#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৪৫
শ্রাবণের অভিমান ভাঙানোর কোনো উপায় না পেয়ে শেষে কথাকে কল করল তূবা। কথাকে সবটা খুলে বলার পর কথা বলল,
‘এতদিন যাবত তোদের মাঝে এতো ঝামেলা চলছে অথচ আমাকে বলিসনি পর্যন্ত। কেন?’
তূবা মিনমিন করে বলল,
‘ভেবেছিলাম আমরা সমাধান করতে পারব, কিন্তু শ্রাবণ এবার এতো অভিমান করেছে যে, মান ভাঙাতেই পারছি না।’
‘বর্ষণ ভাইয়ার কথাও তো বলিসনি।’
‘আসলে আমি জানতাম তোকে বললে তুই বর্ষণ ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করতে পারিস। সে কারণে বলিনি। তাছাড়া বর্ষণ ভাইয়া তো ভুল কিছু বলেনি? তিনি যা বলেছেন বাস্তব চিন্তা করে।’
‘হুম বুঝলাম। তবে একটা বিষয় ভালো হলো, এ কারণে জানতে পারলি মা তোদের সম্পর্কে জানেন এবং রাজি।’
‘হুম তা তো বুঝলাম। তবে তোর ভাই তো রেগে আগুন হয়ে আছে।’
কথা দুষ্টু হেসে বলল,
‘ওর রাগটাও অস্বাভাবিক না। ও-ও ঠিক করছে। কেউ কিছু বললেই তুই ওকে ছেড়ে দিবি?’
‘তুই তোর ভাই এর পক্ষ নিচ্ছিস।’
কথা হেসে বলল,
‘সবসময় তো তোরই পক্ষ নেই। আজ নাহয় ভাই এর নিলাম।’
‘মেজাজ খারাপ করবি না, কথা। আমাকে বুদ্ধি দে কী করে তোর নবাবজাদা ভাই এর রাগ ভাঙাব?’
‘আমার বাসায় আসতে পারবি?’
‘কেন?’
‘দেখ আমার শ্বশুর শাশুড়ি আর দাদি বাড়িতে নেই। তারা কদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেছে। নিহাদ বাসায় আসবে দুপুরের পর। তুই চলে আয়। আমি ঐ বাদরটাকে কৌশলে ডাকছি। তারপর তুই রাগ ভাঙাস। তুই না পারলে আমি সহায়তা করব।’
‘আচ্ছা। তাহালে আসছি। দুপুরে কিন্তু তোর বাসায় খাবো। দেশী মুরগির ঝোল করবি, পোলাও করবি।’
কথা হাসতে হাসতে বলল,
‘ছোচা! তুই এখানে তোর প্রেমিকের রাগ ভাঙাতে আসছিস নাকি গিলতে আসছিস?’
‘তোর ভাই এর টেনশনে কদিন যাবত খেতে পারছি না। আজ তোর বাসায় গিয়ে খাবো।’
‘আচ্ছা আয়। আমি শ্রাবণকে কল করে আসতে বলছি।’
তূবার কল কেটে কথা শ্রাবণকে কল করল,
‘হ্যাঁ, আপু বল।’
‘কোথায় তুই?’
‘ভার্সিটিতে যাচ্ছি।’
‘ক্ল্যাস শেষ কয়টায়?’
‘বারোটায়।’
‘আচ্ছা ক্লাস শেষে সোজা আমার বাসায় আসবি।’
‘কেন?’
‘আয় জরুরি কিছু কথা আছে। দুপুরে খাবি আমার সাথে।’
‘তাহলে বল গরুর মাংস ভূনা করবি?’
‘আচ্ছা।’
কথা কল কেটে বলল,
‘ইডিয়েট দুটো আমাকে রাঁধুনী পেয়েছে নাকি? যে যার মতো ফরমায়েশ করে যাচ্ছে।’
কথা রান্নার জন্য ফ্রিজ থেকে মাছ ভিজিয়েছিল, তার সাথে মুরগির মাংস ভিজালো। গরুর মাংস বাসায় নেই। শুক্রবার নিহাদ আনবে বলেছিল। কিছুক্ষণ পর মুরগির মাংস ধুয়ে, পানি ঝড়তে রাখল। এদিকে চুলায় মশলা কষানো হচ্ছে। মাংসটা কষিয়ে পানি দিয়ে ঢেকে রেখে, অন্য চুলায় মাছটা ভেজে রেখে পোলাউ রান্নার করতে নিলো।
তখন তূবা আসল। দরজায় বেল বাজানোর কথা দরজা খুলে বলল,
‘ওড়না বেঁধে রান্না ঘরে আয় আমাকে হেল্প করবি। বাবা-মা গ্রামে গেছেন দেখে কাজের মেয়েটাকেও ছুটি দিয়ে তাদের সাথে গ্রামে পাঠিয়েছি। ও-ও ওর বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে আসুক।’
তূবা বলল,
‘তো তুই কি আমাকে কাজের লোক পেয়েছিস।’
‘কথা না বাড়িয়ে এদিকে আয়। কচুর লতিগুলো পরিষ্কার করে দে।’
‘কচুর লতি কে খাবে? নিশ্চিত তোর গলা কুটকুট করা ভাইটা? এসব খায় দেখেই সবসময় গলা চুলকায়।’
কথা হেসে বলল,
‘ওহ আচ্ছা।’
তূবা কচুর লতি পরিষ্কার করতে করতে বলল,
‘কদিন যাবত জ্বালিয়ে মারছে আমাকে।’
‘তুই-ও তো কম জ্বালাসনি।’
‘তো আমি তো জ্বালাবোই। জ্বালানোটা মেয়েদের অধিকার।’
‘তাহলে সেই অধিকার ফলিয়ে রাগ ভাঙা।’
‘কখন আসবে বাদরটা?’
