#অরণ্যে_রোদন
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৫৩ (অন্তিম পর্ব)
শ্রাবণ বাড়ি ফিরল রাত তিনটার পর।
তবে বাইক চালিয়ে কিংবা হেঁটে নয়। চারজনার কাঁধে করে। শ্রাবণ ফিরল লাশবাহী গাড়িতে আর ওর নতুন বাইক ফিরল ভাঙাচোরা অবস্থায় মিনিট্রাকে করে। প্রাণহীন শ্রাবণের দেহটাকে হসপিটালের দুজন লোকের সাথে কাঁধে বয়ে আনছে বর্ষণ আর নিহাদ। বর্ষণের কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী জিনিসটা ও কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে ভারী কিছু পৃথিবীতে নেই।
একটা ব্রেকহীন ট্রাক, শ্রাবণের নতুন বাইক সহ ওকে পিষে দিয়ে চলে গেল। ট্রাকের লোকটা বেঁচে গেল ঠিকই, কিন্তু শ্রাবণ হারালো প্রাণ আর শ্রাবণের পরিবার হারালো বেঁচে থাকার আনন্দকে।
রাতটা দশটার দিকে দূর্ঘটনা ঘটে। বাইক নিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে সময়ের খেয়াল ছিল না। ফোনটাও চার্জ শেষ হবার কারণে বন্ধ হয়ে গেছিল। পরে শ্রাবণ বাড়ির দিকেই আসছিল, কিন্তু বাড়ি ফিরেও ফেরা হলো না ওর। বাড়ি তো ফিরল, কিন্তু প্রাণহীন।
দূর্ঘটনার পর, ওখানের লোকজন যখন শ্রাবণকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছিল। হেলমেট না পরার কারণে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায়। মৃত্যুটা মূলত তার কারণেই হয়েছে। দূর্ঘটনার পর খুব কষ্টে শ্রাবণ বর্ষণের ফোন নাম্বার বলেছিল।
খুব কষ্টে আটকানো গলায় ওর সাথে থাকা লোকটিকে বলেছিল,
‘ভাই, আমার পরিবারকে বলবেন আমার বউ আর বাচ্চার খেয়াল রাখতে।’
মৃত্যু পূর্বে সবার কথা মনে হলেও, বারবার মনে হচ্ছিল ও না থাকলে তূবার কী হবে? কঠিন সমাজের কঠিন বাস্তবতাকে টেক্কা দিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে তো? কে রক্ষা করবে তূবাকে? কেউতো শ্রাবণের মতো তূবাকে আগলে রাখেনি।
শ্রাবণ বিড়বিড় করে একবার বলেছিল,
‘ভালোবাসি তূবা।’
তারপর আর কিছু বলা হয়নি ওর। প্রাণ পাখিটা উড়ে চলে গেছে দূরে, বহু দূরে, যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না। শ্রাবণ নিজের কথা রেখেছে। মৃত্যু পূর্বেও ও সচেয়ে বেশি তূবার কথাই ভেবেছে। দূর্ঘটনার খবর পেয়ে বর্ষণ, সোহেল হসপিটালে গিয়ে দেখে সব শেষ। আইনি সকল ঝামেলা শেষ করে শ্রাবণকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত তিনটা বেজে গেল।
শ্রাবণী, কথা, নীরাসহ বাকি সবাই হাউমাউ করে কাঁদছে। তূবা শ্রাবণের এ* ক্সি* ডে* ন্ট হবার খবর শোনার পর যে বেহুশ হয়েছে, তারপর হুশ ফিরেনি। তামিমা আর তূবার মেঝচাচি ওর দেখাশুনা করছেন। ডাক্তার এসে দেখে বলেছেন সব ঠিক আছে। হঠাৎ স্বামীর মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরবে।
৫৪!!
শ্রাবণের নিথর দেহের সামনে তূবা বসে আছে। চোখ থেকে ঝরছে না এক ফোটা অশ্রু। মুখ থেকে বের হচ্ছে না কোনো রকম শব্দ। বেশ কয়েকজন মহিলা আকুল হয়ে তূবাকে কাঁদানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু তূবা কাঁদছে না। একটুও কাঁদছে না, এক ফোটা অশ্রু ঝরছে না। তূবা, শ্রাবণের মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে করে ডাকল,
‘শ্রাবণ! শ্রাবণ!’
