অর‌ণ্যে রোদন পর্ব-৫১+৫২

0
313

#অর‌ণ্যে_রোদন
‌লেখা: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৫১

৫৩!!
দুপু‌রে খাবার কিছুক্ষণ পর,
শ্রাবণ রু‌মে গি‌য়ে তূবা‌কে দেখল, তূবা চোখ বন্ধ ক‌রে বিছানায় শু‌য়ে আছে। সাত মাস চল‌ছে তূবার। শ্রাবণ ওর পা‌শে ব‌সে মাথায় হাত বু‌লি‌য়ে বলল,
‘শরীর খারাপ লাগ‌ছে?’
তূবা চোখ মে‌লে ঠোঁ‌টে আঙুল দি‌য়ে বলল,
‘হুসস।’

তারপর শ্রাব‌ণের হাতটা নি‌য়ে, কামি‌জের কাটা থে‌কে ঢু‌কি‌য়ে নি‌জের নগ্ন পে‌টে রাখল। শ্রাবণ চম‌কে উঠল। পে‌টের ভিতর বাবু নড়‌ছে। শ্রাবণ তা স্পষ্ট বুঝ‌তে পারছে। ওর হাত কাঁপ‌ছে। কাঁপা কাঁপা হাতটা আবার তূবার পে‌টে রাখল। বাচ্চাটা আবার নড়‌ছে। তূবার পেট উপর থে‌কেও তা বেশ বোঝা যা‌চ্ছে।

বিস্ময়, ভয়, আন‌ন্দে শ্রাবণ, তূবা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল,
‘এটা কী ক‌রে সম্ভব? তোমার ভয় ক‌রে না?’
‘না। বরং বাবু প্র‌য়োজ‌নের চে‌য়ে কম নড়‌লে ভয় লা‌গে। ডাক্তার বাবুর নড়াচড়া কাউন্ট কর‌তে ব‌লে‌ছি‌লেন।’
‘ও কী এমন সবসময় ন‌ড়ে?’
‘না। দুপু‌রের পর যখন শুয়ে থা‌কি আর রা‌তে যখন ঘুমাই তখন বে‌শি ন‌ড়ে। মা‌নে শু‌য়ে থাক‌লে বে‌শি নড়্চড়া ক‌রে। হাঁটাচলা বা কা‌জের সময় কম ন‌ড়ে।’
‘ও যখন ন‌ড়ে তোমার কষ্ট হয় না? ব্যথা ক‌রে না?’
‘না। বরং অদ্ভুত আনন্দ হয়। খুব ভা‌লো লা‌গে।’

শ্রাবণ আবার তূবার পে‌টে হাত রাখল। তারপর বলল,
‘সৃ‌ষ্টিকর্তা কতটা রহস্য জা‌নেন। মানব শরী‌রের ম‌ধ্যে আরেকটা শরীর কীভা‌বে মা‌সের পর মাস বে‌ড়ে ওঠে, তারপর জন্ম হয়। আল্লাহ সবসময় তোমা‌কে সুস্থ রাখুক।’

‌বিকাল বেলা,
শ্রাবণ-তূবা ছা‌দে ব‌সে ফো‌নে ওদের রি‌সিপশ‌নের ছ‌বি দেখ‌ছিল। অনেক ছ‌বি দেখার পর, একটা ছ‌বি দে‌খে তূবা লজ্জায় লাল হ‌য়ে গেল। এই ছ‌বিটা শ্রাবণ সে‌দিন তু‌লে‌ছিল যে‌দিন প্রথমবার দুজন কাছাকা‌ছি এসে‌ছিল।

এক মেঘলা দি‌নের, মৃদু বিকা‌লে শ্রাব‌ণের সা‌থে তূবা দেখা কর‌তে আসে। সাধারণত এ সময় শ্রাবণ‌দের বাসায় তেমন কেউ থা‌কে না। নীরার বাচ্চা হবার পর ও চাক‌রি ছে‌ড়ে দি‌লেও সে‌দিন বাবার বা‌ড়ি বেড়া‌তে গি‌য়ে‌ছিল। বাসায় কেউ ছিল না ব‌লেই শ্রাবণ, তূবা‌কে ‌ডে‌কে‌ছিল। ভাবল দুজন একটু একান্ত সময় কাটা‌বে।

ভুলটা তখনই হ‌লো। ব‌লে না ছে‌লে মে‌য়ে একসা‌থে থা‌কলে, তা‌দের মাঝখা‌নে একটা শয়তানও এসে ব‌সে থাকে। সে শয়তানটাই সে‌দিন ওদের মা‌ঝে ব‌সে ভুলটা ক‌রি‌য়ে‌ছিল। গল্প কথায় কা‌ছে আসা, শরী‌রে শরী‌রে স্পর্শ, ঠোঁ‌টে ঠোঁ‌টে কথা। ঘো‌রের মা‌ঝে দুজন বুঝ‌তেই পা‌রে‌নি কী কর‌ছিল। প্রবল নেশাময় আস‌ক্তি‌তে দুজন কেবল একে অপ‌রের দি‌কে ধা‌বিত হ‌য়ে‌ছিল।

বাই‌রে যখন গোধূলী লগ্ন, তূবা শ্রাবণ তখন নি‌জে‌দের রু‌মে প্রবল ভা‌লোবাসায় বি‌ভোর ছিল। একটা সময়, তূবা যখন শ্রাবণের নগ্ন বু‌কে লজ্জায় মুখ লু‌কি‌য়ে ছিল, তূবার মাথ‌ায় চুমু এঁকে‌ ছ‌বি তু‌লে‌ছিল শ্রাবণ। তূবার শরীর পু‌রোপু‌রি চাদ‌রে আবৃত ছিল। ছ‌বিটা শ্রাবণ ফো‌নের খুব গোপন কুঠ‌রি‌তে লু‌কি‌য়ে রে‌খে‌ছিল।

আজ তূবা‌ দেখে লজ্জা বলল,
‘এটা এক্ষুনি ডি‌লিট ক‌রো।’
‘অসম্ভব! এটা আমার জীব‌নে সব‌চে‌য়ে মধুর স্মৃ‌তি।’
‘মধুর স্মৃ‌তি লো‌কের কা‌ছে গে‌লে, ভাইরাল নিউজ হ‌য়ে যা‌বে। তখন কেঁ‌দে কুল পা‌বে না।’
‘এটায় খারাপ কিছু নেই। তোমার চেহারাও দেখা যা‌চ্ছে না। আমার মুখের কিছুটা আর তোমার মাথার তালুর চুলগু‌লো দেখা যা‌চ্ছে। এছাড়া কিছু নেই।’
‘তবুও ডি‌লিট ক‌রো। আমার লজ্জা ক‌রে।’
‘‌জি না আমার লজ্জাবতী।’

৫৪!!
আজ কথা, নিহাদ, কথা‌দের বা‌ড়ি আসল। কথা, তূবা‌কে দে‌খে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল,
‘‌কেমন আছিস?’
‘ভা‌লো। তুই?’
‘খুব ভা‌লো।’
তূবা মৃদু হে‌সে বলল,
‘ভা‌লো তো থাক‌বিই। নতুন কেউ আস‌ছে ব‌লে কথা!’

কথা, নিহাদ লজ্জা পে‌য়ে হাসল। কথা তূবার দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল,
‘তূবা! তো‌কে কি সুন্দর লাগ‌ছে রে! ম‌নে হ‌চ্ছে স্বর্গীয় সৌন্দর্য তোর চেহারায়।’
তূবা লজ্জা পেল। নিহাদ বলল,
‘শ্রাবণ কোথায়?’
তূবা বলল,
‘‌কো‌চিং-এ পড়া‌চ্ছে।’
‘আচ্ছা কথা তু‌মি, তূবার সা‌থে থাকো। আমি দেখা ক‌রে আসি।’
কথা মাথা নে‌ড়ে বলল,
‘আচ্ছা।’
কথা গি‌য়ে ওর মা আর নীড়ার সা‌থে গল্প কর‌তে বস‌লো।

রা‌তে তূবা কিছু খে‌তে পারল না। শরীরটা খারাপ লাগ‌ছে ওর। গভীর রাত, তূবা অনেকটা ঘু‌মি‌য়েই প‌ড়ে‌ছিল। তখন শ্রাবণ চু‌পি চু‌পি ওর রু‌মে আসল। তূবার রু‌মের দরজা ভিতর থে‌কে লক কর‌তে বারণ ক‌রেছে শ্রাবণী। প্রেগ‌নেন্ট মে‌য়ে কখন অসুস্থ হ‌য়ে যায়। সে কার‌ণে দরজা কেবল লক না ক‌রে ভে‌জি‌য়ে রাখা হয়।