‘বারোটা পর্যন্ত ক্লাস চলবে। তারপর আসবে।’
‘আচ্ছা।’
কথা, আর তূবা মিলে বারোটার মধ্যেই রান্না বান্না শেষ করে ফেলল। কথা, তূবাকে বলল,
‘তুই যা আমার রুমের ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে। আমি ততক্ষণে বাকিটা গুছিয়ে ফেলি।’
‘আচ্ছা।’
তূবা ভিতরে যাবার কিছুক্ষণ পর শ্রাবণ আসল। কথাকে বলল,
‘আপু, যা গরম পড়েছে। ঠান্ডা শরবত দে তো।’
‘বস দিচ্ছি।’
কথা কিছু একটা ভেবে বলল,
‘এক কাজ কর আমার রুমে গিয়ে এসির নিচে বস। আমি শরবত নিয়ে আসছি।’
শ্রাবণ, কথার রুমে গিয়ে দেখল, তূবা তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছছে। তূবাকে দেখে রুম থেকে বের হতে যাবে ওমনি তূবা খপ করে হাত ধরে বলল,
‘বাড়াবাড়ি হচ্ছে শ্রাবণ। এবার কিন্তু আমার মেজাজ খারাপ হবে।’
শ্রাবণ কিছু বলতে যাবে। তখন কথা রুমে শরবত আর কিছু ফল নিয়ে টেবিলের উপর রেখে বলল,
‘দরজা বাইরে থেকে লক করে গেলাম। তোদের মান অভিমান ভাঙলে কল করিস।’
কথা সত্যি সত্যি দরজা বন্ধ করে চলে গেল। শ্রাবণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই রইল।
তূবা বলল,
‘শ্রাবণ, প্লিজ আর এমন থাকিস না।’
‘কেন থাকব না।’
‘সরি বলছি তো।’
‘সরি বললেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়?’
‘তাহলে কী করতে হবে বল?’
‘তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি শুধু অন্যের কথা শুনে নাচো।’
‘মানে?’
‘এর পূর্বেও তুমি ভয় পেয়ে বারবার আমার থেকে দূরে গেছ। শান্তার কথা শুনে, তোমার বান্ধবীদের কথা শুনে। এবার বর্ষণ ভাইয়ার কথা শুনে। প্রতিবার আমি তোমাকে ভরসা দিয়েছি সবটা আমি সামলে নিব। তা-ও তোমার ভয় কাটাতে পারিনি। তুমি তোমার ভয়টাকে যতটা ভরসা করো, বিশ্বাস করো ততটা আমাকে কারো না? কাল যদি তোমার বাবা তোমাকে ভয় দেখিয়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে বলেন, তবে তুমি তো তা-ই করবে তাই না? আসলে আমাকে তুমি ভালোইবাসোনি। আমি জাস্ট তোমার টাইম পাস। আমি তো গাধা। ভাবছো বিয়ের আগে গাধাটাকে নিয়ে টাইমপাস করবে তারপর যাকে খুশি বিয়ে করে সংসার সুখে করবে।’
শ্রাবণের কথাগুলো শুনে তূবা সত্যি খুব কষ্ট পেলো। তূবার খুব কান্না পেলো। আটকানো কণ্ঠে বলল,
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আর তোর কাছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসব না।’
শ্রাবণ নিজেও বলতে চায়নি কথাগুলো। রাগের মাথায় মুখ থেকে বের হয়ে গেছে। তূবা বের হতে গিয়ে দেখল দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করা।
তূবা ফোনটা নিয়ে কথাকে কল করে বলল,
‘কথা, দরজা খোল। আমি বাড়ি যাব।’
শ্রাবণ, তূবার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলল,
‘আপু, দরজা খুলবি না। ও কোথাও যাবে না।’
শ্রাবণ, তূবার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
‘এতো কেন রাগ তোমার? তুমি এতো রাগ করো, তাহলে আমি একটুও করতে পারব না?’
‘না, পারবি না। রাগ করার অধিকার কেবল আমার।’
শ্রাবণ হেসে তূবাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। তারপর বলল,
‘তুমি এতো ভীতু কেন? এত কেন ভয় পাও?’
“রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া”
অর্ডার করেছেন তো?