আজ শ্রাবণ বলবে না কোনো কথা। বহুবার মান অভিমানে কথা বলা বন্ধ ছিল ওদের, কিন্তু আজ থেকে কথা বলা একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। বিচ্ছন্ন হয়ে যাবে সকল সংযোগ। ছিড়ে গেল অদৃশ্য মায়ায় বাঁধা ডোর। আসলে কী মায়ায় বাঁধা ডোর আদৌ ছিড়ে? মৃত্যু নামক শব্দটা কী ভালোবাসার বাঁধন কাটতে পারে? নাকি থেকে যায় কোনো অদৃশ্য টান? হয়তো থাকে। সে কারণেই মানুষ স্মৃতি নিয়ে বাঁচে। কেউ কেউ প্রিয় মানুষটার স্মৃতিকেই বাঁচার অবলম্বন করে নেয়।
শ্রাবণের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তূবা পেটে হাত দিয়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে লাগল। ওর ব্যথার ধরণ দেখে মহিলারা বুঝে গেল ওর লেবার পেইন উঠেছে, সাথে পানিও ভেঙে গেছে, কিন্তু তূবার তো কেবল আটমাসে পড়ছে। ওকে দ্রুত হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। তূবার বাবা, তামিমা, তূবার মেঝ চাচি মিলে ওকে হসপিটাল নিয়ে গেলেন।
এতমাস যাবত তারিক সাহেব মেয়ের সাথে কথা বলেননি। মাত্র কয়েকদিন হলো সব ঠিক হয়েছে, আর এর মধ্যে সব এলোমেলো হয়ে গেল। আর এমনভাবে এলোমেলো হলো যেন আর কখনো ঠিক হবে না। আর যেন সাজিয়ে গুছিয়ে ওঠা যাবে না।
তবুও তারিক সাহেব মেয়েকে সামলানোর চেষ্টা করছেন। মেয়ের এ চরম বিপদে তাকেই তো মেয়ের কাছে থাকতে হবে। কিছুক্ষণ পর শ্রাবণী, কথা আর নিহাদকে পাঠিয়ে দিলেন তূবার কাছে। তূবার কাছে এখন এমন কারও থাকা দরকার যে তূবাকে বুঝে, ওকে সামলাতে পারে। শ্রাবণের পর একমাত্র কথাই সেটা পারবে।
তবে কথা কী আজ নিজের মাঝে আছে? ও-ও তো অসুস্থ। আর যার প্রাণের ছোটো ভাই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে কয়েকঘন্টাও হয়নি সে বোনই বুঝে তার হৃদয়ের জ্বলন। কথাকে, নিহাদ সামলে নিচ্ছে কোনোভাবে। আর নিহাদের বাবা-মা সামলাচ্ছেন কথার পরিবারকে।
শ্রাবণী পাগলের মতো করছে। নিজের সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে শোকে পাগল প্রায়। বর্ষণ পাগলের মতো প্রলাপ করছে আর নিজেকে গালাগাল করছে। কেন ও শ্রাবণকে বাইক কিনে দিলো। এই বাইক ওর ভাইকে কেড়ে নিয়েছে। বর্ষণ রাগে দুঃখে ফেটে পড়ে শ্রাবণের বাইকের কাছে গিয়ে কেরোসিন ঢেলে বাইকটাকে জালিয়ে দিলো। তারপর ঐ আগুনের সামনেই দাঁড়িয়ে রইল। আত্মীয়-স্বজনরা জোর করে ওকে ওখান থেকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল।
আর এদিকে তূবা, মরন যন্ত্রণা সহ্য করার পর আট মাসেই অপরিপক্ক একটা ছেলে বাচ্চার জন্ম দিলো। বাচ্চাটা নরমালেই হলো। কিন্তু জন্মের ঘন্টাখানিক পর সে-ও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মাকে ছেড়ে বাবার কাছে চলে গেল। বাচ্চাটা পরিপূর্ণ হলেও এখনও পৃথিবীতে আসার সময় হয়ে ওঠেনি তার, কিন্তু শ্রাবণের মৃত্যু তূবা বা তূবার শরীর কোনোটাই নিতে পারেনি। ফলাফল সময়ের পূর্বে বাচ্চার ডেলিভারি। আর জন্মের কিছুক্ষণ পরই ছেলেটার মৃত্যু। ডাক্তাররা বাচ্চাটাকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কিছু চেষ্টা বৃথা চেষ্টা। অরণ্যে রোদন।