এ বাসার সবাই রু‌মে প্র‌বেশ করার আগে তূবার অনুম‌তি নেয়, কেবল শ্রাবণ বা‌দে। প্র‌তি‌দিন রা‌তে বেশ ক‌য়েকবার ক‌রে চু‌পি চু‌পি এসে প্রিয়তমা‌কে দে‌খে যায়। ‌বিষয়টা সবাই জে‌নেও কিছু ব‌লে না। কারণ জা‌নে ওরা আর সবার ভরসা কর‌বে না। শ্রাবণ চু‌পি চু‌পি বারবার আসে কেবল তূবা ঠিক আছে কি না দেখার জন্য।

শ্রাবণ রু‌মে ঢু‌কে তূবার মাথায় হাত বু‌লি‌য়ে দি‌তে লাগল। মাথায় কা‌রো স্পর্শ পে‌য়ে ঘুম ভাঙল। শ্রাবণ মাথায় হাত বু‌লি‌য়ে দি‌চ্ছে। তূবা ওর দি‌কে তা‌কি‌য়ে মৃদু হে‌সে বলল,
‘এ‌তো রা‌তে তু‌মি এখানে?’
শ্রাবণ হে‌সে বলল,
‘রা‌তে কিছু খাও‌নি। তাই তোমার পছ‌ন্দের হোয়াইট সস পাস্তা বা‌নি‌য়ে আনলাম। খে‌য়ে ব‌লো তো কেমন হ‌য়ে‌ছে?’
তূবা মি‌ষ্টি হাসল।

একটু খাবার পর তূবা আর খেল না। শ্রাবণ‌কে বলল,
‘‌বিছ‌ানায় উঠে ব‌সো। আমি তে‌ামার বুকে হেলান দি‌য়ে বসবো।’
শ্রাবণ বসার পর, তূবা ওর বু‌কে হেলান দি‌য়ে ব‌সে চোখ বন্ধ করল। তারপর বলল,
‘এভা‌বে থাক। আমি একটু ঘুমা‌বো। মনটা অস্থির লাগ‌ছে। তোমার বু‌কে মাথা রাখ‌লে আমার অস্থিরতা ক‌মে।’
‘অ‌স্থির কেন লাগ‌ছে?’
‘জা‌নি না। ম‌নে হ‌চ্ছে খারাপ কিছু হবে।’

শ্রাবণ, তূবার মাথায় চুমু এঁকে বলল,
‘এসব হর‌মোনাল চেইঞ্জ এর কার‌ণে ম‌নে হ‌চ্ছে।’
‘জা‌নি না। ত‌বে খুব ভয় ক‌রে। এতো ভয় আমার কখ‌নো লা‌গে‌নি। কখ‌নো না। সবসময় ম‌নে হয় খুব খারাপ কিছু হ‌বে। ভীষণ খারাপ। এতো খারাপ যা আমি সহ্য কর‌তে পারব না।’
‘করুণাম‌য়ের কৃপায় কিছু হ‌বে না। সব ঠিক থাক‌বে। এখন একটু ঘুমাও।’

তূবা কাত হ‌য়ে শ্রাব‌ণের বু‌কে মাথা রে‌খে চোখ বন্ধ ক‌রল। শ্রাবণ, তূবার পে‌টের নি‌চে বা‌লিশটা ঠিক ক‌রে দি‌য়ে দি‌লো, যা‌তে ওর কষ্ট না হয়।

দরজায় দাঁ‌ড়ি‌য়ে ওদের দুজন‌কে দে‌খে শ্রাবণী মুচ‌কি হাসল। তি‌নিও এসে‌ছিল তূবা কিছু খা‌বে কি না দেখ‌তে, কিন্তু তার আগে শ্রাবণ চ‌লে এসে‌ছে। তার ভ‌ালো লাগ‌ছে এটা ভেবে তার ছো‌টো ছে‌লেটা দা‌য়িত্ব নি‌তে শি‌খে গে‌ছে। ছো‌টো বয়‌সে বাবা হ‌তে ভয় পায়‌নি। সমা‌জের তোয়াক্কা, ভয় না ক‌রে নির্ভী‌কের ম‌তো তূবার হাত ধ‌রে‌ছিল।

যে বয়‌সে ছে‌লেরা বি‌য়ে, বাচ্চার ম‌তো ঝা‌মেলা কাঁ‌ধেই নি‌তে চায় না, দা‌য়িত্ব পালন তো দূ‌রের কথা! সে বয়‌সে তার ছে‌লে নিজের করা ভুল থে‌কে পালায়নি, অস্বীকার ক‌রে‌নি। বরং তূবা‌কে, নি‌জের সন্তান‌কে তা‌দের প্রাপ্য সম্মান দি‌য়ে‌ছে। তূবা‌কে কো‌নো অস্মান ক‌রে‌নি। আজ পর্যন্ত তা‌দের কো‌নো কথায়ও অবাধ্য হয়‌নি। হ্যাঁ হয়‌তো একটা অন্যায় সে ক‌রে ফে‌লে‌ছিল, কিন্তু প‌রোক্ষ‌ণে নি‌জের ভুলটা বুঝ‌তে পে‌রে, ভুলটা শুধ‌রে ফেলার জন্য ম‌রিয়া হ‌য়ে উঠে‌ছিল। এবং শেষ পর্যন্ত নি‌জের সাহস দি‌য়ে শুধ‌রেও ফে‌লে‌ছিল।

শ্রাবণী কো‌নো শব্দ না ক‌রে ভিত‌রে ঢুকল। হা‌তে নাস্তার প্লেট। তূবা তখন ঘুমঘুম প‌ড়ে‌ছে। শ্রাবণ তা‌কে দে‌খে উঠ‌তে চাই‌লে শ্রাবণী হা‌তের ইশারায় না করে। ‌প্লেটটা পা‌শের টে‌বি‌লে রে‌খে শ্রাব‌ণের কা‌ছে এসে ওর মাথায় চুমু খায়। শ্রাবণ অবাক চো‌খে তাকায়। শ্রাবণ মৃদু হে‌সে বলল,
‘আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ।’
শ্রাবণ মুচ‌কি হা‌সে। শ্রাবণী, তূবারও মাথ‌ায় চুমু খে‌য়ে দ‌রজা ভে‌জি‌য়ে চ‌লে যায়। শ্রাবণ, তূবা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে ব‌সে থা‌কে।

৫৫!!
আজ তা‌মিম, তা‌মিমা আসে তূবা‌কে দেখ‌তে। তা‌মি‌ম তো রোজই আসে। তা‌মিমা এখন আর খুব একটা আসে না। যতই ‌হোক তার ভাসু‌রের বা‌ড়ি, তবুও তো এখন মে‌য়ের শ্বশুর বা‌ড়ি। বে‌শি আসা যাওয়া ঠিক না। তা‌মিমা কতগু‌লো ছো‌টো কাঁথা নি‌য়ে আসে, তূবার বাচ্চার জন্য।

তা দে‌খে তূবা বেশ খু‌শি হ‌য়ে ব‌লে,
‘কাঁথাগুলো কি সুন্দর চা‌চি!’
তা‌মিমা হে‌সে বলল,
‘আরও অনেকগু‌লো কাঁথা সেলাই কর‌তে নি‌য়ে‌ছি। বাবু হ‌তে হ‌তে সব শেষ হ‌য়ে যা‌বে। এই কাঁথাগু‌লো দেখ। এগু‌লো তোর মা‌য়ের সেলাই করা। তোর মা তোর ছো‌টো ভ‌াই এর জন্য সেলাই ক‌রে‌ছিল। তি‌নি চ‌লে যাবার পর আমি খুব যত্ন ক‌রে এগু‌লো রে‌খে দি‌য়ে‌ছিলাম। সুন্দর ক‌রে ধুঁ‌য়ে রে‌খে দি‌য়ে‌ছিলাম।’

তূবা কাঁথাগু‌লো জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে গন্ধ নি‌লো। কেমন মা মা গন্ধ! তূবা কান্না ক‌রে দিলো। শ্রাবণী, তূবার মাথায় হাত দি‌য়ে বলল,
‘কাঁ‌দিস না। মা‌য়ের জন্য মন ভ‌রে দোয়া কর। গর্ভাবস্তায় মে‌য়েরা যা দোয়া ক‌রেন আল্লাহ না‌কি তা কবুল ক‌রে। তা‌মিমা তু‌মি ব‌সে‌া আমি চা নি‌য়ে আস‌ছি।’

শ্রাবণী চ‌লে যে‌তেই তা‌মিমা চার‌দি‌কে তা‌কি‌য়ে তূবার হা‌তে বিশহাজার টাকা দিয়ে বলল,
‘এটা রাখ। তোর যা মন চাই‌বে কি‌নে খাস।’
তূবা স্মিত হে‌সে বলল,
‘চা‌চি, তোমা‌কে পূ‌র্বেও ব‌লে‌ছি, এ বাসায় আমার কো‌নো ইচ্ছা‌কে অপূর্ণ রা‌খে না। এটা নি‌য়ে আমি এই প‌রিবা‌রের মানুষগু‌লো‌কে অপমান কর‌তে পারব না।’
‘অপমান কেন হ‌বে? মা মে‌য়ে‌কে দি‌তে পা‌রে না?’