তূবা শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ছোটোবেলা থেকে বড়ো হওয়ার জন্য তোর মতো সুন্দর একটা পরিবেশ আমি পাইনি। দশবছর বয়সে আমি আমার মাকে হারিয়েছি। তারপর থেকে ছোটো চাচির কাছে মানুষ হয়েছি। বাবার সাথে ততটা স্বাভাবিক সম্পর্ক আমার ছিল না। ছোটোচাচি মায়ের মতো বড়ো করলেও আমার ফুপিদের চিন্তাভাবনা খুব নিচু। তাদের তিক্ত কথা শুনে আসছি ছোটোবেলা থেকে। আর যখন থেকে তারা শুনলো আমার মা হওয়ার ক্ষমতা নেই বললেই চলে, তখন থেকে আমার জীবনটাকে জাহান্নাম করে তুলল। তোরা ছোটোবেলা থেকে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের যে বিশেষ ভালোবাসাটা পেয়ে বড়ো হয়েছিস তা আমি পাইনি। আমি কোথাও বেড়াতে গেলে সবাই মা হারা এতিম বলে করুণা করত। সবার চোখে ভালোবাসার বদলে সবসময় করুণাই দেখেছি।
আমার রূপের, গুণের প্রশংসা সবাই করে, কিন্তু তারপরও আমার ফুপিরা আমার জন্য এমন সম্বন্ধ আনতো যারা কি না পূর্ব বিবাহিত, বয়ষ্ক, যাদের বাচ্চা আছে, কিংবা ডিভোর্সি। আমার একটা ত্রুটির কাছে সব রূপ গুণ ঢাকা পড়ে গিয়েছে।
এত নেগিটিভিটির মধ্যে আমি কীভাবে পজেটিভ হবো? মেয়েদের প্রধান শক্তি থাকে তার মা। আমার তো মা-ই ছিলেন না। চাচি অনেক ভালোবাসলেও তিনিওবা কতদিক সামলাতেন? তারও সংসার ছিল, বাচ্চা ছিল। তারমধ্যে আমার দাদিকে তো দেখেছিলি? বউদের পায়ে পায়ে দোষ ধরতেন। তাকেও নিজের কথাগুলো খুলে বলতে পারতাম না।
জানিস শ্রাবণ, কিছু মেয়েদের পিরিয়ড জলদি হয়। আমার ফাস্ট পিরিয়ড হয়েছিল তখন আমার বয়স মাত্র এগারো বছর। এ বিষয়ে তেমন কিছুই জানতাম না। সেদিন আমি এতটা ভয় পেয়েছিলাম, মনে করেছিলাম আমার বড়ো কোনো রোগ হয়েছে। সারাদিন রুমে বসে কেঁদেছিলাম। ভয়ে কাউকে বলার সাহস পাইনি। সেদিন চাচি বাড়ি ছিলেন না। তিনি ফিরলেন রাতে। রাতে আমাকে ডাকতে এসে আমার থেকে সব শুনে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমার যদি মা থাকতো, বা তখন প্রিয় কেউ থাকতো তাহলে আমাকে সেদিন অতটা ভয় পেতে হতো না।’
তূবা হিচকি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘আমার নিজের ফুপাতো ভাইরা বা আরো বেশ কয়েকজন আত্মীয় ছোটোবেলা থেকে আমাকে বাজেভাবে স্পর্শ করতো, আমি বুঝতাম ওগুলো বাজে স্পর্শ, কিন্তু কাউকে বলতে পারতাম না। ছোটো বেলায় কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারতাম না, বা ফুপিদের বললে তারা বিশ্বাস করতো না। বাবা তো নিজের দুনিয়ায় ব্যস্ত থাকতেন।
চাচিকে বলার পর তিনি যতটুকু পারতেন আমাকে প্রটেক্ট করতেন। একটু বড়ো হওয়ার পর তো সেসব মানুষদের থেকে হাজার হাত দূরে থাকতাম। সৌন্দর্য সব মেয়েদের জন্য আর্শিবাদ না। কিছু মেয়েদের জন্য অভিশাপ বটে। আমি যদি সুন্দর না হতাম তাহলে হয়তো ছোটোবেলা হয়ে এত লোকের বাজে নজরে পড়তাম না। হয়তো ছোটোবেলা থেকে অ্যাবিউজ হতাম না। চাচির পর কথা আমাকে প্রটেক্ট করা শুরু করল। এতোবছর যাবত আমার সব সমস্যার সমাধান ছিল কথা।
তারপর তোকে ভালোবাসলাম। কিন্তু তোর সাথে আমার সম্পর্কটা এমন অসম যে সম্পর্কটা আমার শক্তি না হয়ে ভয় হলো। তোকে হারানোর ভয়। তোকে হারিয়ে আমার পক্ষে বাঁচা সম্ভব না রে।’
শ্রাবণ গভীরভাবে তূবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আমি তোমার সবচেয়ে বড়ো সাহস হবো, শক্তি হবো তোমার। দেখে নিও।’
৪৫!!