শ্রাবণের পরিবারের আজ হারানোর দিন। প্রথমে শ্রাবণকে তারপর শ্রাবণের বাচ্চাকে। তূবা এখনও জানে না ওর সন্তানও আর পৃথিবীতে নেই। ওর স্বামীর কাছে চলে গেছে না ফেরার দেশে।
তূবার সবরকম চিকিৎসার পর, ডাক্তার তূবাকে বেডে দিলেন। কথাসহ সবাই তূবাকে দেখতে কেবিনে ঢুকে হতবাক হয়ে গেল। দেখল তূবা সামনে তাকিয়ে কার সাথে যেন হেসে হেসে কথা বলছে, কিন্তু তূবার সামনে কেউ নেই।
তূবা সবাইকে দেখে স্নিগ্ধ হাসল। সদ্য বাচ্চা জন্ম দেওয়া মায়েদের চোখে মুখে থাকে সকালে স্নিগ্ধতা। থাকে রাজ্যের ক্লান্তি। ক্লান্ত চেহারায়ও সৌন্দর্য যেন উপচে পড়ে। ভুবন ভুলানো লালিমা থাকে তাদের চেহারায়। মুগ্ধতায় যেন চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
তেমনই স্নিগ্ধ রূপ নিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে তূবা। কথাকে দেখে হাতের ইশারা কাছে ডাকল। কথা অনেক কষ্টে চোখের জল আটকে ওর কাছে গেল। তূবা বলল,
‘কীরে এত লেইট করলি কেন? দেখ তোর ভাইর অবস্থা আমার ছেলেটাকে সেই কখন থেকে কোলে নিয়ে বসে আছে, আমার কোলে একটুও দিচ্ছে না। ওকে কিছু বল? বাবুকে আমার কোলে দিতে বল, কথা। দাও তো শ্রাবণ, ছেলেকে আমার কোলে দাও।’
কথা বিস্ময়ে চারপাশে তাকাল। কোথায় শ্রাবণ? কোথায় ওদের ছেলে? তূবা আবার বলল,
‘ছেলেটার চেহারা দেখ, কথা? ঠিক তোর ভাইর মতো হয়েছে। মনে হচ্ছে ছোট্ট শ্রাবণ। বাবা ছেলেকে কী সুন্দর লাগছে দেখ? ইশ! আমার তো চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। তুই আয়াতুল কুরসি আর চারকুল পড়ে ওদের ফুঁ দিয়ে দে তো। নয়তো বাকিদের ছাড় আমারই নজর লেগে যাবে। তাড়াতাড়ি দে।’
তূবার কথা শুনে সবাই মুখে কিছু না বললেও চেহারায় ফুটে উঠা বিস্ময় আটকাতে পারল না।
৬০!!
আজ কথার একটি ছেলে বাবু হলো। শ্রাবণ আর ওর ছেলের মৃত্যুর পর কথাদের পরিবারে এটাই খুশির সংবাদ। সবাই আনন্দে আত্মহারা হলেও শ্রাবণের শূণ্যতা প্রতি মুহূর্তে সবাইকে বুঝিয়ে দেয়, তাদের পরিবার শ্রাবণকে ছাড়া কতটা অপূর্ণ, শূণ্য।
সবাই বুঝতে পারে শ্রাবণ নামের সুদর্শন, চঞ্চল, দুষ্টু ছেলেটা তাদের জীবনে কতটা জুড়ে ছিল। তাদের অস্তিত্বে মিশে ছিল। ওর চাঞ্চল্য প্রতি মুহূর্তে সবার চোখে ভাসে। শ্রাবণের কাছের দূরে কোনো একটা মানুষও ওকে ভুলতে পারেনি। এমন একটা মুহূর্ত নেই যখন শ্রাবণকে তাদের মনে পড়েনি। শ্রাবণ মানুষটাই এমন ছিল। যার জীবনে গেছে তার কাছে নিজের ছাপ ফেলে গেছে। ভালোবাসার ছাপ, ভালোলাগার ছাপ, দায়িত্বের ছাপ, সততা আর প্রাণোচ্ছলতার ছাপ।
ওর শূণ্যতা কেউ পূরণ করতে পারবে না। কেউ না। তবুও সময় কিংবা পৃথিবী কোনোটাই থেমে থাকে না। চলতে থাকে আপন গতিতে। বইতে থাকে নিজের সুরে।
৬১!!