‘পা‌রে, য‌দি মে‌য়ের না থা‌কে। মে‌য়ে অভা‌বে থা‌কে, কিন্তু তোমার মে‌য়ে অভা‌বে নেই। শ্রাবণ বা ওর প‌রিবার রা‌খে‌নি। তু‌মি জা‌নো না, শ্রাবণ বি‌য়ের পূ‌র্বে থে‌কেই আমা‌কে পাবার জন্য নি‌জের পা‌য়ে দাঁড়া‌নোর চেষ্টা ক‌রে গে‌ছিল। এখন তো নি‌জের সবটা দি‌য়ে চাক‌রি খুঁজ‌ছে। দিন রাত টিউশনী করা‌চ্ছে। নি‌জের পড়া‌ লেখা কর‌ছে। আমার একার জন্য ও এতো কষ্ট কর‌ছে। তে‌ামা‌দের দেওয়া টাকা নি‌য়ে আমি ওকে মো‌টেও অসম্মান কর‌তে পারব না। তোমর‌া কেন মান‌তে পার‌ছো ন‌া, আমি এখা‌নে খুব ভা‌লো আছি।’

‘না‌রে বোকা মে‌য়ে, আমি ব‌লি‌নি তুই ভা‌লো নেই। তো‌কে দেখ‌লেই বোঝা যায় তুই কতটা ভা‌লো আছিস। আমা‌দেরও তো মন চায় তো‌কে কিছু দি‌তে।’
‘‌‌কিছু দি‌তে হ‌বে ন‌া। তোমর‌া শুধু আমার জন্য দোয়া কর‌বে।’

তা‌মিমা কিছু একটা ব‌লতে চে‌য়েও থে‌মে গেল। তূবা বুঝ‌তে পে‌রে বলল,
‘‌কিছু বলতে চাও চা‌চি?’
‘বা‌ড়ি যা‌বি না?’
‘যাব। যে‌দিন বাবা নি‌জে এসে ডাক‌বে, শ্রাবণ‌কে ওর প্রাপ্য সম্মান দি‌য়ে নি‌য়ে যা‌বে সে‌দিন যাব। পু‌রো প‌রিবার মি‌লে যাব। তার আগে না।’
‘‌তোর বাবা লজ্জায় তোর কা‌ছে আস‌তে পার‌ছে না। সে‌দিন তোর পে‌টে লা‌থি মারার পর থে‌কে তি‌নি এতো অনু‌শোচনায় পু‌ড়ছে যা তুই ভে‌বে পা‌বি না।’

দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে তূবা বলল,
‘আ‌মি মস্ত ব‌ড়ো অন্যায় ক‌রে‌ছিলাম, বাবা রাগ ক‌রেছেন, মে‌রে‌ছেন আমি ঐ পর্যন্তই ম‌নে রে‌খে‌ছি। তারপর কিছু ম‌নে রা‌খি‌নি। তা‌কে ব‌লে দিও, তার প্র‌তি আমার যা অভি‌যোগ তা কখ‌নো প্রকাশ করব না। আমাদের বা‌ড়ি আস‌লে আমি কখ‌নো তা‌কে অসম্মান করব না বা আমার প‌রিবারও কর‌বে না। বি‌য়ের পর সব ভু‌লে আমি নি‌জেই বা‌ড়ি যেতাম, সম্পর্ক ভা‌লো রাখতাম, কিন্তু সেদিন বাবা আমার পে‌টে লা‌থি মে‌রে আমার মাতৃত্ব‌কে আঘাত ক‌রে‌ছিল, সেটা আমি চে‌য়েও ভুল‌তে পারব না।’
তা‌মিমা আর কো‌নো কথা বলল না।

বা‌ড়ি ফি‌রে তা‌মিমা, তূবার ফি‌রি‌য়ে দেওয়া টাকাটা তা‌রিক সা‌হেব‌কে দি‌য়ে বলল,
‘ভাইয়া, তূবা আজও টাকা নেয়‌নি। আপ‌নি আমি দুজ‌নেই জা‌নি তূবা কখনো টাকা নি‌বে না, তা-ও আপ‌নি আমি ওকে দেখ‌তে যাবার সময় টাকা দি‌তে ব‌লেন। এতে যে আমরা ছো‌টো হই বু‌ঝেন? তূবা ওখা‌নে স‌ত্যি খুব ভা‌লো আছে। শ্রাবণ আর ওর প‌রিবার তূবার অনেক খেয়াল রা‌খে। তা‌রিক সা‌হেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘স্বা‌ধে তো দেই না। একটা মে‌য়ের অনেক খরচ। গর্ভাবস্তায় তো আরও বে‌শি খরচ। শ্রাবণ তো করার ম‌ধ্যে কয়টা টিউশ‌নি ক‌রে। কয় টাকাই বা পায়। তা দি‌য়ে আমার মে‌য়ে কীভা‌বে চল‌বে? যে মে‌য়ে দুহা‌ত ভ‌রে টাকা উড়া‌তো, সেই মে‌য়ে আমার টে‌নেটু‌নে চ‌ল‌বে? ব্যাপারটা মান‌তে পার‌ছি না।’

তা‌মিমা মৃদু হে‌সে বলল,
‘টে‌নেটু‌নে চল‌ছে না। শ্রাব‌ণের প‌রিবার য‌থেষ্ট স্বচ্ছল।’
‘প‌রিবা‌রের থাকা আর নি‌জের স্বামীর থাকার ম‌ধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য।’
স্বামীর থাক‌লে মে‌য়েরা যখন তখন স্ব‌ামীর কাছ থে‌কে নি‌তে পা‌রে, কিন্তু তার না থাক‌লে তারা ভ‌য়ে, লজ্জায় চাই‌তেও পা‌রে না, আর চাই‌তে গে‌লে ভা‌বে প‌রিবা‌রের কা‌ছে চাই‌তে হ‌বে, তাই নি‌জের অনেক প্র‌য়োজ‌নের কথা নিজ মা‌ঝেই চে‌পে রা‌খে। স্বামীর কষ্ট হ‌বে ভে‌বে বলে না। আর বারবার চাই‌লে প‌রিবা‌রের লোকও একসময় বিরক্ত হ‌য়ে যা‌বে।’

তা‌মিমা তা‌কে আশ্বাস দি‌য়ে বলল,
‘শ্রাব‌ণের প‌রিবার কেমন তা আপ‌নি ভা‌লো ক‌রেই জা‌নেন। তাছাড়া ওরা তো সারাজীবন প‌রিবা‌রের উপর ব‌সে খা‌বে না? শ্রাবণ গ্রাজু‌য়েশন শেষ ক‌রেছে, মাস্টার্স করছে। শ্রাব‌ণের রেজাল্ট খুব ভা‌লো। ও বি‌সিএস দি‌বে। ইনশাআল্লাহ হ‌য়েও যা‌বে দেখ‌বেন। তাছাড়া ছে‌লেটা তো তূবার জন্য কম প‌রিশ্রম কর‌ছে ন‌া। এ বয়সী একটা ছে‌লে এত প‌রিশ্রম কর‌ছে নি‌জের স্ত্রী বাচ্চার জন্য। ও কিন্তু সে‌দিন চাই‌লে আর পাঁচটা ছে‌লের ম‌তো নি‌জের সন্তান আর তূবা‌কে অস্বীকার কর‌তে পার‌তো, কিন্তু তা না ক‌রে ও শক্ত হ‌য়ে তূবার পা‌শেই দাঁ‌ড়িয়ে ছিল। আপনার ম‌নে হয় না, এ ছে‌লে জীব‌নে তূবা‌কে কষ্ট দি‌বে না?’