কিছুমাস পর,
তূবা বিছানায় বসে আছে। হাতে প্রেগনেন্সি টেস্টকিট। রেজাল্ট পজেটিভ। প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে তূবা তাকিয়ে আছে নিজের হাতে থাকা প্রেগনেন্সি টেস্ট কিটের দিকে। ওর মাথা ঘুরছে। চোখেও মনে হয় ঝাপসা দেখছে। এতো বড়ো ভুলটা ও কী করে করল। ফোনটা নিয়ে শ্রাবণের নাম্বারটা ডায়াল করতে নিয়েও আবার কথাকে কল করল। এই মুহূর্তে কথাকে ছাড়া আর কাউকে কিছু বলতে পারবে না। এমন কি ওর অনাগত সন্তানের বাবা শ্রাবণকেও না।
কথা কল রিসিভ করতেই তূবা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
‘কথা!’
‘হুম।’
‘রেজাল্ট পজেটিভ।’
কথা দপ করে বিছানায় বসে পড়ল। কথাকে ওমন চিন্তিত দেখে নিহাদ জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে কথা?’
কথা অসহায় চোখে নিহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তূবা প্রেগেনেন্ট।’
নিহাদ বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল,
‘কী!’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু শ্রাবণ তূবার তো বিয়ে হয়নি।’
কথা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘বিয়ের সাথে বাচ্চার কী সম্পর্ক? ছাগল দুইটা আমাদের কিছু না জানিয়ে গাধামি করছে। যার ফল তূবার পেটে। আমি শ্রাবণকে ছাড়ব না। থাপড়ে ওর সব কয়টা দাঁত ফেলে দিব। ওর সাহস কী করে হয় তূবার সাথে বিয়ের আগে এসব করার?’
‘শ্রাবণ জানে এসব?’
‘গাধাটাকে কল করে বাড়ি আসতে বলো? তূবাকেও আসতে বলছি।’
‘কী বলছো? বাড়িতে বাবা-মা আছেন। তারা কিছু জানতে পারলে কী ভাববে?’
‘তা-ও ঠিক। তাহলে কী করবো?’
‘আমার বন্ধুর হোটেল আছে। সেখানে একটা রুম বুক করছি। যা বলার সেখানে বসে বলো।’
‘তুমি আমাকে ঠিকানা দাও। তূবাকে মেসেজ করে দিচ্ছি। আর গাধাটাকে কল করে আসতে বলো। ওকে আজ আমি মে* রে* ই ফেলব।’
তূবা লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছে। আবেগের বসে এমন ভুল হয়ে গেছে যা আর শোধরানোর না। ও জানে শ্রাবণ ওকে কখনো ধোকা দিবে না। কিন্তু এখন বাচ্চাটার কী হবে? যেই তূবা মা হতে পারবে না বলে সবসময় এত চিন্তায় থাকতো, সে আজ মা হতে চলেছে কিন্তু তার বাচ্চাটা অবৈধ।
“রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া”
অর্ডার করেছেন তো?
চলবে…
#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৪৬
গত দুই মাস যাবত তূবার পিরিয়ড বন্ধ। শরীরটাও ভালো যাচ্ছিল না। বিষয়টায় তূবার খুব সন্দেহ হলো। কথার সাথে কথা বলে জরুরি ভিত্তিতি দেখা করতে বলল। কথা দেখার করার পর টুকটাক কিছু কথা বলার পর তূবা বলল,
‘কথা, দুই মাস যাবত আমার পিরিয়ড অফ।’
কথা স্বাভাবিকভাবে বলল,
‘তাতে সমস্যা কী? মাঝে মাঝে শারীরিক পরিবর্তনে পিরিয়িড বন্ধ যায়। ওটা নিয়ে ভয় পাবার কিছু নেই। দেখবি কিছুদিন পর হয়ে যাবে। তুই এমন মুখ করে বলছিস যেন তুই প্রেগনেন্ট।’
কথা কথাটা বলতেই দ্রুত তূবার দিকে তাকাল। তূবা অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। কথা বেশ বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
‘তূবা এটা বলিস না, তোর আর শ্রাবণের মধ্যে…!’
তূবা লজ্জায় মাথা নিচু করে রইল। কথা প্রচণ্ড অবাক হয়ে বলল,
‘তূবা, আমি ভুল ভাবছি তাই না? তোদের মাঝে তেমন কিছুই হয়নি? রাইট!’
তূবা মাথা নিচু করে বলল,
‘না। তুই ভুল ভাবছিস না। আমাদের মাঝে সবকিছুই হয়েছে। বেশ কয়েকবার।’
কথা চরম বিস্ময়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তূবার দিকে তাকিয়ে রইল। ও বিশ্বাসই করতে পারছে না, তূবা আর ওর নিজের ভাই এমন কিছু করেছে।কথা আবার বলল,
‘তুই, আমার সাথে মজা করছিস তাই না তূবা?’
তূবা মাথা নেড়ে বলল,
‘না।’
কথা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আস্তে করে বলল,
‘কেন করলি এমন, তূবা?’