কথা সুস্থ হবার পর বাচ্চা নিয়ে ওদের বাড়িতে বেড়াতে আসল। কথা বাড়ি এসেই প্রথমে তূবার সাথে দেখা করতে শ্রাবণের রুমে গেল। কথা রুমে ঢুকে দেখে, তূবা একা একা এমন ভঙ্গিতে কথা বলছে, যেন শ্রাবণ ওর রুমে, ওর সামনে বসা।
কথাকে দেখে তূবা মৃদু হেসে বলল,
‘এতোদিনে বাচ্চা নিয়ে আসার সময় পেলি? হসপিটালে বা তোদের বাড়িতেও কেউ নিলো না আমাকে। এতোদিনে বুঝি বাচ্চার ছোটো মামা-মামিকে মনে পড়ল? কই দে তো আমার কোলে দে বাচ্চাটাকে।’
কথা ভয়ে ভয়ে বাচ্চাকে তূবার কোলে দিলো। তূবা বাবুটাকে কোলে নিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল,
‘দেখো শ্রাবণ, বাচ্চা তোমার মতো হয়েছে। বাচ্চার চেহারা মামার মতো হওয়া ভালো। ভাগ্য নাকি ভালো হয়। তোমার বোন আমার কথা শুনল না। আমারও ছেলে হলো, ওর-ও ছেলে। মেয়ে হলে আমরা দুজন বেয়ান হয়ে যেতাম।’
কথাটা বলেই তূবা বাচ্চাদের মতো খিলখিল করে হাসল। তারপর বলল,
‘শ্রাবণ, এবার না হেসে, নাও তো বাবুকে কোলে নাও।’
তূবা বাবুকে সামনে ফেলতেই যাচ্ছিল ওমনি নিহাদ, কথা দুজনেই খপ করে ধরে ফেলল।’
কথা চাপা কান্না করছে। তূবা বলল,
‘একি অভদ্রতা কথা? এভাবে কেউ বাচ্চা ছিনিয়ে নেয়? দেখ শ্রাবণ মন খারাপ করে বসে আছে। আমার ছেলেও বাচ্চাকে ধরবে বলে হাত পা ছুড়ে কাঁদছে। বাচ্চা, দে দে বলছি।’
নিহাদ কিছু না বলে বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে গেল। তূবার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ও কাউকে জড়িয়ে ধরার ভঙ্গি করে বলল,
‘থাক শ্রাবণ, কেঁদো না। তুমি আমাদের ছেলেকে কোলে নাও। কথার ছেলেকে আমাদের দরকার নেই।’
কথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো কাঁদছে। কাঁদছে ভাইয়ের শোকে, কাঁদছে নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে, প্রিয় বান্ধুবীটাকে কষ্ট পেতে দেখে। কাঁদছে ভাই এর বাচ্চাটার শোকে। এক ঝড় কতগুলো জীবনে উলোট পালোট করে দিলো।
শ্রাবণের আর নিজের সন্তানের পর পর মৃত্যুটা তূবা মেনে নিতে পারেনি। ফলে মানসিকভাবে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে। ও সবসময় মনে করে শ্রাবণ ওর সাথে। কারও সাথে তেমন করে কথা বলে না, কোনো পাগলামিও করে না, শুধু সারাদিন রুমে বসে বসে শ্রাবণের সাথে, ওর বাচ্চার সাথে কথা বলে। কথা বলার ভঙ্গি এমন যেন শ্রাবণ ওর পাশে বসা।
তূবার বাবা মেয়েকে নিতে আসেন প্রতিদিন কিন্তু তাকে দেখলেই তূবা রাগে হিংস্র হয়ে ওঠে। কারণটা কেউ বুঝতে পারে না। কেন তূবা তাকে দেখতে এত উত্তেজিত হয়ে যায়। তূবা কাউকে আঘাত করে না, বরং নিজেকে নিজে আঘাত করে। ও শ্রাবণের রুম থেকে কোথাও যাবে না। কোথাও না। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো এই রুমেই কাটিয়েছে।
এমনকি শ্রাবণের সাথে প্রথম মিলনও এই রুমেই হয়েছিল। তূবা রুমটাকে আকরে ধরে রেখে। এ রুমের প্রতিটা কোণায় ওর আর শ্রাবণের হাজারো স্মৃতি। শ্রাবণের কথা ভেবে, শ্রাবণের পরিবার তূবার সবরকম দায়িত্ব নিয়েছে।
শ্রাবণ-তূবাকে আর তূবা-শ্রাবণকে নিজেদের সবটা দিয়ে শুধু ভালোইবেসেছিল। ওদের চাওয়া ছিল কেবল একে অপরকে ভালোবাসা। সারাজীবনের জন্য কাছে পাওয়া।
প্রকৃতির ভালোবাসা এমনই। যখন দেয় তাকে দুহাত ভরে উজার করে দেয়। যখন নেয় তখন শেষ বিন্দু পর্যন্ত নিয়ে নেয়। শ্রাবণ-তূবা, নিহাদ-কথা, একে অপরকে প্রচণ্ড ভালোবেসে ভালোবাসার আদান প্রদান করেছিল নিজেদের সবটা দিয়ে, কিন্তু প্রকৃতি কথা-নিহাদের ভালোবাসা নিতে চেয়েও ফিরিয়ে দিয়ে গেছে সাথে বোনাস হিসাবে উপরি খুশিও দিয়ে গেছে, কিন্তু তূবা-শ্রাবণকে উজার করা ভালোবাসা দিয়েও আবার নিয়েও গেছে সবটা উজার করে।
শ্রাবণ, তূবা আর ওদের ভালোবাসাকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আগলে রাখতে চেয়েছিল। শ্রাবণের দূর্ঘটনা যেখানে হয়, সেখানের একজন লোক বলেছিল, শ্রাবণ মৃত্যু পূর্বেও বারবার তূবা নামের কাউকে ডাকছিল। এতটা ভালোবেসে তূবাকে আগলে রাখতে চেয়েছিল শ্রাবণ, কিন্তু সবার ভালোবাসাকে আগলে রাখার চেষ্টা সফল হয় না। কিছু চেষ্টা বৃথা হয়। হয় অরণ্যে রোদন।
৬২!!
তূবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে শ্রাবণ। তূবা, শ্রাবণের চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। শ্রাবণ বলল,
‘তূবা!’
‘হ্যাঁ।’
‘ঘুরতে যাবে?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু কোথায়?’
‘কাঁশ ফুলের বিশাল মাঠে। নির্জন বিকালে, বিশাল মাঠে কেবল তুমি আর আমি।’
‘আচ্ছা।’
‘তুমি শাড়ি পরবে, সাদা রঙ আর লাল পাড়ের শাড়ি আর আমি সাদা পাঞ্জাবি পরব।’
‘আচ্ছা।’
‘কাঁশফুলের সাদার মায়ায় আমরা মিশে যাব।’
‘আচ্ছা।’
শ্রাবণ ফিসফিস করে বলল,
‘তোমাকে খুব ভালোবাসবো।’
লাজুক হেসে তূবা বলল,
‘আচ্ছা।’
‘অনেক দুষ্টু আদর করব।’
লজ্জায় লাল হয়ে তূবা নিজের হাত দিয়ে শ্রাবণের চোখ ঢাকল। শ্রাবণ, নিজের চোখ থেকে তূবার হাত সরিয়ে হাতের তালুতে চুমু আঁকল।
এগুলো শ্রাবণের বলা পূর্বের কথা। তূবা কথাগুলো ভেবে কল্পনা করতে লাগল।
বিশাল কাঁশফুলের মাঠে মধ্য খানে দুজন দাঁড়িয়ে আছে। শ’য়ে শ’য়ে কাঁশফুল চিড়ে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে দু’জন। আশে পাশে কেউ নেই। কেবল ওদের ভালোবাসার অনুভূতি ছাড়া এ পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
শ্রাবণ, তূবার কপালে চুমু খেলো। তূবা, শ্রাবণের পায়ের উপর পা তুলে উঠে দাঁড়ালো। গভীর ঘোরে একে অপরকে আলিঙ্গন করল। অতঃপর একে অপরের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে পান করতে লাগল ভালোবাসার অমৃত শুধা। প্রকৃতির মায়ায়, প্রেমের ছাঁয়ায় মিশে যাচ্ছে দু’জন। ওরা কেবল ভালোবেসেছিল, ভালোবাসা চেয়েছিল, একে অপরের সঙ্গ চেয়েছিল সারাজীবন। ভালোবাসতে চেয়েছিল সারাজীবন, কিন্তু প্রকৃতি সবার সব চাওয়া পূরণ করে না। সব চাওয়া পূরণ হতে নেই। সব চেষ্টা সফল হতে নেই। কিছু চেষ্টা বিফলে যায়। যাকে বলে অরণ্যে রোদন।
অরণ্যে রোদন মানে বনে গিয়ে কান্নাকাটি করা। যে কান্না কেউ শোনে না। কেউ বুঝে না। সে কান্না হয় নিষ্ফল ক্রন্দন। ভালোবাসাকে পাবার আবেদন হয় নিস্ফল। তূবা, এখন সারাজীবন শ্রাবণকে পাবার জন্য কাঁদবে, কিন্তু ওর কান্না কি আদৌ কেউ শুনবে? শ্রাবণকে সারা জীবন নিজের করে পাওয়া ওর চেষ্টা, আবেদন কি পূরণ হবে? না! হবে না। কারণ যে চলে যায় সে আর ফিরে আসে না। তাই তূবার কান্না সবসময় অরণ্যে রোদন-ই হবে।
সমাপ্ত