তা‌রিক সা‌হেব আর কিছু বল‌লেন না। তি‌নি নি‌জেও জা‌নেন। যে পুরুষ নি‌জের ভুল‌কে সর্বসম্মু‌খে স্বীকার ক‌রে শা‌স্তি নেওয়ার ম‌তো ম‌নোবল রা‌খে, সে আর যাই করুক তার স্ত্রী‌ সন্তান‌কে কখ‌নো কষ্ট দি‌বে না।

তা‌রিক সা‌হেব, শ্রাব‌ণদের বা‌ড়ির সাম‌নে দি‌য়ে যাবার সময় বারবার ভিত‌রে তাকায়, ভা‌বে য‌দি মে‌য়েটাকে একবার দেখ‌তে পায়, কিন্তু ওদের বা‌ড়ির চারপা‌শের উঁচু দেয়া‌লের কার‌ণে দেখ‌তে পা‌রে না কখ‌নোই। তার খুব ইচ্ছা ক‌রে ভিত‌রে গি‌য়ে মে‌য়ের নাম ধ‌রে জো‌রে ডাক দিক তূবা ব‌লে। মে‌য়ে এসে তা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে কাঁদ‌ুক। সকল মান অভিমান কান্নায় ভে‌সে যাক। কিন্তু রাগী, ক‌ঠিন মানুষগু‌লো নি‌জে‌দের অভিমান, ভা‌লোবাসা সহ‌জে প্রকাশ কর‌তে পা‌রে না। তা‌দের ভা‌লোবাসা বে‌শিরভাগ ক্ষে‌ত্রেই থে‌কে যায় অপ্রকা‌শিত।

৫৬!!
তূবা‌কে নি‌য়ে আজ শ্রাবণ ঘুর‌তে বের হ‌চ্ছে। তূবার ভা‌লো লাগ‌ছিল না। সে কার‌ণে একটু ঘু‌রে ফি‌রে আস‌তে বলল শ্রাবণী। বা‌ড়ি থে‌কে বের হ‌য়ে শ্রাবণ বলল,
‘‌কোথায় যা‌বে?’
‘নদীর পা‌ড়ে চ‌লো। নৌকায় ঘুরব দুজন মি‌লে।’
‘আচ্ছা।’
তূবা‌কে ধ‌রে শ্রাবণ রিকশায় উঠ‌তে সাহায্য করল।

‌কিছুদূর যাবার পর বাজা‌রের সাম‌নে রিকশা থা‌মি‌য়ে, শ্রাবণ নামল। কিছু শুকনা খাবার, পা‌নি, কোল্ড ড্রিংকস কেনার জন্য। তূবা রিকশায়ই ব‌সে রইল। দূর থে‌কে একধ্যা‌নে তূবা‌কে তা‌কি‌য়ে দেখ‌ছেন তা‌রিক সা‌হেব। ম‌নে ম‌নে বলল,
‘মে‌য়েটা কি সুন্দর হ‌য়ে‌ছে! চেহারা দে‌খেই বোঝা যা‌চ্ছে সু‌খে আছে।’

‌মে‌য়ের সাত মা‌সের ফোলা পেটটাও তার চোখ এড়া‌লো না। এই পে‌টেই তো তি‌নি লা‌থি মে‌রে‌ছি‌লেন। ইশ! সে‌দিন কি অমানু‌ষের ম‌তো কাজটাই না ক‌রে‌ছি‌লেন। সে‌দিন তি‌নি রাগ না ক‌রে একটু ভেবে চি‌ন্তে কাজ কর‌তেন ত‌বে, আজ লো‌কে তা‌কে, তূবা‌কে এবং তার প‌রিবার‌কে ‌যে বা‌জে কথাগু‌লো ব‌লে কিংবা পিছ‌নে ব‌সে সমা‌লোচনা ক‌রে তা কর‌তে পার‌তো না। সব‌কিছু সুন্দর সুষ্ঠু হ‌তো। রাগ মানুষ‌কে দি‌য়ে কত কিছু যে করা‌তে পা‌রে, তার হিসাব নেই। তা‌রিক সা‌হেব দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল।

শ্রাবণ, রিকাশায় উঠে আবার তূবা‌কে নি‌য়ে চ‌লে গেল। যতক্ষণ রিকশা‌টাকে দেখা যায় ততক্ষণ তাকি‌য়ে রই‌ল তা‌রিক সা‌হেব।

‌তূবা নৌকায় ব‌সে আছে শ্রাবণ ওর কো‌লে মাথা নি‌য়ে শু‌য়ে আছে। শ্রাবণের বন্ধু সোহাগ নৌকার দাঁড় বাই‌ছে। শ্রাবণ বলল,
‘তূবা, একটা গান গাও তো।’
তূবা হে‌সে বলল,
‘আমার যা কণ্ঠ এখন গান গাই‌লে জ‌লোকম্প শুরু হ‌বে। তু‌মি গাও। তাছাড়া তু‌মি ভা‌লো ক‌রে জা‌নো আমি গান পা‌রি না।’

শ্রাবণ হে‌সে বলল,
‘আ‌মিও পা‌রি না।’
‌সোহাগ হে‌সে বলল,
‘আ‌মি গাই‌বো? আমি কিন্তু দারুণ গান জা‌নি।’
শ্রাবণ বলল,
‘আ‌রে হ্যাঁ। ভু‌লেই গি‌য়ে‌ছিলাম তোর কথা।’

‌সোহাগ গলা ছে‌ড়ে গাই‌তে শুরু করল,

তাকে অল্প কাছে ডাকছি
আর আগলে আগলে রাখছি
তবু অল্পেই হারাচ্ছি আবার

তাকে ছোঁবো ছোঁবো ভাবছি
আর ছুঁয়েই পালাচ্ছি
ফের তাকেই ছুঁতে যাচ্ছি আবার

অভিমান পিছু নাও
তাকে পিছু ফেরাও
তার কানে না যায় পিছু ডাক
আমার মুখ বুজেই তাকে ডাকছি আবার

তাকে অল্প কাছে ডাকছি
আর আগলে আগলে রাখছি
তবু অল্পেই হারাচ্ছি আবার

গান শু‌নে তূবা বলল,
‘অসাধারণ! সোহাগ তু‌মি এতো ভা‌লো গান গাও! আমি তো জানতামই না।’
‌সোহাগ লাজুক হে‌সে বলল,
‘ধন্যবাদ ভা‌বি।’

শেষ বিকা‌লে ‌ফেরার প‌থে শ্রাবণ, তূবা‌কে নি‌য়ে আবার বাজা‌রে নামল। তূবার কিছু প্র‌য়োজনীয় জি‌নিস কেনার ছিল। দোকান থে‌কে জি‌নিসপত্র কেনার পর বের হ‌তেই তা‌রিক সা‌হেব সাম‌নে পড়ল শ্রাবণ, তূবা। তা‌রিক সা‌হেব‌কে দে‌খে তূবার চো‌খে স্পষ্ট ভয় ফু‌টে উঠল। ও শ্রাব‌ণের পিছ‌নে নি‌জে‌কে আড়াল ক‌রে ফেলল। শ্রাবণ বিষয়টা বুঝ‌তে পে‌রে তূবার হাত ধ‌রল। শ্রাবণ, তা‌রিক সা‌হে‌বের দি‌কে তা‌কি‌য়ে হালকা ম‌লিন হে‌সে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম চাচ্চু। কেমন আছেন?’

তা‌রিক সা‌হেব, ওর কথার উত্তর না দি‌য়ে, একপলক তূবার দি‌কে তা‌কি‌য়ে আবার অন্য দি‌কে তা‌কি‌য়ে চ‌লে গে‌লেন। ম‌নে ম‌নে বলল,
‘‌আমার মে‌য়েটা আমা‌কে এতো ভয় কেন পায়? কেন ও আমার সা‌থে সহজ হ‌তে পা‌রত না? দূরত্ব কী আমি তৈ‌রি ক‌রে‌ছি না‌কি আমার রাগ?’

‌তা‌রিক সা‌হেব চ‌লে যে‌তেই, তূবা চো‌খের কো‌ণে জমা অশ্রু মু‌ছে বলল,
‘বাবা এখ‌নও আমা‌দের ক্ষমা কর‌তে পা‌রে‌নি, তাই না শ্রাবণ?’
শ্র‌াবণ, তূবার হাত ধ‌রে বলল,
‘শীঘ্রই হয়‌তো ক্ষমা ক‌রে দি‌বেন। তু‌মি চিন্তা ক‌রো না। আইস‌ক্রিম খা‌বে?’
‘না।’
‘তাহ‌লে?’
‘চক‌লেট কেক।’
‘বাহ্! চ‌লো ত‌বে পেস্ট্রি শ‌পে।’
‘নাহ। বাসায় নি‌য়ে চ‌লো। সবাই একসা‌থে খা‌বো।’
‘আচ্ছা।’

“রৌ‌দ্রোজ্জ্বল দি‌নে একটু মে‌ঘের ছায়া” অর্ডার কর‌তে অমা‌কে নক করুন।

এছাড়া আমার ছয়টা বই: ঘর, সংবৃত, কিছ‌ু সাদা টিউ‌লিপ, তোমায় নি‌য়ে, সমান্তরাল বাঁধন, সমীকর‌ণের মিশ্রণ পা‌চ্ছেন রকমা‌রি সহ যে কো‌নো অনলাইন বুকশ‌পে। এছাড়াও আমার দু‌টো ই-বুক: শেষ পাতা, এক‌দিন বিকালে সকাল হ‌য়ে‌ছি‌ল, পা‌চ্ছেন বইটই এ্যা‌পে।
এছাড়া বিস্তা‌রিত জান‌তে আমা‌কে নক করুন।

চল‌বে…

#অর‌ণ্যে_রোদন
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৫২

৫৭!!
শ্রাবণ, তূবা‌কে বলল,
‘তূবা, তৈ‌রি হ‌য়ে নাও।’
‘‌কেন? কোথাও যা‌চ্ছি আমরা?’
‘হ্যাঁ যা‌চ্ছি।’
‘‌কোথায়?’
‘‌তোমা‌দের বা‌ড়ি।’

তূবা বেশ অবাক হ‌য়ে বলল,
‘‌কেন?’
‘‌কেন আবার? আমি আমার শ্বশুর বা‌ড়ি‌তে বেড়া‌তে যাব না?’
‘হ্যাঁ, না মা‌নে?’
‘কী মা‌নে?’
‘বাবা…!’

দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে শ্রাবণ বলল,
‘তূবা তোমার ম‌নে হয় না, আমা‌দের করা এতো ব‌ড়ো অন্যায়টার পর তার সে‌দি‌নের রাগটা স্বাভা‌বিক ছিল? য‌দিও রাগটা অ‌তিরিক্ত ছিল, কিন্তু তু‌মি নি‌জের দিকটা না ভে‌বে বাবার দিকটা ভা‌বো? আমরাও তো ক‌দিন পর বাবা মা হ‌বো। আমা‌দের সন্তান ব‌ড়ো হ‌য়ে য‌দি এমন অন্যায় ক‌রে, আমরা কি রাগ করবো না? ওভার রিয়াক্ট করব না?

সন্তান যার আছে সেই ‌কেবল এ যন্ত্রণা বুঝ‌বে। তুমি সন্তা‌নের ম‌তো না ভে‌বে মা‌য়ের ম‌তো ভা‌বো। তোমার বাবার প্র‌তি তোমার অভিমান প‌ড়ে যা‌বে। যেমন আমার প‌ড়ে গে‌ছে। অন্যায় যে‌হে‌তু প্রথ‌মে আমরা ক‌রে‌ছি ক্ষমাও ‌তো প্রথ‌মে আমা‌দের চাওয়া উচিত।’

‘‌কিন্তু শ্রাবণ সে চেষ্টা করা হ‌য়ে‌ছিল। আমা‌দের রি‌সিপশ‌নে তা‌কে, ‌তোমার বাবা মা নি‌জে গি‌য়ে নিমন্ত্রণ ক‌রে‌ছি‌লেন, কিন্তু তখন তি‌নি আসেন‌নি। আমি তো ভে‌বে‌ছিলাম তখন ক্ষমা চাইব, কিন্তু তি‌নি না‌ আস‌লে কী করব?’

‘‌তি‌নি আসেন‌নি, কিন্তু আমরাও তো যে‌তে পারতাম? ভুল যখন আমরা আগ বাড়ি‌য়ে ক‌রেছি, ক্ষমাটাও আগ বা‌ড়ি‌য়ে আমা‌দের চাওয়া উচিত। আমা‌দের এতো‌দিন অপেক্ষা না ক‌রে, আরও আগে তার কা‌ছে গি‌য়ে ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল। যা হোক দেরী ক‌রে হ‌লেও আমা‌দের এখন গি‌য়ে তার কা‌ছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। তার পা ধরে ক্ষমা চাওয়া উচিত। তি‌নি ক্ষমা না কর‌লেও বারবার তার কা‌ছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।

যার কন্যা সন্তান আছে কেবল তি‌নিই এ কষ্ট বুঝ‌তে পার‌বে। সন্তান নি‌য়ে, তাদের বি‌য়ে নি‌য়ে বাবা-মা‌য়ের অনেক স্বপ্ন থা‌কে, কিন্তু আমরা তাদের সে স্বপ্ন ভে‌ঙে চুরমার ক‌রে‌ছি। শুধু স্বপ্নই ভা‌ঙি‌নি তা‌দের সম্মানও হা‌নি ক‌রে‌ছি। আমা‌দের কা‌জে‌র কার‌ণে তা‌দের সম্মার ধু‌লোয় মি‌শে গে‌ছে।

সবাই নি‌জে‌দের সম্মান নষ্ট হওয়ার বিষয়টা সহ‌জে নি‌তে পা‌রে না। দে‌খো না অনে‌কে সম্মান নষ্ট হবার কার‌ণে সু* সা* ই* ড পর্যন্ত ক‌রে। মানুষ জীব‌নের চে‌য়ে বে‌শি সম্মান‌কে প্রধাণ্য দেয়। আমরা সেটাই নষ্ট ক‌রে‌ছি। তো আমা‌দের উপর এতটুকু রাগ হওয়াটা কী স্বাভা‌বিক না!’

তূবা, শ্রাবণ‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে কেঁ‌দে ফেলল। কাঁদ‌তে কাঁদ‌তে বলল,
‘তু‌মি, আমার চে‌য়ে ছো‌টো হ‌য়েও এতো কীভা‌বে বু‌ঝো? আমি কেন এতো সব ভা‌বি‌নি?’

শ্র‌াবণ হে‌সে বলল,
‘তোমার হ‌য়ে ভাবার জন্য আমি তো আছি। তাছ‌াড়া বাবা হ‌চ্ছি এখন তো ভাব‌তে হ‌বে। না ভাব‌লে ভবিষ্য‌তে সব সামলা‌বো কী ক‌রে? এখন কান্না না ক‌রে তৈ‌রি হ‌য়ে নাও।’
‘আমাদের সা‌থে আর কে কে যা‌বে?’
‘প্রথ‌মে আমরা দু’জন যা‌বো। তারপর য‌দি দে‌খি প‌রি‌স্থি‌তি স্বাভা‌বিক তাহ‌লে বা‌ড়ির সবাই যা‌বে। প্রথ‌মেই য‌দি তা‌দের নেওয়া ঠিক হ‌বে না। তোমার বাবা কেমন কী রিয়াক্ট ক‌রে তা তো জা‌নি না।’
‘হুম ঠিক বল‌ছো।’

‌কিছুক্ষণ পর,
তূবা, শ্রাবণ হা‌জির হ‌লো তূবার বা‌ড়ি। তূবা, কথা‌, নিহাদকে নি‌য়ে আস‌তে চে‌য়ে‌ছিল, কিন্তু শ্রাবণ বলল,
‘সমস্যা যে‌হেতু আমরা তৈরি ক‌রে‌ছি তাই সমাধানটাও আমরা প্রথ‌মে করব। তোমার বাবা হয়‌তো রাগ কর‌বে, মার‌বে মে‌রে তো ফেল‌বে না।’
তবুও তূবা ভয় পায়। ওর বাবার রাগ‌কে খুব ভয় পায়।’

তূবা দরজার সাম‌নে গি‌য়ে ওর চা‌চি তা‌মিমাকে ডাকল। তা‌মিমা তখন বাগা‌নের লাউ গা‌ছের মাচাটা ঠিক ক‌রে দি‌চ্ছিল। গাছটা সুন্দর হ‌য়ে‌ছে। সবুজ ক‌চি ডগা আর বড়ো ব‌ড়ো পাতার ভারে মাচাটা নু‌য়ে যা‌চ্ছিল। সেটাই ঠিক ক‌রে দি‌চ্ছিল তা‌মিমা। তূবা আর শ্রাবণ‌কে দে‌খে বিস্ম‌য়ের সা‌থে সা‌থে খু‌শিও হ‌লো অনেক। অনেক সুন্দর এবং বি‌নীত ভ‌ঙ্গি‌তে ওদের ভিত‌রে নি‌য়ে গেল।

তূবা ভ‌য়ে বারবার হাত মোচরা‌চ্ছে। কারণ ও জা‌নে ওর বাবা এ সময় ঘ‌রে থা‌কে। যেখা‌নে বা‌ঘের ভয় সেখা‌নে সন্ধ্যা হয়। তূবা, শ্রাবণ ভিত‌রে ঢুকে দেখল তা‌রিক সা‌হেব সাম‌নের রু‌মেই সোফায় ব‌সে টি‌ভি দেখ‌ছে। তূবা ভ‌য়ে ঘাম‌তে লাগল। শ্রাবণ ওর হাত ধ‌রে আশ্বাস দি‌লো।