তূবা মাথা নিচু করেই রইল। কথা আবার বলল,
‘শ্রাবণ তো ছেলেমানুষ ওর কথা বুঝলাম, কিন্তু তোর তো বুঝা উচিত ছিল।’
তূবা আস্তে করে বলল,
‘আমি ওকে ভালোবাসি, বিশ্বাস করি। এছাড়া কিছুই তখন মাথায় আসেনি।’
‘ভালোবাসা, বিশ্বাস নিজের স্থানে, কিন্তু এটা তো…! নিশ্চিত ঐ ইতোরটাই তোকে জোর করেছে তাই না? জানি তো ছেলেদের স্বভাব। সে হোক আমার ভাই।’
তূবা এবারও ধীর কণ্ঠে বলল,
‘দোষ ওর একার না। ও কখনো আমাকে জোর করেনি। যা হয়েছিল প্রথমবার আবেগের বশে একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গিয়েছিল। পরে চেয়েও দুজন দুজনার থেকে দূরে থাকতে পারিনি। সম্মতি দুজনারই ছিল। দোষ দুজনার সমান। ওর একার দোষ না।’
কথা মাথা চেপে বলল,
‘দোষ যার-ই হোক ভুগতে তো হবে তোকে? এ সমাজ মেয়েদের দিকেই আঙুল তোলে। এখন কী করবি?’
‘আমি জানি না।’
কথা বেশ রাগ করে বলল,
‘এক্সিডেন্ট হোক বা যা-ই হোক দেশে তো প্রটেকশনের অভাব ছিল না। ইর্মাজেনন্সি পিল’স তো নিতে পারতি।’
‘আমি তো জানতাম আমার মা হবার ক্ষমতা নেই।’
কথা রাগী কণ্ঠেই বলল,
‘ডাক্তার তো বলেছিলেন ৫% চান্স আছে।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম ডাক্তার সেটা আমাকে বুঝ দেওয়ার জন্য বলেছিল।’
‘ডাক্তার কি তোর দুলাভাই লাগে যে, তোকে বুঝ দিবে? তাছাড়া যেখানে দেখা যায়, যে মানুষের বাঁচার চান্স ১%ও না সেও বেঁচে যায়। মিরাক্কেল হয়। সেখানে তো মেয়েদের গর্ভধারণের পুরো ব্যাপারটাই একটা মিরাক্কেল। আর কী শুনতে চাস?’
তূবা মাথা নিচু করেই রইল। কথা বলল,
‘দেখ এখন তোকে আমি একটা প্রেগনেনন্সি টেস্টকিট কিনে দিব। কাল সকালে তোর ফাস্ট ইউরিন দিয়ে টেস্ট করে আমাকে রেজাল্ট জানাবি। দোয়া কর যাতে রেজাল্ট নেগেটিভ আসে।’
তূবা মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসল নিজের উপর। এতকাল যাবত একটা বাচ্চার জন্য ছটফট করেছে। আর আজ প্রার্থনা করছে রেজাল্ট যাতে নেগেটিভ আসে।
তূবা বসে বসে গতকাল সকালে কথার সাথে হওয়া কথাগুলো ভাবছিল। কথাও ওর পাশে বসে আছে। কথা ওর হাত ধরে বলল,
‘টেনশন করিস না। আমি আছি তোর সাথে।’
কিছুক্ষণ পর নিহাদের সাথে শ্রাবণ আসল। শ্রাবণ আসার সাথে সাথে কথা ঠাস করে ওর গালে চ* ড় বসিয়ে দিলো। শ্রাবণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
‘মা* র* লি কেন?’
কথা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘তূবা প্রেগনেন্ট। এখন কীভাবে প্রেগনেন্ট সেটা জিজ্ঞেস করিস না?’
শ্রাবণ স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কথা আর নিহাদের দিকে তাকাল। তারপর তূবার কাছে গিয়ে বসে ওর হাতদুটো ধরে বলল,
‘তূবা, আর ইউ প্রেগনেন্ট?’
তূবা মাথা নেড়ে সায় দিলো। শ্রাবণ উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল,
‘ইয়েস! ইয়েস! আমি বাবা হবো। দেখছো আমি বলেছিলাম না তোমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি নিশ্চিত আমার বাচ্চার মা হবে।’
কথা, নিহাদ, তূবা তিনজনই শ্রাবণের আচরণে অবাক। কথা আবার শ্রাবণকে চড় মেরে বলল,
‘এতে খুশি হওয়ার মতো কী হয়েছে, কু* ত্তা?’
শ্রাবণ বেশ হেসে বলল,
‘আরে আপু, আমি বাবা হবো, তুই ফুপি হবি। খুশি হবো না?’
কথা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘কু* ত্তা, তোদের বিয়ে হয়েছে? বিয়ে ছাড়া তোদের বাচ্চাকে সমাজ স্বীকৃতি দিবে?’
