলে ভিডিও কল দি।’
‘আচ্ছা দে।’
তূবা রুমের লাইট জ্বালিয়ে কানে হেটফোন দিয়ে ভিডিও কল রিসিভ করল। কল রিসিভ করার আগে গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিলো। গরমের কারণে রাতে ও স্লিভলেস পরে ঘুমায়। এখনও শ্রাবণের সামনে নিজেকে এতটা খোলামেলাভাবে প্রদর্শন করার সময় আসেনি।
কল রিসিভ করার পর শ্রাবণ বলল, ‘তূবা, ঘুম চোখে তোমাকে স্নিগ্ধ লাগছে। অনেকটা আদর আদর।’
তূবা মৃদু হেসে বলল, ‘আমার কিন্তু সত্যি অনেক ঘুম পাচ্ছে।’
‘আচ্ছা তুমি ঘুমাও। আমি তোমাকে দেখি।’
‘কেন?’
‘কখনও তোমাকে ঘুমাতে দেখিনি।’
তূবা হাসল।
অনেক্ষন কথা বলল দু’জন। এবার তূবা ঘুমের কারণে বারবার হাই দিচ্ছে। মাঝে মাঝে ঝিমুনিও দিচ্ছে। তূবা ফোনটা বালিশের সাথে ঠেকিয়ে রেখে কাত হয়ে শুয়ে কথা বলতে লাগল। একসময় সত্যি ঘুমিয়ে পড়ল। শ্রাবণ হা হয়ে দেখতে লাগল ওর ঘুমন্ত মুখটা। এত সুন্দর লাগছে দেখতে যে, শ্রাবণ আবার নতুন করে তূবার প্রেমে পড়ল। মনে মনে বলল, ‘আর কতভাবে আমাকে তোমার পাগল করা বাকি লক্ষী মেয়ে?’
শ্রাবণ ফোনের স্ক্রিনে চুমু খেলো। তূবা ঘুমে বিভোর। পাশ ফিরতে গিয়ে হেডফোনের তারে টান লেগে ফোনটা উবু হয়ে পড়ে গেল। শ্রাবণ আর তূবাকে দেখতে পেল না। ও কল কেটে নিজেও শুয়ে পড়ল। ভাবল আর কল করে তূবাকে বিরক্ত করবে না এখন। ওরও ঘুম পেয়েছে খুব। শ্রাবণ বিছানায় গা এলিয়ে দেবার কিছুক্ষণ পর ঘুমটা কেবল আসল, তখনই মসজিদে ফজরের আযান দিলো। শ্রাবণ আবার উঠে নামাজ পড়ে নিলো। ইদানিং নামাজটা ঠিকমতো আদায় করে। সেটা এই ভয়ে যে আল্লাহ যেন ওর প্রতি অসন্তুষ্ট না হয়। অসন্তুষ্ট হলে যদি তূবাকে না দেয়। তূবাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে। ওকে হারালে বেঁচে থাকাটা সম্ভব হবে না শ্রাবণের পক্ষে।
নির্জন নদীর তীরে, ঘাসের উপর তূবা বসে আছে। শ্রাবণ ওর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। তূবা, শ্রাবণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আর শ্রাবণ শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তূবা ডাকল,
‘শ্রাবণ?’
‘হুম।’
‘সন্ধ্যা তো হয়ে এলো।’
‘হুম।’
‘এবার আমাদের বাড়ি যাওয়া উচিত।’
‘উঁহু।’
‘কেন?’
‘আরেকটু থাকি তোমার কোলে।’
‘দেড় ঘন্টা যাবত তো এমন কোলেই শুয়ে আছিস।’
‘এত শান্তি লাগছে যে উঠতেই মন চাচ্ছে না।’
‘কিন্তু আমাদের তো এখন বাড়ি যাওয়া উচিত।’
শ্রাবণ, তূবার কোমর জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুজে বলল, ‘চলো বিয়ে করে ফেলি। তাহলে সবসময় তুমি আমার কাছে থাকবে।’
তূবা হেসে বলল, ‘কিন্তু আমার পিচ্চিটার যে এখনও বয়স হয়নি।’
‘আর জাস্ট এক বছর তারপরই তোমাকে বিয়ে করব দেখে নিও।’
তূবা নিচু হয়ে শ্রাবণের কপালে চুমু এঁকে বলল, ‘আচ্ছা দেখা যাবে।’
চুমুটা পেয়ে শ্রাবণ এত খুশি হলো যে, খুশিতে তূবাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তূবা, শ্রাবণের চুল এলোমেলো করে বলল,
‘পাগল একটা।’
‘শুধু তোমার জন্য।’
তূবা হাসল। দুজনার চোখেই ভালোবাসার মুগ্ধতা।
চলবে…