তূবা কাঁপাকাঁপা ক‌ণ্ঠে ডাকল,
‘বাবা।’
তা‌রিক সা‌হেব বেশ বিস্ময় নি‌য়ে তার ডান দি‌কে তাকাল। এতক্ষণ তার খেয়াল টি‌ভির দি‌কে ছিল। তূবা, শ্রাবণ‌কে দে‌খে তি‌নি বেশ চম‌কে গে‌লেন।

শ্রাবণ তা‌র দি‌কে তা‌কি‌য়ে মুচ‌কি হে‌সে সালাম ‌দি‌লো।
‘আসসালামু আলাইকুম।’
তা‌রিক সা‌হেবও কিছু না ভেবে সালা‌মের উত্তর দি‌লেন,
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’

ত‌ারপর আর তা‌রিক সা‌হেব কিংবা শ্রাবণ, তূবা কেউই কো‌নো কথা খুঁ‌জে পেল না। তা‌রিক সা‌হেব বলল,
‘‌কেমন আছিস তোরা?’
তূবা মাথা নিচু ক‌রে রইল। ওর চোখ থে‌কে টপটপ ক‌রে ব‌ড়ো ব‌ড়ো অশ্রুকণা ঝ‌রে পড়‌ছে। শ্রাবণ বলল,
‘আমরা ভা‌লো আছি। আপনি?’
‘হ্যাঁ ভা‌লো। বস।’

শ্রাবণ সোফায় না বসে তা‌রিক সা‌হে‌বের পা‌য়ের কা‌ছে বসল। তারপর তার হাত দু‌টো ধ‌রে বলল,
‘চাচ্চু, আমরা মস্ত ব‌ড়ো অন্যায় ক‌রে‌ছিলাম। যার কো‌নো ক্ষমা হয় না। আমা‌দের দ্বারা আমা‌দের দুজনার প‌রিবারই খুব কষ্ট পে‌য়ে‌ছে। দুই প‌রিবা‌রেরই মান সম্মান আমরা ধু‌লোয় মি‌শি‌য়ে দি‌য়েছি। কিন্তু এখন যে ভুল, অন্যায় ক‌রে ফে‌লে‌ছি তা তো পাল্টা‌নো কিংবা মুছে ফেলা যা‌বে না। ভুলটা আমা‌দের ব‌য়ে বেড়া‌তে হ‌বে সারাজীবন।

আমার বাসার সবাই আমা‌দের ক্ষমা ক‌রে দি‌য়ে‌ছে। মে‌নেও নি‌য়ে‌ছে। সবাই আমা‌দের সম্পর্ক মে‌নে নি‌য়ে‌ছেন, শুধু আপ‌নি বা‌কি। আপ‌নি আমা‌দের মারুন, কাটুন, শা‌স্তি দিন, কিন্তু মে‌নে নিন। আমা‌দের এতো তাড়াতা‌ড়ি ক্ষমা কর‌তে হ‌বে না। আপ‌নি বরং আমা‌দের ক্ষমা না ক‌রে শা‌স্তি দিন। তা-ও আমা‌দের মে‌নে নিন। আমরা আপনার পা ধ‌রে ক্ষমা চাই‌ছি চাচ্চু।’

শ্রাবণ তা‌রিক সা‌হে‌বের পা ধরল। তারপর তূবার দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল,
‘কী হ‌লো চাচ্চুর পা ধ‌রে ক্ষমা চাও।’

তূবা কাঁদ‌তে কাঁদ‌তে তার কা‌ছে এসে ধী‌রে ধী‌রে নি‌চে বস‌তে চাইল। সাত মা‌সের পেট নি‌য়ে বসা তো সহজ না। কিন্তু তূবা‌কে বস‌তে হ‌লো না। তার আগেই তা‌রিক সা‌হেব তূবার হাত ধ‌রে বলল,
‘আ‌মি কার নানাভাই হ‌চ্ছি? ছেলের না‌কি মে‌য়ের?’

তূবা এবার হাউমাউ ক‌রে কাঁদ‌তে লাগল। তা‌রিক সা‌হেব তূব‌া‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল,
‘‌সে‌দিন আমার তো‌কে ওভা‌বে মারা উচিত হয়‌নি।’
তূবা কান্নারত ক‌ণ্ঠে বলল,
‘না, বাবা তু‌মি ঠিক কর‌ছো। আমরাই জঘণ্য অপরাধ ক‌রে‌ছিলাম। যে অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।’

‘ভুল তোরা ক‌রে‌ছি‌লি। আমার রাগ করা জা‌য়েজ হ‌লেও, রাগ প্রকাশ করার ধরণ ঠিক ছিল না। তুই ম‌রে যে‌তে পার‌তি।’
‘‌পিছ‌নের কথা বাদ দাও, বাবা। আমা‌দের ক্ষমা ক‌রে দাও।’

‘হুম। যা তো‌দের মে‌নে নিলাম। ত‌বে ক্ষমা করব আমার নানাভাই কিংবা নানুভাই যখন ক্ষমা কর‌তে বল‌বে তখন। কে আস‌ছে বোন না‌কি ভাই?’
শ্রাবণ মুচ‌কি হেসে বলল,
‘ভাই। চাচ্চু আমা‌কে ক্ষমা ক‌রে‌ছেন তো?’

তা‌রিক সা‌হেব বেশ ধমক দিয়ে বলল,
‘চাচ্চু কী রে? বাবা বল।’
শ্রাবণ হে‌সে বলল,
‘বাব‌া।’
তারিক সাহেব শ্রাব‌ণকেও জ‌ড়ি‌য়ে নি‌লেন। র‌াগী মানুষগুলোর মন অনেকটা ঝুনা নার‌কে‌লের ম‌তো। বাই‌রেটা যতটা ক‌ঠিন, শক্ত, ভিতরটা ততটাই নরম, রসা‌লো আর মি‌ষ্টি, ঠাণ্ড, প্রাণ শীতলকা‌রি।

ও‌দের মিলন দে‌খে তা‌মিমাও কেঁ‌দে ফেলল। তা‌রিক সাহেব, তা‌মিমার দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল,
‘‌কি রে তা‌মিমা দাঁ‌ড়ি‌য়ে কাঁদ‌ছিস কেন? ‌মে‌য়ে জামাই আস‌ছে তা‌দের আপ্যায়‌নের ব্যবস্থা ক‌র। যা ‌মেজ বউকে ডাক। আমি গি‌য়ে বেয়াই বেয়ান‌কে নি‌য়ে আস‌ছি। আজ আমার বা‌ড়ি‌তে উৎসব হ‌বে।

সবার ভিত‌রের সকল জড়তা কে‌টে গেল। কা‌লো মেঘ জ‌মে বৃ‌ষ্টি হ‌লো। বৃষ্টি শে‌ষে রঙধনু উঠে আকাশ এখন প‌রিষ্কার, রৌ‌দ্রোময়। রৌ‌দ্রোজ্জ্বল দি‌নের মে‌ঘের ছায়া কে‌টে গে‌ছে। এখন শুধু ঝলম‌লে রোদ। ও হ্যাঁ আমার নতুন বই এর নাম কিন্তু “রৌ‌দ্রোজ্জ্বল দি‌নে একটু মে‌ঘের ছায়া” সংগ্রহ ক‌রে‌ছেন তো?

‌বিকাল থে‌কে তা‌রিক সাহেবের ঘ‌রে আনন্দের বন্যা বইল। রা‌তে দুই প‌রিবার এবং আরও অনেক আত্মীয় স্বজন মি‌লে জ‌মি‌য়ে খাওয়া দাওয়া আড্ডা হ‌লো। সবাই আস‌লেও কথার শরী‌রটা ভা‌লো না বিধায় ও আস‌তে পারল না। ত‌বে নিহাদ আর ওর বাবা নয়ন এসে‌ছিল। খে‌য়ে আবার তারা চ‌লে গে‌ছে।

ক্লান্ত তূবা‌‌কে এক জায়গায় ব‌সে থাক‌তে দে‌খে তা‌রিক সা‌হেব এসে পা‌শে ব‌সে জি‌জ্ঞেস করল,
‘‌তোর কী শ‌রীর খারাপ লাগ‌ছে?’
‘না বাবা। একটু ক্লান্ত লাগ‌ছে।’
‘তাহ‌লে রুমে গি‌য়ে শু‌য়ে পড়।’
‘না না আমি ঠিক আছি।’

তা‌রিক সা‌হেব‌কে কেউ ডাকল।তি‌নি চ‌লে গে‌লেন। শ্রাব‌ণের প‌রিবা‌রের সবাই-ই রা‌তে চ‌লে গেল। শুধু তূবা-শ্রাবণ‌কে রে‌খে গেল।