এবার শ্রাবণও চুপ হয়ে গেল। ও-ও চুপ করে তূবার পাশে বসে রইল। বেশকিছুক্ষণ নীরবতায় কাটানোর পর নিহাদ বলল,
‘আমার মতে যতদ্রুত সম্ভব ওদের বিয়ে করে নেওয়া দরকার। সম্ভব হলে দুই একদিনের মধ্যে।’
শ্রাবণ বলল,
‘আমি রাজি। আমি বাসায় গিয়েই বাবা মায়ের সাথে কথা বলছি। তারা তূবার বাসায় দুই একদিনের মধ্যে প্রস্তাব নিয়ে যাবে। তারপর সরাসরি বিয়ে। কোনো আয়োজনের আপাতত দরকার নেই। বিয়েটা হয়ে যাক।’
তূবা মাথা নিচু করেই রইল। লজ্জায় কারও দিকে তাকাতে পারছে না। ম্যাচিওর বয়সের হয়েও আবেগের বশে এমন একটা ভুল করে ফেলেছে যে, কারও দিকে চোখ তুলে তাকাবার মুখ ওর নেই। ভালোবাসা সত্যি অন্ধ। মানুষকে দিয়ে ঐ সব কাজও করায় যেসব কাজের বিপক্ষে সে থাকে।
লজ্জা শ্রাবণেরও করছে, কিন্তু ও তূবার মতো চুপ থাকতে পারবে না। ওকে তূবার হয়ে বলতে হবে, সবার সাথে লড়তে হবে। ও তূবাকে ভালো করে চিনে। প্রচণ্ড ভীতু মেয়ে। নিজের অধিকারে জন্য এক বিন্দু পরিমান লড়বে না। লড়াই করা তো দূরে থাক, এখানে ও সম্পূর্ণ নীরব ভূমিকা পালন করবে। কারও সাথে কিছু বলবে না। নিজে কষ্ট পেয়ে মরে যাবে তা-ও না। ওর হয়ে শ্রাবণকেই বলতে হবে।
কথা কিছুক্ষণ পর বলল,
‘বিয়ে বললেই তো সম্ভব না! গর্ভবতী মেয়েদের বিয়ে শরীয়ত সম্মত না। ওদের বিয়ে সম্ভব কেবল বাচ্চা জন্ম হওয়ার পর। নয়তো বাচ্চা এবরশন…!’
শ্রাবণ বলে উঠল,
‘অসম্ভব। আমি আমার বাচ্চাকে হত্যা করতে পারব না।’
শ্রাবণের কণ্ঠের দৃঢ়তায় কথা, নিহাদ, তূবা তিনজনই অবাক। ওরা ভেবেছিল, বাচ্চার কথা শুনলে, বিয়ের নাম শুনলে শ্রাবণ একটু হলেও ভয় পাবে। আজকালকার যুগের ছেলে বলে কথা! কিন্তু শ্রাবণের কণ্ঠের দৃঢ়তা বলে দিচ্ছে ও তূবা আর ওর সম্পর্ক নিয়ে কতটা সিরিয়াস। সাথে ওর অনাগত সন্তানকে নিয়েও।
কথা বলল,
‘তোদের কথা বুঝলাম, কিন্তু এই মুহূর্তে তোদের বিয়ে কীভাবে সম্ভব সেটা ভেবে পাচ্ছি না। তাছাড়া পরিবারকেওবা কী বলবি?’
শ্রাবণ বলল,
‘আমি সরাসরি সব সত্যি কথা বলে দিব। বিয়ে দুই একদিনের মধ্যেই হবে।’
সবাই আবার চুপ করে রইল। শ্রাবণ, তূবার হাত ধরে বলল,
‘তুমি প্লিজ টেনশন করো না। তোমার ভয় পেতে হবে না। আমি আছি তোমার সাথে। থাকব সারাজীবন। তোমার হাত কখনো ছাড়ব না।’
তূবা মাথা নিচু করেই রইল। চোখ থেকে ঝরতে লাগল বিন্দু বিন্দু অশ্রু কণা।
অনেক ভেবে নিহাদ একটা উপায় বের করলো। এখন কথা হচ্ছে শ্রাবণের পরিবারকে নিহাদ, কথা রাজি করাতে পারলেও তূবার বাবাকে রাজি করাতে পারবে তো?
“রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে একটু মেঘের ছায়া”
অর্ডার করেছেন তো?”
৪৬!!
সেদিন বিকালে,
কথা ওর মা শ্রাবণীকে বলল,
‘মা, শ্রাবণ তূবার বিয়ের জন্য ওর বাসায় কবে প্রস্তাব পাঠাবা?’
‘শ্রাবণের তো পরীক্ষা চলছে। আর চারটা পরীক্ষা বাকি। পরীক্ষা শেষ হোক তারপর।’
কথা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘মা, তূবা প্রেগনেন্ট।’
শ্রাবণী বিস্ফরিত চোখে তাকিয়ে বলল,
‘তাহলে বাচ্চার বাবা?’
কথা খানিকটা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘তুমি এখনও বুঝতে পারছো না কে? তোমার ছেলে শ্রাবণ।’
শ্রাবণী স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। যে সন্তানকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো। যাকে নিয়ে তার এত আশা, ভরসা, যার প্রতি এতো বিশ্বাস, সে এভাবে তার বিশ্বাস ভঙ্গ করল?