আত্মীয়-স্বজন সব চ‌লে যাবার পর শ্রাবণ তা‌মিমার কা‌ছে এসে বলল,
‘চা‌চি, একটু রসুন ছে‌চে, স‌রিষার তে‌লে দি‌য়ে গরম ক‌রে দিন তো।’
‘‌কেন রে। তোর কোথাও লাগল না‌কি?’
‘না না। আমার কোথাও লা‌গে‌নি। সপ্তাহ খা‌নিক হ‌লো তূবার শরী‌রে পা‌নি আস‌ছে। এতক্ষণ ব‌সে থাকার এবং হাঁটাহাটির কারণে পা ফু‌লে গে‌ছে খুব, ব্যথা কর‌ছে না‌কি। তাই পা মা‌লিশ ক‌রে দিব। ওর আরাম লাগে।’
‘তুই গি‌য়ে শু‌য়ে পড়। আমি মা‌লিশ ক‌রে দিব।’
‘না না চা‌চি। আপ‌নি শুধু তেল রসুন গরম করে দিন। ওর সব কাজ আমিই ক‌রি।’

তা‌মিমা, একটা স্টি‌লের বা‌টি‌তে তেল রসুন গরম করে দিল। শ্রাবণ রু‌মে গি‌য়ে তূবার পা সুন্দর ক‌রে মা‌লিশ ক‌রে দি‌য়ে ওকে বিছানায় শুই‌য়ে দি‌য়ে পে‌টে নি‌চে বা‌লিশটা দি‌য়ে দি‌লো।

তূবা শু‌য়ে মুচ‌কি হে‌সে বলল,
‘‌বি‌য়ের পর আজ প্রথম আমরা রা‌তে এক রুম শেয়ার কর‌ছি।’
‘‌বি‌য়ের পর না বরং এটাই প্রথম আমা‌দের রা‌তে রুম শেয়ার করা।’

তূবা হে‌সে বলল,
‘এখা‌নেও আমা‌দের বি‌য়ের সব স‌ত্যিটা বলা উচিত ছিল।’
‘আপাতত কিছু স‌ত্যি আমা‌দের প‌রিবা‌রের হ‌য়ে থাক। ভয় পেও না, ‌তোমার শ্রাবণ যেমন তে‌ামার নেশায় পাগল হ‌তে পা‌রে, তেম‌নি নি‌জে‌কে নিয়ন্ত্রণ কর‌তেও পা‌রে।’

তূবা হাসল। শ্রাবণ, তূবার পা‌শে শু‌য়ে ওকে আষ্টে পি‌ষ্টে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল,
‘এই জি‌নিসটা আমি মো‌টেও নিয়ন্ত্রণ কর‌তে চ‌াই না।’
তূবা হে‌সে বলল,
‘আরও শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রো।’

৫৮!!
কথার শরীরটা খুব খারাপ। ক‌দিন যাবত খাওয়া দাওয়া একেবা‌রে বন্ধ। যা-ও মু‌খে দেয় ব‌মি ক‌রে উগ‌ড়ে ফে‌লে দেয়। শরীর এতো ক্লান্ত হ‌য়ে‌ছে যে, শেষমেস শরী‌রে স্যালাইন দি‌তে হ‌য়ে‌ছে। বাসায়-ই সব ব্যবস্থা করা হ‌য়ে‌ছে। স্যালাইন চল‌ছে আর কথা মরার ম‌তো প‌ড়ে প‌ড়ে ঘুমা‌চ্ছে।সো‌হেল, শ্রাবণী, বর্ষণ এসে‌ছে অনেকক্ষণ হ‌লো, কিন্তু ওর ঘুম ভাঙার নাম নি‌চ্ছে না। তারাও আর ডা‌কে‌নি।

অনেক্ষণ কথা ব‌লে শ্রাবণী, মো‌মেনা‌কে বলল,
‘আপা, এখন যে উঠ‌তে হয়। ঘ‌রে তূবা আর নীরা একা। নীরা তো ছে‌লে নীরব‌কে সামলা‌তে ব্যস্ত থাকে। তূবা একদম একা। শ্রাবণ সন্ধ্যার পর ছাড়া বাড়ি ফির‌বে না। বুঝ‌তেই পার‌ছেন তূবা অসুস্থ।’

‘হ্যাঁ, আপা। আপ‌নি বরং যান। কথার খেয়াল রাখার জন্য আমি, নিহাদ আছি।’
শ্রাবণী, মো‌মেনার হাত ধ‌রে বলল,
‘আমার মে‌য়েটা ব‌ড়ো ভাগ্য ক‌রে এমন শাশু‌ড়ি পে‌য়ে‌ছেন। নয়‌তো যে সময় মা মে‌য়ের খেয়াল রা‌খে সে সময় শাশু‌ড়ি রাখ‌ছে।’

মো‌মেনা বলল,
‘স‌ত্যি বলতে পুত্রবধূর খেয়াল রাখার দা‌য়িত্ব কিন্তু শশুরবা‌ড়ির লোক‌দের। কারণ বি‌য়ের পর ঘ‌রের বউ এর উপর তারা বে‌শি অধিকার ফলান। কেবল তা-ই না, বাচ্চা জ‌ন্মের পর বাবা, দাদা, দা‌দি ম‌নে ক‌রেন বাচ্চা তা‌দের রক্ত। বাচ্চার প্র‌তি অধিকার কেবল তা‌দের।

যখন অধিকার বে‌শি খাটান তাহ‌লে দা‌য়িত্বটাও তা‌দের বে‌শি নেওয়া দরকার। কিন্তু তা না ক‌রে, আমা‌দের দে‌শের শাশু‌ড়িরা ঘ‌রের বউ প্রেগ‌নেন্ট হ‌লে তা‌কে বা‌পের বা‌ড়ি পা‌ঠি‌য়ে দেয়। তারপর বাচ্চা হওয়ার পর, ঘ‌রের বউ যখন সুস্থ হ‌য়ে কাজ করার যোগ্য হয় তখন আনেন। যেন ঘ‌রের বউ কেবল তা‌দের বাচ্চা দেওয়ার আর কাজ করার মে‌শিন।’

শ্রাবণী মুচ‌কি হে‌সে বলল,
‘একটা জি‌নিস খেয়াল ক‌রে‌ছেন আপা, আমরা মে‌য়েরাই মে‌য়েদের ক‌ষ্টের কারণ। ঘ‌রে বউ গি‌য়ে শ্বশুর, দেবর কিংবা স্বামী দ্বারা তেমন কষ্ট পায় না। কষ্ট বে‌শি পায় ননদ আর শাশু‌ড়ি দ্বারা। আবার শাশু‌ড়ি ননদরা ঘ‌রের বউ এর দ্বারা। অথচ এরা সবাই একটু জে‌নে বু‌ঝে চল‌লে সব সম্পর্কগু‌লো ক‌তো সুন্দর থা‌কে।’
‌মো‌মেনা হে‌সে বলল,
‘‌ঠিক বল‌ছেন।’

শ্রাবণী, মো‌মেনা আরও কিছু কথা বলে চ‌লে গেল। কথার ঘুম ভাঙল রাত আটটার দিকে। ঘুম থে‌কে উঠে কাউ‌কে না দে‌খে নিহাদ‌কে ডাকল।
‘‌নিহাদ।’

‌নিহাদ পা‌শের রু‌মে ছিল। ডাক শু‌নে এসে বলল,
‘উঠে‌ছো?’
‘হুম। স্যালাইন কখন শেষ হ‌য়ে‌ছে?’
‘‌কিছুক্ষণ আগে। এখন শরীর কেমন লাগ‌ছে?’
‘একটু ভা‌লো। ত‌বে মাথাটা ঘুরা‌চ্ছে।’
‘‌কিছু খাও ঠিক হ‌য়ে যা‌বে।’
‘হুম। তার আগে আমা‌কে ওয়াশরু‌মে নি‌য়ে চ‌লো। পেট ভারী হ‌য়ে গে‌ছে।’
‘আচ্ছা চ‌লো।’

‌ফ্রেশ হ‌য়ে কথা সাম‌নে আসল। কথা‌কে দে‌খে মো‌মেনা বলল,
‘‌কেমন লাগ‌ছে শরীর?’
‘একটু‌ ভা‌লো। মা, পাতলা খিচু‌রী আচার দি‌য়ে খে‌তে ইচ্ছ‌া কর‌ছে।’
‘আচ্ছা, তুই বস। এক ঘন্টার ম‌ধ্যে খিচুরী রান্না কর‌ছি। ত‌বে এখন কী খা‌বি বল? ফল বা অন্যকিছু খা‌বি?’
‘কী খা‌বো সেটাই ভে‌বে পাচ্ছি না।’

‌নিহাদ ওর মা‌কে বলল,
‘মা, তু‌মি গি‌য়ে খিচুরী রান্না ক‌রো। আমি দেখ‌ছি ও কী খা‌বে।’
মো‌মেনা আচ্ছা বলে চ‌লে গেল। নিহাদ বলল,
‘কথা, পেয়ারা আছে। বিকা‌লে বাবা তোমার জন্য গাছ থে‌কে তাজা পে‌রে নি‌য়ে আস‌ছেন। খা‌বে? কে‌টে দিব?’
‘দাও।’

কথা ক‌য়েক পিচ পেয়ারা বেশ মজা করেই খে‌লো। রা‌তে আমের আচার দি‌য়ে খিচুরীও বেশ পেট পু‌রে খেল, কিন্তু ঘুমা‌নোর আগে ব‌মি ক‌রে সব ভা‌সি‌য়ে দি‌লো। প্রথমবার ‌প্রেগ‌নে‌ন্সি‌তে কথার এতো সমস্যা হয়‌নি। এতো ব‌মিও হয়‌নি। এবার যেমন কিছুই খে‌তে পার‌ছে না, তখন বেশ ভা‌লোই খে‌তে পারত। এবার কথার খুব কষ্ট হ‌চ্ছে। প্রথমবার এতো কষ্ট হয়‌নি।

৫৯!!
বর্ষণ, শ্রাব‌ণের জন্য নতুন বাইক কি‌নে এনে‌ছে। শ্রাবণ অনেক খু‌শি হ‌য়ে বর্ষণ‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে‌ অনেকবার ধন্যবাদ বলল। এই বাইকটা ওর অনেক‌দিন যাবত শখ ছিল, কিন্তু ‌নি‌জের শখ বাবা-মা‌য়ের উপর চা‌পি‌য়ে দি‌তে শ্রাবণ মো‌টেও পছন্দ ক‌রে না। ভে‌বে‌ছিল নি‌জে ইনকাম ক‌রে নিজের শখ পূরণ কর‌বে।

বর্ষণ পূ‌র্বে ব‌লে‌ছিল গ্রাজু‌য়েশ‌নের পর কি‌নে দি‌বে। য‌দিও তখন শ্রাবণ ব‌লে‌ছিল,
‘ভাইয়া, তোমার কষ্ট কর‌তে হ‌বে না।’
‌কিন্তু বর্ষণ ওর এতো ভা‌লোবাসার ‌ছো‌টো ভাই এর সকল শখ পূরণ কর‌তে চায়। সে কার‌ণে বাইকটা কি‌নে দি‌য়ে‌ছে। বর্ষণ বলল,
‌’যা বাইক নি‌য়ে ঘু‌রে আয়। আর এই নে কিছু টাকা বন্ধু‌দের সা‌থে পা‌র্টি ক‌রিস।’
শ্রাবণ লাজুক হে‌সে বলল,
‘ভাইয়া, তূবা‌কে নি‌য়ে যাই?’
বর্ষণ হে‌সে বলল,
‘‌নি‌য়ে যা।’

শ্রাবণ, তূবার কা‌ছে এসে বলল,
‘তৈরি হ‌য়ে নাও। আমরা আমার নতুন বাই‌কে ক‌রে ঘুর‌তে যা‌বো।’
তূবা দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে বলল,
‘তু‌মি ব‌ড়ো হবা কবে?’
‘‌কেন?’

তূবা নি‌জের আটমা‌সের পেটটা দে‌খি‌য়ে বলল,
‘এটা কী?’
শ্রাবণ হে‌সে বলল,
‘আমা‌দের বাবু।’
তূবা হে‌সে বলল,
‘তু‌মি আট মা‌সের প্রেগ‌নেন্ট একটা মে‌য়ে‌কে নি‌য়ে বাই‌কে ঘুরতে চা‌চ্ছো? ভয় করছে না?’
‘ভয় কেন কর‌বে? এর পূর্বেও তো আমার সা‌থে ক‌তো বাই‌কে ঘ‌ুর‌ছো? তখন অবশ্য ভাইয়ার বাইক ছিল। আজ আমার নি‌জের বাইক। আমি বাইক চালা‌নে কত দক্ষ তা তো জানো। বাই‌কে বস‌লে ম‌নে হ‌বে প্লে‌নে বস‌ছো?’

তূবা ‌হে‌সে বলল,
‘থাক এখন না। আগে বাবু আসুক তারপর তিনজন মি‌লে ঘুরব।’
‘‌শিওর?’
‘পাক্কা।’
শ্রাবণ হে‌সে বলল,
‘তাহলে আমি যা‌চ্ছি। তু‌মি কিন্তু সাবধা‌নে থাক‌বে। বাথরু‌মের টাইস আজ‌কে প‌রিষ্কার ক‌রে‌ছি, এখন আর স্লিপ কর‌বে না। তা-ও সাবধা‌নে। দরজা লক ক‌রে থাকবা না। ঠিকম‌তো খে‌য়ে নিও।’
‘তু‌মি কতক্ষ‌ণের জন্য যা‌চ্ছো?’
‘আটটার ম‌ধ্যে চ‌লে আসব।’
‘তাহ‌লে এমনভা‌বে কথা বল‌ছো যেন অনেক‌দি‌নের জন্য যা‌চ্ছো। যাও এখন। ত‌বে বাইক খুব সাবধানে চালাবা।’
‘আচ্ছা।’

শ্রাবণ যে‌তে নি‌লে তূবা পিছু ডাকল। তারপর কা‌ছে এসে শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধরল। শ্রাবণ হে‌সে বলল,
‘কী হ‌য়ে‌ছে?’
‘এম‌নি প্রানটা ছটফট কর‌ছে।’
‘থাক আজ‌কে তাহ‌লে না যাই।’
‘আ‌রে না। যা-ও ত‌বে সাবধা‌নে।’

শ্রাবণ, তূবার কপা‌লে, গা‌লে গভীর চুম‌ু আঁকল। তারপর বলল,
‘তূবা, প্রেগ‌নেন্ট হ‌লে কি মে‌য়ে‌দের চেহারায় সপ্ত আসমা‌নের সে‌ৗন্দর্য নে‌মে আসে?’
‘‌কেন?’
‘তাহ‌লে তু‌মি দিন‌কে দিন পরীর চে‌য়েও সুন্দর কেন হ‌চ্ছে. আমার সবসময় তোমার দি‌কে তা‌কি‌য়ে থাক‌তে ইচ্ছা ক‌রে। তোমা‌কে কা‌ছে পে‌তে ইচ্ছা ক‌রে। কীভা‌বে যে নি‌জে‌কে নিয়ন্ত্রণ ক‌রে আছি, সেটা য‌দি তু‌মি বুঝতা।’

তূবা লাজুক হে‌সে বলল,
‘আর তো কয়টা মাস। তারপর আমি সবসম‌য়ের জন্য তোমার।’
‘আমার তোমা‌র ভা‌লোবাসা চাই, সারাজীবনের, প্র‌তি‌টি মা‌সে, প্রতি‌টি দি‌নে, প্র‌তি‌টি ঘন্টায়, প্র‌তি‌টি মি‌নি‌টে, প্র‌তি‌টি সে‌কে‌ন্ডে, প্র‌তি‌টি মুহূ‌র্তে। তু‌মি আমার স্বপ্ন। যা‌কে আমি সারাজীবন শুধু পে‌তেই চাইব। কখ‌নো হারা‌তে চাইব না।’

তূবা হে‌সে শ্রাব‌ণের মাথা নিচু ক‌রে ওর চো‌খে চুমু আঁকল। অনেকক্ষণ দুজন দুজন‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে ছিল। তারপর শ্রাবণ বিদায় নি‌য়ে চ‌লে গেল।

রাত দশটা,
শ্রাবণ ফির‌ছে না দে‌খে, তূবা টেনশ‌নে শ্রাবণী‌কে বলল,
‘মা, ও এখ‌নো কেন ফির‌ছে না? কল ক‌র‌ছি তা-ও ডুক‌ছে না।’
শ্রাবণীও বেশ বিচ‌লিত হ‌য়ে শ্রাব‌ণের বন্ধু‌দের কল করল।

শ্রাবণ বা‌ড়ি ফিরল রাত তিনটার পর।
ত‌বে বাইক চা‌লি‌য়ে কিংবা হে‌টে নয়। চারজনার কাঁ‌ধে ক‌রে। শ্রাবণ ফিরল লাশবাহী গা‌ড়ি‌তে আর ওর নতুন বাইক ফিরল ভাঙা‌চোরা অবস্থায় মি‌নিট্রা‌কে ক‌রে। প্রাণহীন শ্রাব‌ণের দেহটা‌কে হস‌পিটা‌লের দুজন লো‌কের সা‌থে ব‌য়ে আন‌ছে বর্ষণ আর নিহাদ।

চল‌বে…