শ্রাবণী ঠাণ্ডা গলায় বলল,
‘তুই আমার সাথে মজা করছিস কথা? আমাদের শ্রাবণ এমটা করতে পারে না। ও আমার বিশ্বাস ভাঙতে পারে না!’
কথা বলল,
‘না মা, মজা করছি না। মা, প্লিজ শ্রাবণ, তূবাকে তুমি ভুল বুঝো না। এ বয়সে অনেক ছেলে মেয়েই ভুল করে বসে। কিন্তু মা, এটা এমন ভুল যা একবার করলে আর কখনো শুধরানো যায় না। এখন ওদের দুজনার জীবন যাতে নষ্ট না হয় তার ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে।’
শ্রাবণী এতটা কষ্ট কখনো পায়নি। কষ্টে কান্না করতে করতে বলল,
‘যে ছেলেকে আমি সবচেয়ে বেশি ভরসা করেছি। সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি সে এভাবে আমার বিশ্বাস ভাঙল? ওকে ভালোবাসি বলে, ওর অসময় বয়সের সম্পর্কও মেনে নিয়েছি। এতোকিছুর পরও ওরা আমার ভালোবাসা, বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিলো?’
‘মা, প্লিজ তুমি শান্ত হও আর ওদের ভুল বুঝো না। ভুল একটা করে ফেলছে এখন কিছু করার নেই। আমাদেরই দেখতে হবে, এই ভুলের কারণে ওদের জীবনটা যেন নষ্ট না হয়।’
শ্রাবণী অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করল। সে কিছুতেই মানতে পারছে না তার ছেলে এমন কাজ করেছে। বারবার নিজেকে নিজের শিক্ষাকে দায়ী করছে। ভাবছে তার শিক্ষার অভাবে এমন হয়েছে। কথা এবং নীরা তাকে অনেকভাবে বুঝিয়ে শান্ত করল। অনেকক্ষণ পর শ্রাবণী বলল,
‘শ্রাবণ জানে তূবা প্রেগনেন্ট?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী বলছে ও?’
‘ও তূবা আর বাচ্চার দায়িত্ব নিতে রাজি।’
শ্রাবণী আবার কান্না শুরু করল। নীরা বলল,
‘মা, প্লিজ তুমি নিজের শিক্ষাকে দোষ দিও না। ওরা একটা ভুল করে ফেলছে, কিন্তু দুজনেই কিন্তু সে ভুলটা মেনেছে, বুঝতে পারছে ভুল করছে এবং প্রস্তাচ্ছে। ওরা কিন্তু ভুলটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। বরং ভুলটা যাতে বড়ো আকার ধারণ না করে সে জন্য সবার নিকট সাহায্য চেয়েছে। শ্রাবণ কিন্তু ভয় পেয়ে তূবাকে ছেড়ে দেয়নি কিংবা নিজের করা কাজটাকে অস্বীকার করেনি। বরং শক্ত হয়ে তূবার পাশে দাঁড়িয়েছে।
অনেক ছেলেদের মতো নিজের সন্তানকে অস্বীকার না করে বরং নিজ সন্তানের, তূবার দায়িত্ব নিতে চেয়েছে। মা, ওর মাঝে যে সাহস সেটা তো তোমারই শিক্ষার কারণে। ও যদি তূবার সাথে অন্যায় করার পর নিজ সন্তানকে অস্বীকার করতো বা তথাকথিত বয়ফ্রেন্ডদের মতো বাচ্চা নষ্ট করে ফেলতে বলতো তাহলে বুঝতা তোমার ছেলের শিক্ষার অভাব, কাপুরুষ সে। কিন্তু সে তো নিজেই নিজের দোষ স্বীকার করেছে এবং শাস্তি নিতে রাজি হয়েছে।
তূবা আর সন্তানের দায়িত্বকে অস্বীকার না করে বরং দায়িত্ব নিতে চেয়েছে। এখন মা, প্লিজ তুমি তোমার রাগ, অভিমান সাইডে রেখে ওদের একটা গতি করো। তোমার রাগ, অভিমান দেখানোর সময় অনেক আছে। ওদের শাস্তি দেওয়ার সময়ও আছে, কিন্তু শীঘ্রই ওদের সম্পর্কের একটা নাম না দিলে, তূবার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।’
কথা বলল,
‘হ্যাঁ মা, আমরা আজ তূবাকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিলাম। ওর আট সপ্তাহ চলছে। ওকে যতদ্রুত সম্ভব আমাদের বাসায় আনা দরকার, তুমি বাবার সাথে কথা বলে রাজি করাও। আজ রাতেই চলো তূবাদের বাসায়।’
শ্রাবণী চোখের জল মুছে বলল,
‘তোর বাবাকে না হয় রাজি করালাম। তূবার পরিবারকেও রাজি করালাম, কিন্তু এ অবস্থায় ওদের বিয়ে কী বৈধ হবে?’
‘জানি মা, বৈধ হবে না। তবে নিহাদ কিছু বুদ্ধি বের করেছে। যাতে ওদের বিয়েও হবে আর লোকে ওদের বাচ্চাকে অবৈধ ভাববে না।’
‘কী?’
‘মা, আমরা আজ বা কাল ওদের শুধু রেজিট্রি ম্যারেজ করে, তূবাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসবে। তূবা আর শ্রাবণ সম্পূর্ণ আলাদাভাবে থাকবে। বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ওরা একে অপরের সাথে কথাও বলতে পারবে না। বাচ্চা হবার পর, একটা দিন দেখে আবার ঘরোয়াভাবেই শরীয়ত মোতাবেক ওদের বিয়ে দিয়ে দিব। শ্রাবণ তো বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেই। বাচ্চা হওয়ার পর, শরীয়ত মোতাবেক বিয়ের পর ওরা স্বামী স্ত্রীর মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে। নিহাদ এই বুদ্ধি দিয়েছে। আমিও ভেবে দেখলাম সমাজের পাঁচজনার মুখ বন্ধ করার আর কোনো উপায় নেই।
নীরা আর কথার অনেক বুঝানোর পর শ্রাবণী রাজি হলো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে। কথা আর নীরার সাথে কথা বলে শ্রাবণী সামনের রুমে আসল। শ্রাবণী সেখানে এসে দেখল শ্রাবণ মাথা নিচু করে বসে আছে। পাশে বর্ষণ আর নিহাদ বসা। শ্রাবণী, শ্রাবণকে কাছে ডাকল। শ্রাবণ লজ্জায় তার মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। শ্রাবণ, শ্রাবনীর কাছে আসতেই, শ্রাবণী ঠাস ঠাস করে বেশ কয়েকটা চড় মারল শ্রাবণের গালে। শ্রাবণ মাথা নিচু করেই রইল।
চড় মেয়ে শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘বল, তোর কোন ইচ্ছাটা আমরা অপূর্ণ রেখেছিলাম? কোন জিনিসটা তুই চেয়েও পাসনি বল? তোর আর তূবার সম্পর্কের কথা জেনে, তোর খুশির কথা ভেবে আমি এ অসম বয়সের সম্পর্কে রাজি হয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের এত ভালোবাসার প্রতিদান তুই কী দিলি? আমার শিক্ষাকে এভাবে কেন অপমান করলি বল? তুই যে কাজটা করলি তা কী আদৌ কোনো মানুষের কাজ? তুই তো জাানায়ারের মতো কাজ করলি। জানোয়ার যেমন বৈধ অবৈধ মানে না, তুইও তাই করলি। আমি কী তোর মতো জানোয়ারকে পেটে ধরেছিলাম?’
শ্রাবণ ওর মায়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল,
‘মা, ক্ষমা চাইবার মতো মুখও আমার নেই। তবুও বলবো তোমার ছেলেকে একবার ক্ষমা করে দেখো। আমি আর কখনো তোমার বিশ্বাস ভাঙব না। একটা সুযোগ দাও মা নিজের ভুল শোধরানোর। তুমি আমায় শাস্তি দাও, মারো, কাটো যা খুশি করো তা-ও ভুল শোধরানো একটা সুযোগ দাও।’
শ্রাবণী প্রচণ্ড রাগ করে বলল,
‘তুই আর কোনোদিন আমাকে মা বলে ডাকবি না। কথা বলবি না আমার সাথে। এটাই তোর শাস্তি।’
শ্রাবণ, শ্রাবণীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘মা, প্লিজ তুমি আমাকে এমন শাস্তি দিও না। তুমি ভালো করে জানো, আমি তোমার কতটা পাগল, কতটা ভালোবাসি তোমাকে।’
শ্রাবণী, শ্রাবণকে নিজ থেকে দূর করে বলল,
‘আমাকে ভালোবাসলে তুই এমন কাজ করতে পারতি না।’
শ্রাবণী চলে গেল। শ্রাবণ তার পিছু পিছু যেতে চাইলে বর্ষণ বাঁধা দিয়ে বলল,
‘এখন যাসনে। রাগটা একটু কমুক তারপর বরং যাস। তখন দেখবি আবার তোকে বুকে টেনে নিবে। মা, সবচেয়ে বেশি তোকে ভালোবাসে। কদিন গেলেই রাগ পড়ে যাবে। সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
এ বাড়ির ব্যাপারটা তো মোটামুটি মিটমাট হলো। এবার তূবার বাবাকে রাজি করাতে হবে। হুট করে বাড়ি গিয়ে কথা বললেই তো রাজি করানো যাবে না। দেখা যাবে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। তাই নিহাদ আর বর্ষণ ঠিক করলো আগে ওরা দুজন গিয়ে তারিক সাহেবকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলবেন। তারপর বাড়ি গিয়ে পারিবারিকভাবে বিষয়টার সমাধান করবে। বর্ষণ আর নিহাদ চলে গেল তারিক সাহেবের সাথে কথা বলতে। শ্রাবণও ওদের সাথে যেতে চাইল কিন্তু নিহাদ নিষেধ করল। প্রথমে বড়োরা কথা বলুক। ওকে দেখলে তার রাগ আরও বেড়ে যেতে পারে।
চলবে…